জ্যৈষ্ঠ মাসের রবিবারে, যতীন বাবু বেলা সাড়ে বারোটার সময় ভাত খেয়ে, রান্না ঘর থেকে বড় ঘরে এসে ঢুকলেন । ঢুকে দেখলেন, বড় মেয়ে মায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল খুলছে, ছোট মেয়ে সতী মেঝের ওপর শুয়ে আছে মুকুলের পাশে । মুকুল খালি গায়ে উপুড় হয়ে শোয়া, একটা হাতের কনুইয়ের ভাঁজে মাথা রাখা, আরেকটা হাত মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া। সতীর হাতে একটা বই। হাঁটু দুটো তুলে সতী বই পড়ছে। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে যতীনবাবু নামে চল্লিশোত্তর সেই ভদ্রলোক, এইগুলি দেখে বিছানায় গিয়ে বসলেন । আর বসতেই, হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন রেণুবালা, তাঁর পয়ত্রিশোত্তর স্ত্রী।
মুখে ঘাম, আগুনের আঁচে আর গরমে মুখটা তামাটে। সবেগে ঘরে ঢুকে, চৌকির তলা থেকে একটা ডাব বের করলেন রেণুবালা । “ডাবের জলটাও একটু এগিয়ে দিতে পারো না—এক বিবি চুল আঁচড়াচ্ছে, আর এক বিবি নতুন ধোলাই শাড়ি পরে চিত হয়ে শুয়ে আছে । ওঠ ওঠ, হাজারবার বলেছি শাড়ি পরে ধুলোর মধ্যে বসবি না—” বলতে বলতে রেণুবালা একটা চামচের উল্টো মুখ দিয়ে ডাব ফুটো করতে লাগলেন।
“অতোই যদি শাড়ির মায়া, আমায় ফ্রক পরতে দিলেই পারো—ফ্রকই তো আমি পরতে চাই।” বলতে বলতে মেঝের ওপরই পাশ ফিরে শুলো সতী ।
“আহা হা, ছোট্ট মেয়েটি আমার, ফ্রক পরে না-ঘুরলে তোমার চলে, একেবারে কচিটি—” বলতে বলতে পিরিচ্ করে ডাব থেকে জল ছিটকে রেণুবালার চোখে মুখে লাগলো। রেণুবালা শাড়ির আঁচল দিয়ে সেটা মুছলেন ।
মুকুল বলে উঠলো—“মুছলে কেন মা, চেটে নিলেই পারতে, তোমারও ডাবের জল খাওয়া হতো।”
মুকুল উঠে বসলো। রেণুবালা একটা কাচের গ্লাসে জল ঢাললেন। ডাবের ভেতর থেকে শাদা নারকোলের খানিকটা মেশানো, জলো-দুধের বাটির জলের মতো, জল বেরুতে লাগলো, অতি মৃদু শব্দ করে ।
মায়া পিঠের চুলগুলোকে দু-ভাগ করে, এক ভাগ সামনে নিয়ে এলো। তারপর, এক হাতে চুলের গুছিটাকে মুঠো করে ধরে ঘাড় নামিয়ে আর এক হাতে চিরুনি চালাতে লাগলো।
রেণুবালা জলের গ্লাসটা যতীনবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। যতীনবাবু ধরতেই, নিচু হয়ে, চৌকির তলা থেকে পানের ডিবেটা বের করে দুটো পান দিলেন যতীনবাবুর হাতে । নিঃশেষিত গেলাসটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে সাপ্তাহিক পান দুটো মুখে পুরে বিছানায় কাত হলেন । যতীনবাবু পান খান না—রবিবারটা বাদে । রেণুবালা ডাবটা উঠোনে ছুঁড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে বললেন—“মায়া—সতী—মুকুল—স্নানে যাও, আমি আর দেরি করতে পারবো না ।"
যতীনবাবুও বললেন, “যা না মুকুল, স্নান করে আয় ।”
মুকুল মেঝের ওপর বসে থেকেই বললো, “সতী আগে যাক", সতী বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে বলল, “কেন, তোমার আগে যেতে কি হয় ?”
মায়া হাতের তেলোতে তেল ঢালতে ঢালতে বললো, “কাউকেই এখন যেতে হবে না—আমি যাচ্ছি”। মায়া তেল মাখলো, আলনা থেকে একটা শাড়ি, একটা সায়া, একটা ব্লাউজ, একটা ছোট জামা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরুতেই মায়া রোদ দেখলো। তাদের বাড়ির উঠোনটুকু ভরতি রোদের মধ্যে নামলো। কুয়োর পাড়ে গেল। বাথরুমের ভেতর ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। প্রথমে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলো না মায়া । অভ্যাসমতো দড়িটাতে জামা-কাপড়গুলো রাখতে রাখতে চোখটা অভ্যস্ত হয়ে গেল । অন্ধকার স্নানঘর। কিছুতেই ভাবা যায় না—বাইরে এখন দুপুর । খাঁ-খাঁ দুপুর । মায়া বুঝলো, সে যদি এখন গিয়ে জানলায় দাঁড়ায়, দেখতে পাবে, চোখমুখ কুঁচকে ধুকে ধুকে উড়নচণ্ডি ছেলেগুলো বাড়ি ফিরছে। রবিবার তো, তবে এখনই ফিরছে না। কম বেলা তো নয়, ফিরতেও পারে। মায়া দেখলো ঘরটা যেন রাত্রি । রাত্রির অন্ধকারে পুকুরের জল যেমন চকচক করে ওঠে, তেমনি এবড়ো-থেবড়োভাবে চকচক করছে চৌবাচ্চার জল। পায়ের নীচে ঠাণ্ডা মেঝে। মায়া ভাবলো—এতক্ষণ ধরে যে ঘুম ঘুম ভাব তাকে দখল করে আছে, ঐ জল গায়ে পড়তেই সেটা কেটে যাবে । কেটে যাবে, কেটে যাবে-ভাবলো মায়া ।
রান্নাঘর থেকে, জানলা দিয়ে উত্তর দিক থেকে আকাশের মাঝখানে আসবার পথের মতো আকাশটার দিকে তাকিয়েই শিক নিয়ে উনুনের সামনে উবু হলেন রেণুবালা । স্নান করতে হবে—গাটা জ্বলে যাচ্ছে। আকাশটা নীল—মায়ার রঙ-চটা নীল শাড়ির মতো ।
জানলা দিয়ে যতীনবাবু বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর আকাশটা লটকে আছে, একটা দোতলা-তেতলা বাড়ির ছাতের বাঁশের সঙ্গে। যতীনবাবু পান চিবুতে চিবুতে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন । তাকিয়ে রইলেন কিছু দেখবার জন্য নয়, পানটা শেষ না করে ঘুমোনো যাবে না বলে। যতীনবাবু দুয়েকটা রঙ চেনেন, কিন্তু জানেন না। লাল-নীল-বেগনি-সবুজ—এই সব চড়া-চড়া রঙগুলো দেখে দেখে তাঁর মুখস্থ হয়ে গেছে। সব সময়ই দেখতে হয়—না-চিনে করবেন কি । কিন্তু তিনি গোলমেলে রঙের মধ্যে নেই। রেণুবালা যখন সেলাই-ফোঁড়াই করতো–তখন এই রঙগুলো চেনা থাকলেই বাজার থেকে সুতো কিনে আনা যেতো। আজকাল আরো নানারকম জটিল রঙ হয়েছে। সেগুলো যতীনবাবু চেনেন না। পরনের শাড়ির রঙ চিনে যখন রেণুবালাকে ডাকতে হতো, তখন রক্তাম্বরী, নীলবসনা সুন্দরী—এই সব সম্বোধনেই চলতো। আজকালকার ডাকগুলো জটিল হয়েছে—যতীনবাবু সেগুলো জানেন না। আকাশটার রঙ আধুনিক নয়। যতীনবাবু রঙটা চেনেন, কিন্তু মনে করতে পারছেন না, কোন ছেলেবেলার রঙ যেন । দু-একবার এই রঙটা তিনি দেখেছেন । কিন্তু নামটা জানেন না। কোনো নাম দিয়ে রঙটাকে ভাবতে পারলেন না।—আর পারলেন না বলেই জানলার কাছে গিয়ে পিচু করে পানের পিক ফেললেন, বাইরে ।
আর, ওপাশের জানলায় দাঁড়ানো সতী চমকে উঠলো। বইটা শেষ করে, থমথমে মন নিয়ে, স্নান না করে, দুপুরের জানলায় এসে দাঁড়িয়েছিল সতী । এই ঘরটার পেছনে একটা ছোট্ট মাঠ, মাঠের এক কোণে একটা ভাঙা-চোরা ঘর, মাঠটা একটু উঁচু হয়ে রাস্তায় মিশেছে, নিচু হয়ে কাঠ চেরাইয়ের জায়গায় নেমে গিয়েছে। সেই ছোট্ট মাঠটার পূবদিকে একটা বাড়ির ভেতরে বিরাট বড় ঝাঁকড়া আম গাছ । আমগাছের ছায়াটা এখন মাঠে নেই, বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। সতী কিছু দেখছিল না, এমনি এমনি তাকিয়ে ছিল । এক হাতের আঙুল দিয়ে, গত বিকেলের বাঁধা, তাই এলিয়ে-পড়া চুলের মধ্য থেকে জট ছাড়াচ্ছিল । আর এক হাতে শিক ধরা। হাতটা যেমন নিজের অজ্ঞাতেই চুল টানছিল, চোখটাও তেমনি কী দেখছে না-জেনেই দেখছিল। তাই যতীনবাবুর পিক ফেলা মাত্রই চমকে উঠলো সতী । সতী তখনি তাকিয়েছিল এই ঘরটার পেছনে যে ছোট ছোট, একেবারে ছোট, একটু বড়, আবার তার চাইতেও বড় কচুগাছগুলো আছে—সেই দিকে। সেই এক-একটা কচুগাছ থেকে যতীনবাবুর জানলার উচ্চতা হবে হাত তিনেক । সেই তিন হাত উচু থেকে সুপুরি, চুন আর খয়েরের লাল লালাসিক্ত পানের পিক সবুজ,–একেবারে সবুজ, একটুও কালচে না, একটা কচি কচুপাতার ওপর পড়তেই চমকে উঠলো সতী । সতী-আঁচল তার কাঁধ বেয়ে মাটি ছুঁয়েছে। সতী—হাতের আঙুল তার অজ্ঞাতেই চুল ছুঁয়েছে সতী—এখনো তার স্নান হয়নি। সতী চমকালো। চমকানোর পর আবার ওদিকে চাইতেই উত্তপ্ত মাটি আর সূর্য সেই লাল রসটাকে শুকিয়ে ফেললো প্রায়। তবু সতী চমকালো। ভয় পেলো, তাই মাথা থেকে অন্যমনস্ক হাত ছিটকে এলো। ভয় পেলো, তাই কাঁধের একটু আটকে থাকা আঁচল গড়িয়ে পড়লো। গড়িয়ে পড়লো, তাই ভয় পেয়ে ছুটতে গিয়েও ছুটতে পারলো না সতী । হেঁটে একটু-আটকে-থাকা আঁচল গড়িয়ে পড়লো। খপ করে।
উঠোনে ফেলে-দেওয়া ডাবটা নিয়ে মুকুল ফুটবল খেলছে। বাঁ-পায়ে কিক মেরে ডান পায়ে নিচ্ছে, ডান পায়ে কিক মারছে সোজা, আবার ছুটে গিয়ে সেটাকে ধরছে। ধরে পায়ের পাতার ওপর তুলে হাই কিক মারার চেষ্টা করছে। সতী এসে বারান্দার চৌকিটাতে বসামাত্র মুকুল চেঁচালো, “দেখ সতী, কর্নার কিক এলে, ডান পায়ের পাতাটা একটু ছুঁইয়ে হাই কিক মারতে হয়"-তারপরই ভাবটাকে হাই কিক করলো সতীকে লক্ষ্যে রেখে। ডাবটা সামান্য উঠে ধপ করে পড়ে একটু গড়িয়ে দুলতে লাগলো।
মুকুল ডাবটার ওপর ডান পা দিয়ে সেটাকে নাড়ানো শুরু করলো। উঠোনভরা রোদ্দুর। ডাব আর মুকুলের একটা ছায়া পড়েছে মুকুলের পায়ের নিচে ।
এলো চুল খোঁপা করে, এক হাতে ধোয়া পাকানো জাম-কাপড়, আর এক হাতে গামছা নিয়ে মায়া উঠোন পেরিয়ে ঘরের দিকে আসছে। তার পা ভেজা। ভেজা-পা জল-পা আঁকছে উঠোনে । দুটো-তিনটে পা আঁকা হতে না-হতেই উত্তপ্ত মাটি আর সূর্য মায়ার পা থেকে সব জল শুষে নিল ।
মায়াকে আসতে দেখে সতী-মুকুল কলঘরের দিকে দৌড়লো। সতী পৌঁছুতে না-পৌঁছুতেই মুকুল কলঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । হা-হা করে হাসতে লাগলো ভেতর থেকে । ‘পাজি কোথাকার বলে, সতী চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। ভেতর থেকে মুকুল চেঁচাল, "এই সতী, গামছাটা দিয়ে যাস।' সতী উঠোনটা পেরিয়ে বারান্দার তার থেকে ঝোলানো গামছাটা টান দিয়ে নিল । তারের শব্দ হলো ঝনঝন করে। দরজার কানায় গামছাটা রাখতে রাখতে বললো—“দাদা, রেখে গেলাম।”
অন্ধকার ঘরে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, চৌবাচ্চার জলের দিকে তাকিয়ে থেকে, মুকুল ভাবতে লাগলো, মাথায় তেল দেওয়া হয়নি, আবার গিয়ে দিয়ে আসবে কি না। আজ আবার বিকেলে একটু খেলার ইচ্ছে ছিল, পায়ে তেল মালিশ করলে হতো। ধুৎ, যে-গরম, স্নানটা তাড়াতাড়ি করে নিতে হয় । দুপুর । বেলা তো কম হয়নি। এ-ঘরটায় অন্ধকার । আজ দুপুরে ঘরটার দরজা জানলা বন্ধ করে, এমনি অন্ধকার করে ঘুমোতে হবে । বাইরের দুপুরটাকে হুট-আউট করে দিলে ঘুম আসবে ভালো । দুপুর যদি টের পাওয়া যায়, তবে তো ঘুম কিছুতেই আসবে না। ঘটিটা তুলে নিয়ে গবগব করে জল ঢালতে লাগলো মাথায় । জলটা মাথা থেকে দ্রুতস্রোতে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণের টিস-টিসে ভাবটা কাটছে। মনে হচ্ছে, এবার একটা ঘুমের পরিতৃপ্তি। না, স্নান করে বসে থাকা যায় । না । খেতে হবে এখুনি। স্নান-খাওয়া হলে, আর, দুপুরটা ছুঁতে পারে না। মুকুল মাথায় আরো জল ঢালতে থাকে ।
যতীনবাবু রঙ চেনেন, রঙ জানেন না। রোদ আর আগুনে মুখের রঙ কী হয়, ঘামের রঙ কেমন, তিনি জানেন না। তবে চেনেন । এই রেণুবালাকে দেখে দেখেই চিনেছেন। রেণুবালা হাফসিয়ে বললেন, "কী গরমই পড়েছে। হাতের পাখাতে একটু গতি দিয়ে গরমটা দূর করতে চাইলেন যতীনবাবু। রেণুবালার গায়ের ঘামের গন্ধ যতীনবাবুর নাকে লাগছে। রেণুবালা আবার বললেন, "কী গরমই পড়েছে।” যতীনবাবু বললেন, “এখুনি স্নানে যেও না, একটু বিশ্রাম করে যাও।”
আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বিশ বছরের মোটাসোটা মায়া মুচকে হেসে, মনে মনে বললো—“আহা-হা, নিজের খেয়ে-দেয়ে ঘুমানো হচ্ছে আর মুখে আদর করা হচ্ছে। একটু দেরি করে খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হতো, না ? (বাঃ, আমি তো দেরি করেই খেতে চাইলাম। তুমিই তো— ঠিক আছে, আমি স্নান করে আসি, তুমি জেগে থাকো, আমার খাওয়ার সময় গল্প করতে হবে ')
সেই পিকফেলা জানালাটা দিয়ে দুরের কোন দোতলা তেতলা বাড়ির ছাতের বাঁশের সঙ্গে লটকানো আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলেন রেণুবালা। যতীনবাবু দেখলেন : রেণুবালার থুতনিটা ঘামে ঘামে আরও ছুঁচলো। রেণুবালার সিথিতে সিঁদুরের একটা চড়া, মা-শীতলার পাথুরে মাথার মতো। মায়া চিরুনিটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল। চিরুনিটা রেণুবালার সিঁদুরের কৌটোতে গিয়ে লাগলো। কৌটোটা গড়াতে গড়াতে একজায়গায় আটকে গেল ।
মুকুল ঘরে ঢুকে বললো—“খেতে দাও, খিদে পেয়েছে।”—“তুমি আগে খেতে এলেই পারো। এ মা, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না, আবার ঐ ছাড়া লুঙিটা পরলে,” আলনা থেকে একটা ধোয়া পাজামা মুকুলের কাঁধে ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল মায়া, “ভাত বাড়ছি, খেতে এসো।”
“দিদিটা এমন ছুচিবাই”—ঘচ্ ঘচ্ করে চুল আঁচড়ে মুকুল বেরিয়ে গেল।
"দুপুর খাঁ-খাঁ স্নানাহার পরিতৃপ্ত মানুষটির তৃষ্ণা পেলো। অস্নাত অভুক্ত মহিলাটির ঘুম পেলো, বালিশে মাথা না দিয়ে শুয়ে পড়লেন। দুপুর খাঁ-খাঁ । কলঘরের মাঝখানে সতী দাঁড়িয়ে । শরীরটায় তৃষ্ণা, বড় তৃষ্ণা, বাঘের চোখের মত জ্বলজ্বল জল ।
রেণুবালার গায়ে ঘামের গন্ধ-মিষ্টি বোটকা। রেণুবালা জামার বোতাম আটকায়নি, গলায় ঘাম, বুকে ঘাম।
”তোকে খাওয়ানো একটা হ্যাঙ্গামা । পরিষ্কার করে খেতে পারিস না, অসভ্য কোথাকার ? সবতাতেই হুড়োহুড়ি—” মুকুলকে ভালো করে খাওয়াতে চাইল মায়া। মুকুল ভেবেছিল, খেয়ে-দেয়ে ঘুম দেবে। স্নানের আগে যেমন মনে হয়েছিল, স্নান করলেই দেহমনের বিস্বাদটা কেটে যাবে, অথচ কাটলো না ; খাওয়ার আগে তেমনি মনে হয়েছিল খেলে পরে চোখ-মুখ কোঁচকানো আর চামড়ার শুকনো ভাবটা কমবে, কমছে না, কমবে না। খাওয়াটা বিশ্রী ।
রেণুবালার গলায় ঘাম। হাতের তেলো দিয়ে ঘামটা মুছে দিলেন যতীনবাবু। চট চট করে উঠলো তেলোটা। রেণুবালা খোলামেলা—
সতী হিলহিলে। এই শরীরটা উত্তপ্ত, তৃষ্ণার্ত, কাতর। শরীরটা জ্বলছে। সতী তার হাতের কনুইয়ের ভাঁজে মুখটা ডোবালো। গন্ধ-ঘামের, পিপাসার, জ্বালার। দুপুরের।
দুপুরের মিষ্টি বোটকা গন্ধ। দুপুরের খাওয়াতে চাওয়া। দুপুরের খেতে ভালো না-লাগা। দুপুর, ভরে আসছে।
দুপুর ; টইটুম্বুর, টসটস করছে দুপুরটা। মধ্যসমুদ্রের মতো নিস্তরঙ্গ বিরাট, ব্যাপক, রঙহীন : চুম্বক-পাহাড়ের মতো আকর্ষক ; ফুলশয্যার পুরুষের মতো স্থির সবল জ্বলন্ত ।
সতী বারান্দার চৌকিতে শুয়ে আছে। বারান্দার চালে সিলিঙ নেই। তিন পাশ খোলা । হুহু করে মাঝে মাঝে গরমের দমকা বাতাস ছুটে আসছে, মাথা, মুখ, গা, গলা পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে, ছেকা লাগানো গরম হাওয়া । সতীর সারা গায়ে সূর্যের হলকা লাগছে। সতী চোখ বুজে আছে, ঘুমিয়ে নেই। তার কপালে ঘাম, গলার তিনটি ভাঁজে ঘাম, ঘামের গুঁড়ি গলা থেকে ব্লাউজের ভেতর নেমে গেছে। নিচের ঠোঁটের নিচের ভাঁজে ঘাম। চোখের পাতার সমস্ত রেখা ঘামে ভরা। কপালের দুপাশে ঘাম চিকচিক করছে । ওপরের ঠোঁটের মাঝখানে ছোট খাদে ঘাম। সতীর শাড়ির আঁচল পিঠের তলা থেকে বেরিয়ে, বুকের ওপর দিয়ে গিয়ে ডানদিকে জড়ো হয়ে আছে। সতীর ফরসা শরীরটা যেন কোনোরকমে ঢাকাঢুকো দিয়ে পড়ে আছে। সতীর ভেতরটা আগুনের মতো লাল। তপ্ত ইস্পাতের মতো সতী পড়ে আছে বিধাতার পরিকল্পনার অভাবে । সতী ভাবছে, সে ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে । এই ঘরটায় বাবা-মা দাদা ; ঐ ঘরটায় দিদি। সে ঘুমুচ্ছে না। সেই নিথর শরীর সতীর দুয়েকবার মুচড়ে উঠলো। সবুজ কচি, একেবারে কচি, পাতলা, তার বুকের চামড়ার মতো কোমল, মসৃণ, নরম, নিটোল কচুপাতার ওপর সুপুরির কুচি আর চুন খয়ের মেশা একগাদা পিক পড়লো আর পিছলোল। পিছলোল, আর আকাশ-মাটি শুষে নিল । সতীর শরীর মুচড়ে উঠলো। শরীর মোচড়ানোয় গলার তিনটে রেখা ভেঙে অনেকগুলো হয়ে গেল। মোচড়ানি থেমে গেল ; স্থির হলো । সতীকে যেন কাতর করছে বাইরের সূর্য নয়, ভেতরের রক্ত । রক্তগুলো হু হু করে ছুটে আসছে হৃৎপিণ্ডে । হৃৎপিণ্ডটা দবদব করে, ফাটে না, বুকটা ধড়ফড়ায়। রক্তগুলো আবার শিরা-উপশিরা দিয়ে ফিরে যায়। সেই প্রচণ্ডগতি রক্তস্রোতকে দেহে ধারণ করে, সতী ধরণীর মতো, স্থির আর বিবশ হয়ে পড়ে আছে। সতী কান পেতে থাকলো। একটা কাতরধ্বনি পথ দিয়ে, বিকেলের বাতাসের মতো ধীরে আসছে। দু আনার ব্যাঙ-বেহালার ধ্বনি। কী একটা গান বাজাচ্ছে বেহালাঅলা, ঐ দুটো পাতলা ছোট বেঁটে তারে সে-সুর পুরোপুরি খোলে না, বাজে না। তবু বেঁটে-মোটা তারে এমন একটা সুর বাজছে, যা সতীর কানে, ঘাটে-বসে-থাকা মেয়ের কানে ভাটিয়ালির মতন বাজছে। বিধাতার অতিব্যস্ত কোনো দিনের, কোন এক ফাঁকে কোনোরকমে গড়ে তোলা সতী নামক এই আধাআধি-মানুষ চতুর্দশী বাঙালী মেয়েটার ব্যথা-বুদ্ধির অমিল ও শক্তি-ইচ্ছার গরমিল-ভরা মনটা সেই সরু-মোটা ধেটে তারে মোটা, রোমশ, হাড়হেড়ে আঙুল দিয়ে বাজানো অর্ধেক সুরে দুলছে, উদাসী-হাওয়ায়-নড়া ঘরের শিকলের মতো। সারা দিন শুধু বাসন-মাজা আর কাপড়-কাচা গোধূলিবেলাটুকু আছে ঘাটে বসে ভাটিয়ালি সুর শোনার জন্য। সতী কান পেতে রইল সুরটা বাজুক, বাজুক ; বেজে বেজে তার তৃষ্ণা মেটাক, তাকে শীতল করুক—যাতে সে নিজেকে নিজে ছুঁতে পারে, তাকে কঠিন করুক—যাতে সে নিজেকে নিজে উদ্ধত করতে পারে, তাকে গতি দিক—যাতে সে উদ্ধত শীতল কঠিন দেহটা নিয়ে অস্তিত্বের মতো সুন্দর আর অবস্থিতির মতো নিশ্চিত হয়। কিন্তু তার আগে, এই সঙ্কীর্ণ দেহ আর মনের তৃষ্ণা মেটাও । তৃষ্ণা মেটাও । তৃষ্ণা মেটাও ।
অনেক ছেলের মা, শিথিল দেহ, শ্লথ যৌবন নারীর মতো দুপুরটা হাঁফসাচ্ছে। একটা মাদী কুকুরের মতো দুপুরটা পড়ে আছে জিভ আর দু পাশের দুটো ছুঁচলো দাঁত বের করে। যতীনবাবু চোখ বুজে পড়ে আছেন চিত হয়ে । তিনি ছাড়া আর সবাই যেন ঘুমে অচেতন । এ ঘরে রেণুবালা আর মুকুল, ও-ঘরে মায়া, বারান্দায় সতী । মরার পরও চৈতন্য থাকলে চিতার আগুনে তপ্ত হতে, আগুন হতে ও অঙ্গার হতে যেমন লাগতো যতীনবাবুর যেন তেমনি লাগছে। তিনি অপেক্ষা করে আছেন আগুন হয়ে জ্বলতে জ্বলতে কখন তিনি অঙ্গার হবেন, তারপর নদী থেকে মাটির কলসিতে জল এনে, ঢেলে তাকে নিশ্চিহ্ন করা হবে । মাটির কলসি করে বয়ে-আনা জলে লুপ্ত হবার ইচ্ছায় সারা শরীরটা জ্বলছে যতীনবাবুর আর এই প্রজ্বলন্ত মানুষটির দিকে তাকিয়ে বসে আছে দুপুর, এই শ্লথ-যৌবন দুপুর। তাঁর চিন্তা থেকে অদূরে এই দুপুর যেন তেমনি এক মহিলার মতো বসে আছে যার সারাটা মুখ ঘাম আর আগুনে তামাটে, যে গায়ে জামা দিয়েছে অথচ বোতাম না আটকানোয় বুক দেখা যাচ্ছে, বহু প্রসবিনীর মত যার উদরে অনেকগুলো ভাঁজ পড়েছে, যার সারা শরীরে নেশার-স্মৃতি-আনা মদের গন্ধের মতো ঘামের গন্ধ, যার গলায় ঘাম এবং সেখানে হাত দিলে, হাত চটচট করে। অফিস-পাড়ার দুপুর বেলার পানওয়ালির মতো নেশাতুর এই দুপুরের চোখ। যতীনবাবু চোখ বুজে থাকলেন। একটা ভাঙা অস্পষ্ট, আধোচেনা সুর যতীনবাবুর কানে গেল, হিসেব-কষা অফিসের দুপুরে পাশের ছোকরা-র গুনগুন গানের মতো, মৃদু, তাই অবাধ । সুরটা পুরো চেনা যায় না, বোঝা যায় না, স্পষ্ট করে সুরটা বাজছে না কেন, তার গায়ের চর্বিতে বোধ হয় সূরটা ঠেকে যাচ্ছে, সেই মেয়েটার গায়ে চর্বি নেই, হিলহিলে তরতরে, নদীর মতো সুরটা বয়ে আসছে অথচ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাঙ-বাজনা বেহালার দুটো মোটা তারে কোনো সুরের পুরোটুকু রাজে না। মাটির কলসি নিয়ে, নদীর ঘাটে, যে জল আনতে গেছে, সে এতো দেরি করছে কেন ? অফিসের বসন্ত তো প্রতিদিন দুপুরে ঠিক এই সময় এক গ্লাস জল দিয়ে যেতে ভোলে না। বেহালার সুরটা পূর্ণ হচ্ছে না কেন ? পুরোটা বাজাও, পুরোটা বাজাও । ছোকরা ছেলেটা গুনগুন করে গায় কেন, পুরোটা কেন গায় না ? দেহের চর্বিটা গলে গলে যাক, সুরটা এসে বুকে ঘা দিক । তার আগে যৌবনের মতো উজ্জ্বল শ্যামলতা নিয়ে, প্রাণের মতো উদ্দীপনা, শরীরটাকে ছেয়ে দিক। বড় তৃষ্ণা এ-দেহের, এ-মনের। জল দাও, সুর দাও ।
ছোট্টখাটো ভুঁড়ি-আলা মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোকের মতো দুপুরটা ঘুমুচ্ছে। দুপুরের শরীরের শক্তিটা চর্বি হয়ে যাচ্ছে, চর্বিটা হাড়টাকে ঢেকে দিচ্ছে, হাড়ের স্পর্শ আর পাওয়া যায় না, মোটা থলথলে ভুড়ি যেন গায়ের সঙ্গে লাগে আর পিছলোয় । চোখ বুজে রেণুবালা শুয়ে আছেন, রেণুবালা বাদে আর সবাই যেন ঘুমিয়ে । মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে মুকুল, বারান্দায় সতী, ও-ঘরে মায়া, আর বিছানার ঐ পাশে যতীনবাবু। কেবল জেগে আছেন রেণুবালা। পড়ে আছেন অন্তঃসত্ত্বার মতো নিথর হয়ে। রেণুবালার মনে হলো প্রথম অন্তঃসত্ত্বা হতে কেমন লাগে ভুলে গেছেন। তাঁর খুব ইচ্ছে হলো আবার তিনি জননী হন। ডাকবার আগে তাঁর গলা দিয়ে গোঙনি বেরুক, শরীরটা মুচড়ে উঠুক, শরীরের ওপর একটা ভার নেমে আসুক, গর্ভের কোষে তাঁর রক্তের মধ্যে নতুন আন্দোলন আসুক,আন্দোলন থামুক, রক্ত থিতোক, জমাট হোক, একটা ছোট্ট পোকা হোক, পোকাটার গায়ে মাংস লাগুক, পোকাটা বড় হোক, পোকাটা মানুষের শিশু হোক, শিশুটা ভারি হোক, হাত পা কান নাক চোখ ফুটুক, বাচ্চাটা আরো বড়ো হোক, আরো ভারি হোক, পেটের ভাঁজগুলো ফুলে উঠুক, পেটটা টনটন করে ফুলুক। প্রথম-অস্তঃসত্ত্বা বউয়ের মতো তলপেট ভারি, গা-থমথম রেণুবালার। যেন তার সারা শরীরে রস এসেছে, মুখ ভারি, চোখ ভারি, বুক ভারি । দুপুরের পেটের ভেতর যেন একটা বাচ্চা ঘোরে ফেরে, নিশ্বাস নেয়। দুপুরের যেন বড়ো কষ্ট হয় কোমর বেঁকাতে, নিচু হতে। রেণুবালা নিথর হয়ে পড়ে আছেন, যেন ফোলা তলপেটের ওপর হাতটা রেখে । শরীরের আরামের জন্য তিনি পেটটা হাতাচ্ছেন। সেই মোটা ভারি বাচ্চাটা পেটের ভেতর দাপাদাপি গুতোগুতি করে, ছটফট করেন রেণুবালা। রেণুবালা চোখ বুজে দেখলেন পাশের বাড়ির ঝাঁকড়া আমগাছটায় পাতায় পাতায়, ডালে ডালে, সারা গায়ে, অসংখ্য কাঠ-পিপড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শুড়ে শুড়ে কথা বলছে, উঠছে, নামছে, চলছে, ফিরছে। কোটরের ভেতর থেকে এক একটা পিপড়ে শুড় দিয়ে টেনে অন্য পিপড়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কান পাতলেন রেণুবালা। একটা সুর দুপুরে বাজছে। আধো চেনা একটা সুর মায়া হওয়ার সময়কার মতো অস্পষ্ট । পুরো সুরটা শোনবার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন রেণুবালা। যেন প্রাণের কোটরের ভেতর দুটো কাঠ-পিপড়ে অধীর হয়ে জড়াজড়ি করছে। সুরটা পুরো কেন বাজছে না ? দুপুর ভরে কেন বাজছে না, শরীর ভরিয়ে কেন বাজছে না। মোটা ছোট তারে একটা সুরের আভাস মাত্র বাজছে । মন দিয়ে সেটাকে পুরো করতে চাইলেন রেণুবালা। একটি পিপড়ে জীবনের অণুপরিমাণ বীজ রচনা করে নিয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে এলো। সুরটাকে মনে মনে পুরো করতে চাইছেন রেণুবালা। একটা সুরের জন্ম হোক, একটা জীবনের জন্ম। বেহালা-অলার মোটা হাড়হেড়ে হাতে ধরা ছড়ের মতো, মাটির বেহালার ওপর ছড়ের গতির মতো—রেণুবালার শরীরটা সৃষ্টির কামনায় কাঁপতে লাগলো। সুরটা পূর্ণ হোক ! পূর্ণ হোক !
কিশোরীর মতো দুপুরটা ধীরে ধীরে ফুলে উঠেছে, ভরে উঠেছে। খুব চেনা অথচ রহস্যময় । সুন্দর । দূরে দাঁড়িয়ে । মাঠে ফুটবল খেলতে খেলতে দেখা কোনো দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ানো মেয়ের মতো—দূরের, তাই মনের কাছের, তাই সুন্দর। মুকুল শুয়ে, চোখ বুজে। যেন সে বাদে আর সবাই ঘুমিয়ে, চৌকির ওপর বাবা-মা, বারান্দায় সতী, ও-ঘরে দিদি। বাইরের ঝাঁ-বাঁ রোদ মুকুলের চোখের পাতায় পড়েছে। চোখ বন্ধ থাকলেও, রঙিন রঙিন কী সব দেখা যাচ্ছে যেন, জলের তলে ডুবে চোখ খুললে যেমন দেখায় তেমনি। কী রঙ, মুকুল সেটাই জানতে চায়, বুঝতে চায়। লাল, নীল, সবুজ, হলদে, বেগুনি—এ সব পুরনো মোটা রঙ নয়। এ রঙটার সঙ্গে আরেকটা রঙ মিশে কী একটা রঙ, তাই জানতে চায় মুকুল, মুকুল রঙ চিনতে চায়। শাদা পাতলা শাড়ির নিচে ফিকে সবুজ সায়া পরলে যেমন আরেকটা রঙ হয়ে যায়, তেমনি লাগছে বোজা চোখের পাতার ওপরে দুপুরের রঙ । একটা রঙ হলে তো হতোই, নানা রঙ । সাঁতার কাটবার সময় ছিটকে ওঠা জলের রামধনুর মতো জটিল। এই জটিল রঙগুলোতে রঙিন দুপুর। একটা অস্পষ্ট সুর কানে এলো মুকুলের। ভাঙা ভাঙা, আধো-চেনা, একটা কান্নার মতো সুর দুপুরের পথ দিয়ে চলেছে। দ্রুত অথচ বিষয় । বিরাট মাঠের মধ্যে দুপুরের মরীচিকার মতো সুরটা কাঁপছে। ঘামে আবছা হয়ে আসা দৃষ্টিতে সেটাকে রঙিন দেখা যাচ্ছে, জটিল রঙিন । সুরটা পুরোপুরি বাজছে না কেন। ঐ মরীচিকার মতো জটিল রঙগুলো স্থির হয়ে একটা দেহ পাক, স্তম্ভিত রামধনুর মতো। তারপর মুকুল সেই রঙগুলোকে দেখবে। সুরের রঙ চিনবে। অথচ সুরটা একটা পুরো সুর হচ্ছে না, আভাসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। চুয়িংগাম ছাড়া দৌড়লে যেমন গলায় কাঁটা কাঁটা বেঁধে, মুকুলের গলায় তেমনি বিঁধছে আর সুরটা পুরো বাজাচ্ছে না কেন। বোজা চোখের পাতার ওপর রঙের খেলা দেখতে ও বুঝতে অধীর হয়ে উঠলো মুকুল। ঐ সুরটা পুরো না হলে রঙটা পুরোপুরি খুলবে না । সুর তোলো । পুরো সুর।
ফোটোতে দেখা অদেখা-পুরুষকে কল্পনার মতো দুপুরটা আশঙ্কায় দুরুদুরু, সম্ভাবনায় রঙিন, ব্যর্থতায় ধবধব । বিশ বছরের মোটাসোটা মায়া শুয়ে আছে। ঘাম তার সারা শরীরে কোথাও নেই, কিন্তু দেহটার রঙ টকটকে । বিশ বছরের মোটাসোটা মায়া যেন অফিস থেকে কারো ফেরার অপেক্ষায় শুয়ে। জুতোর শব্দ শুনলেই উঠে বসবে। মায়া চোখ বুজে আছে। আর সবাই যেন ঘুমিয়ে। ও-ঘরে বাবা-মা, মুকুল, বারান্দায় সতী। পনেরো ষোলদিনের চেনা এক পরম প্রিয়জনের কাছ থেকে আসা, প্রথম নীল-চিঠির মতো অতল রহস্য দুপুরটার, কী সে রহস্য সেটা বের করবার জন্য দপদপ করলো মায়ার মন । রহস্যের খানিকটা ছোঁয়া ঠোঁটে, শুকনো, খড়খড়ে, গরম ঠোঁট তৃষিত । রহস্যের খানিকটা আভাস আঙুলের আগায়, নরম আঙুলের ডগা রক্তে টকটক, না, পাটকিলে, না , গেরুয়া, না, কোনো রঙই নয়, কিরিমিরি আঁকা দুপুর । দুপুর। মুকুলটা ভারি নোংরা, ছেড়া লুঙি পরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে খায় । সেই অফিস-ফেরত পায়ের শব্দ কোনদিন আসবে না ? একটা সুর শোনা যায়, কান পেতে থিতিয়ে থাকে মায়া। সুর, বেহালার সুর। কোনো একটা গভীরে চেনা সুর কে যেন হাড়হেড়ে আঙুলে বাজাতে বাজাতে চলেছে, আর মায়া সেটা শুনছে। পুরোটা বুঝতে পারছে না, অথচ পুরোটা শোনবার জন্য তার মন ছটফট করছে। আর ঐ ব্যাঙ-বাজনা বেহালা সারাটা দুপুর ধরে বেজে চলেছে এই বাড়ির চারপাশের রাস্তা দিয়ে । ছন্নছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া, উড়নচণ্ডি দুপুরটার উদভ্ৰান্ত মনের কাছে বেহালাটা যেন কী শোনাতে চায়। কোথেকে একটা সুর এনে অন্যমন দুপুরের কানের কাছে কে বাজাচ্ছে ? মায়া ভাবে, যতোবার সুরটা এসে কানে ধাক্কা দেয়, ততোবার ভাবে, কোথায় কী একটা দরজা যেন খুলে যাচ্ছে, যার অপর পারে অতল রহস্য। এই সুরটা পুরো বাজুক, সেই দরজা পুরো খুলুক, সেই রহস্যময় কল্পনা পুরোটা দেখা যাক। সুরটা পুরো বাজুক। সুরটা চেনা যায় না, জানা যায় না। নিজেকেই সাত্বনা দেয় মায়া-ও চেনা যায় না, ও জানা যায় না।—ডাকে ফেরত-দেওয়া মায়ার ছবির মতো দুপুরটা ঈষৎ মলিন হয়ে যাচ্ছে, হাতে-হাতে ব্যবহারে ঈষৎ অপরিচ্ছন্ন ।
মাটির বেহালা বেজে চলেছে, বাজতে বাজতে যেন মিলিয়ে যাবে। দুপুরটা থিতিয়ে আসছে, থিতিয়ে খিতিয়ে যেন বিকেল হয়ে যাবে। সতী পড়ে আছে বারান্দায় সেই চৌকিতে । গোধূলি লগ্ন শেষ হয়ে এসেছে, এবার ঘরে ফেরার পালা, ভটিয়ালির সুর মনে নিয়ে ভরাকলসি কাঁখে আবার ফিরে যাওয়া ধরাবাঁধা জীবনে। কিন্তু তার আগে তৃষ্ণা মিটলো না কেন সতীর পুরোপুরি ? তৃষ্ণা না মিটিয়েই বেহালা কেন চলে গেল, দুপুরটা কেন বিকেল হয়ে যাচ্ছে ?
চৌকির ওপর উঠে বসলো সতী । মাটির বেহালা বেজে চলেছে, বাজতে বাজতে যেন মিলিয়ে যাবে। দুপুরটা থিতিয়ে আসছে, থিতিয়ে থিতিয়ে যেন বিকেল হয়ে যাবে। যতীনবাবু পড়ে আছেন ঘরের চৌকিতে । এ-দেহের যৌবন ফিরে আসতে-না-আসতে বেহালাটা থেমে গেল, দুপুরটা চলে গেল ? বেহালার সুরের নদী বেয়ে নদীর মতো মেয়ে যে কাছাকাছি এসেছিল। আবার দুপুরে বসন্তের দেওয়া জলে তৃষ্ণা মেটাতে হবে । যতীনবাবু চৌকির ওপর উঠে বসলেন । বেহালাটা বেজে চলেছে, মিলিয়ে যাবে যেন । দুপুরটা থিতিয়ে আসছে, বিকেল হয়ে যাবে যেন । রেণুবালা শুয়ে আছেন। বেহালার সুরের মতো শরীরটা একটা কিছু সৃষ্টি করতে যাচ্ছিল যেন, তার আগেই দুপুরটা মিলিয়ে গেল। দেহটা সুর হয়ে উঠলো না। উঠছিল যেন। রেণুবালা উঠে বসলেন। বেহালাটা বেজে চলেছে, মিলিয়ে যাবে যেন । দুপুরটা থিতিয়ে আসছে, বিকেল হয়ে যাবে যেন । মুকুল শুয়ে আছে। বোজা চোখের পাতায় বিচিত্র রঙগুলো স্তম্ভিত রামধনুর গঠন পেতে পেতেই দুপুরটা ফুরিয়ে যাচ্ছে, রামধনু আবার মিলিয়ে গেল। মুকুল বসলো ।
বেহালাটা বেজে চলেছে। মিলিয়ে যাবে। দুপুরটা থিতিয়ে আসছে। বিকেল হয়ে যাবে। মায়া শুয়ে আছে। বেহালার সুর যে অন্য জগতের দরজাটা একটু একটু খুলছিল, সেটা আবার একটু একটু করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী এক রহস্য একটু দেখা যাচ্ছিল, আর যাবে না। মায়া উঠে বসলো । সতী বারান্দা থেকে এ-ঘরে এলো, মায়া ও-ঘর থেকে এ-ঘরে এলো। যতীনবাবু, রেণুবালা, মায়া, সতী, মুকুল—পাঁচজন পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে রইল, আর মাটির বেহালাটা নিজের ছোট্ট দেহটাতে পাগলের মতো ঝোড়ো সুরের আওয়াজ এনে বিদীর্ণ হয়ে, থেমে যাবার আয়োজন করছে যেন ঝড়ের সঙ্গে লড়ছে যেন চড়ুই পাখি । হঠাৎ একটা ট্রাকের জান্তব আওয়াজে মাটির বেহালার সুরটা থেমে গেল। তারা পাঁচজন একটুক্ষণ অপেক্ষা করলো। আর সুর শোনা গেল না। পাঁচজন আবার পাঁচজনের দিকে চাইল । চেয়েই থাকলো। যেন পাঁচজন পাঁচজনকে কিছু একটা বলবে, ঈষদেদ্ভিন্ন পাঁচটি ঠোঁটে তার আভাস। বাড়ির কোন এক খ্যাপা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে, প্রতিদিনই তার আসার আশা, কোনোদিনই সে ফেরে না । দুপুরটা ধীরে ধীরে বিকেল হয়ে গেল।
4 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ গদ্য
উত্তরমুছুনএসব অখাদ্য কুখাদ্য লেখার মানে কি?
উত্তরমুছুনদুপুরের নিস্তব্ধতার মাঝে ঘটে যাওয়া কতশত কামনা। দারুন করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
উত্তরমুছুন