অমর মিত্র'র গল্প : বাবার অফিস

বাবার অফিস রাইটারস বিল্ডিং। মহাকরণ। বেলগেছিয়া থেকে দু নম্বর ট্রামে করে বাবা অফিসে যান। হাঁটা পথে ট্রাম ডিপো। ডিপোয় গিয়ে জানালার ধারে একটি সিট, বাবা বাইরে তাকিয়ে আছেন। ট্রাম কখন ছাড়বে? খাঁকি ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আসছে কি? তারা সকলে এই যাত্রী কেন, নিত্যযাত্রীদের অনেককেই চেনে।
বাবার গায়ে শাদা হাওয়াই শার্ট, গ্যাবারডিনের অফ হোয়াইট রঙের প্যান্ট। বুক পকেটে হলুদ মান্থলি টিকিট। ট্রাম ছাড়ল ঘন্টা বাজিয়ে। ডিপো থেকেই সিট সব ভর্তি। ট্রাম ডিপো থেকে বেরিয়ে কাছিমের পিঠের মতো মস্ত এক ব্রিজে উঠতেই বাবা চোখ বোজেন, একটু ভাত ঘুমে বৌবাজার, ওখান থেকে ট্রাম ডান দিকে ঘোরে, টিং টিং করতে করতে ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে ট্রাম লাল দীঘির দিকে গড়ায়। বাবা ঘড়ি দেখছেন চোখ খুলে। দেরি হয়নি তো। দেরি হয় না। অফিস টাইমের ট্রাম ঘড়ি ধরে ছাড়ে। ঘড়ি ধরে পৌঁছয় ডালহৌসি স্ক্যোয়ার। তখন কি নাম বদলেছে ঐ অঞ্চলের? না, তখনো তা সায়েব গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নামেই চিহ্নিত। লাল দীঘি ঘিরে কত অফিস কাছারি। বাবা বলতেন, ঐ জায়গা থেকে এসপ্ল্যানেড, পার্ক স্ট্রিট সব ছিল হোয়াইট টাউন। শ্বেতাঙ্গদের শহর। আর নেটিভদের শহর ছিল উত্তর কলকাতা। ব্ল্যাক টাউন। স্বাধীনতার পর আর শ্বেতাঙ্গ বসতি থাকল না। কিন্তু সেই অফিস সেই সচিবালয়, মন্ত্রী আমলা কেরানি বড় বাবু, সব রয়ে গেছে। রাজ্য শাসনের লাল বাড়িটি রয়ে গেছে। তার সমুখে লাল দীঘি। রাজা নেই গভর্নর আছেন। মন্ত্রী আছেন। মন্ত্রীরা শাসন করেন রাজ্য। শাসন করার কেন্দ্র বাবার অফিস। ওই লাল বাড়ি থেকেই রাজ্য চলে। কোচবিহার, দারজিলিং জেলা থেকে ২৪ পরগণা। বাবা সেই অফিসে চাকরি করেন স্বাধীনতার পর থেকে। তার আগে ঢাকায়। তখন ব্রিটিশ ভারত। দেশ দুখন্ড হয়ে গেলে অপশন দিয়ে ভারত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারে, এই মহাকরণে।

বাবা তখন বসেন অসংরক্ষিত অঞ্চলে হাটের ভিতরে আলমারি আর ফাইলের তাক দিয়ে ঘিরে তৈরি করা এক চিলতে ঘরে। ঘর বলা যায় আবার যায়ও না। একটু আড়াল দেওয়ার প্রচেষ্টা বলা যায়। প্রমোশনে বাবা সহ সচিব । তাও সেই অর্ডার চেপে রাখা ছিল অনেক দিন। প্রমোশনের ফাইলই সরিয়ে দিয়েছিল নাকি শক্তিবাবু। তাঁর বাৎসরিক রিপোর্ট খারাপ ছিল। কাজ না করে ফাইল জমিয়ে রেখে, ফাইল মিসিং করে শক্তিবাবু জীবন বীমা করে বেড়াতেন। স্ত্রীর নামে এজেন্সি। বাবাকেও বলেছিল বড় একটা পলিসি করতে। না করায় ফাইল হাপিস। মানে গুঁজে দিয়েছিলেন পুরোন সব ফাইলের ভিতর। গুঁজে দিলে তা খুঁজে বের করে কে? সে যাক বাবা নিজে হাতে ফাইল নিয়ে গিয়ে সই করিয়ে আনেন। নিজে তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, নিজেই যান ডেপুটি সেক্রেটারির ঘরে, তারপর জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়ে সেক্রেটারি, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির কাছে যাবে ফাইল। তিনিই আমলাকুলে এক দপ্তরের শিরোমণি। সাধারণ বিষয় সেখানেই শেষ হয়। তার চেয়ে বড় কিছু বিষয় হলে মন্ত্রী মশায় কলমের খোঁচা দেন। তার চেয়েও বেশি হলে সেই ফাইল স্বরাষ্ট্র সচিব হয়ে মুখ্য সচিব, তারপর মুখ্যমন্ত্রী। তারপর ফিরতে থাকে নিচের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নামা ফাইলের ভবিষ্যত। আর সেই ফাইলেই লেখা থাকে কতজনের আশা আকাঙ্ক্ষার পরিণাম। ফাইল নেমে আসে সেই অলীকবাবুর কাছে। অলীকবাবু আমার বাবা। বাবার নিজের অসংরক্ষিত অঞ্চল হাটের মতো গমগম করে সমস্তদিন। কাজ হয় আড্ডা হয়, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান হয়, বাজার দর, চাপা গলায় রাজনীতি...সব হয়। আবার তার ভিতরে কাজও। কত মানুষের কত রকম ঘটনা। তার জন্য রাইটার্সে এসে কেরানিবাবু বড়বাবুর কাছে খোঁজ, কী হলো সেই ফাইলের গতি? যারা আসে তাদের ভিতরে উত্তরবঙ্গের মানুষও যেমন আছে, হুগলির লোকও আছে। তাদের ভিতর মফস্বলের মানুষ যেমন আছে। তেমনি আছে মফস্বল থেকে আসা সরকারী কর্মচারীও। জেলায় জেলায় যত অফিস, সব অফিসের মাথা এইটা। এখান থেকে আদেশ না গেলে কাজ হবে না। বাবা অলীকবাবু বাঁকুড়া জেলার নপাহাড়ি ব্লকের বিডিওর সাসপেনশনের মোটা ফাইল হাতে যাচ্ছেন উপরের সায়েবদের কাছে। ন’মাস বয়স এই ফাইলের। সেই নভেম্বরের ঘটনা। জেলা অধিকর্তার রিপোর্টে প্রমোটি বিডিও বিপত্তারণ মন্ডল সাসপেন্ড হয়ে আছেন। এদিকে মানুষটির রিটায়ারমেন্ট সামনে। যা কিছু হয় হোক একটা। নাহলে সাসপেন্ড থেকেই অবসর নিতে হবে বিপত্তারণকে। পেনশন, গ্রাচুইটি সব আটকে যাবে। একটি নোট শিট আর দরখাস্ত নিয়ে যে ফাইলের শুরু, তার ভিতরে কাগজ জমতে জমতে খুব মোটা হয়েছে তা। অলীকভূষণের মনে হয়েছে উপরওয়ালার ক্রোধের বলি হচ্ছে লোকটা। তাঁর ঘরে আজও বসে আছে। অর্ধেক বেতন পেত। এখন সেভেনটি ফাইভ পারসেন্ট পাচ্ছে। কিন্তু ইনক্রিমেন্ট হয়নি। অবসর সামনের জানুয়ারিতে। তখন আর কিছুই পাবে না। জেলা অধিকর্তা চাইছে তাই হোক। লোকটার শিক্ষা হোক। শিক্ষা যথেষ্ট হয়েছে। উপরওয়ালার কথা অমান্য করতে নেই। তিনি অন্যায় করতে বললেও তা করতে হবে। না হলে কোনো রকমে এড়াতে হবে। সমাজের ক্ষমতাবান ও অবস্থাপন্ন মানুষের বিপক্ষে যেতে নেই। এখনো চার্জ শিট জমা পড়েনি। তারপর তো ইনভেস্টিগেটিং অফিসার বিচার করবে। বিডিও বেআইনি কয়লা খাদান বন্ধ করতে গিয়েছিল। কাজটা গর্হিত নিশ্চয়। রিটায়ারমেন্টের মুখে এসব কাজ না করলেই কি হত না? ঐ অঞ্চল দামোদরের অববাহিকা। মাটির নিচে কয়লা। গ্রামে গ্রামে এমনি খাদান কেটে কয়লা তুলে সমস্তরাত ধরে গরুর গাড়িতে করে পাচার হয়। দামোদরের ওপারে তো ইস্টার্ন কোল ফিল্ড। রানিগঞ্জ, আসান্সোল......সরকার অধিগৃহিত কোল মাইনস অনেক। এপারের খাদান মানে বিহারিনাথ পাহাড়ের কোলে মাটি কেটে কয়লা বের করা। যার এই ব্যবসা যিনি করেন তাঁর খুব প্রতাপ তাদের ঐ গঞ্জে। অনেক জমি, ব্যবসা, আর বেআইনি খাদান। শুধু গঞ্জে কেন জেলাতেও। জেলা অধিকর্তা নাকি বারণ করেছিলেন ঐ সব দিকে মন না দিতে। আগে তো একটা রিপোর্ট গিয়েছিল উপরে। নোট ফর অর্ডার। কিন্তু কোনো আদেশ আসেনি। তখন বিডিও নিজে হাতে নিয়েছিলেন বিষয়টি। থানার ওসি তাঁকে বারণ করেছিলেন। সবদিকে নজর দিতে নেই স্যার। ওসি লোকটা ভাল ছিল। সেই ঘটনার পর বদলি হয়ে উত্তরবঙ্গে। সেই আলিপুরদুয়ার। আজ সহ সচিব ফাইলে দীর্ঘ একটি নোট দিয়েছেন। বিপত্তারণ মন্ডলের চাকরি জীবনে কোনো ময়লা দাগ নেই। তাঁর সার্ভিস বুকে কোনো লাল দাগ নেই। তার বিষয়টি অবিলম্বে নিষ্পত্তি ঘটান যেতে পারে। উপসচিব অবধি তাঁর নোটের সঙ্গে একমত। এবার জয়েন্ট সেক্রেটারি কী বলেন? সহ সচিব অলীকভূষণ জানে না কী হবে। এই ন’মাসে বিডিও লোকটি বুড়ো হয়ে গেছে। উদ্বেগে জীর্ণ হয়ে গেছে। সামনে ভয়ানক ভবিষ্যত। অবসরের টাকা পয়সা না পেলে মেয়ের বিয়ে হবে না। ছেলে বেকার, নকশাল করে, পুলিশের হাতে বাঁচবে কি না সন্দেহ। পূববঙ্গের বরিশাল জেলার মানুষ বিপত্তাতারণ। অলীকভূষণের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা। কলকাতার কাছেই বলা যায়। ২৪ পরগণার বসিরহাট থেকে মাইল পনের। সাতক্ষীরে খুবই নিস্তরঙ্গ জনপদ। বরিশাল ছিল বিপ্লবীদের জেলা। বরিশালে কত বড় বড় মানুষের জন্ম। কবি জীবনানন্দ দাশ, মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত। বরিশালে এক কলেজ আছে বি,এম, কলেজ। খুব নামকরা। কীর্তনখোলা নদীর তীরে বরিশাল শহর। সেই বরিশাল জেলার লোক বিপত্তারণ মন্ডল। বরিশালি গোঁ আছে লোকটার। হবে না ? কত বড় বড় মানুষের দেশ ওই জেলা। আজ অলীকভূষণ শুনেছে বরিশালের তার পৈতৃক ভিটে হলেও বিডিওর জন্ম মামার বাড়ি ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। গ্রামের নাম পূরবশিমুলিয়া। সেই গ্রাম বাদল গুপ্তের। কোন বাদল ? মন্ডল আজ বলল, স্যার বিপ্লবী বাদল গুপ্ত, আমার মায়ের কাছে তাঁর কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, আমার ছেলেকেও সেই কথা শোনাতাম......।

ফাইল নিয়ে সেখান থেকে ফাইল হাতে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করলে সব নিঝুম। গেটে আগে থাকত ব্রিটিশ আমলের লাল পাগড়ির পুলিশ। সব বদল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্বাধীনতার ২৫ বছর হয়েছে সবে। এখন এমনি পুলিশ। সবাই তো ঢুকতে পারে না সেখানে। বড় বড় সায়েবরা বসেন। মন্ত্রী বসেন, যে কেউ ঢুকলে হলো? আমার বাবা অলীকভূষণের ভিতরে একটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উপসচিব একমত হয়েছেন। ফাইল এখন ডি-গ্রুপ কর্মচারী কেউ দিয়ে যেতে পারত যুগ্ম সচিবের ঘরে। তিনি ফেলে রাখতেন কিংবা সহমত হয়ে উপরে পাঠাতেন। সহমত না হলে ফাইল ফেরত চলে আসত। এতবড় সচিবালয় কথা চলে ফাইলে ফাইলে। কখনো ফাইলে নোট আসে, ডিসকাস। আলোচনায় ডাকেন উপসচিব কিংবা যুগ্ম সচিব। সেই করিডোর দিয়ে হেঁটে ফাইল হাতে জয়েন্ট সেক্রেটারির ঘরের দিকে যাচ্ছেন। দাঁড়ালেন। লম্বা করিডোর। ধারে এসে দাঁড়ালে লালদীঘি, লাল দীঘির ডানদিকে রিজারভ ব্যাঙ্ক। কোনাকুনি জি,পি,ও। ট্রাম পুরো লালদীঘি ঘুরে আসে ফেরার জন্য। অলীকভূষণ তখন এদিক থেকেই ট্রামে চাপেন। বিকেল পড়ে যায় কাজ সেরে বের হতে। তখন সেই সেই ধূসরতার ভিতরে ধীরে ধীরে নির্জন আর নিস্তব্ধ হতে থাকে লর্ড ডালহৌসির নামের এই অঞ্চল। লালদীঘি। একটু দূরের হাই কোর্ট, কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের অফিস। কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের অফিস। আমি তখন ওখানে নাম লিখিয়েছি চাকরির জন্য। আমার খুব ইচ্ছে বাবার অফিসে চাকরি পাই।

ফাইল হাতে অলীকভূষণ অলিন্দে এসে দাঁড়ালেন। মস্ত জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। যদি যুগ্ম সচিব না করে দেন। আইন আইনের মতো চলবে। দেরি হলে কিছু করার নেই। সরকারের কর্মচারীর দায়িত্ব উপরওয়ালার কথা শোনা। জেলার কর্তা বিডিও বিপত্তারণকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, ইগনোর করতে।

অফিসের বড়বাবু বলেছিলেন, স্যার, বাদ দিন, ওদের হাত অনেক বড়।

একজন কেরানি বলেছিল, আপনি চাইলে আপনার ঘরে প্যাকেট চলে আসবে স্যার।

বড়বাবু বলেছিল, আমরা স্যার পুজোর সময় বোনাস পাই করালী সাহার কাছ থেকে।

আপনি ইগনোর করলেন না কেন? অলীকভূষণ জিজ্ঞেস করেছিলেন।

বরিশালের বিপত্তারণ বলেছিল, ইগনোর করবই ঠিক করেছিলাম, কিন্তু কী যে হয়ে গেল, সে আমি বোঝাতে পারব না স্যার।

জায়গাটা ছোটবড় টিলা পাহাড়ে ঘেরা। বিডিওর কোয়ার্টারের জানালা দিয়ে সবচেয়ে বড় পাহাড় বিহারিনাথ দেখা যায়। রাতভর গরুর গাড়ি করে বেআইনি খাদানের কয়লা যায় হাইওয়ের দিকে। বিডিও তা ঘরে বসে টের পায়। শোনা গিয়েছিল কয়লা তুলতে গিয়ে কয়লার চাঙড়ের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল এক বালক। কথাটা ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছিল এলাকায়। কিন্তু কোনো অভিযোগ আসেনি। ভয় দেখিয়ে সেই পরিবারের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল খাদানওয়ালা। বিডিও শুনেছিল, থানা পযর্ন্ত আসেনি অভিযোগ। মনে পড়ে গিয়েছিল মা কাঁদত তার একটি বোনের জন্য। সাত বছর বয়সে টাইফয়েডে মরে গিয়েছিল। মায়ের মুখ মনে পড়েছিল। মা বাদল গুপ্তের গ্রামের মেয়ে। রাত্তিরেই থানায় চলে গিয়েছিল বিডিও। কয়লা পাচার বন্ধ করতে পারলে খাদান বন্ধ হবে। বালকের মৃত্যু থামবে। প্রায়ই তো ধস নামে খাদানে। আচমকা এই কথা মনে হয়েছিল সন্ধের পর। অলীকভূষণ অবাক হয়ে শুনেছিল শীর্ণকায় লোকটির কথা। কয়েক মিনিটেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। পুলিশ নেমে পড়ল বিডিওর সঙ্গে।

অলিন্দ দিয়ে হাঁটছেন অলীকভূষণ। এই সেই অলিন্দ। বিনয় বাদল দিনেশের অলিন্দ। আচমকা তাঁর যেন মনে হলো বাদল বসে আছে তাঁর ঘরে। অলীক কিছু অনুভব করলেন। অলিন্দ আচমকা ফাঁকা হয়ে গেল। লালপাগড়ি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে দরজায় দরজায়। দীর্ঘ অলিন্দে জুতো মশমশিয়ে তিন যুবক। ওয়ান্ট টু মিট মিঃ সিম্পসন, ডি,আই,জি, জেল। হ্যোয়ার ইজ মিঃ সিম্পসন? বলতে বলতে ঢুকে পড়েছে পুরোদস্তুর সায়েব হয়ে আসা তিনজন। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দিনেশ গুপ্ত। সিম্পসন কারা দপ্তরের মাথা। জেলবন্দী বিপ্লবীদের উপর ভয়ানক পীড়ন আর অত্যাচার চালাত। সে এক কুখ্যাত সরকারী কর্মচারী। তার ঘরেই ঢুকে পড়ল তিনজন। সায়েব তখন নেটিভ বড়বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করছিল কোন উপায়ে বিপ্লবী টেররিস্টদের সুলুক খুঁজে বের করে লালবাজারে পুলিশ কমিশনার টেগারটের কাছে পৌছে দেওয়া যায়। টেররিস্টদের শেষ করাই বড় কাজ প্রশাসনের।

তখন ডিসেম্বর মাস। গল্প আমি বাবার কাছে ছোটবেলায় শুনেছি। ঢুকে পড়ে তারা সিম্পসন সায়েবকে খুঁজে বের করেছিল। সে অনেক কাল আগের কথা। ১৯৩০। বাবার তখন বছর বারো। তারিখ ৮ই ডিসেমবর। সিম্পসনকে হত্যা করে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিপ্লবীরা। অলিন্দে এক যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে আরো দুজন সায়েব গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। বেরিয়ে আসতে পারবে না তা তারা জানত। বাদল ধরা দেয়নি। একটি ঘরে বসে পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে দিয়ে ঢলে পড়েছিল। বিনয় আর দিনেশকে জীয়ন্ত ধরেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু ডাক্তারির ছাত্র বিনয় হাসপাতালেই আত্মহত্যা করেছিল মাথার ব্যান্ডেজে আঙুল চালিয়ে ঘা বিষাক্ত করে দিয়ে। দিনেশের ফাঁসি হয়েছিল। অলীকভূষণ সমস্ত দৃশ্যটি দেখতে দেখতে বারুদের গন্ধ নিতে নিতে যুগ্ম সচিবের ঘরের দিকে এগোতে লাগলেন কম্পিত পায়ে। অলিন্দ যুদ্ধ শেষ হয়েছে যেন সবে। তাঁর ঘরে একজন বসে আছে। তিনি তাকে মুক্ত করবেন বলে ভেবে এসেছেন। কিন্তু কী করে? সায়েবকে বলবেন, বরিশালের লোক স্যার। বাদল গুপ্তের গ্রামে ওর মামা বাড়ি। বিপ্লবী বাদল গুপ্ত। খুব অনেস্ট। সার্ভিস বুকে কোনো দাগ নেই। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যে। বেআইনি খাদান বন্ধ করতে চেয়েছিল। দেখুন অভিযোগ কত ঠুনকো।

তিনি ঢুকেছেন স্যারের ঘরে। ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে। ডিসকাস করবেন। কিন্তু ঘরে আর একজন যে বসে আছে। মিঃ সিম্পসন। জেলার কর্তা। সেই গদাধর চন্দ। তার খুব ক্রোধ। সেই ক্রোধে পুড়ছে বরিশালের বিপত্তারণ। অলীকবাবু ফাইল এনেছেন? যুগ্ম সচিব জিজ্ঞেস করলেন।

স্যার। কিছুই হ্যাঁ না বলতে পারেন না অলীকভূষণ। শেষে বললেন, আচ্ছা স্যার আনছি। বলে বেরিয়ে এলেন অলীকবাবু। স্যার বলছেন, ডিসকাসের জন্য বাঁকুড়া থেকে মিঃ চন্দকে ডেকে এনেছেন। তাঁর কাছেও শুনবেন। বাইরে এসে করিডোরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলেন অলীক। তাহলে? গদাধর চন্দ কি ছাড়বে ? মেরে ফেলে দেবে বাদল গুপ্তকে। সুইসাইড না করা অবধি ফাইল সজীব রাখবে। নাহ!

বাবা বলেছিলেন, তিনি অলিন্দে সেই কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন। বিনয় বাদল দিনেশ তিনজন তাকে বলছে, যান, অলীকবাবু যান, এটা একটা ভাল মানুষকে বাঁচানোর কাজ। এই অলিন্দ পার হয়ে এসে আপনি ফিরে যাবেন? বাবা ফাইল হাতে ঢুকেছিলেন। বাইরে তিন বিপ্লবী দাঁড়িয়ে। বাবা ফাইল খুলে ছিলেন......।

তারপর কী হলো?

বাবা বললেন, আলোচনা আরম্ভ হলো বিডিওকে নিয়ে।

তারপর?

বাবা বললেন, আলোচনা চলতে লাগল, গদাধর চন্দ কিছুতেই একমত হচ্ছেন না, তখন বিডিও আমার ঘরে একা বসে, অফিস ছুটি হয়ে গেছে।

তারপর?

বাবা বললেন, অলিন্দ যুদ্ধ, তাঁরা আমাকে সাহস যোগাতে লাগলেন বাইরে দাঁড়িয়ে।

হয়েছিল হয় তো ? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। জবাব পাইনি। শেষটা বাবারও জানা ছিল না।

এই আমার বাবার অফিস। মহাকরণ। আমি এখানেই কেরানির কাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু এখনো এত বছরেও এ আমার অফিস হয়নি। বাবার অফিস। তিন বিপ্লবীর মহাকরণ। এখন তাঁদের নামেই এই অঞ্চল। অফিসের সবটাই প্রায় উঠে গেছে নবান্নে। আমার ডিপার্টমেন্ট আছে এখনো। আর নির্জন অলিন্দ আছে। শূন্য অলিন্দে আমি তাঁদের দেখতে যাই। তাঁদের পায়ের শব্দ শুনতে যাই। বারুদের গন্ধ শুঁকতে যাই। খুঁজি সেই ঘর যে ঘরে বাদল গুপ্ত সায়ানাইড মুখে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পরও বিডিও বসেছিল আমার বাবার জন্য। কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল বাবা বলতে পারেননি। ফাইল যুগ্ম সচিবের কাছে রেখে এসেছিলেন। তারপর আচমকা সমবায় দপ্তরে তিনি বদলি হয়ে গেলেন সাতদিনের মাথায়। তারপর...। ফাইল বিশ্রামে গেল। সচল হলো। বিশ্রামে গেল। লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবার ঘরে বসে। ফিরে এসে তাই দেখেছিলেন বাবা। তিনি সেই কথাটা এই অবধি বলে চুপ করে যেতেন।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ