সাম্প্রদায়িকতা আমাদের এই ভূখণ্ডের গভীর অসুখ। এ অসুখ একই সঙ্গে মর্মঘাতী ও প্রাণঘাতী। এর কোনো নিরাময় এখনো পর্যন্ত মেলেনি। অদূর ভবিষ্যতে মিলতে পারে বলেও কোনো আশা দেখা যায় না।
এই অসুখের কবলে পড়ে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন। দেশ ছেড়েছেন। নিঃস্ব হয়েছেন। সমষ্টিগত বিষাদ বহন করতে হচ্ছে বংশ পরম্পরায়।
এর নিদান হিসেবে ধর্ম-সম্পদায় অনুসারে দেশভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অসুখ সারার লক্ষণ দেখা যায়নি। ১৯৫০, ১৯৫৪, ১৯৬৪ সালে রক্তক্ষয়ী হামলা ঘটেছে ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে।
অসাম্প্রদায়িক দেশ নির্মাণ করার আকাঙ্ক্ষায় বাংলার পূর্ব ভূখণ্ডে ৩০ লক্ষ মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ১৯৯২, ২০০১, ২০১৪, ২০১৬ সালে পুরনো কৌশলে সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল হেনেছে।
এই মর্মভেদী বিষয়গুলো নিয়ে গল্পপাঠের প্রকাশক মৌসুমী কাদের কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। আলাপে অংশ নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র, ইমতিয়ার শামীম, শমীক ঘোষ, মোজাফফর হোসেন, স্বকৃত নোমান, অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিচে সেই আলাপগুলো পত্রস্থ হলো।
প্রশ্ন ১. মৌসুমী কাদের :
ইদানীং ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ বিষয়টি নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে । সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ‘মানুষ’ আদৌ আছে কি? একজন লেখক কতটা অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন?

১. অমর মিত্র :
লেখক অসাম্প্রদায়িক হবেন তো নিশ্চয়। কোনো ধর্মের হয়ে কোনো ভাবেই ওকালতি করবেন না যেমন,উদ্দেশ্য মূলক ভাবে কোনো ধর্মের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন। তিনি মানব ধর্মে বিশ্বাস করবেন। ব্যক্তিগত আচার আচরণে তিনি ধর্ম ধর্ম করবেন না। হ্যাঁ লেখার জন্য তাঁকে হয়ত যে কোনো ধর্মের উৎস,দর্শন জানতে হয়।
১. ইমতিয়ার শামীম :
অসাম্প্রদায়িকতা বলতে কী বোঝাচ্ছেন তা যদি জানা থাকত, তা হলে হয়তো বুঝতে একটু সুবিধা হতো, অসাম্প্রদায়িক মানুষ থাকা না-থাকার এই সংশয়, সন্দেহ আর প্রশ্ন কেন আসছে।
তবে সাধারণভাবে আমার এরকমই ধারণা, আমাদের দেশের গড়পড়তা মানুষ অসাম্প্রদায়িকতা বলতে সহজ সরলভাবে ধরে নেয় যে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বা আরও যারা আছেন, তারা সবাই মিলেমিশে থাকবেন, কেউ কারও ধর্ম পালনে বাধা দেবেন না, আবার এমনভাবেও তা পালন করবেন না যে অন্য পক্ষ উত্যক্ত বোধ করবেন কিংবা কারও ধর্ম পালন না করাটাকেও সংকট বা বিপর্যয় হিসেবে দেখা হবে না। আমিও তেমনটা ধরে নিয়ে বলছি, তেমন মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, অবশ্যই আছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কি অসাম্প্রদায়িক নন? বিদ্যাসাগর কি অসাম্প্রদায়িক নন?
এটা শুধু আমার বিশ্বাস নয়, বাস্তবেও অসাম্প্রদায়িক মানুষ অজস্র; তবে দেশবন্ধু ও বিদ্যাসাগরের কথা আমি বিশেষভাবে বলছি এ কারণে যে, আমার নিজের ক্ষুদ্র বিবেচনায় গত ২০০ বছরে তাদের মতো আর কেউই সুনির্দিষ্টভাবে সামাজিকতা ও রাজনৈতিকতাকে সমন্বিত করে সাম্প্রদায়িকতা দূর করার লক্ষ্য নিয়ে একাগ্র হয়ে কাজ করেননি। এখনও অনেকে কাজ করছেন, তবে তা যত না সামাজিকভাবে, তারও বেশি রাজনৈতিকভাবে। এর ফলে তা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহত করতে উদ্বুদ্ধ করছে না। আপনি দেশবন্ধুর কথা ভাবুন, তিনি ফজলুল হকের সঙ্গে মিলে বেঙ্গল প্যাক্ট করেছিলেন। তা তখনকার মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার পর থেকে এতগুলো বছর গেল, ‘সংখ্যালঘুবান্ধব’ দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকারও কত বছর থাকল, অথচ সেই ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ (আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্য এইটুকু করেছে, এর নাম পাল্টিয়ে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন’ রেখে একটু জ্বালামুক্ত করার পর্দা লাগিয়েছে) সমস্যার সমাধান এলো না।
আমাদের বিশাল অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অবশ্য খুবই ধৈর্যশীল--এখনও আশায় বুক বেধে আছেন তারা--আওয়ামী লীগ সরকারই পারবে এ সমস্যার সমাধান করতে! তো, কথা হলো, মানুষ জন্মসূত্রেই কোনো না কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত, এতে তার সংযুক্তির একটি সম্প্রদায়গত চরিত্রও দাঁড়িয়ে যায়; কিন্তু একইসঙ্গে কি সম্প্রদায়ে, কি সমাজে সামাজিকীকরণের জন্যে তাকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েও যেতে হয়। এইভাবে সে বিকাশের প্রক্রিয়ায় এটাও বুঝে নেয়, সম্প্রদায়ের বৃত্তে আবদ্ধ থাকলে তার বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হওয়াটা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া; একজন ব্যক্তি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সংঘের যে কোনও একটির মিথস্ক্রিয়া থেকেই এই প্রক্রিয়ার খপ্পরে পড়তে পারে। একটি সমাজে পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংঘের মধ্যে আদর্শগত মিথস্ক্রিয়াই নির্ধারণ করে দেয় সে কতটুকু সাম্প্রদায়িক কিংবা অসাম্প্রদায়িক হবে; কোনও একটি থেকে সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত হলে আরেকটি সূচক আবার কতটুকু ক্ষতিপূরণ করতে পারবে।
আর একজন লেখক আদতে কতটা অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন, তার উদাহরণ দিতে গেলে তো রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেও এত বেশি উদ্ধৃতি-বক্তব্য পাওয়া যাবে যে ক্লান্তি এসে যাবে। রবীন্দ্রনাথের গল্পে উপন্যাসে অবশ্য মুসলমান চরিত্র নেই বললেই চলে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে তিনি এত ভেবেছেন, এবং এ সমস্যা নিয়ে তার বিভিন্ন গদ্যে এত চিন্তার দিগন্ত উন্মুক্ত করেছেন যে ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
১. শমীক ঘোষ :
প্রথমেই বলে রাখা ভালো এই প্রতিটা প্রশ্ন দেখেই আমি অসম্ভব বিরক্ত হয়েছি। প্রশ্নগুলো খুব প্রক্ষিপ্ত ,এবং বিশেষ একটি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি থেকে প্রভাবিত। বাংলাদেশে একদল মানুষ এই কথাটা খুব বলেন যে অসাম্প্রদায়িক বলে নাকি কিছু হয় না, বা ধর্মনিরপেক্ষ বলে নাকি কিছু হয় না। এই সব কথার মূলে এক ধরণের অসহিষ্ণু ইসলামের প্রভাব আছে। ইসলাম পৃথিবীর শেষ এবং শ্রেষ্ঠ ধর্ম তাহলে আর ধর্মনিরপেক্ষ হব কেন। এই লোকগুলো হয় শয়তান নয় বোকা। এই অসাম্প্রদায়িক মানুষ আদৌ নেই কথাটা বললে অন্য ধর্মের উপর অত্যাচারগুলো সহজেই জাস্টিফাই করা যায়। আবার ভারতের অতিদক্ষিণপন্থীরা অন্য একটা শব্দ আবিষ্কার করেছেন। ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা। তাদের বক্তব্য হল মুসলিমদের সমর্থনে কিছু বলাই নাকি আসলে ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা। এইটা বলে তারা মুসলমানদের উপর হিন্দু সংখ্যাগুরুর প্রভুত্ব আরোপ করার প্রক্রিয়াটা জাস্টিফাই করেন।
একজন লেখকের অসাম্প্রদায়িক হওয়ার কোন দায় নেই। যেমন দায় নেই সাম্প্রদায়িক হওয়ার। লেখকের কাজ মানুষকে নিয়ে। লেখা কোনো স্বাভাবিক কাজ নয়। একটা অস্বাভাবিক কাজ। একটা লোক হঠাৎ দুম করে লিখতে যাবে কেন? তার চেয়ে চাষ করা, চাকরি করা কিংবা ক্রিকেট ম্যাচ দেখা কিংবা সেক্স করা অনেক স্বাভাবিক কাজ। এইসব না করে একটা লোক যখন লিখতে বসে তখন বোঝা যায় তার নিজেকে কম্যুনিকেট করার একটা দায় আছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক দৈন্যন্দিন জীবনে কোথাও সে ঠিক করে কম্যুনিকেট করতে পারছে না। তার কিছু বলার আছে যেটা সে বলতে চাইছে। মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাইছে। অর্থাৎ সে নিজেও একজন প্রান্তিক মানুষ। এবং তার এই প্রান্তিকতাই তাকে বাধ্য করছে মানুষকে নিয়ে কাজ করতে। মানুষকে বুঝতে। প্রান্তিক মানুষ, একা মানুষ, হেরে যাওয়া মানুষ, যেমন হয়ত সে নিজেও। তাদের কথাই সে বলছে কারণ সে নিজের কথাই বলতে চাইছে। এমনকি সে মানুষের জীবনের নিপাট মজার কথাও বলতে চাইছে। কী সেই মজা? মানুষ ভাবে এক হয় এক। মানুষ নিজের জীবনকে এক খাতে নিতে চায়। জীবন তাকে অন্য খাতে নিয়ে যায়। এই আয়রনিটা লেখার উৎস। কারণ এই বোধটার উৎস থেকেই বোধহয় লেখালেখির শুরু। ফলে লেখক কখনও সাম্প্রদায়িক, যখন সে কোন একটি সম্প্রদায় নিয়ে কথা বলতে চায়। হয়ত হেরে যাওয়া সম্প্রদায়। আবার লেখক অসাম্প্রদায়িকই কারণ তার আসল পৌঁছানো আসলে এই সম্প্রদায়কে নিয়ে নয়। তার আসল পৌঁছানো আসলে সমগ্রের কাছে। সমগ্র মানব সভ্যতার কাছে। আর সমগ্রের কোন সম্প্রদায় নেই।
১. মোজাফফর হোসেন :
ইদানীং না। ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ লেখালেখির একটা চিরকালীন বিষয় বলা চলে। মানুষ যেদিন থেকে বিয়ে-থা করে পরিবার গঠন করেছে, সমাজবদ্ধ থেকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, সেদিন থেকেই বোধহয় নিজেদের সাম্প্রদায়িক হিসেবে আবিষ্কার করেছে। তাই ইতিহাস বলে, সাম্প্রদায়িকতা সেকেলে বিষয়। আফসোস মানুষ অনেককিছু ছেড়েছুঁড়ে বড্ড বেশি আধুনিক হল, কিন্তু এই ‘সেকেলে’বিষয়টি ছাড়তে পারলো না। অথচ এটিই আগে ছাড়ার দরকার ছিল। সাম্প্রদায়িক মানুষ আধুনিক হয় কি করে আমি বুঝি না!
একজন লেখক তো বটেই; একজন অতি সাধারণ মানুষও সত্যিকার অর্থেই অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন। এটা আমি বিশ্বাস করি। সুদূর ইতিহাসে নয়, আমি আমার আশেপাশেই এর অনেক দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। তবে এখানে একটা কথা আমি বলি, পৃথিবীতে আদৌতে পরম বা অ্যাবসুলুট বলে কোনো বিষয় নেই। একটু গলদ থাকবেই। কিন্তু মোটা দাগে মানুষ অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন। একজন প্রকৃত লেখককে সেটা হতে হয়। কোনো লেখক যদি সাম্প্রদায়িক মানসিকতার হোন, তবে তাঁকে আমি শিল্পী বলে মনে করি না। শিল্পী হওয়ার পূর্বশর্তই হল, একটা সাধারণ স্তর থেকে ইতিবাচকভাবে সম্মুখভাগে উঠে আসা। কেউ অসাম্প্রদায়িক হলো কিনা সেটি নিয়ে আমি ভাবি না। আমি ভাবি, সে সাম্প্রদায়িক হল কিনা। অর্থাৎ তার ভেতরে কোন ভাবটা স্পষ্ট—সেটা আগে ধরতে হবে। লেখকসহ যে কোনো শিল্পীদের ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক ভাবটা স্পষ্ট হলে তাঁর দ্বারা মহান সৃষ্টি প্রত্যাশা করা চলে না।
১. স্বকৃত নোমান :
সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষ নিশ্চয়ই আছে। আমি তো প্রায়ই ঘুরে বেড়াই। সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষের সন্ধান করে বেড়াই। হাটে মাঠে ঘাটে এমন অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, যারা প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক। তারা আমাদের মতো পুঁতিগত বিদ্যায় বিদ্বান নন। তারা সহজিয়া মানুষ। তারা অসম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করেন, লালন করেন, চর্চা করেন। তাদের নিয়ে আমি লিখেছিও বিস্তর।
নবী ও কবির মধ্যে ফারাক আছে। কবি মানে লেখক বোঝাচ্ছি। নবীর কাজ ধর্ম প্রচার। লেখকের তা নয়। লেখক তার পাঠকের বুদ্ধির মুক্তি ঘটান। বুদ্ধির মুক্তি ঘটলে যে কোনো মানুষ সাম্প্রদায়িক থাকতে পারে না। লেখককে প্রচলিত সকল ধর্মমতের উর্ধ্বে উঠতে হয়। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে আমি নাস্তিকতা বোঝাচ্ছি না। নাস্তিতা মানে অসাম্প্রদায়িকতা নয়। অসাম্প্রদায়িকতা মানে সব ধর্মমতকে অস্বীকার করাও নয়। পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে কিংবা নিত্য পুজা করেও একজন মানুষ অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন। এমন বহু অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমি দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিজয়া-সম্মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যে চাষী চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।’ তাঁর এই কথাতেই অসাম্প্রদায়িকতা নিহিত। লেখক হবেন ঠিক এমনই। সবাইকে তিনি সম্ভাষণ করবেন। মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবে দেখবেন। যে লেখক বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের গ-িতে আবদ্ধ, আমি তাকে লেখক মনে করি না। তিনি লেখক হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতে পারবেন না। তার সকল নিবেদনই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
১. অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় :
এটা একবারে বলা যাবেনা। তিন বা বেশিবার লাগবে। সেটা হোল- আছেন, আছেন,আছেন, এইরকম আর কি। যেভাবে একটুও ঘুষ খাননি এমন মানুষ আছেন, যেভাবে একদম খুন বা রেপ করেননি এরকম মানুষ আছেন, সেভাবেই আছেন। তবে কে কতদিন থাকেন, বা থাকবেন বা থেকে থাকেন, তার ডেটা নেওয়ার কাজটাও ইক্যুয়ালি ইন্টারেস্টিং।
পলিটিক্যালি কারেক্ট হলে প্রায় সবসময়ই পারেন। নাহলে, কাজটা শক্ত। ব্যক্তিস্বার্থে ঘা দিলে ‘কালেকটিভ আনকন্সাস' কি করে বলা মুশকিল। আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে আরও বড় মুশকিল। তিক্ততার, ইন্টলারেন্সের লিগাসি আমাদের নিউরনে। তবে অসাম্প্রদায়িক ছাড়া অন্য ‘অপশন' ছাড়াও বলব, অবস্থান ই আদৌ নেই। এটা নির্মাণ। যেখানে অপশন নেই, তা নিয়ে আমি ভাবিত না।


পলিটিক্যালি কারেক্ট হলে প্রায় সবসময়ই পারেন। নাহলে, কাজটা শক্ত। ব্যক্তিস্বার্থে ঘা দিলে ‘কালেকটিভ আনকন্সাস' কি করে বলা মুশকিল। আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে আরও বড় মুশকিল। তিক্ততার, ইন্টলারেন্সের লিগাসি আমাদের নিউরনে। তবে অসাম্প্রদায়িক ছাড়া অন্য ‘অপশন' ছাড়াও বলব, অবস্থান ই আদৌ নেই। এটা নির্মাণ। যেখানে অপশন নেই, তা নিয়ে আমি ভাবিত না।

প্রশ্ন ২. মৌসুমী কাদের
একজন মহৎ লেখকের দায়বদ্ধতার জায়গাটি থেকে অসাম্প্রদায়িকতার গুরুত্ব কতটুকু?

২. অমর মিত্র :
অসাম্প্রদায়িক না হলে কি মহৎ লেখক হওয়া যায়? লেখকের ধর্ম মানব ধর্ম। এই পৃথিবী, এই মহাপ্রকৃতি,এই জীবন আর সমাজ নিয়ে তিনি বাঁচবেন। ধর্ম নিয়ে নন। একজন মহৎ লেখকের দায়বদ্ধতার জায়গাটি থেকে অসাম্প্রদায়িকতার গুরুত্ব কতটুকু? লেখক সত্য উচ্চারণ করবেন। তিনি সংখ্যালঘু,সংখ্যালঘুর উপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে নিশ্চয় দাঁড়াবেন তার মানে সংখ্যাগুরুর ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ নয়। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মীর মতোই অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়াবেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক,সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংখ্যাগুরু উদারমনার সাহায্যও নেবেন।
২. ইমতিয়ার শামীম :
লেখকের কিংবা মহৎ লেখকের-যার কথাই বলি না কেন, শুধু দায়বদ্ধতার কারণে নয়, শান্তিপূর্ণ ব্যক্তি জীবনযাপনের জন্যেও তো অসাম্প্রদায়িকতার গুরুত্ব সীমাহীন। বঙ্কিমচন্দ্র, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ফররুখ আহমদ কিংবা এখনও আমাদের মধ্যে আছেন-আল মাহমুদ, এদের কথাই ধরুন-এই গুরুত্বকে দায়বদ্ধতার স্থান থেকে না নেয়ার কারণে তারা সমূহ ঔজ্জ্বল্য থাকার পরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছেন।
২. শমীক ঘোষ :
মহৎ শব্দটা একটা ফালতু শব্দ। মহৎ বলে কিছু হয় না। হতেই পারে না। লেখক তার সমকালের, সমাজের সৃষ্টি। তিনি তার সমকাল কিংবা সমাজের থেকে মহৎ, বৃহৎ কিছু নন। এইবার দায়বদ্ধতা। লেখকের কিসের দায়বদ্ধতা? মানে লেখক হঠাৎ দায়বদ্ধ হতে যাবেন কেন? তার নিজেকে প্রকাশ করার আছে। তিনি যা ভাবেন সেটাই তো প্রকাশ করবেন। এর মধ্যে দায়বদ্ধতা ঢুকল কোথা থেকে? এখন লেখক যদি ঋষিতুল্য কেউ হন, যিনি নিজেকে সমাজ-সংসারের থেকে বড় কিছু ভেবে বসেন, তাহলে তার দায়বদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু সেই দায়বদ্ধতা কার কাছে থাকবে সেটা তিনিই জানেন। আমার জানা নেই।
২. মোজাফফর হোসেন :
একজন মহৎ লেখক স্বকাল, স্বজাতি নিয়ে ভাববেন ঠিক আছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে তার ভাবনাটা গোটা বিশ্বের মানুষের জন্য পাথেয় উঠে আসবে। তলস্তয়, গোর্কি, নজরুলের মতো সমাজ-সচেতন লেখক থেকে গ্যেতে-রবীন্দ্রনাথ-দস্তয়ভস্কি ও জয়েসের মতো শিল্প-সচেতন লেখকরা সেটা করতে পেরেছেন। লেখকের দায়বদ্ধতার বিষয়টি আছে বলেই তো তাঁকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার হতে হবে। লেখকের দায়বদ্ধতা তো তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি একক দায়বদ্ধতা না; গোটা জাতি ও মানবকুলের প্রতি দায়বদ্ধতা।
২. স্বকৃত নোমান :
লেখক তো তার লেখার কাছেই দায়বদ্ধ। লেখক তার লেখার কাছে দায়বদ্ধ থাকলে আপনাতেই অসাম্প্রদায়িকতা এসে যাবে তার লেখায়। আর যদি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলি, তাহলে বলতে হবে, লেখক তো আর ইউটোপিয়ার অধিবাসী নন। যে কোনো একটা সমাজেই তার বসবাস। সেই সমাজের ভালো-মন্দের সঙ্গে তাকে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যে দেশের মানুষ এখনো রাস্তায় থুতু ফেলে, বাসের জানালা নিয়ে ঠেলাঠেলি করে, ধর্মের মোহে আরেকজনের মাথায় বাড়ি মারে, ধর্মের জন্য চাপাতি নিয়ে অন্যের ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ে, সেই দেশের কোনো লেখক সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন থাকতে পারেন না। থাকা উচিত নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাকে অসাম্প্রদায়িক হতেই হবে। হতে না পারলে, ঐ যে আগেই বলেছি, তার সকল নিবেদনই ব্যর্থ। তার মধ্যে আর একটি সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। বেহুদাই তিনি কাগজ-কালি নষ্ট করতে থাকবেন।
২. অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় :
দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল। অর্থাৎ কে কিসে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, শেষমেশ সেটাই বড় কথা, সেটাই তাকে চালনা করে। সাম্প্রদায়িকতা একটা নির্মিত অবস্থান। যেভাবে বেশ্যা বলে কিছু হয়না, সে ভাবে সাম্প্রদায়িক বলে কিছু হয়না। যিনি মহৎ হবেন, তিনি এই রদ্দি ‘সোশ্যাল কন্সট্রাক্ট' নিয়ে আদৌ সন্দিহান হন কি ? অনেকের জন্মগত ভাবে মহৎ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, কাউকে অর্জন করতে হয়। ‘মহৎ লেখক কিন্তু সাম্প্রদায়িক’,এটা একটা হাঁসজারু কিসিমের ব্যপার। যারা সাম্প্রদায়িক তারা বায়োলজিক্যালি মানুষ প্রজাতির মাত্র। তাদের নিয়ে সময় নষ্ট না করাই ভালো। এমনিই কাজের শেষ নেই।

প্রশ্ন ৩. মৌসুমী কাদের :
ব্যক্তি জীবনের ‘সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞতা’ লেখক হিসেবে প্রকাশ করবার সময় কতটা ‘নৈর্ব্যক্তিক’ হওয়া সম্ভব?

৩. অমর মিত্র :
ব্যক্তিজীবনে সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত থাকাই লেখকের প্রধান কাজ। আমি মন্দির এড়িয়ে চলি। হ্যাঁ ধর্মের দর্শন বুঝতে চেষ্টা করি। তার ইতিহাস তার রহস্যময়তা বুঝতে চাই। যে কোনো ধর্মের ক্ষেত্রে এইটিই হয়।
৩.ইমতিয়ার শামীম
এটি তো একপাক্ষিক ব্যাপার নয়--তিনি কতটা নৈর্ব্যক্তিক হয়েছেন সেটা বোঝা সম্ভব কেবল তখনই, যখন পাঠকও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে তা পড়তে পারবেন। একজন সাম্প্রদায়িক মানুষের পক্ষে তো কখনোই সাদত হাসান মান্টোর কিংবা কৃষণ চন্দরের রচনার বেদনা বোঝা সম্ভব নয়। তিনি বরং এটা পড়ে আরও বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেন। মীজানুর রহমান ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ লিখেছেন, আমার তো মনে হয় নৈর্ব্যক্তিকতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। বিষয়টা তাই পাল্টাপাল্টি দুই সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখানোর ব্যাপার নয়, নৈর্ব্যক্তিকভাবে উপলব্ধি করার।
অনেকের অতীত স্মৃতিচারণায় দেখি, হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে কত বিপত্তিতে পড়েছেন তারও বয়ান আছে। আসলে তিনি নিজেও তো অন্য ধর্মাবলম্বী হিসেবে গেছেন, নিজের সতীত্ব নাশ হওয়ার আশঙ্কা নিয়েও গেছেন, তাই ওইসব আচরণ বড় বেদনার মতো বেজেছে; এই বোধটুকু আর উচ্চকিত হয়নি, সাম্প্রদায়িকতা নয়--ব্যক্তির নিতান্তই সাধারণ ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্মাচারের স্থান থেকেও এমন হতে পারে। প্রতিটি লেখককেই একটা পর্যায় পর্যন্ত অ্যানথ্রপোলজিস্টও হতে হয়--নইলে এই নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত এই মুহূর্তে হঠাৎ একটি রাশান উপন্যাসের কথা মনে হচ্ছে। সেটি অবশ্য সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা নয়। বোধহয় তারাস বুলবা নামের ওই গল্প একজন গোত্রপ্রধানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে লেখা, সংকীর্ণতা নিয়ে লেখা; কিন্তু লেখক নৈর্ব্যক্তিক বলেই সেটি পড়তে পড়তে আমরা ওই গোত্রপ্রধানের মহীয়ানতাগুলো অনুভব করতে পারি এবং তিনি, কী বলব, প্রতিক্রিয়াশীল এটা উপলব্ধি করার পরও তার জন্যে কিন্তু আমাদের কষ্টও হয়।
৩. শমীক ঘোষ :
দস্তেভস্কি রাশিয়ার কথা লিখেছেন। কাফকা ক্ষমতার উন্নাসিকতার কথা। কুন্দেরার লেখার একটা প্রধান বিষয়বস্তু চেক কমিউনিজমের সময়কার অত্যাচার। মার্কেজ লাতিন আমেরিকার কথা লিখেছেন। এরা সকলেই খুব বড় লেখক। বিশ্বজনীন লেখক। অর্থাৎ এদের লেখার মধ্যে সম্প্রদায়ের চেয়েও বড় কিছু ছিল। সমগ্র মানবজাতির কথা ছিল। তারাশংকর বাঙালির কথা লিখেছেন। ইলিয়াস বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের কথা। অথচ আমরা কেউ বাঙালি বা বাঙালি মুসলমানকে জানতে এদের লেখা পড়ি না। আমরা পড়ি তার সাহিত্যমূল্যের জন্য। তাদের কল্পনা শক্তির জন্য। আমরা পড়ি তাদের মানবজীবনকে বোঝার দৃষ্টিভঙ্গিমার জন্য। ফলে এইগুলো সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞতা নয়। এইগুলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ভিতর থেকে মানুষকে বোঝার বোধের অভিব্যক্তি।
আর নৈর্ব্যক্তিক? লেখকের নিজের ব্যক্তিসত্তা না থাকলে তিনি বুঝবেন কী করে? নৈর্ব্যক্তিক লেখালেখি মূলত এক্সিস্টেনশিয়াল লেখালেখির মূল জায়গা। কারণ চরিত্রের এক্সিটেনশিয়াল কনফ্লিক্ট বোঝাতে লেখককে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু সেটা নৈর্ব্যক্তিক বলে আমার মনে হয় না।
৩. মোজাফফর হোসেন :
প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না। অল্পবোঝা থেকেই বলছি। কোনো লেখক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন কলম হাতে তুলে নেবেন তখন আর তিনি সাধারণ মানুষের মতো প্রতিহিংসাপরায়ন হতে পারবেন না। তাকে যৌক্তিক ও মানবিক পথ ধরে এগুতে হবে। একজন মানুষ যখন লিখতে বসেন তখন আর তাঁর ধর্ম হিন্দুধর্ম, ইসলাম ধর্ম বা এরকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে থাকে না। তাঁর ধর্ম তখন মানবতা। তিনি তখন মানবধর্মের পূজারি। তবে এর সঙ্গে তাঁর প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের কোনো ক্লেশ নেই। যে কারণে তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তিনজন তিন ধর্মের অনুসারী হলেও উচ্চারিত বাণী এক জায়গায় গিয়ে মেলে, সেটা হল অভাব-গ্লানি-বঞ্চনা-শোষণ থেকে মানুষের মুক্তি।
৩. স্বকৃত নোমান :
নৈর্ব্যক্তিক হওয়াটাই তো লেখকের সাধনা। এই সাধনায় তাকে জয়ী হতে হয়। অবশ্যই। নইলে তিনি লেখক কিসের?
৩. অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় :
সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞতা একটা ট্রমা। যারা এর মধ্যে দিয়ে গেছেন তারা জানেন। আমি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কবলে সেভাবে পড়িনি। আমার জন্ম-দেশ ভারতে আমি privileged গোষ্ঠীর লোক। মূলত আমার পদবীর ‘জোরে'। আমার 'গোষ্ঠীর' লোকদের নীচুজাত ও অন্য ধর্মের প্রতি অন্যায় করতে দেখেছি। পরিবারের অনেক সদস্যরাও করেছেন। কিন্ত আমি ধর্মের কারণে নির্যাতন ভোগ করিনি। যেভাবে কুলদা রায় দেশত্যাগ করেছেন, সে অভিজ্ঞতা নেই। তবে ট্রমা অনুবাদ করা শক্ত তা জানি। অনেক দলীয় কোঁদলে পড়েছি। বাড়িতে সম্পত্তির কোঁদলে, আমার মার অসুস্থতার সুযোগে আমায় অচেতন অবস্থায় মানসিক হাসপাতালে চালান করে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে বেরোনো সহজ ছিলনা। দীর্ঘদিন মান্ধাতার আমলের কু চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়েছিল আমার ওপর। সেসব লেখা সহজ নয়, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। মল্লিকাদি, সুবোধদা রা তাদের কাগজে ছেপেছিলেন বহু বছর আগে, কিছু চিকিৎসাকালীন সময়ের নড়বড়ে লেখা। ট্রমা পুনরুদ্ধার হয়না। লেখাতে সেই না পারার ছাপ এসে পড়ে। কেউ নৈর্ব্যক্তিক হতেই পারেন এই অন্তরযুদ্ধে। সেটা তার নিজের সাথে লড়াই।
অন্যদিকে, আরেক পারস্পেকটিভ থেকে বলছি, যেহেতু চাইলে নৈর্ব্যক্তিক থাকা সম্ভব। অনেকেই থাকেন। তবে রূপক, মেটাফর সময় সময় কাজে লাগতে পারে। ঋত্বিক মেলোড্রামাকে ব্যবহার করতেন ফর্ম হিসেবে। যারা ভয় পেয়ে নৈর্ব্যক্তিক থাকতে চান, তাদের সান্ধ্যভাষা কাজে লাগাতে দেখেছি একটা পিচ্ছিল আবরণ হিসেবে। কিন্তু যখন আপদ গোষ্ঠীরা সক্রিয় থাকে, যেমন কু-ক্লাক্স-ক্লান, বজরাং দল, আইসিস ও চাপাতি গোষ্ঠী; তখন সরাসরি না হয়ে উপায় আছে কি ?

প্রশ্ন ৪. মৌসুমী কাদের
সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে লেখক যখন কোন একটি সম্প্রদায়কে সমর্থন করতে বাধ্য হয় (যেমন সংখ্যালঘু) এবং তিনি যদি সেই একই গোষ্ঠিরই লোক হন তখন কি উপায়ে লিখলে ‘পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে’ বলে মনে হবে না।

৪. অমর মিত্র :
লেখক সত্য উচ্চারণ করবেন। তিনি সংখ্যালঘু , সংখ্যালঘুর উপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে নিশ্চয় দাঁড়াবেন তার মানে সংখ্যাগুরুর ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ নয়। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মীর মতোই অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়াবেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক , সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংখ্যাগুরু উদারমনার সাহায্যও নেবেন।
৪. ইমতিয়ার শামীম
আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু নিপীড়ন চলেছে। তখন রণেশ দাশগুপ্ত, নির্মল সেন, অজয় রায় কিংবা যতীন সরকারের মতো অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু এই জন্যে তাদের ‘পক্ষপাতিত্বের’ দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে বলে অন্তত আমি শুনিনি। তার মানে এই নয় যে, সমস্যা সুগভীর নয়। আসলে আমরা যে পথে নির্বাণ বা মুক্তি খুঁজেছিলাম, তাতেও তো কোনো না কোনো ভাবে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন রয়েছে। কথায় কথায় আমরা সাম্প্রদায়িকতার জন্যে ইংরেজ শাসনকেই চূড়ান্তভাবে দায়ী করে থাকি; কিন্তু ইংরেজ শাসন আসার অনেক আগেই ১৭৩০ সালে মুঘল সম্রাট ফররুখ শিয়ারের সময় দোলখেলা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের এমন এক দাঙ্গা হয়েছিল যা ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে তুলেছিল।
আমার চিন্তা ভুল হলে খুশি হবো, কিন্তু একটা ব্যাপার একবার ভেবে দেখুন তো--ইংরেজদের মতো শাসকরা দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে শাসন করলেও আমাদের ঘুম ভাঙল না, শেষমেষ আমাদের ঘুম ভাঙানোর জন্যে ১৮৫৭ সালে বলতে হলো, বারুদ-টোটা বানানোর সময় শুয়োরের চর্বি দেয়া হয়েছে, তাতে আমাদের মুসলমান ভাইদের ঘুম ভাঙল, আমাদের বলা হলো, গরুর চর্বি দেয়া হয়েছে, তাতে আমাদের হিন্দু ভাইদের ঘুম ভাঙল। ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ ধরে এগোলেও যুগান্তর ও অনুশীলনের সদস্যরা আমাদের নমস্য। এদের মধ্যে হিন্দু সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণই ছিলেন বেশি, তাই বলে মুসলমান ছাত্র, শিক্ষক ও যুবক যে ছিল না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু কী নিয়ম করা হলো? কালীমূর্তির সামনে গোপনীয়তা রক্ষার ও সহযোদ্ধাদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হবে।
সন্ত্রাসবাদিতায় দীক্ষা নেয়ার পরও মুসলমান তরুণরা তাই ধীরে ধীরে এই বিপ্লববাদ থেকে সরে এলো, তাদের কাউকে টাকাপয়সা সংগ্রহের, কাউকে ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হলো, কিন্তু প্রতিবাদের মূলধারায় তারা থাকলেন না। আমরা ১৯৪২ সালের মার্চে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ফজলুল হককে শেরে বাংলা বলে ডাকতে শুরু করলাম; কেন? কারণ এর আগে পাটনার এক জনসভায় তিনি ঘোষণা দিলেন, কংগ্রেসশাসিত প্রদেশগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর কোনো হামলা হলে বাংলায় তিনি তার প্রতিশোধ তুলবেন! ফজলুল হক কিন্তু বলতে গেলে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তিনি অভিজাত ছিলেন, সামন্তবাদী ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বোধহয় বলা যায় না। পরে তো পাকিস্তান আমলে ভারত সফরে গিয়ে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে যেসব কথা বললেন, সেসব কথাবার্তার ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তাকে রাজনীতিতে একঘরে করা হলো।
কিন্তু আমাদের এই যে বাগাড়ম্বর, পরস্পরের প্রতি আস্ফালন, এইসবই কিন্তু ইংরেজদের শিখিয়েছে, এদের ধর্মের নামে বিভক্ত করে রাখা যাবে, বিভক্ত হয়ে থাকার জন্যে এরা নিজেরাই মুখিয়ে আছে। অতীতের হিন্দু-মুসলমানদের ওইসব হ্যাঙওভার এখনও আছে, লেখকদের মধ্যেও আছে। কিন্তু এমন কোনও উপায় কি আসলে বাতলে দেয়া সম্ভব যাতে মনে হবে একই গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার পরও পক্ষপাতিত্ব করছেন না তিনি? এমন ব্যাকরণ দাঁড় করানো অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটা ভেবে দেখা যেতে পারে, আমরা যখন কাফকা কিংবা আনা ফ্র্যাঙ্ক পড়ি, দাঙ্গার বিভিন্ন ডায়েরি অথবা স্মৃতিচারণা পড়ি, এ জাতীয় লেখাগুলো পড়ি, তখন কি মনে হয় কোনো নির্যাতিত ধর্মাবলম্বীর কথা পড়ছি? নাকি উন্মূল কোনো মানুষের কথা পড়ছি? আমার মনে হয় ইস্যু আর অবস্থানই বলে দেবে, তিনি সঠিক পথে আছেন কি না।
৪. শমীক ঘোষ :
সমাজকে সংগঠিত করার কাজ রাজনীতিবিদের লেখকের নয়। সব লেখকই সংখ্যালঘু। কারণ সবাই লেখক নন। সবার নিজেকে প্রকাশ করার দায় থাকে না। ফলে লেখকেরও সংখ্যালঘুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এইবার লেখক অমুক গোষ্ঠির লোক তাই সেই গোষ্ঠির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট এমন কথা রাজনীতির লোকেরা বলবেন। তারা আসলে লেখা নিয়েই ভাবিত নন। বিরোধী মতকে দমিয়ে দিতে বেশী আগ্রহী। এদের নিয়ে লেখক ভাবতে যাবেন কেন? তসলিমা নাসরিন বা সালমান রুশদির বিরুদ্ধে যারা ফতোয়া দেয়, তারা কেউই এদের লেখা পড়েনি। ফতোয়া দেওয়াটাই এদের কাজ, কারণ এরা লেখককে ভয় পায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষভাবে। একইভাবে ডিক্টেটররাও লেখকদের প্রতিপক্ষ ভাবতেন। কারণ লেখক সত্যি কথা বললে তাদের সমস্যা।
৪. মোজাফফর হোসেন :
এক্ষেত্রে একজন লেখক নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে লিখবেন। ধরুন এখন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান সম্প্রদায়ের হাতে নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। দেশের একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী লেখক নিশ্চয় এই অনাচারের বিরুদ্ধে লিখবেন। তিনি নিজে ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত বলে লিখবেন তা কিন্তু নয়, তিনি লিখবেন সত্যের পক্ষ নিয়ে। মানুষকে তো আমরা নিরপেক্ষ হিসেবে কামনা করি না। আমরা চাই মানুষ সত্যের পক্ষ নিক। নিশ্চয় সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে লেখক তাঁর সগোত্রের হাহাকার-বঞ্চনার কথা লিখবেন। এটা তাঁর নৈতিক দায়িত্ববোধের ভেতর পড়ে। সাঁওতাল বা ওরাঁও জনগোষ্ঠী থেকে কেউ লেখক হলে তিনি দায়িত্ববোধ থেকেই সংখ্যালঘু হিসেবে সংখ্যাগুরুদের হাতে তাদের বঞ্চনার কথা লিখবেন। সাবল্টার্ন-ভয়েস হিসেবে তাঁকে তৈরি হতে হবে। তিনি এমন করে লিখবেন যেন তাঁর লেখার স্বরের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখক। বাংলাদেশে প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার লিখছেন নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখছেন। তাঁদের কি আমরা কখনো সাম্প্রদায়িক চেতনাপুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবো?
৪. স্বকৃত নোমান :
লেখক কোনো কিছুতে বাধ্য নন। হতে পারেন না। বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ বা খৃষ্টান সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি যেমন সোচ্চার থাকবেন, বাংলাদেশে শিয়া বা আরাকানে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থাকবেন। নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়কে তিনি সমর্থন করবেন কেন? হ্যাঁ, ক্ষেত্রবিশেষ যদি তিনি সমর্থন করতে বাধ্য হনও, সেটা তার ব্যক্তিসত্তার বাধ্যতা। সামাজিক সত্তার বাধ্যতা। লেখকসত্তার নয়। লেখার সময় তার এই বাধ্যবাধকতা থাকবে না। লেখায় তা প্রতিফলিত হবে না। লেখায় তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন। এই নিরপেক্ষতা নির্যাতিত গোষ্ঠীর পক্ষে চলে গেলে তাতে লেখকের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হবে না। কারণ তিনি তো সমাজিক বাস্তবতাকে লেখায় এনেছেন। যেমন বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। লেখক যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের হন এবং এই নির্যাতনের কথা লেখেন, তাতে তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হবে না। কারণ তিনি তো সমাজিক বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছেন।
৪. অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় :
এদেশে আমি সংখ্যালঘু। Immigrant ও উওমান অফ কালার। আমার জন্ম-দেশ ভারতে আমি privileged গোষ্ঠীর লোক। মূলত আমার পদবীর ‘জোরে'। ফলে গুরু-লঘু দুইয়ের অবস্থান আমায় সতর্ক করেছে। এদেশে এসে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে অবস্থান নেওয়ার সময় ‘অপর' কে জেনারালাইজ করার প্রবনতা আমার মধ্যে লক্ষ্য করেছি। একে কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। কারণ আনকন্সাস এরও প্রভাব আছে। নিজেকে ভালনারেবেল ভাবা এইসব। তবে বাইনারিতে না ভাবা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। এটা অভ্যাস করার যতটা পারি চেষ্টা করি। মহৎ লেখকদের লেখার ধাঁচা থেকে অনুকরণ করে বায়াস বর্জন করার চেষ্টাটাও একটা অভ্যাস। সু অভ্যাস। এই অভ্যাস-পালন দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেটাই শিল্প চর্চার উদ্দেশ্য। এর কোন সলিড ফর্মুলা আছে বলে আমি জানিনা। নিজের কথা, বা যে গোষ্ঠীকে সমর্থন করছি তা গুছিয়ে বলতে পারাটাই জরুরী। তার জন্যে পক্ষ নিতে হয়, কিন্তু বায়াসড পক্ষপাতের তেমন প্রয়োজন পড়েনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে সেটাই যথেষ্ট পাওয়ারফুল।

প্রশ্ন ৫. মৌসুমী কাদের :
লেখক যখন স্বার্থপর হয়, আত্মপ্রচারণায় মগ্ন থাকে, ‘মানুষ এবং মাধ্যম’ উভয়কে ব্যবহার করে, নির্লজ্জ আত্মপ্রচার এবং স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং একসময় সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়, এমনকি মহৎ লেখকের খেতাবও অর্জন করে; নব্য লেখকরা কী ভাবে তাকে গ্রহণ এবং অনুসরণ করবে?

৫. অমর মিত্র :
শেষের প্রশ্নে একটিই কথা অত সব গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি কি মহত্তম লেখক হন? তাঁর মনের ছায়া কি লেখায় পড়ে না? তা নষ্টই করে লেখাকে। তাঁকে কি নব্য লেখকরা গ্রহণ করেন? ধার্মিক হওয়া আর সাম্প্রদায়িক হওয়া এক বিষয় নয়। ধর্ম পালন করেন এমন বড় লেখক আমি দেখেছি। তিনি কুসংস্কার,অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা নিয়ে নিশ্চয়ই জীবন যাপন করেন না। যাঁরা করেন তা তাঁরা কি মহৎ লেখার জনক? ধর্ম আর ক্ষমতার অন্ধকারের বিরুদ্ধেই ত তিনি লিখবেন। ধর্ম এখন ক্ষমতা অর্জনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। লেখক যদি ক্ষমতার বিরুদ্ধে যান ধর্মের বিরুদ্ধেও যাবেন নিজের অজান্তে।
৫. ইমতিয়ার শামীম ;
এমন কোনো কোনো ‘মহৎ লেখক’ এখনও জীবিতও আছেন। নতুন লেখকরা তাদের প্রতি যে আচরণ করেন তা থেকেই বোঝা যায়, তাদের জন্যে কোন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। মন্তব্য তাই নিষ্প্রয়োজন।
৫. শমীক ঘোষ :
সব লেখকই স্বার্থপর। নইলে লিখে সময় নষ্ট না করে অন্য কিছু করত। হয়ত বন্যাক্রাণ বা বস্তি সংস্কার বা এমন কিছু ‘মহৎ’ কাজ। সব লেখকই আত্মপ্রচার চায়, নইলে লেখা ছাপাত না। নির্লজ্জ আত্মপ্রচার স্বার্থসিদ্ধি এইগুলো ব্যক্তির কাজ, লেখকের নয়। আমি লেখকের লেখা নিয়ে উৎসাহী। তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে নয়।
৫. মোজাফফর হোসেন :
আত্মপ্রচার ও মিডিয়াবাজি করে কি বড় লেখক হওয়া সম্ভব? পৃথিবীর সাহিত্য-ইতিহাসে কেউ হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তাই বলি, এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। হয়ত কিছু সময়ের জন্য মনে হতে পারে, তিনি বড় লেখক। কিন্তু সময় বড় নির্মম। নব্য লেখকদের উচিত এসব অগ্রাহ্য করতে শেখা। রবার্ট ফ্রস্ট তো অক্তাভিও পাসকে বলেছেন, তরুণ কবিদের প্রথম কাজ হবে তার আগের কবিদের অস্বীকার করা। তিনি অবশ্য শিল্পের জায়গা থেকে কথাটা বলেছেন। আমি এটা এক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি।
৫. স্বকৃত নোমান :
এগুলো লেখকের ব্যক্তিগত সমস্যা। অনেক লেখক এসব সমস্যায় আক্রান্ত। এসব সমস্যার কারণে তিনি একা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তার জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন না। দেখতে হবে, তার এসব সমস্যা তার লেখায় চলে এলো কিনা। লেখায় যদি চলে আসে তিনি নবীনদের কাছে পরিত্যাজ্য হবেন। কিন্তু লেখায় যদি তিনি সৎ থাকেন, আপোস না করেন, তাহলে অবশ্যই তিনি নমস্য। বাল্মিকী তো এক কালে ডাকাত ছিলেন। তাতের রামায়ণের কী ক্ষতি হলো? ‘কবিকে খুঁজো না তার জীবনচরিতে’। রবীন্দ্রনাথের কথা। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে আল মাহমুদ ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক হলে অসুবিধা কোথায়? উত্তরটা হচ্ছে, আল মাহমুদ ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক নন। জামায়াত। জামায়াত আর ধর্ম এক জিনিস না। ধরে নিলাম এক জিনিস। কিন্তু আল মাহমুদ ব্যক্তিজীবনের সীমাবদ্ধতাকে লেখায় প্রকাশ করেছেন। বখতিয়ারের ঘোড়া তার প্রমাণ। এ কারণে তিনি পরিত্যাজ্য। তাকে গ্রহণ বা অনুসরণের কিছু নাই।
৫. অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় :
এর উত্তর তো আপনিই প্রায় দিয়ে দিয়েছেন। নব্য লেখক তার ক্রাফট নেবেন, কন্টেন্ট আনবায়াসড হলে নেবেন, ভাববেন। নয়ত ফেলে দেবেন। বাকী যেসব অপূর্ব চারিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করলেন, তা কি নেওয়ার মত কিছু? শতাব্দী থেকে শতাব্দী যেতে দু-একজন শিল্পী অমরত্ব পান। আমাদের পরিশ্রম করার দরকার কি? এমনিই তো মুছে যাবেন।

প্রশ্ন ৬. মৌসুমী কাদের :
সরকার, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখার সময় একজন সংখ্যালঘু লেখকের ভয় কাটিয়ে ওঠার উপায় কি?


৬. অমর মিত্র :
-----------------
৬. শমীক ঘোষ :
এটাও ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রশ্ন। লেখক কী লিখতে চান সেটা তারই বিবেচ্য। অন্য কারুর নয়। তিনি ভয় পেতেও পারেন। নাও পেতে পারেন। লেখক ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন এটা স্বাভাবিক সত্য। কারণ ক্ষমতা সব সময় আগ্রাসী এবং বিনষ্টকারী। ক্ষমতা ব্যক্তিগতকেও কুক্ষিগত করতে চায়। লেখক ব্যক্তিগত কারণেই লেখক হয়। ফলে সে এতে সমস্যায় পড়বে এটাও ঠিক। ক্ষমতা লেখককে প্রতিপক্ষ ভাবে। ফলে সে ভয় দেখাবেই। এইবার কী করে ভয় কাটিয়ে উঠবে এটা একজন সাইকোলজিস্ট বলতে পারেন। আমি নই।
৬. ইমতিয়ার শামীম :
তিনি সত্যিই কোনো লেখক হলে অন্তত লেখার সময় তো তার ভয় পাওয়ার কথা নয়। হ্যাঁ, লেখা শেষ হওয়ার পর পাঠক হিসেবে পড়তে গিয়ে তিনি তা প্রকাশের পর নিজের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা আবিষ্কার করে সংশয়ে পড়তে পারেন, ভীত হতে পারেন; কিন্তু লেখার আগেই সে প্রশ্ন আসছে কেন? ধারণাগত দিক থেকে একজন সত্যিকারের লেখকও তো সংখ্যালঘুই। দেবীপ্রসাদ যখন ‘যে গল্পের শেষ নেই’ লেখেন, তখন তো তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার পরও সংখ্যালঘুই হয়ে পড়েন, রফিক আজাদ যখন ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’ লেখেন তিনিও তখন সংখ্যালঘুই হয়ে যান। তারা এসব লিখতে গিয়ে নিজেদের অযথাই যেমন দুঃসাহসী ভাবেননি, তেমনি ভীতও ভাবেননি। তারা তাদের হৃদয়ের কথা শুনেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের পাণ্ডুলিপি দিনের পর দিন অপ্রকাশিত থেকেছে, কিন্তু লেখার সময় তিনি ভয়ে কুঁকড়ে যাননি। হয়তো তা যথাসময়ে প্রকাশ করতে পারেননি, সেজন্যে অপেক্ষা করেছেন। প্রসঙ্গত শরৎচন্দ্রের কথা বলি। শরৎচন্দ্র যখন ‘পথের দাবি’র মতো বই লিখে সংখ্যালঘু হয়ে গেলেন, তার বইও বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল, তখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বই পাঠিয়ে প্রতিবাদ প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তুমি কাগজে রাজবিরুদ্ধ কথা লিখলে (মানে ধরুন আজকের এই কলাম লেখা) তার প্রভাব স্বল্প ও ক্ষণস্থায়ী হত--কিন্তু তোমার মতো লেখক গল্পচ্ছলে যা লিখবে তার প্রভাব তো নিয়ত চলতেই থাকবে।’ তিনি এ-ও বললেন, ‘শক্তিমানের দিক দিয়ে দেখলে তোমাকে কিছু না বলে, তোমার বইকে চাপা দেয়া প্রায় ক্ষমা করে দেয়া।’
রবীন্দ্রনাথ যে শরৎকে কত বড় শক্তিমান লেখক মনে করতেন, তা বোঝার জন্যে এই একটি বাক্যই যথেষ্ট। কিন্তু তার পরও শরৎচন্দ্র এরকম একটি চিঠি পাওয়ার ক্ষোভ সারা জীবন বয়েছিলেন। হয়তো তা রবীন্দ্রনাথের লেখা এই কথাগুলো খেয়াল করেই, ‘শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সওয়ার জন্যেও তৈরি থাকতে হবে।’ তাই সরকার, রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে ক্রিটিক্যালি কিছু লিখতে চাইবেন, অথচ লেখার আগেই ফলাফল চিন্তা করে নেবেন, এমন অদ্ভূত প্রত্যাশাই যদি থাকে, তা হলে আপনার না লেখাই ভাল।
৬. মোজাফ্ফর হোসেন :
সরকার, রাজনীতি, ধর্ম এসব নিয়ে লেখার ভয় কেবল সংখ্যালঘু লেখকের নয়, সব লেখকের। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়কে যেমন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তেমনি অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকেও নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলমান লেখকই হামলার শিকার হয়েছেন বেশি। আমরা হুমায়ুন আজাদ-শামসুর রাহমানের কথাও বলতে পারি। সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মানুষ হয়ে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন এখনো নির্বাসনে। তাই এই ভয় কাটিয়ে ওঠার কোনো সরল-সাদা পন্থা আছে বলে আমার জানা নেই। রাষ্ট্র-সরকার সবসময় চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে, এই কারণে বরাবরই রাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তচেতনার লেখকদের দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। যে রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকুক, একজন প্রকৃত মানবতাবাদী লেখক তার বন্ধু হয়ে বেশিদিন থাকেন না। থাকতে পারেন না বলেই থাকেন না। একজন লেখককে সব মানুষের কথা বলতে হয়। রাষ্ট্র তো সব মানুষকে সমান চোখে দেখে না। দ্বন্দ্ব এখানে আসবেই।
তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লেখককে ইসলামধর্ম নিয়ে লিখতে হলে অবশ্যই সাবধানী হতে হবে। একজন মুসলমান লেখক যেভাবে ইসলাম ধর্মের প্রচলিত সংস্কৃতি বা আচারের সমালোচনা করতে পারবেন, একজন হিন্দু লেখক সেভাবে পারবেন না। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট অন্তত সেটা করলে সমস্যা হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে ভয় কাটিয়ে ওঠার উপায় হল, কিছুটা আপোষ করে কিংবা কৌশলী হয়ে লেখা। কিন্তু লেখকের স্বভাবই হল, দিন শেষে সত্যটা বলে ফেলা। এই স্বভাবের কারণেই লেখকরা পৃথিবীতে এখনো শ্রদ্ধার পাত্র। তাই আমি নিজে চাই ভয়কে পাশ কাটিয়ে সত্যটা কেউ বলুক।
৬. স্বকৃত নোমান :
ভয় থাকলে তো তিনি লেখক হতে পারবেন না। লেখকের পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। প্রয়োজনে তাকে মস্তক বন্ধক দিতে হয়। চলে যাক কল্লা, তবু তিনি লিখবেন। এই সাহস না থাকলে লেখালেখি বাদ দিয়ে বরং তিনি হাল চাষ করুন, তাই ভালো।
৬. অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় :
সম্ভবত উত্তর একটাই, সাহস বেশী, লোভ কম। সাহস মানে, চাপাতি, থ্রেট এইসব কে মোকাবিলা করতে পারার মত সাহস। যার যতটা থাকে। আর পুরষ্কার, রাজ অনুগ্রহের লোভ এড়িয়ে যেতে পারা। এ ক্ষেত্রেও যে যতদিন পারেন। অনেককেই আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়, একটা সময় পর। প্রতিষ্ঠান বা শাসকের ক্ষমতার, অনুগ্রহের বাইরে লাইক মাইন্ডেড দের প্রতিষ্ঠান ও শাসক বিরোধী সংগঠনের ছাতা বড় করতে হবে। যেখান থেকে সরকার, রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে আনবায়াসড লেখা ছাপানো সম্ভব হবে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এর কুশাসনের প্রতিরোধে রাস্তায় নেমেছি, প্রাণ ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধপূর্ণ অঞ্চলে গেছি, থেকেছি, ছবি করেছি। তার সাহসটা কিন্তু তখন পেয়েছিলাম, সহমত মানুষরা একসাথে জোট বাঁধতে পেরেছিলাম বলে। রাত একটা তেও অকুস্থল থেকে শঙ্খ ঘোষ বা মহাশ্বেতাদি'র মত মানুষ দের ফোন করতে ভয় পাইনি। পরে ভেবেছি যাদের দেখলে এক সময় আমাদের জিভ সরতনা, তাদের রাত-বেরাতে এমন ফোন করার সাহস এলো কি করে। সমর্থন। তার থেকে। সরকার, কুশাসনের রাজনীতি নিয়ে তখন সিপিএম, শাসক বিরোধী জোটবদ্ধতা তুঙ্গে। এটা প্রথমে ছিলনা। সিপিএমের বিরোধিতা করা একজন বামপন্থী হয়ে সহজ ছিলনা। ছোটো ছোটো জমায়েত, ছোটো ছোটো লেখা, পত্রিকায়, লিফলেটে এগুলো করতে হয়েছে। তারপর মিডিয়া এসেছে এই প্রতিরোধ তুলে ধরতে। অনেকে নতুন সরকার হলে পদ পাবেন ভেবেও ঝাঁপিয়েছেন। পদ পেয়েওছেন। কিন্ত অল্প হলেও অনেকেই নতুন সরকার আসার পর ‘সিপিএমের বিরুদ্ধে ছিলাম’, এই তকমা খাটিয়ে কিছু প্রাপ্তির চেষ্টা করেন নি, এরকমও তো আছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ মানুষকে জোটবদ্ধ হতে আটকায়। পুরস্কার মূলত ব্যক্তি মানুষকে দেওয়া হয়। শিল্পী খেতাব চান। তাই তাকে প্রতিষ্ঠানকে খুশি করতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে, সহমত মানুষদের জোট বদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কিছু আমার চোখে পড়েনা।
একা হতে হতেই মানুষ সমর্থন বর্জিত ও সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। প্রভাবশালী শিল্পীদের কাছে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে গিয়ে সমর্থন আদায় করতে হবে। লেখক একজন সমাজ কর্মী। ঘরের কোণে, একা লিখে, বাজারী লিখে পুরস্কার পাওয়ার মানসিকতায় সরকার, রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে লেখা সম্ভব না। সুতরাং যিনি লিখবেন, তাকে এই রকম ছাতার খোঁজ করতে হবে, আর এই ছাতা গুলিকেও লেখকদের সুরক্ষা নিয়ে অ্যাক্টিভ হতে হবে, আইনের সাহায্যও ভেবে রাখা জরুরী বলে মনে করি। অনেকেই সুরক্ষাহীন অঞ্চলে থাকেন। আসল লড়াইটা তাদেরই করতে হয়। তাদের সুরক্ষার আওতায় কি করে আনা যায় ভেবে দেখতে হবে। সমর্থন ও সুরক্ষার আশ্বাসের ক্ষেত্রে আরও অনেক সঙ্খ্যালঘু লেখক ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেন।
একা হতে হতেই মানুষ সমর্থন বর্জিত ও সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। প্রভাবশালী শিল্পীদের কাছে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে গিয়ে সমর্থন আদায় করতে হবে। লেখক একজন সমাজ কর্মী। ঘরের কোণে, একা লিখে, বাজারী লিখে পুরস্কার পাওয়ার মানসিকতায় সরকার, রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে লেখা সম্ভব না। সুতরাং যিনি লিখবেন, তাকে এই রকম ছাতার খোঁজ করতে হবে, আর এই ছাতা গুলিকেও লেখকদের সুরক্ষা নিয়ে অ্যাক্টিভ হতে হবে, আইনের সাহায্যও ভেবে রাখা জরুরী বলে মনে করি। অনেকেই সুরক্ষাহীন অঞ্চলে থাকেন। আসল লড়াইটা তাদেরই করতে হয়। তাদের সুরক্ষার আওতায় কি করে আনা যায় ভেবে দেখতে হবে। সমর্থন ও সুরক্ষার আশ্বাসের ক্ষেত্রে আরও অনেক সঙ্খ্যালঘু লেখক ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেন।
0 মন্তব্যসমূহ