জীবন ও শিল্পের যে বহু কেন্দ্রাভিমুখী অস্থির বলয়ে উত্তরাধুনিক নন্দনতত্ত্বের অবস্থান, সাহিত্যরূপসমূহের মধ্যে উপন্যাসের পক্ষেই কেবল সেই বিচিত্র জ্ঞান ও তত্ত্বকে অভিন্ন শিল্প-আয়তনে ধারণ করা সম্ভব। উপন্যাসের সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে যে পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী বহু সত্য-অন্বেষী মত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ লক্ষ করা যায়, উত্তরাধুনিক জীবননীতি ও শিল্পনীতির সঙ্গে তা অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ।
বহু ব্যবহারে জীর্ণ Modernism এর গভীরেই যে পরিবর্তন বা রূপান্তরের অন্তঃশীলা শক্তি বিদ্যমান ছিল--উত্তরাধুনিক চিন্তনক্রিয়ায় তার প্রকাশ সুষ্পষ্ট। ইহাব হাসানের বহুল-উদ্ধৃত সাতটি সূত্রের (urbanism, technologism, dehumanization, primitivism, eroticism, antinominalism, experimentalism) বিশ্লেষণ থেকে আধুনিকতা থেকে উত্তরাধুনিকতাবাদে উত্তরণে মানবীয় চিন্তার রূপান্তরক্রম শনাক্ত করা সম্ভব। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সূতিকাগারে যে আধুনিকতার বীজ উপ্ত হয়েছিলো, পুঁজিবাদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহুমুখী পরিচর্যায় তা এক সময়ে মানুষের নন্দনচিন্তার ক্ষেত্রে একক শক্তিতে পরিণত হয়।
পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের বর্বর হাত তাদের কলোনিসমূহের সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে প্রভূত সম্পদ আহরণ করে প্রথমে বাণিজ্য পুঁজিবাদী (marcantile capitalist) এবং পরে শিল্পপুঁজিবাদী (industrial capitalist) শক্তিতে পরিণত হয়। শিল্পপুঁজির ক্রমস্ফীতি নগরায়ণ, যন্ত্রায়ণ ও শিল্পায়নের যে বিস্তার সাধন করে, তা থেকেই সূচিত হয় ইয়োরোপের যুগান্তকারী শিল্পবিপ্লব (industrial revolution)। উল্লেখ্য যে, শিল্পবিপ্লবোত্তর কালের নাগরিক, যান্ত্রিক ও কৃত্রিম মধ্যবিত্তমানসের শিল্পচাহিদারই প্রকাশরূপ হলো উপন্যাস।
সভ্যতার মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের স্বভাবধর্মকে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন (Negation of the Negations) অর্থাৎ নেতির নেতিকরণ। মানুষের নন্দনতাত্ত্বিক অভ্যাসের জগতে উপন্যাসের জন্মও অনেকটা সেইভাবে। সহজ কথায়, বুর্জোয়া তস্করের শিল্পচাহিদার অপর নাম উপন্যাস। কিন্তু ইউরোপীয় পূঁজিবাদ আধুনিকতাকে ভাববাদের রহস্যলোক থেকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্যে বর্বরদের অট্টালিকায় প্রাচ্যের বিপুল জনতার রক্তচিহ্ন পুঁজিবাদের অন্তঃসারশূন্য স্বভাববৈশিষ্ট্যকেই চিহ্নিত করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পুঁজিবাদী আধুনিকতা গভীরতর সংকট ও রক্তপাতের সম্মুখীন হয়। বুর্জোয়া সভ্যতার গর্ভ থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন antithesis। আগস্ত কোঁতের ধ্রুববাদ (positivism), কার্ল মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (dialectic materialism), চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ (theory of evolution) পাশ্চাত্যের ভাববাদী দর্শন ও নন্দনচিন্তাকে প্রকম্পিত করে প্রচণ্ড আঘাতে। উইলিয়াম জেমস-এর মনোবীক্ষণিক জীবনচিন্তা কিংবা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের বহুকৌণিক গুঢ়ৈষা মানব-অভিজ্ঞতাকে এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষান্তে ফ্রেড্রিক নিৎসের জরাথুস্ট-র উচ্চারণ (For the old god come to an end long ago. And verily it was a good and joyful end of Gods) ঈশ্বরমুক্ত এক নতুন জগতের স্বপ্নসম্ভাবনাকেই সুষ্পষ্ট করে তুলব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে উনিশ শতকীয় আধুনিকতার গভীরেই অনেক anti-শক্তির বসবাস। সাহিত্যরূপসমূহের মধ্যে উপন্যাসের আয়তনেই প্রথম এই আন্তঃসংঘাতপূর্ণ সমাজ ও সংস্কৃতির জটিলতা ধরা পড়ে। কেননা আমরা জানি, উপন্যাসের জন্মই একটি মুক্ত আঙ্গিক (open form) হিসেবে। জীবনের বহুকৌণিক অবয়ব ও সত্যকে ধারণ করার ক্ষেত্রে উপন্যাস তার জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয়।
ইংরেজি উপন্যাসে প্রথম যুগের শিল্পী ওয়াল্টার স্কট, হেনরি ফিল্ডিং এবং স্যামুয়েল রিচার্ডসনের উপন্যাসে আরিস্ততোলীয় প্লটধারণা, চরিত্রধারণা ও সময়ধারণার প্রথাগত বিন্যাসই আমরা লক্ষ করি। আরিস্ততলের অনুকরণতত্ত্বে যে বস্তুসর্বস্ব একমাত্রিকতা ছিল, এঁদের ইতিহাস, সমাজ কিংবা রোম্যান্স-আশ্রয়ী নান্দনিক অভিপ্রায় তাকেই সচেতনভাবে অনুসরণ করতে চেয়েছে। কিন্তু রোম্যান্সপ্রাণতার গভীরে কল্পনার যে বলগাহীন আধিপত্য, তা সরলরৈখিক বস্তুসীমার বাইরেও অন্যতম মাত্রা সন্ধানী।
জর্জ এলিয়ট, চাররস ডিকেন্স, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, এমিল জোলা, হেনরি জেমস প্রমুখ ঔপন্যাসিকের বিষয়ভাবনা, তত্ত্বচিন্তা ও আঙ্গিক বিন্যাসে প্রাগ্রসরতা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় থাকলেও প্রথাগত চিরায়তিক পদ্ধতিকে এঁরা পুরোপুরি অতিক্রম করতে সমর্থ হননি। তবে ফরাসি প্রাকৃতবাদ (naturalism) উৎসারিত বিজ্ঞান এবং হেনরি জেমসের মূর্ত ও বিমূর্ত উপাদানের সমন্বয়চিন্তা উনিশ শতকীয় ঔপন্যাসিক নন্দনতত্ত্বের সম্ভাবনাকে করেছিল ভবিষ্যৎগামী।
উপন্যাসের দ্বিমাত্রিক শিল্পভাবনাকে প্রথম রূপ দান করলেন লিও তলস্তয় তাঁর ওয়ার এ্যান্ড পিস এবং আনা কারেনিনা উপন্যাসদ্বয়ে। চিত্র, ঘটনা ও চরিত্রের বহুমূখী সম্ভাবনার চলচ্ছবি ওয়ার এ্যান্ড পিস আর নারী অস্তিস্ত্বের অন্তঃচারী স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, ক্রন্দন ও যন্ত্রণার রূপায়ণ আনা কারেনিনা। সময়ের মাত্রাটিকে তলস্তয় সমাজ ও শিল্প-অভিজ্ঞতা থেকে দুই উপন্যাসে দুইভাবে দেখেছেন। ঘটনা ও চরিত্রের মহাকাব্যিক সঞ্চরণের মধ্যে ওয়ার এ্যান্ড পিস উপন্যাসবিধৃত সময় আনুভূমিক (horizontal); অপরদিকে চরিত্রের অন্তরচারী বহুলাঙ্গিক চেতনা উপস্থাপনের প্রয়োজনে আনা কারেনিনা-র সময় অনেকটা উল্লম্বধর্মী (verical)।
উপন্যাসের শিল্পরূপে যে অনেকান্ত স্বর (polyphony) উত্তরাধুনিক উপন্যাসতত্ত্বের অন্যতম লক্ষ্যবিন্দু, উনিশ শতকে হেনরি জেমস এবং লিও তলস্তয়-এর উপন্যাসে তার প্রাক্চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে ফিওদর দস্তয়েভস্কির রচনায়--যাঁর উপন্যাসপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে মিখাইল বাখতিন উপন্যাসের তত্ত্ব ও শারীরব্যাখ্যার যুতান্তকারী মাত্রা নির্দেশ করেন।
ঘটনাবহুল বিংশ শতাব্দীতে সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি যে বহুমুখী সংকট ও ভাঙনের সুম্মুখীন হয়েছে, তার ফলে উপন্যাসনির্মিতির ক্ষেত্রে উনিশ শতকীয় আধুনিকতা মূল্যহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। দুই বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় মানব অস্তিস্ত্ব ও তার শিল্প-অনুধ্যানের প্রকৃতিও নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এই পরিবর্তমান, জটিল ও দ্বন্দ্বময় সময়স্বভাবের স্ববিরোধ-আক্রান্ত, বহু কেন্দ্রাভিমুখী সত্যস্বরূপকে সাহিত্যরূপসমূহের মধ্যে উপন্যাসই প্রথম আয়তনবদ্ধ করতে সমর্থ হল। আধুনিকতার নন্দনচিন্তায় যে স্ববিরোধ, জন্মলগ্নেই উপন্যাস তা বহুলাংশে আত্মস্থ করে ফেলে। আর যুদ্ধোত্তর কালের জটিল জীবন-অনুধাবন ও তার রূপায়ণের প্রয়োজনে ঔপন্যাসিক-নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে রূপান্তর হয়ে পড়ে অনিবার্য।
পুঁজিবাদী সভ্যতা এবং তার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কলোনিসমূহের অন্তর্গত সমষ্টি ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের ক্রমবর্ধমান স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, তমসাচ্ছন্ন সময়-গহ্বরে সমষ্টিলগ্ন হতে না পারার ব্যর্থতায় ব্যক্তির আত্মরতি ও আত্মহনন এবং জীবনসংক্রান্ত মূল্যচেতনার আমূল পরিবর্তনের পটভূমিতে ঔপন্যাসিকদের নিকট প্রথাগত জীবনধারণা তাৎপর্যহীন বলে মনে হয়। তাঁদের চৈতন্য অনুরণিত হতে থাকে :
এভাবেই উপন্যাস নিজের আঙ্গিকের মধ্যে যে-কোনো কালের উপযোগী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা লালন করে। বর্তমান বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য ও নন্দনচিন্তার ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিক চিন্তনপ্রক্রিয়ার যে বিচিত্রমুখী প্রয়োগ লক্ষ করি, উপন্যাসশিল্পের জন্মকথা, তার বিষয় ও আঙ্গিকের স্বভাবের মধ্যেই সেই চিন্তনের পূর্বসুত্র সুষ্পষ্ট। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সমাজ ও মানবমনের আধুনিকায়নের যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে উপন্যাসের স্বভাবকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, সে আধুনিকতার স্থিরতার কিংবা পরিপূর্ণতার কোন নিদর্শন সভ্যতার ইতিহাসে আমি দেখি না। বরং লক্ষ করি Modern বা আধুনিক এ ধারণাটিকে কেন্দ্র করে চিন্তনবিলাসী মানুষেরা বিচিত্র মতামতের এক পর্বত সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ‘আধুনিকতা’ ধারণাটির জন্ম যে সব সমাজে, সেই সমাজেরই ‘ভাঙনের আলামত, কৃত্রিমতার আলামত, যান্ত্রিকতার আলামত’ উপন্যাসের জন্মকে অনিবার্য করে তুলেছিলো।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এ-সত্য আমরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করি যে, বুর্জোয়া সভ্যতা তার যে প্রত্যেকটি তত্ত্বকথাকে নিজ নিজ উপনিবেশগুলোর ওপর আরোপের চেষ্টা করেছে এবং সব কালেই এক শ্রেণীর বশংবদ তাত্ত্বিকও তারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে বিভিন্ন দেশে। কিন্তু প্রতিটি সমাজ নিজ নিজ স্বভাব, শব্দরূপ, সংলাপের চরিত্র, লোককথা, শ্রেণীরূপ প্রভৃতির ভিত্তিতে ওইরূপ তত্ত্ব বা চিন্তাকে গ্রহণ বা আত্মস্থ করতে চেয়েছে।
ইউরোপের কাছ থেকেই আমরা পেতেছিলাম আধুনিকতা ও স্বাধীনতা নামক দুটি ধারণা, এবং তাদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে উত্তরাধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশিবাদ জাতীয় ধারণাগুলো। এই সব ধারণা বা থিসিস থেকে যে এ্যান্টিথিসিস তৈরি হয়েছে, তা একেকটি সমাজের নিয়মেই বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের উপনিবেশগুলো ‘প্রভু’র বচনকে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, সৎশিল্পের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। লাতিন আমেরিকা কিংবা স্পেনের বিশাল মানবিক পরিসরে উপনিবেশকালে যে সাহিত্যরূপগুলোর জন্ম হয়েছে, গভীর বিশ্লেষণে সেখানে একটা Anti স্বভাবই মূলত প্রত্যক্ষ করি। কবিতা কিংবা নাটকের বহু পূর্বে এই এ্যান্টি-স্বাভাবের জন্ম দিয়েছে উপন্যাস। মিখায়েল বাখতিনের দস্তয়ভস্কির উপন্যাস কিংবা উপন্যাসের সংলাপরহস্য বিশ্লেষণে এই বিরুদ্ধ (Anti) চিন্তার পূর্ণতর একটি ধারণা আমরা লসভ করি।
উপন্যাসের স্বভাবব্যাখ্যায় মনোনিবেশ করলে সময় ও সমাজের এত বিচিত্র-রূপ তরঙ্গ এতে বিধৃত হতে দেখি, যার অনুধাবন বহুকৌণিক শিল্প-অভিরূচি ছাড়া অসম্ভব। উপন্যাসের তত্ত্ব-ব্যাখ্যামূলক অধীত জ্ঞান থেকে যে বিষয়টি আমার কাছে সুষ্পষ্ট, তা হল উত্তরাধুনিকতা একটি তত্ত্ব, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি অভিরুচি। সমাজ ও ব্যক্তির মানদণ্ড এই তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিরুচিকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিল্পবিচারের স্থিতিস্থাপকতার সূত্র উপন্যাস থেকেই আমরা লাভ করি।
বহু ব্যবহারে জীর্ণ Modernism এর গভীরেই যে পরিবর্তন বা রূপান্তরের অন্তঃশীলা শক্তি বিদ্যমান ছিল--উত্তরাধুনিক চিন্তনক্রিয়ায় তার প্রকাশ সুষ্পষ্ট। ইহাব হাসানের বহুল-উদ্ধৃত সাতটি সূত্রের (urbanism, technologism, dehumanization, primitivism, eroticism, antinominalism, experimentalism) বিশ্লেষণ থেকে আধুনিকতা থেকে উত্তরাধুনিকতাবাদে উত্তরণে মানবীয় চিন্তার রূপান্তরক্রম শনাক্ত করা সম্ভব। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সূতিকাগারে যে আধুনিকতার বীজ উপ্ত হয়েছিলো, পুঁজিবাদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহুমুখী পরিচর্যায় তা এক সময়ে মানুষের নন্দনচিন্তার ক্ষেত্রে একক শক্তিতে পরিণত হয়।
পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের বর্বর হাত তাদের কলোনিসমূহের সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে প্রভূত সম্পদ আহরণ করে প্রথমে বাণিজ্য পুঁজিবাদী (marcantile capitalist) এবং পরে শিল্পপুঁজিবাদী (industrial capitalist) শক্তিতে পরিণত হয়। শিল্পপুঁজির ক্রমস্ফীতি নগরায়ণ, যন্ত্রায়ণ ও শিল্পায়নের যে বিস্তার সাধন করে, তা থেকেই সূচিত হয় ইয়োরোপের যুগান্তকারী শিল্পবিপ্লব (industrial revolution)। উল্লেখ্য যে, শিল্পবিপ্লবোত্তর কালের নাগরিক, যান্ত্রিক ও কৃত্রিম মধ্যবিত্তমানসের শিল্পচাহিদারই প্রকাশরূপ হলো উপন্যাস।
সভ্যতার মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের স্বভাবধর্মকে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন (Negation of the Negations) অর্থাৎ নেতির নেতিকরণ। মানুষের নন্দনতাত্ত্বিক অভ্যাসের জগতে উপন্যাসের জন্মও অনেকটা সেইভাবে। সহজ কথায়, বুর্জোয়া তস্করের শিল্পচাহিদার অপর নাম উপন্যাস। কিন্তু ইউরোপীয় পূঁজিবাদ আধুনিকতাকে ভাববাদের রহস্যলোক থেকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্যে বর্বরদের অট্টালিকায় প্রাচ্যের বিপুল জনতার রক্তচিহ্ন পুঁজিবাদের অন্তঃসারশূন্য স্বভাববৈশিষ্ট্যকেই চিহ্নিত করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পুঁজিবাদী আধুনিকতা গভীরতর সংকট ও রক্তপাতের সম্মুখীন হয়। বুর্জোয়া সভ্যতার গর্ভ থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন antithesis। আগস্ত কোঁতের ধ্রুববাদ (positivism), কার্ল মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (dialectic materialism), চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ (theory of evolution) পাশ্চাত্যের ভাববাদী দর্শন ও নন্দনচিন্তাকে প্রকম্পিত করে প্রচণ্ড আঘাতে। উইলিয়াম জেমস-এর মনোবীক্ষণিক জীবনচিন্তা কিংবা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের বহুকৌণিক গুঢ়ৈষা মানব-অভিজ্ঞতাকে এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষান্তে ফ্রেড্রিক নিৎসের জরাথুস্ট-র উচ্চারণ (For the old god come to an end long ago. And verily it was a good and joyful end of Gods) ঈশ্বরমুক্ত এক নতুন জগতের স্বপ্নসম্ভাবনাকেই সুষ্পষ্ট করে তুলব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে উনিশ শতকীয় আধুনিকতার গভীরেই অনেক anti-শক্তির বসবাস। সাহিত্যরূপসমূহের মধ্যে উপন্যাসের আয়তনেই প্রথম এই আন্তঃসংঘাতপূর্ণ সমাজ ও সংস্কৃতির জটিলতা ধরা পড়ে। কেননা আমরা জানি, উপন্যাসের জন্মই একটি মুক্ত আঙ্গিক (open form) হিসেবে। জীবনের বহুকৌণিক অবয়ব ও সত্যকে ধারণ করার ক্ষেত্রে উপন্যাস তার জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয়।
ইংরেজি উপন্যাসে প্রথম যুগের শিল্পী ওয়াল্টার স্কট, হেনরি ফিল্ডিং এবং স্যামুয়েল রিচার্ডসনের উপন্যাসে আরিস্ততোলীয় প্লটধারণা, চরিত্রধারণা ও সময়ধারণার প্রথাগত বিন্যাসই আমরা লক্ষ করি। আরিস্ততলের অনুকরণতত্ত্বে যে বস্তুসর্বস্ব একমাত্রিকতা ছিল, এঁদের ইতিহাস, সমাজ কিংবা রোম্যান্স-আশ্রয়ী নান্দনিক অভিপ্রায় তাকেই সচেতনভাবে অনুসরণ করতে চেয়েছে। কিন্তু রোম্যান্সপ্রাণতার গভীরে কল্পনার যে বলগাহীন আধিপত্য, তা সরলরৈখিক বস্তুসীমার বাইরেও অন্যতম মাত্রা সন্ধানী।
জর্জ এলিয়ট, চাররস ডিকেন্স, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, এমিল জোলা, হেনরি জেমস প্রমুখ ঔপন্যাসিকের বিষয়ভাবনা, তত্ত্বচিন্তা ও আঙ্গিক বিন্যাসে প্রাগ্রসরতা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় থাকলেও প্রথাগত চিরায়তিক পদ্ধতিকে এঁরা পুরোপুরি অতিক্রম করতে সমর্থ হননি। তবে ফরাসি প্রাকৃতবাদ (naturalism) উৎসারিত বিজ্ঞান এবং হেনরি জেমসের মূর্ত ও বিমূর্ত উপাদানের সমন্বয়চিন্তা উনিশ শতকীয় ঔপন্যাসিক নন্দনতত্ত্বের সম্ভাবনাকে করেছিল ভবিষ্যৎগামী।
উপন্যাসের দ্বিমাত্রিক শিল্পভাবনাকে প্রথম রূপ দান করলেন লিও তলস্তয় তাঁর ওয়ার এ্যান্ড পিস এবং আনা কারেনিনা উপন্যাসদ্বয়ে। চিত্র, ঘটনা ও চরিত্রের বহুমূখী সম্ভাবনার চলচ্ছবি ওয়ার এ্যান্ড পিস আর নারী অস্তিস্ত্বের অন্তঃচারী স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, ক্রন্দন ও যন্ত্রণার রূপায়ণ আনা কারেনিনা। সময়ের মাত্রাটিকে তলস্তয় সমাজ ও শিল্প-অভিজ্ঞতা থেকে দুই উপন্যাসে দুইভাবে দেখেছেন। ঘটনা ও চরিত্রের মহাকাব্যিক সঞ্চরণের মধ্যে ওয়ার এ্যান্ড পিস উপন্যাসবিধৃত সময় আনুভূমিক (horizontal); অপরদিকে চরিত্রের অন্তরচারী বহুলাঙ্গিক চেতনা উপস্থাপনের প্রয়োজনে আনা কারেনিনা-র সময় অনেকটা উল্লম্বধর্মী (verical)।
উপন্যাসের শিল্পরূপে যে অনেকান্ত স্বর (polyphony) উত্তরাধুনিক উপন্যাসতত্ত্বের অন্যতম লক্ষ্যবিন্দু, উনিশ শতকে হেনরি জেমস এবং লিও তলস্তয়-এর উপন্যাসে তার প্রাক্চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে ফিওদর দস্তয়েভস্কির রচনায়--যাঁর উপন্যাসপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে মিখাইল বাখতিন উপন্যাসের তত্ত্ব ও শারীরব্যাখ্যার যুতান্তকারী মাত্রা নির্দেশ করেন।
ঘটনাবহুল বিংশ শতাব্দীতে সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি যে বহুমুখী সংকট ও ভাঙনের সুম্মুখীন হয়েছে, তার ফলে উপন্যাসনির্মিতির ক্ষেত্রে উনিশ শতকীয় আধুনিকতা মূল্যহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। দুই বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় মানব অস্তিস্ত্ব ও তার শিল্প-অনুধ্যানের প্রকৃতিও নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এই পরিবর্তমান, জটিল ও দ্বন্দ্বময় সময়স্বভাবের স্ববিরোধ-আক্রান্ত, বহু কেন্দ্রাভিমুখী সত্যস্বরূপকে সাহিত্যরূপসমূহের মধ্যে উপন্যাসই প্রথম আয়তনবদ্ধ করতে সমর্থ হল। আধুনিকতার নন্দনচিন্তায় যে স্ববিরোধ, জন্মলগ্নেই উপন্যাস তা বহুলাংশে আত্মস্থ করে ফেলে। আর যুদ্ধোত্তর কালের জটিল জীবন-অনুধাবন ও তার রূপায়ণের প্রয়োজনে ঔপন্যাসিক-নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে রূপান্তর হয়ে পড়ে অনিবার্য।
পুঁজিবাদী সভ্যতা এবং তার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কলোনিসমূহের অন্তর্গত সমষ্টি ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের ক্রমবর্ধমান স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, তমসাচ্ছন্ন সময়-গহ্বরে সমষ্টিলগ্ন হতে না পারার ব্যর্থতায় ব্যক্তির আত্মরতি ও আত্মহনন এবং জীবনসংক্রান্ত মূল্যচেতনার আমূল পরিবর্তনের পটভূমিতে ঔপন্যাসিকদের নিকট প্রথাগত জীবনধারণা তাৎপর্যহীন বলে মনে হয়। তাঁদের চৈতন্য অনুরণিত হতে থাকে :
Traditional fiction is bankrupt, though whether focus it is true but boring or out rightly false is not clear, of course to say the latter would be to say we live in very bad times indeed. (Macolm Bradhury).এই বিরুদ্ধ সময়স্বভাবে যে বিপ্রতীপগামী চেতনার জন্ম দেয়, তা জটিল, দ্বন্দ্বময় ও বহুবর্ণিল। জীবনের সংজ্ঞার্থের ত্রূপ বদল হয় এবং সেই সঙ্গে সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রের এ্যান্টিস্বভাব মানুষকেও করে তোলে সবকিছুর এ্যান্টি। জন্ম লাভ করে Anti Novel--Anti-plot, Anti-hero, Anti time উপন্যাস। জীবনের রূপবদল উপন্যাসের আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও সাধন করে যুগান্তকারী রূপান্তরসম্ভাবনা। নতুন মানবীয় পরিস্থিতিতে (human conditions) মানুষের অস্তিত্বগত বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা ও ব্যর্থ সিসিফীয় সংগ্রামের শিল্পরূপ হিসেবে উপন্যাস হয়ে ওঠে নব নব মাত্রাসন্ধানী, বহুকৌণিক।
এভাবেই উপন্যাস নিজের আঙ্গিকের মধ্যে যে-কোনো কালের উপযোগী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা লালন করে। বর্তমান বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য ও নন্দনচিন্তার ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিক চিন্তনপ্রক্রিয়ার যে বিচিত্রমুখী প্রয়োগ লক্ষ করি, উপন্যাসশিল্পের জন্মকথা, তার বিষয় ও আঙ্গিকের স্বভাবের মধ্যেই সেই চিন্তনের পূর্বসুত্র সুষ্পষ্ট। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সমাজ ও মানবমনের আধুনিকায়নের যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে উপন্যাসের স্বভাবকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, সে আধুনিকতার স্থিরতার কিংবা পরিপূর্ণতার কোন নিদর্শন সভ্যতার ইতিহাসে আমি দেখি না। বরং লক্ষ করি Modern বা আধুনিক এ ধারণাটিকে কেন্দ্র করে চিন্তনবিলাসী মানুষেরা বিচিত্র মতামতের এক পর্বত সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ‘আধুনিকতা’ ধারণাটির জন্ম যে সব সমাজে, সেই সমাজেরই ‘ভাঙনের আলামত, কৃত্রিমতার আলামত, যান্ত্রিকতার আলামত’ উপন্যাসের জন্মকে অনিবার্য করে তুলেছিলো।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এ-সত্য আমরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করি যে, বুর্জোয়া সভ্যতা তার যে প্রত্যেকটি তত্ত্বকথাকে নিজ নিজ উপনিবেশগুলোর ওপর আরোপের চেষ্টা করেছে এবং সব কালেই এক শ্রেণীর বশংবদ তাত্ত্বিকও তারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে বিভিন্ন দেশে। কিন্তু প্রতিটি সমাজ নিজ নিজ স্বভাব, শব্দরূপ, সংলাপের চরিত্র, লোককথা, শ্রেণীরূপ প্রভৃতির ভিত্তিতে ওইরূপ তত্ত্ব বা চিন্তাকে গ্রহণ বা আত্মস্থ করতে চেয়েছে।
ইউরোপের কাছ থেকেই আমরা পেতেছিলাম আধুনিকতা ও স্বাধীনতা নামক দুটি ধারণা, এবং তাদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে উত্তরাধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশিবাদ জাতীয় ধারণাগুলো। এই সব ধারণা বা থিসিস থেকে যে এ্যান্টিথিসিস তৈরি হয়েছে, তা একেকটি সমাজের নিয়মেই বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের উপনিবেশগুলো ‘প্রভু’র বচনকে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, সৎশিল্পের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। লাতিন আমেরিকা কিংবা স্পেনের বিশাল মানবিক পরিসরে উপনিবেশকালে যে সাহিত্যরূপগুলোর জন্ম হয়েছে, গভীর বিশ্লেষণে সেখানে একটা Anti স্বভাবই মূলত প্রত্যক্ষ করি। কবিতা কিংবা নাটকের বহু পূর্বে এই এ্যান্টি-স্বাভাবের জন্ম দিয়েছে উপন্যাস। মিখায়েল বাখতিনের দস্তয়ভস্কির উপন্যাস কিংবা উপন্যাসের সংলাপরহস্য বিশ্লেষণে এই বিরুদ্ধ (Anti) চিন্তার পূর্ণতর একটি ধারণা আমরা লসভ করি।
উপন্যাসের স্বভাবব্যাখ্যায় মনোনিবেশ করলে সময় ও সমাজের এত বিচিত্র-রূপ তরঙ্গ এতে বিধৃত হতে দেখি, যার অনুধাবন বহুকৌণিক শিল্প-অভিরূচি ছাড়া অসম্ভব। উপন্যাসের তত্ত্ব-ব্যাখ্যামূলক অধীত জ্ঞান থেকে যে বিষয়টি আমার কাছে সুষ্পষ্ট, তা হল উত্তরাধুনিকতা একটি তত্ত্ব, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি অভিরুচি। সমাজ ও ব্যক্তির মানদণ্ড এই তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিরুচিকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিল্পবিচারের স্থিতিস্থাপকতার সূত্র উপন্যাস থেকেই আমরা লাভ করি।
লেখক পরিচিতি
রফিকুল্লাহ খান
রফিকুল্লাহ খান
জন্ম ১৯৫৭। মানিকগঞ্জ।
অধ্যাপক। বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অভিসন্দর্ভ ǁ বাংলাদেশের উপন্যাস (১৯৪৭-১৯৮৭) : বিষয় ও শিল্পরূপ।
অধ্যাপক। বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অভিসন্দর্ভ ǁ বাংলাদেশের উপন্যাস (১৯৪৭-১৯৮৭) : বিষয় ও শিল্পরূপ।
বই ǁ আখ্যানতত্ত্ব ও চরিত্রায়ণ। প্রকাশক : চারুলিপি, ঢাকা।
1 মন্তব্যসমূহ
লেখাটি জরুরি, কিন্তু খুব সংক্ষিপ্ত। বিস্তৃত পরিসরে এই আলোচনা চলতে পারে।
উত্তরমুছুন(খান স্যার তাঁর নাম রফিকউল্লাহ খান লিখে থাকেন।)