
ষ্টেশন ছিল না, ট্রেন থামত না, তবু রেলের লোকদের মুখে মুখে একটা নতুন নাম চালু হয়ে গিয়েছিল । তা থেকে আমরাও বলতাম “আণ্ডাহল্ট" ।
আণ্ডা মানে ডিম। আণ্ডাহল্টের কাছ ঘেঁষে দুটাে বেঁটেখাটাে পাহাড়ী টিলার পায়ের নিচে একটা মাহাতোদের গ্রাম ছিল, গ্রামে-ঘরে মুগী চরে বেড়াত। দূরে, অনেক দূরে ভুরকুণ্ডার শনিচারী হাট-হাটে সেই মুগী কিংবা মুগীর ডিম বেচতেও যেত মাহাতোরা। কখনো সাধের মোরগ বগলে চেপে মোরগ লড়াই খেলতে যেত। কিন্তু সে জন্য বি এফ থ্রী- থার্টি-টুর নাম আণ্ডাহল্ট হয়ে যায়নি। আসলে মাহাতোগাঁয়ের ডিমের ওপর আমাদের কোন লোভই ছিল না ।
আমাদের ঠিকাদারের সঙ্গে রেলওয়ের ব্যবস্থা ছিল, একটা ঠেলা-ট্রলিও ছিল তার, লাল শালু উড়িয়ে সেটা রেলের ওপর দিয়ে গড়গড়িয়ে এসে মালপত্ৰ নামিয়ে দিয়ে যেত। নামিয়ে দিয়ে যেত রাশি রাশি ডিম । বেহারী কুক ভগোতীলাল আগের রাত্রে সেগুলি সেদ্ধ করে রাখত।
কিন্তু সেজন্যও নাম আণ্ডাহল্ট হয়নি। হয়েছিল ফুলবয়েল্ড ডিমের খোসা কাঁটাতারের ওপারে ক্রমশ ভূপীকৃত হয়ে জমছিল বলে। ডিমের খোসা দিনে দিনে পাহাড় হচ্ছিল বলে।
ফৌজী ভাষার বি এফ থ্রী -থার্টি টুর প্রথমেই যে দুটাে অ্যালফাবেট, আমাদের ধারণা ছিল তা সংকেত নয়, ব্রেকফাস্ট কথাটার সংক্ষিপ্ত রূপ ।
রামগড়ে তখন পি ও ডৱ ক্যাম্প, ইটালিয়ান যুদ্ধবাদীরা সেখানে বেয়নেটে আর কাঁটাতারে ঘেরা। তাদের মাঝে মাঝে একটা ট্রেনে বোঝাই করে এ পথ দিয়ে কোথায় যেন চালান করে দিত। কেন এবং কোথায় আমরা কেউ জানতাম না ।
শুধু আমরা খবর পেতাম ভোরবেলায় একটা ট্রেন এসে থামবে।
ঠিকাদারের চিঠি পড়ে আগের দিন ডিমের ঝুড়িগুলো দেখিয়ে কুক ভগোতীলালকে বলতাম, তিনশো তিশ ব্রেকফাস্ট ।
ভগোতীলাল গুনে গুনে ছশো ষাট আর গোটা পঁচিশ ফাউ বের করে নিত। যদি পচা বের হয় । তারপর সেগুলো জলে ফুটিয়ে শক্ত ইট হয়ে গেলে তিনটে সাভার কুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোসা ছাড়াত ।
কাঁটাতারের ওপারে সেগুলোই দিনে দিনে স্তুপীকৃত হত।
সকাল বেলায় ট্রেন এসে থামত, আর সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে ট্রেনের দুপাশে ঝুপঝাপ নেমে পড়ত মিলিটারি গার্ড। সঙ্গিন উঁচু করা রাইফেল নিয়ে তারা যুদ্ধবন্দীদের পাহারা দিত। ডোরাকাটা পোশাকের বিদেশী বন্দীরা একে একে কামরা থেকে নেমে আসত বড়সড়ো মগ আর এনামেল থালা হাতে।
দুটাে বড়-বড় ড্রাম উল্টে রেখে সে দুটােকেই টেবিল বানিয়ে সাভার কুলি তিনজন দাঁড়াত। আর ওরা লাইন দিয়ে একে-একে এগিয়ে ব্রেকফাস্ট নিত। একজন কফি ঢেলে দিত মাগে, একজন দুপীস করে পাউরুটি দিত, আরেকজন দিত দুটাে করে ডিম। ব্যস, তারপর ওরা গিয়ে গাড়িতে উঠত। কাঁধে আই-ই, খাকি বুশ শার্ট পরা গার্ড হুইসল দিত, ফ্ল্যাগ নাড়ত, ট্রেন চলে যেত ।
মাহাতোরা কেউ কাছে আসত না, দূরে দূরে ক্ষেতিতে জনারের বীজ রুইতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখত ।
ট্রেন চলে যাওয়ার পরে ভগোতীলালের জিম্মায় টেন্ট রেখে আমরা কোন-কোন দিন মাহাতোদের গ্রামের দিকে চলে যেতাম সব্জির খোঁজে। পাহাড়ের ঢালুতে পাথুরে জমিতে ওরা সর্ষে বুনত, বেগুন আর ঝিঙেও ।
আণ্ডাহল্ট একদিন হল্ট-স্টেশন হয়ে গেল। রাতারাতি। মোরাম ফেলে। লাইনের ধারে কাঁটাতারে ঘেরা জায়গাটুকু উচু করা হল প্লাটফর্মের মতো ।
তখন আর শুধু পি-ও-ডাবু নয়, মাঝে মাঝে মিলিটারি স্পেশালও এসে দাঁড়াত। গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরা হিপ-পকেটে টাকার ব্যাগ গোঁজা আমেরিকার সৈনিক স্পেশাল। মিলিটারি পুলিশ ট্রেন থেকে নেমে পায়চারি করত, দু-একটা ঠাট্টাও ছুড়ত, আর সৈনিকের দল তেমনি সারি দিয়ে মগ, আর থালা হাতে একে একে এসে রুটি নিত, ডিম নিত, মগভর্তি কফি । তারপর যে-যার কামরায় গিয়ে আবার উঠত, খাকি বুশ-শার্টের গার্ড হুইসল বাজিয়ে ফ্ল্যাগ নাড়ত, আমি ছুটে গিয়ে সাপ্লাই ফর্মে মেজরকে দিয়ে ওকে করাতাম।
ট্রেন চলে যেত, কোথায় কোনদিকে আমরা কেউ জানতে পারতাম না।
সেদিনও এমনি আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন এসে দাঁড়াল। সাভার কুলি তিনটি ডিম রুটি কফি সার্ভ করছিল। ভগোতীলাল নজর রাখছিল। কেউ ডিম পচা কিংবা রুটি স্লাস-এণ্ড বলে ছুড়ে দেয় কিনা ।
ঠিক সেই সময় আমার হঠাৎ চোখ গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে ।
কাঁটাতার থেকে আরো খানিক দূরে নেংটি-পরা মাহাতোদের একটা ছেলে চােখ বড়ো করে তাকিয়ে দেখছে। কোমরের ঘুনাসিতে লোহার টুকরো বাঁধা ছেলেটাকে একটা বাচ্চা মোষের পিঠে বসে যেতে দেখেছি।একদিন ।
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল ট্রেনটা । কিংবা রাঙামুখ আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিল। একজন সৈনিক তাকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ “হেই বলে চিৎকার করল, আর সঙ্গে সঙ্গে নেংটি-পরা ছেলেটা পই-পই করে ছুটে পালাল মাহাতোঁদের গাঁয়ের দিকে। কয়েকটা আমেরিকান সৈনিক তখন হা হা করে হাসছে।
ভেবেছিলাম ছেলেটা আর কোনোদিন আসবে না । মাহাতোরা কেউ আসত না, কেউ না । ক্ষেতিতে কাজ করতে করতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওরা শুধু অবাক চোখ মেলে দূর থেকে দেখত । কিন্তু তারপর আবার যেদিন ট্রেন এল, ট্রেন থামল, সেদিন আবার দেখি কোমরের ঘুনসিতে লোহা-বাঁধা ছেলেটা কাঁটাতারের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে আরেকটা ছেলে, তার চেয়ে আরেকটু বেশি বয়েস। গলায় লাল সুতোয় ঝুলোনো দস্তার তাবিজ, ভুরকুণ্ডার হাটে একদিন গিয়েছিলাম, রাশি রাশি বিক্রি হয় মাটিতে ঢেলে, রাশি রাশি সিঁদুর, তাবিজ, তামার পিতলের দস্তার, বাঁশে ঝোলানো থাকে রঙিন সুতলি, পুতির মালা। একটা ফেরিওলাকে দেখেছি কখনো-কখনো একহাঁটু ধুলো নিয়ে, কাঁধে অগুনতি পুঁতির ছড়, দূর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে যায়।
ছেলে দুটাে অবাক-অবাক চোখ মেলে কাঁটাতারের ওপারে দাঁড়িয়ে আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিল। প্রথম দিনের বাচ্চাটার চোখে একটু ভয়, হাঁটু তৈরি, কেউ চোখে একটু ধমক মাখালেই সে চট করে হরিণ হয়ে যাবে।
আমি হাতে ফর্ম নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম। সুযোগ পেলে হেসে-হেসে মেজরকে তোয়াজ করছিলাম। একজন সৈনিক তার কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কফির মাগে চুমুক দিতে দিতে ছেলে দুটােকে দেখে পাশের জি আইকে বললে, অফুল !
আমার এতদিন মনে হয়নি। ওরা তো দিব্যি ক্ষেতে খামারে কাজ করে, গুলতি নয়তো তীরধনুক নিয়ে খাটাস মারে, নাটুয়া গান শোনে, হাঁড়িয়া খায়, ধনুকের ছিলার মতো কখনো টানটান হয়ে রুখে দাঁড়ায়। নেংটি-পরা সরু শরীর, কালো, রুক্ষ । কিন্তু ব্যাটা জিআই-এর ‘অফুল’ কথাটা যেন আমাকে খোঁচা দিল । ছেলে দুটাের ওপর আমার খুব রাগ হল।
সৈনিকদের মধ্যে একজন গলা ছেড়ে এক কলি গান গাইল, দু-একজন হা-হা করে হাসছিল, একজন চটপট কফির মাগে চুমুক দিয়ে সাভার কুলিটাকে চােখ মেরে আবার ভর্তি করে দিতে বললে। গার্ড এগিয়ে দেখতে এল আর কত দেরি। পাঞ্জাবী গার্ড কিন্তু দিব্যি চন্দ্ৰবিন্দু লাগিয়ে কথা বললে মেজরের সঙ্গে।
তারপর হুইসল বাজল, ফ্লাগ নড়ল, সবাই চটপট উঠে পড়ল ট্রেনে, হাতে চওড়া লাল ফিতে বাঁধা মিলিটারি পুলিশরাও ।
ট্রেন চলে গেলে আবার সেই শূন্যতা, ধু-ধু বালির মধ্যে ফণিমনসার গাছের মতো শুধু সেই কাঁটাতারের বেড়া।
দিনকয়েক পরেই আবার একটা ট্রেন এল। এবার পি-ও-ডাবু গাড়ি, ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দীরা রামগড় থেকে আবার কোথাও চালান হচ্ছে। কোথায় আমরা জানতাম না, জানতে চাইতাম না ।
ওদের পরনে স্ট্রাইপ দেওয়া অন্য পোশাক, মুখে হাসি নেই, রাইফেল উচিয়ে সারাক্ষণ ওদের ট্রেনটা চারদিক থেকে গার্ড দেওয়া হত। আমাদেরও একটু ভয়-ভয় করত। ভুরকুণ্ডায় গল্প শুনে এসেছিলাম, একজন নাকি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে পালাবার চেষ্টা করছিল, পারেনি। বাঙালী বলেই আমার আরো ভয় ভয় করছিলে।
ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম, কাঁটাতারের ওপারে শুধু সেই বাচ্চা ছেলে দুটাে, খাটাে কাপড়ের একটা বছর-পনেরোর মেয়ে, দুটাে পুরুষ ক্ষেতের কাজ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন চলে যাওয়ার পর ওরা নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করল, হাসল, কলকল করতে করতে ঝরনার জলের মতো মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে চলে গেল ।
একজন, দুজন, পাঁচজন-সেদিন দেখি জন-দশেক মাহাতে গাঁয়ের লোক ট্রেন আসতে দেখেই মাঠ থেকে দৌড়তে শুরু করেছে। ট্রেনের জানলায় খাকি রঙ দেখলেই বোধহয় ওরা বুঝতে পারত। দিনে দুখানা প্যাসেঞ্জার মেল-ট্রেনের মতো হস করে বেরিয়ে যেত, দু-একখানা গুড়সা ট্রেন ঠং-ঠুং করতে করতে। তখন তো কই থামবে ভেবে মাহাতে গাঁয়ের লোক আসত না ভিড় করে !!
একদিন গিয়ে বলেছিলাম মাহাতো বুড়োকে, লোক পাঠিয়ে আমাদের আণ্ডাহল্টের তাঁবুতে বেচে আসতে সবজি আর চিংড়ি, সরপুঁটি, মৌরলা।
বুড়ো হেসে বলেছিল-ক্ষেতির কাজ ছেড়ে যাব নাই ।
তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম । কালো-কালো নেংটি-পরা লোকগুলোকে, খাটাে শাড়ির মেয়েগুলোকে। শুধু খালি-গা মাহাতোবুড়োর পায়ে একটা টাঙি জুতো, গেয়ো মৃধার কাছে বানানো টঙি জুতো, এসে সারি দিয়ে ওরা কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে দাঁড়াল।
ট্রেন ততক্ষণ এসে গেছে। কুপব্যাপ নেমে পড়ে আমেরিকান সৈনিকের দল সারি দিয়ে চলেছে মগ আর থালি হাতে।
দুশো আঠারো ব্রেকফাস্ট তখন রেডি বি এফ থ্রি-থার্টি- টুতে । বি এফ থ্রি-থার্টি- টু মানে আণ্ডাহল্ট ।
তখন একটু শীতশীত পড়তে শুরু করেছে। দূরের পাহাড়ে কুয়াশার মাফলার জড়ানো। গাছগাছালি শিশির-ধোয়া সবুজ।
একজন সৈনিক ইয়াঙ্কি গলায় মুগ্ধতা প্রকাশ করল।
আরেকজন কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের ওপরের রিক্ততার দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ কফির মগটা ট্রেনের পা-দানিতে রেখে সে হিপ-পকেটে হাত দিল। ব্যাগ থেকে একটা চকচকে আধুলি বের করে খুঁড়ে দিল মাহাতোদের দিকে।
ওরা অবাক হয়ে সৈনিকটার দিকে তাকাল, কাঁটাতারের ভিতরে মোরমের ওপর পড়ে থাকা চকচকে আধুলিটার দিকে তাকাল, নিজেরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল । -
ট্রেনটা চলে যাবার পর ওরা নিঃশব্দে ফিরে চলে যাচ্ছিল দেখে আমি বললাম, সাহেব বকশিস দিয়েছে, বকশিস তুলে নে ।
সবাই সকলের মুখের দিকে তাকাল, কেউ এগিয়ে এল না।
আমি আধুলিটা তুলে মাহাতোবুড়োর হাতে দিলাম। সে বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর সবাই নিঃশব্দে চলে গেল। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
আমার এই ঠিকাদারের তাঁবেদারি একটুও ভালো লাগত না । জনমনুষ্য নেই, একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়ায় না, তাঁবুতে ভগোতীলাল আর তিনটে কুলি। নির্জন নির্জন । মাটি রুক্ষ, দুপুরের আকাশ রুক্ষ, আমার মন।
মহাতেগাঁয়ের লোকেরাও কাছ ঘেঁষত না। মাঝে মাঝে গিয়ে সবজি কিংবা চুনো মাছ কিনে আনতাম। ওরা বেচাতে আসত না, কিন্তু ভুরকুণ্ডার হাটে যেত তিন ক্রোশ পথ হেঁটে । দিনকয়েক কোন ট্রেনের খবর ছিল না। চুপচাপ, চুপচাপ ।
হঠাৎ সেই কোমরের ঘুনাসিতে লোহা-বাঁধা ছেলেটা একদিন এসে জিজ্ঞেস করল, টিরেন আসবে না বাবু ?
হেসে ফেলে বললাম, আসবে। আসবে।
ছেলেটার আর দোষ কি, বেঁটে-বেঁটে পাহাড়, রুক্ষ জমি, একটা দেহাতী ভিড়ের বাস দেখতে হলেও দু, ক্রোশ হেঁটে যেতে হয় খয়ের গাছের ঝোপের মধ্যে দিয়ে। সকালে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন একটুও স্পীড না কমিয়ে হুস করে বেরিয়ে যেত, বিকেলের ডাউন ট্রেনটাও থামত না, তবু কয়েক মুহূর্ত জানলায় ঝাপসা মুখ দেখার জন্যে আমরা তাঁবুর ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতাম। মানুষ না দেখে, নতুন মুখ না দেখে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম।
তাই আমেরিকান সৈনিকদের স্পেশাল ট্রেন আসছে শুনলে যেমন বিব্রত বোধ করতাম, তেমনি আবার স্বস্তিও ছিল ।
দিনকয়েক পরেই প্রথমে এল খবর, তার পরদিন মিলিটারি স্পেশাল। কুপকাপ করে জি আইরা নামল, সারি দিয়ে সব ডিম রুটি মগভর্তি কফি নিল ।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে মাহাতেগাঁয়ের ভিড় ভেঙে পড়েছে। বিশ হতে পারে, তিরিশ হতে পারে, হাঁটুসমান বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কত কে জানে। খাটাে শাড়ির মেয়েগুলোও বোকা-বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল । ওদের দেখে আমার কেমন ভয়-ভয় করল । ভগোতীলাল কিংবা সাভার কুলি তিনটে মাহাতেগাঁয়ের দিকে যেতে চাইলে আমার বড় ভয়-ভয় করত।
প্ল্যাটফর্ম তো ছিল না, শুধু উঠতে-নামতে সুবিধের জন্যে লাইনের ধারটুকু মোরাম ফেলে উঁচু করা হয়েছিল। আমেরিকান সৈনিকরা কফির মাগে চুমুক দিতে দিতে পায়চারি করছিল। দু-একজন স্থির দৃষ্টিতে মাহাতেগাঁয়ের কালো-কালো মানুষগুলোকে দেখছিল।
হঠাৎ একজন ভগোতীলালের দিকে এগিয়ে গিয়ে হিপ-পকেট থেকে ব্যাগ বের করল, ব্যাগ থেকে একখানা দু টাকার নোট, তারপর জিজ্ঞেস করলে, কয়েনস আছে ? নোট-ভাঙানো খুচরো সৈনিকরা কেউ রাখতেই চাইত না, পয়সা ফেরত না দিয়ে দোকানী কিংবা ফেরিওয়ালা কিংবা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলত, ঠিক আছে, ঠিক আছে। রাঁচিতে গিয়ে কয়েকবার দেখেছি।
এক-আনি, দুয়ানি আর সিকি মিলিয়ে ভগোতীলাল ভাঙিয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে ভিড়ের ভিতর থেকে কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা সেই ছেলেটা হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে কি চাইছে।
সঙ্গে সঙ্গে ভগোতীলালের কাছ থেকে সেই খুচরো আনি-দুয়ানিগুলো মুঠোর মধ্যে দিয়ে সেই আমেরিকান সৈনিক মাহাতোদের দিকে ছুড়ে দিল ।
আমার তখন সাপ্লাই ফর্ম ও-কে করানো হয়ে গেছে, গার্ড হুইসল দিয়েছে।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে, অমনি মাহাতোদের দিকে ফিরে তাকালাম ।
ওরা তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, তাকিয়ে ছিল। তারপর হঠাৎ লাল মোরমের ওপর, ছড়ানো পয়সাগুলোর ওপর কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কোমরের ঘুনসিতে লোহা-বাঁধা ছেলেটা আর গলায় সুতলিতে দস্তার তাবিজ-বাঁধা ছেলেটা।
সেই মুহুর্তে টাঙি-জুতো-পরা মাহাতে বুড়ো ধমক দিয়ে বলে উঠল, 'খবৰ্দার ''!! এমন জোরে চিৎকার করল যে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম ।
কিন্তু বাচ্চা দুটাে ওর কথা শুনল না। তারা দুজনে তখন যে যত পেরেছে আনি-দুয়ানি কুড়িয়ে নিয়েছে। মুখ খোস-ছাড়ানাে কচি ভুট্টার মতো হাসছে। মেয়েপুরুষের সমস্ত ভিড় হাসছে।
টাঙি-জুতো-পরা মাহাতোবুড়ো রেগে গিয়ে তাদের ভাষায় অনর্গল কি সব বলে - গেল । মেয়েপুরুষের ভিড় হাসল।
মাহাতোবুড়ো রাগে গজগজ করতে করতে গাঁয়ের দিকে চলে গেল একাই। মাহাতেগাঁয়ের লোকগুলোও চলে গেল। কলকল কথা বলতে বলতে, খলখল হাসতে হাসতে ।
ওরা চলে যেতেই আণ্ডাহল্টে আবার নির্জন নিস্তব্ধ শূন্যতা। আমার এক-এক সময় ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত। দূরে-দূরে পাহাড়, মহুয়ার বন, খয়েরের ঝোপ পার হয়ে একটা ছােট্ট জল চোঁয়ানো ঝরনা, মাহাতেগাঁয়ের সবুজ ক্ষেত। চোখ জুড়িয়ে যায়, চোখ জুড়িয়ে যায়। তার মধ্যে কালো-কালো নেংটি-পরা মানুষ।
এদিকে মাঝে মাঝেই আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন আসে, থামে, ডিম রুটি মগভর্তি কফি খেয়ে চলে যায়। মাহাতেগাঁয়ের লোক ভিড় করে আসে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে সারি দিয়ে দাঁড়ায়-
সাব বখশিস, সাব বখশিস ।
একসঙ্গে অনেকগুলো দেহাতী গলা চিৎকার করে উঠল।
মেজরের কাছে ফর্ম ও-কে করাতে গিয়ে আমি চমকে ফিরে তাকালাম ।
দেখলাম, শুধু বাচ্চা ছেলে দুটাে নয়, কয়েকটা জোয়ান পুরুষও হাত বাড়িয়েছে।খাটাে শাড়ির একটা তুখোড় শরীরের মেয়েও ।
একদিন সবজি কিনতে গিয়েছিলাম, ঐ মেয়েটা হেসে হেসে জিজ্ঞেস করেছিল, টিরেন কবে আসবে ?
এক-একদিন অকারণেই ওরা দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়ে থাকত, অপেক্ষা করে করে চলে যেত ।
কাঁধে স্ট্রাইপ তিন-চারটে আমেরিকান ততক্ষণে হিপ-পকেট থেকে মুঠোমুঠো আনি-দুয়ানি বের করে ওদের দিকে ছুড়ে দিয়েছে। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করেনি, ওরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল পয়সাগুলোর ওপর । হুড়োহুড়িতে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গেল কারো, কারো বা নেংটির কাপড় ফেসে গেল ।
ট্রেন চলে যাওয়ার পর ভালো করে লক্ষ্য করলাম ওদের । মনে হল মাহাতেগাঁয়ের আধখানাই এসে জড়ো হয়েছে। সবারই মুখে স্মৃর্তির হাসি, সবাই কিছু না-কিছু পেয়েছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই টাঙি-জুতোর মাহাতোবুড়োকে দেখতে পেলাম না। মাহাতোবুড়ো আসেনি। সেদিন ওর আপত্তি, ওর ধমক শুনেও পয়সাগুলো ফেলে দেয়নি ছেলে দুটাে । তাই বোধহয় রেগে গিয়ে আর আসেনি। আমার ভাবতে ভালো লাগল বুড়োটা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে একা একা মাটি কোপাচ্ছে।
আমাদের দিন, কুক ভগোতীলালকে নিয়ে আমাদের পাঁচজনের দিন আণ্ডাহল্টের তাঁবুর মধ্যে কোন রকমে কেটে যাচ্ছিল । মাঝে মাঝে এক-একদিন সৈনিক-বোঝাই ট্রেন আসছিল, থামছিল, চলে সবাই ‘সাব বখশিস সাব বখশিস চেচাত ।
হঠাৎ একদিন মাহাতোবুড়োকে দেখতে পেতাম। কোনদিন ক্ষেতের কাজ ফেলে দু হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হন।হন করে এগিয়ে আসত, রেগে গিয়ে ধমক দিত সকলকে । ওর কথা শুনছে না বলে কখনো বা অসহায় প্রতিবাদের চোখে গাঁয়ের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত ।
কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না । সৈনিকরা হিপ-পকেটে হাত দিয়ে হা-হা করে হাসতে-হাসতে মুঠোভর্তি পয়সা খুঁড়ে দিত। মাহাতেগাঁয়ের লোক হুমডি খেয়ে পড়ত সেই পয়সাগুলোর ওপর, নিজেদের মধ্যে কাড়াকড়ি করতে গিয়ে ঝগড়া বাধাত । তা দেখে সৈনিকরা হা-হা করে হাসত ।
শেষে পর-পর কয়েক দিনই লক্ষ্য করলাম টাঙি-জুতো-পরা মাহাতোবুড়ো আর আসে না । মাহাতোবুড়ো ওদের দেখে রেগে যেত বলে, মাহাতোবুড়ো আর আসত না বলে আমার এক ধরনের গর্ব। হত । কারণ এক-এক সময় ঐ লোকগুলোর ব্যবহারে আমরা - আমি আর ভগোতীলাল খুব বিরক্তি বোধ করতাম। ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেতাম। ওদের কালোকুলো দীন-দরিদ্র বেশ দেখো সৈনিকের দল নিশ্চয় ওদের ভিখিরি ভাবত । ভাবত বলে আমার খুব খারাপ লাগত।
সেদিন কাঁটাতারের ওপারে থেকে ওরা বখশিস। বখশিস বলে চিৎকার করছে, কাঁধে আই-ই থাকি বুশশার্টের গার্ড জানকীনাথের সঙ্গে আমি গল্প করছি, আমাদের পাশ দিয়ে একজন অফিসার মচমচ করে যেতে যেতে ওদের চিৎকার শুনে থুতু ফেলার মতো গলায় বলে উঠল, ব্লাডি বেগার্স।
আমি আর জানকীনাথ পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। আমাদের মুখ অপমানে কালো হয় গেল। মাথা তুলে তাকাতে পারলাম না। শুধু অক্ষম রাগে ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠলাম ।
ব্লাডি বেগার্স, ব্লাডি বেগার্স।
সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মাহাতোদের ওপর । ট্রেন চলে যেতেই আমি ভগোতীলালকে সঙ্গে নিয়ে ওদের তাড়া করে গেলাম। ওরা কুড়োনো পয়সা টাঁকে গুজে হাসতে হাসতে পালাল ।
তবু ওদের জন্যে সমস্ত লজ্জা আমি একটা অহঙ্কারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে সেই অহঙ্কারটা আমার চােখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত মাহাতোবুড়োর চেহারা নিয়ে।
কিন্তু সেদিন আমার বুকের মধ্যের সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে গেল।
ভুরকুণ্ডায় ঠিকাদারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই খবর পেয়েছিলাম।
সাভার দুজন কুলি তখন টেবিল বানানো ড্রাম দুটােকে পায়ে ঠেলে আণ্ডাহল্টের কাঁটাতারের ওপারে সরিয়ে দিচ্ছিল । তাঁবুর দড়ি খুলছিল আর একজন। ভগোতীলাল ড্রামটার গায়ে একটা জোর লাথি মেরে বললে, খেল খতম, খেল খতম ।
হঠাৎ হাই-হল্লা শুনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি মহাতেগাঁয়ের লোক ছুটতে ছুটতে আসছে।
আমরা অবাক হয়ে তাকালাম তাদের দিকে । ভগোতীলাল কি জানি কেন হেসে উঠল ।
ততক্ষণে কাঁটাতারের ওপারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেছে। ওরা ।
সঙ্গে সঙ্গে একটা হুইসল শুনতে পেলাম, ট্রেনের শব্দ কানে এল ।
ফিরে তাকিয়ে দেখি ট্রেনটা বাঁক নিয়ে আণ্ডাহল্টের দিকেই আসছে, জানালায় জানালায় খাকি পোশাক । আমরা বিব্রত বােধ করলাম, আমরা অবাক হলাম। তা হলে খবর পাঠাতেই ভুলে গেছে ভুরকুণ্ডার আপিস ? না, যে খবর শুনে এসেছি সেটাই ভুল ?
ট্রেনটা যত এগিয়ে আসছে ততই একটা অদ্ভুত গমগম আওয়াজ আসছে। আওয়াজ নয়, গান। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল সমস্ত ট্রেন, ট্রেনভর্তি সৈনিকের দল পরস্পরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, গলা ছেড়ে গান গাইছে।
বিভ্রান্তের মতো আমি একবার ট্রেনটার দিকে তাকালাম, একবার কাঁটাতারের ভিড়ের দিকে । আর সেই মুহুর্তে চোখ পড়ল সেই মাহাতোবুড়োর দিকে । সমস্ত ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাহাতোবুড়োও হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে, সাব বখশিস, সাব বখশিস !
উন্মাদের মতো, ভিক্ষুকের মতো তারা চিৎকার করছে। তারা এবং সেই মাহাতোবুড়ো ।
কিন্তু আমেরিকান সৈনিকদের সেই ট্রেনটা অন্যদিনের মতো এবারে আর আণ্ডাহল্টে এসে থামল না। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোর মতোই আণ্ডাহিল্টকে উপেক্ষা করে হুস করে চলে গেল। আমরা জানতাম ট্রেন আর থামবে না।
ট্রেনটা চলে গেল। কিন্তু মাহাতেগাঁয়ের সবাই ভিখিরি হয়ে গেল। ক্ষেতিতে চাষ করা মানুষগুলো সব-সব ভিখিরি হয়ে গেল ।
11 মন্তব্যসমূহ
কী নির্মম কাহিনি ! সহ্য করা যায় না। তবু ঘটে যায়।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।
নিজেও কোথায় কোথায় ভিখিরি হয়েছি তাই খুঁজে চলেছি । শুধু খুঁজে চলেছি।
উত্তরমুছুনবাকরুদ্ধ
উত্তরমুছুনএ তো ভারতবর্ষ নয়,দুঃসময়ের ভারতবর্ষ।
উত্তরমুছুনখুব প্রিয় গল্প
উত্তরমুছুনএতো সর্বকালীন। অনন্ত লোভের ঈশারায় অজস্র চাওয়ার হাত আজও এ ভারতবর্ষে পশ্চিমে প্রসারিত।
উত্তরমুছুনঅপমানে নীচু হয়ে যাই । কি দুঃসহ গল্প !
উত্তরমুছুনমানুষ সর্বদাই ফ্রী তে যাহা পাই,তাই নেবার জন্য কাড়াকাড়ি করে।।।আবার পরিস্থিতি ও মাঝে মাঝে বাধ্য করে অনুরূপ কাজে।।
উত্তরমুছুনএতে যেন সাংকেতিক ভাষাতে বলে দেওয়া হলো, কী ভাবে একটা পুরো দেশ পরাধীন হয়ে গেল...
উত্তরমুছুনঅসাধারণ একটি গল্প৷
উত্তরমুছুনএ তো আজকের ভারতবর্ষ আগামীর জানান দেয়
উত্তরমুছুন