সৈয়দ শামসুল হকের গল্প : নেয়ামতকে নিয়ে গল্প

তার এই খ্যাতির সূচনা কীভাবে কিম্বা কবে থেকে, এখন আর কেউ ভালো করে মনে করতে পারে না। এখন কাঁঠালবাড়ির সকলেই জানে, নেয়ামত যা বলে তা ফলে যায়; শুধু কাঁঠালবাড়ি কেন, নেয়ামতের এই খ্যাতি আমাদের এই এলাকার ভেলাকোপা, হাগুয়ার হাট, বল্লার চর, মান্দারবাড়ি, এ সকলে তো বটেই, যেখানে সিনেমা আছে, কলেজ আছে, কাছারি আছে, হাকিম থাকেন, একাত্তরে যেখানে মিলিটারির ঘাঁটি ছিল, খোদ সেই জলেশ্বরী পর্যন্ত বিস্তৃত।


নেয়ামত একটা কথা বললে তা ঘটে যায়, হয়ে যায়, ফলে যায়। অতএব মানুষজন নেয়ামতের কাছে আসে কখনো আগাম শুনবার জন্য, কখনো বা কোনো বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য, আবার কখনো কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য। নেয়ামত হাসে, নেয়ামত তার হাতের কঞ্চি দিয়ে রাস্তার ধারের আগাছা পিটিয়ে নাশ করে, নেয়ামত শুধু এটুকু বলে এসব কোনো ক্ষমতাই তার নেই। লোকেরা নেয়ামতের পেছন ছাড়ে না, আমাদের কোনো কিছু না হারালেও, কোনো বিপদ থেকে আপাতত উদ্ধার পাবার না হলেও, আমরা নেয়ামতকে দেখলেই কাছের চা দোকান থেকে কিনে চা খাওয়াই; নেয়ামতের ঐ একটিই শখ, চা। দূর দূর থেকে হঠাৎ হঠাৎ একটা লোক আসে আমাদের কাঁঠালবাড়িতে, তার বাড়িতে চুরি হয়েছে, নেয়ামতের কাছে জানতে চায় চোরাই মাল পাওয়া যাবে কি না।

আগাম বলবার নানা রকম বিষয়ের ভেতরে এই চোরাই মালের বিষয়ে ভালো-মন্দ বলাটা নেয়ামতের খ্যাতির পেছনে প্রধানত। অনেকে ধারণা করে, বহু বৎসর আগে এখানে এক বুড়ির গাইগরুটি হারিয়ে যায়। বুড়ি গাইটিকে নিজের মেয়ের মতো দেখত, তাকে হারিয়ে বুড়ি তখন কেঁদে কেঁদে ফিরত, মাঠের ভেতর শস্য, খেতভরা শস্যের ভেতর দিয়ে আলপথ, বুড়ি গাইগরুর শোকে সারা দিন সেইসব আলপথ দিয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরত, বয়সের ভারে সে এখন নত, তাই তাকে লকলকে শস্যের ভেতর দিয়ে চলে যেতে দেখা যেত না, সে ঢাকা পড়ে থাকত, কেবল তার বিলাপ এক ক্ষীণ পতঙ্গের মতো উড়ে উড়ে যেত এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে, কেউ বুঝে পেত না বুড়িকে সান্ত্বনা দেবে কীভাবে; বড় গরিব এই কাঁঠালবাড়ি, সম্ভব হলে কাঁঠালবাড়ির মানুষেরা বুড়িকে একটি নতুন গাই কিনে দিত, সে প্রস্তাব তারা একবার করেও ছিল, কিন্তু বুড়ির চাই সেই গাইটিকেই, মেয়ে হারালে সেই মেয়ে ভিন্ন আর কাকে চায় জননী? বুড়ির এই শোকে, এই আতান্তরে, সারা কাঁঠালবাড়িতে একমাত্র নেয়ামতকেই একদিন কাঁদতে দেখা যায়, সান্ত্বনা দিলেও সে সান্ত্বনা গ্রহণ করে না, তাকে চা দেয়া হয়, কিন্তু যে নেয়ামত দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশ কাপ চাকে চা বলেই গোনে না, সেই নেয়ামত চা ফিরিয়ে দেয়, এবং একসময়ে চোখ তুলে উঁচু গলায় পরিষ্কার ভাষায় উপস্থিত সবাইকে সে জানায়, হ্যাঁ, বুড়ির গাইগরুটিকে সামনের মঙ্গলবার বল্লার চরের পূব দিকের পাথারে দেখা যাবে।

গাইটিকে কথিত পাথারেই দেখা যায়, হয়তো মঙ্গলবারেই, সত্যি কি মিথ্যা আমরা বলতে পারব না, এরকম ঘটনা ঘটে থাকলেও আমাদের তখন বয়স অল্প। তবে নেয়ামতের গল্প উঠলে, তার আদি ঘটনা হিসেবে এই ইতিহাসটি লোকে বলে থাকে।

কিন্তু এ তো আমাদের স্বচক্ষেই দেখা, আমাদের জবাগাছ থেকে ফুল তুলতে আসত যে মেয়েটি, যাকে বাড়ির সবাই দেখলে তাড়া করত কিন্তু আমরা তাকে ফুল তুলতে দিতাম, আমাদের বড় জানতে ইচ্ছে করত মেয়েটি ফুল নিয়ে এই ভোরবেলায় কী করে, ফুল সে কেমন সন্তর্পণে ডাল থেকে তুলে আনত, পেতলের সাজিতে রাখত, এই ভঙ্গিটি দেখে আমাদের বড় বিস্ময় হতো এবং খেদ হতো জবা ফুলের মাস কেন বছরের বারোটা মাসই নয়, সেই মেয়েটি একদিন আর ফুল তুলতে আসে না, আমরা জানতে পাই সে বিছানায় শুয়ে আছে, তার জীবনের আশা আর নেই; আমাদের খুব ইচ্ছে করে সন্ধ্যাকে একবার দেখে আসতে, মেয়েটির নাম ছিল সন্ধ্যা, কিন্তু সাহস হয় না, সন্ধ্যাদের বাড়ির বাইরে আমরা ঘুরঘুর করি, কী পরিচ্ছন্ন ওদের উঠোন, ঝকঝক তকতক করছে, নিকোনোর টানে কাদার রামধনুগুলো থেকে জ্যোতি আর স্নিগ্ধতা ফুটে বেরোচ্ছে, কিন্তু আবার সবই কেমন নিস্তব্ধ, একটি ভীরু পাখির স্বর ভিন্ন শব্দ নেই, সন্ধ্যার আজই শেষ দিন, গলার কাছে বাষ্পের দলা উঠে আসে আমাদের, পেছন থেকে হঠাৎ নেয়ামত আমাদের আশ্বাস দেয়, যেন-বা সে মাটি ফুঁড়েই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে বলে—সন্ধ্যার কোনো ভয় নেই, সে ভালো হয়ে যাবে।

সন্ধ্যা পরদিনই ভালো হয়ে যায়, কবিরাজ পর্যন্ত অবাক হয়ে যায় এবং ‘সবচেয়ে বড় বৈদ্য তিনি আছে ওপরে’ বলে কবিরাজ গনগনে ঝনঝনে দুপুরের আকাশটার দিকে খাড়া তর্জনী তুলে দেখায়; আমরা আবার সন্ধাকে দেখি—তার মুখের সেই ম্লান কিন্তু সুন্দর হাসিটি এখনো আমরা হৃদয়ে ধরি, সন্ধ্যাকে কতকাল আর দেখি না, সীমান্তের ওপারে দীনহাটায় বিয়ে হলে চলে যায় সে আমাদের কৈশোর থেকে আলো নিভিয়ে দিয়ে, কিন্তু নেয়ামতের কথা যে ফলে গিয়েছিল সন্ধ্যার অসুখের সময়ে এর সাক্ষী তো আমরা নিজেরাই। এই ঘটনা আমাদের মনে আছে বিশেষভাবে; অসুখ থেকে সেরে ওঠার পরই সন্ধ্যাকে দেখতে এসেছিল দীনহাটার লোকেরা। সন্ধ্যাকে তারা পছন্দ করে যায়, আশীর্বাদ করে যায়, আমরা নেয়ামতকে অনেক সাহস করে গিয়ে ধরি, এতটা ইতস্তত করবার হয়তো দরকার ছিল না, নেয়ামত বয়সে আমাদের বহু বড় হলেও ব্যবহারে আমাদের সমবয়সী ছিল, সে আমাদের হতাশ করে দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, এ বিয়ে হবেই; সত্যি সত্যি নেয়ামতের কথা ফলে যায়, সন্ধ্যা দীনহাটা চলে যায়।

কিন্তু এই স্তরেই নেয়ামতের কথা ফলে গিয়েছে কেবল, তা নয়। আমাদের আরও মনে পড়ে, মোতাহার যেদিন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যাবার আগে সন্ধ্যায় জিগ্যেস করল, কি নেয়ামত ভাই, পাস করব তো? নেয়ামত সে প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ না কোনোটাই বলেনি, সে এক সম্পর্কবিহীন সূত্রবিহীন দৃশ্য বর্ণনা করেছিল; নেয়ামত বলেছিল, মোতাহার, তোকে আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি একটা দালান দেখতে পাচ্ছি, লাল ইটের দালান, সামনে বাগান, সেই বাগানে কত ফুল, বড় বড় ফুল, মোতাহার, তুই ফুলের ঝারি হাতে নিয়ে ফুল বাগানে ফুলের গাছে পানি দিচ্ছিস, আমি দেখতে পাচ্ছি। আমরা তো শুনে হাঁ, কোথায় মোতাহার যাচ্ছে জলেশ্বরীতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আর কোথা তাকে দেখা যাচ্ছে কার ফুলের গাছে পানি দিতে। আমরা হা হা করে হেসে উঠি, আমরা ধরেই নিই যে মোতাহার পরীক্ষায় ফেল করবে, কথাটা নেয়ামত বলতে চায়নি, তাই যাহোক তাহোক পাগলামো একটা কথা বলে কাটান দিতে চাইছে।

আমরা তো এই ঘটনারই প্রত্যক্ষ সাক্ষী, কয়েক বৎসর পরে, মোতাহার জেল থেকে ছাড়া পেল, পৃথিবীর নৃশংসতম রাজনৈতিক হত্যার ঘটনার শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন, যখন তার প্রতিবাদ করতে কেউ আঙুল তোলেনি, পথে নামেনি, কথা বলেনি, তখন আমাদের মোতাহার জলেশ্বরীতে, সে তখন ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে পড়ছে, বিস্ময়কর এক কাণ্ড করে বসে, সে জলেশ্বরী থেকে কিছু তরুণকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয় মুজিব হত্যার প্রতিবাদ ও অবৈধ সরকারকে প্রতিরোধ করবার ডাক দিয়ে; মোতাহারের কল্পনা ছিল, পথে প্রতিটি জনপদ থেকে তরুণেরা তার এই মিছিলে শামিল হবে এবং শেষ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ তরুণের মিছিল নিয়ে তারা ঢাকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে; সেই মোতাহার গ্রেফতার হয় জলেশ্বরী থেকে নবগ্রাম, মাত্র পাঁচ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবার মাথাতেই, বহুদিন বিনা বিচারে সে বন্দি থাকে, তারপর তার কারাদণ্ড হয় সামরিক আইনের ধারায় সাত বৎসরের জন্য, জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার তাকে কারাদণ্ড দিলেও, সেই জিয়াউর রহমানই সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক রাজবন্দির সঙ্গে মোতাহারকেও ছেড়ে দেন, এ-জাতীয় কারাবাস আর এরকম মুক্তির সঙ্গে আমরা এখন খুবই পরিচিত, আমরা মোতাহারকে মিছিল করে কাঁঠালবাড়ি নিয়ে আসি। কাঁঠালবাড়ির চৌরাস্তায় বিমলের সাইকেলের দোকানে বসে মোতাহার গল্প করছিল, তাকে ঘিরে অনেক ছেলে-ছোকরা, সামনের দোকান থেকে চা আসছে পেয়ালা পেয়ালা। এমন সময় নেয়ামত ভিড় ঠেলে ‘কই, চা খাওয়াও বাবা মোতাহার’ বলতে বলতে এসে হাজির, মোতাহার তাকে নিজের পেয়ালাটাই বাড়িয়ে দেয় ‘আমি এখনো মুখ দিই নাই’ বলে, বলেই, বিস্ময়ে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নেয়ামতের দিকে, তারপর চারদিকে তাকায়, আমি ছিলাম পাশে, আমার কাঁধ খামচে ধরে একবার নাড়া দেয় মোতাহার, তারপর বলে, নেয়ামত ভাই, তুমি সেদিন কী বলেছিলে? তুমি বলেছিলে লাল দালান, ফুলের বাগান, ফুলের ঝারিতে পানি দিই আমি ফুল গাছে, আমি তো জেলখানায় সুপারের বাগানে ফুল গাছেই পানি দিতাম, নেয়ামত ভাই, তুমি আগে থেকে জানলে কী করে? তারপর নেয়ামতের চোখের দিকে চোখ রেখে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মোতাহার বলে, তুমি যদি এতই জানতে, জানতে না বঙ্গবন্ধু খুন হবেন? তবে তুমি সেই কথাটা কেন আগে বলো নাই? কেন তুমি দেশবাসীকে বলো নাই? তবে আমরা জানতাম, আমরা সাবধান হতাম। তুমি তবে জানতেই না, নেয়ামত ভাই।

আমরা তো এখন জানি ঘটনাটা অনেকেই জানেন, জানতেন শেখ মুজিবুর রহমানও স্বয়ং, তাঁকে জানানো হয়েছিল বহুবার, কিন্তু তিনি সাবধান হননি, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে তাঁকে কেউ হত্যা করতে পারে এই বাংলাদেশে; অথবা তিনি জেনেও আর ঠেকাতে পারছিলেন না পতনের প্রচণ্ড গতিঝোঁক, আমরা তো এখন দেখতেই পাচ্ছি, শেখ মুজিবের পরিণতির কথা জানবার জন্য কোনো নেয়ামতের দরকার ছিল না যে তার কাছে আমরা আগাম জেনে নিতে পারতাম, এই পরিণতির কথা লেখা ছিল আমাদের চারদিকেই, আমরা পড়তে পারিনি সেই অক্ষরগুলো, জাতি হিসেবে সত্যি সত্যি সেদিন ছিল আমাদের শৈশব, আমরা বুঝতে পারিনি ইতিহাসের ভাষা।

তবে, বিমলের সাইকেলের দোকানে সেদিন বিকেলে সেই সমাবেশে যারা উপস্থিত ছিল, তাদের ভেতরে আমাদের চেয়ে বয়সে যারা কিছু বড়, একাত্তরে আমাদের মতো বালক যারা ছিল না, তারা মনে মনে অবশ্যই মোতাহারের ঐ উক্তির প্রতিবাদ অনুভব করতে পেরেছিল। নেয়ামত নিশ্চয়ই জানত। তার কাছে অজানা কিছু নেই। আমাদের জ্যেষ্ঠ যারা তাদের এমন স্মরণ না হয়ে পারেনি যে, কাঁঠালবাড়ির সকলেই যখন নিশ্চিন্ত ছিল পাকিস্তানের মিলিটারি আসবে না, তখন নেয়ামতই একমাত্র বলেছে মিলিটারি আসছে। আবার যখন মিলিটারি এসে গোটা কাঁঠালবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়, যখন যুবতীরা এখানে ধর্ষিতা এবং যুবকেরা নিহত হয় তখন এই নেয়ামতই রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে পাগাড়ে লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোকে গিয়ে বলত, নাই, আর বেশিদিন নাই। মানুষগুলো জানে, নেয়ামতের কথা ফলে যায়, নেয়ামত যা বলে তা ফলে, মানুষগুলো অতএব পেশির ভেতরে শক্তি অনুভব করে, তারা বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করে, বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করা গেরিলাযুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় অপেক্ষা হতে পারে না, অতএব কাঁঠালবাড়ির মানুষগুলোকে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের দলে যোগ দিতে। আমাদের জেষ্ঠরা এই ইতিহাস জানে বলেই তারা এখন বলে ওঠে, নেয়ামতের অজানা কিছু নেই, আসলে নেয়ামতকে কেউ জিগ্যেস করেনি বলেই বঙ্গবন্ধুর কথা সে কাউকে বলেনি।

কথাটা আমরা স্বীকার করি, কারণ আমরা দেখেছি, নেয়ামতকে কেউ প্রশ্ন না করলে সে নিজে থেকে কখনোই কিছু বলে না। একাত্তরেও লোকে যখন জানতে চাইত, মিলিটারি আসবে? কেবল তখনই সে বলত, আর যখন লোকে প্রশ্ন করত, ও নেয়ামত, এই খাড়ে দরজালরা আর কত দিন? তখনই সে কেবল অভয় দিত, নাই, আর বেশিদিন নাই।

বিমল আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে, কথাটা অবশ্য সব সময় সত্যি নয়। নেয়ামত বিনা জিজ্ঞাসাতেও দু-একটা কথা বলেছে যা ফলে গেছে, বিমল এখন আমাকে ঘটনা আঙুল তুলে দেখায়।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে কি মানুষের এই এক বিষাদ যে, যে প্রেম বিয়ে পর্যন্ত যায় সে প্রেমের কথা মানুষ ভুলে যায়? কুলসুমের জন্য আমার প্রাণ তখন নিশিদিন নদীর মতো ধাবিত ছিল, কিন্তু চোখে কোনো আশা দেখতাম না, কাঁঠালবাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরের মেয়ে কুলসম, ইরানের বুলবুলের মতো রূপসী কুলসুম, তাপসী রাবেয়ার মতো বিনম্র কুলসুম, সেই কুলসুমকে আমি পাব? শহরে থেকে লেখাপড়া করি, বইয়ে আমার মন বসে না, কাঁঠালবাড়ি ছুটে আসি, আমি কাঁঠালবাড়ি এসে তিষ্ঠোতে পারি না, কারণ কুলসুম আমাকে দেখেও না, এই অবহেলার ভেতরে থাকতে পারি না আমি, আবার শহরে ফিরে যাই। যাবার আগে বিমলের বাড়িতে ওদের মজা পুকুরের পাশে ফাটল ধরা শানে বসে বিমলের গলা জড়িয়ে ধরে আমি কাঁদি, প্রতিজ্ঞা করি আর কখনো ফিরে আসব না; কিন্তু পূর্ণিমা আবার ফিরে আসে, মজা পুকুরের পানি আবার রূপালি হয়ে যায়, এমন শান বাঁধানো ঘাট শত ফাটল নিয়েও ঝকঝক করে, বিমল বসে বসে সিগারেট টানে, আমি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আকাশের নক্ষত্র আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে গান করতে থাকি, আশা এই-যদি বা সে গান দূরে ঐ বাঁশবনের ওপারে কুলসুমের দরোজা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছোয়।

নেয়ামতের ভবিষ্যদ্বাণী করবার খ্যাতি যদিও রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত, আমার মাথাতেই আসেনি যে আমি নেয়ামতকে জিগ্যেস করে দেখি কুলসুমের সঙ্গে আমার কিছু হবে কি না। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি নেয়ামতকে, কাঁঠালবাড়ির বুড়ো বটগাছ, হাঁটু পর্যন্ত ধুলোভর্তি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক, শিবমন্দির, গোরস্থান, প্রাইমারি ইস্কুলের চিরকালের পড়ো-পড়ো ঘরখানা, মাঠের মধ্যে পুরনো কোন শতাব্দীর কোনো একটা দালানের ভাঙা কোণ যে বেরিয়ে আছে সেই কবে থেকে, এ সবের মতোই নেয়ামতও যেন কাঁঠালবাড়ির রূপ রচনা করে আছে, বিশেষভাবে তার সম্পর্কে সচেতন হবার আমার কোনো কারণ নেই। সেই নেয়ামত একদিন আমাকে শিবমন্দিরের কাছে পাকড়াও করে। এই তুই নাকি ঢাকা থাকিস? হ্যাঁ, থাকি। নেয়ামত নির্মল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বলে, তাই তোকে দেখি না, তাইতো বলি জাহাঙ্গীর আমাকে চা খাওয়াত, সেই জাহাঙ্গীর গেল কোথায়?

শিবমন্দিরের কাছে কোনো চায়ের দোকান নেই, আশপাশে যত দূর তাকাও সরকারের তুলোর বাগান, এই বাগানের তত্ত্বাবধানে আছে আমার এক চাচাতো ভাই, নেয়ামতকে নিয়ে তারই কাছে গেলাম। ভাই, চা খাব, চা? হতাশ হয়ে চারদিকে তাকাল আমার চাচাতো ভাই। চা? সে অবশেষে উঠে দাঁড়াল, খুঁজে পেতে ভাঙা একটি কেতলি বের করল। চা? সে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে বেরিয়ে গেল। নেয়ামত আর আমি বসে আছি বাগানের এক পাশে অফিসঘরে, ধারে-কাছে জনমানুষ নেই, তুলোর গাছে হাওয়া পড়ছে, সরসর খুটখুট শব্দ উঠছে, বাতাসে তুলোর সূক্ষ্ম আঁশ উড়ছে, সামনের রাস্তা দিয়ে একটি ভিখিরি করুণ স্বরে ভিক্ষা চাইতে চাইতে টিনের গামলায় খুচরো পয়সাগুলো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলেছে, আর গরম পড়েছে তেমনি, কিন্তু এসবের কোনো কিছুই আমাকে এতটুকু বিচলিত বা বিরক্ত করতে পারছে না, কারণ আমার মনের ভেতরে কুলসুম আছে, তাই একটি বসন্তকাল আছে, শীতল বাতাস বইছে, মেঘ ছায়া দিয়েছে, কোথাও গান হচ্ছে, আমার কোনো তৃষ্ণা নেই। আমি আপনার ভেতরে যখন আপনি রয়েছি এভাবে, এই তুলোর বাগানে, বিশ্রী এই গরমের দিনে, নেয়ামত হঠাৎ উচ্চারণ করল, তুই পাবি। আমি প্রথমে বুঝতে পারি না, সে আবার বলে, তুই পাবি। আমার মনে আশার চাঁদ লাফিয়ে ওঠে, নেয়ামত বলে, তুই কুলসুমকে পাবি। অচিরে বিমলকে খুঁজে বের করে এ কথা জানাই। বিমল প্রথমে এই ভবিষ্যদ্বাণীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ঈষৎ সন্দেহ প্রকাশ করে, পরে যখন শোনে যে আমি প্রশ্ন করার আগে নেয়ামত এই বাক্য উচ্চারণ করেছে তখন এর সত্যতা সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ থাকে না, আমারও আর থাকে না।

অনেক দিনের কথা এ, অনেকগুলো বৎসর পার হয়ে এসেছি, এখন আমাদের বৎসরগুলো একেকটি বৎসরের ভেতরে বহু বৎসর ধারণ করে অতিক্রান্ত হয়ে যায়; বিমল আমাকে মনে করিয়ে না দিলে আমার হয়তো মনেই পড়ত না যে আমারও জীবনে প্রেম একদা এসেছিল।

বিমলের সঙ্গেও বহুদিন পরে আমার দেখা, বহুদিন পরে আমি কাঁঠালবাড়ি এসেছি। কুলসুম সন্তানসম্ভবা, আমি আর কুলসুম রোজই এখন একটা তর্কের ভেতরে পড়ে যাই, আমাদের ছেলে হবে না মেয়ে হবে? সেই তর্কের সূত্র ধরেই আমার কাঁঠালবাড়ি আসা, কুলসুমই হঠাৎ একদিন বলে, নেয়ামতকে জিজ্ঞেস করা গেলে সে বলতে পারত ছেলে না মেয়ে হবে। যে সন্তান গর্ভে আছে সে পুত্র অথবা কন্যা, এটা দু’দিন আগে জানলে সন্তানের কোনো অর্থেই কোনো দিক থেকে লাভবান হবার কথা নয়, তবু মানুষ যত দিন থেকে সন্তান আকাঙ্ক্ষা করতে জেনেছে, যতদিন থেকে যে একটি নারীকে নির্বাচন করতে শিখেছে ততদিন থেকে সে গর্ভের সন্তানের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়েছে- এরকম একটা ধারণা আমার ছিল, কিন্তু আমার সেই ধারণাকে একেবারে তুলোধুনো করে দেয় আর কেউ নয়, কুলসুমের ভাই মোতাহার। কুলসুমের সাধভক্ষণ ছিল, মোতাহারকে ডেকেছিলাম; খাওয়াদাওয়ার পর কোলের কাছে বালিশ টেনে সে আমার আর কুলসুমের তর্ক খানিক শোনে, তারপর চিত হয়ে শুয়ে বলে, দ্যাখ, এই যে ছেলে না মেয়ে এটা কেন জানতে চাস? আসলে সম্পত্তি, তোর সম্পত্তির উত্তরাধিকার কে হতে যাচ্ছে তুই সেটা জানতে চাস, ছেলে হলে নিজের ঘরেই থাকছে সম্পত্তি, মেয়ে হলে চলে যাচ্ছে পরের ঘরে। কুলসুম একথা শুনে ঠোঁট ফুলিয়ে ভাইকে বলে, রাজনীতি করে তো নিজের জীবন নষ্ট করলে, তোমাদের পার্টি কোনোদিনও ক্ষমতায় আসবে না, তা যাক, সে তুমি বোঝ, কিন্তু রাজনীতি এনে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের জীবনে ঢোকাবে না। মোতাহার তখন ঠোঁট উল্টে বলে, আগুনে যখন জ্বলবে গা তখন ঝলসে যাবে।

কুলসুম খুব রাগ করেছিল মোতাহারের ওপর; কুলসুমকে খুশি করবার জন্যই কাঁঠালবাড়ি আমি ছিলাম, নেয়ামতের খোঁজ করি, আমার হঠাৎ ভীষণ কান্না পায়, বিমল আমাকে জানায়, নেয়ামত মারা গেছে। বিমল আমাকে বলে, নেয়ামত নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, আমি মারা যাব।

আমি মারা যাব—কথাটি যতই রক্ত ঠাণ্ডা করে দেবার মতো শোনাক না কেন, আমার মনে না হয়ে পারে না যে, এটি একটি সাধারণ বাক্য, সরল বাক্য এবং সত্য বাক্য। এই বাক্য উচ্চারণ করায় আদৌ প্রমাণিত হচ্ছে না যে নেয়ামত একজন ভবিষ্যৎ বক্তা।

তখন বিমল আমাকে বলে, হ্যাঁ, সে কথা সত্য, তবে ক্ষেত্রবিশেষে। আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাই তার এই কথার। তখন খুব সংক্ষেপে এবং নিচু গলায় সে আমাকে বলে নেয় যে, এমন এক কাল যখন কে যে কোথায় শুনে ফেলবে এবং কী বিপদ পরিণামে উঠে আসবে কেউ বলতে পারে না। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করে অচিরে বিমল আমার চোখে চোখ রাখে, মুহূর্তের জন্য, তারপর রাস্তার দিকে চোখ ফিরিয়ে সে বলে, তুমি তো মান্নানদের চেন না, একাত্তরে ছোট ছিল বলে রাজাকার হয়নি, এবার আবার একাত্তর হলে মান্নানরাই হবে রাজাকার, সেই মান্নানদের সঙ্গে কথায় কথায় নেয়ামত বলেছিল—কী বলেছিল এ নিয়ে একেকজন একেকরকম কথা বলে, তবে এটা ঠিক নেয়ামত পরোয়া করে কথা বলেনি, তখন মান্নানরা বলেছিল, নেয়ামত, তুমি তো এত জানো ভবিষ্যৎ, তবে বলো, তোমার ভবিষ্যৎ কী? নেয়ামত নাকি উত্তর দিয়েছিল, আমার ভবিষ্যৎ? আমি মারা যাব।

এই সময়ে বিমলের দোকানে গ্রাহক উপস্থিত হয়, বিমলের কথায় ছেদ পড়ে; দূরের এক মানুষ, সর্বাঙ্গে ধুলো, তার সাইকেলের চাকা বসে গেছে, বিমল টায়ারের লিক সারাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি যেন শুনতে পাই আমার কানে অবিরাম ধ্বনিতে হচ্ছে নেয়ামতের কণ্ঠে আমি মারা যাব। আমি অনুভব করে উঠি যে, ক্ষেত্রবিশেষে সরল বাক্যও কত জটিল হয়ে পড়তে পারে।

গ্রাহক বিদায় নিলে বিমল আবার আমার পাশে এসে বসে এবং খুব নিচু স্বরে জানায়, এর কয়েকদিন পর নেয়ামতের লাশ পাওয়া যায় সরকারি তুলোর বাগানের ভেতরে। সে লাশ আবিষ্কার করে আমারই চাচাতো ভাই; গত কয়েকদিন থেকে কাঁঠালবাড়িতে সকলেই আলোচনা করছিল যে নেয়ামত বলেছে, আমি মারা যাব কথাটা। আমার চাচাতো ভাইও শুনেছিল, অতএব নেয়ামতের লাশ দেখেই তার মনে পড়েছিল কথাটা, কাঁঠালবাড়ির সকলেরই মুখে তারপর কয়েকদিন ধরে শুধু শোনা গিয়েছিল, নেয়ামত ছিল এমন বাকসিদ্ধ যে নিজের মৃত্যুর কথাও নিজে বলে যায় নিজ মুখে।

বিমলের দোকান থেকে বেরিয়ে সারা কাঁঠালবাড়ি হেঁটে, সরকারি তুলোর বাগানে আর কিছু পড়ে নেই জেনেও সেখান আঁতিপাঁতি করে কি খুঁজে আবার আমি ফিরে যাই বিমলের কাছে। সন্ধ্যা, সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করে বিমল এখন বাড়িতে, আমরা দুই বন্ধু মজা পুকুর পাড়ে গিয়ে বসি, আমরা সেই ফাটল ধরা শানের ওপর বসি, বিমলের বউ চা দিতে এসে বলে যায়, সেদিন এই ফাটলে কে নাকি সাপ দেখেছে, যেন আমরা এখানে বেশিক্ষণ না বসি। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত এখানেই বসে থাকি, আমাদের গল্প নেয়ামতকে নিয়ে নয়, নেয়ামতকে নিয়ে গল্প করতে করতে আমরা আবিষ্কার করি যে, আমরা প্রত্যেকেই হয়তো কিছু না কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি; বিমল আর আমি, আর এই যে ফাটল ধরা পুকুরপাড়, এই অন্ধকার, এই সাপের ভয়, আমরা সমস্ত কিছু নিয়ে এবং জড়িয়ে বসে থাকি, আমরা কখন যেন আমাদেরই জীবনের গল্প করতে শুরু করি, এবং চমকিত হয়ে আবিষ্কার করি, যে মান্নানরা এখন এই পুকুরপাড়ে উপস্থিত নেই, তবু আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে ভয় পাচ্ছি। এমনকি কুলসুমের গর্ভের সন্তানকে নিয়ে কোনো উচ্চারণ আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ