গল্পপাঠ--
কেমন আছেন?
আনোয়ার শাহাদাত--
যে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের সঙ্গে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এবং তার সঙ্গে আরব বিশ্বাস আছে, সেই জনপদ ও জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে বলতে হচ্ছে 'ভালো নয়'।
গল্পপাঠ--
বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গি কর্মকাণ্ড মাথা চাড়া দিয়েছে। মুক্তমনা, যুক্তবাদি, ব্লগার, বিজ্ঞানমনষ্ক, সংস্কৃতি-কর্মী, প্রকাশক, নাস্তিক,সংখ্যালঘু আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেককে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি গুলশানের একটি রেস্তোরায় আক্রমণ করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে ২৮ জনকে। এর মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যা বেশি। শোলোকিয়ায় ঈদের জামায়াতে আক্রমণ করা হয়েছে পুলিশদের উপর। এই 'ধর্মীয়' 'জঙ্গি ' 'মৌলবাদ' বিষয় গুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আনোয়ার শাহাদাত--
আপনার প্রশ্নের শেষাংশ অনুসরণ করি। আপনি বলছেন "'ধর্মীয়' 'জঙ্গি ' 'মৌলবাদ' বিষয় গুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন?" প্রথমে "ধর্মীয়"- আধুনিক রাষ্ট্রগুলো শত বছরের প্রচেষ্টায় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, নিষ্ক্রিয় করছে। কারণ তারা উপলব্ধি করল রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের মধ্যে 'ধর্ম' থাকলে রাষ্ট্রে আধুনিক কোন সংযোজনা সম্ভব নয়। ফলে তারা তা বিদায় দিয়ে স্থাপন করেছে বিশ্বাসের জায়গা যেখানে থাকা উচিৎ সেখানেই। অর্থাৎ জন জীবনকে নিয়ন্ত্রিত না করতে পারে এমন জায়গায়। কিন্তু বাংলাদেশ শুরু থেকে আরব ও বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চাপে পরে ওই বিশ্বাসের পথকে রাষ্ট্রীয় ভাবে সামনে এনেছে এবং আজকের এই পরিণতি ওই ধার্মিক যে সব ধারাবাহিক সংযোজন সরকার ও ‘কি-আইকন’রা অনুসরণ করেছে তারই ফল। সেটাই আপনার প্রশ্নের 'ধর্মীয়' অংশের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
আপনার প্রশ্নের এর পরের অংশ 'জঙ্গি'। ধর্ম বিশ্বাসের প্রধান গোমর বা দুর্বলতা হচ্ছে তা কেবল মাত্র একটি বিশ্বাস! অর্থাৎ বিশ্বাস একটি 'জুয়া' খেলবার অনুকরণে ঝুঁকির মতন। যিনি খেলছেন তিনি বিশ্বাস করছেন, এই বিশ্বাসে যে, তিনি জিতবেন বা জিতলেও জিততে পারেন। এর পর তিনি দেখতে পান, হয় ওই জুয়ায় জিতেছেন, না হয় জিতেন নি। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের জুয়ার জায়গাটায় আর সেটা দেখবার সুযোগটা নেই। ফলে বিশ্বাসের অর্জন কী হতে পারে ওই 'জুয়া’র হার-জিত এর মতন তা যেহেতু আর জানবার উপায় থাকে না ফলে এই নিয়ে অর্থাৎ বিশ্বাসের প্রসারতা অযৌক্তিকতায় নিমগ্ন হয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন করে বৃদ্ধি করা যায়। ধরা যাক যে পরিবারের ছেলেরা ওই গুলশানে আরবের কায়দায় আরবের এজেন্ডা অর্জনে খুন করেছে, তাদের পিতা মাতারা যদি এক মুহূর্তের জন্যও কেঁদে থাকেন পুত্রহারা-শোকে বা দুঃখ বোধ করে থাকেন, তবে কিন্তু তাদের 'বিশ্বাস' আর থাকল না, ধর্ম আর থাকল না, কারণ তারা যখন তাদের ছেলেদের বিশ্বাসী হতে বলেছেন তখন কিন্তু এর কোনো সীমারেখা দিতে পারেন নি, কেন না বিশ্বাসের কোন সীমা রেখা নেই। ফলে তাদের লাগামহীন বিশ্বাসী আত্মাহুতি, পছন্দ নয় এমনদেরকে হত্যা-- যে কোন কিছুই করা জায়েজ তাদের জন্য, তাদের বিশ্বাস থেকে, অর্থাৎ যে কোন যায়গা থেকে যে কোন ভাবে যে কোন বিশ্বাসী তার মতন করে বিশ্বাসের জায়গাটাকে বর্ধিত বা সংকুচিত করতে পারে, তার সুবিধার্থে যতটুকু লাগে। এই সম্ভাবনার জায়গাটা থেকেই 'জঙ্গি'র জন্ম, অর্থাৎ কোন গোষ্ঠীর স্বার্থে 'বিশ্বাসের এই রূপটি নির্মাণ করা হয় এবং তাতে একদল বিশ্বাসী হয়ে ওই নির্দেশনায় এ্যাক্ট করে থাকে।
'মৌলবাদ' প্রসঙ্গে আর আলাদা করে বলবার দরকার নেই।
সামাজিক উন্নাসিকতা থেকে বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাসের দাপট বেড়েছে। পাশে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক চাপ। মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রগুলোর জনগণ শাসানোর যে পদ্ধতি বাংলাদেশের সে রকম নয়। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যের ওই রকম অনেক দেশের চাইতে জীবন-ত্যাগী-জঙ্গির সংখ্যা বাংলাদেশে অনেক বেশী হবে। তার কারণ ওই রাষ্ট্রগুলো আবার যে বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া রেখেছে তাও ওই বিশ্বাসের নামে। ফলে তার নিষ্ঠুরতার মাত্রা ও পদ্ধতি ওই রকম সাধারণ 'জঙ্গি' নির্মাণ সম্ভব নয় যেমনটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে বা ভবিষ্যতে ঘটবে।
গল্পপাঠ--
জঙ্গিদের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল তারা বলার চেষ্টা করছেন--ব্লগার, মুক্তমনা, নাস্তিক, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনষ্করা দেশের সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো কথাবার্তা বলছেন। তারাই জঙ্গিবাদকে উস্কানি দিয়ে এই ঘটনাগুলোর কারণ তৈরি করে দিচ্ছেন। আপনি দীর্ঘদিন মার্কিন দেশে আছেন। নানা দেশে নানা কর্মসূচিতে ভ্রমণ করেন। নানা বিষয়ে আপনার পাঠও ঈর্ষণীয়। এই ধর্মীয় অনুভূতি ব্যাপারটি আসলে কী জিনিস? আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ঘটনাটিই বা কী? আপনি কি মনে করে বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো কথাবার্তা ব্লগাররা বলেছেন?
আনোয়ার শাহাদাত--
আপনার প্রশ্নের এই অংশের "জঙ্গিদের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল তারা বলার চেষ্টা করছেন--ব্লগার, মুক্তমনা, নাস্তিক, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনষ্করা দেশের সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো কথাবার্তা বলছেন। তারাই জঙ্গিবাদকে উস্কানি দিয়ে এই ঘটনাগুলোর কারণ তৈরি করে দিচ্ছেন। " উত্তরের দরকার পড়ে না। কেনো না এটা বলছে মূর্খরা বা যারা বিশ্বাসটাকে ব্যবহার করে অন্য কিছু অর্জন করতে চান। আমার সবাই জানি ওইরকম কথা আসলে মিথ্যা, ভুল, অসৎ, অনাধুনিক ইত্যাদি।
মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি বা শিয়া শাসিত দেশগুলো এই 'অনুভূতি'কে ব্যবহার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকার দরকার পরে না। এই যে সারা পৃথিবীতে এখন ওই অনুভূতির তাণ্ডব চলছে এর আসলে কী কোন ব্যাখ্যা থাকবার দরকার পড়ে? অর্থাৎ তাদের যা ইচ্ছা তারা তাই করতে পারে ওই 'অনুভূতি'র নাম দিয়ে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে কিছু নেই। আধুনিক আইনি ব্যবস্থায় ওর কোন বিধান নেই। যদি এমন কিছু ঘটে থাকে আপনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন, আইনি ব্যাখ্যায় তার নিষ্পত্তি হতে পারে, সে বিধান আছেও।
অনুভূতির এই ব্যবহার স্বৈরতান্ত্রিকতার জন্য দরকার পড়ে। এভাবে বলি-- ধরা যাক আপনি আমাকে এই যে এই সব প্রশ্ন করেছেন এতেও আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এবং আমি আপনার বিরুদ্ধে একটা ধস্তাধস্তিমূলক সমাধানে যেতে চাইতে পারি ওই অনুভূতির নাম দিয়ে। আজ রাস্তায় গেলে যদি উ আমার এই বাঙ্গালী নৃতাত্ত্বিক চেহারাটা দেখে চাইনিজ বা একজন ককেশীয় লোক বলে ফেলে যে, তোমার ওইরকম অনভ্যস্ত চেহারাটা দেখে আমার গভীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। অতএব এই নাও তোমার একটা ঘুষি বরাদ্দ হলো এবং সে আমাকে একটা ঘুষি মারল!!! এই ভাবে একে সীমাহীন সংখ্যায় ব্যবহার করা যেতে পারে এবং যারা একে ব্যাবহার করতে চায় তারা সে-ভাবেই করে থাকে। বাংলাদেশের হত্যা তালিকার ধরন দেখেন-- সেখানে মুক্তমনা, সঙ্গীতপ্রিয়,ধর্ম যাজক (যে কোন ধর্মের এমন কী ওই ঘরানার লোকরাও মুক্ত নন), সমকামী... ।
এই যে অংশটুকু আপনার প্রশ্নের "আপনি কি মনে করে বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো কথাবার্তা ব্লগাররা বলেছেন?" এই উত্তরের কোন মানে হয় না। কারণ এর কোন অর্থ তাদের কাছে নেই। যখন এক জঙ্গি আর এক জঙ্গিকে হত্যা করে (আল কায়দা- দায়েশ [আইসিস] এক অপরকে হত্যা করে) তখনো তো ওইরকম একটি অনুভূতির ব্যবহার তারা করে থাকে। ফলে অনুভূতি একটি অর্থহীন ধ্বংসাত্মক আপেক্ষিক তত্ত্ব। একে সন্ত্রাসীরা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে।
গল্পপাঠ--
এই প্রসঙ্গে বাক স্বাধীনতা, স্পীচ, হেইট স্পীচ ইত্যাদি বিষয়গুলোও চলে এসেছে। এর ব্যাখ্যাও দেশে নানাজনে নানা রকমভাবে করছেন। যেমন সরকার বলছেন, দেশে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকার বিরোধীরা বলছেন বাক স্বাধীনতা নেই। কিছু কিছু পত্রিকা যেমন ক’ বছর আগে ব্লগারদের বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক খবর প্রকাশিত করছে। দিগন্ত টিভিতে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া হয়েছে। এমন কি বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে সংখ্যালঘু, মুক্তমনা, প্রগতিশীলদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ,হুমকি প্রকাশ করা হচ্ছে। এমনকি হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা শফি প্রকাশ্যে বলেছেন, নাস্তিকদের হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে গেছে। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর মধ্যে দিয়ে বাক স্বাধীনতা, হেইট স্পীচ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তি এসে পড়ে। আসলে ঘটনাগুলো কি?
আনোয়ার শাহাদাত--
এই প্রশ্নটির ভেতরে যে সব তথ্য দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ একটি গোলযোগপূর্ণ এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের নমুণা। আমাদের সরকারেরা এই রকমই বলে থাকে। আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, যদি এমন কোন মতপ্রকাশ করা হয় যা প্রচলিত আইনের আওতায়, যার মূলার্থটা প্রচলিত আইনকে উদ্বিগ্ন করে না বা লঙ্ঘন করে না, তবে তা যে যাই বলুক আমি তাতে তেমন ক্ষতি দেখি না। উদাহরন হিসাবে- ধরা যাক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন "আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে..."। এর মধ্যে আইনগত কোন ভায়োলেশন নেই। এর উত্তরে আমি এখন বলবো "প্রধানমন্ত্রীর এই স্টেটমেন্ট আমার ধর্মীয় এবং অধর্মীয় অনুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে..." এই দুটো স্টেটমেন্টই কোন আইনকে ভায়োলেট করে না। কিন্তু রাষ্ট্রের ভাবটা এমন যে, প্রথম যিনি বলেছেন (প্রধান মন্ত্রী) তারটা সঠিক এবং দ্বিতীয়টা অপরাধ (আমারটা), এর সবই হয়ে থাকে...
কিন্তু কথা হচ্ছে- ধরা যাক হেফাজতে ইসলাম বলেছে হত্যার কথা। জানেন তো এটা একটি মামলার বিষয় অর্থাৎ প্রচলিত যে আইন রয়েছে তার আওতায়ই সম্ভব একটা মকদ্দমা করা, সেটা হয়েছে ? মনে হয়না হয়েছে। এখন ওই হেফাজত জানবে কী করে যে রাষ্ট্রের আইন তার কাণ্ডজ্ঞানহীন, দায়িত্বহীন কথা গ্রহণ করবে না, বরং ওই রকম কথা বলবার কারণে তার বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তা হয়নি। এর কারণ জাতি হিসাবে আমরা যতো না আইনের মাধ্যমে কিছু অর্জন করতে চাই, তার চেয়ে অন্য পথে বিনোদিত হয়ে এর একটা সমাধান চাই। প্রচলিত আইন-ব্যবহারের প্রতি নাগরিকদের অনীহা বা অলসতা দেশের বর্তমান অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির একটি বড় কারণ। ।
কিন্তু কথা হচ্ছে- ধরা যাক হেফাজতে ইসলাম বলেছে হত্যার কথা। জানেন তো এটা একটি মামলার বিষয় অর্থাৎ প্রচলিত যে আইন রয়েছে তার আওতায়ই সম্ভব একটা মকদ্দমা করা, সেটা হয়েছে ? মনে হয়না হয়েছে। এখন ওই হেফাজত জানবে কী করে যে রাষ্ট্রের আইন তার কাণ্ডজ্ঞানহীন, দায়িত্বহীন কথা গ্রহণ করবে না, বরং ওই রকম কথা বলবার কারণে তার বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তা হয়নি। এর কারণ জাতি হিসাবে আমরা যতো না আইনের মাধ্যমে কিছু অর্জন করতে চাই, তার চেয়ে অন্য পথে বিনোদিত হয়ে এর একটা সমাধান চাই। প্রচলিত আইন-ব্যবহারের প্রতি নাগরিকদের অনীহা বা অলসতা দেশের বর্তমান অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির একটি বড় কারণ। ।
0 মন্তব্যসমূহ