রংগন চক্রবর্তী
কোনো একটি রাষ্ট্র যখন নিজের স্বার্থে অন্য কোনো একটি ভূখণ্ডকে দখল করে নেয়, এবং সেই দখল করা ভূখণ্ডের মানুষদের ওপর নিজের শাসন চাপিয়ে দিয়ে তাদের শোষণ করে নিজের লাভ বাড়ায়, তখন এই শাসন ব্যবস্থাটাকেই সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism) বলা হয়। সাম্রাজ্যবাদ। আমাদের ইতিহাসে এক খুবই পুরোনো অভিজ্ঞতা, নতুন কিছু আদৌ নয়। কলোনিয়ালিজম এই সাম্রাজ্যবাদেরই একটা বিশেষ রূপ। সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা গেছে যে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরাই অধিকৃত অঞ্চলে এসে বসবাস করে সেখানকার মানুষজন, সংস্কৃতি, জীবনধারার সঙ্গে মিশে যায়।
কিন্তু উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং উপনিবেশগুলোর মধ্যে ফারাককে যত্ন করে টিকিয়ে রাখা হয়। আইনের চোখেই হোক বা শাসনের প্রাত্যহিক নিয়মের মধ্যে দিয়েই হোক, উপনিবেশবাদের মূল কথাই হল এই অসাম্য : কেন্দ্রের অধিবাসী, ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের জন্য এক আইন আর উপনিবেশের মানুষদের জন্য অন্য আইন। কেন্দ্রের সুযোগ সুবিধের পাল্লা উপনিবেশের তুলনায় সব সময়ই ভারি।
কিন্তু উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং উপনিবেশগুলোর মধ্যে ফারাককে যত্ন করে টিকিয়ে রাখা হয়। আইনের চোখেই হোক বা শাসনের প্রাত্যহিক নিয়মের মধ্যে দিয়েই হোক, উপনিবেশবাদের মূল কথাই হল এই অসাম্য : কেন্দ্রের অধিবাসী, ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের জন্য এক আইন আর উপনিবেশের মানুষদের জন্য অন্য আইন। কেন্দ্রের সুযোগ সুবিধের পাল্লা উপনিবেশের তুলনায় সব সময়ই ভারি।
পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ছিল উপনিবেশবাদের স্বর্ণযুগ। এই সময়ে ইউরোপের কিছু দেশ পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করে সেখানকার মানুষদের ঔপনিবেশিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে আনে। বলা যায় গোটা দুনিয়াটা ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন ইত্যাদি। কয়েকটি দেশের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের দেশগুলো যখন এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে তখন তারা সেখানকার মানুষ ও সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়। এই সমাজগুলো, তাদের সংস্কৃতি, মানুষদের চেহারা, পোষাক, আচার ব্যবহার ছিল পুরোপুরি আলাদা। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা নিজেদের শাসনকে একটা নৈতিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য এই পার্থক্যগুলোকে ব্যবহার করে। ঔপনিবেশিকদের লেখা বইয়ের পর বই, নৃতত্ত্ববিদ্যা জাতীয় তথাকথিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চর্চায়, ইতিহাসে, ধর্মযাজকদের বক্তৃতায় বারবার প্রমাণ করা হতে থাকে ইউরোপের সভ্য সমাজগুলোর তুলনায় এই সমাজগুলো কত পিছিয়ে পড়া, কত বর্বর। কেন ইউরোপের দ্বারা শাসিত হওয়াটাই এদের সুসভ্য হওয়ার এক মাত্র পথ। আর এই ভাবে সভ্যতার নামে পৃথিবীর এই বিশাল ভূখণ্ড থেকে লুঠ করে নেওয়া হল সব রকমের সম্পদ।
উপনিবেশবাদ শুরু হওয়ার আগে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বা দেশের সম্পদ ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি ছিল। কিন্তু উপনিশবাদী লুণ্ঠনের ফলে এই ৫০০ বছরে পৃথিবীর ভারসাম্য অনেকটাই পশ্চিমের পক্ষে ঝুঁকে পড়ে। ইংল্যান্ডের মতো একটা ছোট দেশ ঔপনিবেশিক শোষণের মধ্যে দিয়ে প্রায় রাতারাতি পৃথিবীর ধনীতম দেশগুলোর মধ্যে একটা হয়ে উঠেছিল। I
আজকের দিনে বসে দুনিয়াকে বুঝতে হলে উপনিবেশবাদের এই ইতিহাস ভালো করে বোঝা দরকার। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে আদি উপনিবেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন খুবই জোরদার হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধে ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলোরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সব বিভিন্ন কারণে ১৯৬০-এর দশকে পৌঁছে আমরা দেখি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো হার মানছে। পৃথিবীর অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে এবং পূর্ণ মর্যাদায় জগতসভায় আসন নিতে সচেষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অনেক সমাজতত্ত্ববিদেরাই মনে করেন যে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে যাওয়া মানেই এই ঔপনিবেশিক ইতিহাস শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং ঠিক উল্টোটাই। উপনিবেশবাদ পৃথিবীর ওপর গভীর ছাপ ফেলেছে। বিভিন্ন অর্থে, নানা অপরিবর্তিত বা পরিবর্তিত রূপে সে ইতিহাস এখনও এক চলমান শক্তি হিসেবে বর্তমানের গতি প্রকৃতিকে নির্ধারণ করে চলেছে। তাই তাকে আমাদের বোঝা এবং চেনা দরকার। উপনিবেশবাদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও বহু বিতর্ক রয়েছে। আমাদের ইতিহাসে উপনিবেশবাদকে আমরা কতদূর নির্ধারক হিসেবে দেখব তাই নিয়ে তর্ক রয়েছে। স্বল্প পরিসরে হলেও আমরা সেই বিষয় ও বিতর্কগুলোকে ছুঁয়ে যাব।
আজকে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি সেটা বিশ্ব স্তরে ক্ষমতার সম্পর্কে সুসংগঠিত। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যা এই ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে নেই। এই যে গোটা পৃথিবীকে একটা ক্ষমতার সম্পর্কে নিয়ে আসা এটা কিন্তু অনেক দূর পর্যন্ত উপনিবেশবাদের জন্যই ঘটেছে। উপনিবেশবাদের সময়ই পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড ইউরোপের কোনো না কোনো দেশের অধীন হয়ে পড়ার ফলে একটা আন্তজার্তিক ক্ষমতার কাঠামোর অংশ হয়ে ওঠে, আজকের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কাঠামো তারই কিছুটা পরিবর্তিত উত্তরসূরী। অনেকের মতে এই বর্তমান কাঠামোতেও প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রাধান্য খুব ক্ষুণ্ন হয় নি। আজ আমরা যে জাতি-রাষ্ট্রর ধারণা এবং নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় শাসনব্যবস্থা দেখি তাও প্রথম দেখা দিয়েছিল ইউরোপেই। সেখান থেকেই উপনিবেশবাদের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা উপনিবেশগুলোতে ছড়ায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে এই ধারণাগুলো পেছনে কাজ করেছিল এক ধরনের মানবতাবাদ, যে মত শাসকদের দৈব ক্ষমতার ওপর মানুষের বোধকে, অধিকারকে স্থান দেওয়ার কথা ভেবেছিল। এই বোধ থেকেই সমস্ত মানুষের জন্য সমান ন্যায়, নাগরিকত্ব ইত্যাদি বোধের জন্ম হয়। ইতিহাসের পরিহাস এটাই যে এই মানবতা আর সাম্য কিন্তু উপনিবেশের মানুষদের তার হিসেবের মধ্যেধরে নি, তারা মনুষ্যেতর হিসেবেই গণ্য হয়েছে।
অর্থপ্নৈতিক দক থেকেও উপনিবেশবাদ আমাদের ইতিহাসকে নতুনভাবে সংগঠিত করেছে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে বানিজ্য চলে এসেছে, কিন্তু উপনিবেশবাদ বিশ্ব-বাণিজ্যকে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রাধান্যের স্বার্থে নতুন করে সঙ্গগঠিত করে। উপনিবেশগুলোর কাঁচামাল ইউরোপের দেশগুলোতে গিয়ে সেখানকার কলকারখানায় বিভিন্ন পণ্যে পরিণত হয় এবং তারপর বিশ্ববাজারে বিক্রি হতে আসে। কল কারখানায় বিভিন্ন পণ্যে পরিণত হয় এবং তারপর সম্পদ লুটে নিয়ে, সেখানকার এই বন্দোবস্ত ছিল অসম। উপনিবেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিয়ে, সেখানকার শিল্পগুলোকে ধ্বংস করে, কোটিরও বেশি দাস শ্রমিককে নিয়ে এসে ইউরোপ ও আমেরিকা ফুলেফেঁপে ওঠে। ইউরোপীয় শিল্পবিল্পব সফল হয় এই মুনাফায়। বলা বাহুল্য এই ঋণ শোধ করার কোনো প্রয়োজন ইউরোপ বা আমেরিকা কখনোইই বঢ করেনি। অথচ আজ আবার এই বিশ্বায়নের বাজারে এই ধনী দেশগুলোই ইচ্ছেমত শর্ত অনুযায়ী এই প্রাক্তন উপনিবেশ দেশগুলোকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে নতুন করে লুটছে।
উপনিবেশবাদ সাংস্কৃতিক দিক থেকেও খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আগেই যে উপনিবেশগুলোতে অন্য ধরনের সমাজ-সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়ে ঔপনিবেশিকরা তাদের অসভ্য, অনাধুনিক বলে চিহ্নিত করল এবং সভ্যতার নামে এই মানুষদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে, দেশ দখল করে, সম্পদ লুটে নিয়ে রাজত্ব করল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাফল্য এই যে তারা শুধু গায়ের জোরে এই কাজ করে নি। আন্তোনিও গ্রামসি যাকে ‘হেজিমনি' বলে অভিহিত করেন, সেই সম্মতি নিমার্ণও করতে পেরেছিল। উপনিবেশেরও বহু মানুষ বলে করেছিল যে এই শাসন তাদের পক্ষে ভালো, ইউরোপীয় পদ্ধতিতে শিল্পায়ন, বাজারের বিকাশই সমৃদ্ধির পথ, আধুনিতকার পথ। আজকে যখন এই শিল্পায়নে বিপদগুলো বুঝতে পারছি, যখন মুনাফার লোভে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার, কিছু মানুষের স্বার্থে বহু মানুষকে একেবারে নিংড়ে নেওয়ার ফলগুলো টের পাচ্ছি , তখনও কিন্তু এই শিল্পায়ন, পণ্যের ভোগের মধ্যে দিয়ে জীবনের মান উন্নয়নের হাতছানি আধুনিকতার নামে আমাদের আকর্ষণ করে চলেছে। এই আধুনিকতার ধারণা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়াও কিন্তু উপনিবেশবাদেরই কৃতিত্ব।
মার্ক্সবাদ আমাদের শিখিয়েছে আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসকে ধনতন্ত্রের উত্থানের ইতিহাস হিসেবে দেখতে। এই দর্শনের গুরুত্ব স্বীকার করেও সমালোচকরা আজকে বলছেন যে কেন্দ্র ও উপনিবেশগুলোর বিকাশের মধ্যে যে পার্থক্য তাকে দুনিয়ায়-জোড়া ধনতন্ত্রের সর্বজনীন ইতিহাস হিসেবে বোঝা যায় না। উপনিবেশবাদের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বা দেশগুলোর মধ্যেও যে সামাজিক বদলগুলো ঘটেছে, ঘটছে এবং ইতিহাসকে প্রভাবিত করে চলেছে তাঁর ওপর আরো জোর দিতে হবে, তা না হলে সত্যিকার বোধ তৈরি হবে না।
0 মন্তব্যসমূহ