ইশরাত তানিয়া'র গল্প : ফাকআপ নাইটস্‌

একটু একটু জল জমে ভেতরের অজানা কিছু ভেসে ওঠে। জানা হয়ে গেলে তারপর নৈঃশব্দ। পুকুরে খালি কলসী ডুগ ডুগ করে ডুবে বুদবুদ ছড়িয়ে কানায় কানায় ভরে উঠলে, একটানে যেভাবে কাঁখে তুলে নেয় গাঁয়ের মেয়ে, ভাবনা থেকে তেমনি নিজেকে তুলে নিল কেউ। ভাবনাগুলো না-ভাবনার মতোই। পঞ্চাশ ওয়াটের যথেষ্ট আলোয় স্নানঘরে একটু আগের পুরুষ গন্ধটি ডলে ডলে মুছে ফেলছে সে আর ভাবছে ভার্জিনিয়া উলফ যে প্রশ্ন ভেবেছিল- ইজ দিস লাইফ?


যদিও উচ্চ-মধ্যবিত্ত মেয়েটি ভার্জিনিয়া উলফ নামের কাউকে জানত না। তাই ‘এই কি শুধু জীবন?’ এটি শেষ পর্যন্ত দার্শনিক মতবাদ হয়ে ওঠে না। একটি ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা হয়ে মাকড়সার জালের মতোই প্রায় অদৃশ্য ঝুলে থাকে। এ ভাবনার হলেও-হতে-পারত যথার্থতা বডি ওয়াশের জাদু বুদবুদের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। শুধু সুবাসটুকু ভাসে শাওয়ার থেকে ছুঁড়ে দেয়া জলের ধোঁয়া ধোঁয়া মিহি কণায়। স্নানঘরের বদ্ধ বাতাসে। বিশাল আয়নার পাশে থরে বিথরে সাজিয়ে রাখা বিচিত্র রঙের আর সুরভীর অর্গ্যানিক শাওয়ার জেল। এ্যরোমা থেরাপি, সেন্সুয়াল, এ্যাবসোলিউট রিল্যাক্স...

মরোক্কান গোলাপ, এসেনশিয়াল অয়েল আর জিনসেং নির্যাসের মুহুর্মুহু সুগন্ধে, লুফাঘষা ফেনাগুলো দেহচ্যুত হয়ে টাইলসের মেঝেতে নামে। জলের বুকে লেজের ঝাপটা মেরে বিপরীত দিকে যায়। দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে মতিস্থির করতে সময় নেয়। এরই মধ্যে মেয়েটি মসৃণ পা দিয়ে ঠেলে কিছুটা এগিয়ে দিলে, ধূসর ফেনা আবার ঠিকঠাক পথে ফিরে যায়।

সতেজ মানি প্ল্যান্টের তীব্র সবুজ পাতার আড়ালে দৃশ্যটুকু দেখছে হৃষ্টপুষ্ট টিকটিকি। বেসিনের আয়নায় ওপরের ডান কোণে তার গতকালের সাদাকালো মল লেপ্টে শুকিয়ে আছে।

পুরুষটির চোখ আটকে আছে টিভির ফ্ল্যাট স্ক্রীনে। দেখছে ‘ফাকআপ নাইটস্‌ শো, নিউইয়র্ক’। ব্যর্থতার রাত। ব্যবসা করতে গিয়ে যারা বিফল হয়েছে, একে একে তারা শোনাচ্ছে ব্যর্থতার নিজস্ব কাহিনী। বিভিন্ন দেশের শহরে প্রোগ্রামটি হয়। স্পন্সর করেছে বহুজাতিক কোম্প্যানী। টিআরপি বলছে জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু ছুঁতে যাচ্ছে অনুষ্ঠানটি। বেশ ক’বছর ধরে সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে পুরুষটির কয়েক পেগ মদ্যপান অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। জ্যাক ড্যানিয়েলে দুটো আইস কিউব ভাসছে। পেগ বড় করে বানিয়েছে পুরুষটি। জ্যাপিং করল। অন্য চ্যানেলগুলোতে দেখার মতো কিছু না পেয়ে আগের চ্যানেলে ফিরে হুইস্কিতে চুমুক দিল আর বীফ স্টেক কেটে এক টুকরো মুখে পুরল। সাথে ম্যাশ পটেটো।

ঘষে ঘষে মেয়েটির গমরঙা চামড়ার এক পরত উঠে গেলে তার মনে হয় এবার কেউ থামতে বলুক। কোনো গায়েবী আওয়াজের ধ্বনি কিংবা প্রতিধ্বনি নেই। ঘিনঘিনে ভাব কমে এলে নিস্তব্ধ হাত শাওয়ারের কলে। অবিরাম সে ভিজতেই থাকে এক রঙা ৫ ফুট বাই ৪ ফুট স্নানঘরে। মেয়েটি হাসছে। নরম আঙুলের ছোঁয়ায় একটি একটি জোনাকির পায়ে সে জোছনা মেখে দেয়। শরীর থেকে এক ঝাঁক শিহরিত জোনাকি ওড়ে। সমস্ত কদম ফুটিয়ে, ভরা গাছ হয়ে সে শ্রাবণ করা জলে তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। জলের তোড়ে তার গা উজ্জ্বল সোনালী আভা ছড়ায়। মেয়েটি এখন কাঁদছে।

সফলতার গল্প শুনে যারা ক্লান্ত, তারা জেনে নিচ্ছে ব্যর্থ হবার গল্পগুলো। গোলগাল দুনিয়া ঘুরছে উল্টো। এরর এন ট্রায়াল এ্যপ্রোচ। এনাফ ‘বাউট সাকসেস। ব্যর্থতারও অবসর নেই। প্রতি অনুষ্ঠানে শত শত লোক আসছে ব্যর্থ প্রজেক্টের গল্প শুনতে। বক্তা হিসেবে থাকেন তিন থেকে চার জন উদ্যোক্তা। প্রত্যেকের বরাদ্দ সাত মিনিট। তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যর্থতার গল্পের পর শুরু হবে প্রশ্নোত্তর পর্ব।

খাটের ওপর খুলে রাখা নেভী ব্লু শর্টস আর ফুশিয়া রঙা স্ল্যাকস জানে সপ্তাহান্তের কাকুতি-মিনতি। পীড়াপীড়ি। এক একটি বরফ শীতল অধ্যায় পুরুষটি লেখে ধ্বংসস্তুপের প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরের ভাঙা টুকরোর ওপর। এতটা বিতৃষ্ণা! সে জানে না কবে এক বিশাল পাহাড় দাঁড়িয়েছে দুজনের মাঝখানে। সরু হয়ে আসা দাম্পত্য পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছতে পারে না। অনতিক্রম্য সে পাহাড় একটু একটু করে আরও দুর্গম।

প্রতিবার মেয়েটির সাথে যুদ্ধে সে বিজয়ী অথচ পরাজয়ের খোঁয়ারি সারা শরীর পেঁচিয়ে চেপে বসে থাকে। চূড়ান্ত নৈকট্যের মুহূর্তে মেয়েটি বিস্ময়কর দূরত্বে নিজেকে স্থাপন করে। তার চোখ তখন আলো আঁধারে অস্পষ্ট অতীতে কিংবা আশাহীন ভবিষ্যতে। দুজনের কারো পক্ষেই যা অতিক্রমসাধ্য নয়। ‘ফেইলিয়ার স্টোরিজ’- স্বগতোক্তি করে পুরুষটি। উপায়হীন হাতের গ্লাস নামিয়ে রাখে আক্রোষে। সেটি বোঝা গেল গ্লাস আর টেবলের সাংঘর্ষিক জোরাল ‘ঠক’ শব্দে। টেবলের ওপর ময়ুরের পালক রাখা। সেখানে নীল সবুজের নানান শেডের সিল্কি সম্মিলন। কেউ বলেছিল- ঘরে ময়ূরের পালক রাখলে টিকটিকি থাকে না। আপাত নিরীহ সরীসৃপ জাতীয় একটি টিকটিকি বীরদর্পে হাঁটে মেয়েটির শরীরে আর পূর্ন ঘৃণার ডাস্টবিন হয়ে উপচে পড়ে। একটি ঘিনঘিন ছিনছিন অনুভূতি তাকে মর্মান্তিকভাবে ঘিরে ধরে। শরীরের প্রতিটি রোমকূপে সুঁই ফুটিয়ে দেয়।

সত্যিকারের কথাগুলো তাদের মধ্যে কখনও হয়ে ওঠেনি। শুধু সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতির ব্যালেন্স শীট তৈরী হয়েছে। বলা হয়েছে যা দরকার বা দরকার নয়, যেমন- এবারের বিবাহ বার্ষিকীর অতিথি তালিকায় কারা থাকছে বা থাকছে না। এসএমএসে লিখেছে- চাল আর কফি বাড়ন্ত। এসব কথাই হয়েছে অথচ জীবনের জরুরী কথাগুলো বলার সময় হয়নি। আসলে বলার ইচ্ছে হয় না কারো। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায় অর্থহীন। ক্রমশ শরীর থেকে হাত-পা দূরে সরে যায় অনায়াসে। তবু দুজনের কিছুই এসে যায় না। ওদের দেরি হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি।

অনুষ্ঠানটি শেষ হলেও টেলিভিশন চলতে থাকে। পুরুষটি উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটির জন্য চিকেন তান্দুরী আভেনে ঢুকিয়ে ৩ মিনিট সময় নির্ধারণ করে। তারপর শোবার ঘরে ফিরে আসে। ডান হাতের তর্জনী বাঁকা করে আঙুলের উল্টো পিঠ ঠেকায় লাগোয়া স্নানঘরের দরজায়।

নক নক শব্দ হলে সোনালী ফুল ঝরিয়ে গাছটি ফের মেয়ে হয়ে যায়। ততক্ষণে পাতা কুড়োনির মতো সে জড়ো করেছে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া তার সমস্তটা। মানিপ্ল্যান্টের আড়ালে দৃশ্যটুকু নিঃশব্দে দেখে টিকটিকি। লেজ বার বার কেঁপে উঠলে সামনের এক হাত সামান্য এগোয়। চিকন হাতে সূক্ষ্ম পাঁচটি আঙুল। আঙুলের ধারাল সাদা মিহি নখ আঁকড়ে ধরেছে দেয়ালের অফ হোয়াইট টাইলস্‌। তার সবুজস্বচ্ছ গোল চোখের ভেতর মেয়েটি একটি ছোট পোকার ছায়া হয়ে প্রতিফলিত।

দরজা খুলে দিলে, বাথরোব পেরিয়ে সুগঠিত দুটো পা। পায়ের ত্বকে হীরাচূর্ন হয়ে লেগে আছে কয়েক ফোঁটা জল ঝিকমিক। অজান্তেই বাঁ পা রাখে সে নরম পাপোষে। দৃঢ় পদক্ষেপ। পায়ের পাতা ডুবে গেলে তার মনে হয় এবার ডান পা রাখা যেতে পারে। কৃত্রিম পালকের পাপোষ পাতা দুটোর বাড়তি আর্দ্রতা শুষে নেয়। মেয়েটি ভাবে বেঁচে থাকা হয়তো সম্ভব। পুরুষটি সেদিকে তাকিয়ে কিন্তু কিছু করার নেই।

সদ্য পরিত্যক্ত স্নানটি ছোট্ট জানলা গলে উড়ে যায়। আকাশের একটু নিচ দিয়ে, অন্য কোথাও, আর কারো ব্যর্থতাকে মুছে দিতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. কবিতাময় প্রকার গল্প,পড়তে ভালোলাগছিল। একটা চিত্রকল্প তৈরি করেছেন লেখক সফলভাবে। তবে ঠিক গল্পটা ধরতে পারছিনা, হতে পারে মনসংযোগ অভাব।

    উত্তরমুছুন
  2. কবিতাময় প্রকার গল্প,পড়তে ভালোলাগছিল। একটা চিত্রকল্প তৈরি করেছেন লেখক সফলভাবে। তবে ঠিক গল্পটা ধরতে পারছিনা, হতে পারে মনসংযোগ অভাব।

    উত্তরমুছুন
  3. গল্প তো অন দ্যা সারফেস। টিভি'র একটা শো 'ফাক আপ নাইটস'কে ঘিরে এক ধরণের প্রতিস্থাপনা। পুরুষটির ফাঁপা জোর খাটানো আর নারীর স্নানে ডুবে বিরোধাভাস প্রকাশ। পুরুষ-নারী ধূসরে দাঁড়িয়ে। তাদের আর কিচ্ছু করার থাকে না। এই তো!

    উত্তরমুছুন