উপদেশ মেনে লেখার মামলা জেতা যায় না : হাসান আজিজুল হক

লে খা র  ই শ কু ল

গল্পকার ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলে নবীন গল্পকার মেহেদী উল্লাহর সঙ্গে। মেহেদী উল্লাহ শক্তিশালী গল্পকার। তাঁর নিজের ভাবনাটি স্পষ্ট। ফলে এই প্রবীণ-নবীনের আলাপটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।  

আমি একবাক্যে বলতে পারি, তরুণরা নিজেরাই নিজেদের লেখার রাস্তা খুঁজে বের করবে। আমি এমন কোনো তালেবর লেখক নই যে তরুণদের লেখালেখির ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে পারি। যার যার লেখা তার তার রাস্তায় তাকেই নিতে হবে। আমি নিজেকে বড় লেখক মনে করিনি, আজও করি না, কোনো আত্মশ্লাঘা বোধ করারও কারণ নেই আমার। এই প্রশ্ন তরুণদের তরফ থেকে অভিজ্ঞ লেখকদের করা হয়ে থাকে, তারা কিভাবে লেখালেখি শুরু করতে পারে বা কিভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে।

আমি নিজের কথা বলতে পারি। কিভাবে শুরু করেছিলাম, কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমি কোনো তন্ত্রমন্ত্র শিখিনি যে এ রকম করলে লেখা হবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ক্রিয়েটিভ লিটারেচার পড়ানো হলেও মহান লেখকদেরও এই অভিমত, লেখালেখির সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া সম্ভব নয়। একটা বিশেষ প্রক্রিয়া মেনে গদ্য তৈরি হয় না, সাহিত্যও তৈরি করা যায় না।
যারা লেখক হতে চায়, আমি তাদের উপদেশ দিই না। উপদেশের মতো অকেজো আর কিছু হতে পারে না। মামলার ক্ষেত্রে উপদেশে জেতা যায়, কিন্তু লেখার মামলা জেতা যায় না। নিজের পথ নিজে খোঁজা উচিত, যদিও অন্তত জটিল কাজ; গহন অরণ্যে ঢুকেছি বলেই মনে হয়। সুন্দরবনের মতো সাহিত্যের পথ নিবিড় ও জটিল জালে আচ্ছন্ন। আমার কাজ কেউ করে দেবে না, পথ তৈরি করে সেই পথেই হাঁটতে হবে।
আমার জন্ম অজপাড়াগাঁয়ে। বাইরের সংস্কৃতি বলতে কিছুই ছিল না সেখানে। ছিল শুধু গ্রন্থ। আমি কৈশোরে বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরি শংকর ভট্টাচার্য, রমাঁ রলাঁ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কপার ফিল্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আলেকজান্ডার, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, আন্তন চেখভসহ বিভিন্ন লেখকের বই পড়েছি। পড়েছি রুশ ও ইংরেজি সাহিত্য। পৃথিবীর বড় লেখকরা তখন জীবিত ছিলেন, কৈশোরে আমি বড় লেখকদের বই পড়েছি।
অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম বলে শৈশবেই আমার চৈতন্যের সঙ্গে মাটির অভিজ্ঞতার সাক্ষাৎ। লাঙল তৈরি করা দেখেছি, কামার, কুমার, সূত্রধর- এ-জাতীয় পেশাজীবীর কাজ দেখেছি। মনে পড়ে, আমার গ্রামে কোনো ধোপাখানা ছিল না, বাবা বর্ধমানে কাপড় পাঠাতেন। ফলে আমি আমার পড়া থেকেই বাইরের পৃথিবী দেখেছি, অথচ লেখালেখিতে আমার কোনো পূর্বসূরি নেই, আমি পাইনি কাউকে। আমি ব্রাত্য, ভিক্ষাহীন, আমার অপরাধ বা সুকর্ম, বাংলা ছোটগল্প আমি প্রায় কিছুই পড়িনি।
১৯৬০ সালে লেখা 'শকুন' গল্পে আমি আমার চোখের দেখাই তুলে ধরেছিলাম। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার যোগ সামান্যই। এটি আমার নিজের ঘটনা, ফুটবল খেলার পর নিজের চোখের দেখা ঘটনা। প্রাত্যহিক ঘটনা থেকেই লিখেছি, সাবলীলভাবে লিখিত। 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' গল্পটিও একই উপায়ে লিখিত। আমার বেশির ভাগ গল্পই কল্পনা থেকে নয়, বাস্তব থেকে নেওয়া; শিখতে হয়নি আমাকে, কোনো কিছু থেকে নিইনি আমি।
গল্প লিখে ফেলার পর আমি নামকরণ করি। লিখে চলি সাবলীল ভঙ্গিতে, যা আসে মনে, যা দেখেছি জীবনে, লিখতে বসে লিখি। আগে থেকে কাঠামো বা প্লট ঠিক করে লিখি না। কাটাছেঁড়া করি না, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে লেখার পর নতুন কিছু আর যোগ করি না, তবে বাহুল্য বর্জন করি। গল্প বা উপন্যাসের জটিল নাম দেওয়ার অভ্যাস নেই আমার, সহজ নাম বাছাই করি গল্পের মূলকথা বা ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে। বর্ণনাভঙ্গিও সহজ-সরল আমার।
আজকাল গল্প-উপন্যাসে নিরীক্ষা হচ্ছে। নিরীক্ষা করুক, বাধা নেই, নিরীক্ষা আমিও করি, যেমনটি করেছি 'সাবিত্রী উপাখ্যান' উপন্যাসে। আঙ্গিকের নিরীক্ষা, কোমর বাঁধা নিরীক্ষা।
মুখ চলতি ভাষার পক্ষে আমি। পড়ামাত্র লোকে যেন বুঝতে পারে। তরুণরা এ নিয়ে উৎসাহী। এর যথাযথ প্রয়োগও কিন্তু জানতে হবে। তবে এ নিয়ে কোনো দলাদলির পক্ষে নই আমি।
কথা বলেছেন : মেহেদী উল্লাহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ