রমানাথ রায়'এর হে অরণ্যদেব নিয়ে আলোচনা

অমর মিত্র


রমানাথ রায় ও তাঁর সহযাত্রী লেখক বন্ধুরা গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনের ইস্তাহারে গল্পের ভিতর থেকে কাহিনি বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। গল্পহীন গল্প। আসলে তা ছিল আঙ্গিকের পরীক্ষা নিরীক্ষা। নতুন ভাবে গল্প বলতে এসেছিলেন তাঁরা।
কাহিনি সবর্স্ব গোল গল্পের বিরুদ্ধে তাঁরা কলম ধরেছিলেন। এঁদের পত্রিকা এই দশক পড়ে অবাক লাগত। এইটুকু বোঝা যেত গল্প বলার নতুন ভঙ্গী এঁরা অনুসন্ধান করছেন। এঁদের কেউ কেউ পেরেছেন নতুন ভাবে লিখতে। রমানাথ রায় তাঁদের ভিতর অগ্রগণ্য। তিনি তাঁর স্টাইলেই বিশিষ্ট। তিনি যেভাবে গল্প বলে যাচ্ছেন গত চার দশকের উপর সেই ভাবে গল্প আমাদের সাহিত্যে আগে বলা হয় নি। অথচ এই কথনভঙ্গী আমাদের লোক কাহিনি কিংবা কথা সরিৎসাগরে ছিল যেন। গল্পহীন গল্পের কথা বলেও শেষ পযর্ন্ত গল্পই বলেছেন রমানাথ রায়, কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে নেই টানা কাহিনি, আছে কিছু দেখা, কিছু অনুভূতির চিহ্ন। আছে গোপন বিদ্রূপ, ব্যঙ্গ। চাপা শ্লেষ। আর আছে গভীর জীবন। দু-এক ফোটা অশ্রু। তিনি একেবারে আলাদা। তিনি এই সমাজ, চারপাশের বাস্তবতার যে কথা লেখেন, সেই বাস্তবতা তাঁর নির্মাণ। সাহিত্যের বাস্তবতা কীভাবে আলাদা হয়ে যায় তা রমানাথ রায়কে পড়লে ধরা যায়। তাঁর নিজস্ব দর্শন আছে, বলার কথা আছে। রামরতন সরনি, বউ রান্না করে, পানু শান্তি চেয়েছিল, ফাঁসির ধারাভাষ্য, হে অরণ্যদেব, অশ্রুবিন্দু---কত গল্পের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় তিরিশ বছর আগে লেখা “তিনতলার ঘর” গল্পটির কথা। তিনতলার ঘর এক ব্যক্তির গল্প যে কিনা একটি একতলা বাড়ি করেছিল। সেই বাড়িতে সংসার পেতেছিল। তারপর তার সন্তানেরা জন্মায়। সন্তানেরা জন্মালে সেই বাড়ির দোতলা করতে হয়। ব্যক্তিটি দোতলায় উঠে আসে। বউ একতলাতে থেকে যায়। তখন বউ দোতলায় উঠে আসত, কথা হতো দেখা হতো। এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যায়। দুই ছেলের বিয়ে হয়। লোকটিকে তিনতলায় একটি ঘর বানিয়ে একা উঠে আসতে হয়। তার বুড়ি থাকে নিচে। সে বুড়ির সঙ্গে কথা বলতে চায়। তার সময় হয় না। বড়ছেলের বউ, ছোট ছেলের বউ, মেয়ে আসে কেউ ব্রেকফাস্ট নিয়ে, কেউ দুপুরে ভাত নিয়ে, চা নিয়ে, কেউ রাতের খাবার নিয়ে। নিঃসঙ্গ নির্জন এক বৃদ্ধের এই গল্প এখনো মনে পড়ে। কতজনকে দিয়ে সে তার বুড়িকে ডেকে পাঠায়, বুড়ির সময় হয় না সমস্তদিন, সন্ধ্যা রাত্রি। যখন বুড়ি উঠে আসে সেই নির্জন তিনতলার ঘরে, সেই গভীর রাতে, বুড়ো তখন ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায়। গল্পটি সময় পার করে অসীমে গিয়েছে যেন। রমানাথ লেখেন ছোট ছোট বাক্যে। কেউ যেন নিজের কথা বলে যাচ্ছে আটপৌরে ভাষায়। রমানাথ রায় আধুনিক নগর সভ্যতার অসুখের কথা উপলব্ধি করতে পারেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার, মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা লিখতে পারেন। মানুষের ক্লান্তিকর জীবন, শঠতা, হিংস্রতা, বিপন্নতা, নিরূপায়তা----- সবই তাঁর বিষয়। আমি হে অরণ্যদেব গল্পটির কথা বলি। এই গল্প একটা সময় আমাদের স্তম্ভিত করেছিল। তিনটি ভাই। মধ্যমজন তার নিজের কথা বলে যাচ্ছে। বাবা মা বড় ও ছোটর উপর একটু বেশি নজর করেন, মধ্যমজন একটু যেন কম স্নেহ পায়। সে একা হয়ে গেছে মনে মনে। সে কীভাবে আছে সে কথাই বলে যায় তার মতো করে। এই গল্পে এমন কোনো কাহিনি নেই যা বলা যাবে। আবার গল্পটিতে কিশোরটি যে কথা বলে যায় একটু একটু করে, তা কোনো কাহিনি না হয়েও গল্প। গল্পটি আরম্ভ হয় এই ভাবে, “ আমাদের বাড়ির নাম গোলোকধাম। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে হোমিও-হাসপাতাল। দক্ষিণ দিকে বোবা কালাদের স্কুল। পুব দিকে নারকেলডাঙার খাল......। আমাদের বাড়ির রঙ গোলাপী......”। সে প্রথমে বাড়ির কথা বলে খুঁটিয়ে। ক’টা ঘর। বাগানে কী কী ফুল......। বাড়ির পর সে স্কুলের কথা বলে। হেড মাস্টার, এম,এ,বি,টি। মনিটর। অ্যাসিসটান্ট হেড মাস্টার। টিফিন। বাংলা, ইংরেজি অংক...। অঙ্কে ফেলের জন্য বাবার মার। টিফিনে খেলার মাঠে অন্য ছেলেদের দৌড়। টিফিনের পর সিক্সথ পিরিয়ডে মিহিরবাবু স্যারের বাংলা রচনার ক্লাস। মিহিরবাবু এক একদিন তাঁর ক্লাসে অরণ্যদেবের গল্প বলেন। অরণ্যদেবের গল্প শুনতে তার খুব ভাল লাগে। সে সব কথা বলে যায় পর পর। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাবে ফেলে আসা শৈশব। স্কুলের পর আবার বাড়ি। বাবা মা দাদা। কাজের ছেলে মধুর সঙ্গে, বাড়ির কুকুর বাঘার সঙ্গে খেলা। লুডো খেলা, মধুর সঙ্গে গল্প। মধুর বাড়ির কথা শোনা। ছেলেটি সমস্তদিনের কথা বলে যায়। ক্লান্তি উঠে আসতে থাকে তার কথনে। এই এই শহরের শৈশব। এই শৈশবে কোনো বৈচিত্র নেই। সে যে শোনাবে কিছু, কী শোনাবে? এ আমাদের শহরে, নগরে নিবার্সিত এক অপু, যার জন্য এই নগর কোনো বিস্ময় রাখে নি। সে বলছে কী? না, মধু যখন এসেছিল তার মাইনে ছিল পনের টাকা, এখন সে পায় কুড়ি টাকা। মধু সেই টাকা বাড়িতে মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দেয়। মধু ফাঁক পেলেই পয়সা চুরি করে। আবার সে গোপনে কাজও খুঁজছে। ভাল কাজ পেলে চলে যাবে। বালকের সমস্তদিন এই ভাবে আবর্তিত হয়। সন্ধেয় মাস্টারমশাই আসেন পড়াতে। একজন সোম আর বুধ, অন্যজন মঙ্গল ও বৃহস্পতি। পাঠক, পড়তে পড়তে কি জীবনস্মৃতির কথা মনে পড়ে? বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। এই জীবন সেই জীবন নয়। এ কোনো স্মৃতি নয়। বালকের জীবন। যে জীবনে কোনো আম আটির ভেঁপু নেই। আছে শুধু একঘেয়ে বয়ে চলা। মা বাবা, দাদা ভাই, ইতিহাস, ভুগোল, ইংরেজি বাংলা খবরের কাগজ, গোয়েন্দা রিপ, যাদুকর ম্যানড্রেক আর অরণ্যদেব—এই সব নিয়ে বালকের দিন যায়। একটা দিনের পর আর একটা দিন আসে। সকালের পড়া, ন’টার ভোঁ বাজা, স্নান খাওয়া, জামা প্যান্ট পরা। স্কুলে রওনা হওয়া। এই একঘেয়ে জীবনের হাত থেকে মুক্তি পেতে কমিক্সের অরণ্যদেব ভরসা। স্কুলের প্রেয়ারের ঘন্টা বাজে। সবাই শুরু করে, তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে...। সে গান গাইতে পারে না। ঠোঁট নাড়ে আর মনে মনে বলে ঃ “হে অরণ্যদেব ! আমার এখানে একদম ভাল লাগে না। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। আমি তোমার সঙ্গে ডেনকালির জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব।“ এ যেন নিশ্চিন্তপুর থেকে এই শহরে নির্বাসিত অপুর কথা। গল্পটি বেদনাচ্ছন্ন করল তিরিশ বছর বাদে আবার পড়ার পর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. নীলক্ষেত থেকে বহুদিন আগে রমানাথ রায়ের 'প্রিয় গল্প' নামে একটি গল্প সংকলন কেনা হয়। রমানাথ রায় সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু একজন অজানা লেখকের লেখা আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। এমন নতুন ধরনের লেখা যা আগে কখনো পড়ি নি। যেন এরকম গল্প আগেও কেউ লিখেন নি, পরেও এরকম নতুন ধরনের লেখা পাই নি। গদ্য এমন নির্মোহ অথচ স্পর্শকাতর হতে পারে রমানাথের গল্প না পড়লে তা জানা সম্ভব নয়। 'হে অরণ্যদেব' আমার পড়া সেরা ১০টি গল্পের একটি। প্রিয় কিন্তু অনেকটা অজ্ঞাত রমানাথ সম্পর্কে আরও জানতে চাই। রমানাথ রায়ের গল্প নিয়ে আলোচনার জন্য গল্পপাঠকে ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. একটি আলোচনা - একজন লেখকের চোখে আরেকজন লেখকের - যার আবেশ অনেককাল মুগ্ধ করে রাখবে।

    উত্তরমুছুন