নাস্তিক্যবাদ ও চার্বাক

শামিম আহমেদ

‘নাস্তিক’ শব্দটি মৈত্রায়ণী উপনিষদের সমকালীন। সাধারণ মানুষ ‘নাস্তিক’ বলতে ঈশ্বর-অবিশ্বাসীকে বোঝেন। ভারতীয় দর্শনে ‘নাস্তিক’ কথাটির অন্য মানে আছে। যিনি বেদে অবিশ্বাসী, তিনি নাস্তিক। সাধারণ মানুষের কাছে ‘আস্তিক’ হলেন ঈশ্বরবিশ্বাসী কিন্তু ভারতীয় দার্শনিকের কাছে আস্তিক হলেন বেদবিশ্বাসী।
সাংখ্যের কপিল মুনি নিরীশ্বরবাদী হয়েও আস্তিক কেননা তিনি বেদের প্রামাণ্যে বিশ্বাসী। তবে ‘নাস্তিক’ শব্দটির অর্থ এত সহজ নয়। পাণিনি শব্দটির অর্থ করেছেনঃ নাস্তিক সেই যে পরলোক মানে না। হরিচরণের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষে’ও ‘নাস্তিক’ শব্দের প্রাথমিক অর্থ হল ‘পরলোক নাই’—ইহা যাহার মতি। ঈশ্বরে অবিশ্বাস সেখানে দ্বিতীয় অর্থ। তৃতীয় অর্থ হল, লোকসাধনাদৃষ্টাভাববাদী, চতুর্থ—বেদনিন্দক। মহাভারতের শান্তিপর্বে আছে, পারলৌকিককার্যেষু প্রসুপ্তা ভৃশনাস্তিকাঃ—যাঁরা পারলৌকিক কার্যে বিশ্বাসী নন, তাঁরাই নাস্তিক। আচার্য মনু বলছেন, নাস্তিক হল বেদনিন্দক কারণ বেদেই পরলোকের প্রস্তাব আছে, সুতরাং বেদ না-মানার অর্থ হল পরলোক না-মানা। গীতা অনুযায়ী, নাস্তিক হল ঈশ্বরবিহীন মানুষ। কুমারিল ভট্ট তাঁর ‘শ্লোকবর্তিকা’-য় বলেছেন একই কথা। বুদ্ধদেব বেদ, ঈশ্বর, আত্মা কিছুই মানতেন না; সেই অর্থে তাঁকে নাস্তিক-শিরোমণি বলা উচিত। কিন্তু যেহেতু তিনি জন্মান্তরবাদকে মেনেছেন, তাই তাঁকেও ‘নাস্তিক’ বলা যাবে কিনা, তা ভাববার বিষয়।

পরবর্তী কালে ‘নাস্তিক’ কথাটির ব্যবহার শুরু হয় অপযশার্থে। মাধ্ব ও শৈবরা পরস্পরকে এই নামে কলঙ্কিত করতে চাইতেন। কপিল-কণাদ-মহাবীর-বুদ্ধদেবকে ‘নাস্তিক’ আখ্যায় অনেকে ভূষিত করেছেন।

নাস্তিকের সব বৈশিষ্ট্য মিলে যায় যাঁর সঙ্গে তিনি হলেন চার্বাক। অভিধান অনুযায়ী, চারু বাক যার তিনিই চার্বাক। ‘চারু’ কথাটির অর্থ চিত্তচারী, মনোজ্ঞ, মনোহর, রুচির। এই চার্বাক আসলে একটি দার্শনিক সম্প্রদায়। ভারতীয় দর্শনের প্রায় সব আস্তিক শাখা চার্বাককে পূর্বপক্ষ খাড়া করে তাঁদের মত খণ্ডনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। লৌক্য বৃহস্পতিকে চার্বাক মতের আদি প্রবর্তক বলা হয়। লৌক্য হলেন তিনি, যিনি সর্বত্র বিরাজ করেন। পুরাণে বৃহস্পতিকে এই রকম ভাবে পাওয়া যায়—তিনি সপ্তমুখ, সপ্ত রশ্মি, মিষ্ট জিহ্বা, নীল পৃষ্ঠ, তীক্ষ্ম শৃঙ্গ ও শতপত্রবিশিষ্ট। তিনি হিরণ্য ও লোহিতবর্ণ। আবার ঋগ্বেদের বৃহস্পতি ছন্দের অধিকারী ও লোকস্থিতির সহায়ক। বৃহস্পতি হলেন দেবগুরু, তিনিই গণপতি। প্রজ্ঞা ও মিষ্ট বাক্যের অধিকারীই ‘গণপতি’ নামের যোগ্য। তিনি গ্রহরাজও। পুরাণের বৃহস্পতির সঙ্গে লৌক্য বৃহস্পতির অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী চার্বাককে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন—বিতণ্ডাবাদী, স্থূল ও সুশিক্ষিত চার্বাক। পরমতখণ্ডণ হল বিতণ্ডাবাদীদের প্রধান লক্ষ্য। তাঁদের সদর্থক কোনও তত্ত্ব নেই। সর্বত্র সন্দেহ-উৎপাদন বিতণ্ডাবাদীর প্রধান কাজ। স্থূল চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, কারণ তা অপরোক্ষ অনুভব। প্রত্যক্ষের সাহায্যেই আমরা সংশয় ও বিপর্যয়শূন্য জ্ঞান পাই। প্রত্যক্ষ হল সাক্ষাৎ অনুভব। অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয় কারণ তা পরোক্ষ অনুভবের উপর নির্ভরশীল। অনুমানলব্ধ জ্ঞান সুনিশ্চিত নয়। প্রত্যক্ষ ধূম থেকে অপ্রত্যক্ষ আগুনের অনুমান করা আর অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা। শব্দ-প্রমাণকেও তাঁরা প্রমাণের মর্যাদা দেন না, তাই বেদাদি শাস্ত্র তাঁদের কাছে অপ্রমাণ। অজর-অমর আত্মা বলে কিছু নেই। দেহের নাশে আত্মার বিনষ্টি। পরিদৃশ্যমান জগত আকস্মিক ও চাতুর্ভৌতিক। এই চতুর্ভূত হল—মাটি, জল, আগুন ও বায়ু। জড় ভূতচতুষ্টয়ের বিশেষ সংমিশ্রণ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি। চার্বাকদের এই মতবাদকে জড়বাদ বলা হয় এই কারণেই। যেমন গুড়তণ্ডুল প্রভৃতি সুরাঙ্গ থেকে মদশক্তির উদ্ভব, তেমনই ভূতচতুষ্টয় থেকে সচেতনতার প্রকাশ। তাঁদের মতে, দৈহিক সুখই মানুষের লক্ষ্য। ঈশ্বর, পরলোক, পুনর্জন্ম বা জন্মান্তর বলে কিছু নেই। কার্যকারণসম্পর্ক ও কর্মফলকে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে স্থূল চার্বাক পুষ্ট হয়েছে। ভোগের সুখকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। কাঁটা আছে বলে মাছ খাবে না, এ রকম মূর্খে ভাবে। যথাসম্ভব দুঃখ পরিহার করে সুখভোগ করা বুদ্ধিমানের কাজ। ক্ষণিক হলেও, অল্প হলেও, ব্যক্তিগত হলেও, দুঃখমিশ্রিত হলেও, বর্তমানে প্রাপ্ত সুখকে ত্যাগ করা উচিত নয়। অতীত তোমার নয়, ভবিষ্যতকে বিশ্বাস করো না, কেবল বর্তমানই প্রত্যক্ষ উপলব্ধ। যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচো, প্রয়োজনে ঋণ করে ঘি খাও আর ভস্মীভূত দেহ ফিরে আসবে না।

যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেদ্ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।

ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।

তৃতীয় সম্প্রদায়টি হল সুশিক্ষিত চার্বাক। তাঁরা প্রত্যক্ষের বাইরে কিছুটা পরিমাণে অনুমানকে মান্যতা দেন। নইলে লোকযাত্রানির্বাহ ব্যাহত হয়। কিন্তু সেই সব অনুমানকে কখনোই মানেন না, যে সব অনুমান আত্মা, ঈশ্বর, পরলোক প্রভৃতিকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। অর্থ ও কামকে তাঁরা পুরুষার্থ বলে মানলেও প্রথম দুই প্রকারের চার্বাকদের তুলনায় সুশিক্ষিত অনেকটাই সংযত। সূক্ষ্মতর মানসিক সুখও তাঁদের পুরুষার্থের তালিকায় রয়েছে। সুশিক্ষিত চার্বাক বাৎস্যায়নের কামসূত্রে বর্ণিত নির্মল সুখকেই আদর্শ মনে করেছেন। সুশিক্ষিত চার্বাক নিসর্গ ও স্বভাববাদী। তাঁরা বিশ্বাস করেন, স্বভাবই জগতবৈচিত্রের নিয়ামক, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির নিয়ামক। মানুষের ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু নেই। সকল ব্যাপার স্বভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাজেই মানুষের কর্তব্য বা দায়িত্ব বলে কিছু নেই, সৎ বা অসৎ বলেও কিছু হয় না। শাস্ত্র নেই, পরলোক নেই, মৃত্যুই অপবর্গ।

আমাদের দেশের দুই মহাকাব্যে চার্বাককে সমহিমায় পাওয়া যায়। রামায়ণে চার্বাক বেদমার্গের পরিপন্থী। সেখানে জটায়ু রাবণকে বলছেন, সীতা হলেন পবিত্র বেদবিদ্যা আর আসুরি শক্তিসম্পন্ন রাবণ বিতণ্ডা বা হেতুবাদের সঙ্গে তুলনীয়। রামায়ণে জাবালির উক্তিতে বেদাদি শাস্ত্রের নিন্দা প্রকটভাবে উপস্থিত। অযোধ্যাকাণ্ডে তিনি বলেছেন, “অষ্টকা পিতৃদেবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত হয়। ইহা অন্নের উপদ্রবমাত্র। মৃত ব্যক্তি কি ভক্ষণ করতে পারে?”

রামচন্দ্র ভরতকে বলছেন, বৎস! তুমি তো লোকায়তিক ব্রাহ্মণকে সেবা করছ না! এঁরা মূঢ় পাণ্ডিত্যাভিমানী ও অনর্থকুশল। মুখ্য ধর্মশাস্ত্র উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এই কুপণ্ডিতরা বিতণ্ডাকে আশ্রয় করে নিরর্থক বাবদূকতা প্রদর্শন করেন। টীকাকার ‘লোকায়তিক’ শব্দের অর্থ করেছেন—চার্বাক মতানুসারিণঃ শুষ্কতর্কবাবদূকাঃ।

রামায়ণে যেমন রাবণকে বৈতণ্ডিক চার্বাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তেমনি মহাভারতে দুর্যোধনকেও চার্বাকের সখা হিসাবে দেখানো হয়েছে। মৃত্যুর সময় দুর্যোধন চার্বাকের নাম ধরে বিলাপ করে বলছেন, ‘‘বাক্যবিশারদ পরিব্রাজক বন্ধু চার্বাক অন্যায় যুদ্ধে আমার এই প্রকার শোচনীয় মৃত্যুর খবর জানতে পারলে নিশ্চয় প্রতিশোধ নেবেন।’’ মহাভারতের টীকাকার নীলকন্ঠ বলছেন, চার্বাক হল ব্রাহ্মণবেশধারী রাক্ষস। মহাভারতকার অবশ্য চার্বাককে ‘মূর্খ, কটুভাষী ও কুকুরের ন্যায়’ বলতে দ্বিধা করেননি।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরের অভিষেক কালে দুর্যোধনের মিত্র চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুর ছদ্মবেশে শিখা, দণ্ড ও জপমালা ধারণ করে রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই চার্বাক যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার জানিয়ে বললেন, “তুমি জ্ঞাতিহন্তা কুনৃপতি, তোমাকে শত ধিক!” তাঁর বাক্যবাণে ব্যথিত হয়ে যুধিষ্ঠির অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কাছে কাতরভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণরা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ, এ হল দুর্যোধনসখা চার্বাক রাক্ষস।’’ তারপর সেই ব্রাহ্মণদের ক্রোধের আগুনে চার্বাক জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন।

শাস্ত্রকারদের কেউ কেউ বুদ্ধদেবকে ‘চার্বাক’ নামে অভিহিত করেছেন। লোকায়ত চার্বাককে পাষণ্ড, নাস্তিক নামেও ডাকা হয়। মহাভারতের আদিপর্বে দেখা যায়, এক নগ্ন ক্ষপণক উতঙ্কের আনা কুণ্ডল চুরি করে পালাচ্ছেন। এই ক্ষপণক আসলে পাষণ্ড, বৌদ্ধ ভিক্ষু। পরে তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তিনি তক্ষক, যাঁর দংশনে রাজা পরীক্ষিৎ মারা যান। এবং তার পরে জনমেজয় করেন সর্পসত্র। বৌদ্ধের সঙ্গে চার্বাকের বহু মিল থাকলেও এই দুই সম্প্রদায় এক নয়। শান্তিপর্বের মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়ে চার্বাক ও সৌগত (বৌদ্ধ) মতবাদ আলাদা করে উল্লিখিত হয়েছে। মৈত্রায়ণী উপনিষদে কাপালিকদের সঙ্গে লোকায়তদের সমপর্যায়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কাপালিকদের সঙ্গে চার্বাকদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, কাপালিকরা দেবতা (চামুণ্ডা, শক্তিনাথ, মহাভৈরব প্রমুখ) মানেন, চার্বাক এ সব মানেন না। তবে উভয়েই ঐহিক ও দৈহিক সুখ বাদ দিয়ে পরলোকে স্বর্গসুখ কামনা করে না।

চার্বাকের সংশয়বাদ, নাস্তিকতা ও বস্তুবাদ ভারতীয় চিন্তার ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ। সব ক্ষেত্রে যে তাঁরা খুব বলিষ্ঠ যুক্তি রেখে গিয়েছেন, এমন নয়। কিন্তু সাধারণের জনমানসে তাঁরা যে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন, সে কথা মানতেই হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অত্যন্ত ভাল লেখা। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. লেখাটি পড়ে যে সমৃদ্ধ হলাম একথা বলা যায় না। লেখক অনেক কথাই বলেছেন, কিন্তু  কোনো প্রমাণ্য সংযুক্ত করার তাগিদ অনুভব করেননি। এটা ঠিক, চার্বক দর্শন নিয়ে সেরকম নাড়াঘাটা হয়নি। আর বিষয় যেখানে জবাবদিহি অপ্রয়োজনীয় ভোগবাদ, কাজেই সেটা যে অধিক জনপ্রিয় সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যেহেতু মানুষ শরীরটাকেই আত্মা বলে ভাবে। খায় দায় ঘুমায়, মৈথুনেলিপ্ত বংশ বৃদ্ধি করে আবার স্বপ্নও দেখে তারপর দিন যায় দিন আসে। একদিন মরেও যায় দেখি।

    উত্তরমুছুন