মোহছেনা ঝর্ণা'এর গল্প : দোলাচল

কাঠবিড়ালি দুইটা অনেক্ষণ ধরেই জলপাই গাছের ডাল পেঁচিয়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করা হলুদ রঙা ফুলের পাশ কাটিয়ে সবুজের রঙ ছড়ানো কচি ঝিঙাটার অর্ধেকটাই খেয়ে ফেলেছে। আর তিনতলার বারান্দায় বসে দৃশ্যটার প্রথম থেকেই দর্শক হয়েছিল মুহিত।মেঘলা মেঘলা শান্ত একটা পরিবেশ এখন। যেন অনেক যুদ্ধের পর বেশ খানিকটা নিরবতা।গতকাল রাত থেকে ভোর পর্যন্ত অঝোর ধারায় কেঁদেছে আকাশ।এই বিকালেও সে কান্নার দমক থেকে বের হতে পারেনি বলেই হয়তো সব কিছু থমথমে হয়ে আছে। 

ইদানীং মুহিত দুনিয়াবি চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন এক জগতে ডুব দেয়ার চেষ্টায় মত্ত।প্রায় ভাবে যে কোনোদিন হয়তো চাকরিটা ছেড়ে দিবে। এই চাকরিটার পেছনে যে সময় তাকে দিতে হয় সে সময় যদি নতুন জগতে নিজেকে অভ্যস্ত করানোর জন্য দেয়া যেত তবে নিশ্চিত দিনশেষে সমস্ত ভব যন্ত্রণা থেকে খুব সহজেই মুক্তি পাওয়া যেত।

বাসার সবাই মুহিতকে আড় চোখে দেখে। এই ছেলের কি হয়েছে, সে কি সমস্যায় জড়িয়ে পড়ল কি না, তার চলাফেরায় উদাসীন ভাব কারো চোখ এড়ায় না। সে টিভি দেখতে খুব পছন্দ করত। আর এজন্য এক বছরের ইনসেন্টিভ এর টাকা দিয়ে সে বসার ঘরের জন্য ৪২ ইঞ্চি স্ক্রিন এর একটা এলইডি টিভি কিনল।অথচ কি আশ্চর্য গত বেশ কিছুদিন যাবত সে টিভি দেখছে না।অফিস থেকে ফিরেও খুব একটা গল্প-গুজবে সময় নষ্ট করছে না।

মুহিতের বড় ভাই মারুফ একদিন কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেনি, কারণ তার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় হলেও অসংলগ্ন কিছু কারো দৃষ্টি গোচর হয়নি।

মুহিতের মা রিজিয়া পারভীন আর ধৈর্য্য রাখতে পারেন না।তার মনে হয় ছেলে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে উদাসীন হয়নি তো! আবার মনে হয় প্রেমে পড়লে তো উৎফুল্ল থাকার কথা। অফিসে কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল না তো! আহারে! নিশ্চয়, বসের আচরণে মনে কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না। নাকি বন্ধুদের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে মতানৈক্য হলো। কত কথা ভেবে যান রিজিয়া পারভীন, কিন্তু নিজেই আবার কোনো সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারেন না।

রিজিয়া পারভীনের আবার মনে হয়, সব সমস্যা মুহিতের ঘরটা কেন্দ্র করে। ঘরের ভেতরে ঢুকলে এ ছেলে আর বের হতে চায় না। আগে প্রায় সময় ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া ছাড়াও মাঝে মাঝে মাকে নিয়ে বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে খেতে যেত, সুমদ্র দেখতে যেত, সমুদ্র দেখতে দেখতে বলত মা তোমার মনের ভেতরে এমন কোনো ইচ্ছা কি এখনো লুকিয়ে আছে যা তুমি কাউকে বলনি পূরণ করতে না পারার বেদনায়। রিজিয়া পারভীন হাসতে হাসতে বলতেন, হ্যা, রে বাবা, তোর বউ দেখার ইচ্ছা তো এখনো পূরণ হলো না।

মুহিতও মায়ের সাথে হাসতে হাসতে বলত, সে ইচ্ছা আপাতত পূরণ হবে না।অন্য কোনো ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো।

রিজিয়া পারভীন এখন ভাবেন, ছেলেকে কি তাকে এ প্রশ্নের মাধ্যমে কোনো ক্লু দিতে চেয়েছিল, তার সমস্যা সম্পর্কে। তিনি ঠিক করেন আজ মুহিত অফিস থেকে এলে তিনি অবশ্যই তার রুমে ঢুকবেন। সে বাসায় না থাকলে তার রুমে ঢুকার উপায় নাই, কারণ বেশ কিছুদিন হলো সে বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় তার রুমের দরজা লক করে যায়।

সন্ধ্যার পর বাসায় এসে মুহিত যথারীতি কিছুক্ষণ বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারটায় বসে। আজ মনে হচ্ছে পূর্ণিমা। আকাশে বড় গোল আয়নার মতো একটা চাঁদ। তারপর ডুবে যায় তার নিজের জগতে। এ জগতে যখন সে ডুব দেয় প্রতিবারই তার মনে হয়, হায় হায় সে এতদিন কোথায় ছিল? টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের মনের চাহিদাকে এভাবে পায়ে মাড়ানোর জন্য যথেষ্ট আফসোস হচ্ছে এখন তার। বারবার মনে হচ্ছে নিজের মনের চাহিদা অপূর্ণ রেখেই হয়তো একদিন দম ফুরিয়ে ঠুস হয়ে যেতে হবে।

আহা! এ জীবনে কেউ কারো নয়। তবু কি মিছে বিভ্রম! বারবার মনের ভেতরে আকুপাকু করে তারাশংকর, হায় জীবন এত ছোট কেনে?

মুহিতের মা, রিজিয়া পারভীন মুহিতের দরজায় টোকা দেয়। দরজায় টোকা দেয়ার শব্দে মুহিত বুঝতে পারে , দরজার ওপাশে এখন শুধু মা নামক এক ফলদ বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। মাকে সব সময় তার ফলদ বৃক্ষের মতো মনে হয়। আলো দেয়, ছায়া দেয়, ফুল দেয়, ফল দেয়, আর আমরা পথিক হেঁটে যাওয়ার সময় কত নির্দয় ভাবে এমনি এমনি গাছের একটা পাতা ছিঁড়ে ফেলি, ডাল ভেঙ্গে হাতে নিয়ে ঘুরি, হাতের নিড়ানি দিয়ে গাছের ছাল তুলে ফেলি। অথচ গাছ কিন্তু গর্জে ওঠে না। হুংকার ছাড়ে না। শুধু গা থেকে দু:খগুলো সাদা সাদা আঠালো কষ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

মাও তো একটা গাছ।

যেদিন মেজো ভাবি ইশারা ইংগিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছে মা, একা মানুষ, এত বড় একটা বেডরুম দখল করে আছে তার চেয়ে তিনি সেটা ছেড়ে যদি লিভিংরুমটা ব্যবহার করতেন তাহলে তার আর বড় ভাবীর দুইমেয়েকে একটা রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয় না।
রিজিয়া পারভীন মানুষ হিসেবে এত বোকা নন যে তিনি পুত্রবধূ'র স্পষ্ট ইশারা ধরতে পারবেন না।কিন্তু সংসার নামক এই রংগশালা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে মাঝে মাঝে অন্ধ এবং বধির হয়ে থাকার ভান করতে হয়। এই ভান অবশ্য তিনি বহু বছর আগে থেকে করা শুরু করেছেন।

মুহিত মায়ের এই অভিনয় প্রতিভায় বরাবরই মুগ্ধ ছিল। তবে ফলদ বৃক্ষের মতো মায়ের চোখ থেকে যখন সাদা সাদা কষের মতো দু:খ ঝরে যায় তখন তার মনে হয় একটা জীবন নিজের মতো করে কাটানোর সুযোগ অন্যদের অহেতুক চাপে পড়ে বিসর্জন দেয়ার কোনো মানে হয় না।হুম,তারপর থেকেই সে নিজের জন্য নদী না হলেও একটা পুকুর খোড়ার ব্যবস্থা করতে থাকে। যেখানে সে ডুব দিয়ে থাকবে।

অনেকদিন পর রিজিয়া পারভীন মুহিতের ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকেই রিজিয়া পারভীনের চক্ষুচড়ক গাছ।বিছানাটা ছাড়া মুহিতের ঘরের প্রতিটা জায়গায় কেবল বই আর বই।

রিজিয়া পারভীন বলেন,এত বই কখন কিনেছিস? কখন পড়বি এত বই? আর এত বই পড়েই বা কি হবে?

মার কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠে মুহিত। তারপর বলে ঠিক বলেছ মা, এত বই পড়ে কিছু হয় না, হয় শুধু মাথা নষ্ট।দেখছ না আমার মাথাটা কেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আমার কিছু ভালো লাগে না। মা জানো বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকলে ভব যন্ত্রণা এড়ানো যায়।

রিজিয়া পারভীন কোমল গলায় বলে, তোর কিসের এত যন্ত্রণা বাবা? মাকে বল।মা সব ঠিক করে দিব।

মুহিত আবারো হা হা করে হেসে উঠে বলে, জানো মা গতকাল একটা বই পড়েছি। বিদেশী লেখকের অনুবাদের বই।লেখকের নাম ফ্রানৎস কাফকা। একটা মানুষ সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে দেখে সে পোকা হয়ে গেছে।

রিজিয়া পারভীন অবাক হয়ে বলে, কি বলছিস, তাও আবার হয় নাকি?

মুহিত বলছে, আহা! শোনো না মা, যে মানুষটা পোকা হয়ে গেছে সে তার পরিবারের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিল। সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটার এমন রূপান্তরে মুষড়ে পড়ে পুরো পরিবারটা। তারা তাদের ছেলেকে সারিয়ে তোলার আশা নিয়ে এক একটা কষ্টকর দিন পার করে। কিন্তু যখন দেখল পোকা রূপী তাদের ছেলেটা তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে তখন ধীরে ধীরে তারা অতিষ্ট হতে থাকল।একটা সময় তাদের অবহেলা, অবজ্ঞা কিংবা নেহায়েত স্বল্প আয়ু থাকা পোকাটি যখন মারা যায় (এ মরে যাওয়াটা অনেকটা ইচ্ছামৃত্যু্র মতো, অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া), পরিবারটি এক রকম হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।কি নির্মম তাই না মা? মানুষ নিজেও জানে না সে কখন কার ভালোবাসায় বাঁচে আবার কখন কার অবহেলায় বাঁচে।

রিজিয়া পারভীন, ছেলের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।

মুহিত মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই,অভিনয়ের জীবন আমার ভালো লাগে না। আমি তোমার জন্য বাঁচতে চাই মা। আমার মায়ের জন্য। যে মা শুধু আমাদের জন্য মেনে নিয়েছিল অনেক কিছু।অনেক লুকানো বেদনা। এমনকি স্বামীর বহুগামী চরিত্রও।

রিজিয়া পারভীনের চোখ গলে দু’ফোঁটা পানি পড়ে মুহিতের চুলে।



মুহিত মায়ের কোলে মাথা রেখেই বিড়বিড় করে বলে যায়, আমি ভালো আছি মা, আমার এ ছোট্ট জীবনে আমাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকতে হয় না। মনের মধ্যে গভীর আক্রোশ, গভীর বেদনা লুকিয়ে আমাকে সুখী মানুষের অভিনয় করতে হয় না। ঐ অপরূপ টালমাতাল জোৎস্নার আলো দেখতে দেখতে চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠা অশ্রু গোপনে মুছতে হয় না মা। আমি ভালো আছি মা। আমি এভাবেই ভালো থাকতে চাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ