শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়য়ের গল্প : উত্তরের ব্যালকনি



ব্যালকনিতে দাঁড়ালে লোকটাকে দেখা যায়। উল্টোদিকের ফুটপাথে বকুল গাছটায় অনেক ফুল এসেছে এবার। ফুলে ছাওয়া গাছতলা । সেইখানে নিবিড় ধুলোমাখা ফুলের মাঝখানে লোকটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে । গায়ে একটা ছেঁড়া জামা, জামার রঙ ঘন নীল। পরনে একটা খাকি রঙের ফুলপ্যান্ট-- লজ্জাকর জায়গাগুলিতে প্যান্টটা ছিঁড়ে হাঁ হয়ে আছে। মাথায় একটা ময়লা কাপড়ের ফগ্‌গে জড়ানো ।
পিঙ্গল দীর্ঘ চুলগুলি আস্তে আস্তে জটা বাঁধছে। গালে দাড়ি বেড়ে গেছে অনেক, তাতে দুচারটে সাদা চুল । গায়ে চিট ময়লা, কনুইয়ে ঘা, তাতে নীল মাছি উড়ে উড়ে বসে । এই হচেছ লোকটা । দু-পা ছড়িয়ে নির্বিকার বসে আছে, দুই চোখে অবিরল ক্লান্তিহীন তাকিয়ে থাকে। ঘা থেকে উড়ে মাছিগুলি চোখের কোণে এসে বসে । লোকটা দুহাত তুলে চেঁচিয়ে বলে--সরে যা, সরে যা, মেল ট্রেন আসছে ।

পাগল।

সকালে ভাত খেয়ে একটা পান মুখে দেয় তুষার। সুগন্ধী জর্দা খায়। তারপর পিক ফেলতে আসে ব্যালকনিতে । ফুটপাথের ধারে কর্পোরেশনের ময়লা ফেলার একটা ড্রাম আছে । অভ্যাসে লক্ষ্য স্থির হয় । তুষার একটু ঝুঁকে দোতলার ব্যালকনি থেকে সাবধানে পিক ফেলে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না । পিকটা ঠিক গিয়ে পড়ে সেই ড্রামটায় । এদিক-ওদিক হয় না । অনেক দিনের অভ্যাস ।

পিক ফেলে তুষার বকুলগাছের তলার সেই লোকটাকে একটু দেখে । পাগল । তবু এখনো চেনা যায় অরুণকে । চেনা যায়? তুষার একটু ভাবে । কিন্তু অরুণের আগের চেহারাটা কিছুতেই সে মনে করতে পারে না । ফর্সা রঙ, ভোঁতা নাক, বড় চোখ--এইরকম কতগুলি বিশেষণ মনে পড়ে, কিন্তু সব মিলিয়ে চেহারার যে যোগফল--সেই যোগফলটাই একটা মানুষ--সেই মানুষটার নাম ছিল অরুণ--সেই অরুণকে কিছুতেই সব মিলিয়ে মনে পড়ে না। তবু তুষারের মনে হয়, এখনো অরুণকে চেনা যায়। কিন্তু আসলে বোধহয় তা নয়। অরুণকে আর চেনা যায় না বোধহয় । তবু তুষারের যে অরুণকে চেনা মনে হয় তার কারণ, গত পাঁচ বছর ধরে অরুণ ঐ গাছতলায় বসে আছে। ঐখানে বসে থেকে থেকেই তার চুল জট পাকাল, গালে দাড়ি বাড়ল, গায়ে ময়লা বসল--এই সব পরিবর্তন হল অরুণের। রোজ দেখে দেখে সেই পরিবর্তনটা অভ্যস্ত লাগে তুষারের। তাই অনেক পরিবর্তনের ভিতরেও আজও অরুণকে চেনা লাগে তার ।

পাগলটা মুখ তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল । আকীর্ণ ফুলের মধ্যে বসে আছে পাগল। তার চারদিকে শোষক নীল মাছি উড়ছে। পাগলটার চোখে এখন আর কিছু নেই। প্রথম প্রথম তুষার ঐ চোখে ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধ--এই সব কল্পনা করত। ব্যালকনি থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসত ঘরে, পারতপক্ষে ব্যালকনির দরজা খুলত না। কিন্তু আস্তে আস্তে তুষার বুঝে গেছে, পাগলটার চোখে কিছু নেই । কেবল অবিন্যস্ত চিন্তারাশি বয়ে যায় মাথার ভিতর দিয়ে, ওর চোখ কেবল সেই প্রবহমানতাকে লক্ষ করে অসহায় শূন্যতায় ভরে ওঠে । তুষার এখন তাই পাগলটার দিকে নির্ভয়ে চেয়ে থাকতে পারে। কোনো ভয় নেই ।

পাগল মাতাল আর ভূত--অনেক ভয়ের মধ্যে এই তিনটের ভয় সবচেয়ে বেশি ছিল কল্যাণীর! তার বিশ্বাস ছিল, বাসার বাইরে যে বিস্তৃত অচেনা পৃথিবী সেখানে গিজগিজ করছে পাগল আর মাতাল । আর চারপাশে যে অদৃশ্য আবহমণ্ডল তাতে বাস করে ভূতেরা, অন্ধকারে একা ঘরে দেখা দেয়।

কোনো পাগলের চোখের দিকে কল্যাণী কখনো তাকায়নি ৷ এখন তাকায় । ভয় করে না কি ? করে । তবু অভ্যাসে মানুষ সব পারে।

পান খাওয়ার পর অভ্যাস মতো বাথরুমে গিয়ে মুখ কুলকুচো করে আসে তুষার। তারপর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খায়। পানে খায়ের খায় না বলে ওর ঠোঁট লাল হয় না। তবু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা তোয়ালে দিয়ে সাবধানে ঠোঁট মোছে তুষার। প্যান্ট শার্ট পরে। তারপর অফিসে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় অভ্যাস মতো বলে--সদরের দরজাটা বন্ধ করে দাও।

কল্যাণী সদর বন্ধ করে।

শোওয়ার ঘরের মেঝেতে বসে জলের গ্লাস রঙের বাক্স ছড়িয়ে কাগজে ছবি আঁকছে তাদের পাঁচ বছর বয়সের মেয়ে । সোমা এখনও কেবল গাছ লতাপাতা, আঁকে। আর আঁকে খোপাসুদ্ধু মেয়েদের মুখ। বয়সের তুলনায় সোমার আঁকার হাত ভালই। তার আঁকা গাছপালা, মুখ সব প্রায় একই রকমের হয়, তবু মেয়েটা বিভোর হয়ে আঁকে। সারাদিন।

আজও লম্বা নিম পাতার মতো পাতাওয়ালা একটা গাছ আঁকছে সোমা। একটু দাঁড়িয়ে সেটা দেখল কল্যাণী। তারপর বলল--স্নান করতে যাবি না?
--যাচিছ মা, আর একটু--

মেয়ের ঐ এক জবাব।

--বড্ড অনিয়ম হচ্ছে তোমার । ঐ সব আজেবাজে এঁকে কী হয় ?
--এই তো মা, হয়ে এল--বিভোর সোমা জবাব দেয় ।

সামনের বছর স্কুলে ভর্তি হবে যখন তখন দেখবে। সময়মতো স্নান খাওয়া, সময়মতো সব কিছু। এই সব তখন চলবে না--

বলতে বলতে কল্যাণী অলস পায়ে তুষারের স্নান করা ভেজা ধুতিটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে আসে।

যখন তুষার থাকে, তখন কখনো কল্যাণী ব্যালকনিতে আসে না । সারা সকাল রান্নাবান্নার ঝঞ্ঝাট যায় খুব, তুষারকে খাইয়ে অফিসে পাঠিয়ে কল্যাণী অবসর পায়। স্নানের আগে বাঁধা চুল খুলতে খুলতে অলস পায়ে এসে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। তাকায় ।

আকীর্ণ ধুলোমাখা ফুলের মধ্যে বসে আছে পাগলটা। বসে আছে অরুণ। ব্যালকনিটা উত্তরে । গ্রীষ্মের রোদ পড়ে আছে । কল্যাণীর গায়ে রোদ লাগল, সেই রোদ বোধহয় কল্যাণীর গায়ের আভা নিয়ে ছুটে গোল চরাচরে । পাগলটা বকুল গাছের নিবিড় ছায়া থেকে মুখ তুলে তাকাল ।

এখন কল্যাণী পাগলের চোখে চোখ রাখতে পারে। ভয় করে না। কী করে। তবু অভ্যাস। পাঁচ বছর ধরে পাগলটা বসে আছে ঐ বকুলগাছের তলায়। পাঁচ বছর ধরে উত্তরের এই ব্যালকনিটাকে লক্ষ করছে ও। ভয় করলে কি চলে।

কল্যাণী গ্রীষ্মের রোদে ব্যালকনির রেলিঙ থেকে তুষারের ভেজা ধুতিটা মেলে দেয়। তারপর দাঁড়িয়ে চুল খোলে, অলস আঙুলে ভাঙে চুলের জট ।

পাগলটা তাকিয়ে আছে।

এখান থেকেই দেখা যায়, ওর ফাঁক হয়ে থাকা মুখের ভেতরে নোংরা হলদে দাঁত, পুরু ছ্যাতলা পড়েছে। ঘুমের সময়ে নাল গড়িয়ে পড়েছিল বুঝি, গালে শুকিয়ে আছে সেই দাগ। দুর্গন্ধ মুখের কাছে উড়ে বসছে নীল মাছি ।

ঐ ঠোঁট জোড়া ছ'সাত বছর আগে কল্যাণীকে চুমু খেয়েছিল একবার । একবার মাত্র । জীবনে ঐ একবার । তাও জোর করে । এখন ঐ নোংরা দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে সেই কথা ভাবলে বড় ঘেন্না করে ।

দুপুর একটু গড়িয়ে গেলে ঠিকে ঝি মঙ্গলা এসে কড়া নাড়ে। তখন ভাতঘুমে থাকে কল্যাণী । ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে দেয় । মঙ্গলা যখন রান্না ঘরের এঁটোকাঁটা মুক্ত করতে থাকে তখন কল্যাণী রোজকার মতোই ঘুম গলায় বলে--ভাতটা দিয়ে এসো।

নিয়ম। প্রথম যখন পাগলটা ঐ গাছতলায় এল তখন এই নিয়ম ছিল না। পাগল চিৎকার করত, আকাশ বাতাসকে গাল দিত । চিৎকার করে হাত তুলে বলত টেলিগ্রাম...টেলিগ্রাম...! তখন ঘরের মধ্যে তুষার আর কল্যাণী থাকত কাঁটা হয়ে। পাগলটা যদি ঘরে আসে । যদি আক্রমণ করে । তারা পাপবোধে কষ্ট পেত । অকারণে ভাবত অরুণের প্রতি তারা বড় অবিচার করছে। কিন্তু আসলে তা নয়। অরুণকে কখনো ভালোবাসেনি কল্যাণী, সে ভালোবাসত তুষারকে । অরুণের সঙ্গে তুষারের তাই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না । তুষারের ছিল সহজ জয় । অরুণের ছিল পৃথিবী হারানোর দুঃখ । সেই দুঃখ তার দুর্বল মাথা বহন করতে পারেনি। তাই লোভ, ক্ষোভ, আক্রোশবশত সে এসে বসল তুষার-কল্যাণীর সংসারের দোরগোড়ায়। চৌকি দিতে লাগল, চিৎকার করতে লাগল। সংসারের ভিতরে তুষার আর কল্যাণী ভয়ে সিটিয়ে থাকত, দরজা-জানালা খুলত না।

-- চলো, অন্য কোথাও চলে জাই। কল্যাণী বলত।

--গিয়ে লাভ কী ? ও ঠিক সন্ধান করে সেখানেও যাবে ।

আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল। অরুণ গাছতলা পর্যন্ত এল । তুষার কল্যাণীর সংসারের দোরগোড়ায় বসে রইল। কিন্তু তার বেশি এগোলো না। চিৎকার করত, কিন্তু কল্যাণীর নাম উচ্চারণ

করত না, তুষারেরও না । লোকে তাই বুঝতে পারল না, পাগলটা ঠিক এখানেই কেন থানা গেড়েছে।

ভয় কেটে গেলে মানুষের মমতা জন্মায় ।

তুষার একদিন বলল-- ওকে কিছু খেতে দিও। সারাদিন বসে থাকে ।

কেন ?

--দিও । ও তো কোনো ক্ষতি করছে না । বরং ওর ক্ষতি হয়েছে অনেক । আমরা একথালা ভাতের ক্ষতি স্বীকার করি না কেন I

সেই থেকে নিয়ম । কল্যাণী দুবেলা ভাত বেড়ে রাখে । ঠিকে ঝি দুপুর গড়িয়ে আসে। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় ভাত, অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে জল দিয়ে আসে । পাগলটা খিদে বোঝে। তাই গোগ্রাসে খায়, জল পান করে। অবশ্য খেতে খেতে কিছু ভাত ছড়িয়ে দেয় । কাকেরা উড়ে উড়ে নামে, চেঁচায়, নীল মাছির ভিড় জমে যায়। খাওয়ার শেষে পাগলটা এঁটো হাত নিশ্চিন্ত মনে জামায় মোছে। গাছের গুঁড়িতে মাথা হেলিয়ে ঘুমোয় ।

ঘুমোয় ! না, ঠিক ঘুম নয়। এক ধরনের ঝিমুনি আসে তাব । আর সেই ঝিমুনির মধ্যে অবিরল বিচ্ছিন্ন চিন্তার স্রোত কুলকুল করে তার মাথার ভিতর দিয়ে বয়ে যায়। চোখ বুজে সে সেই আশ্চর্য স্রোতস্বিনীকে প্রত্যক্ষ করে ।

মঙ্গলা আপত্তি করত--আমি ভিখিরির এঁটো মাজতে পারব না, মা।

মাইনের ওপর তাকে তাই উপরি তিনটে টাকা দিতে হয় ।

মঙ্গলা ভাত নিয়ে গিয়ে পাগলটার সামনে ধরে দেয়। তারপর একটু দূরে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় গাল পাড়ে--হাভাতে, পাগল, রোজ ভাতের লোভে বসে থাকা! কপালও বটে তোর, এমন বাসার সামনে আস্তানা গাড়লি যে তারা তোকে সোনার চক্ষে দেখল।

ভাতঘুমে রোজ কল্যাণী মঙ্গলার গাল শুনতে পায় ।

আগে আলাদা ভাত যত্ন করে বেড়ে দিত কল্যাণী । ক্রমে সেই সব যত্ন কমে এসেছে। এখন তুষারের পাতের ভাত, সোমার ফেলে দেওয়া মাছের টুকরো, নিজের ভুক্তাবশেষ সবই অ্যালুমিনিয়ামের থালাটায় ঢেলে দেয়। পাগলটা সব খায়।

গত বছর একটা প্রমোশন হয়েছে তুষারের জুনিয়ার থেকে । এখন সে সিনিয়র একজিকিউটিভ । নিজের কোম্পানির দশটা শেয়ার কিনেছে সে । ফলে সারাদিন তার দম ফেলার সময়ই নেই ।

বিকেলের আলো জানালার শার্সিতে ঘরে আসে । তখন এয়ারকণ্ডিশন করা ঘরখানায় সিগারেটের ধোঁয়া জমে ওঠে । কুয়াশার মতো আবছা দেখায় ঘরখানা। তখন খুব মাথা ধরে তুষারের। ঘাড়ের একটা রগ টিকটিক করে নাড়ে । অবসন্ন লাগে শরীর । সিগারেটে সিগারেটে বিস্বাদ, তেতো হয়ে যায় জিব । চেয়ার ছেড়ে উঠবার সময় প্রায়ই টের পায়, দুই পায়ে খিল ধরে আছে । চোখে একটা আঁশ আঁশ ভাব।

অফিসের ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ । কেবল বেকায়দায় আটকে থাকা তার ছোকরা স্টেনোগ্রাফারটি তাড়াতাড়ি তার কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ঘর ঝাঁট দিচ্ছে জমাদার । চাবির গোছা হাতে দারোয়ান এঘর ওঘর তালা দিচ্ছে।

দীর্ঘ জনশূন্য করিডোর বেয়ে তুষার হাঁটতে থাকে । নরম আলোয় সুন্দর করিডোরটিকে তখন তার কলকাতার ভূগর্ভের ড্রেন বলে মনে হয়।

বাইরে সুবাতাস বইছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এই প্রথম ফুসফুস ভরে বাতাস টানে সে। কোনো কোনো দিন এইখানে দাঁড়িয়েই ট্যাক্সি পেয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দিন খানিকটা হাঁটতে হয় ।

আজ ট্যাক্সি পেল না তুষার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপরে হাঁটতে লাগল।

একটা বিশাল বাড়ির কাঠামো উঠছে। দশ কি বারোতলা উচু লোহার খাঁচা । ইট কাঠ বালি আর নুড়ি পাথরের স্তুপ ছড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ হয়ে আছে কংক্রিট মিক্সার, ক্রেন হ্যামার উটের মতো গ্রীবা তুলে দাঁড়িয়ে । জায়গাটা প্রায় জনশূন্য। কুলিদের একটা বাচ্চা ছেলে পাথর কুড়িয়ে ক্রমান্বয়ে একটা লোহার বিমের গায়ে টং-টং করে ছুঁড়ে মারছে। ঘণ্টাধ্বনির মতো শব্দটা শোনে তুষার। শুনতে-শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

ওই তুচ্ছ শব্দটি--ঘণ্টাধ্বনিপ্রতিম--তার মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । সে আবার ফিরে তাকায় । লোহার প্রকাণ্ড, ভয়ঙ্কর সেই কাঠামোর ভিতরে-ভিতরে দিনশেষের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছে । চারিদিক আকীর্ণ আবর্জনার মতো ইট কাঠ পাথরের স্তূপ! ঘণ্টাধ্বনিপ্রতিম শব্দটি সেই অন্ধকার কাঠামোর অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে আসছে।

ওই শব্দ যেন কখনও শোনেনি তুষার। তার শরীরের অভ্যন্তরে অবদমিত কতগুলি অনুভূতি দ্রুত জেগে ওঠে। তীর আকাঙ্ক্ষা জাগে--ছুটি চাই, ছুটি চাই । মুক্তি দাও, অবসর দাও ।

কীসের ছুটি ! কোন অবসর ! সে পরমুহূর্তেই অবাক হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে । কিন্তু উত্তর পায় না । প্রতিদিন নিরবিচ্ছিন্ন কাজের মধ্যে ডুবে থাকা--এ তার ভালোই লাগে । ছুটি নিলে তার সময় কাটে না । বেড়াতে গেলে তার অফিসের জন্য দুশ্চিন্তা হতে থাকে। কাজের মানুষদের যা হয় ।

তবু সে বুঝতে পারে, তার মধ্যে এক তীব্র অনুভূতি তাকে বুঝিয়ে দেয়-- কী রহস্যময় বন্ধন থেকে তার সমস্ত অস্তিত্ব মুক্তি চাইছে । ছুটি চাইছে । চাইছে অবসর । সে তন্ন-তন্ন করে নিজের ভিতরটা খুঁজতে থাকে । কিছুই খুঁজে পায় না। কিন্তু তীব্র অজানা ইচছা এবং আকাঙক্ষায় তার মন মুচড়ে ওঠে ।

আবার সে পিছন ফিরে সেই লোহার কাঠামো দূর থেকে দেখে । সেখানে অন্ধকার জমে উঠেছে। একটা বাচ্চা ছেলে অদৃশ্যে এখনো পাথর ছুঁড়ে মারছে লোহার বিমের গায়ে ।

চৌরঙ্গির ওপরে তুষার ট্যাক্সি পায়।

--কোথায় যাবেন?

ঠিক বুঝতে পারে না তুষার, কোথায় সে যেতে চায় । একটু ভাবে । তারপর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলে--সোজা চলুন ।

গাড়ি সোজা চলতে থাকে দক্ষিণের দিকে, যেদিকে তুষারের বাসা । সেদিকে যেতে তুষারের ইচছা করে না। বাড়ি ফেরা--সেই একঘেয়ে বাড়ি ফেরার কোনও মানে হয় না।

সে ঝুঁকে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে--সামনের বাঁদিকের রাস্তা।

এলগিন রোড ধরে ট্যাক্সি ঘুরে যায়।

কোথায় যাব। কোথায় । তুষার তাড়াতাড়ি ভাবতে থাকে । ভাবতে ভাবতে মোড়ে এসে যায় । এবার ? ভিতরে সেই তীব্র ইচ্ছা এখনও কাজ করছে । অন্ধকারময় একটা বাড়ির কাঠামো--লোহার বিমে নুড়ি ছুঁড়ে মারার শব্দ--তুষারের বুক ব্যথিয়ে ওঠে । মনে হয়--কেবলই মনে হয়--কী একটা সাধ তার পূরণ হয়নি। এক রহস্যময় অস্পষ্ট মুক্তি বিনা বৃথা চলে গেল জীবন।

সে আবার বলে--বাঁয়ে চলুন ।

ট্যাক্সি দক্ষিণ থেকে আবার উত্তর মুখে এগোতে থাকে । আবার সার্কুলার রোড। গাড়ি এগোয় । ভিতরে-ভিতরে ছটফট করতে থাকে তুষার ।

একটা বিশাল পুরোনো বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি । তুষার বাড়িটাকে দেখল। কী একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ল না । আবার বাড়িটা দেখল। হঠাৎ পাঁচ-সাত বছর আগেকার কয়েকটা দুরন্ত দিনের কথা মনে পড়ল। নিনি। নিনিই তো মেয়েটির নাম।

গাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল, তুষার গাড়ি ঘোরাতে বলল ।

সেই বিশাল পুরা নো বাড়িটার তলায় এসে থামে গাড়ি ।


হাতে সদ্য কেনা এক প্যাকেট দামি সিগারেট আর দেশলাই নিয়ে সেই পুরোনো বাড়ির তিন তলায় সিড়ি ভেঙে উঠতে-উঠতে তুষার ভাবে--এখনও নিনি আছে কি এখানে? আছে তো!

বাড়িটায় অসংখ্য ঘর আর ফ্ল্যাট। ঠিক ঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার ওপর পাঁচ-সাত বছর আগেকার সেই নিনি এখনও এখানে আছে কিনা সন্দেহ। যদি না থেকে থাকে তবে ভুল করে ঢুকে বিপদে পড়বে না তো তুষার?

একটু দাঁড়িয়ে ভেবে, একটু ঘুরে-ফিরে দেখে তুষার ঘরটা চিনতে পারল । দরজা বন্ধ । বুক কাঁপছিল, তবু দরজায় টোকা দিল তুষার।

দরজা খুললে দেখা গেল, নিনিই। অবিকল সেইরকম আছে ।

চিনতে পারল না, ভ্রু তুলে ইংরিজিতে বলল--কাকে চাই?

তুষার হাসল-- চিনতে পারছ না ?

নিনি ওপরের দাঁতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু ভাবল । তুষার দেখল ডান দিকের একটা দাঁত নেই । সেই দাঁতটা বাঁধানো, দাঁতের রঙ মেলেনি। পাঁচ বছরে এইটুকু পালেটেছে নিনি ।

--আমি তুষার । নিনির মুখ হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে গেল ।

এবার বাংলায়--আঃ, তুমি কি সেইরকম দুষ্টু আছ ! বুড়ো হওনি?

-- আগে বলো, তুমি সেই নিনি আছো কি না! তোমার স্বামী-পুত্র হয়নি তো! হয়ে থাকলে দোরগোড়া থেকেই বিদায় দাও।

নিনি ঠোঁট উল্টে বলল--আমার ওসব নেই। এসো ।

ঘরে সেই রঙিন কাগজে ছাওয়া দেওয়াল, ভাড়া করা ওয়ার্ডরোব, মেয়েলি আসবাবপত্র। এখনো সেন্ট-পাউডার ফুলের গন্ধ ঘরময়। বিছানার মাথার কাছে গ্রামোফোন, টেবিলে রেডিও আর গিটার।

নিনি কয়েক পলক তাকিয়ে বলল--তুমি একটুও বদলাওনি।

--তুমিও।

কিন্তু তুষারের তীব্র ইচ্ছাটা এখনও অস্থির অন্ধের মতো বেরোবার পথ খুঁজছে! সে কি এইখানে তৃপ্ত হবে ? হবে তো ? উত্তেজনায়, অস্থিরতায় সে কাঁপতে থাকে । ওয়ার্ডরোবের পাল্লা খুলে সাবধানে গুপ্ত জায়গা থেকে একটা দামি মদের বোতল বের করে নিনি, তারপর হেসে বলে--এই মদ কেবল আমার বিশেষ অতিথিদের জন্য ।

এই সবই তুষারের জানা ব্যাপার । ওই যে গোপনতার ভান করে দামি বোতল বের করা ওটুকু নিনির জীবিকা। তুষারের মনে আছে নিনি বারবার তাকে এই বলে সাবধান করে দিত--মনে রেখো এটা ভদ্র জায়গা। আর, আমি বেশ্যা নই। মাতাল হয়ো না, হুল্লোড় করো না।

তুষার হাসল। সে বারবার নিনির কাছে মাতাল হয়ে হুল্লোড় করেছে ।

তুষার আজ মাতাল হওয়ার জন্য উগ্র আগ্রহে প্রস্তুত ছিল। একটুতেই হয়ে গেল । তখন তীব্র মাদকতাময় একটা গৎ গিটারে বাজাচ্ছিল নিনি। ওত পেতে অপেক্ষা করছিল তুষার। বাজনার সময়ে নিনিকে ছোঁয়া বারণ । খাজনা থামলে তারপর--

ভিতরে তীব্র ইচ্ছেষ্টা গিটারের শব্দে তীব্রতর হয়ে উঠেছে।

মুক্তি । সামনেই সেই মুক্তি । চোখের সামনে আবার সেই খাড়া বিশাল লোহার কাঠামোতে ঘনায়মান অন্ধকার, লোহার বিমে নুড়ির শব্দ।

বাজনা থামতেই বাঘের মতো লাফ দিল তুষার।

তীব্র আশ্লেষ-ইচ্ছা, আনন্দময় আবরণ উন্মোচন, তারই মাঝখানে হঠাৎ ব্যথায় ককিয়ে ওঠে নিনি--থামো, থামো, আমার বড় ব্যথা--

তুষার থামে--কী বলছ?

নিনি ঘর্মাক্ত মুখে ব্যথায় নীল মুখ তুলে বলে--এইখানে বড় ব্যথা--

পেটের ডান ধার দেখিয়ে বলে--গত বছর আমার একটা অপারেশন হয়েছিল । অ্যাপেন্ডিসাইটিস--

তুষারের স্খলিত হাত পড়ে যায়। পাঁচ বছরে অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে । সব কিছু কি আর ফিরে পাওয়া যায় ?

সময় পেরিয়ে গেল তুষার ফিরল না ।


বিকেলে চুল বেঁধেছে কল্যাণী । সেজেছে । চায়ের জল চড়িয়েছিল, ফুটে-ফুটে সেই জল শুকিয়ে এসেছে। গ্যাসের উনোন নিভিয়ে কল্যাণী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। উত্তরে ব্যালকনি, উলটোদিকে ফুটপাতে সেই বকুলগাছ, গাছতলায় ধুলো-মাখা আকীর্ণ ফুলের মধ্যে বসে আছে পাগলটা। একটু দূরে বসে একটা রাস্তার কুকুর পাগলটাকে দেখছে ।

দৃশ্যটাকে করুণ বলা যায়। আবাব বলা যায়ও না। অরুণকে নিয়ে এখন আর ভাববার কিছু নেই। এখন সে রাস্তার পাগল। মুক্ত পুরুষ ।

এখন ব্যালকনিটা অন্ধকার । পিছনে ঘরের আলো । তাই রাস্তা থেকে কল্যাণীকে ছায়ার মতো দেখায়। পাগলটা মুখ তুলে ছায়াময়ী কল্যাণীকে দেখে। টুপটাপ বকুল ঝরে পড়ে। অবিরল পাগলটা হাত বাড়িয়ে ফুল তুলে নেয়। লম্বা নোংরা নখে ছিঁড়ে ফেলতে থাকে ফল । রাত বাড়ছে। তার খিদে পাচ্ছে।


পুরানো বাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে অনেকক্ষণ হল রাস্তায় নেমে এসেছে তুষার। কখনো নির্জন সেক্সপিয়ার সরণী, কখনো চলাচলকারী মানুষের মধ্যে চৌরঙ্গি রোড ধরে বহুক্ষণ হাঁটল সে। এখনো মাঝে মাঝে উঁচু বাড়ির লোহার কাঠামোর ভিতরে ঘনায়মান অন্ধকার তার মনে পড়ছে, মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছে নেপথ্যে কে যেন নুড়ি ছুঁড়ে মারছে লোহার বিমের গায়ে। তার মন বলছে এখানে নয়, এখানে নয়। চলো সমুদ্রে যাই। কিংবা চলো পাহাড়ে, ছুটি নাও । মুক্তি নাও। বৃথা বয়ে যাচ্ছে সময় ।

কেন যে এই ভূতুড়ে মুক্তির ইচ্ছা ? সে কি চাকরি করতে করতে ক্লাস্ত ? সে কি সংসারের একঘেয়েমি আর পছন্দ করছে না ? কল্যাণীর আকর্ষণ সব কি নষ্ট হয়ে গেল?

বেশ রাত করে সে বাড়ি ফিরল।

সোমা ঘুমিয়ে পড়েছে। কল্যাণী দরজা খুলে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

--মদ খেয়েছো?

--খেয়েছি ।

-- আর কোথায় গিয়েছিলে ?

-- কোথায় আবার ?

কল্যাণী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে।

ভারী বিরক্ত হয় তুষার--কাঁদছো কেন ? মদ তো আমি প্রথম খাচ্ছি না ! আমাদের যা স্ট্রেইন হয় তাতে না খেলে চলে না--

কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ তীব্র মুখ তোলে কল্যাণী--শুধু মদ ! মেয়েমানুষের কাছে যাওনি ? তোমার ঠোঁটে গালে শার্টে লিপস্টিকের দাগ--তোমার গায়ে সেন্টের গন্ধ--যা তুমি জন্মে মাখো না--

তুষার অপেক্ষা করতে লাগল। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।

অনেকটা রাত হল আরো । বেশ পরিশ্রম করতে হল তুষারকে । তারপর রাগ ভাঙল কল্যাণীর । উঠে ভাত দিল ।

বাইরে বকুল গাছের তলায় তখন পাগলটা অনেকগুলি ফুল নখে ছিঁড়ে স্তুপ করেছে। উগ্র চোখে সে চেয়ে আছে। অন্ধকার ব্যালকনিটার দিকে । ঘরের দরজা বন্ধ । তার খিদে পেয়েছে। মাঝে মাঝে সে চেঁচিয়ে বলছে--অন্ধকার । ভীষণ অন্ধকার । কোই হ্যায় ।

সেই ডাক শুনতে পেল তুষার । খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল--পাগলটাকে রাতের খাবার দাওনি ?

--কী করে দেবো ? রোজ মঙ্গলা রাতে একবার আসে খাবারটা দিয়ে আসতে। আজ আসেনি, ওর ছেলের অসুখ ।

--আমার কাছে দাও, দিয়ে আসছি ।

--তুমি দেবে ? অবাক হয় কল্যাণী ।

নয় কেন?

--শুধু দিয়ে আসা তো নয়। বাবুর খাওয়া হলে এঁটো বাসন নিয়ে আসতে হবে। পাগলের এঁটো তুমি ছোঁবে ? তুষার হাসল--তোমার জন্য ও অনেক দিয়েছে। ওর জন্য কিছু দিই--

থালায় নয়, একটা খবরের কাগজে ভাত বেড়ে দিল কল্যাণী ।

তুষার সেই খবরের কাগজের পোঁটলা নিয়ে বকুল গাছটার তলায় এল ।

পাগলটা তুষারের দিকে তাকালও না । হাত বাড়িয়ে পোঁটলাটা নিল। খুলে খেতে লাগল। গোগ্রাসে ।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা সিগারেট খেতে খেতে দেখতে লাগল তুষার ।

--খাওয়া ছাড়া তুমি আর কিছু বোঝো না অরুণ ?

পাগলটা মুখ তুলল। না । তার খিদে পেয়েছে । সে খেতে লাগলে ।

--ঐখানে, ঐ ব্যালকনিতে মাঝে মাঝে কল্যাণী এসে দাঁড়ায় । তাকে দেখ না ? তার বাঁ গালে সেই সুন্দর কালো আঁচিলটা এখনো মাছির মতো বসে থাকে--দেখ না ? এখনো আগের মতোই ভারী তার চোখের পাতা, দীর্ঘ গ্রীবা, এখনো তেমনি উজ্জ্বল রঙ । চেয়ে দেখ না অরুণ ?

পাগল গ্রাহ্যও করে না । তার খিদে পেয়েছে । সে খাচ্ছে ।

আকাশে মেঘ করেছে খাব । তুষার মুখ তলে দেখল। পিঙ্গল আকাশ, বাতাস থম ধরে আছে। ঝড় উঠবে। এই ঝড়বৃষ্টির রাতেও বাইরে থাকবে পাগল । হয়তো কোনো গাড়ি বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়াবে। ঝড় খাবে। আর অবিরল নিজের মধ্যবর্তী বিচ্ছিন্ন চিন্তার এক স্রোতস্বিনীকে করবে প্রত্যক্ষ ।

--তোমার কোনো নিয়ম না মানলেও চলে, তবু কেমন নিয়মে বাঁধা পড়ে গেছো অরণ । তোমার মুক্তি নেই ।

ডাল তরকারিতে মাখা কাগজটা ছিঁড়ে গেছে ৷ফুটপাথের ধুলোয় পড়েছে ভাত। পাগল তার নোংরা হাতে, নখে খুঁটে খাচ্ছে। একটা রাস্তার কুকুর বসে আছে অদূরে, আর দুটো দাঁড়িয়ে আছে। তুষার চোখ ফিরিয়ে নিল।

ঘর অন্ধকার হতেই সেই লোহার কাঠামো, তার ভিতরকার ঝুঝুকো আঁধার আর একবার দেখা গেল । লোহার বিমের গায়ে নুড়ি পাথরের টুং টুং শব্দ। অবিরল অবিশ্রাম। বুকে খামচে ধরে মুক্তির তীব্র সাধ । কিসের মুক্তি ? কেমন মুক্তি ? কে জানে! কিন্তু তার ইচ্ছা উত্তপ্ত পারদের মতো লাফিয়ে ওঠে ।

আকুল আগ্রহে সে আবার বাতি জ্বালে। কল্যাণী বলে--কী হল ?

উত্তেজিত গলায় তুষার ডাকে--এসো তো, এসো তো কল্যাণী ।

তারপর সে নিজেই হাত বাড়িয়ে মশারির ভিতর থেকে টেনে আনে কল্যাণীকে। আনে নিজের বিছানায়। কল্যাণী ঘোমে ওঠে। উজ্জ্বল আলোয় কল্যাণীকে পাগলের মতো দেখে তুষার চুমু খায়, তীব্র আগ্রহে, রিরংসায় তাকে মন্থন করে, বিড়বিড় করে বলে--কেন তোমার জন্য ও পাগল? কী আছে তোমার মধ্যে? কী সেই মহামূল্যবান? আমাকে দিতে পারো তো ?

বৃথা । সবশেষে ঘোরতর ক্লান্তি নামে ।

এইটুকু আর কিছু নয় ।

ওরা ঘুমোয়। বাইরে ঝড়ের প্রথম বাতাসটি বয়ে যায়। প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাটি একটি পোকার মতো উড়ে এসে বসে পাগলাটায় ঠোঁটে । বসে বসে ঝিমোয় পাগল । তার রক্তবর্ণ চুলগুলি নিয়ে খেলা করে বাতাস। বিদ্যুৎ উদ্ভাসিত করে তার মুখ । মাথায় অবিরল বকুল ঝরিয়ে দিতে থাকে গাছ ।


বহু উঁচু থেকে ক্রেন হ্যামারটা ধম করে নেমে আসে। চমকে উঠে বসে তুষার। বুকের ভিতরটা ধকধক করতে থাকে । এত জোরে বুক কাঁপতে থাকে যে দুহাতে বুক চেপে ধরে কাতরভাবে একটা অস্ফুট শব্দ করে সে ।

কিসের শব্দ ওটা ? অন্ধকারে উঁচু উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্দ ক্রেন হ্যামারটা সে কোথায় দেখেছে? কবে? বাইরে ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দ বাড়ি বাড়ি করা নেড়ে ফিরছে। একা একা উল্লাসে ফেটে পড়ছে ঝড়। সেই শব্দে মাঝরাতে ঘুমভাঙা তুষার চেয়ে থাকে বেভুল মানুষের মতো। বুক কাঁপে। আস্তে আস্তে মনে পড়ে একটা বিশাল লোহার কাঠামো তাতে ঘনায়মান অন্ধকার, উঁচু ক্রেন হ্যামার । অমনি ব্যথিয়ে ওঠে বুক । তীব্র মুক্তির ইচ্ছায় ছটফট করতে থাকে সে । তার মন বলে--চলো সমুদ্রে । চলো পাহাড়ে । চলো ছড়িয়ে পড়ি।

বুক চেপে ধরে তুষার। আস্তে আস্তে হাঁপায় ।

বাইরে খর বিদ্যুৎ দিয়ে মেঘ স্পর্শ করে মাটিকে ।

এই ঝড়ের রাতে তুষারের খুব ইচ্ছে হয়, একবার উঠে গিয়ে পাগলটাকে দেখে আসে।

কিন্তু ওঠে না। নিরাপদ ঘরে ভীরু গৃহস্থের মতো সে বসে থাকে।

বাইরে ভিখিরি, পাগলদের ঘরে ঝড় ফেটে পড়ে। তাদের ঘিরে নেমে আসে অঝোর বৃষ্টির ধারা।

পরদিন আবার বকুলতলায় পাগলকে দেখা যায় । অফিস যাওয়ার আগে পানের পিক ফেলতে এসে উত্তরের ব্যালকনি থেকে তাকে দেখে তুষার । একটু বেলায় কল্যাণী আসে । দেখে । অভ্যাস ।

কাজের মধ্যে ডুবে থাকে ৷ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে তুষার মাঝে মাঝে অস্বস্তি বোধ করে । অফিসের পর বাদুড়ের পাখনার মতো অন্ধকার ক্লান্তি নামে চারধারে । অনেক দূর হেঁটে যায় তুষার। ট্যাক্সিতে ওঠে, কোনোদিন ওঠে না । হেঁটে হেঁটে চলে যায় বহু দূর। কী একটা কাজ বাকি রয়ে গেল জীবনে ৷ করা হল না । এক রোমাঞ্চকর আনন্দময় মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল আমার ! পেলাম না। অস্থিরতা বেড়ালের থাবার মতো বুক আঁচড়ায়।

মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যায়। তার ৷ উঠে বসে । সিগারেট খায় । জল পান করে। কখনো বা উত্তরের দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় । মোমবাতির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে সাদা বাতিস্তম্ভ, তার নিচে বকুল গাছ, তার ছায়া। অন্ধকারে একটা পুঁটলির মতো পড়ে আছে পাগল।

আবার ফিরে আসে ঘরে । বাতি জ্বালে । পাতলা নেট-এর মশারির ভিতর দিয়ে তৃষিত চোখে ঘুমন্ত কল্যাণীকে দেখে । তার বুক ঘেঁষে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চা সোমা । সোমার মাথার কাছে দুটো কাগজ, তাতে ছবি আঁকা ৷ একটাতে নদী, নৌকো, গাছপালা। অন্যটাতে খোঁপাসুদ্ধ একটা মেয়ের মুখ, নিচে লেখা সোমা। অনেকক্ষণ ছবি দুটোর দিকে চেয়ে রইল তুষার একটা শ্বাস ফেলল।

কল্যাণী শান্তভাবে ঘুমোচ্ছে। মুখে নিশ্চিত কমনীয়তা। চেয়ে থাকে তুষার । আস্তে আস্তে বলে--কী করে ঘুমোও?


--চলো, বাইরে যাই । কিছুদিন ঘুরে আসি। এক সকালে চায়ের টেবিলে কল্যাণীকে এই কথা বলল অবসন্ন তুষার।

--চলো । কোথায় যাবে ?

--কোথাও । দূরে। সমুদ্রে বা পাহাড়ে।

--পুরীর সমুদ্র তো দেখেছি। দার্জিলিং শিলঙও দেখা ।

--অন্য কোথাও । অচেনা নিজন জায়গায়। বলে তুষার। কিন্তু সে জানে--মনে মনে ঠিক জানে--যাওয়া বৃথা । সে কতবার গেছে বাইরে, সমুদ্রে, পাহাড়ে । তার মধ্যে মুক্তি নেই, জানে। মুক্তি এখানেই আছে । আছে দুর্লভ ইচ্ছাপূরণ । খুঁজে দেখতে হবে ।

তবু তারা বাইরে গেল । এক মাস ধরে তারা ঘুরল নানা জায়গায়। পাহাড়ে, সমুদ্রেও। ফিরে এল একদিন।

পাগলটা ঠিক বসে আছে। উত্তরের ব্যালকনিটার দিকে চেয়ে।

মাঝে মাঝে কাজের মধ্যেও তুষার হঠাৎ বলে ওঠে--না্‌নাঃ । বলেই চমকায়। কিসের না? কেন না?

ছোকরা স্টেনোগ্রাফারটিকে জরুরী ডিকটেশন দিতে দিতে বলে ওঠে--না্‌নাঃ । স্টেনোগ্রাফারটি বিনীতভাবে থেমে থাকে।

তুষার চারদিকে চায় । অদৃশ্য মশারির মতো কী একটা ঘিরে আছে চারদিকে! ওটা কী ! ওটা কেন! কী আছে ওর বাইরে ?

নিজন শেক্সপিয়ার সরণী ধরে হাঁটে তুষার, হাঁটে নিজান ময়দানে, হাঁটে ভিড়ের মধ্যে । বহু দূরে দূরে চলে যায়। কিন্তু সেই অলীক মশারির বাইরে কিছুতেই যেতে পারে না। ট্যাক্সিতে উঠে বলে--জোরে চালাও ভাই । আরো জোরে...আরো জোরে....

ট্যাক্সি উড়ে যায় । তবু চারদিকে অলীক সূক্ষ্ম জাল ।

হতাশ হয়ে ভাবে--আছে কোথাও বাইরে যাওয়ার পথ । খুঁজে দেখতে হবে । চোখ বুজে ভাবে। উটের মতো একটা ক্রেন হ্যামার আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে বিশাল লোহার কাঠামো, সেইখানে একটা লোহার বিমে নুড়ি ছুঁড়ে শব্দ তুলছে বাচ্চা একটা ছেলে।

এক একদিন রাতে ভাত দিতে নেমে আসে তুষার। ভাত রেখে একটু দূরে দাঁড়ায় । সিগারেট খায় ।

--অরুণ, তোমার কি ইচ্ছে করে আমার ঘরে যেতে ?

পাগল খায়। উত্তর দেয় না।

--ইচ্ছে করে না কল্যাণীকে একবার কাছ থেকে দেখতে ?

পাগল খায়। কথা বলে না।

জানতে চাও না সে কেমন আছে?

ফিরেও তাকায় না পাগল। খেয়ে যায়।

--একদিন তোমাকে নিয়ে যাব আমাদের ঘরে । যাবে অরুণ ?

একজন প্রতিবেশী পথ চলতে চলতে দাঁড়ায় । হঠাৎ বলে-- আপনার বড় দয়া । রোজ দেখি দু'বেলা পাগলটাকে আপনারা ভাত দেন। আজকাল কেউ এতটা করে না অন্য কারো জন্য। আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের কাছে আপনার কথা বলি।

কৌতূহলে প্রশ্ন করে তুষার--কী বলেন ।

--বলি, ঐরকম মহাপ্রাণ হয়ে ওঠো। আমরা তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দ্বারা কিছু হল না পৃথিবীর । কাছাকাছি আপনি আছেন--এটাই আমাদের বড় লাভ।

তুষার মূক হয়ে যায়। এ কেমন মিথ্যা প্রচার! দয়া! দয়া কথাটা কেমন অদ্ভুত! এমন কথা সে তো ভাবেওনি ।

কিন্তু ভাবে তুষার। ভাবতে থাকে। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে তেমনি বলে ওঠে--ন্‌নাঃ। চমকায়। জালবন্ধ এক অস্থিরতায় অন্যমনস্ক হয়ে যায় । ঝড়বৃষ্টি হলে এখনো মাঝে মাঝে ক্রেন হ্যামারটা ধম করে নেমে আসে। জেগে উঠে যন্ত্রণায় বুক চেপে কাতরতার শব্দ করে সে ।

এক রাতে সত্যিই তুষার কল্যাণীকে ভাত বাড়তে বলে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল । রাস্তা পার হয়ে এল বকুল গাছটার তলায়।

--চলো অরুণ ৷ একবার আমার ঘরে চলো। কোনোদিন তুমি যেতে চাওনি । আজ চলো । আমি নিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে । আজ তোমার নিমন্ত্রণ।

বলে হাত ধরল পাগলের । পরিষ্কার সুন্দর হাতে ধরল নোংরা হাতখানা।

কে জানে কী বুঝল পাগল, কিন্তু উঠল।

সাবধানে তার হাত ধরে রাস্তা পার করল তুষার । সিঁড়ি বেয়ে এল । দাঁড়াল এসে খাবার ঘরের দরজায় ।

--কল্যাণী, দেখ কাকে এনেছি ।

কল্যাণীর হাত থেকে পড়ে গেল একটা চামচ । ভয়ঙ্কর ঠিন্‌ঠিন্‌ শব্দ হল । কেঁপে উঠল কল্যাণীর বুক । শরীর কাঁপতে লাগল। ভয়ে সাদা হয়ে গেল তার ঠোঁট।

--মা গো! চিৎকার করল সে।

নরম গলায় তুষার বলল--ভয় নেই, ভয় নেই কল্যাণী । তুমি খাবার সাজিয়ে দাও। অরুণ আজ আমার অতিথি ।

নীরবে দাঁড়িয়ে রইল কল্যাণী । জলে তার চোখ ভরে গেল ।

তুষারের হাতে-ধরা পাগল নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল ।

এত কাছ থেকে অরুণকে অনেকদিন দেখেনি কল্যাণী। কী বিপুল দারিদ্র্যের চেহারা। খালাসিদের যে নীল জামাটা ওর গায়ে, তা বিবর্ণ হয়ে ছিঁড়ে ফালা ফালা । খাকি প্যান্টের রঙ পাল্টে ধূসর হয়ে এসেছে। কী পিঙ্গল ওর ভয়ঙ্কর রাঙা চুল। পৃথিবীর সব ধুলো আর নোংরা ওর গায়ে লেগে আছে। কেবল তখনো অকৃপণ সুন্দর সুগন্ধি বকুল ফুল ছেয়ে আছে ওর মাথার জটায়, ঘাড়ে।

কাঁপা হাতে খাবার সাজিয়ে দিল কল্যাণী । তার চোখ দিয়ে অবিরল জল গড়িয়ে পড়ছে। পাগল তার দিকে তাকালই না। চোখ নিচু রেখে খেয়ে যেতে লাগল।

মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে তুষার বলছিল--খাও অরুণ, খাও ।

খাওয়া শেষ হলে তাকে আবার হাত ধরে তুলল তুষার। নিয়ে এল ঘরে।

--এই দেখ আমার ঘোরাদোর। ঐ যে মশারির নিচে শুয়ে আছে, ও আমার মেয়ে সোমা। এই দেখ, ওর হাতে আঁকা ছবি। এই দেখ ওয়ার্ডরোব, ফ্রিজিডেয়ার। ঐ ড্রেসিং টেবিল। এই দেখ, আরো কত কী...

ঘুরে ঘুরে অরুণকে সব দেখায় তুষার।

মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে--এখানে এই সুন্দর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না অরুণ ? ইচ্ছে করে না এই সব জিনিসপত্রের মালিক হতে ? তুমি আর চাও না কল্যাণীর মতো সুন্দর বৌ? সোমার মতো মেয়ে।

অরুণের হাতে জোর ঝাঁকুনি দেয় তুষার--বলো অরুণ, ইচ্ছে করে না?

--অন্ধকার ? ভীষণ অন্ধকার! পাগল বলে ।
--কোথায়--কোথায় অন্ধকার ?
--এইখানে ।

বলে চারদিকে চায় পাগল ।

--আর কোথায় ?
--চারদিকে ।
--থাকবে না অরুণ ? থাকো থাকো। থেকে দেখ ।

পাগল কিছু বলে না ।

হতাশ হয়ে তার হাত ছেড়ে দেয় তুষার।

পাগলটা আস্তে আস্তে সদর পার হয় । সিঁড়ি ভাঙে ৷রাস্তা পেরিয়ে চলে যায় বকুল গাছটার তলায় ৷ পা ছড়িয়ে বসে। গুঁড়িতে হেলান দেয়। কুলকুল করে বয়ে চলে তার অন্য লগ্ন চিন্তার স্রোতস্বিনী। চোখ বুজে অনাবিল আনন্দে সে সেই স্রোত প্রত্যক্ষ করে।

উত্তরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় তুষার। চেয়ে দেখে নিশ্চিন্তে বকুল গাছের ছায়ায় আবার বসেছে পাগল ৷ টুপটাপ বকুল ঝরছে তার মাথায়।

উত্তরের ব্যালকনি থেকে দৃশ্যটা দেখে তুষার। তার দুই চোখ ভরে আসে জলে ।

--কিছুই চাও না অরুণ। বকুল গাছের তলায় তোমার হৃদয় জুড়িয়ে গেছে। হায় পাগল, ভালবাসা নয়, এখন কেবল ভাতের জন্য তোমার বসে থাকা ।


এখন আর কল্যাণীর কোনো সন্দেহ নেই। সে কাছ থেকে অরুণকে দেখেছে। সে কেঁপেছিল থরথর করে। দুঃখে ভয়ে উৎকণ্ঠায়। কিন্তু অরুণের মুখে সে দেখেছে বিস্মৃতি । তাকে আর মনে নেই অরুণের।

বড় শীত পড়েছে এবার। বকুল গাছ থেকে শুকনো পাতা খসে পড়ছে পাগলের গায়ে । ছেঁড়া জামা দিয়ে হু-হ করে উত্তরে হাওয়া লাগছে শরীরে। বড় দয়া হয় । মঙ্গলার হাত দিয়ে একটা পুরানো কম্বল পাঠিয়ে দেয় কল্যাণী । পাগল সেই কম্বল মুড়ি দিয়ে নির্বিকার বসে থাকে।

মাঝে মাঝে কল্যাণীরও বুক ব্যথিয়ে ওঠে । ভালবাসার কথা মনে পড়ে। তুষার কি তাকে ভালবাসে এখনো । কে জানে। মাঝে মাঝে উগ্র রিরংসায় তাকে মন্থন করে তুষার । কখনো দিনের পর দিন থাকে নিস্পৃহ । আর, ঐ যে ভালোবাসার জন্য পাগল অরুণ--ও বসে আছে ভাতের প্রত্যাশায় । কল্যাণীকে চিনেও চেনে না ।

তাহলে কী করে বাঁচবে কল্যাণী ! বুক থামচে ধরে এক ভয় ।

আবার, বেঁচেও থাকে কল্যাণী । বাঁচতে হয় বলে।

মাথার ওপর সব সময়ে উদ্যত নিস্তব্ধ ক্রেন হ্যামারটাকে টের পায় তুষার। অস্বস্তি। কখন যে ধম করে নেমে আসে। অকারণে বুক কাঁপে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে তুষার। ঠিক সকাল নটায় পিক ফেলতে এসে উত্তরের ব্যালকনি থেকে বকুল গাছটার গোড়ায় পাগলকে দেখে । দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে থাকে ।

কোম্পানি এবার উনিশ লক্ষ টাকা লাভ করেছে। ক্লান্তি বাড়ে। দিনশেষে তার শরীর জুড়ে নেমে আসে বাদুড়ের ডানার মতো অন্ধকার ক্লান্তি । তার ডালপালা ধরে কেবলই নাড়া দেয় এক তীব্র ইচ্ছা। নাড়া দেয়, নাড়া দিতে থাকে । অলীক ছুটি, মিথ্যা অবসর, অবিশ্বাস্য মুক্তির জন্য খামোকা আকুল হয় সে। পৃথিবী ঘুরে যাচ্ছে। বয়ে যাচেছ সময় ৷ বয়স বাড়ছে ।

তুষার অস্থির হয় । অস্থিরতা নিয়ে বেঁচে থাকে।

ঠিক যেন এক নদীর পাড়ে বসে আছে পাগল। কী সুন্দর আবছায়া নদীটি । চারদিকে আধো আলো, আধো অন্ধকার । অনন্ত সন্ধ্যা । নদীটি বয়ে যায় অবিরল । স্মৃতি স্মৃতিময় তার স্রোত। পাগল প্রত্যক্ষ করে । ক্লান্তি আসে না । বকুলের গাছ থেকে পাতা খসে পড়ে, কখনো ফুল বৃষ্টি আসে, ঝড় বয়ে যায়, আবার দেখা দেয় রোদ। তবু আবছায়ায় নদীটি বয়ে যায় । বয়ে যায় ।

পাগল বসে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ