সংবাদটি সত্য নয় প্রিয় মহাশ্বেতাদি

অমর মিত্র

প্রিয় মহাশ্বেতাদি, আপনার কাছেই তো কতবার শুনেছি, কতবার উচ্চারিত হয়েছে, উলগুলানের শেষ নাই। মানুষের সংগ্রাম ফুরোয় না। বীরসা আর চোট্টি মুন্ডা বনের অধিকার বুঝে নিতেই এসেছিল, এসেই যাচ্ছে। সেই আসার বিরাম নেই। বিরাম হবে কেন, মানুষ যে সেই কত বছর ধরে যুদ্ধ করতে করতে টের পেয়েছে, যুদ্ধ ফুরোয় না। মারাং দাই মহাশ্বেতা বলেছেন, এক যুদ্ধ যেতে যেতে আরেক যুদ্ধ এসে যায়। প্রিয় মহাশ্বেতাদি, জগমোহন নামের হাতিটি তো এখনও পার হয়ে যাচ্ছে ক্ষুধার্ত পৃথিবী।
তার মৃত্যু এখনও হয়ে যাচ্ছে, কত প্রলম্বিত সেই মৃত্যু, তার বুঝি আরম্ভ নেই, শেষও নেই। ক্ষুধার্ত মানুষ পার হয়েই যাচ্ছে মহাপ্রান্তর। ভয়ানক রৌদ্র, কঠিন মাটি, খিদেয় খিদেয় না খেয়ে খেয়ে মানুষগুলো বাড়েনি, অদ্ভুত সব শিশু চাল লুট করে পালায়। পালিয়ে যাচ্ছেই। প্রিয় মহাশ্বেতাদি, দ্রৌপদী মেঝেনকে কাপড় পরানোর কেউ নেই, না এখনও নেই। তার এজাহার নিয়েই যাচ্ছে ছোট কত্তা থেকে বড় কত্তা। বস্ত্রহীন দ্রৌপদী আমার দেশমাতৃকাই হয়ে উঠেছিল মণিপুরে।

’‌৭১–‌এর দেশ, ’‌৭৭–‌এর দেশ আর এই বৃষ্টিহীন মাঠঘাট, নিদয়া শ্রাবণে কোনও তফাত হয়নি। এতটা দিন গেল, সেই ভারতবর্ষ আর এই ভারতবর্ষকে রেখে যে আপনি চলে গেলেন, মারাং দাই, ছত্তিশগড়ে, জঙ্গলে জঙ্গলে মানুষ যে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। জমি গেল, হাল গেল, ঘরের মেয়ে দ্রৌপদী মেঝেনকে বনের ভেতরে ধরেছে নিরাপত্তারক্ষী, সকলকে রেখে চলে গেলেন। অথচ সেই বীরসা মুন্ডার দেশে, সাঁওতাল পরগনায়, সিংভূমের জঙ্গলে, ডুলং আর সুবর্ণরেখা কূলে, পথের ধারে বসে আছে তো রাবণ সোরেন, জেকব মুন্ডা কিংবা দ্রৌপদী মেঝেন, উৎসব নাইয়া। কত দিন ধরে বসে আছে শালবনের ধারে, হুড়ি, পাহাড় টিলার নিচে। স্টেশনের ধারে, বাবুবাড়ির দুয়ারে ভাতের জন্য। মারাং দাই, দিদি, মা অন্নপূর্ণা ভাত নিয়ে আসবে। মহাশ্বেতাদির থাকা আর না–থাকায় অনেক তফাত। মহাশ্বেতাদিই তো আমাদের শিখিয়েছিলেন বহরমপুরের অনীক পত্রিকায় গল্প কেন, উপন্যাসও লেখা যায়। আর সেই লেখা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। সেই শিক্ষাই আমার সমস্ত জীবনের সঞ্চয়।

মানুষের কাছে যাও। মানুষ নিয়ে লেখো। কত রকমের মানুষ তাঁর গল্পের বিষয়। আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম ১৯৭৭–‌এর অক্টোবর কিংবা নভেম্বরে। তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমার একটি গল্প পড়ে। হ্যাঁ, এমন কতজনের খোঁজ করেছেন তিনি গল্প পড়ে, উপন্যাস পড়ে। তখন মহাশ্বেতাদিকে পড়ে আমরা উদ্দীপ্ত হয়েছি বারবার।

সেই ’৭২–‌এর প্রসাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘‌হাজার চুরাশির মা’‌ গোপনে পৌঁছে গিয়েছিল জেলখানায় বিপ্লবীদের কাছে। তারপর ১৯৭৬–‌৭৭ নাগাদ কৃত্তিবাস পত্রিকায় ‘‌অপারেশন বাসাই টুডু’‌, অমৃত পত্রিকায় ‘‌জগমোহনের মৃত্যু ও তারপর’‌‌, মহাশ্বেতাদিকে আমরা পড়েই চলেছিলাম। বহুদিনের এক অচলায়তনে যেন ঘা মেরেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, ঘা–‌ই নিশ্চয়। ধামসায় ঘা দিয়েছিলেন তিনি। গ্রাম ভারতবর্ষ ফিরে এসেছিল তার ভাঙাচোরা মুখ নিয়ে।

আমাদের গল্প আমাদের উপন্যাস যখন নীরক্ত, মানুষের মুখ যখন ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমাগত, তখন সেই গত শতাব্দীর সাতের দশকে মহাশ্বেতাদি সেই বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পথে নেমে এসেছিলেন। পথই পথ। দিদি সেই যে রোহিণী নামের গ্রাম, আদিম জাতি ঐক্য পরিষদের রাতভর মিটিং, মনে পড়ে। সেই যে জ্যাকব মুন্ডা, বড় সাইজের ঢল ঢল হাফ শার্ট আর সস্তার প্যান্ট, যে আমার কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার নিয়ে গিয়েছিল, তার হাত থেকে সেই বই ঘুরতে লাগল অন্যজনের কাছে, মুন্ডা গ্রামে গ্রামে, আর আর ফেরতই পেলাম না বইটি। সেই সব বই এখনও ঘুরছে কারও হাতে, হাত বদল হয়েই যাচ্ছে। ৪০ বছর হয়ে গেল। কেউ যে বিশ্বাসই করবে না মারাং দাঈ নেই।

মহাশ্বেতাদি আমাদের সাহিত্যের এক বিরল প্রকৃতির লেখক। তাঁর কোনও পূর্বসূরি ছিল না, তাঁর উত্তরসূরি হবে না। আরম্ভে কেন, বহুদিন তাঁর স্পর্শ পেয়েছি আমি। তাঁর সমুখে বসে নতুন লেখা গল্প পড়েছি। তাঁর মতামত শুনেছি। শুনেছি সেই ১৩৫০–‌এর মন্বন্তরের কথা, তৃপ্তি মিত্র আর তিনি মন্বন্তরের কথা বলছেন, জীবিত শিশু মৃত মায়ের স্তন্যে মুখ দিয়ে আছে বলতে বলতে দুই মহীয়সীর চোখে জল, আমি নীরব শ্রোতা। শুনেছি ঝাঁসির রানী লিখতে ঝাঁসি একা একা ঝাঁসির পথে হেঁটেছিলেন কীভাবে সেই কথা।

আমার এই সামান্য জীবনে মহাশ্বেতাদির যে অকৃপণ ভালবাসা পেয়েছি, তা ধন্য করেছে আমাকে। এ জীবনের পুণ্য সেই মেলামেশা। আমাকে কোটিপতি করেছে তাঁর জীবনের স্পন্দন। মনে পড়ে চাকরির কারণে দীঘায় আমার হোটেল বাসের সময় তিনি বেড়াতে গিয়েছেন, বিকেলে আমরা ঘুরছি, হঠাৎ দেখি তিনি এক পুলিস কনস্টেবলের হাত ধরে টানাটানি করছেন, চ থানায় চ। সে গরিব আমওয়ালার ঝুড়ি থেকে বিনি পয়সায় অর্ধেক আম নিজের থলেতে ভরে চলে যাচ্ছিল। ভিড় জমে গেছে সেই অদ্ভুত দৃশ্যে।

জীবনের সত্য আর সাহিত্যের সত্য একাকার। মহাশ্বেতাদি চলে গেলেন, কী করে যাবেন তিনি?‌ হয় বীরসার দেশে গেছেন, না হয় ছত্তিশগড়ের অর‌ণ্যে, সিংভূমের পাহাড়ে, ভাগনাডিহির প্রান্তরে। এই যাওয়া সেই পথে যাওয়া। না, সংবাদ সত্য নয়। এই মৃত্যু সত্য নয়। বসাই টুডুর কথা ভুলে গেছি আমরা?‌ কতবার এনকাউন্টারে মরেছে বসাই, আবার মজুরির লড়াই নিয়ে অন্য জায়গায় বেঁচে উঠেছে। বসাই বসাই। মহাশ্বেতা তুমি বসাইয়ের জননী, তোমার মৃত্যু হয় না। তোমার বেঁচে ওঠার খবর ধামসা–মাদলে ফিরে এল বলে।‌‌‌

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. এক কথাশিল্পী আরেকজনের মৃত্যুতে যেন দিশেহারা। এ লেখায় এরই প্রতিফলন ।

    উত্তরমুছুন