হঠাৎ খেয়াল হলো সীমানা পেরিয়ে এসেছি। সীমানা বলতে সংকীর্ণ একটা খাল। ওপরে কালভার্ট রাস্তাটা কালভার্ট পেরিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত।
আমার বাড়ি খালের উত্তরে। হাঁটতে হাঁটতে এদিকে, অর্থাৎ দক্ষিণে চলে এসেছি। অন্য এলাকা । সাবধানতা চলে এল আপনাআপনি। এখানে হঠাৎ কোনো লোকের সাথে ঝগড়া বেঁধে গেলে— সেটা যদি তার নিজের দোষেও হয়, ব্যাপারটা আমার পক্ষে কতদূর নিরাপদ হবে বলা যায় না। ফুটপাতের দােকানগুলোর জিনিসপত্র আমার অসতর্ক হাত বা পায়ের ছোঁয়ায় যদি এদিক-ওদিক সরে যায়, কেউ ছাড়বে না। আমায়।
এই দক্ষিণে মাঝে-মধ্যে সন্ধ্যার দিকে সময় সুযোগ পেলেই হাঁটতে চলে আসি; সীমানা পেরিয়ে৷ উত্তরের তুলনায় এদিকটা একটু ফাঁকা। চেনা লোকজন কম থাকায় হাঁটাচলায় বাঁধাও পড়ে কম। তাছাড়া বাড়ি থেকে দূরত্ব তো আর বেশি নয়।
আর-একটু এগোতেই থামতে হলো। কঁধে একটা হাত। মনে হলো বেশ ভারী। লোকটাকে চেনা চেনা লাগল। বলল, “কী ব্যাপার, এদিকে কোথায় ?”
মাথায় এল না ঠিক কোথায় দেখেছি বা আলাপ হয়েছে।
“হাঁ... এই পায়চারি করছি.. একটু সান্ধ্যভ্রমণ আর কি.”
সে সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করল, “সুগার বেড়েছে? কত এখন ?” লোকটার মুখে অর্ধেক হাসি। সেটা সৌজন্য নাকি অনুসন্ধানের ছদ্মবেশ ? শুধু শুধু পায়চারি করা; তাও আবার অন্য পৌরসভা, অন্য বিধানসভা এলাকায়— ঠিক জাস্টিফাই করা যাবে কি-না কে জানে। সপ্রতিভভাবে বলার চেষ্টা করলাম, “হ্যা হ্যা। তা বেড়েছে বটে খানিকটা। একেবারে বর্ডার লাইনে।”
যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে ওকে ছেড়ে এগিয়ে গেলাম যাতে মনে না করে, পালাচ্ছি। এই দক্ষিণেরও দু’চারটে লোককে যে চিনি না, তা নয়। একটু থেমে রাস্তার একপাশে এসে মোবাইল বের করে সামান্য ঘেঁটে নিলাম।
নাঃ । এদের কারো নম্বর সেভ করা নেই। গত পূর্ণিমার রাতে এখানে একটি মেয়ে লাশ হয়েছে। এখানে মানে দক্ষিণে, লোকগুলো নাকি উত্তরের, মানে আমার এলাকার। মেয়েটার শরীরে কিছু ছিল না। ওরা রাখে নি, শুধু মানুষের দাঁতের চিহ্ন। কবিতার ক্ষতবিক্ষত ছেড়া পৃষ্ঠার মতো। জ্যোৎস্নায় ভেসে-যাওয়া রাতে মানুষের-মাংস-খাওয়া মানুষেরা কি কখনো ছোটােবেলায় চাঁদের সাথে সাথে হেঁটে যাওয়ার খেলা খেলেছিল ?
কথাটা মনে পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি আবার এখানে বহিরাগত কি-না। পাশের দোকানটায় ঢুকলাম। দোকানদার মুশকো চেহারার শকুনচােখো একটা লোক। ব্যবহারটা রাফ। দেখলেই বােঝা যায়, দাপটওয়ালা। তাই এখানেই ঢুকলাম। একটা ইউজ অ্যান্ড থ্রো ব্লেড নিলাম। এম. আর. পি. আঠারো টাকা। লোকটা আঠারোই চাইল। তাড়াতাড়ি আগ্রহের সঙ্গে দিয়ে দিলাম। কুড়ি টাকা দিয়ে দুটাকা ফেরত নিতে গিয়ে আফশেস হলো। ইশ, যদি আঠারো টাকাই খুচরো দেওয়া যেত। এবার থেকে মাঝে-মাঝে জানা দামের দু-একটা জিনিস কিনতে হবে এর থেকে। একটা লোক তো অন্তত চেনা বাড়ল এই দক্ষিণে।
একটু এগোলে ওই-যে সেলুনটা, বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে —ওখানে মাঝে-মাঝে চুল কাটাতে গেলে হয়। তাছাড়া ছুটির দিনে এক্সট্রা খবরের কাগজ কিনতে হলেও সীমানা পেরিয়ে এদিকেই আসা যেতে পারে। চলতে চলতে, আস্তেই চলছিলাম, তো হঠাৎ মনে হলো উলটাে ফুটের লোকটা আমাকে লক্ষ করছে। বড়োসড়ো চেহারা, বড়ো গোঁফ-জুলপি, চােস্তু পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে আর, গলায় চেনা। এইরকম চেহারা আর পোশাক দেখেই মনে হয় যেন দল-টল করে। নিদেনপক্ষে কোনো ক্লাব সংগঠন। নাহলে কি অত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকায় ?
নার্ভাস হলেই আমার আবার ডান হাঁটুটা কেমন নড়বড়ে হয়ে যায়। পা-টা যেন সোজা পড়তেই চায় না, হাঁটলে সেটা বেশ বােঝা যায়। লোকটা দেখছে বুঝতে পেরে একজায়গায় দাঁড়িয়ে পা-টা বার কয়েক ভাঁজ করে একটু-আধটু এদিক-ওদিক করলাম। যেন কতবড়ো চােট পেয়েছি তাই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সামান্য একটু খুঁড়িয়েও নিলাম। আপনা থেকেই হওয়া নার্ভাসনেসটা এ-কাজে সাহায্য করল। মনে হলো সুবিধে হবে। একটা নড়বড়ে আহত পায়ের দুর্বল লোক কি আর সন্দেহজনক হতে পারে ?
দু-একবার এরকম কসরত করে সামনে এগোলাম। ডানদিকে সামান্য গেলেই লাইব্রেরি। লাইব্রেরির সামনে একটু দাঁড়ালাম। মাঝে-মধ্যে এখানে এসে কাগজ বা বইপত্র ঘাটাঘাঁটি করি। এবার মেম্বারশিপটা নিতে হবে। বই হাতে রাস্তাটায় যাতায়াত করলে কেউ তেমন কিছু নিশ্চয়ই ভাববে না।
এই কাজটা বা এই প্রক্রিয়াটা আমি শুরু করেছি। বেশ কিছুদিন হলো। অফিসে যেতে আসতে দুটাে রেল-স্টেশনে আমাকে উঠতে নামতে হয়। কাটাতে হয় বেশ খানিকক্ষণ। দুটাে স্টেশনেই অন্তত তিনটে করে চায়ের স্টলে পালটে পালটে নিয়মিত চা খাই।
ম্যাগাজিনের স্টলে দাঁড়াই দুদণ্ড। টুকটাক কিনি। প্ল্যাটফর্ম চত্বরে দাড়িও কাটি মাঝে-মধ্যে। দু-একটা চেনা ঠেক হয়ে যায় এভাবে।
রেলস্টেশনজনিত সতর্কতাএমনি এমনি আসে নি আমার। একটা ঘটনা বলি। একদিন স্টেশনে বসে আছি। অবশ্য সেটা আমার বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র কোনো এলাকারই স্টেশন নয়। এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করেই দুটাে ট্রেন ছেড়ে দিয়ে বসে বসে। আশপাশটা দেখছিলাম; খুব তাড়া ছিল না। আর ভালোও লাগছিল। দুপুরবেলা প্ল্যাটফর্ম একরকম ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ কোথেকে দুটাে পুলিশ, বােধহয় অনেকক্ষণ ধরেই দেখছিল আমাকে— সোজা কাছে চলে এসে সে কী জেরা! কোথা থেকে এসেছি। কোথায় যাব। এই-সব। আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম, প্রোটাে অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড।
ব্যাগটা হাতড়ে ওরা পেল একটা প্লেবয় ম্যাগাজিন আর দুটাে মৰ্তমান কলা। হতচ্ছাড়ারাপ্লেবয়টা নিয়ে চলে গেল। এদিক নেই, ওদিক আছে। এরপর থেকে স্টেশনে বসলে খবরের কাগজ খুলে পড়ি। কয়েকদিন পর মনে হলো খবরের কাগজও তো হয় এদিকের-- নয় ওদিকের। আজকাল ব্যাগে কাগজের সাথে সাথে নন্টে-ফন্টে, হাঁদ-ভোদা রাখি, যারা রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
দূরের স্টেশনটাতে, মানে কর্মস্থলের ওখানে আর কি, বােমা পড়েছিল সেদিন। গুলিও চলেছিল। হঠাৎ যেন অন্ধকার নেমে আসে। ছোরা, ভোেজালি, পাইপগান হাতে কারা যেন দখল নিয়ে নেয় গোটা এলাকার। বাতাসে বারুদের গন্ধ। আমি কিন্তু ছোরা, চাকু, ভোেজালি, বুলেট— সবকিছুরই গন্ধ পাই।
শুধু গন্ধ নয়। প্রায়ই দেখি, দেখে যাই। প্রথম প্রথম ভাবতাম, চামচিকে বা বাদুড় জাতীয় কিছু হবে।— ভোর বা সন্ধের দিকে কেমন অস্পষ্ট ঘোলাটে করে দেয় চারিদিক, কোনো কোনো এলাকায়। ভালো করে লক্ষ করলে ঠিকই বুঝি, চামচিকের মতো উড়ন্ত জিনিসগুলো নিজেরাই হেঁটে চলে বেড়ায়— ঠিক বোরহেসের গল্পের ছুরির মতো। এই চামচিকে বা পঙ্গপালের কুয়াশা আমাকে এমন ইঙ্গিতও দেয় যে, এরা এখন নিজেরাই নিজেদের বংশ বিস্তার করতে সক্ষম। এখানে সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে, উত্তরে সেদিন যে “বডি’ হয়ে পড়েছিল। বসনহীন। কাজটা নাকি দক্ষিণের | বহু যত্নে লতাপাতা ফুল তাঁর শরীরে একে দিয়েছিল ওরা— তুলি আর ব্রাশ দিয়ে।
তুলি আর ব্রাশ বলতে অবরুদ্ধ, কালান্তক রাগে ফুসতে-থাকা কতগুলো ছােরা— নানা আকৃতির আর সাইজের। খুনটা খুব বড়ো কথা নয়। আসলে ব্যাপারটা ছিল একটা শিল্পকর্ম। ও-রকম আলপনা আঁকা, মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপসহ— কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল। নিশ্চয়ই।
মৃতদেহের ক্যানভাসে ছুরির তুলি বােলাতে বােলাতে সে-ও হয়তো মনে মনে চলে গিয়েছিল ছেলেবেলায়। সত্যিই এর কোনো অর্থ নেই। শিল্পের কি অর্থ হয় ?
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ, কী বলব, কপাল খারাপ, লাগল এক ধাক্কা। যতটা ব্যথায়, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কে শিউরে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনটা শান্ত হয়ে গেল। যাক বাবা। খাল পেরিয়ে নিজের জায়গায় এসে পড়েছি। অর্থাৎ উত্তরে। এখানেই আমার ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড— এ-সব আছে।
কিন্তু তাতেও কি রেহাই আছে ? যে-লোকটাকে ধাক্কা মারলাম। সে তো কী করবে ভেবে পায় না। “আপনার কিছু হয় নি তো দাদা ? সরি। ভীষণ ভুল হয়ে গেছে|” বলল সে। দোষটা যদিও আমার |
“ও কিছু না ঠিক আছে”, বলি ওকে। তাও তাঁর আতঙ্ক যায় না। আমার প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে দেয়। আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি, আমার ডানপায়ের বেখাপ্পা, বেয়াদব বুড়ো আঙুলের নখের চাপে তার পাছড়ে গেছে। প্রয়োজন হলো না বলে সে-ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞাসাই করলাম না। বললাম, “মশাই কোত্থেকে?”
“এদিকে মানে, এই খালটা পেরিয়ে একটু এসেছি, এই এমনি-ই আর কি ...” “কোন কারণে নয়, এমনিই?” তোতলাতে থাকে লোকটা ।
তার মানে দক্ষিণ থেকে উত্তরে এসেছে। লোকটার পায়ের পাতা সজোরে চেপে ধরি। জামার কলার টেনে ধরে এবার বলি, “এমনি! জানো না রাস্কেল, এমনি বলে কিছু হয় না ?”
“না বলছিলাম যে...”, আমতা আমতা করে সে।
“বলবে। আবার কি? অ্যা? জান বাংলাভাষার সবচেয়ে সন্দেহজনক শব্দ ‘এমনি’? কোত্থেকে এসেছ? দক্ষিণ ?”
“আজ্ঞে হ্যা”, সে বলল।
“রেশন কার্ড আছে?”
“আছে।”
“ভোটের ফটো ?”
“হ্যা। তাও আছে।”
“ইলেকট্রিসিটি বিল ? গ্যাসের লাইন ?” বলি আমি।
“গ্যাসের লাইন আছে। কিন্তু ইলেকট্রিসিটি বিল তো নেই। ভাড়া থাকি তো।”
“অ। তাহলে ওদিককারও পুরোপুরি নও।” ধমকে উঠলাম।
“সুগার নর্ম্যােল?”
“আজ্ঞে কী বললেন ?”
“ব্লাড সুগার কত?”
“মাপাইনি তো!”
''তাহলে সুগারের কারণে হাঁটাহাঁটি করছে, এটুকু বলার জায়গা অন্তত নেই।''
“তা হলে আসা কিজন্যে ? কী হে?”
“ওই তো বললাম, এমনি।”
“চােপ স্কাউন্ডেল। বল ঠিক করে উল্লুক!”
লোকটা খানিকক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “আসল কথাটা তো কেউ বিশ্বাস করে না, তাই বলি না। ওই-যে বটগাছটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটা ঠিক যেখানে বাক নিয়েছে, এমন একটা বাঁক, যে—বাঁক পেরোলেই মনে হয় অন্য দিগন্ত— হেঁটে হেঁটে ওই বাঁকটা পেরোতে ভারি ভালো লাগে। দুটাে জগতের সীমানা। ছোটােবেলায় আমি আর দাদা যখন ঘুড়ির পিছনে ছুটতে ছুটতে এরকমই একটা বাঁক পেরিয়ে যেতাম...”
লোকটার পায়ের ওপর থেকে পা সরিয়ে নিলাম। এবার টানতে টানতে নিয়ে এলাম বর্ডারে। মানে খালপাড়ে।
“শোন মৰ্কট, আবার বলছি “এমনি’ বলে কিছু হয় না। উদ্দেশ্যহীনতাই সবচেয়ে সন্দেহজনক ব্যাপার। যখন বেরোবি পকেটে একটা জিনিসপত্রের ফর্দ আর টাকা রাখবি, তার সাথে ব্যাগ। কিনিস না কিনিস।”
একেবারে ঠিক সীমানায় এসে আমার আত্মবিশ্বাস কমতে কমতে ও তার আত্মবিশ্বাস বাড়তে বাড়তে একদম ঠিক সমান হয়ে গেল। এবার একই সাথে আমি তাকে আর সে আমাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে যার যার নিজের এলাকায় পাঠিয়ে দিলাম।
0 মন্তব্যসমূহ