হোটেল রুমে ঢুকেই কাঁধ থেকে ক্রস ব্যাগ খুলে সজোরে টেবিলের ওপর রাখে অনিতা। ফোমের বিছানায় ধপাস করে ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দেয়। নরম বিছানার মাঝ বরাবর আড়াআড়ি। চোখ দুটো সিলিং ফ্যানের দিকে। বেশ পুরনো ফ্যান। অফ হোয়াইটের ওপর হালকা সোনালি বর্ডার। ধীরে ধীরে পাখা ঘুরতে শুরু করল। ঘরময় বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আরামে চোখ বুজে সে। শাহেদ ফ্যানের সুইচ অন করে ঘরের একমাত্র জানলা খুলে দেয়। বলে- সাগর দেখা যাচ্ছে, অনি!
অনিতা জানলার দিকে এগিয়ে শাহেদের পাশে দাঁড়ায়। উজ্জ্বল নীল সাগর। দূর থেকেও ঢেউয়ের সাদা ফেনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এক নিমিষেই ওর মন ভালো। শাহেদ তার কোমরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত রাখে। দুজনই সাগরের দিকে তাকিয়ে। শাহেদ বলে- একটা হট শাওয়ায় নাও দেখবে একদম ফ্রেশ লাগছে। গোসল করেই বেরিয়ে যাব। লাঞ্চ করে বীচে হাঁটব। মাত্র বিকেল হয়েছে। সূর্যাস্ত মিস করতে চাচ্ছি না।
অনিতা নিশ্চুপ। কোমর থেকে শাহেদের হাত সরিয়ে খাটে এসে বসে। ট্রলি টেনে বডি ওয়াশ, শ্যাম্পু বের করে। তারপর শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকে যায়। শাহেদ নিজেও ক্লান্ত। দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়েই সিগারেট ধরায়। বুকের ডান দিকে একটু চিনচিনে ব্যাথা। গ্যাস হয়েছে নিশ্চয়ই। অনিতার ব্যাগে ওষুধ আছে। না বলে শাহেদ তার ব্যাগ ধরে না। ধরলেও সে কিছু মনে করবে না। তবুও শাহেদ কিছু ব্যাপারে অন্যের ব্যক্তিগত সীমারেখা অতিক্রম করে না। এটা তার নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য।
শাহেদ লক্ষ্য করেছে হোটেলে ঢোকার পর অনিতা একটা কথাও বলেনি। এই এক মুশকিল অনিতাকে নিয়ে। অসম্ভব মুড সুইং হয়। উচ্ছ্বলতার মতো বিষণ্ণতারও কোন দিনরাত নেই। কখনো সাজ বর্জিত তপস্যারত সাধিকা। কখনো সাজ চর্চিত রাজইন্দ্রানী। আপাত গম্ভীর অনিতার চোখে মাঝে মাঝে শাহেদ কিশোরীর চপলতা দেখে। বেশিক্ষণ নয় খানিক ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে যায়। গত পাঁচ বছরে শাহেদ এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অনিতার মন বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায় ক্ষান্ত হয়েছে। তবু হঠাৎ ধাক্কা লাগে। এই যেমন এখন লাগল।
সেইন্ট মার্টিন’স আইল্যান্ড। সাগরকন্যা সমুদ্রপুরী থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। সর্বাঙ্গে প্রবাল জড়িয়ে। বিবর্তনবাদের সূত্রানুযায়ী সময়ের সাথে সাথে আইল্যান্ডের লেজ খসে এখন শুধু সেন্ট মার্টিন হয়ে গেছে। এখনো বিদ্যুৎ আসেনি দ্বীপে। ইদানিং কিছু জেনারেটর দেখা যায়। রাত দশটার পর জেনারেটর বন্ধ। এতে বরং ভালো হয়েছে। কৃত্রিম আলোহীন এ প্রবাল দ্বীপ অনিতাকে অপরিশোধিত আদিম বুনোভাব নিয়ে আকর্ষণ করে।
ডিসেম্বরের বিকেল। ধুলোয় পা ডুবিয়ে হাঁটছে শাহেদ অনিতা। পুরো দ্বীপ যেন নারকেল গাছের বাগান দিয়ে সাজান। গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু পরে পরে ঠাণ্ডা এলোমেলো হাওয়ায় চিকন পাতারা দুলে উঠছে। পাতায় হাওয়ার ঝিরঝির। দীর্ঘ শ্বাস টেনে অনিতার ফুসফুস বাতাসে ভরপুর। জাহাজ ঘাটের বাজারে গিয়ে রূপচাঁদা ফ্রাই খেল ওরা। রাস্তার দু পাশে সারি সারি মনিহারী দোকান। খেলনা, শামুক ঝিনুকের নানান শৌখিন জিনিসপত্র। বার্মিজ আচার, স্যান্ডেল, মুলতানি মাটি সাজিয়ে দোকান বসেছে। মৌসুম শেষ হলেই দোকানীরা মাছ ধরতে ‘দরিয়া’য় চলে যাবে। হঠাৎ নাকে শুঁটকীর গন্ধ ঝাপটা দেয়। কী বিরাট একেকটা শুঁটকী! কারবারীরা এসে দাম দস্তুর করে। সাধারণ পর্যটকরাও ‘ফ্রেশ’ শুঁটকী কিনে নিয়ে যায়। শুঁটকীর গন্ধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাতাসে হারিয়ে যায়।
অনিতার বেশ ফুরফুরে লাগছে। অনেকদিন পর সে শাহেদের হাত ধরে হাঁটছে। ভালো লাগছে অনিতার। সাগরের তীর ঘেঁষে কেয়া গাছের ঝোপ। দ্বীপের এ প্রান্তে কোনো ভিড় নেই। দুএকজন বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবাক হয় সে। অনিতা শাহেদকে বলে- পর্যটন মৌসুমেও এখানে একজন মানুষ নেই! কী আশ্চর্য। ‘আজকে উইক ডে তাই ভিড় নেই’ শাহেদ জানাল, ‘কাল দেখো কেমন ভিড় হয়।’ তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা চায়ের টং দোকান। দোকানের সামনে বসল ওরা। সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে। কেয়া পাতার ছাউনী। চারটি বাঁশের খুঁটিতে ভর দেয়া। যেন দোকান ছাড়িয়ে দোকানের চাল সামনে এগিয়ে গেছে। চমৎকার সাগর দেখা যাচ্ছে।
কাছেই এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক চা পান করছেন। বার্মিজ চা। সামনের দিকে ডান পাশের খুঁটির দিকের চেয়ারটায় বসেছে অনিতা। খুঁটির ওপর কেয়া ফলের থোকা ঝুলছে। তার পাশে শাহেদ। অনিতার ভেজা চুল বাতাসে শুকিয়ে গেছে। হাত দিয়ে খোঁপা বাঁধল সে। বেশ কয়েকবার চুল পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধতে হলো। অনিতার চুল বেশ লম্বা।
দোকানী দুধ-চিনি মিশিয়ে দুগ্লাস চা এগিয়ে দিল। প্লাস্টিকের চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে শাহেদ বলে- এতক্ষণে কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। চল সাগরের পাড়ে হেঁটে আসি। অনিতা সবে চায়ে চুমুক দিয়েছে। সে বলে- তুমি যাও আমি চা শেষ করে আসছি।
শাহেদ এগিয়ে যায় সাগরের দিকে। সব সময়ই চা শেষ করতে অনিতার বেশ সময় লাগে। ধীরে ধীরে চা ঠাণ্ডা হয়ে তলানীটুকু এমন বিস্বাদ যে পুরোটা শেষ করা যায় না। দীর্ঘ দিনের চা পানের অভ্যাস থেকে অনিতা এখন বোঝে কখন থেমে যেতে হবে। কাপের তলায় বেশ খানিকটা চা ভাসতে থাকে।
-দেখুন কেমন হলো?
অনিতা চমকে মুখোমুখি বসা লোকটির দিকে তাকায়। প্রশ্নটি যে তাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে এটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল।
-জ্বী!
-এটা দেখুন।
লোকটি একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে দেয়। কাগজ না বলে বিস্কুটের প্যাকেট বলাই ভালো। ফেলে দেয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় অনিতা অবাক। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। কাগজের দিকে তাকিয়ে দেখল কিছু দাগ টানা। আঁকিবুঁকি কাটা। মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল সে কিছুক্ষণ। একটা মুখের আদল ফুটে উঠেছে।
-আপনি, আপনি আমার স্কেচ করেছেন!
-জ্বী, করেছি। আচ্ছা, আমি আসি।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। এবার লোকটির দিকে ভালো করে তাকাল অনিতা। সব কিছুই মধ্যম। শুধু বড় বড় উজ্জ্বল চোখ দুটো সাদামাটা চেহারায় বুদ্ধিবৃত্তিক আলো ফেলেছে। মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল। এই সল্ট এ্যান্ড পিপার লুক অনিতার খুব ভালো লাগে। অবিন্যস্ত চুল। ভদ্রলোক হয় চুল আঁচড়ান না নয়তো জোরাল সামুদ্রিক বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে গেছে।
আর কিছু না বলেই ভদ্রলোক হাঁটা শুরু করলেন। অনিতা একবার কাগজের দিকে আরেকবার লোকটির দিকে তাকাল। কাগজটা নেয়া ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছে না। অতো কিছু ভেবেচিন্তে অনিতা কাগজটা নেয়নি। ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর এবং চাহনিতে একটা সততা ও স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। যা অনিতার স্নায়ুর ওপর স্বভাবিক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। অজান্তেই সে হাত বাড়িয়েছে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এটা অনেকটা হাঁচি দেবার মতো একটা কিছু ধরে নিল অনিতার। দূরে শাহেদকে দেখা যাচ্ছে। অনিতা কাগজটা ব্যাগে ঢুকিয়ে গলার কাছে স্কার্ফ ঠিক করল তারপর বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।
শাহেদ অনিতা কে দেখছে। অনিতা সাগরকে। দুজনেই পানিতে পায়ের পাতা ভিজিয়েছে। আকাশ জুড়ে স্বপ্নের নাম-না-জানা মায়ারঙগুলো ভেসে যায়। গাঢ় রক্তিমাভার সাথে মিশেছে এ্যপ্রিকটের মিষ্টি কমলা, মধু রঙা সোনালীর গাল আদরে ছুঁয়ে দিল স্যাফেয়ার নীল। সাগরের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে বিচিত্র রঙিন লীলাভঙ্গী চারদিকে লালচে কমলা আলো ছড়িয়েছে। সে নরম আলো এসে পড়ছে অনিতার মুখে। শাহেদের খুব ইচ্ছে যায় দুটো হাতের পাতায় অনিতার মুখটাকে ধরে রাখতে।
টকটকে লাল সূর্য নেমেছে সাগরের বুকে। বাতাস বইছে সারাক্ষণ। আদিগন্ত বিস্তৃত সূর্যাস্তের আকাশ আর সীমাহীন সমুদ্রের বিশালতায় অনিতা তুচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়ে। নির্লিপ্ত অস্তগামী সূর্য। হাজার লক্ষ বছরী সূর্যাস্ত বেলা লাটিমের মতো ঘুরপাক খায়। শেষের কথা বলে। নির্বিকার আকাশ আর চিরবহতা সমুদ্র কিছুতেই তাদের কিছু আসে যায় না। শুধু অনিতার হৃদয় অনাসক্ত হয়ে উঠতে পারে না। প্রবল তৃষ্ণা বোধ করে সে। ভেতরে ভেতরে বিচলিত হয়। অস্থিরবোধ করে। ছটফট। শাহেদকে হোটেলে ফিরে যাবার কথা বলে। শাহেদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটতে থাকে অনিতা। টলতে টলতে ভেজা বালিতে মুখ লুকিয়ে রাখা এক টুকরো প্রবালে হোঁচট খায়।
শাহেদ অনিতার কাছে এসে বলে- শরীর খারাপ লাগছে? অনিতা নিরুত্তর। শাহেদ আবারো বলে- জার্নির ধকলটা কেটেনি। স্যালাইন এনেছিলে? মাথা ব্যাথা করছে?
-ওহ্!
একটি হতাশা এবং বিরক্তিজনিত শব্দ অনিতার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। এত কথা চারিদিকে। স্তব্ধতা পাবার জন্য এবার বুঝি নিজের কবর খুঁড়তে হয়। বাতাসের সব অক্সিজেন জীবনের ভেতর ঢোকাতে ব্যস্ত অনিতা। প্রাণবায়ু টিকিয়ে রাখার জন্য। একথা বলার প্রয়োজন মনে করে না যে সে সুস্থ আছে।
হোটেলে ফিরে সে শুয়ে পড়লো। রাতে কিছু খেলো না। শুয়েই রইল। অন্ধকার বাতাসের রাত। বাতাসে ভেসে সে ধূসর ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কালো পানির ঢেউ সেখানে। কোথায় যেন যেতে হবে। সবাই চলে গেল এক এক করে রিকশায়। সে তখনও দাঁড়িয়ে। কারও যাবার কথা তার সাথে। সেলাই মেশিনে লাল ফ্রক সেলাই হচ্ছে। খুলে ছড়িয়ে পড়ছে লেসের পুঁতি। লক্ষ লক্ষ অগুন্তি। ছিটকে উঠছে পিংপং বলের মতো। যেন বরফ কুচি আছড়ে পড়ছে তুষারকন্যার পায়ের কাছে। পুঁতি আর কুড়োন হয় না। হাত লাগতেই জ্বলে উঠল আগুনের স্ফুলিঙ্গ। সবেতেই তালগোল। পুঁতির বরফ। বরফের আগুন। ক্যানভাসে কী উত্তাল ঢেউ! বহু বহু জল মিলিত স্বরে কথা বলছে। অবিরাম রিকশার ক্রিং ক্রিং। কোথায় যেন যাবার ছিল সে, কারো সাথে। ক্যানভাসে ধুসর ঢেউয়ের ওপর একটা বন্ধ চোখ। চোখটা কার অনিতা ধারণা করতে পারে না। চোখ খোলা থাকলে হয়তো চেনা যেত।
পাশে শাহেদ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনিতা ভাবল- এ কে? এখানে শুয়ে আছে কেনো? কী হতো না থাকলে? সে-ই বা কী করছে এখানে? চলে যাবে? এসব অর্থহীন চিন্তা বাদ দিয়ে অনিতা পাশ ফিরে শোয়। মানুষের বেশির ভাগ ভাবনাই উদ্দেশ্যহীন। অনিতার ভাবনাও নিরর্থক। এমন অন্ধকার জলের গন্ডগোল সে আগে কখনো দেখেনি। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অনিতা। স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন খুব এক ঘুম।
সকালের রোদে সাগরের পানি নীল। আকাশের প্রতিবিম্ব সাগরে। প্রবালের জন্যই হয়তো সেইন্ট মার্টিন’স বীচে তেমন বালু নেই। কক্সবাজারে সাগর থেকে তীরে উঠলে প্রচুর বালু কাপড়ে লেগে থাকে। ওদের সাথে আরো কয়েকজন সাগরে নেমেছে। ছেলে ছোকরার দল। আজই এসেছে। টায়ার ভাসিয়ে ডুবছে ভাসছে। বীচ বল নিয়ে খেলছে। দূরে ঢেঊয়ের তালে দুলছে তিনটি ট্রলার। চিয়ারলিডারদের ছন্দময়তায়। ট্রলারে বাঁশের কঞ্চির ওপর বেধে রাখা এক টুকরো কাপড় তুমুল উড়ছে। চিয়ারলিডারের হাতে ফুলঝুরি হয়ে।
অনিতা সাঁতার কাটতে পারে না। তবু সে আবিষ্টের মতো সাগরের দিকে এগিয়ে যায়। আকন্ঠ পানিতে অনিতার মনে হলো এই ওজনহীন শরীরটা আদৌ তার নিজস্ব শরীর নয়। মাথাটাই শুধু ওর। গলা থেকে পা পর্যন্ত শরীরটা অন্য কারো। বড় বড় ঢেউ এগিয়ে আসছে। রহস্যে রোমাঞ্চে প্রেমিকের মতোই। আছড়ে পড়ল অনিতার ওপর। উথাল পাথাল নোনা জলে চোখ জ্বলছে। এবার আর ভারসাম্য রাখতে পারল না। কিছুক্ষণের জন্য পায়ের তলার বালু সরে গেল। যাকে বলে হাবুডুবু খাওয়া। ঢেউ চলে গেল। গলা পানিতে উঠে দাঁড়ায় অনিতা। কয়েক মুহূর্ত আগের নির্ভার অনুভূতি মনে করে গা শিরশির। আশ্চর্য বোধ করে সে তারপর ঢেউ কেটে সাগরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। একের পর এক ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারসাম্য হারিয়ে বেসামাল। শাহেদ জোরে ‘অনি, অনি’ বলে ডাকতেই গলা পানি থেকে ফিরে আসে। হতাশ গলায় শাহেদ বলে- মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছে করেই একটা ঝামেলা করতে চাও। একটা অঘটন না ঘটালে তোমার শান্তি হবে না। অনিতা হাসে। অনাবশ্যক হাসি। কিছু বলে না।
বাজার থেকে কিছু স্যুভেনির কিনেছে অনিতা। এখন সাবধানে সেগুলো ব্যাগে ভরছে। কাল সকালে চলে যাবে ওরা। শাহেদ একটা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল। সময়ের কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে। তবু যেন অনিতার সমুদ্র দেখা ফুরায় না। সন্ধ্যায় শাহেদ আর বের হতে চায় না।
ব্যাগ গুছানো শেষ করে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল অনিতা। হোটেলের সামনে বার-বি-কিউ চুল্লীতে গোল গোল করে কাটা কাঠের টুকরো সাজানো। কয়লা দেয়া হচ্ছে। আজকে রাতে বার-বি-কিউ করবে কেউ। অনিতা রুমে ঢুকে দেখল শাহেদের হাতে হেইনিকেন। বাথরুমে গিয়ে সে ভাল করে হাত মুখ ধুলো। আজ বেশি সময় নিল। ক্রীম লাগালো। লিপ বামের সামান্য গোলাপি আভা ঠোঁটে। তখন সবুজাভ ক্যান থেকে বীয়ারে চুমুক দিচ্ছে শাহেদ আর ক্রস ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হোটেল থেকে একা বাইরে এলো অনিতা। হোটেল সংলগ্ন বীচে গিয়ে দেখল কয়েকটা দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ রাতে বার-বি-কিউ করবে। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো অনিতা। ঘোর কালো আকাশে বিন্দু বিন্দু সহস্র নক্ষত্র, উপ-নক্ষত্র জ্বলছে। কালো মখমলের ইজেলে কেউ যেন ফোঁটা ফোঁটা রূপালি রঙ ছুঁয়ে দিয়েছে।
-কী দেখছেন আকাশে? এত আত্মভোলা হয়ে?
- কালপুরুষ। এবার অনিতা চমকায় না। মরাল গ্রীবা সামান্য ঘুরিয়ে কাঁচা পাকা অবিন্যস্ত চুলের লোকটির দিকে তাকিয়ে সে উত্তর দেয়।
-আপনি অনেক সাহসী। একা বের হয়েছেন। জায়গাটা ভালো নয়।
-খুব বেশি সাহসের কাজ করেছি কি? সবে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বীচ জুড়ে কত মানুষ। আমারতো মনে হয় আপনি অনেক সাহসী। অনুমতি না নিয়েই কারো স্কেচ করে ফেলেন।
-সেকি! স্কেচ তো আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। মৃদু হাসি ফোটে ভদ্রলোকের চোখে-মুখে।
-দিয়ে দিলেন। সেটাই তো সাহসের ব্যাপার।
-কালপুরুষের আকৃতি লক্ষ্য করেছেন? পুরুষাকৃতি।
-তাইতো! লক্ষ্য করিনি আগে। ইন্টারেস্টিং। আপনি একজন চিত্রকর, তাই না?
-নিজে থেকেই আঁকি। কখনো শিখিনি। সহজাতভাবেই এটা আসে। ধরুন হাঁচি দেবার মতোই একটা রিফেক্স এ্যাকশান। এলে আটকান যায় না।
চমকে ওঠে অনিতা। কথা শেষ করেই ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। প্রাণ খোলা উদাত্ত হাসি।
-একজন জাত শিল্পীর সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
-ওরে বাবা! শিল্পী বলবেন না। আমি ডিজার্ভ করি না।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেন তিনি। গোল্ড লিফের একটা স্টিক তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে রেখে বলেন- শিল্পী হওয়া অনেক বড় ব্যাপার, জানেন? মার্গ সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সব আদিতে সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য। সবাই কি আর গুহাচিত্র এঁকেছে বলুন! কেউ কেউ ছিল যারা চাষের কাজ, পশু পালন, শিকার, রতিসুখ, সন্তান উৎপাদনের বাইরে কিছু অনুভব করেছিল।
ফস করে লাইটারের এক ইঞ্চি আগুন বাতাস চাটে। তিনি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরেন। অনিতার সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন- অতৃপ্তি তাড়িত হয়ে তারা সৃষ্টি করেছিল শিল্প। এই অতৃপ্তি হতে পারে সৃষ্টিকে জানার। কিংবা সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে পাওয়ায় আকাঙ্ক্ষা। শিল্পের উপাদান তারা নিজের অজান্তে হাতে তুলে নিয়েছেন। তারা ক্ষণজন্মা। দৈবী।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল অনিতা। একটু ঘুম ঘুম লাগছে তার। পাশেই বড় একটা প্রবালের ওপর সে বসে পড়ে। ভদ্রলোক অনিতার পিছু পিছু আসেন কিন্তু বসেন না। প্রবাল খণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।
- আমি বিশ্বাস করি শিল্প নির্মাণ করে শিল্পীকে। আকস্মিকভাবে কথা শুরু করে অনিতা। বলে- যে শিল্পের উপাদানের কথা আপনি বললেন সে উপাদানগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পসত্তাকে এক করে। একটি কেন্দ্রের দিকে নিয়ে আসে।
সহজ স্বরে অনিতা বলতে থাকে- ‘শিল্পের রঙ, রূপ, রেখা, সুর হৃদয়ে প্রতিফলিত। আমি মীন করছি স্নায়ুতে। সে বোধ ধীরে ধীরে জুড়ে যায়। ব্লক সেটের মতো। একের পর এক। তখনই প্রাত্যহিক মানুষের শিল্পীতে রূপান্তর,’ তন্দ্রাচ্ছন্ন অনিতা অনেকদিন পর এক সাথে অত কথা বলল, ‘বোধজাত প্রজ্ঞা শুধু শিল্পীর নয়। শিল্পীর অনুরাগী মানুষের মধ্যেও ট্রান্সমিটেড হয়ে যায়। এভাবে শিল্প আরেকজন মানুষ পেয়ে যায়। যে ভাবীকালে শিল্পের স্রষ্টা হবে। তবে শৈল্পিক প্রকাশে মাধ্যমের ভিন্নতা থাকতে পারে।’
অচেনা কারো সাথে কথা বলাটা এ মুহূর্তে খুব স্বাভাবিক লাগছে তার কাছে। কথা না বলাটাই যেন অস্বাভাবিক। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে তার মোটেও কোনো ছিনতাইকারী কিংবা ধর্ষক বলে মনে হচ্ছে না। বিশালতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচুতার কৃমিকীটগুলো ভস্ম হয়ে যায়। লোকটি যেন খুব চেনা। সন্দেহের ছাল বাকলহীন ঋজু ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা শুদ্ধতার অনড় বৃক্ষ। ছায়া পায় অনিতা। সামান্য আশ্রয়।
চুপচাপ দুটো মুখ। বালুর বুকে লুটিয়ে পড়ে অজস্র তারার আলো। রাতের নিস্তব্ধতায় আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। পরস্পরকে বলা কথাগুলো তাদের ভেতর ঘুরপাক খায়।
-আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। এটুকু বলে হঠাৎ থামলেন তিনি। সিগারেট ফেলে হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে ঢোকালেন। পায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে সামান্য ঝুঁকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন- আকাশে-নোনাবাতাসে-সাগরে গভীর সন্ধি রচিত হয়েছে! সাগর কেমন ডাকছে, দেখুন, আয় আয়। আমি আসি এখন।
সাগরের হাতছানি দেখতে পায় অনিতা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তার। সে বলতে চায়- আপনি যাবেন না, প্লিজ! অনেক দিন পর আজ আমার ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুখে বলে- আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
-আপনি হোটেলে ফিরে যান।
-না।
ভদ্রলোককে অবাক করে দিয়ে অনিতা প্রবালের ওপর শুয়ে পড়ে। তিনি শুধু “আসি” বলে পেছন ফিরে হাঁটতে থাকেন। একবারও ফিরে তাকান না।
শক্ত ধারালো প্রবালের ওপর শুয়ে অনিতা। পুরু পুলওভারের জন্য পিঠে ব্যথা পায় না। কোথায় যেন সে যাবার ছিল। সে জানতে পারেনি। তাই পৌঁছতেও পারে না। রিকশা ক্রিং ক্রিং। পুঁতি কুড়িয়ে তবেই রিকশায় উঠে পড়বে অনিতা। পুঁতিগুলো এ্যরোমেটিক জুঁইঝোপ। ইরেক্ট ক্লেম্যাটিস নাকি ক্লেম্যাটিস রেকটা। মনে পড়ে না। তারার মতো ফুটে আছে। চারটা করে পাপড়ি মেলে। লাল ফ্রক ভরে যায়। এতো সুগন্ধ আর স্বস্তি সে আগে কখনো পায়নি। চোখ ভরে আকাশ। অনিতা আর আকাশ। মাঝখানে কেউ নেই। পূর্ণিমা তিথি নয়। শুধু মেঘমুক্ত নক্ষত্রবীথি। জুঁই জুঁই তারায় উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ছায়াপথ। সেখানে আলো জ্বলে ওঠে। অনিতার শরীর জুড়েও। কপালে, চোখে, দুহাতের পাতায়। তপ্ত কিংবা তীব্র নয় মৃদু আলো। পঞ্চপ্রদীপ জ্বলে উঠল। কী দুর্লভ এই জ্বলে ওঠা!
অনিতার পদ্মনাভিতে টান লাগে। পৃথিবীর সাথে অদৃশ্যত যে শেকড় জুড়ে আছে তার মূলে। অতগুলো সেডিল। হতে পারে মৃত্যুর মাত্রায়। খাওয়ার জন্য অনুতাপ হয় না অনিতার। সে ঘুমোয়। তার দিকে তাকিয়ে কালপুরুষ। অনবচ্ছিন্ন মিটমিট জ্বলছে।
অনিতা জানলার দিকে এগিয়ে শাহেদের পাশে দাঁড়ায়। উজ্জ্বল নীল সাগর। দূর থেকেও ঢেউয়ের সাদা ফেনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এক নিমিষেই ওর মন ভালো। শাহেদ তার কোমরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত রাখে। দুজনই সাগরের দিকে তাকিয়ে। শাহেদ বলে- একটা হট শাওয়ায় নাও দেখবে একদম ফ্রেশ লাগছে। গোসল করেই বেরিয়ে যাব। লাঞ্চ করে বীচে হাঁটব। মাত্র বিকেল হয়েছে। সূর্যাস্ত মিস করতে চাচ্ছি না।
অনিতা নিশ্চুপ। কোমর থেকে শাহেদের হাত সরিয়ে খাটে এসে বসে। ট্রলি টেনে বডি ওয়াশ, শ্যাম্পু বের করে। তারপর শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকে যায়। শাহেদ নিজেও ক্লান্ত। দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়েই সিগারেট ধরায়। বুকের ডান দিকে একটু চিনচিনে ব্যাথা। গ্যাস হয়েছে নিশ্চয়ই। অনিতার ব্যাগে ওষুধ আছে। না বলে শাহেদ তার ব্যাগ ধরে না। ধরলেও সে কিছু মনে করবে না। তবুও শাহেদ কিছু ব্যাপারে অন্যের ব্যক্তিগত সীমারেখা অতিক্রম করে না। এটা তার নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য।
শাহেদ লক্ষ্য করেছে হোটেলে ঢোকার পর অনিতা একটা কথাও বলেনি। এই এক মুশকিল অনিতাকে নিয়ে। অসম্ভব মুড সুইং হয়। উচ্ছ্বলতার মতো বিষণ্ণতারও কোন দিনরাত নেই। কখনো সাজ বর্জিত তপস্যারত সাধিকা। কখনো সাজ চর্চিত রাজইন্দ্রানী। আপাত গম্ভীর অনিতার চোখে মাঝে মাঝে শাহেদ কিশোরীর চপলতা দেখে। বেশিক্ষণ নয় খানিক ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে যায়। গত পাঁচ বছরে শাহেদ এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অনিতার মন বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায় ক্ষান্ত হয়েছে। তবু হঠাৎ ধাক্কা লাগে। এই যেমন এখন লাগল।
সেইন্ট মার্টিন’স আইল্যান্ড। সাগরকন্যা সমুদ্রপুরী থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। সর্বাঙ্গে প্রবাল জড়িয়ে। বিবর্তনবাদের সূত্রানুযায়ী সময়ের সাথে সাথে আইল্যান্ডের লেজ খসে এখন শুধু সেন্ট মার্টিন হয়ে গেছে। এখনো বিদ্যুৎ আসেনি দ্বীপে। ইদানিং কিছু জেনারেটর দেখা যায়। রাত দশটার পর জেনারেটর বন্ধ। এতে বরং ভালো হয়েছে। কৃত্রিম আলোহীন এ প্রবাল দ্বীপ অনিতাকে অপরিশোধিত আদিম বুনোভাব নিয়ে আকর্ষণ করে।
ডিসেম্বরের বিকেল। ধুলোয় পা ডুবিয়ে হাঁটছে শাহেদ অনিতা। পুরো দ্বীপ যেন নারকেল গাছের বাগান দিয়ে সাজান। গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু পরে পরে ঠাণ্ডা এলোমেলো হাওয়ায় চিকন পাতারা দুলে উঠছে। পাতায় হাওয়ার ঝিরঝির। দীর্ঘ শ্বাস টেনে অনিতার ফুসফুস বাতাসে ভরপুর। জাহাজ ঘাটের বাজারে গিয়ে রূপচাঁদা ফ্রাই খেল ওরা। রাস্তার দু পাশে সারি সারি মনিহারী দোকান। খেলনা, শামুক ঝিনুকের নানান শৌখিন জিনিসপত্র। বার্মিজ আচার, স্যান্ডেল, মুলতানি মাটি সাজিয়ে দোকান বসেছে। মৌসুম শেষ হলেই দোকানীরা মাছ ধরতে ‘দরিয়া’য় চলে যাবে। হঠাৎ নাকে শুঁটকীর গন্ধ ঝাপটা দেয়। কী বিরাট একেকটা শুঁটকী! কারবারীরা এসে দাম দস্তুর করে। সাধারণ পর্যটকরাও ‘ফ্রেশ’ শুঁটকী কিনে নিয়ে যায়। শুঁটকীর গন্ধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাতাসে হারিয়ে যায়।
অনিতার বেশ ফুরফুরে লাগছে। অনেকদিন পর সে শাহেদের হাত ধরে হাঁটছে। ভালো লাগছে অনিতার। সাগরের তীর ঘেঁষে কেয়া গাছের ঝোপ। দ্বীপের এ প্রান্তে কোনো ভিড় নেই। দুএকজন বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবাক হয় সে। অনিতা শাহেদকে বলে- পর্যটন মৌসুমেও এখানে একজন মানুষ নেই! কী আশ্চর্য। ‘আজকে উইক ডে তাই ভিড় নেই’ শাহেদ জানাল, ‘কাল দেখো কেমন ভিড় হয়।’ তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা চায়ের টং দোকান। দোকানের সামনে বসল ওরা। সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে। কেয়া পাতার ছাউনী। চারটি বাঁশের খুঁটিতে ভর দেয়া। যেন দোকান ছাড়িয়ে দোকানের চাল সামনে এগিয়ে গেছে। চমৎকার সাগর দেখা যাচ্ছে।
কাছেই এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক চা পান করছেন। বার্মিজ চা। সামনের দিকে ডান পাশের খুঁটির দিকের চেয়ারটায় বসেছে অনিতা। খুঁটির ওপর কেয়া ফলের থোকা ঝুলছে। তার পাশে শাহেদ। অনিতার ভেজা চুল বাতাসে শুকিয়ে গেছে। হাত দিয়ে খোঁপা বাঁধল সে। বেশ কয়েকবার চুল পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধতে হলো। অনিতার চুল বেশ লম্বা।
দোকানী দুধ-চিনি মিশিয়ে দুগ্লাস চা এগিয়ে দিল। প্লাস্টিকের চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে শাহেদ বলে- এতক্ষণে কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। চল সাগরের পাড়ে হেঁটে আসি। অনিতা সবে চায়ে চুমুক দিয়েছে। সে বলে- তুমি যাও আমি চা শেষ করে আসছি।
শাহেদ এগিয়ে যায় সাগরের দিকে। সব সময়ই চা শেষ করতে অনিতার বেশ সময় লাগে। ধীরে ধীরে চা ঠাণ্ডা হয়ে তলানীটুকু এমন বিস্বাদ যে পুরোটা শেষ করা যায় না। দীর্ঘ দিনের চা পানের অভ্যাস থেকে অনিতা এখন বোঝে কখন থেমে যেতে হবে। কাপের তলায় বেশ খানিকটা চা ভাসতে থাকে।
-দেখুন কেমন হলো?
অনিতা চমকে মুখোমুখি বসা লোকটির দিকে তাকায়। প্রশ্নটি যে তাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে এটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল।
-জ্বী!
-এটা দেখুন।
লোকটি একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে দেয়। কাগজ না বলে বিস্কুটের প্যাকেট বলাই ভালো। ফেলে দেয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় অনিতা অবাক। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। কাগজের দিকে তাকিয়ে দেখল কিছু দাগ টানা। আঁকিবুঁকি কাটা। মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল সে কিছুক্ষণ। একটা মুখের আদল ফুটে উঠেছে।
-আপনি, আপনি আমার স্কেচ করেছেন!
-জ্বী, করেছি। আচ্ছা, আমি আসি।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। এবার লোকটির দিকে ভালো করে তাকাল অনিতা। সব কিছুই মধ্যম। শুধু বড় বড় উজ্জ্বল চোখ দুটো সাদামাটা চেহারায় বুদ্ধিবৃত্তিক আলো ফেলেছে। মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল। এই সল্ট এ্যান্ড পিপার লুক অনিতার খুব ভালো লাগে। অবিন্যস্ত চুল। ভদ্রলোক হয় চুল আঁচড়ান না নয়তো জোরাল সামুদ্রিক বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে গেছে।
আর কিছু না বলেই ভদ্রলোক হাঁটা শুরু করলেন। অনিতা একবার কাগজের দিকে আরেকবার লোকটির দিকে তাকাল। কাগজটা নেয়া ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছে না। অতো কিছু ভেবেচিন্তে অনিতা কাগজটা নেয়নি। ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর এবং চাহনিতে একটা সততা ও স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। যা অনিতার স্নায়ুর ওপর স্বভাবিক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। অজান্তেই সে হাত বাড়িয়েছে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এটা অনেকটা হাঁচি দেবার মতো একটা কিছু ধরে নিল অনিতার। দূরে শাহেদকে দেখা যাচ্ছে। অনিতা কাগজটা ব্যাগে ঢুকিয়ে গলার কাছে স্কার্ফ ঠিক করল তারপর বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।
শাহেদ অনিতা কে দেখছে। অনিতা সাগরকে। দুজনেই পানিতে পায়ের পাতা ভিজিয়েছে। আকাশ জুড়ে স্বপ্নের নাম-না-জানা মায়ারঙগুলো ভেসে যায়। গাঢ় রক্তিমাভার সাথে মিশেছে এ্যপ্রিকটের মিষ্টি কমলা, মধু রঙা সোনালীর গাল আদরে ছুঁয়ে দিল স্যাফেয়ার নীল। সাগরের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে বিচিত্র রঙিন লীলাভঙ্গী চারদিকে লালচে কমলা আলো ছড়িয়েছে। সে নরম আলো এসে পড়ছে অনিতার মুখে। শাহেদের খুব ইচ্ছে যায় দুটো হাতের পাতায় অনিতার মুখটাকে ধরে রাখতে।
টকটকে লাল সূর্য নেমেছে সাগরের বুকে। বাতাস বইছে সারাক্ষণ। আদিগন্ত বিস্তৃত সূর্যাস্তের আকাশ আর সীমাহীন সমুদ্রের বিশালতায় অনিতা তুচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়ে। নির্লিপ্ত অস্তগামী সূর্য। হাজার লক্ষ বছরী সূর্যাস্ত বেলা লাটিমের মতো ঘুরপাক খায়। শেষের কথা বলে। নির্বিকার আকাশ আর চিরবহতা সমুদ্র কিছুতেই তাদের কিছু আসে যায় না। শুধু অনিতার হৃদয় অনাসক্ত হয়ে উঠতে পারে না। প্রবল তৃষ্ণা বোধ করে সে। ভেতরে ভেতরে বিচলিত হয়। অস্থিরবোধ করে। ছটফট। শাহেদকে হোটেলে ফিরে যাবার কথা বলে। শাহেদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটতে থাকে অনিতা। টলতে টলতে ভেজা বালিতে মুখ লুকিয়ে রাখা এক টুকরো প্রবালে হোঁচট খায়।
শাহেদ অনিতার কাছে এসে বলে- শরীর খারাপ লাগছে? অনিতা নিরুত্তর। শাহেদ আবারো বলে- জার্নির ধকলটা কেটেনি। স্যালাইন এনেছিলে? মাথা ব্যাথা করছে?
-ওহ্!
একটি হতাশা এবং বিরক্তিজনিত শব্দ অনিতার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। এত কথা চারিদিকে। স্তব্ধতা পাবার জন্য এবার বুঝি নিজের কবর খুঁড়তে হয়। বাতাসের সব অক্সিজেন জীবনের ভেতর ঢোকাতে ব্যস্ত অনিতা। প্রাণবায়ু টিকিয়ে রাখার জন্য। একথা বলার প্রয়োজন মনে করে না যে সে সুস্থ আছে।
হোটেলে ফিরে সে শুয়ে পড়লো। রাতে কিছু খেলো না। শুয়েই রইল। অন্ধকার বাতাসের রাত। বাতাসে ভেসে সে ধূসর ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কালো পানির ঢেউ সেখানে। কোথায় যেন যেতে হবে। সবাই চলে গেল এক এক করে রিকশায়। সে তখনও দাঁড়িয়ে। কারও যাবার কথা তার সাথে। সেলাই মেশিনে লাল ফ্রক সেলাই হচ্ছে। খুলে ছড়িয়ে পড়ছে লেসের পুঁতি। লক্ষ লক্ষ অগুন্তি। ছিটকে উঠছে পিংপং বলের মতো। যেন বরফ কুচি আছড়ে পড়ছে তুষারকন্যার পায়ের কাছে। পুঁতি আর কুড়োন হয় না। হাত লাগতেই জ্বলে উঠল আগুনের স্ফুলিঙ্গ। সবেতেই তালগোল। পুঁতির বরফ। বরফের আগুন। ক্যানভাসে কী উত্তাল ঢেউ! বহু বহু জল মিলিত স্বরে কথা বলছে। অবিরাম রিকশার ক্রিং ক্রিং। কোথায় যেন যাবার ছিল সে, কারো সাথে। ক্যানভাসে ধুসর ঢেউয়ের ওপর একটা বন্ধ চোখ। চোখটা কার অনিতা ধারণা করতে পারে না। চোখ খোলা থাকলে হয়তো চেনা যেত।
পাশে শাহেদ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনিতা ভাবল- এ কে? এখানে শুয়ে আছে কেনো? কী হতো না থাকলে? সে-ই বা কী করছে এখানে? চলে যাবে? এসব অর্থহীন চিন্তা বাদ দিয়ে অনিতা পাশ ফিরে শোয়। মানুষের বেশির ভাগ ভাবনাই উদ্দেশ্যহীন। অনিতার ভাবনাও নিরর্থক। এমন অন্ধকার জলের গন্ডগোল সে আগে কখনো দেখেনি। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অনিতা। স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন খুব এক ঘুম।
সকালের রোদে সাগরের পানি নীল। আকাশের প্রতিবিম্ব সাগরে। প্রবালের জন্যই হয়তো সেইন্ট মার্টিন’স বীচে তেমন বালু নেই। কক্সবাজারে সাগর থেকে তীরে উঠলে প্রচুর বালু কাপড়ে লেগে থাকে। ওদের সাথে আরো কয়েকজন সাগরে নেমেছে। ছেলে ছোকরার দল। আজই এসেছে। টায়ার ভাসিয়ে ডুবছে ভাসছে। বীচ বল নিয়ে খেলছে। দূরে ঢেঊয়ের তালে দুলছে তিনটি ট্রলার। চিয়ারলিডারদের ছন্দময়তায়। ট্রলারে বাঁশের কঞ্চির ওপর বেধে রাখা এক টুকরো কাপড় তুমুল উড়ছে। চিয়ারলিডারের হাতে ফুলঝুরি হয়ে।
অনিতা সাঁতার কাটতে পারে না। তবু সে আবিষ্টের মতো সাগরের দিকে এগিয়ে যায়। আকন্ঠ পানিতে অনিতার মনে হলো এই ওজনহীন শরীরটা আদৌ তার নিজস্ব শরীর নয়। মাথাটাই শুধু ওর। গলা থেকে পা পর্যন্ত শরীরটা অন্য কারো। বড় বড় ঢেউ এগিয়ে আসছে। রহস্যে রোমাঞ্চে প্রেমিকের মতোই। আছড়ে পড়ল অনিতার ওপর। উথাল পাথাল নোনা জলে চোখ জ্বলছে। এবার আর ভারসাম্য রাখতে পারল না। কিছুক্ষণের জন্য পায়ের তলার বালু সরে গেল। যাকে বলে হাবুডুবু খাওয়া। ঢেউ চলে গেল। গলা পানিতে উঠে দাঁড়ায় অনিতা। কয়েক মুহূর্ত আগের নির্ভার অনুভূতি মনে করে গা শিরশির। আশ্চর্য বোধ করে সে তারপর ঢেউ কেটে সাগরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। একের পর এক ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারসাম্য হারিয়ে বেসামাল। শাহেদ জোরে ‘অনি, অনি’ বলে ডাকতেই গলা পানি থেকে ফিরে আসে। হতাশ গলায় শাহেদ বলে- মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছে করেই একটা ঝামেলা করতে চাও। একটা অঘটন না ঘটালে তোমার শান্তি হবে না। অনিতা হাসে। অনাবশ্যক হাসি। কিছু বলে না।
বাজার থেকে কিছু স্যুভেনির কিনেছে অনিতা। এখন সাবধানে সেগুলো ব্যাগে ভরছে। কাল সকালে চলে যাবে ওরা। শাহেদ একটা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল। সময়ের কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে। তবু যেন অনিতার সমুদ্র দেখা ফুরায় না। সন্ধ্যায় শাহেদ আর বের হতে চায় না।
ব্যাগ গুছানো শেষ করে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল অনিতা। হোটেলের সামনে বার-বি-কিউ চুল্লীতে গোল গোল করে কাটা কাঠের টুকরো সাজানো। কয়লা দেয়া হচ্ছে। আজকে রাতে বার-বি-কিউ করবে কেউ। অনিতা রুমে ঢুকে দেখল শাহেদের হাতে হেইনিকেন। বাথরুমে গিয়ে সে ভাল করে হাত মুখ ধুলো। আজ বেশি সময় নিল। ক্রীম লাগালো। লিপ বামের সামান্য গোলাপি আভা ঠোঁটে। তখন সবুজাভ ক্যান থেকে বীয়ারে চুমুক দিচ্ছে শাহেদ আর ক্রস ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হোটেল থেকে একা বাইরে এলো অনিতা। হোটেল সংলগ্ন বীচে গিয়ে দেখল কয়েকটা দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ রাতে বার-বি-কিউ করবে। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো অনিতা। ঘোর কালো আকাশে বিন্দু বিন্দু সহস্র নক্ষত্র, উপ-নক্ষত্র জ্বলছে। কালো মখমলের ইজেলে কেউ যেন ফোঁটা ফোঁটা রূপালি রঙ ছুঁয়ে দিয়েছে।
-কী দেখছেন আকাশে? এত আত্মভোলা হয়ে?
- কালপুরুষ। এবার অনিতা চমকায় না। মরাল গ্রীবা সামান্য ঘুরিয়ে কাঁচা পাকা অবিন্যস্ত চুলের লোকটির দিকে তাকিয়ে সে উত্তর দেয়।
-আপনি অনেক সাহসী। একা বের হয়েছেন। জায়গাটা ভালো নয়।
-খুব বেশি সাহসের কাজ করেছি কি? সবে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বীচ জুড়ে কত মানুষ। আমারতো মনে হয় আপনি অনেক সাহসী। অনুমতি না নিয়েই কারো স্কেচ করে ফেলেন।
-সেকি! স্কেচ তো আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। মৃদু হাসি ফোটে ভদ্রলোকের চোখে-মুখে।
-দিয়ে দিলেন। সেটাই তো সাহসের ব্যাপার।
-কালপুরুষের আকৃতি লক্ষ্য করেছেন? পুরুষাকৃতি।
-তাইতো! লক্ষ্য করিনি আগে। ইন্টারেস্টিং। আপনি একজন চিত্রকর, তাই না?
-নিজে থেকেই আঁকি। কখনো শিখিনি। সহজাতভাবেই এটা আসে। ধরুন হাঁচি দেবার মতোই একটা রিফেক্স এ্যাকশান। এলে আটকান যায় না।
চমকে ওঠে অনিতা। কথা শেষ করেই ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। প্রাণ খোলা উদাত্ত হাসি।
-একজন জাত শিল্পীর সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
-ওরে বাবা! শিল্পী বলবেন না। আমি ডিজার্ভ করি না।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেন তিনি। গোল্ড লিফের একটা স্টিক তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে রেখে বলেন- শিল্পী হওয়া অনেক বড় ব্যাপার, জানেন? মার্গ সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সব আদিতে সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য। সবাই কি আর গুহাচিত্র এঁকেছে বলুন! কেউ কেউ ছিল যারা চাষের কাজ, পশু পালন, শিকার, রতিসুখ, সন্তান উৎপাদনের বাইরে কিছু অনুভব করেছিল।
ফস করে লাইটারের এক ইঞ্চি আগুন বাতাস চাটে। তিনি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরেন। অনিতার সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন- অতৃপ্তি তাড়িত হয়ে তারা সৃষ্টি করেছিল শিল্প। এই অতৃপ্তি হতে পারে সৃষ্টিকে জানার। কিংবা সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে পাওয়ায় আকাঙ্ক্ষা। শিল্পের উপাদান তারা নিজের অজান্তে হাতে তুলে নিয়েছেন। তারা ক্ষণজন্মা। দৈবী।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল অনিতা। একটু ঘুম ঘুম লাগছে তার। পাশেই বড় একটা প্রবালের ওপর সে বসে পড়ে। ভদ্রলোক অনিতার পিছু পিছু আসেন কিন্তু বসেন না। প্রবাল খণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।
- আমি বিশ্বাস করি শিল্প নির্মাণ করে শিল্পীকে। আকস্মিকভাবে কথা শুরু করে অনিতা। বলে- যে শিল্পের উপাদানের কথা আপনি বললেন সে উপাদানগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পসত্তাকে এক করে। একটি কেন্দ্রের দিকে নিয়ে আসে।
সহজ স্বরে অনিতা বলতে থাকে- ‘শিল্পের রঙ, রূপ, রেখা, সুর হৃদয়ে প্রতিফলিত। আমি মীন করছি স্নায়ুতে। সে বোধ ধীরে ধীরে জুড়ে যায়। ব্লক সেটের মতো। একের পর এক। তখনই প্রাত্যহিক মানুষের শিল্পীতে রূপান্তর,’ তন্দ্রাচ্ছন্ন অনিতা অনেকদিন পর এক সাথে অত কথা বলল, ‘বোধজাত প্রজ্ঞা শুধু শিল্পীর নয়। শিল্পীর অনুরাগী মানুষের মধ্যেও ট্রান্সমিটেড হয়ে যায়। এভাবে শিল্প আরেকজন মানুষ পেয়ে যায়। যে ভাবীকালে শিল্পের স্রষ্টা হবে। তবে শৈল্পিক প্রকাশে মাধ্যমের ভিন্নতা থাকতে পারে।’
অচেনা কারো সাথে কথা বলাটা এ মুহূর্তে খুব স্বাভাবিক লাগছে তার কাছে। কথা না বলাটাই যেন অস্বাভাবিক। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে তার মোটেও কোনো ছিনতাইকারী কিংবা ধর্ষক বলে মনে হচ্ছে না। বিশালতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচুতার কৃমিকীটগুলো ভস্ম হয়ে যায়। লোকটি যেন খুব চেনা। সন্দেহের ছাল বাকলহীন ঋজু ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা শুদ্ধতার অনড় বৃক্ষ। ছায়া পায় অনিতা। সামান্য আশ্রয়।
চুপচাপ দুটো মুখ। বালুর বুকে লুটিয়ে পড়ে অজস্র তারার আলো। রাতের নিস্তব্ধতায় আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। পরস্পরকে বলা কথাগুলো তাদের ভেতর ঘুরপাক খায়।
-আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। এটুকু বলে হঠাৎ থামলেন তিনি। সিগারেট ফেলে হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে ঢোকালেন। পায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে সামান্য ঝুঁকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন- আকাশে-নোনাবাতাসে-সাগরে গভীর সন্ধি রচিত হয়েছে! সাগর কেমন ডাকছে, দেখুন, আয় আয়। আমি আসি এখন।
সাগরের হাতছানি দেখতে পায় অনিতা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তার। সে বলতে চায়- আপনি যাবেন না, প্লিজ! অনেক দিন পর আজ আমার ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুখে বলে- আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
-আপনি হোটেলে ফিরে যান।
-না।
ভদ্রলোককে অবাক করে দিয়ে অনিতা প্রবালের ওপর শুয়ে পড়ে। তিনি শুধু “আসি” বলে পেছন ফিরে হাঁটতে থাকেন। একবারও ফিরে তাকান না।
শক্ত ধারালো প্রবালের ওপর শুয়ে অনিতা। পুরু পুলওভারের জন্য পিঠে ব্যথা পায় না। কোথায় যেন সে যাবার ছিল। সে জানতে পারেনি। তাই পৌঁছতেও পারে না। রিকশা ক্রিং ক্রিং। পুঁতি কুড়িয়ে তবেই রিকশায় উঠে পড়বে অনিতা। পুঁতিগুলো এ্যরোমেটিক জুঁইঝোপ। ইরেক্ট ক্লেম্যাটিস নাকি ক্লেম্যাটিস রেকটা। মনে পড়ে না। তারার মতো ফুটে আছে। চারটা করে পাপড়ি মেলে। লাল ফ্রক ভরে যায়। এতো সুগন্ধ আর স্বস্তি সে আগে কখনো পায়নি। চোখ ভরে আকাশ। অনিতা আর আকাশ। মাঝখানে কেউ নেই। পূর্ণিমা তিথি নয়। শুধু মেঘমুক্ত নক্ষত্রবীথি। জুঁই জুঁই তারায় উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ছায়াপথ। সেখানে আলো জ্বলে ওঠে। অনিতার শরীর জুড়েও। কপালে, চোখে, দুহাতের পাতায়। তপ্ত কিংবা তীব্র নয় মৃদু আলো। পঞ্চপ্রদীপ জ্বলে উঠল। কী দুর্লভ এই জ্বলে ওঠা!
অনিতার পদ্মনাভিতে টান লাগে। পৃথিবীর সাথে অদৃশ্যত যে শেকড় জুড়ে আছে তার মূলে। অতগুলো সেডিল। হতে পারে মৃত্যুর মাত্রায়। খাওয়ার জন্য অনুতাপ হয় না অনিতার। সে ঘুমোয়। তার দিকে তাকিয়ে কালপুরুষ। অনবচ্ছিন্ন মিটমিট জ্বলছে।
2 মন্তব্যসমূহ
valo laglo mam
উত্তরমুছুনপাঠের জন্য ধন্যবাদ!
মুছুন