রমাপদ চৌধুরী-গল্প লেখার গল্প

গল্প আমি আদৌ লিখেছি কিনা আমার নিজের সন্দেহ আছে পুরোপারি। যা লিখেছি সেগুলোকে অনেকেই হয়তো গল্প হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন, আর তাই-কবে, কেন, কোথায়, কি ভাবে আমি প্রথমে গল্প লিখতে সুৱু করি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

জীবনের কোন একটা বিশেষ মুহুর্ত থেকেই কি কেউ গল্প লিখতে সুরু করে ? লেখার সুরু, কি কাগজে কালির আঁচড় টানার দিন থেকে ? তা তো নয়। লেখা-লেখা খেলার হাতেখড়ির অনেক আগেই কেউ হয়তো মনের কাগজে শব্দ সাজাতে সুরু করে, কেউ বা গল্প লেখার হাতেখড়িই চালিয়ে যায় বছরের পর বছর, সত্যিকার একটা কোন গল্প লেখার আগে ।

ছোটবেলােয গল্প শুনতে শুনতে প্রথম যেদিন বক্তা চুপ ক’রে যাওয়ায় আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তারপর?-সেদিনই মনের পাতায় প্রথম গল্প উঁকি দিয়েছিল। অর্থাৎ গল্প যে এখানে থামতে পারে না, এর পরেও কিছু আসবে, এই কল্পনাই গল্পের প্রথম প্রাণস্পন্দন। বক্তা যেদিন ভুল ক'বে বলেছিলেন, “তারপর রাজকুমার বাঘটাকে গিলে ফেললো” সেদিন বললাম, যাঃ, তাই কখনো হয় ? অর্থাৎ অবিশ্বাস্য, অবাস্তব। বক্তা ভুল শুধরে বললেন, মানে, বাঘটা রাজকুমারকে গিলে ফেললো। মন তবে সায় দিলে না। বক্তা বলতে বাধ্য হলেন শেষে, না, না, বাঘটা যেই রাজপুত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, আমনি একটা অজগর এসে বাঘটকে গিলে ফেললে। আর আমার মন সে গল্প বিশ্বাস করলে, শিল্পজগতের বিশ্বাস্য আর অবিশ্বাস্যের পার্থক্য বুঝতে পেরে গল্প লেখার ভিৎ তৈরী হলো মনে।

কাগজে কলমে ধরে না রাখলেও কোন একটা ঘটনাকে কেন্দ্ৰ ক’রে বা কোন অসমাপ্ত গল্পের পর চারপাশে যেদিন থেকে পূর্নাঙ্গ কোন কাহিনী বুনেছি, কারো আত্মহত্যার খবর পেয়ে যেদিন ভেবেছি, এমনও তো হতে পারে, কিংবা কোন কুড়িয়ে পাওয়া পয়সার পিছনে কল্পনা করেছি কোন হতভাগ্যের দারিদ্র্য বা খেয়ালী ননীগোপালের নবাবীপনা, সেদিন থেকেই গল্প লেখায় সুরু।

আমার যখন বারো-চোন্দ বছর বয়েস তখন আমার এক বন্ধুর মা'র কাছে আমি ছিলাম অত্যন্ত প্রিয়। তেমন হাসি হাসি সুন্দর মুখ, তেমন স্নেহ প্ৰীতি পবিত্রতায় উজ্বল চোখ আমি খুব কম দেখেছি। সেই বয়সেই হঠাৎ একদিন শুনলাম, তিনি সারা অঙ্গে পেট্রোল ঢেলে. আত্মহত্যা করেছেন। এমন আনন্দমুখর মুখে কি এমন ব্যথা লুকিয়েছিল ভাবতে ভাবতে একটি গল্প বুনে ফেলেছিলাম মনে মনে। আর বঙ্কিমচন্দ্র, প্রভাত মুখুজ্যে, চারু বন্দ্যো-পড়া সেই অকালপক্ক বয়সে একটি দুদিস্তে কাগজের খাতা শেষ করেছিলাম উপন্যাস লিখে।

নামটা আজো মনে আছে, ‘চোরাবালি”। আরেকটা কথা মনে আছে, উপন্যাসটা পড়ে শুনিয়েছিলাম আমার এক মামীমাকে। তিনি হাপুস নয়নে কেঁদেই সারা। তারপর কি ভাবে যেন বাড়ীর সকলের কানে পৌছলো, “কবি” “লেখক’ ইত্যাদি বলে ঠাট্টা সুরু করলো বন্ধুরাও, আর আমি উপন্যাসটা পুড়িয়ে ফেলে অপরাধের প্রাযশ্চিত্ত করলাম।

কবিতা গল্প উপন্যাস কোন কিছু যে আমি আবার কোনদিন লিখবো, ষোল বছর বয়সের আগে কোনদিন আর ভাবিনি।

বাবার চাকরীর দৌলতে রাঁচি-হাজারিবাগ, রায়পুর-বিলাসপুর, ওয়ালটেয়ার-বিশাখাপত্তন, গোয়া-গোলকুন্ডা, অম্বর-উদয়পুর ইত্যাদি বহু জায়গার সঙ্গে অন্তরংগ পরিচয় ঘটেছিল আমার। ১৯৩৯ সালে কোলকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম যে বন্ধুটিকে পেলাম তার বই-পড়া ভুল ভাঙতে গিয়ে জানিয়ে ফেললাম আমার অভিজ্ঞতার কথা।

সে বললে, লিখিস না কেন, অতো যখন জানিস ?

বললাম, কি লিখবো ?

কেন, গল্প ?

হেসে বললাম, জানলেই কি লিখতে হয়, না লেখক মাত্রেই জানে। যে লিখতে জানে, তার অনেক কিছু না জানলেও চলে। শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষী যে কম্পাপার্টমেণ্ট রিজার্ভ আছে বলে, যাকে খুশী গাড়ীতে তুলে নিয়েছে রেল কতৃপক্ষ কি তা বলে গল্প আটকাতে পেরেছে ?

বন্ধুটি হেসে বললে, না, না, লেখ তুই। তোর হবে।

আমি তখন ইডেন হিন্দু হোষ্টেলে থাকি আর কলেজ করতে যাই ওয়াই-এম-সি-এর নীচের পাবলিক রেস্তঁরায়। কিন্তু যেখানেই বসে একটা আভা জমাবার চেষ্টা করি, অমনি বন্ধুটি হেসে হাজির।

—কি রে গল্প লিখেছিস ?

মাসিক বসুমতীর বর্তমান সম্পাদক প্ৰাণতোষ ঘটকই এই বন্ধু। আর বলা বাহুল্য যে, প্ৰাণতোষ নিজে লিখতো তখন এবং সম্পাদকের কাছে লেখা দিয়ে আসার জন্যে একটি সঙ্গী খুঁজছিল। ওর কাছেই শুনলাম, ওর আরেক বন্ধু ইতিমধ্যেই চার-পাঁচটা উপন্যাস লিখে ট্রাঙ্ক বোঝাই করে রেখেছে-একসঙ্গে ছাড়বে।

--নাম কি তার? জিগ্যেস করলাম।

-স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়, আসল নাম গোকুল, লেখে কিন্তু ডাকনামে।

প্রাণতোষের কাছে স্বরাজের নাম প্রায়ই শুনতাম, আর ইতিমধ্যেই ওর সন্মধ্যে প্রবল ঔৎসুক্য জেগেছিল আমার। কিন্তু স্বরাজ পড়তো বিদ্যাসাগরে, তাই দেখা হত না।

হঠাৎ প্রাণতোষ বললে, কালই একটা গল্প চাই তোর, স্বরাজ তোকে লিখতে বলেছে।

এই অদেখা অচেনা লোকটি নির্ঘাৎ ভবিষ্যতের একজন জিনিয়াস বলে ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমার। অতএব সে যখন বলেছে সেদিনই ক্লাশ পালিয়ে ওয়াই-এম-সি-এর পাবলিক রেস্তঁরায় বসে চার পাতার একটা ছোট গল্প লিখে ফেললাম। সামনে বসেছিল আমার অন্য এক অসাহিত্যিক বন্ধু-নাম জ্যোতিপ্ৰসাদ সেন। সে পড়ে বললে, চমৎকার। কিন্তু গল্পের নাম কি দেয়া যায় ? বিশাখাপত্তনে থাকার সময় এক-তামিলতনয়াকে ভাল লেগেছিল, তাকে কেন্দ্র করেই গল্প। গল্পের খাতিরে শেষটা ট্র্যাজিক, আয়রনি অফ ফেট বলা চলে।

পরের ঘণ্টায় প্রাণতোষ এসে বললে, ঠিক আছে। নাম স্বরাজ দিয়ে দিবে আর পরের সপ্তাহেই “আজি-কাল” সাপ্তাহিকের একটি সংখ্যা এনে দেখালো প্রাণতোষ। গল্পের নাম-ট্র্যাজেডি, লেখকের নাম রমাপদ চৌধরী।

সেদিন থেকেই আমার গল্প লেখা সুরু। কারণ, পৃথিবীতে অনেক আশ্চর্য ঘটনাই তো ঘটে। তেমনি এক হদয়বিদারক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। ‘ট্র্যাজেডি" গল্প এক বছরের মধ্যেই আমার জীবনে সত্য হয়ে দেখা দিলো। না, কোন তামিলতনয়া নয়, একটি বাঙালী মেয়েকেই কেন্দ্র করে। আর সেই বেদনা মুছে ফেলবার জন্যে আবার লিখতে হলো আরো অনেক গল্প। তারপর ‘পিগম্যালিয়নের" মতই, যাকে কেন্দ্র করে গল্প লেখা তাকেই ভুলে গেলাম, ভালবেসে ফেললাম লেখাকে।

শুধু প্রেমেরই নয়। ‘ট্র্যাজেডি" লেখার দিন থেকেই সাহিত্যের পথে, ট্র্যাজেডির পথে যাত্রা সুরু করেছি। এক এক সময় সেই পুরোনো গল্পটা পড়বার ইচ্ছে হয়। বড়ো। ভাবি, যদি হারিয়ে না ফেলতাম সেটা! সে গল্পের কপি কি আপনাদের কারো কাছে নেই ?

আজ মনে পড়ে, কত উদ্ভট তর্ক বিতর্ক করেছি সেদিন, কতবার "লেখা” ফিরে এলেই প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট উড়িয়ে রাত জেগে কত নতুনতর অপাঠ্য গল্পই না লিখেছি, দুরু, দুরু, বক্ষে কখনো বা আনন্দবাজারের মন্মথবাবুর হাতে, কখনো বা যুগান্তরে বিনয় ঘোষের হাতে দিয়ে এসেছি, ডাকে পাঠিয়েছি পূর্বাশা আর চতুরঙ্গে। কখনো ছাপা হয়েছে, কখনো হয় নি, আর যখনই কোন গল্প ছাপা হয়েছে। আনন্দে নিজেকে মনে হয়েছে আদ্বিতীয় এক দিগ্বিজয়ী।

এই আমার গল্প লেখাব গল্প। কিন্তু এ গল্প আমার চেয়েও ভালো করে বলতে পারতো আরেকজন। যে নিজে কোনদিন কলম হাতে করে নি, কিন্তু পাবলিক রেস্তারার দিন থেকে আজ অবধি আমার প্রত্যেকটি গল্প পড়ে এসেছে, সমালোচনা করেছে, লেখা শুধরে দিয়েছে, উপদেশ দিয়েছে, গল্প ফিরে এলে আমার মতই আহত হয়েছে, আর ছাপা হলে আমার চেয়েও বেশি আনন্দিত হয়েছে। তার নাম, আপনাদের কাছে হয়তো জানবার মতও নয়। কিন্তু আমার কাছে সে নাম ভোলবার নয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ