সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

ইমতিয়ার শামীম

মধ্যযুগের কোনো একসময়ে হেজাজ থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ। তাঁরা কারা ছিলেন, এখন তা জানার উপায় নেই— তবে এটুকু নিশ্চয়ই বলা যায়, ব্যবসায়ী ছিলেন না তারা— এসেছিলেন সম্ভবত ধর্মপ্রচারে।


কিন্তু দু-এক পুরুষ পরে এ দেশের মানুষ হয়ে পড়েন তাঁরা। ধর্মকর্ম নিয়ে নিরিবিলি থাকতেন তাঁর বাবা সৈয়দ আহমাদউল্লাহও। সুফি প্রকৃতির মানুষ হলেও তাঁর বড় সন্তান সৈয়দ নসরুল্লাহর মতে, ধর্মবোধ খুব প্রবল ছিল তাঁর। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, ইউরোপের সাহিত্য-দর্শনও পাঠ করতেন; কিন্তু মানুষটির মূল ঝোঁক ছিল ইসলামী দর্শনের দিকে। এহেন মানুষের পুত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা তাঁর বড় ভাই সৈয়দ নসরুল্লাহ দুজনেই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার দিকে তত মনোযোগী ছিলেন না। বড়টি যা-ওবা ছিলেন, ছোটটি একদমই না। বড়ভাই সেকথা এক সাক্ষাত্কারে বলেওছিলেন, ছোটবেলা থেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অর্ধশিক্ষিত মোল্লা-মৌলভিদের ওপর খুব বিরক্ত ছিল ওয়ালীউল্লাহ। মনেপ্রাণে তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মান্ধতাই বাঙালি মুসলমানের অধঃপতনের কারণ। এমনকি তাঁর লেখালেখিতেও শুরু থেকেই এই বিষয়টির প্রভাব পড়েছে। তবে এ ব্যাপারটিও বেশ মজার লাগে, বিয়ে করার সময় ধর্মান্তরিত আন-মারির নাম রেখেছিলেন তিনি আজিজা নাসরিন। আর ‘নাসরিন’ বলেই ডাকতেন তাকে— যদিও নসরুল্লাহ থেকে শুরু করে পরিবারের আর সবাই ‘আন-মারি’ই বলতেন।

সরকারি কাগজপত্র মতে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্মদিন ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯২২। যদিও তা আসলে ১৫ আগস্ট ১৯২২। বাংলাদেশে জন্মতারিখের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা এখনো ঘটে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) সৈয়দ আহমাদউল্লাহ ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে ময়মনসিংহে একই পদে বদলি হয়ে আসেন। তারপর আর বেশি দিন বাঁচেননি তিনি। পাকস্থলী ক্যান্সার হয়েছিল তাঁর। ছুটি নিয়ে চিকিত্সার জন্য কলকাতা গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেখানেই পার্ক সার্কাস এলাকার বালুহাক্কাক লেনের বাসায় তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৯৪৫ সালের ১৮ জুনে। মানুষটি স্বাধীনচেতা ছিলেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের এত সমীহ করতেন যে, গুরুতর অভিযোগ ছাড়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করতে দিতেন না তিনি। এ নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধও ছিল। এমনকি তাঁকে যখন ‘খানবাহাদুর’ উপাধির জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। বাঙালি মুসলমানদের যে অংশটি তখন বাঙালিত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে শুরু করেছে, বোধকরি তিনি ছিলেন তাদেরই দলে।

এতদিন পরে, তাছাড়া নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রের অনুপস্থিতিতে নিশ্চিত করে বলা আর সম্ভব নয়, কী করে সাহিত্যচর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন ওয়ালীউল্লাহ। এটুকু জানা যাচ্ছে, তার মামি রাহাত আরা বেগম উর্দু সাহিত্যের লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরসহ বেশ কয়েকটি গল্প-উপন্যাস তিনি অনুবাদ করেছিলেন উর্দু ভাষায়। অনেকগুলো গল্প-উপন্যাসের বইও রয়েছে তাঁর। বালক ওয়ালীউল্লাহর অবচেতনে মামির সাহিত্যচর্চা হয়তো আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। তবে স্কুলে থাকতেই যে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, নিশ্চিত করেই বলা যায় তা। ত্রিশের দশকে সৈয়দ আহমাদউল্লাহ ছিলেন ফেনীর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও)। ওই সময় ১৯৩৫-৩৬ সালে ওয়ালীউল্লাহ ফেনী হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে। হাউজ সিস্টেম ছিল সে বিদ্যালয়ে। ওয়ালীউল্লাহ যে হাউজে ছিলেন, তাঁকে সেটির ম্যাগাজিন সম্পাদক করা হয়েছিল। বোধকরি সেই থেকেই সাহিত্যের সংশ্রবে আসেন তিনি। ম্যাগাজিনের নাম কী রাখা যায়, তা নিয়ে সবাই যখন চিন্তাভাবনা করছে, ওয়ালীউল্লাহই তখন প্রস্তাব করেছিলেন, দেয়াল পত্রিকার নাম রাখা হোক ‘ভোরের আলো।’ পত্রিকাটিতে তিনি শুধু লিখতেন না, ছবিও আঁকতেন। তাঁর সত্মা নাসিম আরা খাতুনের ভাষ্যানুযায়ী, ওই সময় ছবি আঁকার দিকেই তাঁর বেশি ঝোঁক ছিল। ম্যাট্রিকের টেস্ট বা প্রি-টেস্ট পরীক্ষার আগে তাঁর সারাদিন রঙ-তুলি নিয়ে ছবি আঁকা সহ্য করতে না পেরে আহমাদউল্লাহ একদিন অফিস থেকে ফিরে তাঁর আঁকা ছবিগুলো ছিঁড়ে ফেলেন। প্রসঙ্গত, মনে পড়ছে, কয়েক বছর পর ১৯৪০ সালে (পৌষ, ১৩৪৭) কবি বন্দে আলী মিয়া ও বলরাম ঘোষের সম্পাদনায় ‘ভোরের আলো’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে ফেনী থেকে অচিরেই ওয়ালীউল্লাহ তার বাবার বদলির চাকরির সুবাদে চলে যান কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এসএসসি অতিক্রম করেন তিনি। তার পর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন।

ঢাকা কলেজ, লেখাই বাহুল্য, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মানস গঠনে ও রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঢাকা কলেজে তখন শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন দর্শন বিভাগের মমতাজউদ্দিন আহমদ, হরিদাস ভট্টাচার্য, সুলতান উদ্দিন আহমদ, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ। কলেজে ভর্তির প্রথম দিনেই তিনি পান তাঁর ফেনীর স্কুলজীবনের বন্ধু নাজমুল করিমকে— যিনি পরবর্তী সময়ে সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। তাঁর বন্ধুবৃত্তে ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, রবি গুহ, সানাউল হক, খাজা খয়েরউদ্দিন (পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানবাদী মুসলিম লীগের নেতা), নূরুদ্দিন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। তোয়াহা ছিলেন ওয়ালীউল্লাহর রুমমেট। তাই কমিউনিস্ট পার্টির তত্পরতার সঙ্গেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। আহমদুল কবিরের বরাত দিয়ে মোহাম্মদ তোয়াহা জানান, মার্ক্সবাদী না হলেও এবং উদার জাতীয়তাবাদী হলেও ওয়ালীউল্লাহ চাইতেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্টদের ওপর দমন-পীড়ন নেমে এলে ওয়ালীউল্লাহ নূরুদ্দীনদের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টিকে অর্থসাহায্য করেছেন। আর শুধু অর্থসাহায্য কেন, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী এবং কবি ও লেখক গোলাম কুদ্দুসকে ঢাকায় তার পুরানা পল্টনের বাসায় লুকিয়ে রাখেন তিনি। এ সময়েই একদিন সেই বাসায় নিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সামনে নতুন দিন’ লেখা শেষ করে আসেন আবু রুশদ। ‘দেশ-বিভাগের মতো যুগান্তকারী ঘটনার পর’ বন্ধু গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে দেখা হওয়ায় তিনি খানিকটা উত্তেজিতও ছিলেন। কেননা গোলাম কুদ্দুস তার প্রথম উপন্যাস ‘এলোমেলো’র দীর্ঘ আলোচনাও লিখেছিলেন। কিন্তু তাদের দুজনকে নতুন উপন্যাস পড়ে শোনাতে গিয়ে আবু রুশদ রীতিমতো হোঁচট খান। কেননা গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘...ওসব লেখা আমি এখন পড়ি না, আর এখন ওয়ালীউল্লাহর লেখা শুনছি, অন্য কোনো উপন্যাস শোনার সময় নেই।’ গোলাম কুদ্দুস যেদিন ওই বাসা থেকে চলে যান, তার পরের দিনই পুলিশ এসে সার্চ করে ওয়ালীউল্লাহর বাসা। সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশেমের লেখা থেকেও আমরা জানতে পারছি, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রতি তাঁর আস্থার কথা, যদিও নাজমুদ্দিন ‘তাঁর সেই স্বপ্নবিলাসের সঙ্গে একমত’ হতে পারেননি। ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি, শিহরিত হয়েছেন চে’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পরবর্তীকালে ইংরেজিতে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘দ্য আগলি এশিয়ান’-এ তাঁর যে চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে, তা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সম্ভবত এই সময়েরও ছাপ রয়েছে। তাছাড়া জে লেডারার ও ইউজিন বারডিকের তীব্র সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদবিদ্বেষী উপন্যাস ‘দ্য আগলি আমেরিকান’-এর প্রতিক্রিয়ায় এ উপন্যাস লেখেন তিনি; যা থেকেও অনুমান করা যায়, সাম্যবাদীদের প্রতি তিনি ছিলেন গভীরভাবে সহানুভূতিশীল।

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে থাকার সময় থেকেই গল্প লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯৩৯ সালে কলেজের বার্ষিকীতে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম গল্প ‘সীমাহীন এক নিমেষ’। ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় চৈত্র ১৩৪৮ সনে (মার্চ-এপ্রিল ১৯৪২ সালে) ‘অমীমাংসিত’ গল্প প্রকাশের সময় তিনি আনন্দমোহন কলেজে বিএ প্রথম বর্ষে লেখাপড়া করছেন। এ ঘটনারও বেশ পরে পৌষ ১৩৪৯ সনে (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৪২) সওগাত-এ প্রকাশ পায় তাঁর গল্প ‘চিরন্তন পৃথিবী’। ওই সময় বাঙালি মুসলমানদের লেখালেখির প্রধান ক্ষেত্র ‘সওগাত’ কিংবা ‘মোহাম্মদী’ হলেও ওয়ালীউল্লাহ সম্পৃক্ত হয়েছেন সাহিত্যের সকল আয়োজনে। কেন এমন হলো সেটি বোঝার জন্য কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে এবং তাঁর সাহিত্যচিন্তার বিবর্তনকে বোঝার জন্য এ সময়টির বিশ্লেষণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অন্তত একটি গল্প (‘চৈত্রদিনের এক দ্বিপ্রহরে’) রয়েছে, যেটিতে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রত্যক্ষ প্রকাশ ঘটেছে; কিন্তু ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রকাশিত ‘অমীমাংসিত’ গল্প থেকে স্পষ্ট যে, তিনি সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। ঢাকা কলেজে পড়াশোনা শেষ করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে অর্থনীতিতে (সম্মান) পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পরের বছর তিনি সেখান থেকে ময়মনসিংহে তাঁর পিতার কর্মস্থলে চলে এসে ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে। হূষিকেশ লাহিড়ীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যাচ্ছে, কৃষ্ণনগরে থাকার সময় তখনকার আর সব তরুণ বাঙালি মুসলমানের মতো তাঁরও পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি ছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি এ আন্দোলন সম্পর্কে ক্রিটিক্যাল হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষ বিভক্তির পর ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে তিনি হূষিকেশ লাহিড়ীকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘কায়েদে আজমের মৃত্যু অপূরণীয়। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন এযাবত্ পৃথিবীর মহত্তম ব্যক্তিত্বদের একজন। ... তিনি যা করেছেন, সেজন্য মুসলমানরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই বিদেহী নেতার মহত্ত্ব সম্পর্কে আপনার ইতিবাচক মূল্যায়ন তার বিশ্বাসের অনুসারীদের জন্য বিরাট আনন্দের ব্যাপার। ...পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই আজ করুণভাবে খাটো হয়ে আছে। এই স্থায়ী বিচ্ছেদের ভবিষ্যত্ দুঃখজনক, কিন্তু তা সত্ত্বেও জীবন রক্ষার জন্য এই অস্ত্রোপচার অনিবার্য ছিল। যদি আমরা শুধু এই অস্ত্রোপচারের জরুরি দরকারটাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারতাম! আমরা, দুই ভগিনীতুল্য জাতি, নিজ নিজ পিতাকে হারিয়ে আজ এতিম। আমাদের অবশ্যই সুখে দুঃখে বন্ধু হিসেবে থাকা এবং সেটা চালিয়ে যাবার শপথ নিতে হবে।’ বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারত বিভক্তির পক্ষেই ছিলেন তিনি। যদিও এর ফলাফল তাঁকে ক্রমশই ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। যার ছাপ তাঁর গল্প-উপন্যাসেও পড়ে। ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে ‘লালসালু’ লেখার পর পেছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি তাঁকে। ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছেন কি পূর্ববাংলা কি পশ্চিমবঙ্গ— দুই বাংলাতেই ছোটগল্পের বাঁকপরিবর্তনের নায়ক।

কাজী আফসার উদ্দিনের সুবাদে আমরা জানতে পারছি, কবিতাও লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। কাজী আফসার যখন সাহিত্য সাময়িকী ‘মৃত্তিকা’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন, তখন ছোট গল্পকার হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। আফসার তাঁর কাছে ছোটগল্পই চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি পাঠিয়েছিলেন কবিতা। সেটিই তিনি ‘মৃত্তিকা’তে প্রকাশ করেন।

শওকত ওসমান ও জয়নুল আবেদীন ছিলেন ওয়ালীউল্লাহর বড় ভাই নসরুল্লাহর বন্ধু। কিন্তু সাহিত্যচর্চার সূত্রে তিনি শওকত ওসমানের এবং পেইন্টিংয়ে আগ্রহ থাকার কারণে জয়নুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের পর ওয়ালীউল্লাহদের দুই ভাইকে পার্ক সার্কাস এলাকার বালুহাক্কাক লেন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন শওকত ওসমান ও বুলবুল চৌধুরী। এরপর তাদের হূদ্যতা আরো গভীরতা পায়। দেশভাগের পর পরই প্রকাশ পায় ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’— যাতে দুই দেশেরই নাম রয়েছে। মনোটাইপে ঢাকার সবচেয়ে আধুনিক প্রেস নবাবপুরের নারায়ণ মেশিন প্রেস থেকে ছাপা হয় বইটি। কিন্তু কলকাতার সুভাষ এভিনিউ ছিল প্রকাশকের ঠিকানা। প্রকাশক কমরেড পাবলিশার্স ছিল তাঁর বড় মামা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান। দেশভাগের আগে কলকাতায় থাকার সময়ে ওই প্রকাশনার কাজ শুরু করেন তারা। ওয়ালীউল্লাহ এ প্রকাশনার কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন বেশ কিছুদিন। বইটির প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। তবে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পায় আহসান হাবীবের কথা বিতান থেকে, প্রচ্ছদ করেন আবদুর রউফ। ১৯৬১ সালের জুনে এটির উর্দু অনুবাদ প্রকাশ পায় ‘লাল চাদর’ নামে। অনুবাদ করেছিলেন বিখ্যাত উর্দু লেখক ইউনুস আহমার। সম্ভবত এরপর তিনি ‘লালসালু’ যথেষ্ট বিক্রি না হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।

ময়মনসিংহ থেকে বিএ পাস করার পর কলকাতায় গিয়ে এম এতে ভর্তি হন ওয়ালীউল্লাহ। কিন্তু লেখাপড়া শেষ না করেই ১৯৪৫ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকায় সহসম্পাদক পদে যোগ দেন তিনি। দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় এসে রেডিওর বার্তা বিভাগে কাজ শুরু করেন। পরে ১৯৪৮ সালে রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ সময় উর্দু ভাষার সাহিত্যিক কুররাতুলআইন হায়দারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। কিন্তু কুররাতুলআইন ভারত এবং ওয়ালীউল্লাহ সিডনি চলে যাওয়ার পর তাদের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে বোম্বের সমুদ্রের কাছে নওরোজ গামারিয়া রোডে কুররাতুল আইনের বাসায় যান শওকত ওসমান। অবিবাহিতা কুররাতুল তার কাছ থেকে ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। ১৯৫১ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হওয়ার পর নয়াদিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসে তৃতীয় সচিবের পদমর্যাদায় কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৫২ সালের শেষদিকে তিনি সিডনির পাকিস্তান দূতাবাসে একই পদে কাজ করেন। এখানে তাঁর সঙ্গে আন-মারির পরিচয় হয় এবং ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর তাঁরা সংসার শুরু করেন। তবে এর আগেই ১৯৫৪ সালের ১৮ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে এসে ঢাকা আঞ্চলিক তথ্য দফতরে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি। পরের বছরই করাচিতে বদলি হন তিনি। তবে ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর পুরোপুরি প্রবাসজীবন। জাকার্তা-করাচি-লন্ডন-বন হয়ে তিনি ১৯৬১ সালের এপ্রিলে থিতু হন প্যারিসের পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে নিযুক্ত হয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ কুমুরডাঙা দ্বীপের মানুষের গল্প, যা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং কেবল একটি স্টিমার সার্ভিসের কল্যাণে দুটি অংশের মধ্যেকার বন্ধন ফুটে উঠেছে তাতে। যেন তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতারই একটি আদল তৈরি করেন এ কাহিনীর মধ্যে দিয়ে। প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করার সময়ে তিনি ১৯৬৭ সালের আগস্টে ইউনেস্কোর চুক্তিভিত্তিক ‘প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট’ পদে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে চুক্তি অনুযায়ী এ কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ওয়ালীউল্লাহকে বলা হয়েছিল, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাকে কোথাও বদলি করা হবে না, চাকরির মেয়াদও শেষ করা হবে না। ইউনেস্কোর এই কথার ভিত্তিতে তিনি প্যারিসে বাড়িও কেনেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রেক্ষাপটের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তান ওয়ালীউল্লাহকে ইসলামাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এমনকি আর ইউনেস্কোও পাকিস্তানের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁকে ইসলামাবাদে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর দ্বন্দ্বের সুযোগে ইউনেস্কো কর্তৃপক্ষ তাঁকে সংস্থাটির ব্যাংকক আঞ্চলিক কার্যালয়ের একটি নিম্নতর পদে যোগ দিতে বলে। ওয়ালীউল্লাহ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার অজুহাতে ইউনেস্কো তাকে বরখাস্ত করে। বাধ্য হয়ে ওয়ালীউল্লাহ জেনেভায় জাতিসংঘের স্টাফ ট্রাইব্যুনালের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেন। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালের রায়ও তার বিপক্ষে যায়। পেশাগত জীবনের এই ভয়ানক টানাপড়েনের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনে যুক্ত হন ওয়ালীউল্লাহ। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং এনায়েত করিমের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ব্রিটেন ও আমেরিকার পাশাপাশি তিনি ফ্রান্সেও আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। একই সঙ্গে
ইমতিয়ার শামীম



তিনি জাতিসংঘের স্টাফ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত একটি বৈঠক থেকে প্যারিসে ফিরে আসার পর ১৯৭১-এর ১০ অক্টোবর গভীর রাতে হঠাত্ করেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। স্বাধীনতার পর তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু সাহায্য-সহযোগিতা তো পরের ব্যাপার, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেও স্বীকৃতি পাননি তাঁর কন্যা সিমিন ওয়ালীউল্লাহ ও পুত্র ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ।



নিজের লেখালেখি নিয়ে উচ্চবাচ্য না করেও স্বীকৃতি পেতে থাকেন ওয়ালীউল্লাহ। ১৯৫৫ সালে তিনি ‘বহিপীর’ নাটকের জন্য পিইএন পুরস্কার পান, বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬১ সালে আর ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’র জন্য আদমজী পুরস্কার পান ১৯৬৫ সালে। শিশু-কিশোর নাটক ‘সুরঙ্গ’র জন্যও একটি পুরস্কার পান তিনি। কিন্তু এর পরও অতৃপ্তি ছিল তাঁর। তবে তা দূর হয়ে যায় ১৯৭০ সালে প্যারিস থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় এলে। ওই সময় তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়ায় সত্মায়ের বাড়িতে বেড়াতে যান। তখন করটিয়া কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা তাঁকে লেখক হিসেবে সংবর্ধনা দিলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘অনেক দিন দেশের বাইরে থাকলেও আপনারা আমাকে ভোলেননি। এখনো আমার লেখা পড়েন! আপনাদের এত ভালোবাসার পর আমার আর বেশি দিন বিদেশে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।’ এ সময় পাকিস্তান ন্যাশনাল বুক সেন্টারও তাকে সংবর্ধনা দেয়। ওইদিন রাতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘দেশের মানুষ আমাকে মনে রেখেছে। আমার ধারণা ছিল, আমার সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। এখন দেখছি তারা ভালোই জানে। লেখালেখিতে আরো মন দিতে হবে। দেশের মানুষের জন্য বাংলাতেই লিখতে হবে। এখানে পাঠক তৈরি হয়েছে।’

দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ফেরা আর হয়নি। ১০ অক্টোবর রাতে তিনি পড়তে বসেছিলেন, ওই অবস্থাতেই গভীর রাতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান তিনি। প্যারিসেই সমাহিত করা হয় তাঁকে। আমাদের জন্য এটুকুই সান্ত্বনার যে, জীবদ্দশাতেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আবুল হোসেন বা মুনীর চৌধুরীদের কাছে (এই তালিকা নিশ্চয়ই আরো দীর্ঘ এবং এ রকম হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়) তাঁর কথাসাহিত্য তত গ্রহণযোগ্য না হলেও তিনি পাঠকের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছেন। তাঁর মগ্ন পাঠক হিসেবে আমাদের প্রাপ্তি অবশ্য আরো বেশি। কেননা আমরা স্পষ্টই দেখছি, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের তো বটেই, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পুরোধা হিসেবে তার অবস্থান দিন দিন আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। নতুন নতুন বিতর্কও এই উজ্জ্বলতাকে আরো উস্কে দিচ্ছে। যেমন— অর্ধদশক ধরে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, ‘লালসালু’র বয়ানে তাঁর অবস্থান গোঁড়া শরিয়া-অনুসারীদের গোষ্ঠীতে, ‘এই পাঠে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামের এক রক্ষণশীল ব্যাখ্যাদাতায় পরিণত হয়েছেন’। যদিও মিথ্যাচার থেকে কীভাবে রক্ষণশীলতা দানা বাঁধে, আবার মিথ্যাচারিতা কী করে মিথ্যাবাদীর আচরণে উদারতা আনে, তাকে সংশয়ী করে তোলে— এসবই ছিল বোধকরি ‘লালসালু’তে তাঁর অনুসন্ধানের স্থান। আর তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মেই আমরা দেখেছি, শওকত ওসমানের কথা ঋণ করে বলা যায়, প্রকৃতি নিজেই একটি চরিত্রে পরিণত হয়, চরিত্র হিসেবে বিকশিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ