পুরো সময়টার মধ্যে একটা পাপ জড়িয়ে আছে। গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ। রাতের পর রাত কেটে গ্যাছে বোবা সময়ের হাওয়ার বেলুনে। একা একা। নির্ঘুম। এরকম অনেক রাতেই হঠাৎ হঠাৎ পা হড়কে অস্পষ্ট অতলে হারিয়ে যাওয়া অনীকের জন্য নতুন কিছু নয়; কিছুক্ষণ পর পর চোখ খুলে গলার ঘাম মুছতে হয়। একটু স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব হয় বটে কিন্তু ওতে স্বপ্নের জাদু-কাব্যটুকু যেন নেই; শুধুই যেন বয়স্ক নিষ্কাম গদ্য । পুকুরের ধার নেই, নেই নেবুর তলও। তাই কাজলা দিদিও নেই; তিনি হারিয়ে গেছে দূরের কোন তুষার-ঝড়ে।
এই মার্কিন মুলুকের সন্ধ্যের আঁধারটাও যেন বড় অচেনা। রাত-জাগা ঘুটঘুটে ভোরগুলোতে অনীক ওর মা’কে ফোন করে ডানকিন ডোনাটসের পানসে কুসুম-রঙা আলো ছড়ানো কাস্টোমার কিউ থেকে। ভুল হল। কোন কিউ নেই। অনীকই প্রথম খদ্দের। না না ঐ তো আছে! অনীক দাঁড়িয়ে বাসি মুখে অর্ডার দিতে দিতে পেছনে লাইন পড়ে গ্যাছে। রাত-ভোর একাকীত্বের ভারে বিল দিতে দিতে ঘাড়ে সেলফোনটা রেখে ও খটাখট লাইন লাগায় ঢাকার একটা ঘুপচি গলির প্রথম বাড়ীটাতে। যেখানে ওর মা দুপুরের রান্না সেরে কাজের মেয়েটাকে রাতের রান্নার ফর্দ দিতে দিতে ফোন ধরেনঃ “ও বাবা তুমি দুপুরে খাইছো? ও আল্লাহ...ঠিক ঠিক তোমার ঐখানে তো এখন ভোর...
এদেশে সকালটা আসে দূরদেশে বসে অসুস্থ্ জননীর হঠাৎ আরোগ্য লাভের খবরের মত; চারপাশের বাতাস কেমন হাল্কা হয়ে চোখে ঝাপ্টা দেয়। রাতে জমে থাকা গভীর বিষাদ ছিন্নভিন্ন পালিয়ে যায়, থাকলে যেন অপমানিত হবে এই ভয়ে। আবার বলা যায় ও যেন সারারাত সমুদ্রের তলদেশে ছিল এতক্ষণ-ভুশ করে ভেসে উঠে সুর্যের আলোর ভেতর গড়িয়ে পড়ে; হাল্কা আলস্যে উঠে বসে, তছনছ হয়ে যায় অর্ধস্বচ্ছ জানালার শার্সি থেকে প্রতিসরিত আলোর রেখা।
চারপাশের সবকিছু নির্ভার বিছিয়ে থাকে এপার ওপার; শব্দ, আলো, ছোঁয়া, কান্না সবই আছে। কিন্তু এদেরকে ও ঠিক যেভাবে চিনে এসেছে এতদিন এই দূর বিদেশে সেভাবে যেন ওরা নেই। যেন ক্যালেন্ডারে আঁকা একেকটা ছবিঃ চোখ পেতে দেখা যায়, ছোঁয়াও যায় কিন্তু ঠিক ধারণ করা যায় না। থেকে থেকেই ওর নিজেকে মনে হয় একটা প্রাচীন ঘুমন্ত মাছ; যেটা জেগে উঠতে উঠতেই আচমকা নিথর হয়ে গিয়েছিলঃ চোখে আঁকা ছিল বিষ্ময়। ঠিক জানা-বোঝা কোন দুঃখ বা শোক নয়। একধরণের নিঃসাড় বিহ্বলতা।
এরকম ছায়া ছায়া সময়। দিনগুলো মেঘলা আর ফাঁকা। রাতগুলো গুমোট আর নিঃসঙ্গ। এরকমই এক রাতে অনীকের কথা হয় শায়লার সাথে। শায়লা বিবাহিতা। দুই মেয়ের মা। সেরাতে বাইরে শোঁ শোঁ তুষারঝড়। ওদের প্রথম আলাপ হয় একটা বাংলাদেশী চ্যাটরুমে। ওর প্রতিবেশী এক বিদায়ী দম্পতি অন্য স্টেটে মুভ করার আগে তাদের লেখার টেবিলটা ব্যাকইয়ার্ডে ফেলে গ্যাছে। অনীক খানিকটা ইতস্ততঃ করছিল টেবিলটা উঠিয়ে আনার ব্যাপারে। নিজেকে কেমন ভিখিরি ভিখিরি লাগছিল। এদেশে এরকম অনেক কিছুই মানুষ ফেলে যায় যেটা আবার অন্যরা তুলে নিয়ে আসে। টিভি, ফ্রীজ থেকে শুরু করে খাট, আলমারি, টেবিল কোনটাই বাদ নেই। বিশেষ করে অনীকের মত ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা এগুলোর খোঁজে থাকে বেশী যাদের সামান্য স্টাইপেন্ডের টাকায় সারা মাস চলতে হয়। শেষ পর্যন্ত দ্রুত নামা সন্ধ্যার আঁধারে পা টিপে টিপে তুলেই নিয়ে আনল টেবিলটা। ওটাতে ল্যাপটপটা রেখে চ্যাটবক্সে টাইপ করে করে শায়লার সাথে চ্যাট করেছে সারা রাত। পাশে রাখা ছিল নারকেল তেলের কৌটার গড়নের ক্যাসুনাটের বক্স, একটু দূরে একটা পেটমোটা কাপ-ভেতরে কাঁচ-স্বচ্ছ স্মির্ণ অফ;। পরিচয়ের প্রাথমিক বাক্যালাপের পর শায়লা স্বগতোক্তির মত বলে গেল-
“দেশ ছাড়লাম একটা ঘোরের মধ্যে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি এসব ভাবার আগেই সংসার শুরু করতে হল। আমার হা্জবেন্ড খুব গম্ভীর বাট সংসারের দরকারগুলোর ব্যাপারে খুব কেয়ারিং ছিল। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব কোল্ড থাকত। নিরাপদ কিন্তু নিরানন্দ কেটে গেল ৬ টা মাস। কেমন ছেঁড়াখোঁড়া। ঠিক বোঝাতে পারবনা। আমার পাশে বসে সবসময়ই ও কেমন আনমনা হয়ে থাকত। আই ট্রাইড টু লাভ হিম। ইয়েস আই ডিড...এ লট। আমি আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও যোগাযোগ অনেক কমায়ে দিলাম ওকে একটু বেশী সময় দিব বলে। কিন্তু চারপাশটায় কেমন উদ্বাস্তু লাগত নিজেকে; মনের মধ্যে তখনো দেশের ব্যাডমিন্টন-খেলা-হৈ-চৈ কমলা রোদের বিকেল, মোড়ের দোকানের ভেজাল তেলের পুরি-মোগলাই পরোটা, হঠাৎ-আসা ইলিশ বৃষ্টি... সেই চির-চেনা সবকিছুর ওপর এই আমেরিকার জীবন কেমন পুকুরের উপরে ফেনার মত ভাসতে থাকল। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। গ্রোসারি, উইকেন্ড, ক্রেডিট কার্ড, কুকিজ, ম্যাকারনি এন্ড চীজ, উইন্ডোশপিং...এসব জিভের আগায় চলে আস্ল....”
প্রায় প্রতিদিন কথা হত ওদের। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’, ‘তুমি’ থেকে আরও অতলের তুমি। নরম কবিতার বিচ্ছিন্ন পংক্তি, রিসেন্ট দ্যাখা বলিউডের একটু আর্ট আর্ট গন্ধ হিন্দি ছবি, দুপুরে রান্না করা মাছের ঝোল, উঠ্তি কোন দেশী গায়িকার ‘ভারী মিষ্টি’ গলার প্রশংসা , ঘন উষ্ণ লালা মাখা একেকটা স্পঞ্জের মত ভারী সচেতন বাক্য, গভীর রাতে অন্যজনের ফোনে ঘুম-ভাঙা ম্ম্ “হ্যালো”, ছোট্ট করে বলা ‘মিস ইউ’, হোম-মেড হট ডগ, কাঁচভাঙা হাসির চূর্ণ, কালকে-ফোন-করলানা-কেন অভিমান, পেঁয়াজ-ঝাঁজ কান্নার গমক, মান-ভাঙ্গানোর দীর্ঘ দীর্ঘ গড়ানো বাক্য...টুকরো টুকরো সবকিছুই ছিল দিনগুলোর মধ্যে। কথাই হয়ে উঠত একেকটা কঠিন-কোমল নির্মাণ; হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে উল্টেও যেত। নিভে যেত সব । কতদিন খাঁ খাঁ শূণ্যতায় ফাঁকা হয়ে গ্যাছে ঘন্টার পর ঘন্টা!
ছেঁড়াখোঁড়া অদ্ভূত মাতাল একটা সময়। নির্ভার। আবার ক্ষণে ক্ষণে খুব ভারী। এরকম...দিনের পর দিন।
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
শায়লা এক গুমোট দুপুরে বল্ল ‘চলে এসো না আমার এখানে। বেশী দূর তো না। ঘন্টা চারেকের রাস্তা।
“দেখি” এক শব্দে বলি।
“দেখে যাও আমি কীভাবে থাকি। বাচ্চাদের সাথে গল্প করে যাও। আমার সাথেও অবশ্য।” ওপাশে হাল্কা হাসির ঢেউ।
“হুম...”
অনীক ওয়েবক্যামে প্রথম যেদিন শায়লাকে দেখল, সেদিন কেমন যেন নতুন এক অনানুভূত নিঃসঙ্গতা ওর ঘাড়ের কাছে চাপ দিল; শায়লা দেখতে অনীকের প্রাইমারী স্কুলের এক মিসের মত-গোলাটে মুখ, শান্ত বিষন্ন গভীর একজোড়া চোখ, পরিপাটি বেঁধে রাখা ঘন জাম-কালো চুল। দৃষ্টিটা গভীর। ভীষণ গভীর। হাসলে কেমন করুণ দ্যাখাত। ওর ২ মেয়ে, বড়টার নাম রিনি, বয়স ৬, ছোটটার নাম মিনি, বয়স ৪, সারাক্ষণ ছুটোছুটি করতে ওর চারপাশে। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আহ্লাদ করত, ওড়না দিয়ে গাল ঘষত, ল্যাপটপের কী-বোর্ডের একটা কী চেপে দৌড় দিয়ে পাশের ঘরে চলে যেত। মনে হত একটা বিষাদবর্ণ মমিকে ঘিরে আনন্দে নাচ্ছে কিছু অন্ধ স্বপ্নভূক পাখি।
ওদের প্রথম চুমু (ফোনচুমু) খাওয়ার দিনটার কথা এখনো ওর স্মৃতিতে উষ্ণ। প্রথম উদ্যাগটা শায়লারই ছিল। চুমু খাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে অনীকের নিজেকে কেমন অচেনা মনে হয়; যেন ওর চুমু খাওয়ার ঠোঁট নেই, আবেগের যথেষ্ট যোগান নেই...ও নিজেই যেন ওর নিজের চুমু-ব্যবহারে পূর্ণবয়স্ক কোন যুবককে খুঁজে পায়নি। মনে হচ্ছিল শৈশব পেরিয়ে ও এক দৌড়ে ও পূর্ণবয়স্ক মানুষদের মিছিলে ভীড়ে গ্যাছে, আর কেন যেন মনটা খুব হা হা করছিল । ভীড়ের মধ্যে ও ওর মা কে খুঁজতে থাকে। মা অনীক অনেক বড় হয়ে হবার পরও ওর জন্য টিফিন বক্সে করে টিফিন দিয়ে দিতেন...বক্সটার ভেতরটায় কেমন পুরণো কিন্তু খুব চেনা একটা গন্ধ ছিল। ওটা যে দুপুরে হারিয়ে যায়, সেদিন মনে হচ্ছিল অনীকের আর কোনদিন টিফিন খাওয়া হবে না। কোনদিন না। কখনো না। ওর বোধহয় আর কোনদিন টিফিন পিরিওডে ক্ষুধাই পাবে না।
শায়লার কাছে ও খুব জানতে চাইত ওর ছেলেবেলার কথা, ওর বেড়ে ওঠা, ওর এ পর্যন্ত কাটিয়ে আসা জীবনটার ভেতরের গল্প । শুনতে শুনতে একেকবার ভোর হয়ে যেত। দশ বছর বয়সে শায়লার মা মারা যাওয়ার পর ওর জায়গা হয়েছিল ফুপুর বাড়ীতে। একবার প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার সময় ও অলক্ষ্যে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে। ফুপু সেদিন গাছের ডাল ভেঙ্গে প্রচন্ড মেরেছিল ওকে। পরদিন বাবা এসে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়ার সময় ও ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে উঠেছিল-‘ফুপ্পি আর করবনা ফুপ্পি...আর কক্ষনো পেশাব করবনা...’। ও বলে যেত, “বাবা চাপাস্বরে চীৎকার করে উঠেছিল ‘মা কী হয়েছে গো মা? কে মেরেছে তোমাকে?’ বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই কেমন ফাঁকা লাগছিলো সবকিছু, হঠাৎ বুঝলাম বাবা পাশে নেই। রান্নাঘর থেকে বাবার উচ্চকন্ঠ চীৎকার শুনলাম; শেষের দিকে বাবার গলা কেমন ধরে এলো বলে মনে হল। ফুপু স্থির থমথমে গলায় কি যেন বলে আবার থেমে যাচ্ছে, আবার বলছে। কানের বাইরে কেমন ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনি। এরপর হঠাৎই নিজেকে একটা চলন্ত কিছুর মধ্যে আবিষ্কার করি...বাবার ব্যবহার করা আতরের গন্ধ নাকে পাই...চোখ খুলে দেখি আমার মাথা বাবার কোলে...বাবার চশমার কাঁচ ঘোলা... আই রিয়্যালাইযড্দ্যাট আই ওয়ায গোইং হোম।”
ও ফোন রেখে ঘুমাতে গেলে অনীকের মনে পড়ে অনেক ছোটবেলায় এক মেঘলা দুপুরে ও একটা কিশোরী মেয়েকে ওদের পাশের বাড়ীর ছাদে কতদিন একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। চোখ দু’টি বিষন্ন, ভীষণ একা যেন। অনীকের ভীষণ ইচ্ছে করত ওর সাথে কথা বলতে। একেকবার ও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল যে এক দৌড়ে ওদের ছাদে উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়াবে। শেষ মুহুর্তে একটা অসম্ভব দ্বিধা ওর পা থাকে মাথা গ্রাস করে নিল। আর যাওয়া হয়নি। কখনো না।
“সময়টার কথা ভাবলে ভেতরে একটা ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠত।’ শায়লা বলল। ‘মনে হত ওটা কেমন অলক্ষ্যে বয়ে যাওয়া একটা জলের রেখা...গড়াতে গড়াতে কোথায় কতদূর পৌঁছে গ্যাছে। মাঝে মাঝে মনে হত আমার অতীতটা কোন গল্পে পড়া, আমি ওতে বিলং করিনা। আমার বর্তমানটাই যেন আমার অস্তিত্ত্ব। বিশেষ করে যখন আমার বড় মেয়েটা জন্মানোর পর ওকে ঘিরেই আমার সবকিছু যেন আস্তে আস্তে বদলে গেল। তারপর ছোটটা হওয়ার পরে তো আরো...ওদের বাবা খুব খেয়াল রাখত ওদের...হি ওয়ায অ্যান্ড ইয আ গ্রেইট ড্যাড...এটা বলতেই হবে। আমিও আস্তে আস্তে এদেশী কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম...আমার মেয়েরা, ওদের স্কুল, বইখাতা, পেন্সিল, ওভেন, লন্ড্রোমার্ট, লাইজল, বেডবাগ্স, ডিলের পিৎসা, জায়েন্ট, টুনা স্যান্ডোইচ...। এভাবে আস্তে আস্তে আমি কেমন বদলে যেতে থাকি। অতীতের অতীতটুকুতে আমাকে আর পাইনা আমি।”
কয়েকদিন পর এক ঘন বৃষ্টির রাতে শায়লা বলেছিল,
“আমার কন্জুগাল লাইফটাকে আমার একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মত মনে হয় জান... আমেরিকায় আসার পর আমার মনে হত কেমন আলগা ভাবে বেঁচে আছি। আমার হাসব্যান্ড আস্তে আস্তে কেমন পাথরের মত হয়ে যাচ্ছিল। আমার জন্য ওর সময় নাই... ভীষণ ব্যস্ত... তবে হ্যাঁ মেয়ে দুইটাকে টাইম দেয়াতে খুব রেগুলার ছিল। সারাদিন যেন একটা মেশিনের সাথে আছি এমন মনে হত।...আমার কলেজ লাইফ এ একটা ছেলে আমাকে প্রতি রাতে ফোন করত...আমি কখন কোথায় যাই কী করি কার সাথে কথা বলি সবকিছুর উপর নজরদারি করত...আমাকে বলত আমাকে বিয়ে করে পকেটে রেখে দেবে...আমি শুনে ভীষণ রেগে বলতাম ‘আমি কি ঘড়ি না কলম যে আমাকে পকেটে রেখে দেবেন? আই হেইট সাচ ন্যাকা ন্যাকা দেবদাসপনা’। আমার বিয়ের পর ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়...এখন মনে হয় ওর অভিশাপেই বোধহয় আমার জীবনটা আজ এরকম...বিলিভ মি আই ট্রাইড মাই বেস্ট টু মেক মাই হাজবেন্ড হ্যাপি...আই ট্রাইড টু ইভেন কোপ আপ উইথ হিজ ফ্রিজিডিটি...ইউ নো হি কুড নট মেক লাভ অন বেড...দিনের পর দিন আমি ওকে আগলে ধরে বসে থেকেছি...হি ইউজ্ড টু লাই অন মাই ল্যাপ লাইক এ বেইবি...কোল্ড অ্যান্ড হেল্পলেস।”
ওদের দু’জনের সাথে কথা হত যখন তখন। সকাল।দুপুর।গভীর রাত।
ছুটির দিনে গ্রোসারি করতে গেলে সবকিছু খুব অচেনা লাগত অনীকের। মনে হত এই মাল্টার খোসা-রঙের ছড়ানো রোদ, সাদা সাদা পেলব নারী-শিশুর স্বচ্ছন্দ হেঁটে যাওয়া, মাঠে ঘেমে ঘেমে খেলতে থাকা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলোর কলকাকলী...সাজানো কাঠের বাড়ীগুলোকে দু’পাশে রেখে বয়ে যাওয়া শান্ত রাস্তা এসবের ভেতরে যেন ছড়িয়ে আছে একটা অবহেলায় যাপিত জীবন...শূন্য দৃষ্টির ভেতরে ঝুলে থাকা একেকটা সো কল্ড রিয়েল ওয়ার্ল্ড ম্যাটার। এসব কোন কিছুই ছোঁয় না অনীককে। একটুও না।
ওদের কথোপকথনের সময় অনীক একটা নির্লিপ্তির মধ্যে থেকে শুনে যেত শায়লার কথা মাঝে মাঝে ‘হুম’ বা ‘তারপর’ এরকম বলে। শায়লা বলে যেত অনর্গল। ওর বিয়ের আগের জীবন। কৈশোর। শৈশব। হঠাৎ আবার গতকালে ওর বাচ্চার কোন দুষ্টামির কথা। সময়ের ল্যাপ্স থাকলেও ভেদরেখা নেই। একটা টানা বয়ান।
শায়লার একেকটা বাক্যের সাথে অনীক একেকটা জার্নি করে আসত যেন। ফুপুর বাড়ী থেকে ফিরে ও বাবার বাড়ীতে ছিল কয়েক মাস। তারপর বাবা বিয়ে করলেন। ওর সৎ মাও প্রচলিত সৎ মা-ই হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। ওর জায়গা হল প্রচন্ড রক্ষণশীল মামা-মামীর কাছে। একদিন ওর বাবার বাড়ীতে মামী নিজেই এসে ওকে বল্লেন সব গুছিয়ে নিতে। সেই ওর বাবাকে মোটামুটি একেবারে ছেড়ে আসা।
উকিল মামার গোছানো সংসারে এসে সবকিছু বদলে গেল। বাড়ীতে থেকেও বাড়ীতে নেই—এই বোধের সাথে আস্তে আস্তে ও অভ্যস্ত হয়ে গেল। মামাত ভাইটা ওর চেয়ে ৮ বছরের বড়। ভীষণ স্নেহ করত ওকে। প্রতিদিন চকলেট দেয়া থেকে শুরু করে পড়া দেখিয়ে দেয়া, মেলায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়া; মামাত ভাইটির এই স্নেহ বাড়ীর এই গুমোট পরিবেশে ওর জন্য একটা প্রতিনিয়ত স্বস্তির ছায়ার মত ছিল। মামী মাঝে মাঝে স্থির চোখে তাকিয়ে দেখতেন ওদের দিকে; উনার লম্বাটে মুখটা একটা লালাভ ছায়ার ভেতর তিরতির করে কাঁপত। কিশোরী শায়লা কেমন কাঠ হয়ে যেত সেই দৃষ্টির সীমানার ভেতর।
এক শ্রাবণের মেঘলা দুপুরে সবকিছু কেমন একটানে ছিঁড়ে গেল। খালি বাসা। মামী গেছেন তাঁর এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়। মামা কোর্টে। মামাত ভাইটি কেমন অস্থির ভাবে শায়লার ঘরে এসে পায়চারি শুরু করল। যেন সে একটা অন্ধকার গুহায় ঢুকে পড়েছে। বেরুনোর পথটা সামনেই উজ্জ্বল পড়ে রইলেও ভেতরের অন্ধকার তাকে কেমন জড়িয়ে ধরে। বাইরের টানটান বিকট সূর্যের আলো যেন ওকে অন্ধকারের কোমল অস্থি থেকে টেনে বের করে এনে গাছে ঝুলিয়ে ঠা ঠা হেসে ওঠে।
ভাইটা হঠাৎই পেছন থেকে এসে ওর চুলে হাত বোলাতে থাকে। ওকে আপুনি বলে ডাকত। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, “আপুনি কি করিস?” শায়লা স্কুলের বাড়ীর কাজ করছিল। খাতা থেকে মুখ না তুলে উত্তর দিল, “হোমওয়ার্ক করি ভাইয়া। সন্ধ্যায় আজকে ঝুমিদের বাড়ীতে যাব। ওর বড় আপুকে দেখতে আসবে। তাই এখনি শেষ করে রাখছি সব” সেই দুপুরে মামাতো ভাই যখন ওর বিনুনি টেনে, গাল টিপে সবসময় যেরকম আদর করে সেরকম করছিল...তখন ও আর কিছু ভাবতে পারেনি, আসলে ভাবতে শেখেনি।
...হঠাৎই কয়েকটা মুহুর্ত কেমন জোর করে ঠেলে ঢুকে পড়ে ওই দীর্ঘ ছড়ানো দুপুরটার মধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করে; ফ্রকের ঝালরে ঢেকে যাওয়া মামাত ভাইয়ের মুখটা আর দেখতে পায়না। শুধু বোঝে ওর সাদা ফ্রক ভিজে উঠেছে ভাইটির নোনা ঘামের স্রোতে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল ভাইয়ার স্নেহ-ঝরা দৃষ্টিটা এক পলকের জন্য দ্যাখে। কিন্তু ও ভীষণ একটা অস্পষ্ট ভয়ে নিশ্চল হয়ে যায়ঃ ভাইয়া এমন করছে কেন? বাইরে আকাশটা কেমন কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছিল। ঘরটা অদ্ভুত ছায়া ছায়া আর চারপাশটা গলা চেপে বসা তীব্র ফোঁস ফোঁস আওয়াজে ডুবে যাচ্ছে যেন। বাইরের বাতাসের গন্ধটা কেমন বদলে যেতে থাকে। ভেজা দমকা মাতাস প্রথমে ২-৩-৪-৫ টা পৃষ্ঠা উড়িয়ে পুরো অংক খাতাটাই উড়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে ওর পাশে। অস্পষ্ট খামচে ধরা অন্ধকারে ভীষণ ঘর্মাক্ত একটা মুখ দেখে ও। মানুষটার এরকম মুখ তাকে ওর কাছে একটানে অচেনা করে দেয়; বন্য কিন্তু অসহায়; লম্বা কালো শরীরটা নিয়ে গোঁ গোঁ করে কিশোরী বোনকে সাপটে ধরে ওর বুকের উপর কান্নার মত শব্দ করে মুখ লুকালো। অনেক রক্ত গিয়েছিলো সেদিন। মেঝে পাপোশে মাখামাখি। কিছুক্ষণ পর ভাইটা যখন উঠে দাঁড়াল, ভীষণ শান্ত লাগছিলো তাকে। দৃষ্টিটা কেমন মরা মাছের মত। ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতায় ঘাম নিয়ে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড। তার পরপরই ছুটে বেরিরে গিয়েছিলো
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
আজ সেই মামাত ভাইটার লিভারে ক্যান্সার । দেশের একটা সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। মামা মারা গেছেন বহুদিন। মামী শয্যাশায়ী। মামাত ভাইয়ের চিকিৎসার খরচের প্রায় পুরোটাই স্বামীকে বলে মাসে মাসে শায়লা পাঠায় এখান থেকে। ওর স্বামী আইন ব্যাবসা করে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। এখন এক বছরের জন্য গেছেন ইউকে তে একটা ট্রেনিং এ। শায়লা সংসার এখন ওর ২ মেয়েকে নিয়ে।
“ঐ ঘটনার পর মামা কাউকে কিছু বল্লেন না। আমাকে জড়ায়ে ধরে অনেক্ষন কাঁদলেন মামা। এরপর আমাকে নিয়ে জেলা সদরের একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । ছেলেকে ঢাকার কলেজে ভর্তি করে দিলেন। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসলে মামা আমাকে আগে থেকে বাড়ীতে এনে রাখতেন। আমি বাবাকে কোন দিন বলিনি কিছু। কেমন নীরব আর বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাছে আর কিছুই স্বাভাবিক লাগত না তখন থেকে। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে জেগে উঠে পানি পানি বলে চীৎকার করতাম। মনে হত আমি একটা মাটির বাক্সে বন্দী হয়ে আছি...এখনি দরজা খুলে একটা লম্বা কালো লোক ঢুকবে আর আমাকে সাপটে ধরে দরদর করে ঘামতে থাকবে...আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি এরকম শত শত রাত কাটিয়েছি দুঃস্বপ্নের ঘোরের মধ্যে...আমার ম্যারেড লাইফ এ আমার হাজবেন্ড যখন রাতের পর রাত অনেক্ষন চেষ্টা করে এলায়ে পড়ে ঘুমায়ে যেত...আমার শরীর কুলকুল করে ঘামত।...সে যে কি কষ্ট...তোমাকে বোঝাতে পারব না...বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে আমি স্বপ্নে আমার মামাত ভাইকে দেখতাম...কী এক অদ্ভূত বন্য আদরে আমাকে এঁফোড়-ওঁফোড় করে দিচ্ছে...উফ্ফ্আমাকে একটু আদর কর না প্লীজ...একটু আদর কর...আর পারিনা...”
কৈশোর-যৌবনের মাঝামাঝিতে আবিষ্কৃত একটা ভাঙ্গা সাঁকো ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই সময়টার ভেতরে সময়ের ভাঁজ গলে গড়িয়ে পড়ে অনীক। মনে পড়ে সেই ভাঙ্গা সাঁকো পার হতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গিয়ে সাঁতার না জানা একটা গোলগাল পোকার মত কী ভীষণ অকুল পাথারে পড়েছিল ও। সেই রাতে অনীক একটুও ঘুমাতে পারিনি। পরদিন সকালে আগের রাতের আঠালো ঘুম শীতকালে জমে জাওয়া একতাল গ্লু এর মত তখনো সাপ্টে ধরে আছে ওর সমস্ত চেতনা। সকালে নাস্তার টেবিলে আস্ত ডিমের কুসুমটা মুখে পুরে মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল আগের সন্ধ্যায় গাউসিয়া মার্কেটে দ্যাখা এক মাঝবয়েসী গৃহবধুর স্তনের ভাঁজ । চারপাশের রকমারি আলোর ভেতর নিজেকে মনে হচ্ছিল ভয়ংকর এক কিলবিলে কীট যে নারীর স্বপ্ন-নরম স্নিগ্ধতায় বিহ্ববল না হয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছে এক আদিম শরীরী কামনায়...রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসহ্য বাসনার গলিত আগুন। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ঐরকম আরেকজন মহিলাকে দেখে সকালের চাপা পড়া কামনা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ওর। বাড়ীতে ফিরে বাবার ডিস্পেন্সারীর পেছনের অন্ধকার ঘরের তেল চিটচিটে বালিশের ওপর শুয়ে মনের পর্দায় ঐ মহিলার সারস-সাদা বুকের ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়েছিল ও—তীব্র সুখের গণগণে জ্বালা কুসুম কুসুম বেরিয়ে আসে। দেহটা নুয়ে পড়লে দেখি ভদ্রমহিলা কেমন পবিত্র একটা হাসি হাসেন। অনীক নিজের চুল খামচে ধরে ... “কী করলাম এটা কী করলাম...আমি নরকের কীট...আমি অমানুষ!”
রাত-জাগা কথোপকথনের এক রাতে শায়লা আর অনীক ঘন কাল্পনিক স্পর্শে বুঁদ হয়ে একটা উষ্ণ চোরাস্রোতে ভেসে যায়...প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর সেই অনিবার্য অসহায় গণগণে অগ্নিকুন্ডে।
পরদিন সকালে শায়লা অনেক্ষন পরে ফোন ধরে, “হ্যালো”
“ব্যস্ত তুমি? এতক্ষন পরে ধরলা যে?”
ওপাশে নীরব। কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর শোনা গেল, ‘না... ব্যস্ত না’
‘কিছু ভাবছ?’
‘ম্ ম্ ম্...নাহ’
‘ভাবছ একটা কিছু। বলে ফেল কী ভাবছ’
‘নিজের অজান্তেই কালকে কেমন উইন্ডোশপিং করে ফেল্লাম, তাই ভাবছি’
অনীক দপ করে নিভে যায়। ভেতরের আলো, মায়া, স্তব্ধতা কেমন অবশ গলে গলে পড়তে থাকে। অস্ফুটে বলে, ‘স্যরি’
‘তুমি স্যরি বলছ কেন?’
‘আই থিঙ্ক আই শুড’
‘নো, ইউ শুড নট। আমি ইদানীং একটা কথা ভাবি জান...জীবনে কেউ ভালোবাসল না আমাকে...’
অনীক চুপ করে নিঃসাড় শুনে যায়। কিছু বলে না । একটা অব্যয়ধ্বনিও না।
‘কী বোকা আমি, না!! আমি ভাবলাম তুমি বলবা যে তুমি আমাকে ভালোবাস...হা হা হা... তবে আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিলো।’
বেহালার চাবি টাইট দিতে দিতে হঠাৎই যেন মন ভেঙ্গে দিয়ে সবচেয়ে সূক্ষ তারটা ছিড়ে যায়।
‘তাই?’
‘হুম্ম্’
‘তুমি আমার সাথে দেশে যাবা, শায়লা?
‘দেশে?’ ছোট্ট শব্দটা একটা প্রশ্নের ভার নিয়ে কেমন প্রতিধ্বনি তোলে বাতাসে।
‘হ্যাঁ, দেশে। যাবা?’
ওপাশে হাল্কা শ্বাসের শব্দ শোনা যায়, ‘থ্যাংক্স’
‘মানে?’
‘কিছু না’
‘আমি বুঝি নাই’
‘বোঝার কিছু নাই তো’
‘যাবা না?’
‘না’ ছোট্ট, অথচ ভীষণ দৃঢ়।
‘কেন?’
‘বাদ দাও না। অন্য কথা বল।’
‘চাওনা যেতে?’
‘না।’
‘প্রব্লেমটা কী?’
‘আমার মেয়েরা।’
‘ওরাও যাবে’
‘সেটা হয়না।’
‘কেন?’
‘তুমি পারলেও আমি পারব না। আমি আত্মহত্যাও যদি করতে যদি যাই, রিনি মিনি ডাকলে ফিরে আসব।’
‘আত্মহত্যার কথা আসছে কেন?’
‘উলটাটাও যে সত্যি তাই।’
‘মানে?’
‘উফ্ফ্ তোমার এত মানের জবাব দিতে পারবনা। ওভেন এ পোলাও বসাইয়ে এসেছি। বাচ্চারা খেতে চেয়েছে। এতক্ষনে হয়ে গেছে। আমি যাই। পরে কথা হবে।’
পরে আর কথা হয়নি। এর পরের দু’দিন টানা ফোন করেছে অনীক; ও ধরেনি। চারদিন পর শায়লার একটা তিন লাইনের টেক্সট পেল ও, ‘মাই হাসব্যান্ড হ্যাজ্কাম। মাই কিড্স আর সো হ্যাপী। সো হ্যাপী।’
পরপর কয়েকটা রাত ফ্রক পরা বিনুনী করা একটা কৈশোর ছুঁই ছুঁই মেয়েকে স্বপ্ন দেখল অনীক। চেহারাটা ভীষণ মায়াময়। মধ্যরাতে ঘুম ছিঁড়ে যেত ওর। বাইরে গাঢ় কালো রাত।
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
লেখক পরিচিতি
রাজিব মাহমুদ
পুরো নাম মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। জন্ম ঢাকায়। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। ফুলব্রাইট স্কলার। পড়াশোনা ও শিক্ষকতা ঢাকা, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে। লেখেন মূলত গল্প ও কবিতা। পাশাপশি অনুবাদও করে থাকেন। সম্প্রতি যুবান বুকস থেকে বেরুনো অনুবাদ গ্রন্থ ‘অফ দ্য নেশান বর্ণ’-এ তার চারটি অনুবাদ কর্ম অন্তর্ভূক্ত।
এই মার্কিন মুলুকের সন্ধ্যের আঁধারটাও যেন বড় অচেনা। রাত-জাগা ঘুটঘুটে ভোরগুলোতে অনীক ওর মা’কে ফোন করে ডানকিন ডোনাটসের পানসে কুসুম-রঙা আলো ছড়ানো কাস্টোমার কিউ থেকে। ভুল হল। কোন কিউ নেই। অনীকই প্রথম খদ্দের। না না ঐ তো আছে! অনীক দাঁড়িয়ে বাসি মুখে অর্ডার দিতে দিতে পেছনে লাইন পড়ে গ্যাছে। রাত-ভোর একাকীত্বের ভারে বিল দিতে দিতে ঘাড়ে সেলফোনটা রেখে ও খটাখট লাইন লাগায় ঢাকার একটা ঘুপচি গলির প্রথম বাড়ীটাতে। যেখানে ওর মা দুপুরের রান্না সেরে কাজের মেয়েটাকে রাতের রান্নার ফর্দ দিতে দিতে ফোন ধরেনঃ “ও বাবা তুমি দুপুরে খাইছো? ও আল্লাহ...ঠিক ঠিক তোমার ঐখানে তো এখন ভোর...
এদেশে সকালটা আসে দূরদেশে বসে অসুস্থ্ জননীর হঠাৎ আরোগ্য লাভের খবরের মত; চারপাশের বাতাস কেমন হাল্কা হয়ে চোখে ঝাপ্টা দেয়। রাতে জমে থাকা গভীর বিষাদ ছিন্নভিন্ন পালিয়ে যায়, থাকলে যেন অপমানিত হবে এই ভয়ে। আবার বলা যায় ও যেন সারারাত সমুদ্রের তলদেশে ছিল এতক্ষণ-ভুশ করে ভেসে উঠে সুর্যের আলোর ভেতর গড়িয়ে পড়ে; হাল্কা আলস্যে উঠে বসে, তছনছ হয়ে যায় অর্ধস্বচ্ছ জানালার শার্সি থেকে প্রতিসরিত আলোর রেখা।
চারপাশের সবকিছু নির্ভার বিছিয়ে থাকে এপার ওপার; শব্দ, আলো, ছোঁয়া, কান্না সবই আছে। কিন্তু এদেরকে ও ঠিক যেভাবে চিনে এসেছে এতদিন এই দূর বিদেশে সেভাবে যেন ওরা নেই। যেন ক্যালেন্ডারে আঁকা একেকটা ছবিঃ চোখ পেতে দেখা যায়, ছোঁয়াও যায় কিন্তু ঠিক ধারণ করা যায় না। থেকে থেকেই ওর নিজেকে মনে হয় একটা প্রাচীন ঘুমন্ত মাছ; যেটা জেগে উঠতে উঠতেই আচমকা নিথর হয়ে গিয়েছিলঃ চোখে আঁকা ছিল বিষ্ময়। ঠিক জানা-বোঝা কোন দুঃখ বা শোক নয়। একধরণের নিঃসাড় বিহ্বলতা।
এরকম ছায়া ছায়া সময়। দিনগুলো মেঘলা আর ফাঁকা। রাতগুলো গুমোট আর নিঃসঙ্গ। এরকমই এক রাতে অনীকের কথা হয় শায়লার সাথে। শায়লা বিবাহিতা। দুই মেয়ের মা। সেরাতে বাইরে শোঁ শোঁ তুষারঝড়। ওদের প্রথম আলাপ হয় একটা বাংলাদেশী চ্যাটরুমে। ওর প্রতিবেশী এক বিদায়ী দম্পতি অন্য স্টেটে মুভ করার আগে তাদের লেখার টেবিলটা ব্যাকইয়ার্ডে ফেলে গ্যাছে। অনীক খানিকটা ইতস্ততঃ করছিল টেবিলটা উঠিয়ে আনার ব্যাপারে। নিজেকে কেমন ভিখিরি ভিখিরি লাগছিল। এদেশে এরকম অনেক কিছুই মানুষ ফেলে যায় যেটা আবার অন্যরা তুলে নিয়ে আসে। টিভি, ফ্রীজ থেকে শুরু করে খাট, আলমারি, টেবিল কোনটাই বাদ নেই। বিশেষ করে অনীকের মত ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা এগুলোর খোঁজে থাকে বেশী যাদের সামান্য স্টাইপেন্ডের টাকায় সারা মাস চলতে হয়। শেষ পর্যন্ত দ্রুত নামা সন্ধ্যার আঁধারে পা টিপে টিপে তুলেই নিয়ে আনল টেবিলটা। ওটাতে ল্যাপটপটা রেখে চ্যাটবক্সে টাইপ করে করে শায়লার সাথে চ্যাট করেছে সারা রাত। পাশে রাখা ছিল নারকেল তেলের কৌটার গড়নের ক্যাসুনাটের বক্স, একটু দূরে একটা পেটমোটা কাপ-ভেতরে কাঁচ-স্বচ্ছ স্মির্ণ অফ;। পরিচয়ের প্রাথমিক বাক্যালাপের পর শায়লা স্বগতোক্তির মত বলে গেল-
“দেশ ছাড়লাম একটা ঘোরের মধ্যে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি এসব ভাবার আগেই সংসার শুরু করতে হল। আমার হা্জবেন্ড খুব গম্ভীর বাট সংসারের দরকারগুলোর ব্যাপারে খুব কেয়ারিং ছিল। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব কোল্ড থাকত। নিরাপদ কিন্তু নিরানন্দ কেটে গেল ৬ টা মাস। কেমন ছেঁড়াখোঁড়া। ঠিক বোঝাতে পারবনা। আমার পাশে বসে সবসময়ই ও কেমন আনমনা হয়ে থাকত। আই ট্রাইড টু লাভ হিম। ইয়েস আই ডিড...এ লট। আমি আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও যোগাযোগ অনেক কমায়ে দিলাম ওকে একটু বেশী সময় দিব বলে। কিন্তু চারপাশটায় কেমন উদ্বাস্তু লাগত নিজেকে; মনের মধ্যে তখনো দেশের ব্যাডমিন্টন-খেলা-হৈ-চৈ কমলা রোদের বিকেল, মোড়ের দোকানের ভেজাল তেলের পুরি-মোগলাই পরোটা, হঠাৎ-আসা ইলিশ বৃষ্টি... সেই চির-চেনা সবকিছুর ওপর এই আমেরিকার জীবন কেমন পুকুরের উপরে ফেনার মত ভাসতে থাকল। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। গ্রোসারি, উইকেন্ড, ক্রেডিট কার্ড, কুকিজ, ম্যাকারনি এন্ড চীজ, উইন্ডোশপিং...এসব জিভের আগায় চলে আস্ল....”
প্রায় প্রতিদিন কথা হত ওদের। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’, ‘তুমি’ থেকে আরও অতলের তুমি। নরম কবিতার বিচ্ছিন্ন পংক্তি, রিসেন্ট দ্যাখা বলিউডের একটু আর্ট আর্ট গন্ধ হিন্দি ছবি, দুপুরে রান্না করা মাছের ঝোল, উঠ্তি কোন দেশী গায়িকার ‘ভারী মিষ্টি’ গলার প্রশংসা , ঘন উষ্ণ লালা মাখা একেকটা স্পঞ্জের মত ভারী সচেতন বাক্য, গভীর রাতে অন্যজনের ফোনে ঘুম-ভাঙা ম্ম্ “হ্যালো”, ছোট্ট করে বলা ‘মিস ইউ’, হোম-মেড হট ডগ, কাঁচভাঙা হাসির চূর্ণ, কালকে-ফোন-করলানা-কেন অভিমান, পেঁয়াজ-ঝাঁজ কান্নার গমক, মান-ভাঙ্গানোর দীর্ঘ দীর্ঘ গড়ানো বাক্য...টুকরো টুকরো সবকিছুই ছিল দিনগুলোর মধ্যে। কথাই হয়ে উঠত একেকটা কঠিন-কোমল নির্মাণ; হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে উল্টেও যেত। নিভে যেত সব । কতদিন খাঁ খাঁ শূণ্যতায় ফাঁকা হয়ে গ্যাছে ঘন্টার পর ঘন্টা!
ছেঁড়াখোঁড়া অদ্ভূত মাতাল একটা সময়। নির্ভার। আবার ক্ষণে ক্ষণে খুব ভারী। এরকম...দিনের পর দিন।
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
শায়লা এক গুমোট দুপুরে বল্ল ‘চলে এসো না আমার এখানে। বেশী দূর তো না। ঘন্টা চারেকের রাস্তা।
“দেখি” এক শব্দে বলি।
“দেখে যাও আমি কীভাবে থাকি। বাচ্চাদের সাথে গল্প করে যাও। আমার সাথেও অবশ্য।” ওপাশে হাল্কা হাসির ঢেউ।
“হুম...”
অনীক ওয়েবক্যামে প্রথম যেদিন শায়লাকে দেখল, সেদিন কেমন যেন নতুন এক অনানুভূত নিঃসঙ্গতা ওর ঘাড়ের কাছে চাপ দিল; শায়লা দেখতে অনীকের প্রাইমারী স্কুলের এক মিসের মত-গোলাটে মুখ, শান্ত বিষন্ন গভীর একজোড়া চোখ, পরিপাটি বেঁধে রাখা ঘন জাম-কালো চুল। দৃষ্টিটা গভীর। ভীষণ গভীর। হাসলে কেমন করুণ দ্যাখাত। ওর ২ মেয়ে, বড়টার নাম রিনি, বয়স ৬, ছোটটার নাম মিনি, বয়স ৪, সারাক্ষণ ছুটোছুটি করতে ওর চারপাশে। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আহ্লাদ করত, ওড়না দিয়ে গাল ঘষত, ল্যাপটপের কী-বোর্ডের একটা কী চেপে দৌড় দিয়ে পাশের ঘরে চলে যেত। মনে হত একটা বিষাদবর্ণ মমিকে ঘিরে আনন্দে নাচ্ছে কিছু অন্ধ স্বপ্নভূক পাখি।
ওদের প্রথম চুমু (ফোনচুমু) খাওয়ার দিনটার কথা এখনো ওর স্মৃতিতে উষ্ণ। প্রথম উদ্যাগটা শায়লারই ছিল। চুমু খাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে অনীকের নিজেকে কেমন অচেনা মনে হয়; যেন ওর চুমু খাওয়ার ঠোঁট নেই, আবেগের যথেষ্ট যোগান নেই...ও নিজেই যেন ওর নিজের চুমু-ব্যবহারে পূর্ণবয়স্ক কোন যুবককে খুঁজে পায়নি। মনে হচ্ছিল শৈশব পেরিয়ে ও এক দৌড়ে ও পূর্ণবয়স্ক মানুষদের মিছিলে ভীড়ে গ্যাছে, আর কেন যেন মনটা খুব হা হা করছিল । ভীড়ের মধ্যে ও ওর মা কে খুঁজতে থাকে। মা অনীক অনেক বড় হয়ে হবার পরও ওর জন্য টিফিন বক্সে করে টিফিন দিয়ে দিতেন...বক্সটার ভেতরটায় কেমন পুরণো কিন্তু খুব চেনা একটা গন্ধ ছিল। ওটা যে দুপুরে হারিয়ে যায়, সেদিন মনে হচ্ছিল অনীকের আর কোনদিন টিফিন খাওয়া হবে না। কোনদিন না। কখনো না। ওর বোধহয় আর কোনদিন টিফিন পিরিওডে ক্ষুধাই পাবে না।
শায়লার কাছে ও খুব জানতে চাইত ওর ছেলেবেলার কথা, ওর বেড়ে ওঠা, ওর এ পর্যন্ত কাটিয়ে আসা জীবনটার ভেতরের গল্প । শুনতে শুনতে একেকবার ভোর হয়ে যেত। দশ বছর বয়সে শায়লার মা মারা যাওয়ার পর ওর জায়গা হয়েছিল ফুপুর বাড়ীতে। একবার প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার সময় ও অলক্ষ্যে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে। ফুপু সেদিন গাছের ডাল ভেঙ্গে প্রচন্ড মেরেছিল ওকে। পরদিন বাবা এসে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়ার সময় ও ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে উঠেছিল-‘ফুপ্পি আর করবনা ফুপ্পি...আর কক্ষনো পেশাব করবনা...’। ও বলে যেত, “বাবা চাপাস্বরে চীৎকার করে উঠেছিল ‘মা কী হয়েছে গো মা? কে মেরেছে তোমাকে?’ বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই কেমন ফাঁকা লাগছিলো সবকিছু, হঠাৎ বুঝলাম বাবা পাশে নেই। রান্নাঘর থেকে বাবার উচ্চকন্ঠ চীৎকার শুনলাম; শেষের দিকে বাবার গলা কেমন ধরে এলো বলে মনে হল। ফুপু স্থির থমথমে গলায় কি যেন বলে আবার থেমে যাচ্ছে, আবার বলছে। কানের বাইরে কেমন ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনি। এরপর হঠাৎই নিজেকে একটা চলন্ত কিছুর মধ্যে আবিষ্কার করি...বাবার ব্যবহার করা আতরের গন্ধ নাকে পাই...চোখ খুলে দেখি আমার মাথা বাবার কোলে...বাবার চশমার কাঁচ ঘোলা... আই রিয়্যালাইযড্দ্যাট আই ওয়ায গোইং হোম।”
ও ফোন রেখে ঘুমাতে গেলে অনীকের মনে পড়ে অনেক ছোটবেলায় এক মেঘলা দুপুরে ও একটা কিশোরী মেয়েকে ওদের পাশের বাড়ীর ছাদে কতদিন একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। চোখ দু’টি বিষন্ন, ভীষণ একা যেন। অনীকের ভীষণ ইচ্ছে করত ওর সাথে কথা বলতে। একেকবার ও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল যে এক দৌড়ে ওদের ছাদে উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়াবে। শেষ মুহুর্তে একটা অসম্ভব দ্বিধা ওর পা থাকে মাথা গ্রাস করে নিল। আর যাওয়া হয়নি। কখনো না।
“সময়টার কথা ভাবলে ভেতরে একটা ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠত।’ শায়লা বলল। ‘মনে হত ওটা কেমন অলক্ষ্যে বয়ে যাওয়া একটা জলের রেখা...গড়াতে গড়াতে কোথায় কতদূর পৌঁছে গ্যাছে। মাঝে মাঝে মনে হত আমার অতীতটা কোন গল্পে পড়া, আমি ওতে বিলং করিনা। আমার বর্তমানটাই যেন আমার অস্তিত্ত্ব। বিশেষ করে যখন আমার বড় মেয়েটা জন্মানোর পর ওকে ঘিরেই আমার সবকিছু যেন আস্তে আস্তে বদলে গেল। তারপর ছোটটা হওয়ার পরে তো আরো...ওদের বাবা খুব খেয়াল রাখত ওদের...হি ওয়ায অ্যান্ড ইয আ গ্রেইট ড্যাড...এটা বলতেই হবে। আমিও আস্তে আস্তে এদেশী কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম...আমার মেয়েরা, ওদের স্কুল, বইখাতা, পেন্সিল, ওভেন, লন্ড্রোমার্ট, লাইজল, বেডবাগ্স, ডিলের পিৎসা, জায়েন্ট, টুনা স্যান্ডোইচ...। এভাবে আস্তে আস্তে আমি কেমন বদলে যেতে থাকি। অতীতের অতীতটুকুতে আমাকে আর পাইনা আমি।”
কয়েকদিন পর এক ঘন বৃষ্টির রাতে শায়লা বলেছিল,
“আমার কন্জুগাল লাইফটাকে আমার একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মত মনে হয় জান... আমেরিকায় আসার পর আমার মনে হত কেমন আলগা ভাবে বেঁচে আছি। আমার হাসব্যান্ড আস্তে আস্তে কেমন পাথরের মত হয়ে যাচ্ছিল। আমার জন্য ওর সময় নাই... ভীষণ ব্যস্ত... তবে হ্যাঁ মেয়ে দুইটাকে টাইম দেয়াতে খুব রেগুলার ছিল। সারাদিন যেন একটা মেশিনের সাথে আছি এমন মনে হত।...আমার কলেজ লাইফ এ একটা ছেলে আমাকে প্রতি রাতে ফোন করত...আমি কখন কোথায় যাই কী করি কার সাথে কথা বলি সবকিছুর উপর নজরদারি করত...আমাকে বলত আমাকে বিয়ে করে পকেটে রেখে দেবে...আমি শুনে ভীষণ রেগে বলতাম ‘আমি কি ঘড়ি না কলম যে আমাকে পকেটে রেখে দেবেন? আই হেইট সাচ ন্যাকা ন্যাকা দেবদাসপনা’। আমার বিয়ের পর ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়...এখন মনে হয় ওর অভিশাপেই বোধহয় আমার জীবনটা আজ এরকম...বিলিভ মি আই ট্রাইড মাই বেস্ট টু মেক মাই হাজবেন্ড হ্যাপি...আই ট্রাইড টু ইভেন কোপ আপ উইথ হিজ ফ্রিজিডিটি...ইউ নো হি কুড নট মেক লাভ অন বেড...দিনের পর দিন আমি ওকে আগলে ধরে বসে থেকেছি...হি ইউজ্ড টু লাই অন মাই ল্যাপ লাইক এ বেইবি...কোল্ড অ্যান্ড হেল্পলেস।”
ওদের দু’জনের সাথে কথা হত যখন তখন। সকাল।দুপুর।গভীর রাত।
ছুটির দিনে গ্রোসারি করতে গেলে সবকিছু খুব অচেনা লাগত অনীকের। মনে হত এই মাল্টার খোসা-রঙের ছড়ানো রোদ, সাদা সাদা পেলব নারী-শিশুর স্বচ্ছন্দ হেঁটে যাওয়া, মাঠে ঘেমে ঘেমে খেলতে থাকা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলোর কলকাকলী...সাজানো কাঠের বাড়ীগুলোকে দু’পাশে রেখে বয়ে যাওয়া শান্ত রাস্তা এসবের ভেতরে যেন ছড়িয়ে আছে একটা অবহেলায় যাপিত জীবন...শূন্য দৃষ্টির ভেতরে ঝুলে থাকা একেকটা সো কল্ড রিয়েল ওয়ার্ল্ড ম্যাটার। এসব কোন কিছুই ছোঁয় না অনীককে। একটুও না।
ওদের কথোপকথনের সময় অনীক একটা নির্লিপ্তির মধ্যে থেকে শুনে যেত শায়লার কথা মাঝে মাঝে ‘হুম’ বা ‘তারপর’ এরকম বলে। শায়লা বলে যেত অনর্গল। ওর বিয়ের আগের জীবন। কৈশোর। শৈশব। হঠাৎ আবার গতকালে ওর বাচ্চার কোন দুষ্টামির কথা। সময়ের ল্যাপ্স থাকলেও ভেদরেখা নেই। একটা টানা বয়ান।
শায়লার একেকটা বাক্যের সাথে অনীক একেকটা জার্নি করে আসত যেন। ফুপুর বাড়ী থেকে ফিরে ও বাবার বাড়ীতে ছিল কয়েক মাস। তারপর বাবা বিয়ে করলেন। ওর সৎ মাও প্রচলিত সৎ মা-ই হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। ওর জায়গা হল প্রচন্ড রক্ষণশীল মামা-মামীর কাছে। একদিন ওর বাবার বাড়ীতে মামী নিজেই এসে ওকে বল্লেন সব গুছিয়ে নিতে। সেই ওর বাবাকে মোটামুটি একেবারে ছেড়ে আসা।
উকিল মামার গোছানো সংসারে এসে সবকিছু বদলে গেল। বাড়ীতে থেকেও বাড়ীতে নেই—এই বোধের সাথে আস্তে আস্তে ও অভ্যস্ত হয়ে গেল। মামাত ভাইটা ওর চেয়ে ৮ বছরের বড়। ভীষণ স্নেহ করত ওকে। প্রতিদিন চকলেট দেয়া থেকে শুরু করে পড়া দেখিয়ে দেয়া, মেলায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়া; মামাত ভাইটির এই স্নেহ বাড়ীর এই গুমোট পরিবেশে ওর জন্য একটা প্রতিনিয়ত স্বস্তির ছায়ার মত ছিল। মামী মাঝে মাঝে স্থির চোখে তাকিয়ে দেখতেন ওদের দিকে; উনার লম্বাটে মুখটা একটা লালাভ ছায়ার ভেতর তিরতির করে কাঁপত। কিশোরী শায়লা কেমন কাঠ হয়ে যেত সেই দৃষ্টির সীমানার ভেতর।
এক শ্রাবণের মেঘলা দুপুরে সবকিছু কেমন একটানে ছিঁড়ে গেল। খালি বাসা। মামী গেছেন তাঁর এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়। মামা কোর্টে। মামাত ভাইটি কেমন অস্থির ভাবে শায়লার ঘরে এসে পায়চারি শুরু করল। যেন সে একটা অন্ধকার গুহায় ঢুকে পড়েছে। বেরুনোর পথটা সামনেই উজ্জ্বল পড়ে রইলেও ভেতরের অন্ধকার তাকে কেমন জড়িয়ে ধরে। বাইরের টানটান বিকট সূর্যের আলো যেন ওকে অন্ধকারের কোমল অস্থি থেকে টেনে বের করে এনে গাছে ঝুলিয়ে ঠা ঠা হেসে ওঠে।
ভাইটা হঠাৎই পেছন থেকে এসে ওর চুলে হাত বোলাতে থাকে। ওকে আপুনি বলে ডাকত। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, “আপুনি কি করিস?” শায়লা স্কুলের বাড়ীর কাজ করছিল। খাতা থেকে মুখ না তুলে উত্তর দিল, “হোমওয়ার্ক করি ভাইয়া। সন্ধ্যায় আজকে ঝুমিদের বাড়ীতে যাব। ওর বড় আপুকে দেখতে আসবে। তাই এখনি শেষ করে রাখছি সব” সেই দুপুরে মামাতো ভাই যখন ওর বিনুনি টেনে, গাল টিপে সবসময় যেরকম আদর করে সেরকম করছিল...তখন ও আর কিছু ভাবতে পারেনি, আসলে ভাবতে শেখেনি।
...হঠাৎই কয়েকটা মুহুর্ত কেমন জোর করে ঠেলে ঢুকে পড়ে ওই দীর্ঘ ছড়ানো দুপুরটার মধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করে; ফ্রকের ঝালরে ঢেকে যাওয়া মামাত ভাইয়ের মুখটা আর দেখতে পায়না। শুধু বোঝে ওর সাদা ফ্রক ভিজে উঠেছে ভাইটির নোনা ঘামের স্রোতে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল ভাইয়ার স্নেহ-ঝরা দৃষ্টিটা এক পলকের জন্য দ্যাখে। কিন্তু ও ভীষণ একটা অস্পষ্ট ভয়ে নিশ্চল হয়ে যায়ঃ ভাইয়া এমন করছে কেন? বাইরে আকাশটা কেমন কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছিল। ঘরটা অদ্ভুত ছায়া ছায়া আর চারপাশটা গলা চেপে বসা তীব্র ফোঁস ফোঁস আওয়াজে ডুবে যাচ্ছে যেন। বাইরের বাতাসের গন্ধটা কেমন বদলে যেতে থাকে। ভেজা দমকা মাতাস প্রথমে ২-৩-৪-৫ টা পৃষ্ঠা উড়িয়ে পুরো অংক খাতাটাই উড়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে ওর পাশে। অস্পষ্ট খামচে ধরা অন্ধকারে ভীষণ ঘর্মাক্ত একটা মুখ দেখে ও। মানুষটার এরকম মুখ তাকে ওর কাছে একটানে অচেনা করে দেয়; বন্য কিন্তু অসহায়; লম্বা কালো শরীরটা নিয়ে গোঁ গোঁ করে কিশোরী বোনকে সাপটে ধরে ওর বুকের উপর কান্নার মত শব্দ করে মুখ লুকালো। অনেক রক্ত গিয়েছিলো সেদিন। মেঝে পাপোশে মাখামাখি। কিছুক্ষণ পর ভাইটা যখন উঠে দাঁড়াল, ভীষণ শান্ত লাগছিলো তাকে। দৃষ্টিটা কেমন মরা মাছের মত। ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতায় ঘাম নিয়ে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড। তার পরপরই ছুটে বেরিরে গিয়েছিলো
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
আজ সেই মামাত ভাইটার লিভারে ক্যান্সার । দেশের একটা সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। মামা মারা গেছেন বহুদিন। মামী শয্যাশায়ী। মামাত ভাইয়ের চিকিৎসার খরচের প্রায় পুরোটাই স্বামীকে বলে মাসে মাসে শায়লা পাঠায় এখান থেকে। ওর স্বামী আইন ব্যাবসা করে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। এখন এক বছরের জন্য গেছেন ইউকে তে একটা ট্রেনিং এ। শায়লা সংসার এখন ওর ২ মেয়েকে নিয়ে।
“ঐ ঘটনার পর মামা কাউকে কিছু বল্লেন না। আমাকে জড়ায়ে ধরে অনেক্ষন কাঁদলেন মামা। এরপর আমাকে নিয়ে জেলা সদরের একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । ছেলেকে ঢাকার কলেজে ভর্তি করে দিলেন। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসলে মামা আমাকে আগে থেকে বাড়ীতে এনে রাখতেন। আমি বাবাকে কোন দিন বলিনি কিছু। কেমন নীরব আর বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাছে আর কিছুই স্বাভাবিক লাগত না তখন থেকে। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে জেগে উঠে পানি পানি বলে চীৎকার করতাম। মনে হত আমি একটা মাটির বাক্সে বন্দী হয়ে আছি...এখনি দরজা খুলে একটা লম্বা কালো লোক ঢুকবে আর আমাকে সাপটে ধরে দরদর করে ঘামতে থাকবে...আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি এরকম শত শত রাত কাটিয়েছি দুঃস্বপ্নের ঘোরের মধ্যে...আমার ম্যারেড লাইফ এ আমার হাজবেন্ড যখন রাতের পর রাত অনেক্ষন চেষ্টা করে এলায়ে পড়ে ঘুমায়ে যেত...আমার শরীর কুলকুল করে ঘামত।...সে যে কি কষ্ট...তোমাকে বোঝাতে পারব না...বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে আমি স্বপ্নে আমার মামাত ভাইকে দেখতাম...কী এক অদ্ভূত বন্য আদরে আমাকে এঁফোড়-ওঁফোড় করে দিচ্ছে...উফ্ফ্আমাকে একটু আদর কর না প্লীজ...একটু আদর কর...আর পারিনা...”
কৈশোর-যৌবনের মাঝামাঝিতে আবিষ্কৃত একটা ভাঙ্গা সাঁকো ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই সময়টার ভেতরে সময়ের ভাঁজ গলে গড়িয়ে পড়ে অনীক। মনে পড়ে সেই ভাঙ্গা সাঁকো পার হতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গিয়ে সাঁতার না জানা একটা গোলগাল পোকার মত কী ভীষণ অকুল পাথারে পড়েছিল ও। সেই রাতে অনীক একটুও ঘুমাতে পারিনি। পরদিন সকালে আগের রাতের আঠালো ঘুম শীতকালে জমে জাওয়া একতাল গ্লু এর মত তখনো সাপ্টে ধরে আছে ওর সমস্ত চেতনা। সকালে নাস্তার টেবিলে আস্ত ডিমের কুসুমটা মুখে পুরে মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল আগের সন্ধ্যায় গাউসিয়া মার্কেটে দ্যাখা এক মাঝবয়েসী গৃহবধুর স্তনের ভাঁজ । চারপাশের রকমারি আলোর ভেতর নিজেকে মনে হচ্ছিল ভয়ংকর এক কিলবিলে কীট যে নারীর স্বপ্ন-নরম স্নিগ্ধতায় বিহ্ববল না হয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছে এক আদিম শরীরী কামনায়...রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসহ্য বাসনার গলিত আগুন। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ঐরকম আরেকজন মহিলাকে দেখে সকালের চাপা পড়া কামনা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ওর। বাড়ীতে ফিরে বাবার ডিস্পেন্সারীর পেছনের অন্ধকার ঘরের তেল চিটচিটে বালিশের ওপর শুয়ে মনের পর্দায় ঐ মহিলার সারস-সাদা বুকের ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়েছিল ও—তীব্র সুখের গণগণে জ্বালা কুসুম কুসুম বেরিয়ে আসে। দেহটা নুয়ে পড়লে দেখি ভদ্রমহিলা কেমন পবিত্র একটা হাসি হাসেন। অনীক নিজের চুল খামচে ধরে ... “কী করলাম এটা কী করলাম...আমি নরকের কীট...আমি অমানুষ!”
রাত-জাগা কথোপকথনের এক রাতে শায়লা আর অনীক ঘন কাল্পনিক স্পর্শে বুঁদ হয়ে একটা উষ্ণ চোরাস্রোতে ভেসে যায়...প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর সেই অনিবার্য অসহায় গণগণে অগ্নিকুন্ডে।
পরদিন সকালে শায়লা অনেক্ষন পরে ফোন ধরে, “হ্যালো”
“ব্যস্ত তুমি? এতক্ষন পরে ধরলা যে?”
ওপাশে নীরব। কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর শোনা গেল, ‘না... ব্যস্ত না’
‘কিছু ভাবছ?’
‘ম্ ম্ ম্...নাহ’
‘ভাবছ একটা কিছু। বলে ফেল কী ভাবছ’
‘নিজের অজান্তেই কালকে কেমন উইন্ডোশপিং করে ফেল্লাম, তাই ভাবছি’
অনীক দপ করে নিভে যায়। ভেতরের আলো, মায়া, স্তব্ধতা কেমন অবশ গলে গলে পড়তে থাকে। অস্ফুটে বলে, ‘স্যরি’
‘তুমি স্যরি বলছ কেন?’
‘আই থিঙ্ক আই শুড’
‘নো, ইউ শুড নট। আমি ইদানীং একটা কথা ভাবি জান...জীবনে কেউ ভালোবাসল না আমাকে...’
অনীক চুপ করে নিঃসাড় শুনে যায়। কিছু বলে না । একটা অব্যয়ধ্বনিও না।
‘কী বোকা আমি, না!! আমি ভাবলাম তুমি বলবা যে তুমি আমাকে ভালোবাস...হা হা হা... তবে আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিলো।’
বেহালার চাবি টাইট দিতে দিতে হঠাৎই যেন মন ভেঙ্গে দিয়ে সবচেয়ে সূক্ষ তারটা ছিড়ে যায়।
‘তাই?’
‘হুম্ম্’
‘তুমি আমার সাথে দেশে যাবা, শায়লা?
‘দেশে?’ ছোট্ট শব্দটা একটা প্রশ্নের ভার নিয়ে কেমন প্রতিধ্বনি তোলে বাতাসে।
‘হ্যাঁ, দেশে। যাবা?’
ওপাশে হাল্কা শ্বাসের শব্দ শোনা যায়, ‘থ্যাংক্স’
‘মানে?’
‘কিছু না’
‘আমি বুঝি নাই’
‘বোঝার কিছু নাই তো’
‘যাবা না?’
‘না’ ছোট্ট, অথচ ভীষণ দৃঢ়।
‘কেন?’
‘বাদ দাও না। অন্য কথা বল।’
‘চাওনা যেতে?’
‘না।’
‘প্রব্লেমটা কী?’
‘আমার মেয়েরা।’
‘ওরাও যাবে’
‘সেটা হয়না।’
‘কেন?’
‘তুমি পারলেও আমি পারব না। আমি আত্মহত্যাও যদি করতে যদি যাই, রিনি মিনি ডাকলে ফিরে আসব।’
‘আত্মহত্যার কথা আসছে কেন?’
‘উলটাটাও যে সত্যি তাই।’
‘মানে?’
‘উফ্ফ্ তোমার এত মানের জবাব দিতে পারবনা। ওভেন এ পোলাও বসাইয়ে এসেছি। বাচ্চারা খেতে চেয়েছে। এতক্ষনে হয়ে গেছে। আমি যাই। পরে কথা হবে।’
পরে আর কথা হয়নি। এর পরের দু’দিন টানা ফোন করেছে অনীক; ও ধরেনি। চারদিন পর শায়লার একটা তিন লাইনের টেক্সট পেল ও, ‘মাই হাসব্যান্ড হ্যাজ্কাম। মাই কিড্স আর সো হ্যাপী। সো হ্যাপী।’
পরপর কয়েকটা রাত ফ্রক পরা বিনুনী করা একটা কৈশোর ছুঁই ছুঁই মেয়েকে স্বপ্ন দেখল অনীক। চেহারাটা ভীষণ মায়াময়। মধ্যরাতে ঘুম ছিঁড়ে যেত ওর। বাইরে গাঢ় কালো রাত।
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
লেখক পরিচিতি
রাজিব মাহমুদ
পুরো নাম মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। জন্ম ঢাকায়। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। ফুলব্রাইট স্কলার। পড়াশোনা ও শিক্ষকতা ঢাকা, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে। লেখেন মূলত গল্প ও কবিতা। পাশাপশি অনুবাদও করে থাকেন। সম্প্রতি যুবান বুকস থেকে বেরুনো অনুবাদ গ্রন্থ ‘অফ দ্য নেশান বর্ণ’-এ তার চারটি অনুবাদ কর্ম অন্তর্ভূক্ত।
2 মন্তব্যসমূহ
গল্পের শেষে যেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল, এখানে লেখক সার্থক। খুব ভালো লাগলো। প্রথম পড়ছি আপনার গল্প। শুভ কামনা।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ পাঠ ও মন্তব্যের জন্য। শেষটা লিখতে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে। ধন্যবাদ আবারও।
মুছুন