পাওয়ার

অভ্র ঘোষ

আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের পাওয়ার (Power) বা ক্ষমতার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্ব অর্জন করেছে। নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর আলোচনা আমরা দেখতে পাই। সাবেকি সমাজবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে ‘ক্ষমতা’কে বিচার করা হত ক্ষমতাশালী ব্যক্তির দমন বা পীড়নের শক্তি হিসেবে, তার প্রভাবকারী কর্তত্ব হিসেবে। এর সঙ্গে আলোচনা দেখা যেত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে, না বিকেন্দ্রিত করে দেওয়া হবে--তা নিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ দার্শনিক বিশ্লেষণ। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে এই সাবেকি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়িয়ে এক নতুন মাত্রার বিশ্লেষণ চোখে পড়েছে।
মূলত আচরণবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা যেমন, চার্লস ই. মেরিয়াম (C. E. Marriuam), হ্যারল্ড ডি ল্যাসওয়েল (H. D. Lasswel). আব্রাহাম ক্যাপলান (A. Kaplan), জর্জ ক্যাটলিন (G. Catlin), রবার্ট ডাল (R. Dall), ভি ও কী (V.O. Key), হানস মরগেনথ (H. Margenth) প্রমুখ ‘ক্ষমতা’র ধারণাটিকে একটি সামাজিক সম্পর্কের ধারণা, আচরণগত ধারণা, বিশেষ পরিস্থিতিগত ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।। দেখতে চেয়েছেন ক্ষমতা আসলে একধরনের কার্যাবলি এবং সামাজিক (আর্থিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃ্তিক ইত্যাদি সর্বপ্রকার অর্থে) সম্পর্কের আবর্তে কার ক্ষমতা, কীভাবে ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়, তার ফলাফল কী--ইত্যাদি প্রশ্নগুলি সেখানে জরুরি হয়ে ওঠে। সাবেকি রাজনীতি শাস্ত্রে ক্ষমতা বিচার করা হত রাষ্ট্র, সরকার বা বিভিন্ন সংগঠন বা সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আইনগত অবস্থান থেকে। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে এই প্রাতিষ্ঠানিকতা, আইনানুগত্যতার সীমা অতিক্রম করে ক্ষমতার আচরণগত প্রতিক্রিয়া, তাকে এক সামাজিক প্রবাহে অন্তর্ভুক্ত উপাদান হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এদিক থেকে একালে ক্ষমতাতত্বের গতি ও মাত্রার ধারা একেবারেই পালটে গেছে।

ক্ষমতা মূলত এক সম্পর্কের ধারণা। কোনো ব্যক্তির ক্ষমতা আছে কি নেই তা বোঝা যাবে যখন সেই ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে এমন কিছু কাজ করতে বাধ্য করতে পারে যা সেই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় করত না। অর্থাৎ ক্ষমতা হল একধরনের দক্ষতা বা প্রভাব যা অন্যের উপর প্রযুক্ত হয়। অন্যের আচরণকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হলে তবেই কারোর ক্ষমতার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। তাহলে, ক্ষমতার ধারণা সমসময়েই দুই বা ততোধিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, জাতি বা অনুরূপ কারকের সম্পর্কের মধ্যে নিহিত। পারস্পরিক সম্পর্কের আবর্ত ব্যতিরেকে ক্ষমতা অনুধাবন করা যাবে না।

ক্ষমতা আবার আচরণকেন্দ্রিক ধারণাও বটে। অর্থাৎ ক্ষমতাশালী ও ক্ষমতাধীন ব্যক্তিদ্বয়ের সম্পর্ক বুঝতে হলে তাদের পারস্পরিক আচরণ ও তজ্জনিত প্রভাব ইত্যাদির চরিত্র বুঝতে হবে, নাহলে কে কীভাবে কার আচরণ পরিবর্তন করতে পারেন, তা বোঝা যাবে না। এই অর্থে ক্ষমতা আচরণকেন্দ্রিক। ক্ষমতার ধারণা পরিস্থিতি নির্ভর। অর্থাৎ দুই ব্যক্তির সম্পর্ক কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে এবং ক্রিয়াশীল থাকছে, তার বিশ্লেষণ না করলে ক্ষমতার প্রকৃতি বোঝা যাবে না। দেশের প্রধানমন্ত্রীর অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি যতক্ষণ তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আছেন, পদচ্যুত হলে তাঁর ক্ষমতার অনুরূপ চরিত্র বজায় থাকবে না। এসব কথা বিবেচনা করেই সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, ক্ষমতা সম্পর্ক, আচরণ ও পরিস্থিতিকেন্দ্রিক এক ধারণা।

ক্ষমতার ধারণাটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন ক্ষমতা এক ডিসপোজিশ্যনাল ধারণা। যেমন, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজি দার্শনিক টমাস হবস মনে করতেন, ‘ Power of man’s present means to any future apparent good.’ ক্ষমতা মানুষের এমন এক সামর্থ্য যা হয়ত এখুনি প্রকাশমান নয়, ভবিষ্যতে প্রকাশ পেতে পারে। কর্তৃপক্ষের শাস্তির ভয়ে আমরা অপরাধ করিনি, কিন্তু জানি অপরাধ করলে কী শাস্তি কপালে জুটবে। এই ভবিষ্যৎ শাস্তির আশংকার নিরিখে ক্ষমতার চরিত্র ব্যাখ্যা করা যাবে। আবার এর ঠিক বিপরীত মেরু থেকে বার্ট্রান্ড রাসেল ক্ষমতার প্রকাশ্যতার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে ‘Power is the production of intended effects’. ক্ষমতাশালী ব্যক্তির ক্ষমতার চরিত্র বুঝতে হবে কতখানি তিনি তাঁর অভিপ্রায় অনুযায়ী ক্ষমতাধীনের আচরণকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন তার পরিমাণের উপর।

একালের এক বিশিষ্ট সমাজিবিজ্ঞানী ডেনিশ রঙ (Dennis Wrong) ক্ষমতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে করতে গিয়ে কতকগুলি জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন ক্ষমতার সঙ্গে অভিপ্রায়ের সম্পর্ক। সাধারণভাবে সমস্ত ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবানের অভিপ্রায়টি আমরা চোখে দেখতে পাই এবং তার বাস্তবিক চরিতার্থতার রূপ দেখে ক্ষমতার প্রকৃতি নিরূপণ করি। কিন্তু সবসময়েই কি অভিপ্রেত ফল পান ক্ষমতাপ্রয়োগকারী ব্যক্তি? মা সন্তানের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন তার মঙ্গলের জন্য, কিন্তু অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে শিব গড়তে গিয়ে বাদর গড়ে দিলে অভিপ্রেত উদ্দেশ্যের সঙ্গে ক্ষমতাপ্রয়োগের সম্পর্ক মেলে না। অথবা কতকগুলি মুরগিছানার সঙ্গে বৃহদাকার হাতির নাচার ইচ্ছে হতে পারে, কিন্তু এতে যে মুরগিছানাগুলির জীবনসংশয় হবে হাতির এমন অভিপ্রায় না থাকলেও ওই অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এই সমস্যাটিকে মাথায় মাথায় রেখেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে ক্ষমতা অভিপ্রায় অনুযায়ী ফলদায়ক না হলে তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। রঙ বলেছেন, এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ বা অনুপস্থিত। তিনি আরো বলেছেন, যদি দেখা যায়, কোনো ক্ষেত্রে, পূর্বে ক্ষমতাপ্রয়োগ করার পর অভিপ্রেত ফল পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু এখন তা আর ঘটছে না, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে ক্ষমতার সম্পর্ক ভেঙে গেছে বা তার অবসান ঘটেছে।

সুপ্ত বা সম্ভাব্য এবং প্রকাশ্য ক্ষমতার প্রসঙ্গগুলিও আলোচনা করতে হবে। সাধারণভাবে ক্ষমতার চরিত্র বোঝা যায় প্রকাশিত বা প্রযুক্তি ক্ষমতার বহর দেখে। কিন্তু ক্ষমতাকে তো সম্ভাব্য সামর্থ্য বা সুপ্ত সামর্থ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকেও ভাবা যেতে পারে। ক্ষমতাবান ব্যক্তি ক্ষমতার প্রকাশ না ঘটিয়ে বা ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছা ব্যক্ত না করেও অন্যের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারেন। কার্ল ফ্রিড্রিশ যাকে বলেছিলেন, ‘the rule of anticipated reaction’। এক্ষেত্রে যারা ক্ষমতাশালীকে মেনে নিচ্ছে তারা আনুগত্য প্রকাশ না করার প্রক্রিয়াটি ভেবে নিয়েই তাকে মেনে নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আদেশ যে সবক্ষেত্রে মানা হচ্ছে তা নয়। কিন্তু তার পছন্দ কী হতে পারে একথা ভেবে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তখন কিন্তু অভ্যস্ত বা প্রচ্ছন্ন ক্ষমতার অস্তিত্ব লক্ষণীয়। ক্ষমতাবানের প্রত্যাশামত যখন তাঁর আদেশ বা ইচ্ছা সম্মান পায়, যে আদেশ বা ইচ্ছার প্রকাশ তিনি বাস্তবে করেননি, তখন সুপ্ত ক্ষমতার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। মার্কিন কংগ্রেস যখন রাষ্ট্রপতির ভেটো প্রদানের ক্ষমতার ভয়ে কোনো বিল পাশ করার কাজ থেকে বিরত থাকে তখন রাষ্ট্রপতির সুপ্ত বা সম্ভাব্য ক্ষমতার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। সুতরাং, ক্ষমতা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, ক্ষমতাবানের প্রত্যাশা কি, ক্ষমতাবানের অভিপ্রায় সম্পর্কিত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের সচেতনা কতটুকু, ক্ষমতা প্রসঙ্গে এগুলি অবশ্যই বিচার্য।

ক্ষমতা সম্পর্কে বিচার করে সাধারণভাবে একথা বলা যেতেই পারে যে সমাজে এই সম্পর্ক অপ্রতিসম (asymmetrical)। কারণ ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাধীনের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ ও অধীনতামূলক। কিন্তু সমাজে এমন সম্পর্কের ঘটনাও তো বিরল নয় যে দুইপক্ষের ক্ষমতা সমান সমান। তাহলে সাধারণভাবে দৃষ্ট অপ্রতিসম ক্ষমতার সম্পর্ক একমাত্র বাস্তবতা নয়। সমক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিপাক্ষিকতার অস্তিত্বও আছে। পিটার ব্লাউ (Peter Blau) অবশ্য বলবেন, অন্তঃনির্ভরশীল এবং সমক্ষমতাসম্পন্ন দুইপক্ষের পারস্পরিক প্রভাববিস্তারের সম্পর্ক ক্ষমতার অপ্রতুলতাকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু ডেনিস রঙ এই মতামতটিকে সঠিক কারণেই তেমন গুরুত্ব দেননি, কারণ সামাজিক সম্পর্কের জগতে ক্ষমতার সম্পর্কের অপ্রতিসাম্য থাকলেও সেই দুই অপ্রতিসম ক্ষমতাপক্ষের অবস্থান পালটে যেতে পারে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি বা কাজের ভূমিকাগত ক্ষেত্রে। তাহলে ক্ষমতার সম্পর্ক একান্তভাবে এবং নির্ভেজাল অপ্রতিসম, একথা বলা যুক্তিসম্পন্ন হবে না। ক্ষমতার ভারসাম্যের কথাটাও চিন্তা করতে হবে। ক্ষমতাবান এক্ষেত্রে ক্ষমতাধীনকে প্রভাবিত করতে পারলেও অপরক্ষেত্রে ক্ষমতাধীন হয়ে উঠতে পারে ক্ষমতাবান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিবেচনা করে ভারসাম্যের ধারণাটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই ভারসাম্যের কথা বলতে গিয়েই রঙ ‘Intercursive’ ক্ষমতা-সম্পর্কের কথা বলেছেন। বস্তুত Integral বা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিপরীত ক্ষমতা Intercursive

-ক্ষমতা-সম্পর্কের ধারণাটি এসেছে। আধুনিক বহুত্ববাদী সমাজে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়, উচ্চারিত হয় এই প্রশ্ন যে ক্ষমতাবানকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং কারাই বা তা করবে? সাধারণত আধুনিক উদারনৈতিক রাষ্ট্রসমূহে আইনব্যবস্থা বা সংবিধান ক্ষমতাবান শাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আদালতের বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার ধারণাও গুরুত্বপুর্ণ। তাছাড়া কেন্দীভূত ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আরো নানা উপায় রয়েছে--(ক) কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে বিভাজন করে বিকেন্দ্রীকরণের ধারা তৈরি করা, (খ) ক্ষমতাবানের ক্ষমতার ব্যাপকতা ও পরিধি নিয়ন্ত্রণ করা, (গ) কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অধিকারী শাসককুলকে উৎখাত করে ক্ষমতাধীন কর্তৃক ক্ষমতা দখল ইত্যাদি। এইভাবে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরো বিভিন্ন প্রকার প্রচেষ্টা রয়েছে। এসবের সূত্রে আমরা বলতেই পারি যে আধুনিকযুগে রাজনীতি কেবল ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, ক্ষমতাকে সীমায়িত করা বা ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার লড়াইও বটে।

এতক্ষণ ক্ষমতার ধারণাটি যেভাবে বিশ্লেষিত হল তাতে ক্ষমতা বলতে বুঝি একটা বিশেষ গুণ যার মাধ্যমে ক্ষমতার অধিকারী আরেকজনের উপর ক্ষমতা আরোপ করতে পারে। এক্ষেত্রে ক্ষমতার একটি কেন্দ্র খুঁজে নেওয়া দুষ্কর হয় না। কিন্তু ভিন্ন এক দার্শনিক প্রত্যয় থেকে ক্ষমতার সর্বাধুনিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর (Michel Foucauli, ১৯২৬-১৯৮৪) রচনায়।

ফুকো দেখিয়েছেন ক্ষমতা কেন্দ্রহীন, রাজ্যহীন। ক্ষমতা চারদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে বা থাকতে পারে। ক্ষমতা মানে কেবল শাসকের নিষেধাজ্ঞা নয়, আইনের আদেশ নয়। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আইনানুগ আদেশ প্রতিরোধ করার আকাঙ্ক্ষাতেও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। এই অর্থে ক্ষমতা গড়ে ওঠে শক্তির সম্পর্কের বৃদ্ধিতে, ক্ষমতার প্রকাশ নিরন্তর সংঘর্ষের মধ্যে। উৎপাদনের উপায়সমূহ বা যন্ত্রাদি, সামাজিক ছোটোবড় সংস্থা, পরিবার, ছোটবড় গোষ্ঠী, শ্রেণি ইত্যাদির নিরন্তর সংঘাতে বিচিত্রভাবে সমাজের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নানাধরনের বিদারণ--এই সবের মধ্যেই ক্ষমতার বিচিত্র প্রকাশ ঘটে। মার্ক্সবাদী কায়দায় ফুকো ক্ষমতাকে শ্রেণি-সংঘর্ষ বা শ্রমিক-মালিক সংঘাত বা ওই ধরনের অন্য কিছুতে কেন্দ্রীভূত করতে নারাজ। ক্ষমতাকে কেন্দ্রচ্যুত করে ফুকো বলেছেন, ক্ষমতাকে কোনো কেন্দ্রবিন্দুর প্রাথমিক অস্তিত্বের মধ্যে সন্ধান করা উচিত হবে না। ক্ষমতার ভিত সমসময়েই গতিশীল।

আসলে ফুকো হেগেলীয় বা মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ইতিহাস বিচারে আস্থা রাখেননি। তাঁর বিশ্বাস নিৎসে কথিত Genelogy বা বংশানুচরিত পদ্ধতিতে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে আকস্মিকতা, আশাতীত দুর্বিপাক, অবিশ্বাস বা দুর্জ্ঞেয়তার স্থান নেই। একটা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যবোধ দ্বান্দ্বিকতায় কাজ করে। দ্বন্দ্ব তত্ত্বানুযায়ী প্রতিটি যুগে এক-একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা তার নিজস্ব অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে আরো উন্নত কোন অবস্থায় পৌঁছে যায়। সভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটে এবং সমস্ত ধরনের সভ্যতাতেই ক্ষমতার বিশেষ কেন্দ্রগুলিকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। ফুকো এর পরিবর্তে জিনিওলজির পদ্ধতির কথা বলেন, যে-পদ্ধতির ক্ষেত্রে কোনো উদ্দেশ্যবোধ কাজ করে না। কোনো ধারাবাহিক প্রগতির চিন্তা নেই। ফুকো দেখাতে চান যুগে যুগে সংস্কৃতি, চিন্তার ধরন, ধ্যানধারণার বিপুল পরিবর্তন ঘটে বটে, কিন্তু ক্ষমতার প্রয়োগপদ্ধতির (Technology of Power) মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটে না। উনিশ শতকের দার্শনিক বেন্থামের প্যান অপটিক্যাল চিন্তার পিছনে মানব-হিতৈষণার আদর্শ ছিল ঠিকই, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার প্রকরণ ও প্রয়োগপদ্ধতিকে আরো উন্নতমানের করে তোলা। সামন্ততান্ত্রিক যুগে রাজার হাতে প্রাণদণ্ড হত সাধারণ্যে, অবিশ্বাস্য রকমে নিষ্ঠুর ও বর্বর প্রকাশ ছিল তার। উনিশ শতকের বুর্জোয়া যুগে শাস্তির ধরন পাল্টালো, সাধারণতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রচ্যুত ক্ষমতা তার প্রয়োগ পদ্ধতি বদলাল। শাস্থির উন্মুক্ত অনুষ্ঠান থেকে গোপন মনস্তাত্ত্বিক অত্যাচার স্থান পেল।

আরো একটি দিক থেকে ফুকো ক্ষমতার ধরনকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। সপ্তদশ শতকের ইউরোপে যে যুক্তিবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তার সর্বশ্রেষ্ট প্রবক্তা ছিলেন রনে দেকার্তে (Rene Descartes, ১৯৫৬-১৬০)। দেকার্তের মতে মানুষের শুদ্ধ চিন্তা ও যুক্তি এক ও অভেদ। যুক্তির নির্ভরতা ছাড়া সত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞানই ক্ষমতা। ফুকো ধ্রুপদীযুগের এই যুক্তিবাদী দর্শনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞানের এষণা সমাজের ক্ষমতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে যুক্তির সার্বভৌম প্রাধান্যকে অস্বীকার করে একদল মানুষ যখন অন্যবিধ আচরণ করে ( যুক্তিবাদীদের মতে যা অযুক্তির প্রকাশ) তখন তারা আইনভঙ্গকারী, অসামাজিক জীব বা একটা সামাজিক টাইপ হিসেবে ‘উন্মাদ’ বলে আখ্যায়িত হন। ফুকো দেখান এই ধরনের অযুক্তির মানুষজনকে দমনের জন্য এবং যুক্তির স্বরাটত্ব প্রমাণের জন্য কীভাবে যুক্তিবাদ ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা ঘটায়। অযুক্তিকে ক্ষমতার সাহায্যে সবেশে আনার জন্যই যেটা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয় তা হল অযুক্তিকে অসুস্থতা বা রোগ হিসেবে ঘোষণা করা। অসুস্থ মা্নুষকে চিকিৎসা করে সংস্কৃত করে তোলার এই যে মানবহিতৈষী ব্রত-- তার মধ্য থেকেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতার সদম্ভ প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা ঘটে। যুক্তিবাদী ধ্রুপদী যুগের সামাজিক সম্পর্কগুলির মধ্যে এই ক্ষমতার সম্পর্কই নিহিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ