সুমী সিকানদার'এর গল্প : কাটাছেঁড়া পাতা

২ /১/৯৪ /
অফিসে যাচ্ছি । যেতে হচ্ছে বলে না । বাসায় থাকতে ভালোলাগে না। সারাক্ষণ বাচ্চা বাচ্চা করে ঘরে বসে থাকা আমার কাজ না। সন্তান আমার একার না।

যাবার সময় মেয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কি যেন বলে খুব জরুরী । 'পুপুল পুপুল।'
তার জাপানী পুতুলের বোঁচা নাক ভেঙ্গে গেছে তাই এখন মা জোড়া লাগিয়ে দেবে। এত সময় কোথায় ! তোর মা'র নাক তো কবেই ভেঙ্গেছে।

মাম্মাম সরো আমার দেরী হচ্ছে। দেড় বছরের মেয়ে দেরী কি বোঝে । সে জিদ করতে করতে মাটিতে বসে পড়েছে । আমি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। এখন মিনিট দশেক সে তারস্বরে চিৎকার করবে। নানুকে কে ধরে মারবে, চুল টেনে ছিঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাবে। মেয়ের দুনিয়ার ঢং হয়েছে বাপের মত।

৮ /১/ ৯৪//
মাটি'র বাবা একসাথে থাকে না । তার আগের সংসার আছে বড় বড় ছেলে আছে। সংসারে তার ঘর বিছানা বালিশ লোশন চিরুনী কন্ডোম সব আছে। তারপও জেনে শুনে এই গাড্ডায় পা না দিলেও চলতো । কিন্তু চোখ খোলা থাকলেই সব সময় দেখা যায় না। চোখের সাদা অংশে সকল আলো উপুড় করে এসে পড়লেও কিছুই দেখেলাম না। আমি শালা ক্যারেক্টারলেস।

১০/১/৯৪
ভুল । এক ভুল ঠেকাতে অজস্র ভুলের আঠা পর পর জুড়ে গেছে মীরা সুলতানার জীবনে।এখন তোর কি হবে রে মীরা। মাটি তার বিরক্তিতে উপেক্ষায় বড় হচ্ছে । অফিস থেকে ফিরেও বাচ্চা ধরি না। কিছুই করার নেই।


১৮/১/ ৯৪
অফিস শেষে বন্ধুদের আড্ডা ভালো লাগে। আরো কিছু কামিজ কিনতে হবে , ফিটিং কেমন ঢোলা হয়ে গেছে। টান টান করে নিজেকে আয়নায় দেখি। আলতো করে গোল করে করে লোশন লাগাই। শরীর তুই রসে থাকিস বশে থাকিস।

অফিস পাড়ায় নতুন দর্জি আছে লেটেস্ট ক্যাটালগ রাখে। সামনের সপ্তাহেই অর্ডার দিতে হবে। শালা কয়দিনের বিয়ের গুষ্টি কিলাই। এসব বাচ্চা ফাচ্চা নিয়ে পোষাবেনা। আমি আমার মত থাকবো অন্য কারো মত না। অন্য কারোর মত না।

২০ /১/৯৪ 
আজ মৈনাক এসেছে বাসায় ।এসেই গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসিয়ে আমায় উদ্ধার করেছে। কি ,আমি নাকি কার সাথে নাটক দেখতে গেছি। কার কোলে বসে পড়েছি। হারামী আমি কার কোলে বসি আর কাকে কোলে নেই তাতে তোর কি। তুই তো কামের বেটিও ছাড়িস না খাটাশ। 
আমিও এক ধাক্কা দিয়েছি খানিকটা দূরে গিয়ে পড়েছে আর সাথে সাথে রক্ত মাথায়। জুতা খুলে আচ্ছা রকম পেটালো। স্বামী তো ডান্ডা আছে ধান্দা আছে। সকল মন্ত্রনালয় তার পক্ষে আছে।
মেঝেতে শুয়ে অনেক কাঁদলাম। বুকের দুধ দিয়ে ব্লাউজ ভেসে যাচ্ছে। বাচ্চাটা খাবে । শুধু বললাম দরজাটা খুলে দাও , মেয়েটা দুধ খাবে।

২২/১/৯৪
হাতে টাকা নেই। সেদিনের পর থেকে সংসারে টাকা দেয় নি। দুধ তো কেনা লাগে। দুধের বাচ্চা। ভাত গিলতে পারি না চোখের পানি মুখের ভেতরে ঢুকে যায়। হায়রে জীবন।
মা বাবার সংসারে নিজেকে পেইং গেস্ট লাগে। তাদের হাতে সামান্য টাকা দিতে পারি। তুলনায় খুব কম। মৈনাক বাচ্চার খরচ না দিয়ে কিভাবে নিজে খায় , কিভাবে খাস তুই কুকুর । রাতে বুইড়া বউরে কিভাবে লাগাস হারামী। এই বাচ্চা পয়দা করার সময় মনে ছিলো না?
মুখে থুথু আসছিলো গিলে ফেললাম। ঐ হারামীর মুখে এই দামী থুথুও দিতে নেই।

২৫ /১ /৯৪
নূপুর এসেছিলো বেবী নিয়ে , সারাদিন দুই বাচ্চার হাউকাউ । নার্সারী হয়ে গেছে বাসা । দুই বন্ধু অনেক গল্প করেছি। গল্প ফুরালে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থেকেছি। নূপুর আমাকে ছেড়ে কখনো যাস না। 

নূপুর আজ আমার গায়ে পিঠের দাগ দেখে খুব কেঁদেছে।

২৬ /১/৯৪
অফিসের ঝামেলায় নাকাল। প্রচুর চাপ। ইদানিং ফিরতে ফিরতে রাত ৮ টা। বস রহমান স্যারের বাসা কাছেই । সকালে তার গাড়িতে যাই তার গাড়িতেই ফিরি। অত্যন্ত সজ্জন ব্যাক্তি খুব শ্রদ্ধা হয় রহমান স্যারকে। পুরুষের ন্যাক্কারজনক রিপু, কর্কশকন্ঠ এবং কুৎসিত পশু রূপের বিপরীতে তিনি একজন সত্যিকারের মানুষ। 

২৮/১/৯৪
মৈনাক এসেছে। মেয়ে নিয়ে সারাদিন। ঘুম থেকে তোলা খাওয়ানো, খেলা । মেয়ে আধো আধো যাই বলে তাতেই হাসে। ঘোড়া হয়ে সারাবাড়ি হামা দেয়া চলছে। 
আজ অফিস ছিলোনা। রান্না ঘরে মেয়ের জন্য সবজী খিচুড়ি আর মৈ্নাকের জন্য লাউপাতা ইলিশ রাঁধলাম। না করলেও চলতো।

যত রাগই থাকুক মেয়ের জন্য যখন বাবা সময় দেয় তখন কেন যেন ভাল লাগে। সন্ধ্যা বেলায় মেয়েকে ঘুমন্ত রেখে মৈনাক চলে যাচ্ছে। যাবার সময় ''মেয়েটাকে নিয়েও যেতে পারিনা, ছেড়ে বেশীক্ষণ থাকতেও পারিনা।'' বলে চুপ হয়ে গেলো। সেদিনের পর থেকে আর কাছে আসতে দেই নি।

তবে কথাটা শুনে কেন যেন বিশ্বাস হলো। শেষ বেলাকার হাহাকার সুর যেন। অক্ষমতার এক রকম ভাষা আছে মুখে আসে না। কিন্তু সমস্ত শরীর তার নিজস্ব ভাণে ভঙ্গিতে প্রতিবাদ করে। দুই সংসারের কোনটাই তাকে আপন করে নি ।অথচ দুটোই এলোমেলো ভাবে মৈনাকের । এটাও এক যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে মৈনাকের জন্য কষ্ট হয়। মনে হয় সব ভুলে বুকের ভেতর তার মাথাটা চেপে ধরি, সে কাঁদুক।

২/২ /৯৪

মাটির জন্মদিন এ মাসেই। আমার খুব করার শখ । জন্মের সময় মৈনাক ছিলো না। প্রথম জন্মদিন গেছে হাসপাতালে অসুস্থ ছিলো মেয়ে। কিন্তু ছোটবোন মিমি আজ বললো মৈনাক নাকি তাকে ইঙ্গিত করেছে জন্মদিন করা সম্ভব না। কুত্তার বাচ্চা তা তো সম্ভবই না। সবার সামনে মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ানোর গাটস নেই কাপুরুষ কোথাকার লোফার। পালিয়ে বিয়ে করতে পেরেছিলি। রাগে মাথাটা দপদপ করছে। একটা পিস্তল দরকার। ঐ শালাকে মেরে নিজে মরবো। দরকার নাই জন্মদিনের।

১৫/২
মৈনাক সকল যোগাযোগ বন্ধ করেছে। এক জন সৎপুরুষের মত সে প্রথমা স্ত্রীর বগলে আশ্রয় গ্রহন করেছে।

মাটির বার্থডে করেছে মীরা । জমানো টাকায় কেক অর্ডার দিলো 'হট কেক' এ। মিমি,মা-বাবা ,অফিসের সব কলিগ, রহমান স্যার এবং তার স্ত্রী। কত জনের আদর আছে তার উপর মাটির উপর।
পুরো অনুষ্ঠানে মীরার কন্ট্রিবিউট শুধুই কেক। আর সব কিছু মিমি জানে কিছুই জানতে দেয়নি। 
খুব কান্না পেয়ে গেলো। 

আয়নায় নিজেকে দেখলাম। চুল্গুলো ব্যান্ড খুলে ছেড়ে দিয়েছি।। মাটি মায়ের চুল খোলা পেলে মহাখুশীতে টানে। আজ মাটিমনির সমস্ত খুশী পূর্নিমার চাঁদের জোৎস্নার মত এক আকাশে সে একত্র করবে । 
ড্রইং রুমের দিক থেকে তুমুল গান ভেসে আসছে ।



লেখক পরিচিতি
সুমী সিকানদার
জন্মস্থান ঢাকা, বাংলাদেশ। জন্ম তারিখ :  ১৬ ফেব্রুয়ারি।  
প্রকাশিত বইঃ ৫ টি কাব্যগ্রন্থ--
এসো হাত ধরো, নদীটা রেখে যাও, গ্রীবা তার ক্যানভাস , মিসিং পাসওয়ার্ড এবং একাপনা।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ