সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম'এর গল্প : গোর

সিন্দুক কবরের ভেতরটা আটঁসাট। দূর থেকে শরির বাঁকিয়ে উঁকি দিয়েই ঘাবড়ে গিয়েছেন ফয়েজ আহমদ। নতুন কবর। বৃষ্টিতে নীচ থেকে পানি উঠছে দেখে কেমন শিরশিরে অনুভূতি শিড়দাঁড়া দিয়ে নামলো অথবা আটকে রইলো বুকে। মাত্র কয়েক হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অথচ তাকালে মনে হয়, ভেতরের চারকোনা বরফের মতো অন্ধকারটা পৃথিবীর অন্যপাশ অব্দি পৌঁছে গেছে। আশেপাশের দু-একদিন বয়সি কবরগুলো সদ্য মা হওয়া নারীর তলপেটের মতো ফুলে আবার চুপসে বসছে পানিতে।
ফয়েজ এবার খানিকটা গেটের দিকে এগিয়ে দাঁড়ালেন গাছের নীচে। বৃষ্টি ধরে এসেছে কিন্তু ওপর থেকে পাতা চুইয়ে নামছে ফোঁটায় ফোঁটায়। একটু আগেই খুব বৃষ্টি ছিলো এদিকে। সিদ্দিকের সঙ্গে দৌড়ে এসে গোরস্থানের অফিস ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন ফয়েজ। সেখান থেকে কয়েক পা নামতেই বা দিকের দ্বিতীয় সারির একপাশে সদ্য খোঁড়া কবরটায় চোখ পড়লো। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে সিদ্দিক আগ বাড়িয়ে বললো, স্যার হিন্দুক কব্বরটার কামই হ্যাস করলাম হপায়, আরেট্টা আছে ওইডা বাক্স কব্বর। 

নেহাত দুর্ভাগ্য না হলে এমন ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টির ভেতর কোনটা সিন্দুক আর কোনটা আলমারী কবর--এসব মারফতি জ্ঞান ফয়েজের নেওয়ার কথা না। এটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি বাইরে রাখা ফ্রিজের পানির বোতলের মতো ঘেমে উঠেছেন টের পাচ্ছেন। রুমাল হাতড়ালেন পাঞ্জাবির পকেটে। নেই। একটা জিনিস যদি শিরিন মনে করে দিতো, বৃষ্টি-ঘামে ভিজে আঠা হয়ে গেছে শরীর। সেই কখন বাসা থেকে রাজ্যের কাজ নিয়ে বেরিয়েছেন। এখন এখান থেকে বের হওয়া দরকার, কিন্তু সিদ্দিক কথা বলেই যাচ্ছে। অনিচ্ছে সত্ত্বেও তিনি স্বাভাবিক মুখে শুনছেন সব। সুতো দিয়ে মেপে বাশের কঞ্চি বা খেজুরের ডাল দিয়ে চারকোনায় চিহ্ন দাও প্রথমে। সবগুলো চিহ্নের সাথে সুতো টেনে জমির ওপরে কবরের মাপের রেপ্লিকা দাও। এরপর এক মাপে ধার কেটে চার ফুটের মতো গহ্বর তৈরি করাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। তারপর কোদাল চালানোর গতি শ্লথ হয়। ছেনি দিয়ে বা কোদাল দিয়ে চেছে চেছে ভেজা সুতি শাড়ির মত মোলায়েম করতে হয় কবরের মেঝে। ভেতরে দেওয়ার চাঁটাই, বাঁশ এখন কিনতে পাওয়া যায়। আগে গোর খোদকদেরই বানাতে হতো। সিদ্দিক কবর বোঝাতে উš§ুখ আর এটাই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ফয়েজকে। 

- স্যার, হিন্দুক কব্বরে লাশ ঠিক মধ্যিখানে থাকে না। নামায়া ধাক্কা দিয়া ভিতর দিক ঢুকায় দিওয়া লাগে।

- কেন?

- হিয়াল-কুত্তার ভয়ে। এই কব্বরে লাশ টাইন্না বাইর করা যায় না।

- সবাই এ রকম কাটলেই পারে?

- জমি না কিনলি অনুমতি নাই। বড়লোকগো কব্বর। 

- ও আচ্ছা বলে চুপ রইলেন ফয়েজ। প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইলেও পারছেন না। সিদ্দিক কথা বলেই যাচ্ছে, ‘কব্বর যেমনই কাডুক রক্ষা নাই, দ্যাহেন না তলের থ্যা পানি উডছে ক্যামায়!’

- পানি যদি না নামে তাহলে কি হবে? নিজের পান খাওয়া দাঁত বের করে নিষ্ঠুর প্রশস্ত হাসি দিয়ে বললো সিদ্দিক, এইডা মুর্দার পরিবারের ধৈর্য্যরে পর নিব্বর করতেছে। হেরা অপেক্ষা করলি এট্টু না শুহান পর্যন্ত থুয়্যা দিবি আর নইলি দুইডা কলাগাছ ফ্যালায়া বা এক বস্তা বালি ঢাইলা দিবেনে নামায়া। ‘নামানো’ শব্দটা নিষ্ঠুর শোনালো ফয়েজ আহমেদের কানে। আগে কোনো গোরখোদকের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়নি। বৃষ্টিতে আশ্রয় দেওয়ার নামে সিদ্দিক ইচ্ছে করে আতঙ্ক তৈরি করছে মনে হচ্ছে। অবশ্য সেটা অমূলক নয়। এই কাজটা সে করতেই পারে। তাকে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছেনা। তবুও প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, তুমি না ফলের ব্যবসা করতে। এখানে কাজ করছো কতদিন? 

- আমিও জানতাম নিকি এই কাম করা লাগবি? বছর দুই ধইরা, স্যার। 

- আয় বেশি হয়?

- না, অন্য হিসাব।

গোপনে ঢোক গিললেন তিনি। সিদ্দিকের পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও সামলে নিলেন। তিনি যে সিদ্দিককে এর মধ্যে দুবার খুঁজেছেন, চেপে গেলেন। ওর সঙ্গে আজ দ্বিতীয়বার দেখায় চেনার কথা না তবে মনে আছে বিশেষ কারণে। সেদিন বাসায় রাতে অনেক অতিথি আসবে বলে কারওরান বাজারে গিয়েছিলেন। এফডিসির পাশে ভোরবেলা বেশ ভালো মাছ পাওয়া যায়। আড়তে তোলার আগেই পাইকারি দরে মাছ ব্যবসায়ীরা ভাগে বড় বড় মাছ তুলে দেয় পাল্লায়। দেখেশুনে মেহমানদের জন্য মাছ কিনে কাজের ছেলেটার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে হেঁটে এলেন কাঁচা বাজারের ভেতর দিকটায়। সবজির দামদর করে প্রগতি ভবনের সামনে দিয়ে ফেরার পথে দেখলেন, ফল নিয়ে বসেছে কয়েকজন। এদের একেবারে চতুর্থ শ্রেণীর দোকানদার বলা যায়। আড়তের পাশে টিউব লাইট জ্বালিয়ে ফ্যানের নীচে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাট্টা করে তারা প্রথম শ্রেণীর। চতুর্থ শ্রেণীর দোকানদারদের মুখে পোড় খাওয়া বলি রেখার চিত্রাঙ্কন থাকে। চারুকলার ছেলে-মেয়েদের প্রথম প্রথম এমন সোজা, বাঁকানো দাগ আঁকতে শেখানো হয়। চোখের কোনে বাসি পিচুটি লাগানো মুখ দেখলেই বোঝা যায় তাদের পণ্যের অর্ধেক দামও দর করতে লজ্জা নেই ক্রেতার। এরকম কয়েকজন একসারিতে বসেছে জালালাবাদ ভবনের শেডের নীচে। একজনের ঝাঁকা থেকে পাকা বেল আর পেঁপে তুলে যাচাই-বাছাই করলেন ফয়েজ।

- গিরস্ত বাড়ির, ওষুধ-পাত্তির দিয়া নাই নিচ্চিন্তে ন্যান স্যার।

- সবগুলো কত রাখবা?

- ঠেইক্কা গেছি, এক টাহাও বেশি চাইতামনা, পনেরোডা ব্যাল, দুই কেজি আমরা আর দুই হালি কম্ফা সব মিলা সাতশো দিয়েন। খাইয়া আমারে বিচরাইবেন। 

- ধুর মিয়া দাম বুইঝা চাও, কতোতে দিবা বলো?

- স্যার মাইয়াডার পরীক্ষার ফি লাগবো বইলা হেই সকালে বইছি। বিশ্বাস করেন, বেশি চাই নাই।

- তোমাদের এই সমস্যা, সবকিছুতে সুযোগ খোঁজো। ফিসের সঙ্গে কী সম্পর্ক? একদাম বলো।

- আল্লার কিরা স্যার, কাইলকা লাষ্ট তারিখ। ফি না দিলি পরীক্ষা দিতে দিবিন্যা। সাতশো বেশি চাইনাই। জিনিস ভালো নিয়া যান।

কার্তিক মাসেও গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ডিপ ফ্রিজে রেখে অনেকদিন জুস করে খাওয়া যাবে। এই লাভ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন নাকি দোকানদারের বারবার স্যার ডাকায় কাজ হয়েছে, কে জানে। পাকা দরদাম করে ফয়েজ বললেন, ঠিক আছে কথা বাড়িয়ো না, পাঁচশো টাকা। ব্যাগে তোলো। প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে চকচকে নোটটা দিয়ে মনে মনে বেশ স্বস্তি বোধ করলেন ফয়েজ আহমেদ। কোমরের লুঙ্গির গিটে টোপলা মতো জায়গার প্যাঁচ খুলে টাকাটা দুই ভাজ দিয়ে রাখলো লোকটা। 

সিদ্দিককে তিনি আবার খুঁজতে এসেছিলেন দু’দিন পর। মেহমানরা চলে যাওয়ার পরদিন বাসায় সব কিছু কেমন আবর্জনার স্তুপ হয়ে আছে। শিরিন কাজের মেয়েটাকে নিয়ে সামলাচ্ছে জঞ্জাল। রান্নাঘর থেকে গৃহিনীর খবরদারি কণ্ঠস্বরের সাথে পাতিল মাজার সাঁই সাঁই শব্দ ছুটে আসছে বসার ঘরে। ঘরের বাইরে সিঁড়িতে দীপ্র আর পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চার খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সোফায় কাগজপত্র আর কালো একটা ক্যালকুলেটর নিয়ে ব্যবসার হিসাব মেলাচ্ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। হিসেবের গড়মিলের নোট রাখছেন ডায়রিতে। ঠিক তখনই শব্দটা হলো। ধুপ করে কিছু পড়ে গেলো তারপরই ভয়ানক চিৎকার। উর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ে দরজা খুলে যা দেখলেন, অবিশ্বাস্য। তার ছেলে মেঝেতে পড়ে আছে, মাথার পেছনের রক্ত। পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে চিৎকার করছে অন্য ছেলেটা। দীপ্র এমনিতে খুব শান্ত বাচ্চা। কিন্তু ধারে-কাছে কেউ নেই দেখেই হয়ত অমন খেলার সাহসটা হয়েছে। সিঁড়ির হাতলে বসে পিছলে পিছলে কার আগে কে নামতে পারে--প্রতিযোগিতা চলছিল। হাতল থেকে দীপ্র ছিটকে পড়েছে দুই স্তরের মাঝখানের সমান প্রশস্ত অংশে। মাথা ফেটে জামা-কাপড় রক্তে মাখামাখি। ফয়েজ আহমেদ এক চিৎকারে শিরিনকে ডেকেই ছেলে কোলে নিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলেন। ট্রমা সেন্টার থেকে ছেলের মাথায় সেলাই-ব্যান্ডেজ করিয়ে আনলেন কাঁপতে কাঁপতে। যদিও ছেলের সেন্স হারায়নি বা বমি হয়নি কিন্তু আতংক আর ব্যাথায় পুরো চুপসে গিয়েছে। সারারাত ওর মাথার কাছে বসে রইলেন দুজন। ছেলেটা ওষুধের প্রভাবে ঘুমাচ্ছে, দুজনের কেউ সামান্য শব্দও করছেননা ভয়ে যদি জেগে উঠে। ওর ঘুম দরকার। দীপ্রর ঘরে ওষুধ কোম্পানীর ক্যালেন্ডার উড়ছে ফ্যানের বাতাসে। সেই ক্যালেন্ডারে মাস হিসেবে ফল আর ফুলের ছবি। কিছুক্ষণ ক্যালেন্ডারের দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন। ফয়েজ আহমেদ সকালে কাগজে কলম নিয়ে বসেছিলেন হিসেব মেলাতে। আকস্মিক মনে হলো কোথাও হিসেবে ভুল আছে। সারারাত ধরেও তিনি মেলাতে পারলেননা একটা অনুল্লেখিত হিসেব। শান্ত ছেলেটার এমন আকস্মিক দুর্ঘটনাই সবচেয়ে বড় বেহিসেবি ঘটনা তাঁর কাছে। তিনি মানতে পারছেননা। জন্ম থেকেই ওর চলাফেরা একটু শ্লথ, দেরিতে হাঁটতে শিখেছে। পা ফেলে ধীরে আবার চোখে এখনই মাইনাস পাওয়ারের চশমা। সেই ছেলের এমন ভয়ানক সাহস হওয়ার কথা না। ফয়েজ আহমেদ সারারাত এক মুহুর্তের জন্য স্থির হতে পারলেননা। পরদিন সকালে উঠেই গেলেন কারওরান বাজার। রাস্তার পাশের ফলের দোকানগুলোতে খুঁজলেন সেই ফল বিক্রেতাকে। নাম জানেন না তাই ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না কাউকে। দুদিন পর আবারও গেলেন। ওই একই জায়গায় সেদিন এক বুড়ো ফলওয়ালাকে পেয়ে বর্ণনা দিয়ে লোকটির কথা জিজ্ঞেস করতেই শুনলেন ঘটনাটা। শুক্রবার সকালে ফল নিয়ে যে বসে সে লোকের মেয়ে মারা গেছে। অস্বাভাবিক মৃত্যু। আত্মহত্যা করেছে ১৬ বছর বয়সি মেয়ে। এর বেশি কেউ কিছু জানে না। একজন শুধু টিপ্পনি কাটলো, সিয়ানা মাইয়া প্যাট-পুট বাধায় হালাইছিল নাকি কইব কিডা, কিন্তু আপনে খুঁজেন ক্যা সিদ্দিকরে? টাহা পাননি? সব শুনে স্তব্ধ ফয়েজ আহমেদ আবার অবাকও হলেন কিছুটা। একজনের মেয়ে মারা গেলো আর অন্যজন কেমন বিচ্ছিরি মুখভঙ্গি করে মেয়ের চরিত্র নিয়ে ধারণা দিচ্ছে। আসলে এই শ্রেণীর মানুষের সাইকোলজিই আলাদা। তিনি তখনই জেনেছিলেন, ঝুরি নিয়ে বসে থাকা ওই পিচুটি মাখা চোখের বিক্রেতার নাম--সিদ্দিক। 

সেও তো বছর দুই আগের কথা। সেই সিদ্দিকের সামনে সন্ধ্যায় এই গোরস্থানে দাঁড়িয়ে তার শরীর অবশ হয়ে আসছে। এখন বৃষ্টিও কমেছে অনেকটা। হিজল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ভয় পেতে পেতে গোরস্থানের নীরবতায় এক ধরণের মোহও আবিষ্ট করে তুলছে তাকে। দূরে দূরে টিউব লাইট জ্বলছে, তাই অন্ধকারের বদলে একটা ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে আছে পুরো জায়গায়। সব কবরের মাপ যে সমান নয়, তিনি এই প্রথম লক্ষ্য করলেন। কয়েকটা ছোট আকৃতির কবর চোখে পড়লো। আহারে এগুলো বাচ্চাদের হবে। কিছুটা দূরে বৃষ্টি ঠেকাতে নীল রঙের প্লাস্টিক টাঙিয়ে আরও একটা নতুন কবর খোঁড়া হচ্ছে। গর্তের ভেতর থেকে দুজন মানুষের মাথা ওঠা-নামা করছে তালে তালে, অনেকটা কচ্ছপের খোলের ভেতর থেকে মাথা বেরিয়ে আসার মতো। এরা নিচ থেকে মাটি তুলে রাখছে কবরের বাইরের দুপাশে ডাই করে। প্রাচীরের চারপাশে লাগানো হিজল আর দেবদারু। পানি পড়ে ভিজে আছে গাছের গা। সোডিয়াম লাইটের আলোতে সেদিকে তাকালে মনে হয়, আকস্মিক কিছু সোনালি সাপ নামছে বেয়ে। বৃষ্টি হওয়ায় পুরো গোরস্থানের ভেতর কাঁচামাটি আর বাঁশের ঘ্রাণের মিথস্ক্রিয়া। প্রাণপণে কবরের ভাবনা ঝেড়ে ফেলার প্রস্তুতি নিলেন ফয়েজ। প্রায় এক ঘণ্টা হয়েছে তিনি এখানে প্রায় আটকা পড়েছেন বলা যায়। 

মোহম্মদপুর থেকে বাসে নীলক্ষেত নামার পরই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বলাকা সিনেমা হল ক্রস করতেই পুুরুষ্ট হলো পানির ফোঁটা। দৌড়ে আজিমপুর কবরস্থানের গেটের টিনশেডের নীচে দাঁড়াতেই সিদ্দিকের সাথে দেখা। নতুন কবর খুঁড়ে ছাতি নিয়ে বিড়ি খেতে বেরিয়েছে সিদ্দিক। পরিচয় না দিলে হটাৎ চিনতেনও না, কিন্তু সিদ্দিক তাকে মনে রেখেছে দেখেই এখন অস্বস্তিটা বাড়ছে। সিদ্দিকই এগিয়ে এসে বলল, স্যার চিনছেন? আপনি তো পুরাই ভিজ্জা গেছেন। ভিতরে আইসা অফিস রুমের বারান্দায় খাড়ান। 

একটা দীর্ঘ সময় দম আটকে থাকার পর এখন তার অস্থির লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার। এই বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে ছেলেটা না আবার ভিজতে শুরু করে। ইদানিং তাঁর হাঁটাচলা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। সুযোগ পেলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। এখন নিশ্চই দু-একটা রিকশা পাওয়া যাবে। চলে যাওয়ার আগে তবুও মনে হলো, তিনি যে সিদ্দিককে খুঁজতে গিয়েছিলে, এ খবরটা তাকে জানানো প্রয়োজন তাছাড়া তার মেয়ের কথাটা একবার জিজ্ঞেস না করাও অন্যায় হবে। অস্বস্তি নিয়েই সিদ্দিকের কাঁধে হাত রাখলেন ফয়েজ, তোমার মেয়েটার কি হয়েছিল? আমি খুঁজতে গিয়েছিলাম তোমাকে। হাত সরিয়ে দিলো সিদ্দিক।

- বাসি গতর স্যার, ধইরেন না। কব্বর কাটছি।

- কি হয়েছিল তোমার মেয়েটার?

সিদ্দিকের চোখের মনিতে কোনো মায়া নেই বরং যেন আগুন জ্বলে উঠল। সেই আগুন জ্বলা দৃষ্টির সাথে মিশে আছে মুখের একটা নিষ্ঠুর হাসি। অমন মুখ নিয়ে কেমন বিগলিত চেহারাও ফুটিয়ে তুলেছে গোরখোদক সিদ্দিক। বুকের ভেতর হিম জমিয়ে তোলে মানুষের অমন অভিব্যক্তি। সে যেন গল্প বলছে এমন স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে গেলো

- গরিবের পুলাপান। আপনে যেমতে পরথম বিশ্বাস করেন নাই ফলগুলানে ওষুধ দেই নাই, হের মাস্টারও বিশ্বাস করে নাই। ফিসের একখান পাঁচশ টাকার জাল নোট বাপে ইচ্ছা কইরা দেয় নাই। কেলাশের ছাত্রছাত্রীগো সামনে অপমান করছিলো। আদুইরা মাইয়া তো...।

সিদ্দিকের কথা শুনে নির্বাক ফয়েজ। কেবল আমতা আমতা করে বললেন, ভুলটা আমারই কিন্তু না বুঝে হয়েছে। আমি তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।

- না বুইঝা করেন নাই। চালায় দিতে চাইছিলেন না স্যার? ভালোই চলছে।

শক্ত করে ‘না’ বলার শক্তিটা এতক্ষণে হারিয়ে ফেলেছেন ফয়েজ আহমেদ। তার বিদায় নেওয়া জরুরি। কিন্তু এমন অপরাধী হয়ে ‘যাই’ বলেই তো আর যাওয়া যায় না। সামান্য দায় লাঘবের শেষ চেষ্টায় যেন স্বগোক্তি করলেন, মেয়েটা তাই বলে আত্মহত্যা করলো! 

- বাপের মতো ঘিন সহ্য করা শিখে নাই। মাস্টারে গাইল দিছে জ্বাল নোট দিওয়ায় আর বাড়ি ফিরা মা’রে কওয়ায় সে আবার কইছে, তুই মিছা কথা কস। তোর আব্বা গুইনা টাকা দিছে নিশ্চই হারাইছোস। আমি বাড়ি ছিলামনা। ফল খুঁজতে গেছিলাম। ওষুধ না দিওয়া ভালো ফল খুঁজতে গেছিলাম স্যার। ফিরা আমিই ঝুলা শরীলডা দড়ি কাইড্ডা নামাইছি। গরীবের বিষয় স্যার পুলিশও বাতেলা করেনাই। মামলা লিহেনাই। এহন কব্বর কাটি। বুকের ভেতর জমাট আতঙ্ক নিয়ে ফয়েজ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

- আত্মহত্যার মাইনসের নাকি জানাজা হয় না। গ্রামের বাড়ি নিয়া গেছি লাশ। নিজের মাইয়ার কব্বর নিজেই কাটছি। হেরপর থিকা কাডি আর অপেক্ষা করি।

- কিসের অপেক্ষা?

একটা হাসি দিলো সিদ্দিক। মানুষের পক্ষে শব্দহীন সেই হাসি সহ্য করা অসম্ভব। ঘাড়ের রগটা দপদপ করছে ফয়েজের, বুঝতে পারছেন প্রেশার বেড়েছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার। এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না গোরস্থানে। বৃষ্টি কমে আসায় এবার যাবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে পা বাড়াতেই তার হাতে একটা হ্যাচকা টান দিলো সিদ্দিক, কই যান স্যার? আমার কব্বরের লাশ আইছে। দাফন দেইখা যান। বৃষ্টির ভেতর পানিওয়ালা কব্বরে মুর্দা নামাবো দেখবেন না? 

স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফয়েজ আহমেদ। গোরস্থানের গেটে এসে একটু আগেই থেমেছে পিকআপ ভ্যানটা। অন্ধকার গাছের নীচে সিদ্দিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পিকআপ থেকে মরদেহ নামাচ্ছে মৃতের আত্মীয়রা। আবার বৃষ্টির ছাট বাড়ছে। তিনি কি ভুল দেখলেন! সাদা পাঞ্জাবি গায়ে কাকে দেখলেন! শিরিনের ছোটভাই আফাজ এখানে কী করে! আফাজের পাঞ্জাবির কোনা ধরে কি দীপ্র দাঁড়িয়ে আছে? অসম্ভব। হতেই পারে না। তিনি এগিয়ে যেতে চাইলেন, গাছের শিকড়ের মতো কিছু একটা মাটির নীচ থেকে আঁকড়ে ধরল তাঁর পা। শব্দ করে ডাকলেন কিন্তু মুর্দা নিয়ে আসা পিকআপের যাত্রীরা কেউ তাকাচ্ছেনা তাঁর দিকে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, দীপ্রর পাঞ্জাবির পকেটে পানি জমছে, চোখের ভ্রু, হাতের আঙুলগুলো ভিজছে বৃষ্টিতে। ছেলেটা আবার জ্বর বাধাবে। তিনি সেখান থেকেই শব্দ করে ডাকলেন ছেলেকে। না, কেউ তাকায়নি। তার শব্দ শুনছে না কেউ! 

শব যাত্রীর দলে আরও পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছেন ফয়েজ। তারই গা ঘেঁষে মরদেহের খাটিয়া নিয়ে সবাই গেলো নতুন কাটা সিন্দুক কবরটার কাছে। সিদ্দিককে দেখা যাচ্ছে। লাশ নামাতে কবরের ভেতরে নেমেছে সে। পানির ভেতরই কি নামাচ্ছে ওরা? কিন্তু কার লাশ? কাফনের কাপড়ে মৃতদেহের মাথার কাছটায় গেরো দেওয়া। মুখ দেখার উপায় নেই। 


কবরের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই। চাটাই দেওয়া হচ্ছে। ফয়েজ আহমেদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি আসলে বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠেছিলেন কিনা, মনে পড়ছে না। পুরোপুরি নিঃশ্বাস আটকে আসছে ফয়েজের। সামনে ঘিরে ধরছে আশ্চর্য এক অন্ধকার। তিনি গুম গুম পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন। মানুষ ফিরে যাওয়ার শব্দ। একমাত্র পানির নিচে থাকলে উপরের শব্দ এমন ধাতব বস্তু পড়ে যাওয়ার মতো ভারি হয়ে আসে। মাটির নিচেও তাই হয় নাকি, বুঝতে পারছেন না ফয়েজ আহমেদ। চিৎকার করে ছেলের নাম ধরে ডাকলেন, জবাব না পেয়ে এবার ডাকলেন সিদ্দিককে। আশ্চর্য সব শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে বুঝতে পারছেন কিন্তু তাঁর ডাক শুনছে না কেউ। একবার মনে হলো, অল্প বয়েসি একটা মেয়ে দ্রুত সরে গেল পাশ দিয়ে। কে যেন আইজ থিকা আর কব্বর কাটুম না বলে হাসতে হাসতে ফিরে যাচ্ছে শুনতে পাচ্ছেন ফয়েজ আহমেদ।



লেখক পরিচিতি
সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
গল্পকার। সাংবাদিক। গবেষক।
বাংলাদেশ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. বই থেকেই পড়েছি। আপনার গল্পের সরল বর্ণনা আমার বরাবর ভালো লাগে। আপন মনে হয়। মনে হয় আমাদের কথাই বলছেন, আরোপিত কাঠিন্য নেই। এই গল্পটা বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলোর তুলনায় একটু আলাদা। একটু টান টান উত্তেজনা। শেষটায় ধাক্কা।-সাদিয়া সুলতানা

    উত্তরমুছুন
  2. কৃতজ্ঞতা জানবেন। যা ভালো না লাগে বা আরও যত্নের দাবি রাখে মনে হয় তাও জানাবেন।

    উত্তরমুছুন