
পিয়ারসন এয়ারপোর্টে পা দেয়ার তিন মাসের মাথায় মারফোস সুলতানের মনে হলো বড় পুকুরের ছোট মাছ হওয়ার চেয়ে ছোট পুকুরের বড় মাছ হওয়া অনেক মর্যাদার। পৃথিবীতে এতো প্রাণী থাকতে নিরীহ জলচর একটি প্রাণীর সাথে কেন সে তার তুলনা করতে গেল এটাও একটা ভাবনার বিষয়। দেশে তো তার মাছের জীবন ছিল না। মাঝারি একটি কর্পোরেট অফিসের প্রশাসন চালিয়েছে সে শক্ত হাতে। প্রশাসন চালাতে গিয়ে কতো সমালোচনাই না হতো তার। প্রতিদিন সাতটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে অফিসে উপস্থিত হতো মারফোস সুলতান।
পিয়নটা তখনও আসতো না। নিজ হাতে এককাপ কফি বানিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে ইংরেজি দৈনিকের পাতায় চোখ বোলাতো। ঠিক আটটা দশে বেরিয়ে পড়তো ফ্লোরে। গুড মর্নিং স্যার, গুড মর্নিং স্যার বলে সবাই দিনের প্রথম সম্ভাষণ জানাতো তাকে। হাবিবুল্লাহ নামের একাউন্ট সেকশনের ইনচার্জ তখন হয়তো টিফিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে অফিসে ঢুকতো। মুখের জবজবে পানের রস সামলিয়ে সে বলতো-স্যারের শরীরটা ভালা? অনেক সময় মুখের পানের রস সে সামলাতে পারতো না। তখন কোন কিছু না বলে মাথাটা সামান্য নিচু করে তার সিটের দিকে এগিয়ে যেত। হাবীবুল্লার বেশভূষা, পানের প্রতি আসক্তি আর তার সম্ভাষণ মারফোস সুলতানের পছন্দের না। বেশ কয়েকবার রুমে ডেকে সে তাকে বিষয়টা বলেছে কিন্তু তার মধ্যে কোন পরিবর্তনের লক্ষণ নেই। লোকটি কাজে ভালো। একাউন্ট সেকশনের যাবতীয় ঝামেলা সে বলতে গেলে একাই সামলায়। তাই মারফোস সুলতান এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেনি। কিন্তু পরপর তিনদিন দেরিতে উপস্থিতির কারণে একমাসে তিনি তার একদিনের বেতন কর্তনের আদেশ দিলেন।
সাধারণত মাসের পঁচিশ তারিখেই বেতন বিল রেডি হয়ে তার টেবিলে আসতো কিন্তু সে মাসে তিরিশ তারিখ পার হয়ে গেলেও তিনি বেতন বিল টেবিলে পাননি। ঐদিন মারফোস সুলতান সকালের রাউন্ড শেষে ভাবলেন হাবিবুল্লাহ সাহেবকে রুমে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞেস করবেন। তার আগেই এমডি স্যার সালাম দিয়ে তার রুমে এককাপ কফি খাওয়ার জন্য ডাকলেন।
এমডি স্যারের রুমে ঢুকে মারফোস সুলতান একটু অবাকই হলেন। স্যারের বয়স হয়েছে, রাতে তার অনিদ্রাজনিত সমস্যা আছে। সে কারণে সকালের দিকে তিনি থাকেন গম্ভীর। পারতপক্ষে কারও সাথে কথা বলেন না। আজ রুমে ঢোকার সাথে সাথে স্যার তার শরীরের খবর নিলেন, গতকালের খুলনার প্রজেক্টের ফাইলে তার দেয়া সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেন। পিয়নকে ডেকে কফির সাথে স্যারের সেই বিখ্যাত কুকি, যা থেকে ঘিয়ের গন্ধ আসে, সেটিও দিতে বললেন।
কফিতে কেবল একটা চুমুক দিয়েছেন, এমন সময় স্যার বললেন--
-মারফোস সাহেব, এ মাসের বেতন বিল কি রেডি হয়েছে?
-গতকাল টেবিলে পাইনি স্যার। দেখি হাবিবুল্লাহ সাহেবকে জিজ্ঞেস করে।
-আপনি কি এ মাসে হাবিবুল্লাহ সাহেবের একদিনের বেতন কর্তনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন?
-জী স্যার।
-সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করা যায় না মারফোস সাহেব?
-বেতন কর্তন কোন বড়ো বিষয় নয় স্যার। আমি যদি সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করি তাহলে এ অফিসের প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে যাবে।
-দেখেন কি করবেন? জানেন তো হাবিবুল্লাহ সাহেব আপনার ভাবীর আবার দুর সম্পর্কের আত্নীয় ।
মারফোস সুলতান সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নি। হাবিবুল্লাহ সাহেব এখন নিয়ম করে সকালেই অফিসে আসে। এমন কঠিন মারফোস সুলতান তার তুলনা করবেন বাঘের সাথে, তা না করে এখানে আসার তিন মাসের মাথায় নিরীহ একটি জলচর প্রাণীর সাথে নিজের তুলনা করলেন। বিষয়টি মারফোস সুলতানাকে সত্যিই ভাবিয়ে তুললো।
মারফোস সুলতানকে এদেশে স্বাগত জানিয়েছিলো বিরূপ প্রকৃতি। পিয়ারসন এয়াপোর্টের সর্বশেষ আগমনী দরজাটি যখন যান্ত্রিকভাবে খুলে গেল তখন হিমাঙ্কের পনের ডিগ্রী নীচের তাপমাত্রার ঝটকা বাতাস এসে তার পুরো শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। সবকিছু জেনে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন, তারপরও মনে হলো এতো হিমঘরের ঠাণ্ডার চেয়েও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। গত বছর মারা গেছে তার মামা। মামাতো বোন থাকে কিউবা। সময়মতো ফ্লাইট না পাওয়ায় দুতিনটি মহাদেশ ঘুরে, তিন-চারটি ফ্লাইট পরিবর্তন করে দেশে আসতে আসতে চারদিন। চারদিন পর মামাকে যখন বারডেমের হিমঘর থেকে বের করার জন্য দরজা খুললো তখন ঠাণ্ডার তীব্র ফলা এসে লেগেছিলো তার চোখেমুখে। সে ঠাণ্ডায় ছিল গুমোট ভাব, কুয়াশার বিষণ্ণতায় ভরা। কিন্তু পিয়ারসনসের এ বেশ ঝলমলে, চকচকে সূর্যের আলোয় জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরপুর। তবুও এটিকে তার হিমঘরের ঠাণ্ডার মতো মনে হলো কেন। এর কোন উত্তর জানা নেই মারফোস সুলতানের। অবচেতন মনে কানাডার উপর তার কি বিদ্বেষ জমে উঠলো?
সবকিছু জয় করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে এসেছিলো সে। তাই বিরূপ প্রকৃতি তাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেও সেই কাঁপুনিকে গতিতে রূপান্তর করে পরিবার পরিজনসহ উঠেছিলেন তাকে নিতে আসা বন্ধুর বড়ো সড়ো বুইক এনক্লেভ গাড়িতে। এতো প্রশস্ত গাড়িতে কি সে উঠেছিলো দেশে? তার এম ডি স্যারের গাড়িটি কি এর চেয়ে বড় ? মনে হয় না। অফিস থেকে তাকে যে গাড়িটি দেয়া হয়েছিলো, সেটি ছিল টয়োটা করোলা, দেশের মানুষের বিশ্বস্ত আভিজাত্য এ ব্রান্ডের সাথে মিশে আছে। এয়ারপোর্ট থেকে বন্ধুর বাসার পুরোটা পথ জুড়ে রাস্তার দুপাশে ছিল সাদা বরফের উপর ঝকঝকে সূর্যের আলোর চেকনাই সৌন্দর্য। চোখ ঝলসে যাওয়া সে দৃশ্য আর আকাশচুম্বী অট্টালিকা দেখতে দেখতে সে পৌঁছে গিয়েছিলো বন্ধুর বাড়িতে। আগামী দুতিনদিনের আবাস্থলে।
মারফোস সুলতান প্রথম ধাক্কাটি খেয়েছে চাকুরি খুঁজতে গিয়ে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে রিজুমি ড্রপ করে, এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সিগুলোতে ঘুরে ঘুরে দুমাস পর সে একটি ইন্টারভিউয়ের কল পায়।, আহামরি কিছু নয়। দেশে তার অফিসে হাবিবুল্লাহ সাহেবের অধীনে লিকলিকে সদ্য ডিগ্রী পাশ করা মেয়েটি যে কাজ করতো, সে পদমর্যাদার একটি কাজ। হোক না যেমনি তা, শুরু করা দরকার! দেশ থেকে আনা টাকার অঙ্ক এ দুমাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এভাবে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করলে আগামী তিন-চার মাস পর কপর্দকহীন হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। সে চিন্তায় তার জুলফির কাছের চুলগুলো হঠাৎ করেই ধুসর বর্ণ ধারণ করেছে। তাই কোনদিকে না তাকিয়ে মারফোস সুলতান নির্ধারিত দিনে হাজির হয় ইন্টারভিউ বোর্ডে। সবকিছু শুনে বোর্ডের মধ্যবয়সি মহিলা যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, "ডু ইউ হ্যাব এনি কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স"। এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই মারফোস সুলতানের কাছে। দক্ষ পেশাজীবীর কোঠায় সে এদেশে এসেছে সবে দুমাস হলো, এর মাঝে তার কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স থাকার কথা নয়, দেশে ব্যবসা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী তার আছে, দশ বছরের প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতার কথাও জ্বল জ্বল করছে তার রিজুমিতে, তার পরেও অফিসের রেকর্ড কিপিং, ডেসপাস, এবং টুকটাক ড্রাফট লেখার কাজে কেন কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্সের প্রয়োজন হবে তা তার বোধগম্য নয়। মেজাজকে অনেকটা সংযত করে এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বোর্ডে সে জবাবটা দিয়েছিলো। দুদিন পর তার মেইলে একটা চিঠি এসেছিলো, তারা গর্বিত তাদের আবেদনে সাড়া দেয়া ও ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হওয়ার জন্য। চাকুরি হয়েছে কি না সেটি না বলে ভবিষ্যতে আবার তাদের দেখা হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে মেইল শেষ করে। এ সৌজন্যতায় মুগ্ধ হয়েই মারফোস সুলতান বুঝতে পারে চাকুরিটা তার হয়নি।
এরপর মারফোস সুলতান কাজ নিয়েছিলো ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিক্রয়ের দোকানে। যে টাকা পায় তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলে যায়, মনের ভার চলে যায় না। বরফ আচ্ছাদিত পথ মাড়িয়ে সে কাজে যায়, ফিরে আসে একগাদা বিষণ্ণতা নিয়ে। মানুষের মন মনে হয় সবচেয়ে বিচিত্র প্রকৃতির, মানবো না মানবো না করেও একসময় সবকিছু মেনে নেয়। মারফোস সুলতানও মেনে নিয়েছে তার জীবন। মনের দগদগে ঘা শুকোতে শুরু করেছে কেবল, এমন সময় ঘটলো বিপত্তি।
কাজে আজ সারাদিনই চিনচিনে বুকের ব্যথা, এমনটি প্রায়ই হয়, দেশেও হয়েছে। একবার গুলশানের একটি অভিজাত হাসপাতালে টেস্ট করিয়েছিলো সে। রিপোর্ট দেয়ার সময় টেকনিশিয়ান যা বলেছিলো- তেমন কোন খারাপ ফাইন্ডিংস নেই। তবে কেন সত্ত্বর হাজার টাকা খরচ করালো ডাক্তার, এর কোন জবাব দেয়নি টেকনিশিয়ান। পরে ডাক্তারের জবাবও তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
সন্ধ্যার পর ব্যথাটা বাড়লে ৯১১ এ কল করেছিলো দীনা, মারফোস সুলতানের নিষেধ সে শোনেনি। কিছুদিন আগে টিভিতে 'দি কল' নামে একটা সিনেমা দেখেছিলো দীনা, সেখান থেকেই ৯১১ এর কথা জেনেছিলো। ফোন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাঁইরেন বাজিয়ে এলাকাবাসীকে তটস্থ করে এম্বুলেন্স বাসার সামনে এসে হাজির। মারফোস সুলতানের হাঁটা কিংবা চলাফেরার কোন সমস্যা হচ্ছে না তারপরও সবকিছু শুনে সাথে সাথে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে স্ট্রেচারে করে এম্বুলেন্সে তুলে নিলো। দীনা নাছোড়বান্দা, সে সাথে যাবেই। ইএমএস এর লোকজন না করেছিলো, তার কোন কাজ নেই হাসপাতালে।
সারারাত দীনা বসে ছিল ওয়েটিংরুমে, কোন খবরই জানতে পারেনি। সকালের দিকে মারফোস সুলতানকে বের করে নিয়ে আসে। নার্স বুঝিয়ে দেয় সবকিছু। একটি রক্ত নালিতে ব্লোক ছিল ৮০ শতাংশ। ছোটখাটো একটি সার্জারি করেছে তারা। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ, জীবন ধারণে কোন সমস্যা নেই। এম্বুলেন্সে করে নার্সসহ বাসায় ফিরলো তারা। নার্স বাসায় এসে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেল। তিনদিন রেস্ট, তারপর স্বাভাবিক জীবন যাপন। এর মাঝে হাসপাতাল থেকে দুবেলা ফোন করে খবর নিয়েছে মারফোস সুলতানের। এখানকার চিকিৎসা সেবা ফ্রি, কিন্তু কতটা ফ্রি তা জানতে চেয়েছিলও দীনা, নার্স তাকে আস্বস্ত করে বলেছিলো- ইউ ডন্ট হ্যাব নাথিং টু পে!
চতুর্থ দিন সকালে উঠে কাজে যাবে মারফোস সুলতান। দীনা সকালে নাস্তা আর টিফিন রেডি করতে ব্যস্ত। জানালা দিয়ে ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ছিল মারফোস সুলতান। দীনা টিফিনের ব্যাগটা নিয়ে আসতেই তার দিকে তাকিয়ে বললো-এখানকার জীবনটা খুব একটা খারাপ না দীনা, ঐ যে বাইরে দেখো, ধবধবে সাদা সবকিছু, তার মাঝে বেমানান ভাবে জেগে আছে দুএকটা কালো খড়কুটো, ঠিক তেমনি।
একটা ধাক্কায় কানাডায় মন বসেছে মারফোস সুলতানের, সেটি চিন্তা করে ফিক করে হেসে দেয় দীনা।
-আপনি কি এ মাসে হাবিবুল্লাহ সাহেবের একদিনের বেতন কর্তনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন?
-জী স্যার।
-সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করা যায় না মারফোস সাহেব?
-বেতন কর্তন কোন বড়ো বিষয় নয় স্যার। আমি যদি সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করি তাহলে এ অফিসের প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে যাবে।
-দেখেন কি করবেন? জানেন তো হাবিবুল্লাহ সাহেব আপনার ভাবীর আবার দুর সম্পর্কের আত্নীয় ।
মারফোস সুলতান সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নি। হাবিবুল্লাহ সাহেব এখন নিয়ম করে সকালেই অফিসে আসে। এমন কঠিন মারফোস সুলতান তার তুলনা করবেন বাঘের সাথে, তা না করে এখানে আসার তিন মাসের মাথায় নিরীহ একটি জলচর প্রাণীর সাথে নিজের তুলনা করলেন। বিষয়টি মারফোস সুলতানাকে সত্যিই ভাবিয়ে তুললো।
মারফোস সুলতানকে এদেশে স্বাগত জানিয়েছিলো বিরূপ প্রকৃতি। পিয়ারসন এয়াপোর্টের সর্বশেষ আগমনী দরজাটি যখন যান্ত্রিকভাবে খুলে গেল তখন হিমাঙ্কের পনের ডিগ্রী নীচের তাপমাত্রার ঝটকা বাতাস এসে তার পুরো শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। সবকিছু জেনে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন, তারপরও মনে হলো এতো হিমঘরের ঠাণ্ডার চেয়েও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। গত বছর মারা গেছে তার মামা। মামাতো বোন থাকে কিউবা। সময়মতো ফ্লাইট না পাওয়ায় দুতিনটি মহাদেশ ঘুরে, তিন-চারটি ফ্লাইট পরিবর্তন করে দেশে আসতে আসতে চারদিন। চারদিন পর মামাকে যখন বারডেমের হিমঘর থেকে বের করার জন্য দরজা খুললো তখন ঠাণ্ডার তীব্র ফলা এসে লেগেছিলো তার চোখেমুখে। সে ঠাণ্ডায় ছিল গুমোট ভাব, কুয়াশার বিষণ্ণতায় ভরা। কিন্তু পিয়ারসনসের এ বেশ ঝলমলে, চকচকে সূর্যের আলোয় জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরপুর। তবুও এটিকে তার হিমঘরের ঠাণ্ডার মতো মনে হলো কেন। এর কোন উত্তর জানা নেই মারফোস সুলতানের। অবচেতন মনে কানাডার উপর তার কি বিদ্বেষ জমে উঠলো?
সবকিছু জয় করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে এসেছিলো সে। তাই বিরূপ প্রকৃতি তাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেও সেই কাঁপুনিকে গতিতে রূপান্তর করে পরিবার পরিজনসহ উঠেছিলেন তাকে নিতে আসা বন্ধুর বড়ো সড়ো বুইক এনক্লেভ গাড়িতে। এতো প্রশস্ত গাড়িতে কি সে উঠেছিলো দেশে? তার এম ডি স্যারের গাড়িটি কি এর চেয়ে বড় ? মনে হয় না। অফিস থেকে তাকে যে গাড়িটি দেয়া হয়েছিলো, সেটি ছিল টয়োটা করোলা, দেশের মানুষের বিশ্বস্ত আভিজাত্য এ ব্রান্ডের সাথে মিশে আছে। এয়ারপোর্ট থেকে বন্ধুর বাসার পুরোটা পথ জুড়ে রাস্তার দুপাশে ছিল সাদা বরফের উপর ঝকঝকে সূর্যের আলোর চেকনাই সৌন্দর্য। চোখ ঝলসে যাওয়া সে দৃশ্য আর আকাশচুম্বী অট্টালিকা দেখতে দেখতে সে পৌঁছে গিয়েছিলো বন্ধুর বাড়িতে। আগামী দুতিনদিনের আবাস্থলে।
মারফোস সুলতান প্রথম ধাক্কাটি খেয়েছে চাকুরি খুঁজতে গিয়ে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে রিজুমি ড্রপ করে, এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সিগুলোতে ঘুরে ঘুরে দুমাস পর সে একটি ইন্টারভিউয়ের কল পায়।, আহামরি কিছু নয়। দেশে তার অফিসে হাবিবুল্লাহ সাহেবের অধীনে লিকলিকে সদ্য ডিগ্রী পাশ করা মেয়েটি যে কাজ করতো, সে পদমর্যাদার একটি কাজ। হোক না যেমনি তা, শুরু করা দরকার! দেশ থেকে আনা টাকার অঙ্ক এ দুমাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এভাবে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করলে আগামী তিন-চার মাস পর কপর্দকহীন হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। সে চিন্তায় তার জুলফির কাছের চুলগুলো হঠাৎ করেই ধুসর বর্ণ ধারণ করেছে। তাই কোনদিকে না তাকিয়ে মারফোস সুলতান নির্ধারিত দিনে হাজির হয় ইন্টারভিউ বোর্ডে। সবকিছু শুনে বোর্ডের মধ্যবয়সি মহিলা যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, "ডু ইউ হ্যাব এনি কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স"। এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই মারফোস সুলতানের কাছে। দক্ষ পেশাজীবীর কোঠায় সে এদেশে এসেছে সবে দুমাস হলো, এর মাঝে তার কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স থাকার কথা নয়, দেশে ব্যবসা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী তার আছে, দশ বছরের প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতার কথাও জ্বল জ্বল করছে তার রিজুমিতে, তার পরেও অফিসের রেকর্ড কিপিং, ডেসপাস, এবং টুকটাক ড্রাফট লেখার কাজে কেন কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্সের প্রয়োজন হবে তা তার বোধগম্য নয়। মেজাজকে অনেকটা সংযত করে এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বোর্ডে সে জবাবটা দিয়েছিলো। দুদিন পর তার মেইলে একটা চিঠি এসেছিলো, তারা গর্বিত তাদের আবেদনে সাড়া দেয়া ও ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হওয়ার জন্য। চাকুরি হয়েছে কি না সেটি না বলে ভবিষ্যতে আবার তাদের দেখা হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে মেইল শেষ করে। এ সৌজন্যতায় মুগ্ধ হয়েই মারফোস সুলতান বুঝতে পারে চাকুরিটা তার হয়নি।
এরপর মারফোস সুলতান কাজ নিয়েছিলো ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিক্রয়ের দোকানে। যে টাকা পায় তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলে যায়, মনের ভার চলে যায় না। বরফ আচ্ছাদিত পথ মাড়িয়ে সে কাজে যায়, ফিরে আসে একগাদা বিষণ্ণতা নিয়ে। মানুষের মন মনে হয় সবচেয়ে বিচিত্র প্রকৃতির, মানবো না মানবো না করেও একসময় সবকিছু মেনে নেয়। মারফোস সুলতানও মেনে নিয়েছে তার জীবন। মনের দগদগে ঘা শুকোতে শুরু করেছে কেবল, এমন সময় ঘটলো বিপত্তি।
কাজে আজ সারাদিনই চিনচিনে বুকের ব্যথা, এমনটি প্রায়ই হয়, দেশেও হয়েছে। একবার গুলশানের একটি অভিজাত হাসপাতালে টেস্ট করিয়েছিলো সে। রিপোর্ট দেয়ার সময় টেকনিশিয়ান যা বলেছিলো- তেমন কোন খারাপ ফাইন্ডিংস নেই। তবে কেন সত্ত্বর হাজার টাকা খরচ করালো ডাক্তার, এর কোন জবাব দেয়নি টেকনিশিয়ান। পরে ডাক্তারের জবাবও তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
সন্ধ্যার পর ব্যথাটা বাড়লে ৯১১ এ কল করেছিলো দীনা, মারফোস সুলতানের নিষেধ সে শোনেনি। কিছুদিন আগে টিভিতে 'দি কল' নামে একটা সিনেমা দেখেছিলো দীনা, সেখান থেকেই ৯১১ এর কথা জেনেছিলো। ফোন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাঁইরেন বাজিয়ে এলাকাবাসীকে তটস্থ করে এম্বুলেন্স বাসার সামনে এসে হাজির। মারফোস সুলতানের হাঁটা কিংবা চলাফেরার কোন সমস্যা হচ্ছে না তারপরও সবকিছু শুনে সাথে সাথে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে স্ট্রেচারে করে এম্বুলেন্সে তুলে নিলো। দীনা নাছোড়বান্দা, সে সাথে যাবেই। ইএমএস এর লোকজন না করেছিলো, তার কোন কাজ নেই হাসপাতালে।
সারারাত দীনা বসে ছিল ওয়েটিংরুমে, কোন খবরই জানতে পারেনি। সকালের দিকে মারফোস সুলতানকে বের করে নিয়ে আসে। নার্স বুঝিয়ে দেয় সবকিছু। একটি রক্ত নালিতে ব্লোক ছিল ৮০ শতাংশ। ছোটখাটো একটি সার্জারি করেছে তারা। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ, জীবন ধারণে কোন সমস্যা নেই। এম্বুলেন্সে করে নার্সসহ বাসায় ফিরলো তারা। নার্স বাসায় এসে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেল। তিনদিন রেস্ট, তারপর স্বাভাবিক জীবন যাপন। এর মাঝে হাসপাতাল থেকে দুবেলা ফোন করে খবর নিয়েছে মারফোস সুলতানের। এখানকার চিকিৎসা সেবা ফ্রি, কিন্তু কতটা ফ্রি তা জানতে চেয়েছিলও দীনা, নার্স তাকে আস্বস্ত করে বলেছিলো- ইউ ডন্ট হ্যাব নাথিং টু পে!
চতুর্থ দিন সকালে উঠে কাজে যাবে মারফোস সুলতান। দীনা সকালে নাস্তা আর টিফিন রেডি করতে ব্যস্ত। জানালা দিয়ে ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ছিল মারফোস সুলতান। দীনা টিফিনের ব্যাগটা নিয়ে আসতেই তার দিকে তাকিয়ে বললো-এখানকার জীবনটা খুব একটা খারাপ না দীনা, ঐ যে বাইরে দেখো, ধবধবে সাদা সবকিছু, তার মাঝে বেমানান ভাবে জেগে আছে দুএকটা কালো খড়কুটো, ঠিক তেমনি।
একটা ধাক্কায় কানাডায় মন বসেছে মারফোস সুলতানের, সেটি চিন্তা করে ফিক করে হেসে দেয় দীনা।
1 মন্তব্যসমূহ
জীবন যাপনের গুছানো এক গল্প...............
উত্তরমুছুন