অম্লানকুসুম চক্রবর্তী'র গল্প : ডিল চলছে ডিল

নার্সিংহোম থেকে যখন বাবার মৃত্যুসংবাদটা দিল তখন আমি ট্যাবটা নিয়ে ডিডিডি-র প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডিডিডি-র মানে আজকাল সবাই জানে। তাও যাঁরা জানেন না তাঁদের বলে দিই– ডিপ ডিসকাউন্ট ডে। এই ডিডিডির প্রিপারেশনটা একদম ঠিক সময়ে নিয়ে রাখতে হয়। এমনিতেই অ্যাপে সেল শুরু হয় ওয়েবসাইটের ঘণ্টাখানেক আগে। অবশ্য ওয়েবে এখন ক’জনই বা অর্ডার দেয়! খবরের কাগজে ফ্রন্টপেজে ডিডিডি-র বিজ্ঞাপনটা দেখার পর থেকেই আমার রক্তচাপ বেড়ে যায় প্রতিবার। তবে এটা নিয়ে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি, তা হল রক্তচাপটা শুধু আমার নয়, ওদেরও বাড়ে।

রবিবার সকালে যদি ইভেন্টটা থাকে, তাহলে ওই সময় যে কাজগুলো করতে হবে বলে ঠিক করে রেখেছিলাম, সেগুলো শনিবারই মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আসল কথাটা হচ্ছে, ঠিক টাইমে যদি অর্ডারটা প্লেস না করতে পারি, তা হলে জিনিসটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। কারণ যেগুলোতে জেনারেলি ওদের একটু হেভি ডিসকাউন্ট থাকে, সেগুলোর স্টক বেশি থাকে না। এই তো গত মাসে ৩২জিবির পেন ড্রাইভটাতে ফ্ল্যাট ৭৪ পার্সেন্ট অফ দিচ্ছিল। সেল শুরু হয়েছিল ঠিক সকাল আটটায়। বাবার সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে ফালতু পনেরো মিনিট সময় নষ্ট হয়ে যায়। ৮টা ২০ নাগাদ যখন অর্ডারটা প্লেস করি, তখন একটা ‘ব্যাড লাক ফর ইউ টুডে’ মেসেজ দিয়ে স্ক্রিনে দেখাল, ডিলটা এক্সপায়ার করে গিয়েছে। প্রথম ৪৯৯ কাস্টমারের জন্য নাকি ওটা অ্যাপ্লিকেবল ছিল। এই টার্মসগুলো ওরা বিজ্ঞাপনে মেনশন করে দেয় না কেন কে জানে।

আজ রবিবার। শনিবার, অর্থাৎ গতকালের খবরের কাগজে আজকের ডিডিডির বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল। কাল বাড়ি এসে হাসপাতালে ফোন করে বাবার একটা স্ট্যাটাস আপডেট নিয়ে সুতপার সঙ্গে আজকে আমাদের শপিং কার্টে কি কি রাখা যেতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করলাম। প্রতিবারই করি। যেগুলোতে কিছু স্পেশাল ডিল থাকে সেগুলোর উপরেই সুতপার নজর থাকে বরাবর। এই জন্য কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিসও কেনা হয়ে যায়। হু নোজ? আজকে দরকার নেই, কিন্তু কাল জিনিসটার দরকার হতে পারেও তো! এই যেমন গত মাসে একটা টু পয়েন্ট ওয়ান স্পিকার কিনলাম। বাড়িতে একটা হোম থিয়েটার আছে। কিন্তু ৮২ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেখে আসলে আর লোভ সামলাতে পারিনি। তার পরে আবার এমবিআই, মানে মডার্ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যদি জিনিসটা কেনা হয় তা হলে অ্যাডিশনাল পাঁচ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট। এর মানে হল, বিরাশি প্লাস পাঁচ সাতাশি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়ে যাচ্ছিলাম প্রোডাক্টটায়। এমন ভাল অফার পেলে কেউ কি আর লোভ সামলাতে পারে? নিজের বিবেকের কাছে জাস্ট জাস্টিস করা যায় না।

কোথায় যেন শুনেছিলাম, দুনিয়াটা বড় কঠিন ঠাঁই। বাবাই বলত বলে মনে হয়। অনেক অবসোলিট কথাবার্তার মধ্যে এটাও একটা। আমি তো বলি দুনিয়ার থেকে আরও বেশি কঠিন জায়গা হল ভার্চুয়াল দুনিয়াটা। ইউ হ্যাভ টু ডু দ্য রাইট থিং অ্যাট দ্য রাইট টাইম। অফ কোর্স যদি কেউ ডিসকাউন্ট আর ডিল অ্যাভেইল করতে চায় তা হলে। যাদের বাপের প্রচুর টাকা আছে তারা পাড়ার দোকানে বা মোড়ের ইলেকট্রনিক্সের শোরুমে গিয়ে জিনিস কিনতেই পারে। দরাদরি করলে বা আপনার সঙ্গে টার্মস ভাল থাকলে ওরা কখনও কিছু কমসম করে দেয় হয়তো। কিন্তু অনলাইনের পুকুরে যদি ঠিক মতো ছিপটা ফেলা যায়, তাহলে জলের দরে বড় মাছ উঠবেই। উইকডেতে যখন ডিডিডি পড়ে মাঝেমাঝে, আমাদের অফিসে হাজিরা কমে যায়। ইনফ্লেশনের যা বাজার, তাতে ফালতু বেশি দাম দিয়ে জিনিস কিনতে খুব গায়ে লাগে। অনলাইনে কিনলে দু’দিকেই লাভ। যদি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেনা হয় অবশ্য। একে তো কম দামে জিনিসটা পেয়ে যাওয়া যাচ্ছে, আর কার্ডে কিনলে প্রতিটা শপিংয়েই কিছু রিওয়ার্ড পয়েন্ট পাচ্ছি যেগুলো পরে ইচ্ছেমতো রিডিম করে নিতে পারব

সুতপা আমার মুখ দেখে খবরটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। আমি বলিনি কিছু। অ্যাকচুয়ালি বলার সময় পাইনি কারণ ১২ওয়াটের এলইডি ল্যাম্পে একটা ফ্যাবিউলাস ডিল চলছিল। আমার বাস্কেটে দুপিস ল্যাম্প অ্যাড করব কি না ভাবছি, এমন সময়ই নার্সিংহোম থেকে ফোনটা আসে। ওরাও বেশি কথা বলেনি। আমিও জাস্ট ‘আসছি’ বলে ফোনটা কেটে দিয়েছি। সিনেমাতে এই সব ফোনগুলো আসার সময় সারা অন্তরীক্ষ জুড়ে ঝনঝন মিউজিক বাজে। খবরটা যাকে দেওয়া হল, সে হয়তো একবারই ‘হোয়াট’ বলে, কিন্তু সিনেমাতে ওই হোয়াটটাই পাঁচবার রিপিট করে। হাতে জলের গ্লাসটা থাকলে সেটা পড়ে যায় মেঝেতে। কাঁচ ভেঙে গেলে দুটো জিনিস হয় বলে আমার মনে হয়। এক, একটা ইমোশনাল শক। দুই, মেলানকলিক টাচ। ফোনটা আসার পরে আমার অবশ্য দুটোর মধ্যে একটাও হয়নি। হওয়াটা সম্ভবও ছিল না কারণ ওই খবরটা শুনে হাত থেকে ট্যাবটা পড়ে গেলে কেলেঙ্কারি হত। কারণ এটা জাস্ট মাসতিনেক হল কিনেছি। ঠকে গিয়েছিলাম। কিনেছিলাম মাত্র ২২ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে। হ্যাপি আওয়ারে যদি কিনতে পারতাম তাহলে আরও দশ পার্সেন্ট এক্সট্রা ডিসকাউন্ট পেতাম। মাথাতেই আসেনি। যাঁরা হ্যাপি আওয়ার জিনিসটা বোঝেন না, তাঁদের জন্য বলি, কিছু কিছু ওয়েবসাইট দিনের একটা বিশেষ সময় চলতি অফারগুলোর ওপরে আরও বেশি করে ডিসকাউন্ট দেয়। যে সময়টা সাধারনত কাস্টমারের আনাগোনা কম থাকে, সেই সময়টাতে আরও বেশি কাস্টমার ধরাটাই এই হ্যাপি আওয়ারের অবজেক্টিভ। শুধু ওয়েবসাইট কেন, রেস্তোরাঁ, বার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, পার্ক— সব জায়গাতেই তো হ্যাপি আওয়ার চলে। দুপুর বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে এলে তিন পেগের সঙ্গে এক পেগ ফ্রি, এমন পোস্টার আপনারা বারের বাইরে দেখেননি?

বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল অনেকটাই প্রফেশনাল। উষ্ণতার ছোঁয়াটোঁয়া জাতীয় কিছু শব্দ যেগুলো বাংলা সিরিয়ালে খুব ব্যবহার হয়, আমাদের মধ্যে সে সব নেই একেবারেই। অ্যাট লিস্ট আমার মধ্যে তো নেই। সুতপাকে নিয়ে আমি আলাদা ফ্ল্যাটে চলে আসার পর বাবা ফোনটোন করত প্রথমদিকে। আমার বিজি শিডিউল। ওই এক রুটিন বকবক করা খুব বোরিং একটা ব্যাপার। ফোনগুলো সেভাবে এন্টারটেইন করতাম না। বাবা হয়তো সেটা বুঝতে পেরে ফোন করাটা কমপ্লিটলি বন্ধ করে দেয়। তা ছাড়া নিজেকে বরাবরই ভীষন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভাবত। মাকে তো পাইনি বেশিদিন। তখন আমার কত হবে? ক্লাস সিক্স। না সেভেন? সিক্সই মনে হয়। রান্নাঘরে গ্যাসটা বার্স্ট করেছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও সময় পাওয়া যায়নি। মা চলে যাওয়ার পরে অ্যাফেকশানের যে শূন্যতাটা ছিল, সেটা বাবার কাছ থেকে এক্সপেক্টও করিনি। ওই ভ্যাকুয়ামটা পুরোপুরি ভরিয়ে দিয়েছে সুতপা।

বিয়ের মাসদুয়েকের মধ্যেই যখন বাবার থেকে, আই মিন বাবার বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যাই, একবার অবশ্য নাম কা ওয়াস্তে বলেছিলাম— তুমি কি আমাদের সঙ্গে নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করতে চাও? অ্যাট লিস্ট কিছুদিনের জন্য। চাইছিলাম যেন না বলে। ফর এ চেঞ্জ হ্যাঁ বলে দিলে মুশকিলে পড়তাম। আমায় ডোবায়নি, থ্যাঙ্ক গড। আমি আর সুতপা নিজেদের মতো করে ফ্ল্যাটটা সাজিয়ে নিয়েছিলাম। ওই পুরনো ফ্ল্যাটে জায়গার অভাব ছিল। আর যে জিনিসগুলো ছিল সেগুলো খুবই ব্যাকডেটেড। পেল্লায় সাইজের বাক্স টিভিটা বেশ কয়েকবার পাল্টানোর কথা বলেছিলাম বাবাকে। আমিই পে করতাম। কিন্তু রাজি হয়নি। কত ভাল ভাল ডিল মিস করে গিয়েছি জাস্ট একটু প্ল্যানিংয়ের অভাবে। ছোটখাটো সব ব্যাপারেই মনের অমিল হত। কথা কাটাকাটি হত। সুতপা আমাকে কলেজেই বলে দিয়েছিল, সেপারেট থাকতে হবে। আমিও যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে চাইছিলাম বাবার ফ্ল্যাটটা থেকে। আসার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম একটা কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দেব কিনা। বাবা ফ্ল্যাটলি জানিয়েছিল, আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। বাড়ি ছাড়ার সময় চোখ ছলছল করা তো দূরের কথা, বরং বাবা দরজাটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সুতপাকে জড়িয়ে ধরে একটা ঝটিতি চুমু খেয়েছিলাম। সিঁড়িতেই। সুতপা বলেছিল, বাঁচালে আমায়। আমরা বাঁচলাম।

সুতপা আমার কাছে লাকি চার্ম। না হলে বিয়ের তিনমাসের মধ্যেই চার-পাঁচ পার্সেন্ট ইনক্রিমেন্টের বাজারে আমার এগারো পার্সেন্ট মাইনে বাড়ত না। আর মাইনে বাড়ার ফলে সবার প্রথমে যেটা আমার জীবনে এল তা হল মডার্ন ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড। এই কার্ডের জন্যে এলিজিবিলিটিই হল চল্লিশ হাজার টাকা মাসে। এর সুবিধা প্রচুর। অনলাইন শপিং-এর বেশ কিছু সাইটের সঙ্গে এদের টাই আপটা জাস্ট অ্যামেজিং। সুপারকার্ট ডট কমে তো সারাবছরই এমবিআই ব্যাঙ্কের কার্ডে এক্সট্রা দশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেয়। এর জন্য যে আমার কত টাকা বেঁচেছে তার হিসাব নেই। এলইডি টিভি, সুতপার মোবাইল, হেয়ার স্ট্রেটনার, মিক্সার, ডিভিডি প্লেয়ার, জ্যুসার, সুতপার জন্য নানা কস্টিউম জুয়েলারি— সবই তো মডার্ন ব্যাঙ্কের কার্ড দিয়ে কেনা। কয়েকটা রেস্তোরাঁর সঙ্গেও এদের টাই আপ আছে। বিলে ফ্ল্যাট কুড়ি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট। ফলে হোটেলে খাওয়াটাও বেড়ে গিয়েছে। বাবাকে একবার একটা ডিওডোরেন্ট গিফট করব ভেবেছিলাম। সুতপা বারণ করেছিল। আর দিইনি।

দেখেছেন, এমবিআই ক্রেডিট কার্ড নিয়ে এতগুলো কথা বলে ফেললাম, অথচ ওদের কার্ডের যেটা সবচেয়ে ভাল ফিচার, সেটা নিয়ে প্রথমে এক লাইন বলেই থেমে গিয়েছি। মনটা একটু ডিসটার্বড আছে, ওই জন্যেই হবে হয়তো। প্রতি একশ টাকা খরচা করলে আমি একটা করে রিওয়ার্ড পয়েন্ট পাই। খরচার সাথে সাথে পয়েন্টও জমতে থাকে। আর বেশ কিছু পয়েন্ট জমে গেলেই সেগুলো রিডিম করে দারুণ দারুণ কিছু গিফট পাওয়া যায়। যেমন ধরুন, সাড়ে চারশ পয়েন্ট জমে গেলেই আপনি পেয়ে যাবেন একটা মিক্সি। পাঁচশ হলে একটা ইনডাকশন কুকার। সাড়ে সাতশ পয়েন্টে মাইক্রোওয়েভ। মার্কেটে বিগ ফিশের তো অভাব নেই। হাজার দশেক পয়েন্ট হলে তাদের জন্য ব্যাঙ্কক-পাট্টায়ার ফ্রি এয়ার টিকিটেরও ব্যবস্থা আছে। দশ হাজার পয়েন্ট মানে লাখ দশেকের শপিং। ওদের লাইফটা কি কালারফুল মাইরি! আমার অতকিছু হবে না। সেভাবে তেড়ে খরচা করতে হলে তো ইনকামটাও তেমন হওয়া চাই। সেটা আর হল কই? অবশ্য আমি এখনও কোনও পয়েন্ট রিডিম করিনি। চার হাজার চারশ তিরিশ পয়েন্টের মালিক আমি। মানে শুধু এই ক্রেডিট কার্ডটা দিয়েই চার লক্ষ্য তেতাল্লিশ হাজার টাকার শপিং করা হয়ে গিয়েছে আমার। ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্টগুলো আমার জীবনে মাইলফলকের মতো লাগে। আজকাল আর স্বপ্ন দেখি না তেমন। কিন্তু সেদিন একটা দেখলাম। দেখি এক পরী। মুখটা কালো ছিল কিন্তু দেখতে পরীর মতোই তো। কপালে টিপের জায়গায় একটা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ। কার্ডের পিছনে যেমন থাকে। পরীটা চুমু দিচ্ছে আমায়। প্রতিটা চুমুর সঙ্গে সঙ্গে টিরিং টিরিং করে আওয়াজ হচ্ছে আর আমার রিওয়ার্ড পয়েন্ট বেড়ে যাচ্ছে হাজার করে। উফ কি এক্সাইটিং! ভাবলেও আরাম লাগে। এ সব স্বপ্ন সত্যি হয় না কেন?

মাসখানেক আগে আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেল। সরি, গেলেন। ও তো ফোন করে কি কান্নাটাই না কাঁদল। বারবার বলছিল, সব শেষ হয়ে গেল রে। মাথার উপর থেকে ছায়াটা সরে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমার বিরক্তি লাগছিল। ফোনটা ছেড়ে বাঁচলাম। ফোনে তেষট্টি পার্সেন্ট চার্জ নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। বাহান্ন পার্সেন্টে শেষ হল। ডিজগাস্টিং। আমার তো এই ছায়া টায়া সরে যাওয়ার মতো কোনও ফিলিংই হচ্ছে না। সুতপাকেও তো তেমন রিঅ্যাক্ট করতে দেখছি না। দিন সাতেক আগে রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ বাবা যখন দুম করে ঘেমে গেল, তখন ওই ফ্ল্যাটেরই লোকজনরা ধরাধরি করে একটা লোকাল নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিল। আমায় প্রথমে ওরা ফোন করে পায়নি। অফিস থেকে আসতে সেদিন একটু দেরি হয়েছিল আর ফোনটারও ব্যাটারি এগজস্ট করে গিয়েছিল। রাতে এসে চার্জে বসাতেই ওই ফ্ল্যাটের একটা লোকের ফোন। নার্সিংহোমে গেলাম। বলেছিল হার্ট অ্যাটাক হয়েছে একটা। তবে খুব সিরিয়াস কিছু নয়। ছেড়ে দেওয়ারও কথা ছিল। হঠাৎ করে আরেকটা মেজর অ্যাটাক হয়ে গেল। অথচ পরশুই অফিসফেরতা একটা খবর নিয়ে এলাম। ডাক্তার তো বলছিল ঠিকই আছে। একদিক থেকে বাঁচোয়া বাবার মেডিক্লেমের কভার ছিল একটা। এক লাখ টাকার। এটা জানতে পেরে আমার থেকে অনেক বেশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সুতপা।

এলইডি বাল্বের অর্ডারটা প্লেস করে বাড়ি থেকে বেরোলাম। অ্যাপ দিয়ে গাড়ি বুক করে নিলাম একটা। ও, বলতে ভুলে গিয়েছি, একটা পাওয়ার ব্যাঙ্কেরও অর্ডার প্লেস করে দিয়েছি একই সঙ্গে। এর ফলে একটা দারুণ জিনিস হল। রাস্তাঘাটে মোবাইলের চার্জ কমে গেলেও ওটা দিয়ে চার্জ করে নেওয়া যাবে। ভালই ডিসকাউন্ট পেলাম। এই জন্যই অনলাইন শপিংকে সবসময় বলি, হে বন্ধু, রহো সাথে। টেগোর সং।

নার্সিংহোমে পৌঁছলাম। আমি আর সুতপাই পৌঁছলাম। আগেকার দিনে কেউ মারা গেলে কি পরিমাণ লোক আসত। হাসপাতালের সামনে জমায়েত হয়ে যেত একটা। আমার কেউ নেই। বাবার এক্সপায়ার করার খবরটা ফেসবুকে পোস্ট করায় অনেকেই আরআইপি লিখে পাঠিয়েছে। এখনও পাঠাচ্ছে। এই কথাটার মানে হল রেস্ট ইন পিস। কেউ পাশে থাকলে ভালই হত হয়তো এখন। কিন্তু কই, আসার কথা তো একবারও শুনলাম না কারও কাছ থেকে। আমার ওয়ালে এখন কত ফুলের ছবি আসছে। সাদা ফুল। বাবার জন্য। কোনও আসল ফুল নেই। রাস্তায় একটা ফুলের দোকান দেখলাম। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে কিছু রজনীগন্ধার স্টিক কিনলাম। ওগুলোই দেব। নার্সিংহোমের রিসেপশনে দেখলাম বাবার ফ্ল্যাটের কয়েকজন লোক। একজনের চোখে কি জলের একটু চিকচিক ছিল? হবে হয়তো। আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, সত্যিটাকে মেনে নাও বাবা। ভেঙে পোড়ো না। সুতপার মুখের দিকে তাকালাম। কি করে বোঝাই ভেঙে পড়ার মতো তেমন কোনও ফিলিংই হচ্ছে না আমার।

রিসেপশনে যাই। বাবার নাম বলি। ওরা প্রথমে বলল, উই আর সরি। আমি বললাম, বিল কত হয়েছে? ওরা তো এই প্রশ্নগুলোর জন্যই চেয়ে থাকে সারাদিন, আচার দেখে জিভের লালা ঝরার মতো। রিসেপশানের মেয়েটা দুটো কাগজের প্রিন্ট নিয়ে সাদা খামে ভরে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। খামের উপরে নার্সিংহোমের নাম ছাপানো। তলায় পাঞ্চলাইন। উই গিভ নিউ লাইফ টু ইউ। এই খামটা কে পড়ে? রোগী না রোগীর পরিবার? নিউ লাইফ বাঁচলে হয় না মরলে? এক লক্ষ বাহান্ন হাজার সাতশ তিপ্পান্ন টাকা। মেডিক্লেমের কি সব অ্যাডজাস্ট করার পরে বলল আমাকে বলল, সত্তর হাজার পাঁচশ পে করতে হবে।

সুতপা আমার মুখের দিকে তাকায়। চোখের তারায় প্রশ্ন। এতগুলো টাকা! আমার হঠাৎ করে কেন জানি না সন্তান হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। একটা ঠিকঠাক ছেলে। ক্রেডিট কার্ডটা বের করে দিই। সোয়াইপ হয় মেশিনে। প্রিন্টার দিয়ে ফটাফট বেরিয়ে আসে ট্রানসাকশান রিসিপ্ট। সই করে দিই। আমার কর্তব্যবোধ। সত্তর হাজার পাঁচশ।


গাড়ি। কাঁচঢাকা গাড়ি। ড্রাইভারের পাশে বসে আছি আমি আর সুতপা। পিছনে আমার পূর্বসূরী। নশ্বর। নার্সিংহোম থেকে প্রথমে আমাদের ফ্ল্যাটের পথে। শেষবারের মতো।

ক্লান্ত লাগছে। মোবাইলটা বিপ করে ওঠে। এসএমএস। এমবিআই ক্রেডিট কার্ড। কনগ্র্যাটস ফর স্পেন্ডিং রুপিজ সত্তর হাজার পাঁচশ। পয়েন্টস আর্নড ৭০৫। মোট পয়েন্ট ৫১৩৫। আর পাঁচ হাজার পয়েন্ট পেরোনোর জন্য মন্দারমণিতে স্পা রিসর্টে দুরাত্রি তিনদিন। অ্যাবসোলিউটলি ফ্রি।

মোবাইলটার দিকে জুলজুল করে চেয়ে থাকি।●

লেখক পরিচিতি
অম্লানকুসুম চক্রবর্তী : ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্ম। কলকাতার দমদমে থাকেন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর।




অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর গল্পভুবন

গল্পপাঠঃ: 
গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ 
কোনও পরিকল্পনা নিয়ে গল্প লিখি না। নিজের সময়টা নিয়ে কিছু প্রশ্ন, আনন্দ-রাগ-অভিমান নিজের মনের মধ্যেই পুষে রাখি। সেগুলো কলমবন্দি করতে চেষ্টা করি। কখন গল্প হয়ে ওঠে জানি না।

গল্পপাঠঃ: 
শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ  
আমি শুরুই করেছি বলা চলে। যাঁরা পড়ছেন, তাঁরাই বলবেন।

গল্পপাঠঃ: 
গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন?
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ 
তেমন ভাবে কোনও প্রস্তুতি নেই। বাংলা ছোটগল্প পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। ব্যস, এইটুকুই।

গল্পপাঠঃ:
আপনার গল্প লেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ 
যে কটি গল্প লিখেছি, তার বেশিরভাগই আত্মকথনে। উত্তম পুরুষে লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য আসে। তবে এই অভ্যাস বদলানো দরকার।

গল্পপাঠঃ: 
আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ 
লেখার বিষয়ের পরিধি অনেক বাড়ানো প্রয়োজন। ফর্ম ভাঙাটাও জরুরি।

গল্পপাঠঃ: 
আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে?
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ 
মূলত সমসাময়িক কালের লেখকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। যা পাই তাই পড়ি। আদর্শ গল্পকার অনেকেই আছেন। গল্প পড়ার পরে সুখ নয়, অস্বস্তিটা বেশি ভাল লাগে।
গল্পপাঠঃ: 
কার জন্য গল্প লেখেন?

অম্লানকুসুম চক্রবর্তীঃ 
আমি সবে শুরু করেছি। গল্প লেখার সময় কে পড়বেন সেটা আপাতত মাথায় রাখি না। নিজের যেমনভাবে ইচ্ছে করে লিখি। তবে পাঠকের সেন্টিমেন্টটা মাথায় নিয়ে এগোনো অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ