রমানাথ রায়ের গল্প : হে অরণ্যদেব

আমাদের বাড়ির নাম গোলকধাম । আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে হোমিও-হাসপাতাল। দক্ষিণদিকে বোবা-কালাদের স্কুল। পূবদিকে নারকেলডাঙার খাল। পশ্চিমদিকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড। আমাদের দোতলা বাড়ি। আমাদের বাড়ির রঙ গোলাপী । আমাদের বাড়ির মধ্যে একটা উঠোন । উঠোনে দশটা ফুলের টব । তার মধ্যে তিনটে গোলাপ, দু’টো জবা, দু’টো বেল, একটা গন্ধরাজ, একটা জুঁই, একটা রঙ্গন।
এখন কোন গাছে ফুল নেই। তবে জবাগাছে চারটি কুঁড়ি এসেছে। জবাগাছের সব কুঁড়ি আবার ফোটে না। বেশীর ভাগ কুঁড়ি হলদে হয়ে ঝরে যায়। আমাদের উঠোনে একটা বড় বাথরুম আছে। এই বাথরুমে আমরা স্নান করি । বাথরুমের ভিতর একটা বড় চৌবাচ্চা আছে । চৌবাচ্চায় সারাদিন জল থাকে ।

আমাদের বাড়িতে মোট আটখানা ঘর। একতলায় চারখানা । দোতলায় চারখানা । একতলার চারখানার মধ্যে একটা রান্নার ঘর, একটা ভাঁড়ার ঘর, একটা খাওয়ার ঘর, একটা বসার ঘর। দোতলার চারটি ঘরের মধ্যে একটা শুধু পড়ার ঘর। বাকি তিনটে শোবার ঘর। সব থেকে বড় ঘরটায় মা আর বাবা শোন। সে-ঘরে একটা বড় খাট আছে। একটা স্টিলের আলমারি আছে। একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। একটা রেডিও আছে। সে ঘরে আমি বড় একটা ঢুকি না । ঢুকলে মা বকে। আর দু’টো ঘরের একটায় দাদা আর ভাই শোয় । সব থেকে ছোট ঘরটায় আমি আর মধু শুই। মধু আমাদের বাড়িতে কাজ করে। সে তাই মাটিতে শোয়। আমি খাটে শুই। মধু আগে একতলায় শুত । একদিন নাকি কি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে ওপরে শোয় । নিচেয় শুধু বাঘা থাকে। বাঘা আমাদের বাড়ির কুকুর। বাঘা কাউকে কামড়ায় না। বাঘা এমনিতে ভাল । তবে বাড়িতে অচেনা লোক এলে ভীষণ ঘেউ ঘেউ করে । তখন তাকে সামলানো দায় । বাঘা আমাদের কাউকে ভয় করে না । আমাদের কারোর কথা শোনে না। বাঘা কেবল বাবাকে ভয় করে। বাবা যা বলেন বাঘা তাই শোনে। তবে বাঘা মধুকে খুব ভালবাসে। মধু বাঘকে প্রতিদিন খেতে দেয় । বাঘা সপ্তাহে দুদিন মাংস-ভাত খায়। অন্যান্য দিন দুধ-ভাত খায় । প্রতিদিন রাত্রে দুধ-রুটি খায়। খাবার সময় বাঘার থালায় কেউ হাত দিতে পারে না। দিলেই রেগে যায়। কিন্তু মধুকে কিছু বলে না। 

আমরা তিন ভাই। আমরা তিন জনেই এক স্কুলে পড়ি। আমাদের স্কুলের নাম জগদীশচন্দ্র ইনস্টিটিউশন। আমাদের স্কুল চারতলা। দেখতে অনেকটা ইংরেজী ‘এল’ অক্ষরের মত। আমাদের স্কুলের রঙ সাদা। আমাদের স্কুল খুব বড়। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। দাদা ক্লাস টেন-এ। পড়ে। আমি এইট-এ। ভাই সিক্স-এ। আমরা তিনজনে একসঙ্গে স্কুলে যাই। তবে একসঙ্গে বাড়ি ফিরি না। 

আমাদের স্কুলের হেডমাস্টারের নাম ইন্দ্রনাথ ঘোষ। তিনি এম এ বি টি। আমরা তাঁকে খুব ভয় করি। তাঁর ঘরের দরজায় একটা সবুজ রঙের পর্দা ঝোলে। কাউকে ভিতরে ঢুকতে হলে সেই পর্দা সরিয়ে ঢুকতে হয়। আমি কোনদিন তাঁর ঘরে ঢুকিনি। আমাদের মনিটার প্রায়ই তাঁর ঘরে ঢোকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে। আমি সেদিন জল খেতে বেরিয়ে তাঁর সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তিনি বোধ হয় রাউন্ডে বেরিয়েছিলেন। আমাকে দেখেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কার্ড আছে? সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে কার্ড বের করে তাঁকে দেখলাম। তিনি আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন। আমাদের স্কুলে কার্ড ছাড়া বাইরে বেরনো নিষেধ। বেরুলেই শান্তি। তাপসের খুব সাহস। মাঝে মাঝে কার্ড ছাড়াই বেরিয়ে যায়। একদিন ধরা পড়ে দু’পিরিয়ড নীল ডাউন হয়ে থাকল। তারপর ক’দিন তাপসের আর সাহস ছিল না। কার্ড ছাড়া বাইরে বেরতো না। এখন আবার সাহস হয়েছে। কার্ড ছাড়া বাইরে বেরয়। আবার কোনদিন ধরা পড়বে। এবার ধরা পড়লে সারাদিন নীল ডাউন হয়ে থাকতে হবে। 

আমাদের অ্যাসিসট্যান্ট হেডমাস্টারের নাম বিপুল বসু। বিপুলবাবুও এম এ বি টি। বিপুলবাবু ভীষণ কড়া। বেত হাতে সারা স্কুল ঘুরে বেড়ান। কার্ড ছাড়া কাউকে দেখলে নীল ডাউন করিয়ে রাখেন। কেউ ইউনিফর্ম না পরে এলে তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। কেউ মারামারি করলে বা খারাপ কথা বললে তার আর রেহাই নেই। সপাং সপাং করে তার পিঠে বেত পড়বে। একবার একটা ছেলে বই চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিল। বিপুলবাবু তাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। 

আমাদের স্কুল এগারোটায় আরম্ভ হয়। চারটের শেষ হয়। আমাদের প্রতিদিন প্রথমেই বাংলার ক্লাস । তারপর অঙ্কের ক্লাস । তারপর ইংরেজীর ক্লাস। পরের ক্লাসগুলো এক-একদিন এক এক রকম। ভূপেনবাবু আমাদের বাংলার ক্লাস নেন । তিনি আমাদের ক্লাস টিচার । তিনি আমাদের বাংলা টেক্সট আর ব্যাকরণ পড়ান। আমাদের অঙ্কের ক্লাস নেন সুশীতলবাবু। তাঁর ক্লাস আমার ভাল লাগে না। আমি অঙ্ক ভাল বুঝি না। এবার হাফইয়ারলি পরীক্ষায় আমি অঙ্কে ফেল করেছি। বাবা তার জন্যে আমাকে খুব মেরেছেন। সোমেনবাবু আমাদের ইংরেজী পড়ান। তাঁর ক্লাসে গোলমাল হয় । সবাই তাঁকে আড়ালে ‘উচ্ছে’ বলে ডাকে। আমিও ডাকি। উচ্ছে ডাক শুনলে তিনি খুব রেগে যান। একদিন তাপস বোর্ডে বড় বড় করে উচ্ছে লিখে রেখেছিল । সোমেনবাবু ক্লাসে ঢুকে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আমাদের যাচ্ছেতাই করে বলতে লাগলেন। তিনি বারবার জানতে চাইলেন কথাটা কে লিখেছে। আমরা সবাই চুপ করে রইলাম। কেউ তাপসের নাম বললাম না। তার জন্যে সে পিরিয়ডে আমরা সবাই খুব মার খেলাম। তবু আমাদের কিছু হয়নি। তাকে আজো পিছন থেকে ‘উচ্ছে’ ডেকেই পালিয়ে যাই । আমরা আর একজনকে ‘দই’ বলে ডাকি । তিনি আমাদের ইতিহাস পড়ান। তাঁকে দেখলেই সবাই পিছন থেকে দই দই বলে চিৎকার করে ওঠে । আমিও বাদ যাই না । 

ঠিক একটা পঁয়তাল্লিশ-এ আমাদের টিফিনের ঘণ্টা পড়ে। আধা ঘণ্টার জন্যে আমাদের টিফিন হয়। আমার সঙ্গে দু'পিস পাউরুটি আর একটা কলা থাকে। আমার পাউরুটি খেতে ভাল লাগে না। কলাও না । আমার আইসক্রীম খেতে ইচ্ছে করে । গেটের বাইরে আইসক্রীমওয়ালা বসে থাকে। দাদা মাঝে মাঝে আইসক্রীম খায় । ভাইও । বাড়ি থেকে নিশ্চয় পয়সা নিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। আমি একদিন ভাইয়ের হাত থেকে আইসক্রীম কেড়ে একটু খেয়েছিলাম। ভাইয়ের সে কি কান্না। বাড়ি এসে ভাই আবার সেকথা মাকে বলে দিয়েছিল। আমায় মারা খাইয়েছিল । তারপর থেকেই আমি আর কোনদিন ভাইয়ের আইসক্রীম খাইনি। আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে আমাকে আইসক্রীম খাওয়ায় । বিনিময়ে আমি তাদের আমার পাউরুটি দিই, কলা দিই । 

আমাদের স্কুলের মধ্যে একটা মাঠ আছে। টিফিনের সময় সবাই সেই মাঠে ছুটোছুটি করে। মাঠের চারদিকে উঁচু পাঁচিল। মাঠের উত্তরদিকে পাঁচিল ঘেঁষে একটা বড় আমগাছ। কোনদিন তাতে আম হয় না। তার উঁচু ডালে কাকের বাসা । বাসার চারপাশে সারাদিন কাকা কা-কা করে । একদিন একটা ছেলে ডিম পাড়বে বলে গাছে উঠেছিল। বেশী দূর উঠতে পারেনি। একটা কাক তার মাথা ঠুকরে রক্ত বের করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাকে অফিসঘরে নিয়ে গেলাম। অফিস থেকে শ্যামাদাসবাবু তার মাথায় তুলো দিয়ে ডেটল লাগিয়ে দিলেন। বিপুলবাবু ছেলেটাকে খুব বকলেন। তবে তাকে সেদিন আর ক্লাস করতে হয়নি। তার ছুটি হয়ে গেল । 

টিফিনের পর বেশীর ভাগ দিন হয় বিজ্ঞানের নয় ভূগোলের ক্লাস থাকে। আমার তখন ক্লাস করতে একদম ভাল লাগে না । ছুটোছুটি করে শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রমেশবাবু আমাদের বিজ্ঞান পড়ান। তিনি ভাল বোঝাতে পারেন না । গড়গড় করে রিডিং পড়ে যান। আমরা যে যার সঙ্গে কথা বলতে থাকি। তিনি কাউকে কিছু বলেন না। সুধীরবাবু আমাদের ভূগোল পড়ান। তিনি সঙ্গে ওয়াল ম্যাপ নিয়ে আসেন। সেটা দেয়ালে টাঙানো থাকে । ঘণ্টা পড়লে সেটা আবার গুটিয়ে নিয়ে চলে যান। বেশীর ভাগ দিন ম্যাপ টাঙানোই থাকে । কোন কাজে লাগে না । তিনি পড়িয়ে যান । এই সময় কেউ কথা বললে তিনি খুব রেগে যান। তাকে দাঁড় করিয়ে দেন। নয় ম্যাপ পয়েন্টিং-এ ডাকেন। আমি তাই চুপ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কাছে রানীগঞ্জ আর জামশেদপুর একাকার হয়ে যায়। আমি তাঁর শুধু ঠোঁট নাড়া দেখতে পাই। কিছু অর্থহীন শব্দ আমার কানে ভেসে আসে। আমি কিছু বুঝতে পারি না। সুধীরবাবুর মুখ আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যায়। আমি আর তখন চেষ্টা করেও চোখ খুলে রাখতে পারি না। সিকসথ পিরিয়ডে কোন কোনদিন বাংলা রচনার ক্লাস থাকে। মিহিরবাবু আমাদের রচনা করান। আমার রচনা লিখতে খুব ভাল লাগে। রচনায় আমি সব থেকে বেশী নম্বর পাই। মিহিরবাবু আমাকে তাই ভালবাসেন। মিহিরবাবু খুব ভাল। মিহিরবাবু আমাদের এক-একদিন অরণ্যদেবের গল্প বলেন। অরণ্যদেবের গল্প শুনতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। মিহিরবাবু নাকি স্কুলের চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন । মিহিরবাবু চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে । সিকস্থ পিরিয়ডে এক-একদিন সংস্কৃতের ক্লাস থাকে। সংস্কৃতের ক্লাসে খুব গোলমাল হয়। পণ্ডিতমশাইকে কেউ মানে না । তিনি কি পড়েন তা আমরা কেউ শুনতে পাই না । সেভেনথ পিরিয়ডে আমাদের কারোর ক্লাস করতে ভাল লাগে না । বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যাবার উপায় নেই। সেভেনথ পিরিয়ডে কতদিন রোলকল হয় । অ্যাবসেন্ট থাকলে ক্যাপিটাল 'এ' হয়ে যায় । ক্যাপিটাল 'এ' হলে পঞ্চাশ পয়সা ফাইন । ছুটি নিয়ে গেলে কিছু হয় না। 

সপ্তাহে একদিন সেভেনথ পিরিয়ডে ওয়ার্কএডুকেশনের ক্লাস হয়। একদিন পি টি-র ক্লাস হয়। খালি পেটে আমি ব্যায়াম করতে পারি না । কেউই পারে না। আমাদের খুব কষ্ট হয়। তবু করতে হবে। ঠিক চারটে বাজলেই ছুটির ঘণ্টা পড়ে। আমরা হইহই করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ি । আমাদের তখন ভীষণ ভাল লাগে । গোবিন্দ আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে। আমি গোবিন্দর সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি যাই। গোবিন্দর খুব কষ্ট । গোবিন্দর মা নেই, বাবা নেই। গোবিন্দ মাসির কাছে থাকে। মাসি ওকে খুব বকে। বাড়ির সব কাজ ওকে দিয়ে করিয়ে নেয় । গোবিন্দ একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পুলিসের হাতে ধরা পড়ে। আমারো মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে । পুলিসের ভয়ে পালাতে পারি না। তবে বড় হলে আমি পালিয়ে যাব। তখন আর কোন ভয় থাকবে না । জানি না কবে আমি বড় হব। বড় হতে খুব সময় লাগে । 

বাড়িতে আমার মা আছে,বাবা আছেন। তবু বাড়িতে ভাল লাগে না। সবাই আমাকে বকে। আমার নাকি পড়াশুনো হবে না। পড়াশুনো হবে শুধু দাদার আর ভাইয়ের । বাবা দাদাকে ডাক্তারি পড়াবে। মা ভাইকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবে। আমি সব শুনি । কিছু বলি না। আমি জানি দাদা কি। দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ভাইও কম যায় না। খারাপ খারাপ কথা বলে । ভাইয়ের ক্লাসের একটা ছেলে আমাকে সব বলেছে। 

বাবা দাদাকে মাঝে মাঝে ইংরেজী সিনেমা দেখান। মাঝে মাঝে বেড়াতে নিয়ে যান। দামী দামী জামা-প্যান্ট কিনে দেন। গল্পের বই কিনে দেন । দাদা সে সব বই আমাকে পড়তে দেয় না। সব সময় আগলে রাখে। হাত দিলে বকে । কিছুদিন আগে বাবা দাদাকে একটা ক্রিকেটের ব্যাট আর বল কিনে দিয়েছেন। আবার একটা ক্যামেরাও কিনে দেবেন। দাদার খুব মজা । ভাইও খুব জিনিস পায় । মা কিনে দেয় । মা সেদিন ভাইকে একবাক্স রঙ পেনসিল কিনে দিয়েছে। হাতলাট্টু কিনে দিয়েছে। দিকগে। আমার কিছু চাই না। 

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আমি খেয়ে দেয়ে কোথাও বেরই না। বাড়িতেই থাকি । দাদা বাড়িতে থাকে না । ক্লাবে খেলতে যায় । ভাইও বেশীর ভাগ দিন বাড়িতে থাকে না । মার সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আমি আর মধু ছাদে উঠে বাঘার সঙ্গে খেলা করি। বাঘার সঙ্গে খেলা করতে আমার ভাল লাগে । বাঘার খেলার জন্যে একটা কাঠের বল আছে। বলটাকে কখনো আমি ছুঁড়ে দিই। কখনো মধু ছুঁড়ে দেয় । বাঘা দৌঁড়ে সেটা মুখে করে নিয়ে আসে। কখনো আমার কাছে। কখনো মধুর কাছে। কখনো বলটাকে মুখে পুরে ছাদের চারদিকে ছুটতে থাকে। কাউকে দেয় না। আমরা তখন ওর পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকি ।


মাঝে মাঝে আমরা বাঘাকে দুপায়ে হাঁটতে শেখাই। বাঘাকে হাঁটাতে আমাদের খুব ভাল লাগে। আমরা খুব মজা পাই। বাঘাও খুব মজা পায়। এক-এক সময় বাঘার কি যেন হয় । বাঘা রেগে যায়। তখন কান দু’টো তার খাড়া হয়ে ওঠে । মুখ দিয়ে গরর শব্দ বেরয়। মধু তখন ওকে ধমক দেয়, বকে। বাঘা আস্তে আস্তে শান্ত হয়। বাঘা খুশি হলে আমরা বুঝতে পারি। বাঘা তখন পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। সামনের দুপা দিয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরবে। আমাদের গা চোটে দেবে। আমাদের কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে দেবে। আর কেবলই কুঁই কুঁই শব্দ করবে। বাঘার তখন আদর চাই। আদর না পেলে কিছুতেই শান্ত হবে না । 

আমি আর মধু মাঝে মাঝে লুডো খেলি । বাঘা আমাদের পাশে চুপ করে বসে থাকে। আমাদের লুডো খেলা দেখে। লুডোর সব ঘুঁটি নেই। তিনটে ঘুঁটি হারিয়ে গেছে। তাতে কোন অসুবিধে হয় না। লাল আর হলদে ঘুঁটিগুলো ঠিক আছে। মধু এক একদিন লাল ঘুঁটি নিয়ে খেলে। আমি হলদে ঘুঁটি নিয়ে খেলি । আমিও এক একদিন লাল ঘুঁটি নিয়ে খেলি। মধু হলদে ঘুঁটি নিয়ে খেলে। লাল ঘুঁটি খুব পয়া। লাল ঘুঁটি নিয়ে খেললে জেতা যায়। খুব ছক্কা পড়ে। হলদে ঘুঁটি নিয়ে জেতা কষ্ট । কিছুতেই ছক্কা পড়তে চায় না। আমি খেলায় চোরামি করি না। মধু খুব চোরামি করে। আমি প্রায়ই ধরে ফেলি। অত চোরামি ভাল লাগে না। আমরা এক একদিন সাপলুডো খেলি । সাপলুডো খেলতে আমার খুব মজা লাগে। এই একদানে মইতে চড়ে কত ওপরে উঠে যাই । আবার পরের দানে সাপের মুখে পড়ে কত নীচে নেমে আসি। মধু সাপলুডোতে খুব হারে। মধু তাই সাপলুডো খেলতে চায় না। 

মাঝে মাঝে আমাদের লুডো খেলতে ভাল লাগে না। আমরা বসে বসে গল্প করি। মধু আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। মধুর বাড়ি মেদিনীপুর। মধুরা খুব গরীব। মথুরা ছ’ ভাইবোন। মধু সকলের বড়। মধুর এক ছোট বোন আছে। তার নাম গঙ্গা । মধু গঙ্গাকে খুব ভালবাসে। মধু এবার পুজোয় গঙ্গাকে একটা শাড়ি কিনে দেবে। আমারও গঙ্গাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। কি দেব ? এই লুডো ছাড়া আমার দেবার কিছু নেই। আমি তাই দিয়ে দেব। গঙ্গা লুডো পেলে নিশ্চয় খুশি হবে । চার বছর হল মধু আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মধু যখন এসেছিল তখন তার মাইনে ছিল পনের টাকা। ক’মাস হল পাঁচ টাকা বেড়েছে। এখন মধুর মাইনে কুড়ি টাকা। মধু নিজের কাছে টাকা রাখে না। মানি-অর্ডার করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তবু মধু ফাঁক পেলেই পয়সা চুরি করে। মা বাবা কেউ মধুকে বিশ্বাস করে না। একবার হাতে নাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল । বাবা বকেছিলেন । মাও । তবু বাবা মধুকে তাড়াননি। মধু খুব কাজের। মধু বাজার করে, রেশন তোলে, রান্না করে, বাসন মাজে, ঘর মোছে। মধু আগে ভাত ডাল ছাড়া কিছু রাঁধতে পারত না । মা মধুকে মাছ রান্না শিখিয়েছে। মাংস রান্নাও শিখিয়েছে। মার এখন খুব মজা। মাকে আর রান্না করতে হয় না। সারাদিন শুয়ে থাকে আর ঘুরে বেড়ায় । আর থেকে থেকে হুকুম চালায়। মধুর আর এখানে ভাল লাগছে। না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ দেখছে। কাজ পেলেই চলে যাবে। আমি মধুর সব কথা জানি। মধু আমাকে সব বলে। আমি এসব কথা কাউকে বলি না। মধু আমাকে বারণ করে দিয়েছে। বারণ না করলেও আমি কাউকে বলতাম না । মধুর মত আমারো কোথাও কাজ নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমাকে কে কাজ দেবে ? আমি কি কাজ জানি ? 

আমাদের দুজন মাস্টারমশাই আছেন। একজন আমাদের ইংরেজী পড়ান। তিনি সপ্তাহে দুদিন আসেন। সোমবার আর বুধবার। দু’ঘণ্টা পড়ান। সাতটায় আসেন, নটায় যান। আর একজন মাস্টারমশাই মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার আসেন। অঙ্ক করান। আর বিজ্ঞান পড়ান। তিনিও দু ঘণ্টা পড়ান। সাতটায় আসেন, ন’টায় যান। শুক্রবার, শনিবারও রবিবার কেউ পড়াতে আসেন না। এই তিনদিন আমরা নিজেরাই পড়ি । মাস্টারমশাইরা যা যা করতে দিয়ে যান আমরা তাই তাই করি। না করে উপায় নেই। বকুনি খেতে হয়। বাবার কাছে রিপোর্ট যায়। অঙ্ক নিয়ে আমার বড় গোলমাল হয়। কিছুতেই উত্তর মেলাতে পারি না। কেবল ভুল হয় । দাদার ভুল হয় না। উত্তর দেখে ঠিক মিলিয়ে দেয়। ভাইও তাই করে । তবে অনেক অঙ্ক ভাই পারে না । দাদা করে দেয় । আমি কাউকে দিয়ে অঙ্ক করাই না । দাদা ভাল ইংরেজী জানে না। প্রায়ই বানান ভুল করে। প্রিপোজিসানের ভুল করে। টেনসের ভুল করে। ভাই অনেক সময় দাদাকে দিয়ে ট্র্যানশ্লেসন করিয়ে নেয়। তাতে অনেক ভুল থাকে। মাস্টারমশাই লাল কালি দিয়ে সেগুলো কেটে দেন। আমার লেখাতেও ভুল থাকে। তবে অত ভুল থাকে না। তবু মাস্টারমশাই আমাকে বেশী নম্বর দেন না। দাদা সব সময় আমার থেকে বেশী নম্বর পায়। ভাইও । আমার মনে হয় মাস্টারমশাই দাদা আর ভাইকে বেশী ভালবাসেন । 

পড়তে পড়তে আমার ভীষণ ঘুম পায়। মাস্টারমশাই থাকলেও পায়, না থাকলেও পায় । আমি না ঘুমোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করি। চোখে জল দিই। বারান্দায় পায়চারি করি। কিন্তু ঘুম ঠেকাতে পারি না। ইংরেজীর মাস্টারমশাই আমাকে ঘুমতে দেখলে শুধু ধমক দেন। অঙ্কের মাস্টারমশাই আমাকে কান ধরে দাঁড়াতে বলেন। কান ধরে দাঁড়াতে আমার বিশ্রী লাগে। দাদা মুখ টিপে হাসে । ভাইও । এক-এক সময় আমি তাই কান থেকে হাত নামিয়ে নিই। নামালো হবে কি । মাস্টারমশাই-এর চোখ খাতার দিকে থাকে, কিন্তু দাদার চোখ খাতার দিকে থাকে না। থাকে আমার দিকে । কান থেকে হাত নামাতে দেখলেই দাদা মাস্টারমশাইকে নালিশ করে দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে আবার কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকি । মাস্টারমশাইরা না এলেও রেহাই নেই। শুক্রবার, শনিবার রবিবার কোন মাস্টারমশাই আসেন না। কিন্তু মা বাড়িতে থাকে। কোন কোনদিন বাবাও থাকেন। আমি ঘুমোতে থাকলে দাদা ছুটে মার কাছে নালিশ করে আসে। বাবা থাকলে বাবার কাছে। আমি তখন পড়ে পড়ে বকুনি খাই, কানমলা খাই, চড় খাই, অথচ দাদাও মাঝে মাঝে ঘুমোয়। ভাইও । আমি ওদের নামে নালিশ করি না। ওরা ঘুমোলে আমি ওদের জাগিয়ে দিই। আমি এবার থেকে আর জাগিয়ে দেব না। যত পারে ঘুমোক । আমার কি দরকার। মার চোখ আছে। বাবারও চোখ আছে। একদিন ঠিক ধরা পড়ে যাবে। 

রাত দশটার সময় আমরা সবাই খেয়ে নিই। বাবার এক একদিন ফিরতে রাত হয় । বাবার খাবার টেবিলে ঢাকা থাকে । বাবা কোনদিন খান । কোনোদিন খান না। বাবা এসেই ডোর-বেল টেপেন। আমার ঠিক ঘুম ভেঙে যায়। মধুর ঘুম ভাঙে না। আমি মধুকে ঠেলে জাগিয়ে দিই। মধু টলতে টলতে নিচে নেমে যায়। দরজা খুলে দেয় । দরজা বন্ধ করে দেয়। বাবা মসমস শব্দ করে ওপরে উঠে আসেন। আমি শুয়ে শুয়ে সব টের পাই। এক একদিন মধুর ঘুম আর ভাঙে না। মধু খুব ঘুমকাতুরে । সেদিন আমিই নিচে নেমে আসি। দরজা খুলে দিই। দরজা লাগিয়ে দিই। বাবাকে এই সময় আমার ভীষণ ভয় করে । বাবার পা টলতে থাকে। বাবার মুখ দিয়ে বিশ্রী গন্ধ বেরয়। আমি তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে আসি। নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিই। তারপর শুয়ে পড়ি । এই সময় মার সঙ্গে বাবার কথা কাটাকাটি হয় । মা কি যেন জোরে জোরে বলে । বাবাও কি যেন জোরে জোরে বলেন । আমি সব কথা বুঝতে পারি না । সব কথা অস্পষ্ট হয়ে ভেসে আসে । একদিন একটা গ্লাস ভাঙার শব্দ হয়েছিল । আর একদিন চেয়ার পড়ার শব্দ হয়েছিল । আজকাল এ রকম শব্দ হয় না । সামান্য কথা কাটাকাটির পর সব শান্ত হয়ে যায়। আমিও আস্তে আস্তে ঘুমোবার চেষ্টা করি। ঘুমোবার আগে প্রতিদিন আমার অরণ্যদেবের কথা মনে পড়ে। 

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে আমার কষ্ট হয় । বিশেষ করে শীতকালে । লেপ মুড়ি দিয়ে বেলা পর্যন্ত পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে । এখন বর্ষাকাল। এখন শীত করে না । না করলেও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না । এক একদিন ভোরে বৃষ্টি হয়। শুয়ে শুয়ে আমার বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগে। লাগলেও উপায় নেই। মার ডাকাডাকি, বকুনি শুরু হয়ে যায়। আমি উঠে পড়ি। দাদাও উঠে পড়ে। ভাইও । আমরা দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসি । তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নিই। মুখ ধুয়ে চা খাই। চার সঙ্গে চিনি মাখানো টোস্ট খাই। মধু আমাদের চা করে দেয়। টেস্ট করে দেয়। তারপর আবার আমরা দোতলায় উঠে আসি। পড়ার ঘরে ঢুকে পড়তে বসি । বাবা তখনো ঘুমোতে থাকেন। বাবা ওঠেন আরো পরে । বাবাকে কেউ কিছু বলে না। বাবাকে সবাই ভয় করে । মা-ও করে। দাদাও।

সকালবেলা আমরা স্কুলের পড়া করি। বাবা এক-একদিন কাগজ হাতে নিয়ে আমাদের ঘরে এসে বসেন। মাঝে মাঝে কাগজ পড়া বন্ধ করে আমাদের পড়া ধরেন । বাবা পড়া ধরলে আমি কোনদিনই ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারি না । আমার কেবলি ভুল হয়ে যায়। আর ভুল হলে রেহাই নেই। কানমলা খেতে হয়। চড় খেতে হয়। বাবা খুব জোরে মারেন। বেশীর ভাগ সময় গালে মারেন। গালে আঙুলের দাগ বসে যায়। তবে দাদাকে বাবা মারেন না। শুধু বকেন । ভাইকেও তাই। 

বাবা আমাদের প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়তে বলেন । আমাদের বাড়িতে ইংরেজী বাংলা দু’টো কাগজই আসে। আমি ইংরেজী পড়ে মানে বুঝি না। তাই ইংরেজী কাগজ পড়ি না। দাদাও বোঝে না। তবে পড়ে যায়। বোঝার ভান করে। আমি বাংলা কাগজ পড়ি। আমার অরণ্যদেবের গল্প পড়তে ভীষণ ভাল লাগে। জাদুকর ম্যানড্রেক বা গোয়েন্দা রিপের গল্পও ভাল লাগে। কিন্তু অরণ্যদেবের মত কোনটাই ভাল লাগে না । আমার মাঝে মাঝে অরণ্যদেবকে দেখতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে অরণ্যদেবের মত হতে ইচ্ছে করে । 

মা-ও থেকে থেকে আমাদের পড়ার ঘরে আসে । মা বি এ পাস । কিন্তু ভাল ইংরেজী জানে না । দাদা তাই মাকে ট্র্যানশ্লেসন জিজ্ঞেস করে । মা পারে না । দাদা খুব মজা পায় । বাবা পাশে থাকলে মুচকে মুচকে হাসেন । মা তাতে রেগে যায়। মা তাই দাদাকে পড়ায় না। ভাইকে পড়ায় । বেশীর ভাগ সময় ইংরেজী পড়ায়। ভাইয়ের ইংরেজী খুব সহজ। সে ইংরেজী আমিও পারি। মা পারে না। মাকে মাঝে মাঝে ডিকসনরি খুলতে হয়। মা ব্যাকরণও জানে না। মে আর ক্যান-এ কেবলি গুলিয়ে ফেলে। তবু মা-র ইংরেজী পড়ানো চাই। ইংরেজী পড়াতে মা-র ভাল লাগে। মা কখনো কখনো আমাকেও ইংরেজী পড়ায় । খেয়াল হলে ইতিহাস ভূগোলও পড়ায়। মা হাতে বই নিয়ে পড়ায়। বই বন্ধ করে পড়াতে পারে না । মাকে আমি এক এক সময় ম্যাপ খুলে জায়গা বের করতে বলি । জায়গা বের করতে মারি পাঁচ-সাত মিনিট লেগে যায় । আমি তখন চুপ করে বসে থাকি। পড়তে হয় না । 

এক-একদিন আমাদের পড়ার ঘরে বাবা আসেন না । মাও না । আমরা তিন জন পড়তে থাকি। আমার তখন ঘন ঘন বাথরুমে যেতে ইচ্ছে করে । দাদার জল পিপাসা পায়। ভাইয়ের মুখে কেবলি থুতু আসে। আমরা ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকি। আমাদের পড়ার ঘরে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। ঘড়িটা বার বার স্লো হয়ে যায়। কতবার সারানো হল। তবু ঠিক হল না । 

ঠিক ন’টার সময় ভোঁ বাজে। বাবা তখন স্নান করতে যান। আমরা উঠি না । আমরা পড়তে থাকি। আমরা উঠি সাড়ে ন’টায় । তারপর আমরা একে একে স্নান করতে যাই । দাদা আগে স্নান করে । তারপর আমি । তারপর ভাই । দাদা প্রতিদিন সাবান মাখে । দাদার গা থেকে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরয় । আমি সাবান মাখি না । সাবান মাখতে আমার ভাল লাগে না । তবে মাঝে মাঝে মাখতে হয় । না মাখলে মা বকে । ভাইও প্রতিদিন সাবান মাখে। নিজে ভাল মাখতে পারে না । মা তাই এক-একদিন মাখিয়ে দেয় । শীতকালে আমরা কেউ সাবান মাখি না। না মাখলেও স্নান করতে হয়। শীতকালে স্নান করা খুব কষ্ট । খুব শীত করে। মা তা বোঝে না। 

স্নান করার পর আমরা খেতে বসি । বাবার তখন খাওয়া হয়ে যায় । আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে খাই। প্রতিদিন আমরা ডাল খাই, মাছ খাই, দুধ খাই। কোন কোনদিন পোস্ত হয় । কোন কোনদিন চচ্চড়ি হয়। এক একদিন ডিমের ডালনা হয় । সেদিন মাছ হয় না । আমার ডিম খেতে ভাল লাগে না । কেমন একটা আঁশটে গন্ধ লাগে । মাকে আমি কতদিন সেকথা বলেছি। মা শোনে না । ভাই বললে ঠিক শুনত। আমি যেন এলেবেলে। আমার কথার দাম নেই। আমার পাতে তাই ডিম পড়ে থাকে । মুখে দিই না । সে ডিমটা ভাই খায় । ভাইয়ের খাওয়ার দিকে মার খুব নজর। মাছের মুড়ো আগে বাবার পাতে পড়ত। এখন আর বাবার পাতে পড়ে না। এখন ভাইয়ের পাতে পড়ে । দাদা মাছের মুড়ো খেতে পারে না। তাই চুপ করে থাকে। ভাইও মাছের মুড়ো খেতে পারে না । মা ভাইকে ভেঙে খাইয়ে দেয় । আমার এক-একদিন মাছের মুড়ো খেতে লোভ হয় । চেয়েও ফেলি। মা দেয় না । ভাই প্রতিদিন আমাদের থেকে বেশী দুধ পায়। সঙ্গে দুধের সরটাও পায়। দাদা তাই নিয়ে মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করে। মা তখন দাদাকে একটু সর দেয়। সেই সঙ্গে আমিও একটু পেয়ে যাই। চিনি দিয়ে সর খেতে আমার খুব ভাল লাগে। তবে টিফিন আমাদের এক রকম। দু পিস পাউরুটি আর একটা কলা। ভাই আলাদা কিছু পায় না । 

খাওয়া শেষ হলে আমরা মুখ হাত ধুয়ে নিই। আমরা জামা-প্যান্ট পরতে শুরু করি। বাবা এই সময় বেরিয়ে যান। জামা-প্যান্ট পরতে চুল আঁচড়াতে আমার দেরী হয়ে যায়। চুলের সিঁথি কিছুতেই ঠিক হতে চায় না। কেবল বেঁকে যায়। দাদা তাড়াতাড়ি জামা-প্যান্ট পরে। চুল আঁচড়ায়। দেরী হয় না। ভাইয়েরও না । মা এক-একদিন ভাইয়ের সিঁথি ঠিক করে দেয় । ভাই এখনো সোজা করে সিঁথি কাটতে পারে না । আমার বেরতে দেৱী হলে সবাই কথা শোনায় । ভাইও । 

আমাদের কাছেই স্কুল। স্কুলে যেতে দেরী হয় না। দশ পনের মিনিট লাগে। আমরা হেঁটে যাই। বৃষ্টির মধ্যেও হাঁটি। রিকশা করি না। তখন আমাদের তিনজনের হাতে তিনটে ছাতা থাকে । দাদার আর আমার ছাতা কালো রঙের । ভাইয়ের ছাতা চার রঙের। ভারি সুন্দর দেখতে। মা গত বছর ভাইকে কিনে দিয়েছে। রাস্তায় আমরা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলি না। ভাই দাদার পাশাপাশি হাঁটে । আমি পিছনে পিছনে আসতে থাকি। দাদা খুব জোরে হাঁটতে পারে। ভাইও । আমি জোরে হাঁটতে পারি না । 

স্কুলে ঢুকে আমরা আলাদা হয়ে যাই । ভাইয়ের ক্লাস একতলায় । ভাই একতলায় থেকে যায়। আমার ক্লাস দোতলায় । আমি দোতলায় উঠে যাই । দাদার ক্লাস তিনতলায়। দাদা তিনতলায় উঠে যায়। আমাদের ক্লাসে চল্লিশ জন ছাত্র। কুড়িটা ডেস্ক। দশ দশটা করে কুড়িটা ডেস্ক দু’দিকে সাজানো থাকে। প্রত্যেক ডেস্কে দু-জন করে ছাত্র বসে। আমি ক্লাসে ঢুকে নিজের ডেস্কে বসে পড়ি । আমার পাশে গোবিন্দ বসে। আমি কোনদিন আগে আসি। কোনদিন গোবিন্দ আগে আসে। গোবিন্দ না এলে আমার খারাপ লাগে । 

এগারটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়ে । আমরা তখন হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে পড়ি। সবাই গাইতে শুরু করে : তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে-- - । আমি গান গাইতে পারি না । আমার গলা দিয়ে স্বর বেরয় না । আমি শুধু ঠোঁট নাড়ি। আর মনে মনে বলি : হে অরণ্যদেব ! আমার এখানে একদম ভাল লাগে না। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও । আমি তোমার সঙ্গে ডেনকালির জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব ।

-----------------------------------------------------------------------------------------------
হে অরণ্যদেব গল্পটি নিয়ে কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের আলোচনা পড়ুন : লিংক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ