বাংলা কথাসাহিত্যে এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব শওকত আলী। কথাসাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই রয়েছে তার পদচারণা তবে গল্প আর উপন্যাসে তিনি এঁকেছেন জীবনের ঘনিষ্ঠ চিত্র। তুলে ধরেছেন শোষিত ও অন্ত্যজ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা আর বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্রহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায় লুপ্ত ও বিস্মৃত ইতিসাসে তাঁর সৃজনশীল নিরীক্ষাধর্মী অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ আর কথাসাহিত্যে সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা।
জন্ম ও বাল্যকাল
দিনাজপুরের রায়গঞ্জ নামের এক থানা শহরে শওকত আলীর জন্ম। স্কুলের রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। তবে তাঁর মতে তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৯৩৫ সালে। মায়ের তৃতীয় সন্তান তিনি কিন্তু সন্তানদের মধ্যে চতুর্থ কারণ বড় দু’বোন যমজ। বেশ বড় একটা বাড়িতে কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। অনেকখানি জায়গাজুড়ে পুকুর আর চারদিকে বাগান ছিল সে বাড়িটির। শিশু বয়সে ঐ গাছপালা, বাগান আর প্রকৃতি দেখতেন তিনি। বাবা ছিলেন তাঁর দাদা দাদির প্রথম সন্তান। তাঁর জন্মের আগেই মারা যান দাদা। দাদি তাঁকে খুব আদর করতেন। রাতে দাদির কাছেই থাকতেন। দাদির কোলে বসে শুনতেন কাহানী। যা তাঁকে শিশুকাল থেকেই গল্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত রায়গঞ্জেই ছিলেন। তারপর শ্রীরামপুর, হুগলি জেলায়। সেখানে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে মা ভর্তি হলেন ডিপ্লোমা করতে। বাবা ছিলেন হোমিও প্যাথিক ডাক্তার। বাবাও শ্রীরামপুরে চলে আসলেন। ডাক্তারির প্র্যাকটিস শুরু করলেন। বাবা কলকাতায় হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী নিতে ভর্তি হলেন, ডিগ্রী নিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন, কলকাতায় শুরু হয়েছে বোমা হামলা। তাই আবার তারা ফিরে এলেন রায়গঞ্জ।
শিক্ষা ও রাজনীতি
উনিশ খ্রিস্টাব্দের আগেই এই পরিবারে শিক্ষা প্রবেশ করেছিল। রায়গঞ্জের উকিলপাড়ায় থাকতেন তাঁরা। ও পাড়ায় ওটাই ছিল একমাত্র মুসলিম পরিবার। সে সময়টায় মুসলিম পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল না। কিন্তু এই পরিবারের মেয়েরা লেখাপড়া করেছিল। শওকত আলীর মা লেখাপড়া শিখেছিলেন। একজন দিদিমনিকে রেখে ঘরেই শিখেছিলেন ইংরেজী। মা ডিপ্লোমা করতে গিয়েছিলেন শ্রীরামপুর।
তাঁর স্কুল জীবনও শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশনারী স্কুলে। খুব প্রাচীন স্কুল এটি। সম্ভবত উইলিয়াম কেরী স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে রায়গঞ্জ করনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন তিনি। এই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন ঐ সালেই সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইএ ভর্তি হন এবং ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ পাস করেন।
এ সময় জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। মূলত রাজনীতি ছিল তাঁর রক্তে। জন্মের পরই দেখেছেন কংগ্রেসের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাবার সক্রিয় অংশগ্রহণ, মা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। পরস্পর বিপরীতমুখী দুই স্রোত। ওটা রাজনীতির একটা জটিল সময়। এই জটিল সময়টি তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সমস্ত বোধ দিয়ে। বুঝতে পেরেছিলেন মুসলমানরা অবহেলিত, তাদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে। ব্রিটিশ তাড়াতে হবে। আবার দেখেছেন বাঙালী মুসলমানরা একটা বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্যই পাকিন্তান চাইছে। আবার যখন পাকিস্তান হলে জিন্নাহ যখন ঢাকায় এসে ঘোষণা দিলেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ রেডিওতে এটি যখন খুব প্রচার হলো তখন মা খুব অসুস্থ। তখন সব ভাইবোনকে ডেকে তাঁর মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, ‘ওই পাকিস্তানে তোরা যাবি না। যে পাকিস্তানের জন্য তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন, সেই পাকিস্তান যেতেই তিনি নিষেধ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে মায়ের মৃত্যু হলে তাঁকে আর পাকিস্তান আসতে হয়নি। কিন্তু তাঁর পুরো পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। পকিস্তানে এসে আবার বুঝেছিলেন বাঙালী মুসলমানরা যে বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য পাকিস্তান চেয়েছিলেন তা পূরণ হয়নি। বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশের প্রয়োজন। এসব কিছুই তাঁকে নানাভাবে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল
কলেজে পড়ার সময় জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। তৃণমূল মানুষের জন্য কাজ করা, তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করা, ছিল তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। তারপর বাঙালী জাতীয়তাবাদের জাগরণ। রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন সবকিছু তাঁকে আন্দোলিত করে। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের ডিস্ট্রিক সহ-সভাপতি বানানো হয় তাঁকে। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা জারি হয়। চলে ব্যাপক ধরপাকড় তিনি আর কমরেড মোঃ ফরহাদ একসঙ্গে জেল খাটেন। হাজী মোঃ দানেশ বিখ্যাত নেতা ছিলেন। তাঁর সঙ্গেও সক্রিয় রাজনীতি করেন। জেল থেকে বের হয়ে ১৯৫৫ সালে বিএ পরীক্ষা দেন এবং তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ বাংলায় ভর্তি হন ও ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করেন।
সাংবাদিক ও শিক্ষক জীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে। সে সময় আবার তিনি সাংবাদিকতাও শুরু করেন। ১৯৫৫ সালেই দৈনিক মিল্লাতে চাকরি নেন তিনি। এ সময় পরিচয় ঘটে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু মানুষের সঙ্গে। যাদের মধ্যে ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং সমকালের সম্পাদক কবি সিকান্দার আবু জাফর।
এমএ পাস করার পর আসেন বীরগঞ্জে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঠাকুরগাঁও কলেজে। দুই বছর থেকে যান ঠাকুরগাঁওয়ে। এ সময় পছন্দ করে বিয়ে করেন ইডেন কলেজের ছাত্রী শওকত আরাকে। কিন্তু ঢাকা তখন তাঁকে ডাকছে। সাংবাদিকতার সেই দিনগুলো, লেখালেখির নেশা আর লেখক বন্ধুদের টানে ও উৎসাহে চলে আসেন ঢাকায়। এ সময় তিনি সমকাল পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৬২ সালে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন জগন্নাথ কলেজে। কর্মজীবনে স্থিতু হন। তারপর টিকাটুলিতে জায়গা কিনে ঢাকায়ও তিনি স্থাযী হন। ২৫ বছর চাকরি করেন এই কলেজে। ১৯৮৮ সালে জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে যোগ দেন এখানে ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৯ সালে তাঁকে সরকারি সঙ্গীত কলেজের প্রিন্সিপাল করা হয। এরপর ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
জগন্নাথ কলেজে যোগদানকালে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ। এ সময় সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান মমতাজউদ্দিন আহমেদ, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান, হারুন অর রশিদকে। তাঁর আর একজন জুনিয়র সহকর্মী ছিলেন কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। যিনি তাঁর টিকাটুলির বাসায়ও ছিলেন। যার সঙ্গে তার আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘকাল। সাংবাদিকতা জীবন এবং কলেজ জীবনের সহকর্মীররা তাঁকে নানাভাবে লেখালেখির প্রেরণা জুগিয়েছে।
লেখক হয়ে ওঠা
বাড়িতে প্রচুর বই ছিল। বাবার লেখাপড়ার প্রতি খুবই আগ্রহ ছিল। মাও ছিলেন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত এবং শিল্পিত মননের মানুষ। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল দুজনেরই। বাড়িতে ইংরেজী পত্রিকা, মাসিক পত্রিকা মোহাম্মদী, পরে সওগাত, আনন্দবাজার, যুগান্তর পত্রিকা আসত। ছোটবেলার ঐ প্রকৃতি আর রায়গঞ্জে প্রচুর বৃষ্টি হতো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আম কুড়ানো। লুকিয়ে বিলে, খালের উজানে মাছ ধরা, এগুলো খুব আনন্দ দিয়েছে তাঁকে আর এগুলোই নানাভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর লেখক জীবনকে ।
ক্লাস থ্রিতে থাকতেই লিখতে চেষ্টা করেছিলেন কবিতা। ক্লাস নাইন টেনে- স্কুল ম্যাগাজিনে লিখলেন প্রবন্ধ। বই পুরস্কার পেলেন। যা তাঁকে লেখার প্রতি উৎসাহ যোগালো। দেশভাগের পর দিনাজপুরে এসে তাঁর প্রথম লেখা একটি গল্প প্রকাশিত হয় কলকাতার বামপন্থীদের ‘নতুন সাহিত্য’ নামের পত্রিকায়। এরপর দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, ইত্তেফাকে তাঁর অনেক গল্প, কবিতা এবং বাচ্চাদের জন্য লেখা প্রকাশিত হয় এবং লেখাটা হয়ে ওঠে সাধনার আর অস্তিত্বের। নিজের লেখক হয়ে ওঠা সম্পর্কে তিনি বলেনÑ
যত দূর মনে পড়ে আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়, দিনাজপুরের কোন কাগজে। সেই কাগজের নাম কিংবা সেই গল্পের নাম কোনটাই এখন আর মনে নেই। পরে বিএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় এসে জুটে গেলাম কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর সূত্রেই পরিচয় হলো সমকাল পত্রিকার সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে। তখন থেকেই সমকালে লেখালেখি ও কাজের শুরু। আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, এই দুই কীর্তিমান লেখক আমার লেখক-জীবনকে নানাভাবে পরিচর্যা করেছেন।
প্রত্যেক লেখকের বেড়ে ওঠার পেছনে অনেকের অবদান থাকে, প্রভাব থাকে। আজ মনে হয়, আমার লেখক হয়ে ওঠার শুরুর দিনগুলোতে পরিবার ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল আমাকে (আমার (লেখালেখি, শওকত আলী, প্রথম আলো, ২৯.৫,২০১৫)
প্রকাশিত বই
উপন্যাস-
পিঙ্গল আকাশ, ওযারিশ, প্রদোষে প্রাকৃতজন, উত্তরের খেপ, নাঢাই, বসত স্থায়ী ঠিকানা, দলিল, ঘরে যেতে চাই, দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি, পূর্বদিন, কোথায় আমার ঘরবাড়ি, ত্রিপদী, দুই রকম পতন ও ভিতর গড়ের তিন মূর্তি (কিশোর উপন্যাস)
গল্পগ্রন্থ : উন্মুল বাসনা, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’।
পুরস্কার
বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাঙলা ১৯৬৮ সালে একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৮৩ সালে পান অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০-এ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন।
তাঁর সৃষ্টির জগত
জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার সময়ই শুনতে পাই, সারা দুনিয়াতে যুদ্ধ হচ্ছে আর দেখি রাতের বেলা ভূতের কান্নার মতো সাইরেন বাজছে আর সব বাতি নিভিয়ে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার করে ফেলা হচ্ছে সারা শহরটাকে। একদিন সত্যি সত্যি বোমা পড়ল কলকাতার কাছে আর তখন শুরু হলো পালাও পালাও রব। গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে মানুষ ছুটছে রেলস্টেশনের দিকে উদ্দেশ্য, গ্রামগঞ্জে, নয়তো মফস্বল শহরে ঠাঁই নেবে। ওই যুদ্ধ চলার সময়ই আবার লেগে গেল দুর্ভিক্ষ। রাস্তায় রাস্তায় কঙ্কালসার মানুষকে বসে নয়তো দাঁড়িয়ে ভিক্ষে চাইতে দেখা যেত। কাউকে কাউকে ডাস্টবিন থেকে পচা আর উচ্ছিষ্ট জিনিস তুলে নিয়ে খেতেও দেখা গেছে। বাইরে বেরোলেই মরা মানুষের লাশ চোখে পড়ত (আমার লেখালেখি, শওকত আলী, প্রথম আলো, ২৯.৫,২০১৫)
যুদ্ধ, হানাহানি, অস্থিতিশীল-উত্তপ্ত সময়, মানবিকতার পরাজয়, মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা এসবের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। যা তার মনে ব্যাপক রেখাপাত করেছিল। সাধারণ মানুষের এই মানবেতর জীবন, দুর্ভিক্ষ, মানুষের পচা লাশ দেখার পাশাপাশি তিনি আবার দেখেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিমের রায়ট, দেশভাগ এবং ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের দুর্বহ কষ্ট।
যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ দুই-ই শেষ হলো বটে, তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মুখে সেøাগান শোনা যেতে লাগল। একদিকে জয় হিন্দু আর ভারতমাতা কী জয়, অন্যদিকে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। খবর শোনা গেল কলকাতা আর বিহারের মুঙ্গেরে মুসলমানদের মেরে কেটে সাফ করে দিচ্ছে হিন্দুরা আর মুসলমানরা নোয়াখালী, বরিশাল আর ঢাকায় একজন হিন্দুকেও রাখেনি। সবাইকে মেরে বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ লুট করে নিচ্ছে। ওই রকম খবর শুনতে শুনতেই একদিন জানা গেল, ব্রিটিশরাজ্যের দিন শেষ, তাদের ভারত সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে গেছে। পাকিস্তানে হিন্দুর জায়গা নেই আর হিন্দুস্তানে মুসলমান থাকলে তারা বেঘোরে মারা পড়বে। (আমার লেখালেখি, শওকত আলী, প্রথম আলো, ২৯.৫,২০১৫)
এই দেশভাগ তাঁকে জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছিল। জন্মভূমির মাটি হারানোর গভীর বেদনা, শোষিত মানুষের পরাজয় তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। শওকত আলীর উপন্যাস ও গল্পের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে নিম্নবর্গের মানুষ, তাদের শোষিত জীবনের কথকতা। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শওকত আলীর মনের বিদ্রোহ আজীবন। খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের দুঃখ বেদনা, হাহাকার বঞ্চনা আর গভীর অনুভবে তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন।
ইতিহাসের পালাবদল, শাসকের পালাবদলের ধারায় সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সাধারণ মানুষের জীবন প্রেম ও অনুভব এবং ৮০০ বছর আগের ইতিহাস আশ্রয়ী তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের নামকরণটাও সে চিন্তা থেকেই এসেছে। প্রদোষকাল মানে দিন এবং রাত্রির মাঝামাঝি সময়। হিন্দু শাসন চলে যাচ্ছে মুসলমান শাসকেরা আসছে এই মাঝামাঝি সময়ে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তারা কী ভাবছেন?
আমার চিন্তাটা এ কারণেই এসেছিল যে, এখানকার সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজ্যশাসনের যে প্রক্রিয়াটা ছিল, তা তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রান্তে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এতবেশি হওয়ার কারণ কী? এটা আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আমি অনেককে প্রশ্ন করেছি কিন্তু কোন সঠিক উত্তর পাইনি।...
যবনরা আসছে শুনে অতবড় রাজা লক্ষণ সেন রান্না করা খাবার না খেয়েই নৌকা নিয়ে পালিয়ে গেলেন। এ ঘটনাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিল এ উপাদানগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়। আমি ইসলাম প্রচার করতে যাচ্ছি না। কী হয়েছিল না হয়েছিল সেসবের কোন সিদ্ধান্তও আমি দিইনি। এর মধ্যে প্রেমের ব্যাপারটা আছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা যে সমাজ পরিবর্তনের জন্য উত্থান-পতন, গৃহযুদ্ধ সবকিছুতেই অংশ নিয়েছে। প্রেমিকাকে ফেলে প্রেমিক যুদ্ধে যাচ্ছে, সে কোন যুদ্ধে যাচ্ছে? কার জন্য যাচ্ছে? তার ধর্ম কী? একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ পরিবর্তনের কথাই আমি বলতে চেয়েছি। (সাক্ষাৎকার, ১৯.৫.২০১৩, শিলালিপি)
তার এ উপন্যাসে আছে মানব মনের এক চিরন্তন প্রশ্ন এই জীবন জীবনের জন্য যুদ্ধ এই শাসক শ্রেণী এই যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াই আবার ক্ষমতা হারিয়ে কাপুরুষের মতো পলায়ন এই যে বারবার ভাঙ্গা-গড়া এর শেষ কোথায়Ñ দেখ, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবল প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছেÑ এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতদিন এভাবে চলবে?
উপন্যাসের এক চরিত্রের এই প্রশ্ন মানুষের অস্তিত্ব আর জীবনের সর্বজনীন এক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত এবং পূর্বরাত্রি পূর্বদিন যেগুলোকে একসঙ্গে ত্রয়ী উপন্যাসের জন্য তিনি ফিলিপস্ পুরস্কার পান। ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন আসছে যেটাই ‘দক্ষিণায়নের দিন’ যার মানে হচ্ছে শীতকাল আসছে। ‘কুলায় কালস্রোত’ হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে একবারে আঘাত করছে। আর ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি। মূলত ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসে, যে নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ সমগ্র জীবনব্যবস্থা, ধ্যান-ধারণা আর চাল-চলনে যে পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে তা নিবিড় পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে।
নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন ও বিচরণের পাশাপাশি আদিবাসীর জীবনও উঠে এসেছে তার গল্পে। স্কুলে এবং কলেজে শিক্ষকতার সময় তিনি মাটিসংলগ্ন মানুষের সঙ্গে মিশেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। তাঁর উপন্যাস গল্প তাই অন্ত্যজ মানুষের হাহাকার, শোষণ আর বঞ্চনার চারণভূমি। শুধু শোষণ আর নিপীড়নের ঘনিষ্ঠ চিত্র নয়। শোষিত মানুষের জেগে ওঠা, বঞ্চনার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা জীবন আর অত্যাচারিতের বিজয়েও তিনি আশাবাদী। তাঁর গল্পের নিপীড়িত জনতা তাই জ্বালিয়ে দেয় প্রতিরোধের আগুন, খড়ের গাদায় পুড়িয়ে দেয় মহাজনের ঘর, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কড়ায়-গ-ায় হিসাব চায়। ‘লেলিহান স্বাদ’ গল্পে আমরা দেখি শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী মানুষ আগুন ধরিয়ে দেয় ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পে দেখি মহাজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিসাব চায় নিপীড়িত মানুষ। প্রতিশোধে সাপের ঝাঁপি খুলে দেয় অন্ধকারে।
শওকত আলীর মানসিক জগৎ ছিল বিশ্রামহীন। সাধারণ নিপীড়িত জনতার মুক্তি আর সৃষ্টির উন্মাদনায় উন্মাতাল, উত্তাল। তিনি যেমন আপোসহীন ছিলেন তৃণমূল মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্তির জায়গায় তেমনি শিল্পসৃষ্টি লেখনী ও প্রকাশের জায়গায়। তাই তাঁর উপন্যাস গল্পে যেমন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাধারণ মানুষের শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা এবং মুক্তির আকাক্সক্ষা তেমনি প্রকাশের ঋজুতা, বর্ণনা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতায় তা হয়ে উঠেছে শিল্পোত্তীর্ণ জীবনের ঘনিষ্ঠ পাঠ।
শওকত আলী জীবনকে দেখেছেন নির্মোহভাবে। তাঁর কলমের দক্ষতায় এঁকেছেন মানুষের জীবনছবি। সে জীবনছবি আমাদের ইতিহাস, শ্রেণী, শ্রেণী সংগ্রাম আর জীবন আকাক্সক্ষার। তাঁর লেখা কোন বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত নয়, জীবনের বাইরে, জীবনের গল্পের বাইরে অথবা আখ্যানহীন কোন কিছু তিনি আঁকতে চাননি। তিনি জীবনের প্রতি ভাঁজ থেকে গল্প তুলে এনেছেন। তাই তার গল্পে, তার সৃষ্টিতে যেমন আছে মানবিকতার পরাজয় ও দলিত জনতা, মানুষের অন্ধকার, মৃত্তিকালগ্ন মানুষ তেমনি আছে বিদ্রোহী-প্রতিবাদী মানুষ বিপ্লব, স্বপ্ন, জাগরণ আর মানুষের বিজয়। তিনি বিশ্বাস করেন জীবনে আর জীবনকেই ভাবেন শিল্প। জীবন আর শিল্পের এক অক্লান্ত কারিগর তিনি।
বর্তমান সময়ে তিনি
কথাসাহিত্যের এ কিংবদন্তি পুরুষ এখন সময় কাটান টিকাটুলিতে তাঁর বাসার নির্জন কক্ষে। বার্ধক্যের নানা শারীরিক সমস্যায় এখন আর তেমন লিখতে পারেন না। একটা পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা বহুদিনের। কাজটায় হাতও দিয়েছিলেন। সেখানে জীবন আর সময়কে আঁকতে চান তিনি। কিন্তু স্মৃতি মাঝে মাঝেই তাঁকে প্রতারিত করছে। অনেককিছুই স্মরণ করতে পারছেন না। লিখতে না পারলেও বই তাঁর অবসরের প্রিয় সঙ্গী। পড়েন গল্প, উপন্যাস, রাজনীতি ইতিহাসের বই। একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী তিনি লিখে যেতে পারবেন কি নাÑ এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও আশাবাদী তিনি। যা আমরা করতে পারিনি তা নতুন প্রজন্ম করবে, যা আমরা জয় করতে পারিনি তা নতুন প্রজন্ম করবে এই স্বপ্ন জীবনের প্রতি তাকে করে ইতিবাচক ও আশাবাদী। আর তাই জীবনের জয় বা পরাজয় এবং সবকিছুর পরে আবার উত্তসূরির হাতে রেখে যাওয়া সৃষ্টির নিশানাতেই তিনি বিশ্বাসী। আর সে কারণেই দৃঢ় কণ্ঠে তার উচ্চারণ
জীবনের কথাই যদি সাহিত্যের কথা হয়, তাহলে পাশবিকতা, ধ্বংস ও বিপর্যয় যেমন বাস্তবতা এবং সাহিত্যের বিষয়, তেমনি ওই সবের পাশাপাশি ফুল ফোটানোর বাস্তবতাও সাহিত্যের বিষয়। এটা গ্রিক সভ্যতার যুগে যেমন সত্য, এই বিশ্বায়নের যুগেও তেমনি সমান বা খানিক বেশি রকমই সত্য। ব্যক্তির আপেক্ষিকতা মুক্ত স্বয়ম্ভর বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের যতই গুণগান করা হোক, কি সংসার-সম্পর্কহীনতাকে যতই প্রগতিশীলতার পরিচায়ক বলে ঘোষণা করা হোক, ভবিষ্যতে কী হবে জানি না, তবে এখনও ওসব কথা চমকমারা বুলি ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না।
0 মন্তব্যসমূহ