কামাল রাহমান
বাংলা সাহিত্যে পদ্য না গদ্য এগিয়ে-- এরকম একটা বাতিল প্রশ্ন সুবিবেচনা-প্রসূত না হলেও মাঝে মাঝে এক হেঁয়ালির মতো এটা দেখা দেয় অনেকের ভেতর। এটার জবাব সামান্য জটিল। পদ্য যদি এগিয়ে থাকে, প্রায় একশ বছর আগে গীতাঞ্জলির কাব্যরসে মুগ্ধ হয়েছিল বিশ্ববাসী, এর ধারাবাহিকতা কোথায়? গদ্যের প্রশ্নে বলা যায় বাংলা সাহিত্যে বিশ্বমানের অনেক উপন্যাস থাকা সত্ত্বেও কটা উপন্যাস অনূদিত হয়ে বিশ্বের পাঠককূলের হাতে পৌঁছাতে পেরেছে। বিশ্ব সাহিত্যে গীতাঞ্জলি একটা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছিল।
স্থায়ী কোনো আলো ছড়াতে বাংলা পদ্য বা গদ্য কোনোটাই সক্ষম হয়নি। এর একটা কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে বাংলা সাহিত্যের পদ্য ও গদ্য রচয়িতাদের এক অনন্যসাধারণ প্রাদেশিকতা। আরো কিছুটা নির্দিষ্ট করে বললে, আঞ্চলিকতা। সহজ এই বৃত্তটির বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছেন না আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশের জন্য স্বতস্ফূর্ত কোনো প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায় না। ত্রিশের কবিকূলের মধ্যে বাঁধ ভাঙ্গার একটা জোয়ার এসেছিল। কিন্তু অনুকরণ অনুসরণ করে বৃত্তের বাইরে হয়তো বেরিয়ে আসা যায়, এরপর সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য না থাকলে বৃহত্তর পরিসরে এসে স্বাভাবিকভাবে হারিয়ে যায় সকল উদ্যোগ। ত্রিশের কবিদের আরেকটা প্রচেষ্টা ছিল রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে আসা, যেটাতে ভালোভাবেই সফল হন তাঁরা। কিন্তু ওখান থেকে বেরিয়ে ঐ প্রাদেশিকতার ভেতরই রয়ে যান। হাংরি, স্যাড, কিংবা হালের উত্তরাধুনিকতা প্রভৃতি আন্দোলনও প্রাদেশিকতার বৃত্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি। বৈশ্বিক মানদণ্ডে নিয়ে যেতে পারেনি তাঁদের রচনাকে। এমনকি বাংলা সাহিত্যেও স্থায়ী কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এসব উদ্যোগ বা আন্দোলন, পদ্য অথবা গদ্য কোনোটাতেই। পরবর্তীতে যা হয়ে এসেছে এখন পর্যন্ত-- আত্মসুখে বিভোর হয়ে থাকা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশের জন্য সুদূরপ্রসারী কোনো কল্পনা করা দূরে থাক প্রাদেশিক পরিসরটিও হাতে নেই এখন। শ
কোনো একটা সাহিত্যকর্মের দোষগুণ বোঝার জন্য রচয়িতাকে যেতে হয় সাহিত্যরচনা-অনভিজ্ঞ মানুষের কাছে। প্রকৃত পাঠকের কাছে। যারা কদাচিৎ নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন, অথবা করতে পারেন। অথচ পঠিত বিষয়ে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেন পুরোপুরি অন্তর দিয়ে। লেখকের সর্বজনীন হয়ে ওঠার জন্য যথাযোগ্য ও প্রমাণিত এক পন্থা এটা। সমালোচকেরা ও অন্ধ অনুকারকেরা প্রায়শ ভ্রান্তি সৃষ্টি করে। পাঠকের ভেতর বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।
প্রকৃত লেখকের জন্য নিঃসঙ্গতা একটা জরুরী বিষয়। তার মূলশক্তি হচ্ছে-- আত্মশক্তি। নিজের ভেতর ডুবে থাকা। আহরিত সঞ্চয় থেকে ও অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে প্রকাশ করার বিষয়গুলো ঠিকভাবে পৃথক করা ও সুন্দরভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা। গোর্কির মতো শক্তিমান ও সর্বকালের সেরা পাঠকপ্রিয় ও উঁচুমানসম্পন্ন লেখক পৃথিবীতে আছেন কজন! তিনিও নিজেকে অনেক সময় নিঃসঙ্গ ভাবতেন। নিজের সমাজ ও পাঠক নিয়ে প্রচণ্ড হতাশা ব্যক্ত করতেন। নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করতেন। এটা হচ্ছে লেখকের নিয়তি। প্রয়োজনীয় শিক্ষা, সচেতনতা ও বাস্তবতাবোধ, প্রথম-প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা, অন্তরগত প্রেরণা, জাগতিক শৃঙ্খলা ও পারক্যবোধ, প্রভৃতি অর্জণের জন্য যে আর্থিক ও মানসিক সঙ্গতি থাকা উচিত তা অনেকের নেই। ফলে অক্ষম প্রচেষ্টা হিসেবে অগ্রহণযোগ্য বিকল্পগুলোই বেছে নিতে বাধ্য হতে হয়। এটার কারণও অসুস্থ সমাজব্যবস্থার ভেতরই রয়েছে। নষ্ট সময়ে নষ্টদের প্রাধান্য থাকাটাই স্বাভাবিক।
মিথের পুন-নির্মাণ, কিংবা কোনো কিংবদন্তি হয়ে ওঠা চরিত্রকে মিথের মতো করে উপস্থাপন, অথবা রূপকথার কোনো চরিত্র অথবা ঘটনার পুন-উপস্থাপন একটু কঠিন ও চর্চাসাপেক্ষ বৈকি। রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো করেই নিজেকে রচনা করেছেন। এখন যদি কেউ তাঁর রচনার বিষয় ও বাণী আধুনিক রূপে বা সমসাময়িক বিভায় বদলাতে চান তাহলে তা নতুন সৃষ্টি হতে পারে, রবীন্দ্র-রচনা আর থাকবে না ওটা। রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য তাঁর নিজস্বতায়। শেক্সপীয়্যার মঞ্চে এখন শেক্সপীয়রীয় মূল ঢঙের পাশাপাশি আধুনিক উপস্থাপন মঞ্চস্থ হচ্ছে। এটা নব্য-শেক্সপীয়রীয়। ক্ল্যাসিক শেক্সপীয়্যার এখনো রয়ে গেছে। দুটোরই দর্শক রয়েছে। মিথেরও রয়েছে এক উচ্চাঙ্গের সৌন্দর্য। এর পুন-নির্মাণ কোনোভাবেই এর সৌন্দর্য ব্যহত করে হতে পারে না। সাধু ভাষায় লিখে ও ঐসব বিষয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে অথবা ভাষাটাকে দুমড়ে-মুচড়ে বিকৃত করে আপাতত আত্মশ্লাঘা বোধ করতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু কালের গ্রাসে সেসব আবর্জনায় পরিণত হয়। মিথের পুন-নির্মাণ ও রূপকথার পুন-উপস্থাপন বিষয়ে কুশলী হওয়া লেখকের জন্য একটা পূর্বশর্ত। নয়তো বিষয়টাকে নষ্ট করে ফেলার সম্ভাবনা থেকে যায়।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা পর্বের শুরু বিশ্ব সাহিত্যের এ পর্ব হতে বেশি দেরিতে নয়। পদ্যে ঈশ্বর গুপ্ত ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং গদ্যে প্যারীচাঁদ মিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে এর শুভ-উত্থান। ঐ অবস্থা থেকে গত দেড়শ’ বছরে বিশ্ব-সাহিত্যের বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চার ব্যবধান ও বর্তমান উচ্চাবস্থা অনেকটা অকল্পনীয়। ব্যপ্তি ও গভীরতা, উভয়ার্থে। বাংলা সাহিত্যের উত্তরণও অসামান্য। অনেক উঁচু মানের পদ্য ও গদ্য রচিত হয়েছে। প্রণম্য সাহিত্যিকেরা গুণে ও মানে বাংলা সাহিত্যের কলেবর বৃদ্ধি করেছেন। সর্ব-ভারতীয় ও ইউরোপীয় মিথের ব্যবহার হয়েছে অসংখ্যভাবে। কিন্তু মেনে নিতে কষ্ট হয় যে এর প্রায় সবই বিষয় ও আঙ্গিকে প্রাদেশিক।
বাংলা অঞ্চলের মিশ্র এই সমাজটির ভ্রুণ সঞ্চালিত হয়েছিল ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালীন সময়ে। এ অঞ্চলে রাজা তখন লক্ষণ সেন। কিন্তু ঐ রাজা প্রকৃতপক্ষে জনগণের রাজা ছিলেন না। প্রজাপালনও তাঁর ধর্ম ছিল না। ইতিহাস তাই বলে। রাঢ়, বরেন্দ্র, সমতট, তাম্রলিপ্ত, উৎকল, হরিকেল প্রভৃতি অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত, মহাসামন্ত প্রভুদের পীড়নে শত-সহস্র জনপদ হয়ে উঠেছিল নরকতুল্য। মুষ্টিমেয় কিছু ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য সম্প্রদায়ের সুবিধেভোগীরা সমাজের সকল সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা লুণ্ঠন করছিল। অশীতিপর বৃদ্ধ রাজার রাজকার্য পরিচালনা করার যোগ্যতাই ছিল না, রাজ্য রক্ষা করা দূরে থাক। ফলে মুষ্টিমেয় ভাগ্যান্বেষী সৈনিকের ছলনার স্বীকার হতে হয়েছিল তাঁকে। রাজ্যের বিশাল সেনাবাহিনীর যাবতীয় খরচাদি যদিও যোগাতে হয়েছে দরিদ্র জনগনকে কিন্তু ঐ হাতি-ঘোড়াবাহিনীও চরম মুহূর্তে কোনো কাজে আসেনি। পলায়নের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে নিয়তি মেনে নিতে হয় রাজাকে।
ইউরোপীয় বন্দুকের নল অনুসরণ করে এক সময় আফ্রিকায় বাইবেলধারী পাদ্রীর দল ছড়িয়ে পড়েছিল। তারও আগে তুর্কি তলোয়ারের ছত্রছায়ায় মুসলমান ধর্মানুসারী একদল সাধুপুরুষ এসেছিল এদেশে। অসাধারণ এই জনপদে তাঁদের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দরবেশ নামে। কীর্তিমান এসব সাধুপুরুষদের মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে অন্তজ শ্রেণির লক্ষ লক্ষ মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এটাকে ধর্মান্তর বলাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রান্তবর্তী, সদানিপিষ্ট ও অচ্ছুত ঐ জনগণের ধর্মই বা কি ছিল তখন? নতুন ধর্মের ছায়াতলে অস্পৃশ্য ঐ মানুষগুলো অন্তত মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এবং পেয়েছিল কিছুটা নিরাপত্তা ও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাত থেকে নিষ্কৃতি। ধর্মান্তরের ফলে হিন্দু ব্রাহ্মণেরা ফতোয়া দিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত ওদের। কিন্তু তাতেও ধর্মান্তরের ঐ স্রোত ঠেকাতে পারেনি ওরা। হাজার হাজার বছরের নিষ্পেষণের প্রতিশোধ ব্রাত্যজনেরা নিয়েছিল একেবারে অজানা এক ধর্মের প্রতি আস্থা স্থাপন করে। নিজেদের জীবিকার সংস্থান তাদের জন্য কোনো সমস্যা ছিল না। এ জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে হতো না। বরং ওদের উপরই নির্ভর করতো রাজা থেকে শুরু করে নিুতম শোষক ব্রাহ্মণ প্রাণীটি পর্যন্ত। সমাজ পরিবর্তনের ঐ জটিল সময়টাকে উপন্যাসের বিষয়ভূক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শওকত আলী। অভাবিত ঐ প্রদোষকালে এ অঞ্চলে কোনো আদর্শ নায়কের উত্থান ঘটেনি। ফলে উপন্যাসটিতেও কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র লক্ষ্য করা যায় না। চাতুর্য ও প্রতারণামূলকভাবে অশ্ব-বিক্রেতার ভূমিকা নিয়ে লক্ষণ সেনের প্রাসাদে যেভাবে প্রবেশ করেছিল বখতিয়ার খিলজি তাতে খলনায়ক হিসেবে তাকে উপস্থাপন করা যেতো। উপন্যাসে তার উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্যভাবে নেই। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে এক মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ, ও ঘটনাক্রমে তার প্রেমিকা স্বামী-পরিত্যক্তা লীলাবতী, বসন্তদাস ও প্রোষিতভতর্িৃকা মায়াবতী, অক্ষম ও নিয়তিনির্ভর পুরোহিত শুদ্ধানন্দ, স্থির-প্রতিজ্ঞ অথচ করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ বৌদ্ধভিক্ষু জ্ঞানানন্দ, তরুণ ও নিষ্ঠাবান ভিক্ষু নিরঞ্জন, ক্রুর চরিত্র অভিমন্যু দাস, অত্যাচারী মহাসামন্ত হরিসেন, মুসলমান বৃদ্ধ দরবেশ, এরকম ডজনখানেক চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অসাধারণ বিষয়, সান্ধ্যকালীন ভাষা, ঔপন্যাসিকের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও উপন্যাসটি প্রাদেশিকই রয়ে গেছে।
কোনো একটা উপন্যাসের কাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে পাঠকের আবেগ ও মনশ্চেতনা, নিয়ে যায় উৎসে, সৃষ্টির গভীরে। এটার আবেদন অনেকটা আদি-স্তরের। একটা জাতির ভ্রুণ গড়ে ওঠার যে কাহিনী তার দাবী আকাশচূম্বী। এ উপন্যাসের যে পাঠক সে সত্যসন্ধানী, মূলাশ্রয়ী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, তাকে ফাঁকি দেয়া কঠিন। ঔপন্যাসিক যদিও তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা উপন্যাসের শেষে ব্যক্ত করেছেন, পাঠককে সন্তুষ্ট করে না তা। ইতিহাস ও ইতিহাসের কথা এক না। ঔপন্যাসিক শুধু ওদুটোকে দেখেই ক্ষান্ত থাকেন না, অন্য দিকটাও দেখেন ও দেখাতে চেষ্টা করেন। পর্দার অন্তরালের ঐসব দৃশ্য দেখানোর অনেক সুযোগ উপন্যাসের বিষয়ের ভেতর ছিল। হয়তো সম্প্রদায়ের ভেতর নিজের অবস্থানের কারণে সাম্প্রদায়িক ঐ বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল নিজের সম্প্রদায়ের ঐ বিষয়গুলো ইতিহাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে আলোয় নিয়ে আসা। অন্য সম্প্রদায়ের কোনো ঔপন্যাসিকের পক্ষে এটা হয়তো কঠিন। একজন নজরুলের পক্ষে সম্ভব মসজিদের বিপক্ষে কিছু বলার মতো সৎ সাহস দেখানো। অন্য সম্প্রদায়ের কেউ ওকথা বললে দাঙ্গা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উপন্যাসের শুরু দীর্ঘ পথের যাত্রা-ক্লান্ত এক মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের মূর্ছা যাওয়া থেকে জীবনাবস্থা ফিরে পাওয়ার বর্ণনা দিয়ে। আত্রেয়ী তীরবাসী শ্যামাঙ্গ মন্দিরগাত্রের মৃৎফলক নির্মাণের জন্য গিয়েছিল বিল্বগ্রামে। সেখানে ওর স্বাধীন শিল্পপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর মৃৎফলকগুলো প্রত্যাখ্যাত হয় সামন্তপ্রভু সুধীমিত্র কর্তৃক, ভুলুন্ঠিত হয় শ্যামাঙ্গের জীবনসাধনা, শিল্পকুশলতা। গুরু বাসুদেব মন্দির হতে বহিষ্কৃত করেন তাকে। বিতাড়িত শ্যামাঙ্গ বাড়ি ফেরার পথে যে জনপদ অতিক্রম করে তা ত্রিশূল আক্রমণে বিপর্যস্ত। একদিকে আগ্রাসী মুসলমানদের সংহার ও ধ্বংসযজ্ঞ, ‘শুকদেব বললেন, যে লোকটির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিলো, সে ছিলো ধর্মপুরোহিত, এতো সুমধুর ব্যবহার কখনও এতদ্দেশীয় কোনো পুরোহিতের হতে পারে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এমন বিনয়ী, এমন সৌম্য ও পবিত্রদর্শন যে কি বলবো তোমাকে। ওদের মধুর ব্যবহার যেমন সত্য, তেমনি সত্য হত্যা এবং লুণ্ঠনও। সন্ধান নিয়ে দেখো, মগধ দেশের জনপদগুলির কি অবস্থা হয়েছে। সহস্র লোকের প্রাণ গেছে এই যবনদের অসির আঘাতে। এদেরই আরেক রূপ যে যমদূতাকৃতি সে কথা ভুললে কিন্তু অপরাধ হবে।’ আরেকদিকে রাজার অনুচর, ‘তারপর রোষকষায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বললো, অরে সদ্ধর্মী কীট, তোর গুপ্তচর বৃত্তির কি পরিণতি হয় এখনই দেখতে পাবি। এখনও সময় আছে, বল, কি হেতু তোর এই হাটে আগমন? পিপ্পলী হাটে তোরাই কি মহাসামন্ত হরিসেনের পরিজনদের উপর আক্রমণ করিসনি? তোরাই কি মূল দ্রোহকারী নোস?’ এর বাইরে রয়েছে স্বজাতির মধ্যে মিশে থাকা সর্পচরিত্র অভিমন্যু দাস ‘যখন আলিঙ্গনের জন্য ব্যগ্র দু’বাহু প্রসারিত করতে চায়, তখনও সে না বলে। এবং শেষে যখন নীবিবন্ধ স্পর্শ করে অভিমন্যু, তখন লীলাবতী চিৎকার করে ওঠে। কেন, কেন? বিভ্রান্ত বিহ্বল দৃষ্টি এবং স্খলিত কণ্ঠস্বর অভিমন্যুর। সে তখনও জানতে চায়, তাহলে আমার অনুমান সত্য-- বলো? প্রথমে সেই ব্রাহ্মণ কিশোরটি, তাই না? সেই উপবীতধারী তরুণ গৌরোজ্জ্বল ব্রাহ্মণ বালক তাই না? অতঃপর পিতার প্রভুপুত্রটি তাই না? নাকি প্রতিবেশী কেউ?’ এসবের কোনো প্রতিবিধান নেই, এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী ভিক্ষুদের একাংশ চায় অত্যাচারী এক শত্র“ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের অত্যাচার হতে রক্ষা পেতে অপর শত্র“ মুসলমানের সঙ্গে হাত মেলাতে, অন্য অংশ চায় প্রতিরোধ করতে। কিন্তু কীভাবে এই প্রতিরোধ, তা জানা নেই ওদের। এই ফাঁকে সনাতনধর্মী নিগৃহীত জনগোষ্ঠি কোনো কূলকিনারা না পেয়ে আপাত নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের আশ্রয় নেয়। এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা ‘হরকান্ত যোগী সিদ্ধপাকে দেখছিলেন। শ্মশ্র“মণ্ডিত মুখাবয়ব হলেও চক্ষু দুটি স্মরণ করতে পারেন। একদা ক্ষেত্রজীবী গৃহস্থ ছিলো এই যোগী পুরুষ। একমাত্র সন্তান পুত্রটিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। পুত্রটি কায়স্থ পল্লীতে খেলতে যেতো-- এবং ঐ সময়ই কায়স্থ পল্লীর বালকেরা তাকে বর্ষায় স্ফীত পুনর্ভবার প্রবল স্রোতে নিক্ষেপ করে। ঐ ঘটনায় দীননাথ উন্মাদপ্রায় হয়ে যায়, স্ত্রী কমলা উন্মাদিনী হয়ে পুনর্ভবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে-- নাহ, সেই ঘটনা স্মরণ করতেও প্রাণ শিহরিত হয়। হরকান্তের রুগ্ন দেহে সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি এতোকাল পর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। তাঁর অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলো। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট আরম্ভ হলো।’ এই ছিল ঐ সময়ের সমাজের অবস্থা। দুই পর্বে বিভক্ত উপন্যাসের ‘প্রদোষকালে প্রাকৃতজন’ পর্ব শেষ হয় এভাবে ‘বরেন্দ্রভূমির জনপদগুলিতে তখন ঐভাবেই প্রাণ বধ হচ্ছে, গৃহ লুণ্ঠিত হচ্ছে, পল্লী প্রজ্বলিত হচ্ছে। রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে পরম ভট্টারক মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে সগৌরবে আসীন হলেও তাঁর মহাসামন্ত ও সামন্তবর্গ প্রজাপালনের কোনো কাজ করে না। বরঞ্চ তারা বিলাসব্যসন ও প্রজাপীড়নে অধিক মত্ত। ওদিকে যবন জাতির হাতে মহাকালের ডমরুতে অনাহত ধ্বনি বেজে উঠেছে। কেউ জানে না, ভবিষ্যতে কী আছে। বড় ধূসর ঐ প্রদোষকাল!’
দ্বিতীয় পর্ব ‘দুষ্কালের দিবানিশি’র কেন্দ্রে বসন্তদাসের অবস্থান। মনের ভেতর তার স্ত্রী মায়াবতীর মুখ। রক্তের ভেতর ধ্বংসোন্মুখ দেশ ‘মানুষের জীবন অতিষ্ঠ এবং অসহ্য। সর্বত্রই দেখেছি উচ্চশ্রেণীর লোকদের হাতে নিুশ্রেণীর লোকদের নিপীড়ন হবেই-- প্রত্যক্ষে হোক আর পরোক্ষে হোক। লুণ্ঠন, হত্যা, দস্যুবৃত্তি-- এগুলি প্রায় নিত্যসঙ্গী মানুষের জীবনে। রাজপাদোপজীবী যাঁরা, তাঁরা কিছুই করেন না-- সম্ভোগ ও ব্যসনে তাঁদের আসক্তি সীমাহীন। প্রজারা তাঁদের কাছে যেন পীড়নের পাত্র-- পালনের নয়। ছিন্নমূল ক্ষুদ্রতরুর মতোই তাদের অবস্থা। ফলে যখনই দেখি যবনেরা আসে, তখনই তারা হয় পলায়ন করে, নতুবা বশ্যতা স্বীকার করে-- কখনই যুদ্ধ করে না। যবন শক্তি ভিন্নদেশীয়। তারা আজ আছে কাল নেই-- এমতাবস্থায় এই-ই মাহেন্দ্রক্ষণ, রাষ্ট্রশক্তি একেবারে শতধা বিচ্ছিন্ন-- এই ক্ষয়িত রাষ্ট্রশক্তিকে আঘাত করলেই ধসে পড়বে।’ মাদকসেবী, প্রমত্ত একদল নগরদুবৃত্ত কর্তৃক লুঠ করে নেয়া লীলাবতী মুসলমান শিবিরে যেমন খানিকটা নিরাপত্তা পায়, তেমনি টেনে নিতে চায় প্রেমিক শ্যামাঙ্গকে ‘লীলা নিজের হাত মুক্ত করে নেয়। বলে, আমি তোমার পুত্তলিটি নই শ্যামাঙ্গ, আমি জীবন্ত নারী-- আমার স্বামী চাই, সংসার চাই, সন্তান চাই,-- ঐগুলিই আমার ধর্ম, অন্য ধর্ম আমি জানি না-- আমাকে তুমি প্রকাশ্যে বিবাহ করো।’ কিন্তু শ্যামাঙ্গের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এ আমন্ত্রণ। অন্তরে সে শিল্পী। জীবনের বিনিময়েও তার স্বাধীন সত্তাকে বিসর্জণ দিতে পারে না। মুসলমান সৈন্যের বর্শাবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হয় তাকে। সমাজের পুরীষকীট অভিমন্যু আশা করে লীলাবতী ওর ভোগে আসবে এবার। কিন্তু তা যে হয়নি, ইতিহাস সে কথা বলে। হয় আত্মঘাতী হয়েছে লীলাবতী, অথবা কোনো সৈনিকের বহুগামীতার সঙ্গী, গনিমতের মাল।
উপন্যাসের এ রকম সমাপ্তি পাঠকের ভাবনাকে চূড়ান্তে কোথাও পৌঁছে দেয় না। উপন্যাস তো ছোট গল্প নয় যে ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’ অবস্থা পাঠকের ভেতর থেকে যাবে। অতৃপ্ততা সত্তেও বাংলাভাষাভাষী পাঠকের জন্য অসাধারণ এ উপন্যাসটি। কিন্তু এটা যখন বিশ্বের অন্য অংশের পাঠকের কাছে অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছাবে তখন এটার কোন দিকটা বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করবে ঐ পাঠককে। বিষয়, ভাষা, শৈলী, সময়, অথবা কি? আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রবেশের জন্য উপন্যাসের এসব দিকগুলো বিবেচনা করতে হয়। পাশাপাশি দেখা যেতে পারে চিনুয়া এচেবের ‘থিংস ফল এপার্ট’ উপন্যাসের বিষয় ও ইতিহাস। কি আছে ঐ উপন্যাসে যা এত বিপুলভাবে আন্তর্জাতিক পাঠক আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে! ওটাও একটা জাতির দিনবদলের সময়ের দলিল। নাইজেরিয়ার প্রাচীন সমাজ, বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত মানুষজনের প্রথাগত লৌকিক বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কৃতি, টোটেম, উপাসনা প্রভৃতি পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত আধুনিক সংস্কৃতির কারণে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, আদিম আফ্রিকার সনাতন মূল্যবোধ ও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য কীভাবে ভুলুণ্ঠিত হয়েছে, বিলুপ্তির পথ ধরেছে, প্রাচীন ও নতুনের সংঘাত, প্রভৃতি বিষয়গুলো নিরাবেগী দৃষ্টিতে উপস্থাপন করা হয়েছে উপন্যাসটিতে। এসবের ফলশ্রুতিতে প্রাচীন আফ্রিকার এক ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা পেয়েছে উপন্যাসটি। ব্যাপকভাবে বিশ্বে আলোড়ণ তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটার কেন্দ্রীয় চরিত্র ওকোনকো পাঠকের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের প্রতি তার অকৃত্রিম বিশ্বাস, ঐতিহ্যবিনাশী ভিনদেশী সংস্কৃতির বিপক্ষে আমৃত্যু অবস্থান, কঠিন জীবন সংগ্রাম, ও হার-না-মানা প্রকৃতি তাকে প্রতিষ্ঠা করেছে একজন আফ্রিকান বীর হিসেবে। কিন্তু প্রদোষে প্রাকৃতজনের কোন চরিত্রটাকে বিশেষভাবে দাঁড় করানো হয়েছে? বিপুল সম্ভাবনা ছিল শ্যামাঙ্গ চরিত্রটির। কিন্তু সেটা সম্ভাবনাই রয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের সাহিত্যের। বৈশ্বিক চেতনা থেকে উপন্যাস লেখা সম্ভবত এখনো শুরু হয়নি। হয়তো অনেক অনেক মহাবীর নেই আমাদের মধ্যে, যাদের চরিত্র নির্ভর করে গড়ে উঠতে পারে একটা মহান উপন্যাস, কিন্তু অসংখ্য বীর তো রয়েছে! একজন অতি-সাধারণ মানুষের ভেতরও থাকতে পারে বীরের চরিত্র। চিনুয়ার ওকোনকো কোনো স্পার্টাকাস নয়। সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসা চরিত্র। কিন্ত চিনুয়ার কলম তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যকে হয়তো আরো অনেকদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে বাংলার বীরদের খুঁজে পেতে! বলা হয়ে থাকে পাঠকের চিন্তা মাথায় রেখে কিছু লেখা সম্ভব না। কথাটা আংশিক সত্যি। লেখার পর পাঠকের চিন্তা মাথায় আনতে হয়। এবং সেভাবে ওটাকে ঢেলে সাজাতে হয়। দুর্ভাগ্য, যারা বাংলায় লেখালেখি করেন, প্রথাগত অথবা অপ্রথাগত, কোনো হিসাবই এখানে মিলানো যায় না। কোনো একটা বই প্রথমে নিজের ভাষার পাঠকের কাছে গৃহীত হতে হয়। তারপর হয়তো আন্তর্জাতিক পাঠকের কথা ভাবা যায়। আবার নিজের ভাষায়ও আন্তর্জাতিক রুচির পাঠক গড়ে ওঠা জরুরী। এটা দুভাবেই সত্যি, এই পাঠক সৃষ্টির দায় কিছুটা লেখকেরও। নিতান্তই দুর্ভাগ্য, এদেশে প্রকাশকের ভূমিকা খুব সামান্য, অথবা কিছুই নেই, এক বানিজ্য ছাড়া। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটিরও দরিদ্র জনগণের কর ও ভিক্ষালব্ধ অর্থ আত্মসাতের বাইরে করণীয় খুব কমই আছে।
কথাসাহিত্য-রচয়িতাদের অনেকের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে রচিত প্রবন্ধ/নিবন্ধ ও গল্প তাদের উপন্যাসের বিজ্ঞাপন হিসাবে কাজ করে। যার গল্পে আকর্ষণ রয়েছে তার উপন্যাসের প্রতি পাঠক আগ্রহী হয় বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প তাঁর উপন্যাস থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকে। বিষয়, ভাষা, প্রকরণ ও বুনোটের মুন্সিয়ানার দিক থেকে। শওকত আলীর গল্প সে-তুলনায় তাঁর উপন্যাস থেকে পিছিয়ে। হয়তো এ কারণে তাঁর উপন্যাসগুলো সেভাবে আলোচিত নয়। আশ্চর্য ব্যতিক্রম, প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি! এটার চূড়াস্পর্শী মানের জন্যই নয়, পাঠকপ্রিয়তার জন্যও বটে। প্রথম প্রকাশের পঁচিশ বছর অতিক্রম করেছে, এবং অষ্টম মুদ্রণ হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর পর অন্য কোনো কথা সাহিত্যিকের কোনো বইয়ের এতো সংখ্যক মুদ্রণ কমই হয়েছে।
চির-সংগ্রামী এই জনপদের ইতিহাসের আরেক ক্রান্তিকালীন সময়ের নিুবর্গীয় সমাজ নিয়ে লেখা সেলিনা হোসেনের উপন্যাস নীল ময়ূরের যৌবন। এ উপন্যাসটি ইতিহাসনির্ভর নয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নিদর্শন চর্যাপদের উপর ভিত্তি করে রচিত। চর্যাপদ রচনার সময়কে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী ধরা হলে ওখানে রয়েছে ঐ সময়ের প্রান্তিক মানুষের অসাধারণ এক সমাজচিত্র। বৌদ্ধ ধর্মানুসারী পাল রাজাদের পতনকাল আর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজাদের উত্থানকাল। বৌদ্ধ ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে তার আত্মশক্তি। সুযোগ গ্রহণ করছে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। নীল ময়ূরের যৌবন উপন্যাসে সেলিনা হোসেন একটা সমাজের আদি স্তরের মিথ পুন-নির্মাণই শুধু করেননি, এক সূত্রে গেঁথেও দিয়েছেন। বিষয় হিসেবে বাংলা সাহিত্যে চিরদিনই থেকে যাবে এটার স্বাক্ষর। ছোট্ট এ উপন্যাসটি সমাজের ঐ সব অসঙ্গতিগুলো আবার নতুন করে উপস্থাপন করেছে পাঠকের সামনে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কাহ্নুপাদ, রাজা বুদ্ধমিত্রের প্রাসাদে পাখা দোলানোর কাজ করে। ক্লান্তিকর পরিশ্রমে নিজে ঘর্মাক্ত হয়েও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখাটানার কাজ করে রাজসভা শীতল রাখে। রাজকর্মচারী হওয়ার সুবাদে যদিও কিছুটা সম্মান আছে সমাজের সাধারণ মানুষের ভেতর, কিন্তু সেটা এক ধরনের আত্মপীড়নের মতো। কাহ্নুর মনের জ্বালা বেরিয়ে আসে গানের সুর হয়ে, ‘আলি এঁ কালি এঁ বাটে রুন্দেলা। তা দেখি কাহ্নু বিমনা ভইলা।।’ যে রাজার অধীনে কাজ করে কাহ্নু, সেখানে নৃত্যগীতের আসরও হয়। কিন্তু কাহ্নুর গীত প্রবেশাধিকার পায় না সেখানে। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর সেখানে গান গাওয়ার অনুমতি পেলেও রাজমন্ত্রীর আশানুরূপ গীত গাইতে পারে না কাহ্নু। তাকে বলা হয় রাজার গুনকীর্তণ মেশানো গীত রচনা করতে। কাহ্নুর শিল্পীসত্তা আহত হয় এতে। এদিকে সমাজের উপর রাজানুগ্রহীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষজন প্রতিবাদী হয়ে উঠে। রাজার অধীনে কাহ্নুর চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত জানালে মন্ত্রী দেবল ভদ্র ক্ষুব্ধ হয়ে বেঁধে নিয়ে আসে তাকে। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কাহ্নুর ঔদ্ধত্যের প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে রাজ-প্রশস্তি রচনা করে রাজ্যের সর্বত্র গেয়ে বেড়ানো। কিন্তু কাহ্নু সরাসরি জানিয়ে দেয় সে রাজাকে চেনে না। অনেক অত্যাচার সয়েও মন্ত্রীর কথা-মতো কাজ না করায় কাহ্নুর হাত দুটো কেটে ফেলা হয়। স্ত্রী শবরীর অক্ষম চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার থাকে না। এর প্রতিশোধ নেয় পাটনী ডোম্বী। দেবল ভদ্রের ভাগ্নে রাতে ডোম্বীর ঘরে এলে সুযোগ বুঝে ওকে খুন করে। পরিণামে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ডোম্বীকে। ওদের পাড়া আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রতিবাদী তরুণ দেশাখ সীমিত সামর্থ্য নিয়ে এটার বিপক্ষে যুদ্ধ করে। কিন্তু ওদের এই সামান্য প্রচেষ্টা বিশাল রাজশক্তির বিপক্ষে টিকে থাকবে কীভাবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ওরা।
আবিষ্কৃত অথবা উদ্ধারকৃত মোট চব্বিশজন চর্যা-রচয়িতার পঞ্চাশটি চর্যার ভেতর হাজার বছর আগের অন্তজ সমাজের যে করুণ চিত্র পাওয়া যায় তা একটা উপন্যাসের মাধ্যমে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন সেলিনা হোসেন। এটার ভাষা সহজ ও গতিশীল ‘রাত কত বুঝতে পারে না শবরী। আজ পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় ভেসে গেছে প্রান্তর। এমন ফুটফুটে জ্যোৎস্না ও অনেকদিন দেখেনি। হঠাৎ করে শবরীর খুব ভালো লাগে। দেশাখ এখনো আসছে না কেন? কোথায় গিয়ে আটকে গেল? তখুনি একটা মৃদু কোলাহল ওর কানে আসে। আস্তে আস্তে সেটা বাড়ে। শবরী ভালো করে খেয়াল করে। পুব পাড়ার ওদিকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। শবরীর ভয় হয়। কিছু বুঝতে পারে না। ও দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ঠিকই ধরেছে, বাড়ি পুড়ছে। চড়চড় শব্দে বাঁশ ফাটছে। তবে কি রাজার লোক রাতের অন্ধকারে ওদের উপর হামলা চালালো?’ উপন্যাসের শেষাংশে একটু হোঁচট খেতে হয়, কাহ্নুপার মুখ দিয়ে এখানে যা বলিয়েছেন ঔপন্যাসিক তা কিছুটা আরোপিত মনে হয় ‘আমাদের তেমন একটা জায়গা একদিন হবে। রাজা প্রজা সমান হবে। আমাদের ভাষা রাজদরবারের ভাষা হবে। তেমন দিনের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে দেশাখ।’ আমাদের দুর্ভাগ্য, এই স্বপ্নটার জন্ম অন্তজ ঐ সমাজে তখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি, এটা নিছকই কষ্টকল্পনা। চর্যাপদের রচনাকাল প্রায় আড়াইশ তিনশ বছর, ঐ সময়টা রাজাদের রাজ্যশাসনের সময়, প্রজাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাল এসেছে অনেক পরে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক ক্রান্তিকালের, অনেকটা সদ্য অতীতের। বিভাজিত, ও দীর্ঘকাল সহ-অবস্থানে টিকে থাকা বাঙালি সংস্কৃতি স্পষ্ট দুভাগ হয়ে যায়। বাঙালি হিন্দুর জন্য হিন্দুস্থান আর মুসলমানের জন্য পাকিস্তান। দুই ধারার এই বাঙালি সংস্কৃতি কীভাবে এক সঙ্গে টিকে ছিল! নিুবর্গীয় মুসলমানেরা, যাদের সবাই ধর্মান্তরিত হয়েছিল নিজেদের ডোম, বাগী প্রভৃতি অন্তজ শ্রেণি-পরিচয় মুছে ফেলার জন্য, এবং এরাই মুসলমান জনগোষ্ঠির প্রায় শতভাগ, এদের সহনশীলতাও ঐতিহাসিক। নিুশ্রেণির সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শত বিপত্তি সত্ত্বেও অটল থেকে সমাজের উচ্চকোটির সেবা দিয়ে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে এই দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের ভেতর রেষারেষি সে-অর্থে তেমন কিছু ছিল না। হিন্দু জনগোষ্ঠির উচ্ছিষ্টভোগী কুলীন ব্রাহ্মণদের জায়গায় মুসলমান সমাজে প্রতিস্থাপিত হয়েছে মোল্লা মৌলানা গোষ্ঠি। এখনো এরা পরজীবি শোষকের ভূমিকায়ই রয়েছে। ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করছে। এমনকি রাজনীতিকেও সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। জাতিগত অথবা সাম্প্রদায়িক বিভাজনে প্রান্তিক মানুষেরা হাজার হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা ছিল নিপিষ্ট। বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টশীলাও এদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। মুসলমান ধর্মের তখনকার সাম্যবাদ অর্থনৈতিকভাবে না হলেও মানুষ হিসেবে সামান্য সামাজিক স্বীকৃতিটুকু দিয়েছিল। শত শত বছরের নিপীড়নে এই শ্রেণির মানুষের ভেতর আশ্চর্য এক সহনশীলতাও গড়ে উঠেছিল। চরম অপমানজনক ব্যবহারও এদেরকে স্পর্শ করে না। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় ইলিয়াস সমাজের এই অসঙ্গতিটা প্রকাশ করেছেন: ‘‘বড়ো একটা হ্যারিকেন হাতে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বৈকুণ্ঠ চেরাগ আলিকে ধমক দেয়, ‘এখন দোকানেত সন্ধ্যা দেওয়া হবি, তোমার এটি থাকা চলবি না।’’ অথবা, ‘‘ঘরের ভেতর হ্যারিকেন জ্বালাচ্ছিলো কালো ঢ্যাঙা একটা মানুষ, বৈকুণ্ঠের আবেদনে সাড়া না দিয়ে বলে ‘ত্যাল লিবু? খাড়া। ওটি থাক। বেজাতের মানষেক হামরাও ঘরোত ঢুকবার দেই না।’’ --প্রভৃতি বাক্যগুলোতে।
বিগত দুই শতকে বিশ্বাবস্থা এতোটা বদলেছে যে আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা, প্রচলিত বিশ্বাস, ধর্ম, মিথ প্রভৃতি মানুষের আস্থা প্রায় পুরোপুরি হারিয়ে বসেছে। ব্যতিক্রম শুধু দরিদ্র-বিশ্ব ও বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠি। কুসংস্কারের সঙ্গে এখনো ধর্মীয় মিথও সমানভাবে বিশ্বাসে রেখেছে পৃথিবীর এই বিপুল ও অকার্যকর অক্ষম জনগোষ্ঠি। ধর্মবিশ্বাসের ভিত, যাহোক, দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মিথের পুন-নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে অনেক বিস্তৃতভাবে। মিথ হতে পারে যে কোনো কিছু। কোনো অতিলৌকিক ঘটনা, মায়াবিভ্রম, অথবা কিংবদন্তি হয়ে ওঠা কোনো চরিত্র। ইলিয়াসের উপন্যাসের শুরুতেই জন্ম নেয় এক মিথ। মুনসি বয়তুল্লা শাহর মিথ ‘‘অনেকদিন আগে, তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার বাপেরও জন্ম হয় নি, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরই তখনো দুনিয়ায় আসতে ঢের দেরি, বাঘাড় মাঝির দাদার বাপ না-কি দাদারই জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন-কেটে বসত-করা বাড়ির নতুন মাটি ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, ঐসব দিনের এক বিকালবেলা মজনু শাহের বেশুমার ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান কেল্লায় যাবার জন্যে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় মুনসি বয়তুল্লা শাহ গোরা সেপাইদের সর্দার টেলরের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিলো ঘোড়া থেকে। বন্দুকের গুলিতে ফুটো গলা তার আর পুরট হলো না। মরার পর সেই গলায় জড়ানো শেকল আর ছাইভস্মমাখা গতর নিয়ে মাছের নকশা আঁকা লোহার পান্টি হতে সে উঠে বসলো কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মাথায়। সেই তখন থেকে দিনের বেলা রোদের মধ্যে রোদ হয়ে সে ছড়িয়ে থাকে সারাটা বিল জুড়ে। আর রাতভর বিল শাসন করে ওই পাকুড়গাছের ওপর থেকেই।’’
কাৎলাহার বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মাঝিদের ভেতর মুনসির কেরামতি শত সহস্র ডালপালা মেলে শোলোকের মধ্য দিয়ে বিড়াজিত থাকে। ঘুমের ঘোরে নিশিহাঁটা তমিজের বাপ খোঁজে কিংবদন্তির ঐ মুনসিকে, আর মুনসির শোলোকের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে চেরাগ আলী ফকির। দেশভাগের ইতিহাস, গ্রাম নগর জনপদ ভেঙ্গে নতুন সমাজ বিন্যাসের ইতিবৃত্ত, সমাজের অতি সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ, হাসিকান্না, জীবনে দেখা ও না-দেখা সব স্বপ্ন বিশাল ক্যানভাসের ভেতর অসংখ্য ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন ইলিয়াস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটা মাইলফলক এ উপন্যাস।
বাংলার বাইরের মিথনির্ভর, এবং সম্ভবত বাঙালি মুসলমানের ভেতর সব চেয়ে বেশি পঠিত উপন্যাস মীর মোশারফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু। এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ধর্মীয় মিথ। কিন্তু ধর্মের সত্য নয়। বলা চলে উপন্যাসটি ইতিহাস-আশ্রিত নয়। ইতিহাসের অন্ধ-বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। মীর সাহেবের প্রচণ্ড ধর্মীয় আবেগ তখনকার ধর্ম-অন্তপ্রাণ পাঠককেও আক্রান্ত করেছে সমভাবে। সীমারের খঞ্জর চালানোর বিষয়টি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই সাধারণমানসে বিশ্বস্ত হয়েছে। এখানে ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব ঈর্ষণীয়। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৮৮৫-৯০। অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় প্রায় শত বৎসর উপন্যাসটি বাঙালি মুসলমানদের পাঠতালিকায় শীর্ষে অবস্থান করেছে। যদিও বিগত কয়েক দশকে এটার পাঠকসংখ্যা সীমিত হয়ে পড়েছে। উপন্যাসটির ভাষা ও বর্ণনাশৈলী ঐ সময়ের বাঙালি মুসলমান পাঠকের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল। ‘‘সীমার গাত্রের বসন উন্মোচন করিয়া হোসেনকে দেখাইল। নিজেও দেখিল। হোসেন সীমারের বক্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দুই হস্তে দুই চক্ষু আবরণ করিলেন। সীমার সজোরে হোসেনের গলায় খঞ্জর দাবাইয়া ধরিল। এবারেও কাটিল না। বার বার খঞ্জর ঘর্ষণে হোসেন বড়ই কাতর হইলেন। পুনরায় সীমারকে বলিতে লাগিলেন, ‘‘সীমার! আর একটি কথা; আমার মনে হইয়াছে, বুঝি তাহাতেই খঞ্জরের ধার ফিরিয়া গিয়াছে, তোমারও পরিশ্রম বৃথা হইতেছে, আমিও যারপরনাই কষ্টভোগ করিতেছি। সীমার! মাতামহ জীবিতাবস্থায় অনেক সময় স্নেহ করিয়া আমার এই গলদেশে চুম্বন করিতেন। সেই পবিত্র ওষ্ঠের চুম্বনমাহাত্ম্যেই তীক্ষ্ণধার অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে। আমার মস্তক কাটিতে আমি তোমাকে বারণ করিতেছি না; আমার প্রার্থনা এই যে, আমার কণ্ঠের পশ্চাদ্ভাগে, যেখানে তীরের আঘাতে শোণিত প্রবাহিত হইতেছে, সেইখানে খঞ্জর বসাও; অবশ্যই দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইবে।’’
অনেকটা বিস্ময় ও কিছুটা হতাশা নিয়ে প্রসঙ্গিত হলো পঞ্চম উপন্যাসটি। শেখ রফি আহমেদের ‘রল্ফ’। এটার ইতিহাসও বাংলার বাইরে, ইউরোপের জার্মানির। হিটলারের কন্সেনট্রেশান ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা এক ইহুদির। সাহিত্যের বাণিজ্যায়নের বিপরীতে অন্তত কিছু প্রকৃত পাঠক আশা করা যায় যারা বিজ্ঞাপন ও প্রচারে প্রলোভিত না হয়ে ভালো একটা বই খুঁজে বের করে পড়বেন। এক্ষেত্রে হতাশ হতে হয়েছে। চার বছর আগে বইটির প্রকাশ। দায়সারা একদুটা পরিচিতিমূলক আলোচনার বাইরে অন্য কিছু হয়নি এ বইটা নিয়ে। অথচ এটার প্রকৃত সমালোচনা করে ঔপন্যাসিককে প্রণোদিত করতে পারলে বাংলা সাহিত্য এই ক’বছরে আরো দুচারটা উঁচুমানের উপন্যাস পেতে পারতো। এটাই একমাত্র বাংলা উপন্যাস যা গত চার বছরে দুবার পড়েছি। উপন্যাসটির রচয়িতা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী। আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর এ পরিচয়টাও বাংলাদেশে অথবা বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে সেভাবে জ্ঞাত নয়। যে জাতি তার প্রকৃত বীরদের সম্মান দেয় না, সেখানে খলনায়কদের প্রাধান্য থাকাটাই স্বাভাবিক, এবং সেখানে প্রকৃত বীরের উত্থানও বিলম্বিত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ