
দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত করিয়াই সিদ্ধি খাওয়া, নহিলে সিদ্ধির নেশায় কৈলাসের কোনদিন ঝোঁক ছিল না। তাড়ির কাছে কি সিদ্ধি! কিন্তু তাড়ি সে আজকাল আর খায় না। একদিন নেশার ঝোঁকে মেয়ে কালীতারার কানের মাকড়ি টানিয়া ছিড়িয়া ফেলার পর হইতে ছাড়িয়া দিয়াছে। পোষ্টাপিসের ছুটি থাকিলে বদনের দোকানে যাওয়ার জন্য বিকালের দিকে এখন তার পা সুর সুর করে, এক ভাড় তালের রস আর বদনের বউয়ের কড়া করিয়া ভাজা পেয়াজবড়ার অভাবে দিনটা তার বৃথাই গেল মনে হয়। কিন্তু বদনের দোকানে যাওয়া আর তার হইয়া উঠে না। কানের খানিকটা উচুতে আর একটা ছেদা করিয়া কালী অবশ্য আবার মাকড়ি পরিয়াছে, কিন্তু কানের কাটা অংশটুকু বেশ দেখিতে পাওয়া যায়। কৈলাস চাহিয়া দেখে আর অনুতাপ করে। মাকড়ি-ছেড়ার রাত্রে কৈলাসের নেশার জগতে তিলটি তাল হইয়াই ছিল, কালী বিশেষ না চেচাইলেও তার মনে হইয়াছিল মেয়েটা বুঝি আৰ্তনাদ করিয়াই মারা যায়, এবং সেই ফেনানো উপলব্ধিটাই তার স্মরণ আছে।
কাটা কানের জন্য কালী বিশেষ দুঃখ করে না। বলে হোকগে বাবা, কান নে ধুয়ে ধুয়ে জল খাব কি! তোমার একটো কুস্বভাব তো শুধরোলো।
শুনিযা কৈলাস খুশী হয়। সে যে আর তাড়ি খায় না মেয়ের জন্য সে একটা বড়রকম ত্যাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। মেয়ে ত্যাগটা বোঝে জানিলে নেশা না করার আপশোষে সে অনেকখানি সান্ত্বনা পায়।
রামগতির জামাই মাখম একটা কালিপড়া লণ্ঠন রাখিয়া গিয়াছে। তারই মৃদু আলোকে পরিমাণ ঠিক করিয়া কৈলাস আরও খানিকটা সিদ্ধি গিলিয়া ফেলিল। তারপর একটা অত্যন্ত দুঃখের হাসির সঙ্গে নিজের মনে তার মাথা নাড়ার কারণটা রামগতি কিছুই বুঝিতে পারিল না।
বলিল আর খেও না দাদা।"
কৈলাস বলিল, না। খাইলে ছাই হয়। না আছে তাড়ির গন্ধ না আছে স্বাদ।
তবু সে প্রায়ই রামগতির কাছে সিদ্ধি খাইতে আসে, সর্পী হইতে বাদাম পেস্তা আর সাদা চিনি আনিয়া দিয়া সবুজ সরবৎকে বিলাসিতায় দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করে। সিদ্ধি যোগায় রামগতি। তার জামাই মাখমের বাড়ি ময়মনসিং-এর একটা মহকুমা শহরে—যেখানে মাঠে-ঘাটে বিনা চাষেই সিদ্ধি গাছে জঙ্গল হইয়া থাকে। টিনের তোরঙ্গে কাপড়ের নীচে লুকাইয়া সে শ্বশুরের জন্য সিদ্ধিপাতা লইয়া আসে। নিজে না আসিলে লোক মারফৎ পাঠাইয়া দেয়। আবগারী বিভাগের লোকেরা মদ আফিং প্রভৃতি বড় বড় মাদক সামলাইতে ব্যস্ত থাকে, সুতরাং কাজটা মাখম আইন বাঁচাইয়াই করে। মাখম নিজে কিন্তু কোন নেশাই করে না। কেবল তামাক খায়। সে ভারি শান্ত ও সংসারী মানুষ, —একা সে সাতাশী বিঘা জমির চাষ আবাদ দেখে আর বছরে দেড় হাজার টাকার গুড়ের কারবার সামলায়। শ্বশুরকে সে বিশেষ ভক্তি করে এবং শ্বশুরের বন্ধু বলিয়া প্রতিবার আসা ও যাওয়ার সময় কৈলাসকে পায়ে হাত দিয়া প্ৰণাম করিতে ভোলে না।
কৈলাস থাক, থাক’, বলিয়া তার প্রণাম নেয় ও চিরজীবী হওয়ার জন্য আশীৰ্ব্বাদ জানায়। তারপর রামগতির কাছে প্রাণ খুলিয়া মাখমের সঙ্গে নিজের গোয়ারগোবিন্দ জামাই সুবলের তুলনামূলক সমালোচনা আরম্ভ করিয়া দেয়। সুবলকে সে চাষা বলে, গুণ্ডা বলে, গেজেল বলে এবং আরও অনেক-কিছু বলে। সুবলের নাই এমন অনেক দোষও সে তার ঘাড়ে চাপাইয়া দেয়। বারকয়েক বলিবার পর সুবলের সেই কাল্পনিক দোষগুলিতে তার বিশ্বাস জন্মিয়া যায়।
মেয়ের মত মেয়ের সেই অপদার্থ জামাইটাও বেচারীর সজ্ঞান মুহূৰ্ত্তগুলিতে অধিকার করিয়া থাকে। আজও সমস্ত সময়টা সে মাখমের সঙ্গে সুবলকে মিলাইয়া দেখিতেছিল। সুবলের সঙ্গে সম্পর্ক একপ্রকার রহিত করিয়া এবং কালীকে পাঠাইতে রাজী না হইয়া সে যে ভালই করিয়াছে এর স্বপক্ষে সমস্ত যুক্তিগুলি তার কাজে ক্রমেই পরিষ্কার ও অকাট্য হইয়া উঠিতেছিল।
ভয় দেখিয়ে পত্র লিখিছে দাদা, এবার মেয়ে না পাঠালে ফের বিয়ে করবে। আমি বলি, কর! কর গিয়ে তুই য’টা পারিস বিয়ে। ওতে ভয় পাবার পাত্র কৈলেস ধর নয়। একটা মেয়েকে সে রাজার হালে পুষতে পারবে। হঠাৎ ভয়ানক রাগিয়া, আরে আগে তুই গাঁজা গুণ্ডামি ছাড়, মানুষ হ' তবে তো পাঠাব মেয়ে। নিজের গর্ভধারিণী মার গায়ে হাত তুলিস, তোকে বিশ্বাস কি? এটুকু কল্পনা। রামগতি বলিল, ‘মার গায়ে হাত তোলে না কি?
‘তোলে না? ওর অসাধ্য কৰ্ম্ম আছে জগতে ? মেয়ে কি আমি সাধে পাঠাই না দাদা,— মেরে ফেলবে যে!"
প্রকৃতপক্ষে মেয়েকে স্বামীর ঘর করিতে না পাঠানোর কৈফিয়তই সে আগাগোড়া রামগতিকে দিয়া যায়। সুবলের মেজাজটা বিশ্ৰী, অন্য দোষও তার কমবেশী আছে, কিন্তু মেয়ে পাঠানো চলে না এমন অজুহাত সেটা নয়। কিন্তু নিজে রাজা না হইলেও রাজকন্যার সঙ্গে কালীর বিশেষ পার্থক্য আছে বলিয়া কৈলাস মনে করে না এবং মাখমের মত রাজপুত্রগুলির একটাকেও সে যে কালীর জন্য সংগ্ৰহ করিতে পারিত না এ কথাটাও সে ভুলিয়া থাকে। সে ভালবাসে বলিয়াই সুবলের চেয়ে ভাল স্বামীর ভাগ্য কালির অৰ্জ্জিত হইয়া গিয়াছে এই রকম একটা ঝাপসা ধারণা বরং তার আছে।
তবু মাঝে মাঝে সুবলের দোষগুলি তার কাছে সংসারের রোগশোকের মতই অপরিহার্য ও মাৰ্জ্জনীয় মনে হয়। কালীকে না পাঠানোর অনেকগুলি সমর্থনই কমজোরী হইয়া যায়। তখন সে আশ্রয় করে জামাইয়ের সঙ্গে তার মতান্তরকে। কালীকে নিতে আসিলে বিনা প্ররোচনায় সুবলকে সে এমন অপমানই করে যে সুবলও তাকে অপমান না করিয়া পারে না। কৈলাস তখন পাড়াপ্রতিবেশীকে ডাকিয়া জামাইয়ের মেজাজ দেখায়, তার গালাগালির সাক্ষী করে, এবং সকলের সামনে জোর গলায় ঘোষণা করিয়া দেয় যে জামাই যতদিন জামাইয়ের মত না আসিবে মেয়ে সে কোনমতেই পাঠাইবে না। পোষ্টাপিসের সে হেডপিয়ন তার একটা সম্মান আছে, মেয়ে তার ফেলনা নয়।
কালী ঘরেব ভিতর থ হইয়া থাকে। ভাবে এত গোলমালে কাজ কি বাবু, দিলেই হয পাঠিয়ে! মারে যদি না হয় খাবই একটু মার।
দাঁতে দাঁত ঘষিয়া সুবল সকলের কাছে তার একটা নালিশ জানায়।
শুনিয়া কৈলাস যায় ক্ষেপিয়া। কালীকে ঘরের ভিতর হইতে হাত ধরিয়া টানিয়া আনিয়া চড়া গলায় জিজ্ঞাসা করে, চাস? চাস তুই যেতে ? বল, চেচিয়ে বল, সবাই শুনুক কালী সুস্পষ্ট মাথা নাড়ে।
সুবল সহসা কেমন ঝিমাইয়া পড়ে, আর তেমনভাবে কৈলাসের সঙ্গে কলহ চালাইতে পারে না। সকলকে শুনাইয়া একটা অশ্রদ্ধেয় কথা বলিয়া ঘাড় উচু করিয়া সে চলিয়া যায়। -
সুবল যতক্ষণ উপস্থিত থাকে প্রতিবেশীরা তাকে এত বেশী ছিছি করে যে, তার প্রতি কালীর পর্যন্ত একটা সাময়িক অশ্রদ্ধা জন্মিয়া যায়। সুবল চলিয়া গেলে তার একটু সুর বদলায়। বলে যে জামাই যাই হোক মেয়ে না পাঠাইয়া উপায় কি? আরও বলে যে কালীর যখন বয়সের গাছপাথর নাই তাকে আর এভাবে রাখা উচিত নয়। কারণ গ্রামটা খারাপ ছেলেতে ভৰ্তি, কালীর খারাপ হইতে কতক্ষণ ? '
কৈলাস কটমট করিয়া ইহাদের দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। নিজেই এক ছিলিম তামাক সাজিয়া টানিতে থাকে।
একজন বয়স্কা বিধবা কথাটা আরও স্পষ্ট করিয়া দেয়।
‘হা লো কালী, সেদিন দুপুরবেলা বংশী কি করতে এসেছিল রে? তোর কাছে তার কি দরকার?”
কালী মুখ লাল করিয়া বলে-”কবে মাসী”।
কৈলাস লাফাইয়া ওঠে। বলে-”খুন করে ফেলবো কাতুর মা। রতনের পিসী রোজ দুপুরে এসে বসে থাকে জানিস নে তুই?”
কাতুর মা বলে “ বসে থাকে না ঘুমোয়, তুই দেখতে আসিস। আমি তো দুপুরে না ঘুমিয়ে থাকতে পারি না।”
খানিক রাত্রে কৈলাস রামগতির কাছে বিদায় নিল। রামগতি হাঁকিয়া বলিয়া দিল “ একটু তেতুল গুলে খেয়ো দাদা, রকম ভালো নয়।”
গ্রামে সন্ধ্যার পরেই রাত্রি । কানাইমুদী ইতিমধ্যেই ঝাঁপ বন্ধ করিয়াছে। দোকানের সামনে বাঁশের টঙে চিত হইয়া শুইয়া আছে, মুখে তার বিডির আগুন। কানাইয়ের ভাই বংশী ছোড়া রোজ এমনি সময় ওখানে এমনভাবে শুইয়া থাকে আর থাকিয়া থাকিয়া বাঁশি বাজায়। সুবলের মতই অপদার্থ। কয়েকবার মুখ ফিরাইয়া কৈলাস জোনাকির মতো তার বিডির আগুনের জ্বলা-নেভা চাহিয়া দেখিল। ছেলেদের এ-রকম ভাসিয়া বেড়ানো সে পছন্দ করে না। কানাইয়ের একেবারে দায়িত্ববোধ নাই। ভাইয়ের একটা বিবাহ সে এবার দিলেই পারে।
মেয়ের বদলে বংশীর মতো ছেলেও যদি তার একটা থাকিত তবে কোন ভাবনা ছিলো না, এও কিন্তু কৈলাসের মনে হয়। পরের বাড়ির পরের সংসার মানুষের ছেলেকে ধরিয়া টানাটানি করে না, মমতার সঙ্গে থাকে অধিকার। ছেলের বউ আনিয়া মেয়ের সাধও মেটানো চলে। নিজের সন্তানকে নিজের কাছে রাখিয়া সকলের কাছে অপরাধী হইয়া থাকিতে হয় না।
অন্ধকার পথে চলিতে চলিতে কৈলাসের ভয়ানক রাগ হইতে লাগিল। সংসারে একি অবিচার। সে তার মেয়েকে কোথাও পাঠাইতে চায় না, মেয়ে তার কোথাও যাওয়ার নামে ভয়ে অস্থির হয়- তাদের দুজনকে পৃথক করিয়া দেওয়ার জন্য লোকের এত মাথাব্যাথা কেন? সে কারও ভালো মন্দে থাকে না, তার শান্তি নষ্ট করিতে লোকের এতো উৎসাহ কি জন্য? প্রতিবেশী নিন্দা করে, সুবল আসিয়া দাবী জানায়। কিসের নিন্দা, কিসের দাবী? দেশে ঢের মেয়ে আছে, সুবল যাকে খুশি ঘরে আনিয়া কষ্ট দিক, প্রতিবেশীদের ঘরে ছেলেমেয়ে আছে তাদের ভালোমন্দ লইয়া তারা মাথা ঘামাক। সে কথাটি কহিবে না। কিন্তু সে আর তার মেয়ে দুজনেই যখন সুবলকে অস্বীকার করিয়াছে , লোকের বলাবলিকে তারা যখন গ্রাহ্য করে না, তাদের আর বিরক্ত করা কেন? গায়ের জোরেই সকলে মিলিয়া তাদের দিয়া যা খুশী করাইয়া লইবে নাকি? রাগ আর তার কমিতে চায় না। নির্জন রাস্তায় নিজের মনে কৈলাস গজ গজ করিতে লাগিল। নেশায় তার মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করিতেছে, রাস্তাটা ঝুলানো দোলনার মতো দুলিয়া উঠিতে চায়, গ্রামের সমতল পথে সে পাহাড়ী দেশের চড়াই উৎরাই ভাঙ্গিতেছে। তবু এমন জমজমাট নেশার মধ্যেও তাড়ির তৃষ্ণায় সে আহত। মেয়ের জন্য কত দুর্দাশাই তার কপালে আছে কে জানে। এতেও লোকে মেয়ের উপর তার অধিকার স্বীকার করিবে না। তাড়ি তো বড় কথা, কালীর জন্য সুবল একটা ছোটখাট ত্যাগও স্বীকার করুক দেখি। সেবেলা তার পাত্তা মিলবে না। অধিকার জাহির করতেই সে মজবুত।
এমনি মানসিক অবস্থায় বাড়ির উঠানে পা দিয়া কৈলাস দেখিল, দাওয়ার মাদুরে কাত হইয়া তারই হুঁকায় সুবল পরম আরামে তামাক টানিতেছে। চিনিতে পারিয়াও সেখান হইতে কৈলাস হাঁকিয়া বলিল “কে?”
হুঁকা রাখিয়া সুবল নামিয়া আসিল। বলিল -”আজ্ঞে আমি।”
বলা নাই কওয়া নাই, তুমি বাড়ির মধ্যে ঢুকেছো কেন?
সুবল ঠিক করিয়া আসিয়াছিল এবার সুর নরম করিবে, সহজে রাগিবে না।
মাটির দিকে চাহিয়া সে বলিল, বাড়ির মধ্যে ঢুকব না তো কোথায় যাব?
শ্বশুরকে একটা প্ৰণাম ঠুকিবে কি-না সুবল তাহাও ভাবিয়া দেখিতেছিল। অভ্যর্থনার রকম দেখিয়া সেটা আর পারিয়া উঠিল না।
কৈলাস বলিল, কোথায় যাবি তা আমি কি জানি? চুলোয় যাবি।’
সুবল বলিল, "এত রাগবার কারণটা কি হ’ল ? মা নিতে পাঠাল বলে এসেছি বই তো নয়।"
কৈলাস বলিল, ‘মা নিতে পাঠাল! তোর মা কে রে যে আমার মেয়েকে নিতে পাঠায়? যা তুই বেরো আমার বাড়ি থেকে।
সুবল অল্প রাগ করিয়া বলিল, “বার করে দিচ্ছ যে, তোমার বাড়ি থাকতে এসেছে কে? গাছতলা ঢের ভাল।"
যা তবে গাছতলাতে যা। ফের আমার বাড়ি ঢুকলে তোর ঠাং খোঁড়া করে দেব।
"ঠ্যাং অমনি সবাই সবাকার খোঁড়া করছে। আমারও দুটাে হাত আছে।
প্রতিবার যেমন হয়, এবারও তেমনি ভাবে দুজনের সুর চড়িতে লাগিল; ভাষা রূঢ় হইতে অভদ্র এবং অভদ্র হইতে অশ্রাব্যে দাঁড়াইয়া গেল। মাত্রা কৈলাসেরই বেশী। সে বুঝিতে পারিয়াছিল আজ একটা হেস্তনেস্ত হইয়া যাইবে, সুবল শেষ মীমাংসা করিতে আসিয়াছে, আজ ওকে ফিরাইয়া দিতে পারিলে ও আর আসিবে না। শুধু আসিবে না নয়, কালীকে কোনদিন পাঠানও অসম্ভব করিয়া দিবে। বিধবা মেয়ের মত তার কাছে থাকা ছাড়া কালীর আর কোন উপায় থাকিবে না। মেযেটা বাঁচিবে।
খানিক পরে তাই কলহের পরিসমাপ্তির জন্য কৈলাস পা হইতে ছেড়া চটি খুলিয়া সুবলকে পটাপট কয়েক ঘা বসাইয়া দিল। উঠানে একটা বাঁশের বাতা পড়িয়া ছিল, সেটা কুড়াইয়া লইযা কৈলাসের মুখের উপর নিৰ্ম্মম ভাবে কয়েকবার আঘাত করিয়া সুবলও করিল প্রস্থান। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া উলুখড় কালী তার জীবনের দুই রাজার যুদ্ধ আগাগোড়া সবটাই চাহিয়া দেখিল।
কৈলাসের আঘাত কম লাগে নাই। মুখে চার-পাঁচটা কালো দাগ পড়িয়াছে, নাক দিয়া রক্তপাত হইয়াছে এবং খোঁচা লাগিয়া একটা চোখ বুজিয়া গিয়াছে। অনেক রাত অবধি তাহার নাক দিয়া রক্ত ও চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। থাকিয়া থাকিয়া সে বলিতে লাগিল, দেখলি কালী, দেখলি ? আর একটু হলে খুন করে ফেলত রে!
মনে মনে সে কিন্তু নিশ্চিন্ত হইয়াছিল। সুবল আর আসিবে না। তাকে ক্ষমা করার কামনা কালীর মনে যদি কখনও জাগিয়া থাকে এ ঘটনার পর আর জাগিবে না। বাপকে যে এমন করিয়া মারিয়া যায় মেয়ে কি তাকে ক্ষমা করিতে পারে? এবার আর বুঝিতে পারা নয়, কালী নিঃসন্দেহ প্রমাণ পাইয়াছে যে, সুবল মানুষ নয়—খুনে ডাকাত। ওকে এবার কালী ভয়ঙ্কর ঘৃণা করিবে। আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিই এবার তাকে কোনমতে ভুলিতে দিবে না যে বাপের কাছে থাকাই তার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ ও মঙ্গলজনক ব্যবস্থা।
অথচ কালী ভয়ানক গম্ভীর হইয়া গিয়াছে। ভাল করিয়া কথার জবাব দেয় না। সুবলের বিরুদ্ধে সত্যমিথ্যা অভিযোগে সায় দিতে তার যেন আর তেমন উৎসাহ নাই।
প্রথমটা কৈলাস অত খেয়াল করে নাই। শেষে মেয়ের ভাব লক্ষ করিয়া সে অস্বস্তি বােধ করিতে লাগিল।
‘কথা কইছিস না যে কালী?
“কি বলব বল না?
‘বাঁচলি, কি বলিস?
ঝগড়াঝাটি ভাল লাগে না বাবু।
'দেখলি তো? কি রকম কান্ডটা ক’রে গেল? কৈলাস নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইল।
একটা বিরক্তিকর ব্যাপার ঘটিয়াছে শুধু এই জন্যই কালীর মন খারাপ হইয়াছে, সুবলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়া গেল বলিয়া নয়। কাল ওর মুখের মেঘ কাটিয়া যাইবে। যেমন হাসিয়া খেলিয়া এতদিন এতকাল তার দিন কাটিয়াছে কাল আবার গোড়া হইতে তার শুরু। এবার আর বাঁধা পড়িবে না। কাল সে ওকে সতীশের হাৰ্ম্মোনিয়মটা আনিয়া দিবে। পাড়ার লোকে নিন্দা করিবে, তা করুক। নিন্দা করা যাদের স্বভাব নিন্দা তারা করিবেই। কালী আনন্দে শুধু নাচিতে বাকী রাখিবে।
তার মত অবস্থার লোক কে কবে মেয়েকে বাইশ টাকা দিয়া হাৰ্ম্মোনিয়ম কিনিয়া দিয়াছিল? তার এক মাসের মাহিনা!
পরদিন সোমবার। সোমবার উখারায় মস্ত হাট বসে। অনেক দূর দূর গ্রামের লোক হাটে চিঠিপত্র সংগ্ৰহ করিতে আসে, সেখানে বড় বড় মহাজনদের নামে মোটা টাকার মনিঅৰ্ডার ও ইনসিওর থাকে। চিঠির তাড়া হাতে চামড়ার ব্যাগ কাধে ঝুলাইয়া বেলা দশটার মধ্যে কৈলাসকে হাটে হাজির হইতে হয। একটা পর্যন্ত সেখানে সে চিঠি ও টাকা বিলি করে।
সপার পোষ্টাপিস কাছে নয়, পাঁচমাইল পথ। পোষ্টাপিসে চিঠি ও টাকা হিসাব করিয়া গুছাইয়া লইয়া আরও তিন মাইল হাটিলে তবে উখারার হাট। কৈলাসের সকালে ওঠা দরকার ছিল, কিন্তু কালী তাকে কোনমতেই ডাকিয়া তুলিতে পারিল না। উঠিতে সে বেলা করিয়া ফেলিল।
"সকালে তুলে দিলি না যে কালা? আজ হাট বার খেয়াল নেই? দিনকে দিন তোর কি হয়েছে?!"
"তুমি উঠলে? রাঁধতে রাঁধতে ক’বার যে ডেকেছি তার ঠিক নেই।
কৈলাসের রাগ হইয়াছিল। সে আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু হঠাৎ গত সন্ধ্যার কথা মনে পড়ায় এক নিমেষে গলিয়া জল হইয়া গেল।
'রাঁধতে তোর যদি কষ্ট হয় তো বল তোর মাসীকে এনে রাখি।
'রাঁধতে আবার কষ্ট কিসের? মাসীর ধাক্কা পোয়াতে পারব না বাবু।
কৈলাস খুশী হইয়া মনে মনে হাসিল। ভাবিল, বাপের সেবার ভারটা মাসীর উপরেও ছাড়িয়া দিতে কালীর বাঁধে।
সে স্নান করিয়া আসিল। পিাঁডিতে বসিয়া বলিল, “আন রে কালী, চটপট আন। দেখেছ শালার রোদ্দুর! প্রাণটা যাবে।
কালী বলিল, হুটোপাটি করলে চলবে না বাবা, বসে খেতে হবে।’
‘বসে খাওয়ার সময় গড়াচ্ছে।’
কিন্তু কালী যে কাণ্ড করিয়া রাখিয়াছে তাহাতে বসিয়া না খাইয়া তার উপায় রহিল না। ডাল আর আলুভাত খাইয়াই নিত্য সে পোষ্টাপিসে যায়, আজ কালী নিমন্ত্রণ রাঁধিয়াছে। কখন সে এত সব করিল কে জানে। কৈলাস যা খাইতে ভালবাসে তার কোনটাই একরকম সে বাদ দেয় নাই। কলাপাতার বদলে আজ খাওয়ার ব্যবস্থা থালাতে, থালায় তরকারী সাজাইয়া কালী কুলাইয়া উঠিতে পারে নাই।
এ কী করেছিস রে! তুই কি ক্ষেপেছিস কালী?
'একদিন কি ভাল খেতে নেই?"
"এত কেউ খেতে পারে?'
না খাও তো আমার মাথা খাও।”
কৈলাস প্রাণপণে খাইল। মেয়ের এতটুকু সুখের জন্য সে প্রাণ দিতে পারে, মেয়ে সাধ করিয়া রাঁধিয়াছে, সে খাইবে না? উঠান রোদে ভরিয়া গিয়াছে, সেখানে ছায়া ফেলিয়া কালী তাহাকে পরিবেশন করিল, মাছের কালিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেমন হয়েছে বাবা?
বেশ হয়েছে। চমৎকার রেঁধেছিস কালী।'
কালীর পায়ের মলের আওয়াজ বাড়িটাকে যেন জীবন্ত করিয়া রাখিয়াছে। সে একাকিনীই ঘরভরা। এ বাড়িতে তার অতগুলি ছেলেমেয়ে যে পট-পট করিয়া মরিয়াছিল, কৈলাসের কাছে আর তাহা শোকাবহ স্মৃতি নয়। এমনি ভাবে ভাত বাড়িয়া দিয়া, এমনি ভাবে মল বাজাইয়া হাঁটিয়া কালী তার জীবনে শোকের চিহ্ন রাখে নাই, তার গৃহের আবহাওয়া হইতে মৃত্যুর স্তব্ধতা মুছিয়া লইয়াছে। কটা ছেলেমেয়ে আর তার মরিয়াছে? দুটা—তাও পাঁচ-সাত বছর বয়সে—একযুগ আগে। তবু, কালী না থাকিলে তাদের জন্যই কৈলাস শোকাতুর হইয়া থাকিত বই কি!
খাওয়ার পর বসিয়া বসিয়া কৈলাস খানিক তামাক টানিল। বেলার দিকে তার নজর ছিল না, ধীরেসুস্থে খাকী কোট কাঁধে ফেলিয়া সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইল।
কালী ছল ছল চোখে বলিল, এই রদ্দুরে কি ক’রে অতদূর যাবে বাবা ?
মেয়ের মমতায় মুগ্ধ হইয়া কৈলাস বলিল, জানিস কালী, তোর মা ঠিক অমনি ক’রে বলত। তারপর সান্তনা দিয়া বলিল, বিশ বছরের অভ্যেস, আর কি কষ্ট হয়? বলে, রোদে ঘুরে ঘুরে মাথার চুলে ছাই-এর রঙ ধরে গেল।"
ধূসর মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কৈলাস বাহির হইয়া গেল। কালী বলিয়া দিল, গাছের ছায়ায় জিরিয়ে জিরিয়ে যেও বাবা।"
মানুষের ছায়ায় যে জিরাইয়া জুড়াইয়া গেল, গাছের ছায়া দিয়া সে করিবে কি? বিশ বছরের দুবেলা চেনা পথ কাঠফাটা রোদে বোঝাই পেটে পথ চলিতে কৈলাসের মুখের হাসি কোন মতেই মুছিয়া গেল না। চেনা মানুষকে দাঁড় করাইয়া সে কুশল জিজ্ঞাসা করিল, যে ডাকিল দুদণ্ড বসিয়া তার তামাক খাইল, মেয়ে আজ তাকে কি রকম গুরুভোজন করাইয়াছে অনেক বাড়াইয়া তার বর্ণনা করিল। পোষ্টাপিসে পৌঁছনোর আগেই তার পেটে কেমন করিয়া মাংস সন্দেশ আর নাম না-জানা একটা ক্ষীরের খাবার হাজির হইয়া গেল।
নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আমার অমন মেয়ে, তার কীই বা আমি করলাম। চোখ কান বুজে একটা জানোয়ারের হাতে সঁপে দিলাম মেয়েকে। এমন ঝকমারি কাজ মানুষ করে।’
পোষ্টাপিসে পৌছিতে তার দেরী হইয়া গেল।
পোষ্টমাষ্টার বলিলেন, দিন কে দিন বড় যে নবাব হয়ে উঠছ হে কৈলাস!
“আজ্ঞে মেয়েটার বড় অসুখ বাবু।
পোষ্টমাষ্টার তার দুৰ্ব্বলতা জানিতেন, একটু নরম সুরে বললেন, ‘মেয়ের তো তোমার অসুখ লেগেই আছে।
কৈলাস উৎসাহিত হইয়া বলিল, সাধে অসুখ লেগে থাকে বাবু? মনের কষ্টে। জামাই যে মানুষ নয়, ডেকে জিজ্ঞেস করে না। একদিন-দুদিনের জন্য যদি বা আসে তো মেরে গাল দিয়ে ভূত ছাড়িয়ে দিয়ে যায়। মেয়ে আমার খায় না দায় না, দিবারাত্তির কাঁদছে—অসুখ হবে না ?
দ্রুত পটু হস্তে সে চিঠির তাড়া গুছাইয়া নিতে লাগিল। গলা নামাইয়া বলিল, “আপনার জামাইটি ভাল। আমায় সেদিন ডেকে বললেন, কৈলেস, অমন খাসা শাড়ী নিয়ে যাচ্ছ কার জনো ? আমি বললাম, মেয়ে পরবে জামাইবাবু, গরীবের মেয়ে হলে কি হয় মেয়ের আমার সখটি আছে পুরোমাত্রায়। জামাইবাবু হেসে কাপড়ের দাম জিজ্ঞেস করলেন, তারপর আমার হাতে টাকা গুজে দিয়ে বললেন, "আমায় একজোড়া এনে দিও তো কৈলাস। লুকিয়ে এনো। পোষ্টমাষ্টারের মুখের দিকে চাহিয়া চোখ মিটমিট করিয়া কৈলাস রহস্যটা তাকে বুঝাইয়া দিল, দিদিমণির জন্যে আর কি, তাই লুকিয়ে আনতে বলা।
তোমার মুখে দাগ কিসের কৈলাস?
কৈলাসের বকুনি থামিয়া গেল। সে সংক্ষেপে জবাব দিল ‘পড়ে গিয়েছিলাম।"
পোষ্টমাষ্টার সিন্দুক খুলিয়া টাকা বাহির করিয়া দিলেন। আজ ইনসিওর নাই, মনিঅৰ্ডারও কম। সই করিয়া টাকা লইয়া কৈলাস বলিল, “আমায় গোটা কুড়িক টাকা দিন।'
‘এবার হবে না কৈলাস। বলিয়া পোষ্টমাষ্টার মাথা নাড়িলেন। কৈলাস কোমরের কাপড়ের ভিতর হইতে একটা টাকা বাহির করিয়া পোষ্টমাষ্টারের টেবিলের উপর রাখিল। বলিল, আগাম সুদ দিচ্ছি বাবু দিন। মাইনে থেকে পাঁচ টাকা ক'রে কাটবেন, চারমাসেই শোধ হয়ে যাবে। নতুন তো নয়?
‘সুদের জন্য নয় হে!" পোষ্টমাষ্টার টাকাটা দুই আঙ্গুলে তুলিয়া লইলেন, কিন্তু পকেটে ভরিলেন না, কি জান, সাহস হচ্ছে না। কোনদিন ইনস্পেক্টর হুট করে এসে পড়বে, বলবে সিন্দুক খোলো। একেবারে ডুবে যাব তাহলে। তোমার কি বল, গায়ে তোমার আঁচড়টি লাগবে না, টানাটানি করবে আমাকে নিয়েই। মাথা নাড়িলেন একটা টাকার জন্য অতবড় ভয়ানক দায়িত্ব নিতে পারি না কৈলাস।”
একটা টাকা কি কম হ’ল বাবু!' কৈলাস অনিচ্ছার সঙ্গে একটা সিকি বাহির করিয়া দিল। টাকা আর সিকিটা পকেটে ভরিয়া পোষ্টমাষ্টার আবার সিন্দুক খুলিলেন। কুড়িটি টাকা বাহির করিয়া কৈলাসকে দিলেন। কথা আর তিনি বলিলেন না, নীরবে কাজ করিতে লাগিলেন। একটু লজ্জা বোধ হয়। যৎসামান্য।
হাটে পৌছানো মাত্র কৈলাসকে ঘিরিয়া ভিড় জমিয়া গেল। তার মধ্যে এমন নরনারীর সংখ্যা অল্প নয়, একটি পোষ্টকার্ড পাওয়া তাদের জীবনে বিশেষ ঘটনা। তাদের আগ্রহ ও উত্তেজনা কৈলাসকে চিরদিনই বিশেষভাবে বিচলিত করে। চিঠি বিলানো সকলের প্রতি তারই যেন অনুগ্রহ। ধনীর দারোয়ানের কাঙালী বিদায় করার মতই গৰ্ব্ব সে বোধ করে!
ছেলেবেলা কালী মাঝে মাঝে তার সঙ্গে হাটে আসিত। কৈলাসের ইচ্ছা হয় কালীকে এখন একবার হাট লইয়া আসে। সে দেখিয়া যায় হাট-ভরা লোক কি ভাবে তার বাপের পথ চাহিয়া থাকে, তাকে কত খাতির করে। কত লোককে সে হাসায়-কাদায়। অধর চিঠি পড়িয়া বলে, সুখবর এনেছ কৈলেসদা, যাওয়ার সময় ফুটিটুটি একটা কিছু তুলে নিয়ে যেও। বসন্ত চিঠি হাতে ধূলার উপর বসিয়া পড়ে। তার দেওয়া চিঠির খবরে হরিদাসী হাটের কলরব ছাপাইয়া আৰ্ত্তনাদ করিতে থাকে।
এসব দেখিলে কালী কি রকম আশ্চৰ্য্য হইয়া যায়।
শেষ দুপুরে প্রাপ্য তরিতরকারী সংগ্ৰহ করিয়া গামছায় বধিয়া কৈলাস পোষ্টাপিসে ফিরিয়া গেল। গুমোট হইয়া দারুণ গরম পড়িয়াছে। বিকালে ঝড়-বৃষ্টি হওয়া আশ্চর্য নয়। হাৰ্ম্মোনিয়মটা আজ তাহা হইলে আর কেনা হয় না। কিন্তু কালী পাঁচ মিনিটের নোটিশে কাল তার মান রাখিয়াছে, পুরস্কারটাও তাকে অবিলম্বে দেওয়া দরকার। কাল পর্যস্ত ধৈর্য কৈলাস ধরিতে পারবে না। অথচ দেরী করিয়া আসিয়া পাঁচটার আগে আজ ছুটি পাওয়াও মুস্কিল।
সে শ্রান্তি বোধ করিতেছিল। তবু বেঞ্চিতে চিৎ হইয়া খানিক ঝিমানোর ইচ্ছা ত্যাগ করিয়া সে পোষ্টমাষ্টারের বাড়ির মধ্যে গেল।
পোষ্টমাষ্টারের মেয়ে দাওয়ায় ছেলে কোলে লইয়া বসিয়াছিল, বলিল, “কি কৈলাস?”
‘সেই যে মাদুলির কথা বলছিলে দিদিমণি, আজ গেলে সেটা পাওয়া যায়।
পোষ্টমাষ্টারের মেয়ে সাগ্রহে বলিল, তবে তুমি আজকেই যাও কৈলাস।”
বাবু যদি রাগ করেন?
“আমি বলে রাখব।'
মাদুলি লইয়া পোষ্টমাষ্টারের মেয়েকে কৈলাস অনেকদিন ঠকাইতেছে। ঝিকণ ফকিরের মাদুলি আনা সহজ কথা নয়, একবেলা নৌকায় গিয়া সাত ক্রোশ হাঁটিলে তবে ঝিকণ ফকিরের আস্তানা। আজকাল করিয়া কৈলাস মাদুলির দাম বাড়াইয়াছে, এবার একদিন আধ পয়সা দিয়া একটা মাদুলি কিনিয়া তার গ্রামেরই জাগ্রত দেবতার পূজার ফুলের একটি শুকনো পাপড়ি ভরিয়া আনিয়া দিবে। বলিবে, দিতে কি চায় দিদিমণি, কত হাতে পায়ে ধরে আনলাম। পাঁচসিকে লাগল। না না, ও আর তোমাকে দিতে হবে না দিদিমণি। নিতে নেই গো, নইলে নিই না? মাদুলির খরচ বলে নয়, আমার মেয়েকে সন্দেশ খাবার জন্য যদি দাও তবে বরং নিতে পারি।"
এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কৈলাসের বিবেকের কোন প্রতিবাদ নাই। কালী ভিন্ন সংসারের আর সমস্ত মেয়ে তাদের কৰ্ম্মফল ভোগ করিবেই, ঝিকণ ফকিরের মাদুলিতে তাদের কোন উপকার হওয়া সম্ভব নয়। এটুকু ছলনায় তবে ক্ষতি কিসের? মাদুলিতে দেবতার ফুল তো থাকিবেই।
সকলের মত কৈলাসের আত্মপ্রবঞ্চনাতেও এমনি একটি সুন্দর শৃঙ্খলা থাকে। কালীর সম্বন্ধেও তার আত্মপ্রবঞ্চনা এমনি মনোহর। পোষ্টমাষ্টারের মেয়ের কাছে ঝিকণ ফকিরের মাদুলির মত কালীর জীবনে সুবল অনর্থক, মঙ্গল দূরে থাক এ দুটি মেয়ের দুঃখ মোচনও মাদুলি আর সুবলকে দিয়া হইবে না। একজনের জন্য সে তাই অকারণে সাতক্রোশ পথ হাঁটিতে যেমন রাজী নয়, আর একজনকে পরের বাড়ী পাঠাইয়া শূন্য ঘরে বুক চাপড়াইতেও তার তেমন ইচ্ছা নাই।
সতীশের বাড়ি পথে পড়ে না, একটু ঘুরিয়া যাইতে হয়। হাৰ্ম্মোনিয়ম কিনিয়া বাহির হইতে অপরাহ্ন হইয়া গেল। রোদের তেজ কমিয়াছে, কিন্তু হাৰ্ম্মোনিয়ম ঘাড়ে করিয়া পথ চলিতে কৈলাস শ্রান্ত হইয়া পড়িল। মনে হয় এতক্ষণে তার নেশা টুটিয়া গিয়াছে। কিন্তু নেশার সঙ্গে স্নেহকে সে ঝিমাইয়া পড়িতে দিবে কেন? সে জোরে জোরে পা ফেলিয়া চলিতে লাগিল।
আধ মাইল গিয়াই সে হাঁপাইয়া পড়িল। বাদ্যযন্ত্রের ভারে ঘাড়টা ইতিমধ্যে ব্যথা হইয়া গিয়াছে। পথের ধারে সেটা সে নামাইয়া রাখিল। পা দুটা বেজায় টন টন করিতেছে।
বয়স যে পঞ্চাশ পার হইয়াছে সেটা আর অস্বীকার করা যায় না। এই ধরণের প্রমাণ আজকাল প্রায়ই পাওয়া যায়। বয়সটা কৈলাসের গুরুতর বিপদ। কালীর জীবনের অৰ্দ্ধেকটা কাটিতে-না-কাটিতে তাকে মরিতে হইবে ভাবিতে কৈলাসের ভাল লাগে না। কালীর কি উপায় হইবে? কালীর ভার কে লইবে ?
সুবল লইতে পারিত। তার মৃত্যুর পরেও সুবল বঁচিয়া থাকিবে।
মৃত্যুর সঙ্কেত মানিয়া মেয়েকে তার নিশ্চিত দুঃখ-দুৰ্দ্দশার মধ্যে বিসৰ্জ্জন দিতে হইবে না কি? তার এত স্নেহ এত কল্যাণকামনা, এত ত্যাগ কোন কাজে লাগানো যাইবে না ; মাঝে মাঝে নেশার অবসাদের সময় কথাটা ভাবিয়া অসহায় আফশোষে কৈলাসের মাথা ঝিম ঝিম কবে। মরণে তার এমন নিশ্চিহ্ন নিশ্চিন্ত অবলুপ্তি যে কালীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু পরিমাণে হওয়া যায় এমন একটা জোড়াতালি দেওয়া যুক্তিও সহজে আবিষ্কার করা যায় না। তবু বসিয়া বসিয়া সে জোড়াতালি দেয়। ভাবে, সে তো আজই মরিতেছে না। দু-চার বছর গেলে সুবলের হয়ত পরিবর্তন হইতে পারে, সে মানুষ হইতে পারে। তখন কালীকে পাঠান চলিবে। সে আরও ভাবে যে কালীকে লইয়া যাইবার জন্য সুবলের যেরকম আগ্রহ তাতে এ আশা করা যায় তার মৃত্যুর পর মেয়েটাকে সে ফেলিবে না। তার সুবিধার জন্য কালীর প্রতি প্রেমকে সুবল দশ-বিশ বছর বাঁচাইয়া রাখিবে এটা কৈলাসের আশ্চর্য মনে হয় না। এই বিশ্বাস বজায রাখার জন্য সে একটা যুক্তিও ব্যবহার করে। সুবলের সঙ্গে কলহ তার; কালী কোনও অপরাধ করে নাই। কালী ছেলেমানুষ, বাপের ব্যবস্থা না মানিয়া তার উপায় কি? বাপের অপরাধে সুবল নিশ্চয় মেয়েকে শাস্তি দিবে না।
তাছাড়া, তার সম্পত্তি আর জমানো টাকা এবং কালীর মত রূপে গুণে দুর্লভ বউয়ের লোভ সুবল কি সহজে ত্যাগ করিবে?
আধঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করিয়া কৈলাস উঠিল। একটা লোক ধরিয়া তার মাথায় হাৰ্ম্মোনিয়ম চাপাইয়া গ্রামের দিকে চলিতে আরম্ভ করিল।
গ্রামের বাহিরে দেখা হইল বংশীর সঙ্গে।
বংশী বলিল, “কালীকে তাহলে পাঠিয়েই দিয়ে কৈলেস কাকা ?
"হুঁ বলিয়া কৈলাস শঙ্কিত হইয়া রহিল।
বংশী বলিল, সুবল গাড়ী খুঁজে হয়রাণ। সব গাড়ী গেছে হাটে, কোথায় পাবে গাড়ী? আমি বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, কালী আমায় ডেকে বললে, বংশীদা, একটা গাড়ী জোগাড় ক’রে দাও না? আমি শেষে রামগতি কাকার গাড়ীটা জুটিয়ে আনি তবে ওরা রওনা হয়।
কৈলাস বলিল, “দেখ দিকি কাণ্ড আগে থাকতে গাড়ী ঠিক ক’রে রাখবে, তা নয়,—সুবলটার একেবারে বুদ্ধি নেই।
'তোমার সঙ্গে দেখা হল না বলে কালী কেঁদেই অস্থির।
কেন, কাদল কেন? জষ্টি মাসেই তো ওকে আমি নিয়ে আসব।'
বংশী জ্ঞানীর মত বলিল, তাতে কি শানায় কৈলাস কাকা, শ্বশুরবাড়ি যেতে মেয়েরা কাঁদবেই। — হাৰ্ম্মোনিয়মটা তোমাব না কি? কার জনো কিনলে?
কার জন্যে আবার, নিজের জন্যে। খালি বাড়িতে কি ক’রে সময় কাটাব; ওটা বাজিয়ে প্যাঁ পো করা যাবে। তুই কোথায় যাচ্ছিস রে বংশী? সন্ধ্যের সময় এসে দুটো গানটান শুনিয়ে যাস তো ' ।
বাড়ি গিয়া জামা খুলিয়া কৈলাস তামাক সাজিযা লইল। কালী পাড়ায় কোথায় বেড়াতে গিয়াছে; তামাক খাইয়া সে স্নান করিল। চিনি খুজিয়া লেবু দিয়া সরবৎ করিয়া পান করিয়া রামগতির ওখানে গেল ।
রামগতি বলিল, কালীকে তা হ’লে পাঠাতে হ’ল কৈলাসদা ?
কৈলাস বলিল, হ্যাঁ, দিলাম পাঠিয়ে। কালী সতেরয় পড়েছে, আর কি রাখা যায়? তবে এবাব বেশী দিন রাখব না, জষ্টিব মাঝামাঝি নিযে আসব। পাঠাব একেবারে সেই পুজোর পর।’
রামগতি বলিল, ভালই করেছ। মানুষেব মন, কি জান দাদা, একেবারে আশ্চর্য। কালীকে পাঠাওনি বলেই হয়ত সুবল ওবকম হয়ে যাচ্ছিল, এবার বদলে যাবে। এতদিন কালীকে আটকে রাখা উচিত হয় নি।
কৈলাস বলিল, অতটা বুঝতে পারি নি।
সুবল আব একটা বিযে ক'রে বসলে কি বিপদ হ’ত বল ত ? কথাটা কৈলাস নিজেও অনেকবার ভাবিয়াছে, আজ রামগতির মুখে শুনিয়া সে শিহরিয়া উঠিল। ভাগ্যে কালী তাব পাগলামাতে সায় দিয়া নিজেব সৰ্ব্বনাশ করে নাই, গোপনে স্নেহ দিয়া সম্মান দিয়া বাপের অপমান ও অবিবেচনার বন্যাতেও নোঙর হইয়া স্বামীকে বধিয়া রাখিয়াছে।
রামগতি বলিল, একটু সিদ্ধি করব না কি ?
কৈলাস বলিল, বদনার ওখানে গেলে হয় না? থাক, কাজ নেই। সিদ্ধিই কর।’
গ্রামে সন্ধার পরই রাত্র। ঝাঁপ বন্ধ করা দোকানের সামনে- বেঞ্চিতে কাৎ হইয়া এমনি সময় বংশী বিড়ি টানে আর থাকিয়া থাকিয়া বাঁশী বাজার, রামগতির বৈঠকখানায় মাখম একটা কালি-পড়া লণ্ঠন রাখিয়া যায়, সিদ্ধির নেশায় কৈলাসের দু-চোখ স্তিমিত হইয়া আসে, খানিক পরে বাড়ি ফিরিয়া কালীকে দেখার চেয়ে একমাস পরে পাথুরেঘাটায় গিয়া কালীকে বাড়ি ফিরাইয়া আনার কল্পনা কৈলাসের বেশী মনোরম মনে হয়, আর ওদিকে গরুর গাড়ীব মধো কালী সুবলের সঙ্গে বক্ বক্ করে। -
বলে, তোমার জন্য বাবার কাছে মুখ দেখাবার উপায রইল না।
কিন্তু একমাস বলে তাকে আনিতে গেলে কালী অনায়াসে আসিয়া কৈলাসকে প্রণাম করে, বলে, ‘রাস্তায় কষ্ট হয়নি তো বাবা ? যে গরম!'
কারও লজ্জা নাই। নিয়ম পালনে লজ্জা কি? পদে পদে নিয়মলঙ্ঘন করিয়াই তো সংসারে লজ্জা ও দুঃখের সীমা নাই।
0 মন্তব্যসমূহ