হাসান আজিজুল হকের গল্প : স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র

সকালের খাবারের পর এক কাপ দুধ-চিনি ছাড়া ঠাণ্ডা চা তিন চুমুকে গিলে নিয়ে লেখক তাঁর স্ত্রীকে বললেন, আমি লেখার ঘরে যাচ্ছি, কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে বলবে, দেখা হবে না, আমার স্বপ্ন দেখা চলছে। স্বামীর দিকে একবার স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলেন লেখকের স্ত্রী। সত্যি, অনেকদিন তো তেমন করে দেখেননি স্বামীকে! গোল মাথার সমস্ত চুল উঠে গেছে, পরিচ্ছন্ন রোঁয়াহীন শালগমের মতো দেখাচ্ছে মাথাটা। ঘাড় যেন কয়েকগুচ্ছ নড়বড়ে দড়ি, মাথাটাকে ধরে রাখতে থরথর করে কাঁপছে। হাত পা সরু সরু। চোখে পড়ে বিরাট একটি ভুঁড়ি, শরীর থেকে বাড়তি, এক কোপে ওটাকে নামিয়ে দিতে পারলেই শরীরটায় যেন সামঞ্জস্য ফেরে। স্ত্রী ভাবলেন, শামলা রঙের লোহার মতো শক্ত মজবুত কাঠামোর লম্বা চুলের, উজ্জ্বল চোখের সেই মানুষটি কোথায়! তিনি শুধু বললেন, আচ্ছা বলব।

নিজের ঘরে এসে উত্তরের জানলা খুললে বাইরে নিমগাছ আর বড় ফাঁকা একটা মাঠ। অনাবাদি পাথুরে, টিলার মতো উচু জায়গার ঢালুতে একটা বড় মরা গরু ফেলে দিয়ে গেছে কেউ। গোটা কতক কুকুর আর শকুন দেখা যাচ্ছে সেখানে। শকুন তো দেখা যায় না আজকাল! মরা গরুও তেমন দেখা যায় না। গরুদের মরার কোনো সুযোগই হয় না, তার আগেই ওদের গলায় ছুরি বসে। কসাইয়ের ছুরি ফসকে এক আধটা গরু মরে গেলেও আবার তারা কসাইয়ের দোকানে ঝোলে। একবার এক ভূতুড়ে বাড়িতে রাত কাটাতে হয়েছিল, সকালে পায়খানার দিকে যেতে ছাদ ছাড়া ভাঙা ঘরটার মধ্যে একটা কুকুরের মুণ্ডু দেখেছিলেন, লাল রঙের কুকুরটার ধড়ও চোখে পড়েছিল। যে লোকটা তার ছাল ছাড়াচ্ছিল, তার পিছনে দশ বছরের একটি ছেলে গলা নামিয়ে বলেছিল, আদমি আয়া, দেখতা হ্যায়। কুকুরটার স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল ।

লেখকের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেছে। ধুলোর পাহাড় সরিয়ে নিজের চেয়ারে বসতে হয় তাকে। পা থেকে ভুরু পর্যন্ত ধুলোয় ডোবা। গলার মধ্যে ঢুকে যায় শুকনো হড়কড়াই ধুলো, দমকে দমকে কাশি উঠে আসে নাভিমূল থেকে, কষ বেয়ে নেমে আসে লালায়-ভেজা আঠালো ধুলোর সরু নালি, জিভে মাটির সোঁদা স্বাদ । শুধুমাত্র চোখ দুটিকে ধুলোর বাইরে আনেন লেখক, চোখ দুটি খোলা না থাকলে স্বপ্ন দেখতে পান না তিনি। দু'পাশে কাঠের আর লোহার র‍্যাকে হলুদ হয়ে যাওয়া বইয়ের সারি, সমস্ত অক্ষর উঠে গেছে, ধুলো একটা অক্ষরও আস্ত রাখেনি, সমস্ত শুষে খেয়ে নিয়েছে। আঙুল দিয়ে মুছে মুছে তবে অনেক সময় দেখা যায় কিছু কিছু অক্ষর আধ-খাওয়া রয়েছে। আঙুলের ডগায় সেইসব অক্ষরের ভাঙা জায়গাগুলো কড়কড় করে। সমস্ত বইয়ের কাঁধে এমনিই ধুলোর প্রতাপ যে কারো নাম পড়া যায় না।

কোলকুঁজো হয়ে লেখক চেয়ারে বসলে দুমদাম করে এক একটি বই র‍্যাক ছেড়ে উঠে এসে তাঁর উপরে পড়ে। পত্রিকাগুলো উড়তে থাকে আকাশের অনেক উঁচুতে ঠিক যেন শকুনের ঝাঁক, নিঃশব্দে কালো কালো বিন্দুর মতো চক্কর দিতে দিতে তারা নিচে নামে, শেষে ঝটপট শব্দে ডানা গুটিয়ে নিতে নিতে লেখকের ঘাড়ে চেপে আসে। একসাথে একটা গোটা র‍্যাকের সমস্ত পত্রিকা উড়ে এসে তাঁকে সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়। শুধুমাত্র ময়লা চোখ দুটি ছাড়া। লেখক পুরোপুরি ঢাকা পড়েন, হ্যাঁ, এখন তিনি স্বপ্নের মতোই স্পষ্ট বিশ্বাসযোগ্য দেখতে পাচ্ছেন জিনিসপত্র, মানুষজন, বারান্দার উপর ঘটিবাটির মতো সাজানো নানা ঘটনা। স্পষ্ট কিন্তু এলোমেলো । আবার স্বপ্নে যেমন হয়, আবছা, রহস্যময়, ফিকে, আঁধার, স্বপ্নের যা স্বভাব, মিশে গলে কাদার মতো ঢলঢলে হয়ে যাওয়া। যেমন সারা জীবন তিনি যা লিখতে চেয়েছেন, কিন্তু লিখতে পারেননি, এখন স্বপ্নে দেখা ছাড়া আর লিখতে পারবেনও না কোনোদিন। ধুলোয় বুজে আছে কলম, সমুদ্রের মুখের কাছটায় গিয়ে যেমন পলি পড়ে পড়ে স্রোত আটকানো মাথা-মোটা বিষাক্ত সাপের মতো হয়ে যায় নদী, নীল বিষের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় জনপদ, অনেকটা সেই রকম। লিখতে না পারার ক্ষোভে ধোঁয়া আর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পুড়তে থাকে ওঁর মগজ, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাষ্পের মতো বেরিয়ে যায় ঐ থকথকে পদার্থ। তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন : তালগাছের মাথার উপরে কী বিশাল একটি নৌকো, আলকাতরা মাখানো নিকষ কালো, নদী থেকে অনেকটা দূরে, চিকচিকে অসুস্থ একটি জলের ধারা, ঐ হচ্ছে নদী, তালগাছের মাথা পর্যন্ত ফোঁপে উঠে নৌকোটিকে সেখানে আটকে দিয়ে গজরাতে গজরাতে নেমে যায় আর মাঝে মাঝে কঠিন আক্রোশে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে। আশেপাশে সবই প্রকাণ্ড, ঢাকের মতো বাজবার অপেক্ষায় মানুষের লাশ চারপাশে ছিটিয়ে আছে, একটা করে টোকা দিলেই দ্রিমি দ্রিমি বেজে উঠবে। স্বপ্লে আবার নিজে নিজে কিছু করার উপায় নেই, সবই শুধু ঘটে যায়, সবই সয়ে যেতে হয়, গরু-ছাগলগুলোও ফুলে ঢাক হয়ে আছে, সমস্ত দিগন্ত নদী নালা মাঠ প্রান্তর নিয়ে চক্রাকারে ঘুরছে, বাতাসও বাইরে যেতে পারে না। ওদিকে জঙ্গলের মধ্যে দুই বিশাল মহীরুহের মাঝখানে বাবুই পাখির বাসার মতো দুহাতে লতা ধরে ঝুলে আছে বারো বছরের এক শিশু, শুকনো খড়ের মতো হালকা। এসব নিয়ে লেখা যায়নি। কিংবা বিষম ফেঁপে ওঠা বলেশ্বর গদগদিয়ে জল ঢালে সমুদ্রের মুখে, বলেশ্বর হয়ে ওঠে হরিণঘাটা, দিকহীন মোহনা বাতাসে নীল চাদরের মতো ফেঁপে ওঠে, আর প্রবল ধারায় বৃষ্টি হতে থাকে, আকাশ নেমে এসে সমুদ্রের সঙ্গে বুকে বুক লাগিয়ে মিশে যায়-- এই নিয়ে পুরো একটি বই লিখবার ছিল, তার একটি অক্ষরও লেখা হয়নি। এখন শুধুই স্বপ্ন, হিংস্র শ্বাপদের মতো বারবার হানা দেয়, বিলের তলায় ড্রামভর্তি আচারের মতো ফালি ফালি করে কাটা মানুষের দেহ, তারা ড্রাম থেকে বেরিয়ে হেঁটে নিজেদের বাড়িতে চলে যায়, টোয়াং টোয়াং শব্দে ঘড়ি সময়কে পিছিয়ে দেয়, বিশাল একটি দা তেরছা করে মানুষগুলিকে কেটে ফেলে, ড্রামের মধ্যে হাত পা মাথা বুক, আবার ঢুকছে, ড্রাম আবার বিলের জলের তলার আঁধারে; ঝোপের আড়ালে যে বস্তাটি ছিল সেটা উঠোনে এনে মুখটা খুলতেই গড়গড় করে গড়িয়ে যায় একটি মাথা, একটি বিধবা চোখ আকাশে তুলে পেত্নীর গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলে, হা ভগমান, আমাদের বাড়ির লোক। কিন্তু লেখকের এই গল্প লেখা হয়নি। এমনি করে রাস্তার ভাঁড়, বাজারের বেশ্যা, জমির মজুর কাউকে নিয়ে কিছুই লেখা হয়ে ওঠেনি। তারপর যাযাবর জাদুকর, বান্ডিলের সুতো শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে যে বলে, লেগে যা, সাথে সাথে সুতোটা ঝুলতে থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সুতো ধরে তরতর করে উপরে উঠতে থাকে জাদুকর আর দুএক মিনিটের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন আকাশ থেকে বিকট আর্তনাদে আওয়াজ আসে, শূন্য থেকে প্রথমে আসে জাদুকরের কালো টুপিটা, তারপর তার চেয়ে থাকা মাথা, তখনো টাটকা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা থেকে, তারপর জাদুকরের টুকরো টুকরো হাত পা ধড়। এর একটুখানি পর, আপনারা সব এখানে কী করছেন বলে ভিড় থেকে জাদুকর নিজেই বেরিয়ে এসে তার নিজের শরীরের অংশগুলো হাওয়া করে দিয়ে বান্ডিলের সুতোটা গুটিয়ে এনে তালুতে রেখে দেয়--

এইসব বৃত্তান্ত তিনি কতকাল থেকে লিখতে চেয়েছেন, কিন্তু লেখা হয়নি। এত রক্ত দিয়ে কী লিখবে লেখক যখন তার নিজেরই শুক্র পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। ধুলোর মধ্যে চোখ দুটি পুরোপুরি ঢেকে গেলে লেখকের স্বপ্ন দেখা শেষ হয়। তখন নিষ্কম্প বিরাট মুখ থুবড়ানো আঁধার। আঁধার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ