মহাশ্বেতা দেবী কেন অনিবার্য

রুমা মোদক

একজন লেখকের লেখক হয়ে উঠা কতোটা সহজাত প্রতিভাগত আর কতোটা পারিবারিক সামাজিক পরিমণ্ডল কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তা নিয়ে কোনো নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বোধকরি কঠিন। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির জ্ঞান চর্চা আর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন পূর্বক একজন রবীন্দ্রনাথের গড়ে উঠা যেমন সত্য, তেমনই স্ব-সমাজ বিচ্ছিন্ন একজন লালনের স্বজ্ঞানে-স্বশিক্ষায় অন্তর্জগতের সত্য সন্ধানে লালন হয়ে উঠাও বাংলার সমৃদ্ধ সাহিত্য ভুবনের অনস্বীকার্য বাস্তবতা।
পারিবারিক পরিমণ্ডলের প্রসঙ্গটি একারণে যে, পিতা যার কল্লোল যুগের কল্লোলিত পুরুষ মনীশ ঘটক, কাকা কিংবদন্তি ঋত্বিক ঘটক, মামা ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরী, সেই মেধাবী রক্তের উত্তরাধিকারী একজন মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম আর বেড়ে উঠার পরিমণ্ডলই কি ঘোষণা করে তাঁর ভবিতব্যের বার্তা, যার সাক্ষরই তিনি রেখে গেছেন নিজের সাহিত্য অভিযাত্রার প্রতিটি বাঁকে, নিজের গন্তব্য অন্বেষণের ক্লান্তিহীন পরিভ্রমণে এবং ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রমে।

বোধকরি এই হয়ে থাকে একজন শক্তিশালী লেখকের অন্তর্গত অভিপ্রায়। আপন সাধনার গন্তব্য খুঁজে ফেরা, দলিত, প্রান্তিক নিপীড়িতের মাঝে তা খুঁজে পাওয়া এবং আবিষ্কৃত ঠিকানার আরাধ্য জেনেই স্থিত হওয়া, স্বস্তি পাওয়া এবং সন্তুষ্টি অর্জন করা। যা হয়তো অধিকাংশ লেখকের অধরা স্বপ্নই থেকে যায়, শেষ পর্যন্ত এবং হয়তোবা সেটাই একজন লেখককে কালোত্তীর্ণ হবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। নিজ চেষ্টা পরিশ্রম আর অনুসন্ধিৎসায় মহাশ্বেতা দেবী লেখক সত্ত্বার যে গন্তব্য খুঁজে নিয়েছিলেন তার জন্য কৃতিত্ব যেমন তাঁর প্রাপ্য, ঠিক তেমনিভাবেই সহজাত সৃজনশীলতা ও মেধার সমন্বয়ে সৃষ্টিতে মগ্ন থাকা আর পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করার কৃতিত্বটাও তাঁর সমানভাবেই প্রাপ্য। কেননা সচেতন প্রয়াসে আদ্যোপান্ত এ তাঁর একারই লড়াই। স্বীকার্য সত্য এই যে, নশ্বর মানুষ তার জীবনব্যাপী কর্মযজ্ঞে সাধনা করে অলীক অমরত্বের। জৈবিক দেহ নয়, কর্মই তাঁকে সেই মোহময় পথের সন্ধান দেয়। কখনো ‘আত্মপ্রেম’ যদিও বা হয়ে উঠে অমরত্বের বাসনার ক্রিয়াশীল সংকীর্ণতা, তবু মানুষই পারে শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতির সমন্বয়ে আপন অন্তরে জন্ম দিতে অপরিমেয় মানবিক বোধ দায়বদ্ধতার। অতঃপর অমরত্বের বাসনা আর দায়বদ্ধতার সমন্বয়ে মানব-সন্তানের জীবন ও কর্ম উৎসর্গিত হয় মানব-কল্যাণের উদ্দিষ্টে। অমরত্বের বাসনার হয়ে উঠে মানবিক হয়ে উঠারই গৌরব গাথা। অরণ্যের অধিকারের ভূমিকায় যেমনটি মহাশ্বেতা দেবী বলেন “দায়িত্ব অস্বীকারের অপরাধ সমাজ কখনো ক্ষমা করে না”। সেই দায়িত্ব প্রকারান্তরে দায়বদ্ধতাই তাকে অভীষ্ট গন্তব্যের সন্ধানে চালিত করেছে। লেখক হিসাবে তিনি খ্যাতি কিংবা জনপ্রিয়তা কিংবা স্বীকৃতির কাছে সমর্পিত হন নি, যা হতে পারতেন প্রাথমিক পর্যায়ে সাহিত্য চর্চার সাফল্যের পর। হয়তো লেখক সত্তার আবশ্যিক অনুষঙ্গ অতৃপ্তি তাঁকে গন্তব্য অনুসন্ধানে প্ররোচিত করেছে এবং ক্লান্তিহীন পথিক মহাশ্বেতা দেবী সেই চলার পথেই দায়িত্বের মতো মহান মানবিক বোধটুকু অর্জন করে নিয়েছেন সাহিত্য চর্চার পূর্বশর্ত হিসেবে। যাই হোক না কেন, আজ এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যাংগন যখন মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ, বিমূঢ় তখন সাহিত্য মোদী পাঠক মাত্রই জানেন এই দায়িত্ব আর প্রতিভার অপূর্ব সম্মিলনের কারণেই তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন স্বতন্ত্র গন্তব্য, আর তাই বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান হয়ে উঠেছে অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্ববোধ জারিত সমাজকর্মী সুলভ কর্মতৎপরতা তাঁর সাহিত্যকর্মে ব্যতিক্রমী পালক যোগ করে তাঁকে তাঁর সমকালেই স্বতন্ত্র করে তুলেছে সাধনার একনিষ্ঠতায়।

মূলত তাঁর দুটি সত্তা হয়ে উঠেছে একটি আরেকটির পরিপূরক সমাজকর্মী কিংবা লেখক, কখনোই তিনি একটির জন্য অপরটির সাথে আপোষ করেন নি। বামপন্থী পরিবারের রাজনৈতিক বিশ্বাস তৈরি করেছে তাঁর মানস আর সাংস্কৃতিক অভিরুচি, কিন্তু একজন যথার্থ বিজ্ঞান মাস্ক ব্যক্তির মতোই কোনো তত্ত্বে অন্ধ-আনুগত্য স্থাপন করেননি। প্রচলিত- সেই হারানো বামপন্থার হাতে সিংগুর-নন্দীগ্রামের জমি দখলের প্রতিবাদে ঝলসে উঠেছেন, হয়তো আপাত ভুল পথে সমাধান খুঁজেছেন, কিন্তু এর অসামঞ্জস্যতা সনাক্তপূর্বক স্বীকার করতেও দ্বিধা করেন নি।

সাহিত্য সাধনায় ও স্পষ্ট তাঁর সেই আপোষহীন অভিযাত্রা। ১৯৫৬ সালে ‘ঝাঁসির রানী’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে যে সাহিত্য যাত্রা শুরু তাঁর, সে যাত্রা ছিল মধ্যবিত্ত নারীর লক্ষ্মণগণ্ডি ভেঙে স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরির ইংগিত। ৮ বছরের সন্তানকে স্বামীর কাছে রেখে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঝাঁসি গোয়ালিয়র। এই উদ্ধত প্রথাভাংগা যাত্রাভংগির কারণে, পরবর্তীকালে নারী লেখকদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘আইডল’ বা আরবি তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণেই উত্তর প্রজন্মের নারী লেখকরা গন্তব্য খুঁজেন চেনা চার দেয়ালের বাইরে। হতে পারে একজন ঔপন্যাসিকের সহজাত প্রবণতা এই সাহিত্য-সৃষ্টি, হতে পারে নিরীক্ষা তাঁর কালের প্রয়োজন কিংবা নিজেকে স্বতন্ত্র হিসাবে উপস্থাপনের আয়োজন। কিন্তু এতো নিরেট সত্য যে আমাদের স্বদেশ-স্বসমাজ বাস্তবতায় একজন নারী লেখক যথেষ্ট সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা সত্ত্বেও থেকে যান চেনা চক্রেই, যে চক্র আবর্তিত হয় কেবলই তার সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার চার দেয়ালে। চৌকাঠ ডিঙিয়ে তা পৌঁছাতে পারে না বীরসা-চোট্টি মুণ্ডা পর্যন্ত, যা সম্ভব করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, যে কারণে তিনি ‘নারী লেখক’ জাতীয় একমাত্র বহু ঊর্ধ্বে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন জীবদ্দশাতেই।

শুরুতে সাহিত্যকে জীবিকা করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। কিন্তু তথাকথিত জনপ্রিয়তায় নিজের লেখক সত্তাকে বিসর্জন দেন নি, এ হয়তো তাঁর সেই দায়বদ্ধতার তাগিত। শুরুর দিকে ৫৬ তে ‘ঝাঁসির রানী’ প্রকাশের পর ৬৭ পর্যন্ত প্রায় আঠার খানা উপন্যাস রচনা করেছেন তিনি। জনপ্রিয় হচ্ছিলো লেখাগুলো। এ ধারাটি তাঁর লেখক হিসাবে প্রকাশ কিংবা জীবিকা অর্জনের নিরাপত্তায় জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু নিজেই ভেঙে দিয়েছেন নিজের নিরাপত্তার বলয়। স্বীকার করে নিয়েছেন সৃজনশীল সত্তার অনুসন্ধিৎসাকে। কখনো হন্যে হয়ে খুঁজলেন নারীর শৃঙ্খল এবং অহংকার দুটোরই প্রতিরূপ। হাজার চুরাশির মা থেকে স্তন্যদায়িনী। মাতৃত্ব তাঁর গল্পে নানা মাত্রিকতায়। হয়তো সাবটেক্সট হিসাবে ব্যক্তিজীবনে মাতৃত্বের করুন টানাপড়েন ভবিষ্যৎ গবেষণার উপাত্ত হবে, কিন্তু সেই রূঢ় বাস্তবের নান্দনিক উপস্থাপনায় মধ্যবিত্ত নারী ব্রতী যশোদা হয়ে উঠেন রক্ত মাংসের অনবদ্য সব চরিত্র, অমোচনীয় অবস্থান ঘোষণা করেন কালের পাঠক মানসে। যথেষ্ট সামাজিক দায়বদ্ধতার ভাষ্য না হয়ে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের বয়ান হয়ে উঠার অপরাধে নিজের লেখাকে নিজেই বাতিল করে দেয়ার (তিমির লগন ও রূপরেখা) সৎসাহস অর্জন ও একজন লেখকের জাত চেনানোর জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

যা লিখেছেন, রেখে গেছেন, তার সাহিত্যমান কিংবা সাহিত্যমূল্য বিবেচিত হবে ভাবীকালে। সম-সাময়িক কালে কর্মে ও সৃজনে, দায়বোধে ও দায়িত্ববোধে কথায় এবং কাজে, পথে-ঘাটে আর কাগজে-কলমে যে অভূতপূর্ব নজির রেখে গেছেন মহাশ্বেতা দেবী আরো অনেককাল বাঙালি গর্বে খোদিত হবে তাঁর কারণে আর তিনি অনিবার্য হয়ে থাকবেন তাঁর রেখে যাওয়া কর্মযজ্ঞের উজ্জ্বল আলোতেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ