সোমেন বসু'র গল্প : তারায় পাওয়া মানুষ

আকাশ বুঝিবা এক কলঙ্কিনী। বা কলঙ্কিনী বলে না দাগালেও তার কালিমাপ্রীতি তো অবশ্যম্ভাবী। না হলে দেখো না, প্রতিদিন সূর্য পাটে যাওয়ার সময়, তার মুখখানা যে অমন সিঁদুরে ছুপিয়ে দিয়ে চলে যায়, আকাশ তা পাত্তা দিয়েও দেখে? উলটো কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ধুয়েমুছে রাত্রির কালোবেশ সযত্নে গায়ে জড়িয়ে নেয়। কালো কী কেবল কলঙ্কের রঙ? বিষাদেরও তো! আবার বিষাদের রঙ সাদাও তো হয়।
প্রাচীন বিধবা রমণীর শুভ্রবেশ বা মরার খাটের পলকা পায়াগুলোতে বাঁধা থাকা রজনীগন্ধার মতো! আবার কালোরও তো রকম আছে। ঘোলাটে কালো বা ঈষৎ লালচে কালো। যেমন বর্ষার কালোমেঘে ঢাকা রাতের আকাশ। আবার পরিষ্কার কালো বা নিকষ কালো। যেরকম আকাশ বাদুলে মেঘের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত। কিছু সাদা শারদীয় মেঘ ভেসে বেড়াতেও পারে বা। কিন্তু তাদের গায়ে লেপ্টে পড়ার নিবিড়তা নেই। বরং যেন আকাশের থেকে একটু মার্জিত দূরত্বই বজায় রেখে চলে। আর এইরকম রাতেই সূর্য ডোবার পর থেকেই একটা একটা করে জ্বলে ওঠে তারারা। লক্ষ, কোটি, অগুনতি। চাঁদও বাহুল্য হয়ে যায় এসব রাতে। কোনও কোনও রাত তারার রাত।

এই রাতগুলোয় রথীন আত্মহারা হয়। অন্ধকারের চাদর ফুঁড়ে ফুটে উঠছে একটা একটা করে আলোকবিন্দু। চোখ মটকাচ্ছে, ওকে ইশারা করছে। রথীন জানে না সে ইশারার অর্থ। কোনও অজানা জগতের আহ্বান, নাকি কোনও গোপন গভীর সংকেত। ওর খালি মনে হতে থাকে, ওরা ওর সব জানে। পালাবার উপায় নেই। পালাবেই বা কোথায়? কার থেকে চোখ সরাবে? সারা আকাশ জুড়েই তো ওরা। অবশ্য ও যে পালাতে চায় এমনটাও নয়। বরং এই বিপন্ন বিস্ময় ওর মননে জন্ম দেয় এক আবেশের, মুগ্ধতার। ও বসে থাকে বিহ্বল। ওর একলা থাকার একচিলতে ঘরটাকে পিছনে রেখে। ওর সামনে অলস জেগে থাকে চরাচরছোপানো এক মস্ত বিল। জায়গায় জায়গায় চাষ হয়েছে হয়তো, কিন্তু যার বেশিটাই জলা, ঝোপঝাড়। কিন্তু আপাতত সব ছাপিয়ে কেবল অন্ধকার। একটাই বলয় যেন। মাটির অন্ধকার আর আকাশের অন্ধকার। একটাই আকাশ। একটাই পৃথিবী। এমনকি আকাশের তারারাও আকাশকে পৃথক করতে পারে না জমির থেকে। অমন অজস্র মিটমিটে আলোকবিন্দু তো মাটিতেও ছড়ানো। লাখোকোটি জোনাকি-- তারাদের জমিনতুতো ভাই। রথীন যে ঘাসের বিছানায় তারাদের চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে না, সে স্রেফ এই জোনাকিদের জন্য। বলয়টা তাহলে সম্পূর্ণ হয় না।

রথীনের পিঠে ওর ঘরের সাথে অলসভাবে লেপ্টে আছে গোটা গ্রামটা। ওর ঘরটার পাশেই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলবাড়িটা। ওর কর্মস্থল। তার দক্ষিণে হারান মণ্ডলের কুঁড়েটা প্রথম। এখানেই রথীনের গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত। আর তারপর গোটা গ্রামটা। এই সন্ধে সাতটার সময় যার অস্তিত্ব নির্ধারিত হচ্ছে কেবলমাত্র কিছু কেরোসিন কুপির টিমটিমে আলোয় আর খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত কিছু অস্ফুট বাক্যালাপে। আটটার মধ্যে সব বাড়িতেই খাওয়ার পাট চুকবে। তারপর গ্রামের মাঝের তেমাথিতে, কী ঢোকার রাস্তার কালভার্টের ওপর একটু জটলা। বিড়ি টানাটানি, হাল্কা গল্পগাছা, দু'চারটে টুকরো হাসি, হঠাৎ কোনও খোলা গলায় এক আধটা ভাওয়াইয়া। মোটামুটি ন'টার মধ্যে সব শেষ, শান্ত। খোলা দাওয়ায় শুয়ে মড়ার মতো ঘুমোবে হাক্লান্ত শরীরগুলো। নেহাত নবদম্পতি ছাড়া গ্রামের মানুষ সাধারণভাবে ঘরে ঘুমোয় না।

এগুলোই রথীনের কাছে বিস্ময়। ওর জন্ম, লালন, বর্ধন সবই শহরে। আর সে শহর যে এখান থেকে খুব দূর এমনও নয়। তবু মনে হয় যেন কত আলোকবর্ষের দূরত্ব। তৃপ্তিও পায় নিজের সিদ্ধান্তের কথা ভেবে। এই গ্রামের স্কুলের চাকরিটা পেয়ে ও প্রথম তল্লাশ করেছিল এখানেই একটা আস্তানার। পেয়েও গেল। ঘরটা স্কুলেরই। কিন্তু মূল স্কুলবাড়িটার থেকে বিচ্ছিন্ন। নিজের দায়িত্বে থাকতে হবে। এবং রথীন তাতে এককথায় রাজি। বাবামাদাদাবৌদি হয়তো খানিক ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, বিশেষত বাবামা, কিন্তু অবাক হয়নি। যে ছেলেটা নিজের কিশোরবেলায় মাঠে অন্যদের সাথে দাপাদাপি না করে মাঠের পাশের ঝিলের ধারে বসে বিকেল গুজরান করতো, হারিয়ে যেতো ফড়িঙে, ঘাসের ডগায় লেগে থাকা আলগা জলবিন্দুতে, ঝিলের জলে আলতো হাওয়ার খেয়ালী আলপনায়, বা রাতে পড়াশুনার শেষে ওর বয়সী অন্যরা যখন হামলে পড়তো টিভির ওপর, ও চলে যেতো ছাদে, আকাশচাঁদতারাদের সান্নিধ্যে, তার তো এটাই স্বাভাবিক।

আসলে সব মানুষ তো একরকম হয় না। গড়পড়তা শহুরে বাঙালীর প্রকৃতিপ্রেমের সাক্ষ্য দেয় দীপুদা। এখন অবশ্য তার সাথে জঙ্গলটা যোগ হয়েছে। সেসব ছবি আগে যত্ন করে গোছানো থাকতো অ্যালবামে। এখন থাকে কম্পিউটারে জেপেগ ফাইলে। আগে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা বাড়িতে আসলে সেই অ্যালবামের ঘা খেতো, এখন মানুষের বন্ধু তো ফেসবুকে। আর গ্রামের মানুষের তো প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক পুরনো দম্পতির মতো। উচ্চকিত প্রেম নেই, আছে নির্ভরতা, সাহচর্যের অমোঘ প্রয়োজনীয়তা। রথীন এই দুই মানদণ্ডেই সৃষ্টিছাড়া। দ্বিতীয়টাতে তো বটেই, প্রথমটার নিরিখেও। রথীনের আকুতি প্রকৃতিতে মিশে যাওয়ার। নিজের সত্তাটাকে প্রকৃতির মাঝে বিলীন করে দেওয়ার। কোত্থেকে যে এল এমন চিন্তাভাবনা! সেই ছোটবেলায় একটা গল্পে পড়েছিল একটা মানুষ গাছ হয়ে গেল, সেটার থেকেই কি? হতে পারে! এ নিয়ে স্কুলকলেজে বন্ধুরা, বন্ধু যদিও ওর হতো না সেরকম, বিস্তর গবেষণা করেছে, অনেক সুপরামর্শ দিয়েছে। কেউ বলেছে, মরলে তো চাস না চাস ভাই পঞ্চভূত গিলেই নেবে। তা আপাতত জীবনটাকে লুটে লে না কেন! কেউ বলতো, এসব পড়ে ফরে সময় নষ্ট না করে হিমালয়ে চলে যেতে। দু'একটা গুহাটুহা নিশ্চয়ই এখনও ফাঁকা আছে। কেউ আবার আর এক কাঠি ওপরে গিয়ে প্রকৃতি নামে কোনও মেয়ে খুঁজে বিয়ে করে নিতে বলতো! তাহলে প্রতি রাতে, সুযোগ থাকলে দিনে রাতে মিশে যাওয়া যাবে! একমাত্র ধ্রুবই ব্যতিক্রম। ওর এই আকাঙ্খায় ধুয়ো কখনও না দিলেও হেসেও ওড়ায়নি কখনও। রথীনের এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে ধ্রুবই ওর একমাত্র বন্ধু।

আস্তে আস্তে আকাশের কালো আর বিলের কালো মিশে গিয়ে একটা বলয় তৈরি হচ্ছে। এক সম্পূর্ণ, নিটোল বলয়। তার মধ্যে অসংখ্য কুচি আলোকবিন্দুর মতো জ্বলতে নিভতে থাকছে অগণন তারা, জোনাকি। বিভেদ মুছে যাচ্ছে দ্রুত। কোনও কোনও তারা জোনাকি হয়ে যাচ্ছে, কোনও কোনও জোনাকি তারা। রথীন অনুভব করতে পারছে পৃথিবীর বর্তুলতা। সেই বলয়ের মধ্যে আস্তে আস্তে নিজেও হয়ে উঠছে একটা বিন্দু। সেইসময়েই পেছনে এসে দাঁড়াচ্ছে সন্ধ্যা। হারাণ মণ্ডলের যুবতী কন্যা। বিবাহবিচ্ছিন্না। গ্রামের ভাষায় ভাতারছাড়ি। নিঃশব্দেই যেন বলছে সন্তর্পণে, "খেতে চলুন!" সন্ধ্যা জানে মাস্টার এই সময়ে একটা ঘোরে থাকে। শব্দজোড়া সেই অলীক বলয়ে ভাসতে ভাসতে পৌঁছচ্ছে রথীনের মস্তিষ্কে। তৈরি করছে এক অমোঘ সংকেত। আস্তে আস্তে রথীন রওনা দিচ্ছে সন্ধ্যার পিছুপিছু। নিশির ডাক পাওয়া মানুষের মতো।


২.

হাট গ্রামজীবনের সজীবতার দর্পণ। সজীবতার, প্রাণচাঞ্চল্যের, শব্দমুখরতার। ফলে রথীন যে প্রকৃতির মানুষ, ওর কাছে হাট আকর্ষণীয় হতে পারে না। কিন্তু তাও এই সাপ্তাহিক হাটটায় ওকে আসতে হয় মাসে দু'বার। এ সেই হারাণ মণ্ডলের সাথে চুক্তির জের। নামেই হারাণ মণ্ডলের সাথে চুক্তি। এ চুক্তির প্রস্তাবক, নির্মাতা, রূপায়ক, সবই রথীন। ও প্রথমে চেয়েছিল দু'বেলা খোরাকির বিনিময়ে হারাণের হাতে একটা থোক টাকা দিয়ে দিতে। হারাণ রাজি হয়নি। একটা লোক দু'বেলা দু'মুঠো খাবে, তার জন্য টাকা নিতে হবে! তাও আবার লোকটা কিনা গ্রামের মাস্টার! স্বভাবশান্ত প্রৌঢ় হারান টানতে থাকা বিড়ির ধোঁয়া গিলে কেশেটেশে একসা হয়েছিল প্রথমে। তারপর বিপদে পড়লে যা করণীয়, সেই নিজের সদর দপ্তরে দরবার, "অ সন্ধ্যার মা... শুনলি... মাস্টার কী কয়!!" আর তারপরই সন্ধ্যার মা'র শান্ত, মুচকি হাসিটা খেয়াল না করেই "হুররর.... কী যে কন!!" বলে হাতের মুদ্রায় মশামাছি জাতীয় কিছু উড়িয়ে দিয়েছিল। অগত্যা রথীনকে হাটে আসতে হচ্ছে। ও অবশ্য প্রতি সপ্তাহেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার মা'র সাথে বহু অনুরোধ-উপরোধ, দরকষাকষির পর এই দুটো হাটে রফা হয়েছে। সন্ধ্যার বাপ আর ঢোকেনি এর মধ্যে। বেরিয়ে গেছিল। সন্ধ্যাও না। এই পুরো সময়টা ও বারান্দায় বসে একটা মাছ ধরার জাল বুনছিল।

এবং সেই দুটো হাট নিয়েও অশান্তি। প্রায় প্রতিবারই হারানকাকির কাছে ও জিজ্ঞেস করলে শুনতে পায় কিছুই নাকি লাগবে না। অথচ বারদুয়েক এরকম শুনে ও হাটে গিয়ে আবিষ্কার করেছে হারানকাকা হয় সরষের তেল, নয় কোনও সবজিপাতি কিনছে। রথীন তাই এখন নিজের মতোই কিছু শাকসবজি কেনে। আর মাছ হোক বা মাংস, অবশ্যই কেনে। এমনিতে তো একতরকারিভাত হয়। যখন যে সবজির সময়, খেতে খেতে মুখ পচে যায়। গরমে কাঁঠাল, কাঁচা, এঁচড়, পাটের সময় পাটশাক... প্রতিদিন চলতে থাকে তার জড়িয়ে যাওয়া ক্যাসেটের মতো। কোনদিন হয়তো কিছু ভাজা বা পুড়িয়ে সানা করা হল... এই। বর্ষায় মাছ। মাঠেঘাটে ধরা। পুঁটি, সাটি, চ্যাঙ, কই, ট্যাংরা, কুচো চিংড়ি, ছোট কাঁকড়া। দেশের মানুষের খাবার যোগান দেওয়ার দায়িত্ব যারা পালন করে, তারা অধিকাংশই এরকমই খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। হারান মণ্ডলের সংসারে তাই রথীনের হাট করার দিনগুলো ব্যতিক্রম। আজও কিনেছে ও। পাঙাস মাছ। সন্ধ্যা রাঁধে ভালো।

আর এই মাছহাটি থেকে বেরনোর মুখেই ওকে ধরলো সুবল মাহাতো। মুখ চেনে রথীন। নামটাও জানে। পেটানো, নির্মেদ, খাটুয়া, কালো শরীর। বছর তিরিশেক হয়তো বয়স। বা তার একটু বেশি। তেলচুপচুপে ঈষৎ ঢেউখেলানো চুলটা পাট করে আঁচড়ানো। সুবলের চুলের দিকে নজর পড়তে রথীনের মনে পড়ে গেল সন্ধ্যা, সন্ধ্যার মা একটা ভাঙা কাচের টুকরো দেখে চুল আঁচড়ায়। ওদের মাটির বারান্দার খড়ের চালাটার মধ্যেই গোঁজা থাকে টুকরোটা। একদিকে পারা লাগানো। কোনওকালে যে আয়না ছিল, তার বার্তা। একটা আয়না কিনে নিয়ে যাবে?

"ছেলেটাকে আপনার কাছে পাঠাবো মাস্টারমশাই... একদম পড়তে চায় না! সেভেনে উঠলো এইবার...."

চেনা আর্জি। অনেক ছেলেমেয়েই আসে রথীনের কাছে পড়া দেখতে। ওদের গ্রামটার, আশেপাশের গ্রামেরও। আশ্চর্য! স্কুলের গ্রামটা রথীনের নিজের গ্রামই হয়ে উঠছে অবচেতনে! সে হোক! রথীন দেখিয়ে দেয় পড়া। কারোর থেকেই কোনও বিনিময়মূল্য নেয় না। প্রয়োজন পড়ে না তো ওর।

"দেবেন...", একটু স্মিত হেসে সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ায় রথীন। দেরি করা যাবে না। ও বাজার নিয়ে গেলে রান্না বসবে।

হারানকাকিকে বাজারটা দিতে কাকি একটা কচি লাউ দেখালো। গা থেকে আলো ঠিকরে পড়ার মতো কচি সবুজ রঙ। নধর স্বাস্থ্য। তাপসের মা দিয়ে গেছে। তাপস এইটে পড়ে। এই গাঁয়েরই ছেলে। রথীনের কাছে আসে পড়া দেখতে। বিনিময় বেশ আদিম ব্যাপার। রথীন এর মধ্যে ঢুকতে না চাইলেও ঢুকতে হয়।

শেষে "এটা কিনলাম" বলে একটু লাজুক মুখে আয়নাটা কাকির হাতে দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় রথীনের মনে হল, ওর এই আয়না কেনাটাও কী বিনিময়? মানুষ-মানুষের সম্পর্ক কী তাহলে অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে? প্রকৃতিও কী বিনিময়ে বিশ্বাসী?


৩.

একটা ঘোর লেগে আসছিলো রথীনের। মাথার চিন্তাগুলো বিশ্লিষ্ট, স্পষ্ট হচ্ছে না। আবছা, ঘোলা... আর তার মধ্যে মিটমিট করতে থাকা অজস্র আলোকবিন্দু। আকাশ, বিল ছড়ানো বিস্তৃত আলোকবিন্দুদের চিত্রণ নয়। যা রথীনকে আরাম দেয়। বিভোর করে। এই বিন্দুগুলি কেন্দ্রীভূত। ও সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছিলো। 

টলছিলো রথীন। দুলছিলো অল্প অল্প। বাস্তব-পরাবাস্তব, চেতন-অবচেতনের মাঝের সূক্ষ্ম সীমারেখায় অবস্থান করছিলো ওর সমগ্র সত্তা। ওর জন্মের গল্প অনেকবার শুনেছে মা'র থেকে। মাকে যখন অ্যানাস্থেসিস্ট ইঞ্জেকশন দিয়েছিল, মা অজ্ঞান হতে চায়নি। জেগে থাকতে চেয়েছিল, অনুভব করতে চেয়েছিল শেষবারের মতো প্রাণজন্ম দেওয়ার মুহূর্তটা। তখন নাকি মায়েরও এমনটাই হয়েছিল।

রথীন কি অজ্ঞান হয়ে যাবে? রথীন কি জন্ম দেবে কোনও নতুন প্রাণ?

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো ছেলেটা অন্ধকারে মিশে গেছে। অপু। সুবল মাহাতোর ছেলে। বলছিল...। বলছিল, না এখনও বলছে রথীন অবশ্য নিশ্চিত নয়। ও শুধু বুঝতে পারছে ওর কানসংলগ্ন বায়ুমণ্ডলে কিছু শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু ঢুকে পড়ছে কান দিয়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পৌঁছচ্ছে হয়তো মাথায়। কোনও আবছা সিগন্যাল তৈরি করছে। করতে করতেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার তারাভরা আকাশের মাঝে হঠাত হঠাত খসে পড়তে পড়তে মাঝপথে বায়ুমণ্ডলে লীন হয়ে যাওয়া উল্কাদের মতো। রথীনের মাথায় তারা খসছে।

সন্ধ্যা... সন্ধ্যা সেদিন স্থির তাকিয়েছিল ওর দিকে। ওর চোখগুলো স্পষ্ট ছিল। এই ছেলেটার মতো মণির কালো আর পাশের সাদায় মিলেমিশে যাওয়া নয়। রথীন হঠাতই জিগ্যেস করে ফেলেছিল, "তুমি খোরপোষের মামলা করোনি সন্ধ্যা?" সেই সেদিন। আড়মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য সন্ধ্যার পিছুপিছু যখন যাচ্ছিল ও। আড়? না, বোয়াল? নাকি পাঙাস?

কিন্তু এই ছেলেটা কী বলছে ওকে? ছেলেটা না। দুটো চোখ। তার একটু তলা দিয়ে উৎসারিত শব্দগুলোকে প্রাণপণে ধরতে চেষ্টা করে রথীন। কান দিয়ে ধরে কোনওরকমে মাথায় পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করে। মাথা বাক্যগঠন করে নেবে। যদি পারে...

"জোনাকিগুলো এখনও পোষ মানছে না জানিস মাস্টার... তাই বোতলে ভরে রাখি... ভালো লাগে না... মরে যায়... খুলে দিই... হাতটা বাড়াই... বসে না হাতে... পাশ দিয়ে উড়ে যায়... পোষ মানতে চায় না..."

বোতল মানে একটা কাঁচের গোলাকার জার। শহরে অনেক বাড়িতে যেমন জারে জল দিয়ে মাছ রাখা থাকে। অ্যাঞ্জেল, গোল্ডফিশ। এখানে জলের বদলে হাওয়া আর মাছের বদলে জোনাকি। চলন্ত, জ্বলন্তনিভন্ত আলোকবিন্দু। রথীনের সহ্য হচ্ছে না। ও সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে।

ধ্রুব বলেছিল বিয়ে করতে। বাড়িতে গেলে ধ্রুবর সাথে একদিন আড্ডা মারে রথীন। ধ্রুব বলছিল, "প্রকৃতি মানে কী কেবল গাছপালা, চাঁদতারা, আকাশ? আমাদের ভেতরে কি প্রকৃতি নেই? তাকে দমন করে রাখলে সে বদলা নেয় রথী। সেই প্রকৃতিকে সঠিকভাবে ব্যবহার কর... শক্তি পাবি!"

রথীন দেখতে পাচ্ছে অপুর দুটো হাত। এই ছেলেটার চোখদুটো ঘোরলাগা। এই ছেলেটা জোনাকি পোষে। রথীন পড়া বোঝায়, ওর ওপর দিয়ে, আশপাশ দিয়ে চলে যায় সেগুলো। ও ওর নেশাগ্রস্ত চোখদুটো নিয়ে তাকিয়ে থাকে আনমন। সেই ছেলেটার কালো হাতদুটো হলুদ হয়ে যাচ্ছে। স্থির হলুদ নয়, মিটমিটে। হলুদ-কালো-হলুদ-কালো! হাতের মাংস চামড়া সব খসে গিয়ে রয়েছে হাজারলাখ জোনাকি!

ধ্রুব বলছিল, "গ্রামে চলে গেলি, ওখানে কী আর প্রেমটেমের সুযোগ পাবি? কথা কইতে হবে তো? কালচারাল ডিফারেন্স তো একটা থাকে..."

সন্ধ্যা তাকিয়েছিল দীর্ঘ কয়েকপল। তারপর কেটে কেটে বলেছিল, "খোরপোষের জন্য তো বিয়ে করিনি। আমি খেটে খেতে পারি।"

হারান মণ্ডলরা বাপবেটি রথীনকে খুঁজে পেল স্কুলবাড়িটার উত্তর-পশ্চিম কোণায় বিলের একধারে। এই দিকটায় একটা বড় দীঘি আছে। গভীর কালোজলের দীঘি। পাড়ে একটা পুরনো ভাঙা মন্দির। গ্রামে নানা কথা ওড়ে। তাই রাতে কেউ এদিকটা মাড়ায় না। রথীন শুয়েছিল মন্দিরটার একটু পাশে মাটির মধ্যেই। কোনও চোট-টোট নেই। অবিকল ঘুমোচ্ছিল যেন। সন্ধ্যাই দেখতে পায়। দেখে বাপকে দেখায়। হারান ডেকে তোলে। রথীন সুস্থই ছিল। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে খালি বলেছিল, "চলো খেতে যাই...."


৪.

আজ আকাশে চাঁদ নেই। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার একটু একটু করে সাম্রাজ্যবিস্তার করছে। একদিনের নিরঙ্কুশ রাজত্বের জন্য পনেরোদিনের আয়োজন। অমাবস্যা সামনে। শারদীয়া অমাবস্যা। মহালয়া। বিলটা জুড়ে এখানেসেখানে কাশের ঝোপ। আজকের রাতটাও বড় মোহময়ী। চাঁদ যত মরছে, তারারা তত উৎসাহী হচ্ছে। জোনাকিগুলোও ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা বিল জুড়ে। রথীন বসে আছে ওর নির্দিষ্ট জায়গাটায়। ওকে তারায় পাচ্ছে ধীরেধীরে। আকাশ-ডাঙ্গার তারায়, যৌথভাবে।

সেই রাতের পর তিনটে দিন কেটে গেছে। অপু আর আসেনি। রথীন এই গ্রামের ছেলেগুলোর কাছে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল ওর কথা। ওরাও আসে ওর কাছে পড়তে। বলতে পারেনি। খেয়ালই করেনি সেভাবে। রথীনের মতো অপুরও বন্ধু নেই।

কিন্তু ওই ঘরটা টেনেছিল রথীনকে। দীঘির ধারে ভাঙা মন্দিরটা। হাড়গোড় বেরিয়ে গেছে। দেওয়ালের এখানেসেখানে অশ্বত্থ শিকড় চারিয়ে দিচ্ছে। পুরনো কোনও জমিদারের সম্পত্তি ছিল। বারংবার হাতবদল হতে হতে সে জমিদারী আর দেখা যায় না। তবে সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। শুধু এই মন্দির আর দীঘিটা বাদে। ইহারা দেবোত্তর। অতএব খাস। এই গ্রামের দশই আপাতত এর জিম্মেদার। সে দশের অবস্থাও তথৈবচ। নিজেদের পুজোই ঠিকমতো সারতে পারে না, তো ভগবান! বছরে একদিন একটু পুজোঅাচ্চা হয়। একটা ছোট মেলা বসে। অষ্টপ্রহর নামকীর্তন হয়। সেইসময়টাতে একটু ঝাড়পোঁছ হয়। ব্যস, ওটুকুই। বাকি সময়টায় দেবতা থাকে দেবতার মতো, তার সেবায়েতরা থাকে তাদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রাম নিয়ে। কৃষকরা বাস্তববাদী। এই কদিনের গ্রামজীবনে রথীন এটা বেশ বুঝেছে।

তা সেই মন্দিরেরই যে ঘরে বিগ্রহ, তার পাশে আর একটা ছোট ঘর একসময় ছিল। এখন কিছু ভেঙ্গে পড়া ইঁটের দেওয়াল তার স্মৃতিচারণ করে মাত্র। এখানটাতেই অপুর জারটা আছে।

এটাই টেনেছিল রথীনকে। অপুর থেকেও বেশি। নইলে অপুর খোঁজে ও তো আর অপুর বাড়ি হাজির হয়নি। এখানে হানা দিয়েছিল একদিন। দিনের আলোয়। ভরদুপুরে।

পায়নি। ছিল না। এদিকওদিক হাতড়েও দেখেছিল। নেই। বেশি গভীরে যায়নি অবশ্য। সাপখোপ থাকতে পারে। আছেও নিশ্চিত। সবমিলিয়ে ওখানে ঘুরঘুর করতে রথীনের একটু গা ছমছমই করছিল। কেন কে জানে।

বেরিয়ে আসার সময় একটা সড়সড় আওয়াজ শুনে পেছনে ঘুরে তাকিয়েছিল ও। খানিক চমকেই। দেখেছিল ভাঙা দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দুটো দাঁড়াশ। একে অপরকে পেঁচিয়ে। দুলছে হাল্কা হাল্কা। রথীনকে দেখেছে বা দেখেনি। দেখলে ভ্রূক্ষেপ করেনি, আর না দেখলে দেখার কোনও ইচ্ছেও নেই। নিজেদের মধ্যে বিভোর। শঙ্খ লেগেছে দাঁড়াশের।

রথীনও বিভোর হয়ে গেছিল কিছুক্ষণ। বিভোর, অথবা বিবশ। ওর ছাব্বিশ বছরের জীবনে এ জিনিস দেখেনি কখনও ও। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল ওর। একটু সম্বিত ফিরতে বেরিয়ে এসেছিল পা টিপেটিপে। পায়ের শব্দে ওরা বিরক্ত হতে পারতো।

গোটা ঘটনাটা মানসপটে ভাসালে কেমন একটা ভালোলাগার আবেশ জড়িয়ে ধরছিল রথীনকে। ও বুঝতে পারছিল না কেন, তবে ভালো লাগছে, বড্ড ভালো লাগছে।

কিন্তু অপুর জোনাকির জারটা? সেটা কোথায় গেলো?

ঠিক এমন সময়েই অপু আসলো।

প্রথমে বুঝতে পারেনি রথীন। হঠাৎ মনে হল বিলের অন্ধকারের মধ্যে যে জোনাকিগুলো নেচে বেড়াচ্ছিল, তাদের মধ্যেই কয়েকজন যেন একটা তিননম্বর সাইজের ফুটবল পাকিয়ে ওর দিকে দৌড়ে আসছে। দৌড়েও না, ভেসে ভেসে। মাটির কয়েকফুট ওপর দিয়ে। অপুর সেই জোনাকির জার? সেদিন যেটা ও অত খুঁজেও পেল না? সেটাই ধেয়ে আসছে ওর দিকে? 

উত্তেজনায়, খানিক ভয়ে রথীন উঠে দাঁড়াতেই জারটা ওর একদম সামনে চলে আসলো। কথাও বলে উঠলো....

"দ্যাখ মাস্টার, আমি পেরেছি! জোনাকিগুলো পোষ মেনেছে আমার!! দ্যাখ, ওরা কেমন আমার মাথায় বসে আছে!! কোত্থাও উড়ে যাচ্ছে না! দেখলি?? বলেছিলাম না! পেরেছি.... আমি পেরেছি....!!"

জারটা আবার তারাভরা অন্ধকারের মধ্যে দৌড় দিল। অপুর মাথাটা জোনাকিভরা জার হয়ে গেছে!

ভয়, উত্তেজনা, বিহ্বলতা সমস্ত অনুভূতিগুলো উপরপড়া হয়ে রথীনকে স্থাণু করে দিল। অপুর গমনপথের দিকে ও একখানা হাত তুলতে পারলো শুধু!

কিছু কি বলতে চেয়েছিল ও? যেতে চেয়েছিল নিজেও? থামাতে চেয়েছিল অপুকে? আদৌ কি কিছু বলতে চেয়েছিল?

ঠিক তখনই রথীনের মূর্তির পাশে এসে দাঁড়ালো এক নারীমূর্তি। রথীনের মূর্তি প্রাণ পেলো সেই অনুভবে। ওর শহুরে অপরিশ্রমী কোমল হাতটা দিয়ে সন্ধ্যার কর্মী শক্ত হাতখানা আঁকড়ে ধরলো। পরম আকুতি নিয়ে।

তারপর.... এক লাস্যময়ী আকাশ, এক আকাশভরা তারা, এক বিলভরা জোনাকি এবং কাশ, এবং এক গ্রামভরা জীবনকে সাক্ষী রেখে দুই নারীপুরুষ যাত্রা শুরু করলো পাশাপাশি....


খেতে...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ