গল্পপাঠের অন্যতম সম্পাদক মোমিনুল আজম গত ৯ এপ্রিল পিতৃহারা হয়েছেন। মোমিনুল আজমের সদ্য প্রয়াত বাবার প্রতি গল্পপাঠের শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল।
মোমিনুল আজম লিখেছেন--
''নশ্বর এই পৃথিবীতে সবচেয়ে শ্রদ্ধার, ভালোবাসার মানুষ ছিলেন আমার বাবা। গত জানুয়ারি মাসে কানাডা থেকে গিয়েও তাঁকে দেখে এসেছি। অসুস্থ্যতার কারণে মার্চের শেষ সপ্তাহে যখন তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হলো তখন এক দিনের নোটিশে আবার চলে গিয়েছিলাম দেশে। হাসপাতালের কেবিনে তাঁর সাথে কাটিয়ে এসেছি সপ্তাহ খানেক। নিরব কর্কট রোগ বেড়ে উঠেছিলো তাঁর শরীরে। এ রোগের জ্বালা যন্ত্রণা ভোগার আগেই এ পৃথিবীকে আমার জন্য নিরানন্দ, অবাসযোগ্য করে আজ তিনি চলে গেলেন (ইন্না লিল্লাহে . . . রাজিউন)।
হাসপাতালের কেবিনে বাবার সাথে আমার সর্বশেষ এ ছবিটি তুলেছিলো ছোটভাই শাহী। তাঁর এ হৃদয় জুড়ানো হাসি এখন আমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দিবে''।
মোমিনুল আজম কিছুদিন আগে বাবার চশমা নিয়ে একটি লেখা করেছিলেন। অসামান্য সরল ও মমতামাখানো লেখাটি আজ প্রকাশ করা হলো।
আমার বাবার চোখের সমস্যা দীর্ঘদিনের। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছি তিনি চশমা ব্যবহার করেন। দু'তিন বছর পরপর দেখতাম বাবা ডাক বিভাগের ভিপি পার্সেলে করে ঢাকা থেকে চশমা নিয়ে আসতেন। আমরা যখন ঢাকায় থাকা শুরু করলাম তখন আর ডাক বিভাগের সহায়তার প্রয়োজন হয় নি। আমরাই তখন বাবাকে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতাম, চশমা বানিয়ে দিতাম।
২০০৯ সালের দিকে তিনি প্রায় চোখে দেখেন না, আগের চশমা খুব একটা কাজ করে না। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষার পর ডাক্তার বলেছিলেন- "ওনার যা বয়স, চোখের যা অবস্থা তাতে কোন কিছুই আর কাজ করবে না।" তিনি হাই পাওয়ারের একটি চশমা দিয়ে বললেন- " এটা দিয়ে উনি কোনমতে চলাফেরা করতে পারবেন।" চশমা বানানোর পর মোটা লেন্স আর পাওয়ার দেখে আমার মনে হয়েছিলো বাবা এটি ধারণ করবেন কিভাবে? এটি নিয়েই বাবা চলেছেন কয়েক বছর। পড়তে তেমন পারতেন না। হালকা যা দেখতেন তা দিয়ে লাঠি ব্যবহার করে পথ চলতে পারতেন। কানাডা থেকে অ্যালুমিনিয়ামের কারুকাজ করা লাঠি নিয়ে দিয়েছিলাম বাবাকে। ঠিক অন্ধ না হলেও অন্ধের মতোই ছিলো তাঁর জীবনযাত্রা।
'বয়সের কারনে তাঁর অপারেশন করে কোন লাভ হবে না' ডাক্তারদের এমন মন্তব্য এবং বাবার ডায়াবেটিসের কারনে অপারেশন করলে চিরতরে অন্ধ হয়ে যেতে পারেন, এ ভয়ে কোন ভাই দায়িত্ব নেয়ার সাহস পায় নি। বাবাও অপারেশনে সম্মতি দেননি। সবসময় তাঁর পৃথিবী হয়ে থাকতো কুয়াশাচ্ছন্ন।
এবার দেশে গিয়ে নেমেছিলাম রাতে। সকালে উঠে ফোন করতেই বাবা কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন, " গতরাতে সিডি দিয়ে ওঠার সময় পড়ে গিয়ে চশমা ভেঙ্গে ফেলেছেন, চোখে এখন আর কিছুই দেখেন না।" দেরী না করে গিয়েছিলাম বাবার কাছে। গাইবান্ধায় চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করে বাবার জন্য কোন চশমার সুপারিশ করতে পারেননি, অর্থাৎ তারা ম্যানুয়ালি কিংবা মেশিনে তার চোখে কোন পাওয়ার ধরতে পারেনি।
এমন অবস্থায় বিচলিত হয়ে পড়ি, তবে কী বাবাকে অন্ধ হয়েই বাকী জীবনটা কাটাতে হবে? এমন চিন্তা করতেই মনে হলো বাবাকে কয়েক বছর আগে দেখানো হয়েছিলো গাইবান্ধায় এক চক্ষু শিবিরে, রংপুরের দীপ আই কেয়ার ফাইন্ডশন পরিচালনা করেছিলো সে চক্ষু শিবির। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক খাইরুল ইসলাম দীপু বাবাকে পরিক্ষা করে বলেছিলেন, ফ্যাকো সার্জারি করলে ওনার দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসতে পারে। বিষয়টি মনে হতেই বাবার সাথে চোখের সার্জারি নিয়ে আলাপ করলাম। পঁচাশি বছরের বাবা আমার এই প্রথম সার্জারির সম্মতি দিয়ে বললেন- আমি এখন এমনিতেই অন্ধ, সার্জারি করে ভালো হলে ভালো , না হলেও তো আর ক্ষতি নেই।"
বাবার এ সম্মতি পাওয়ার পরের দিনই তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম রংপুরে। দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশনে ডাক্তার খাইরুল ইসলাম দীপু বাবাকে ধরে ধরে বিভিন্ন রুমে নিয়ে গিয়ে টেষ্ট করিয়েছেন। পরে আমার সাথে একান্তে আলাপ করে বলেছিলেন " খালুর একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আর একটি চোখে সামান্য ভিষন আছে, আপনি অনুমতি দিলে ফ্যাকো সার্জারি করে দেখতে পারি। বাবার দৃষ্টি শক্তি ফেরার আশি শতাংশ নিশ্চয়তা পেয়ে বাবার সাথে আলোচনা না করেই অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন আর অপারেশন করা সম্ভব হয় নি। বাবার ডায়াবেটিস আছে। ফাস্টিংসহ ডায়াবেটিক পরীক্ষা না করে তিনি অপারেশন করতে চাননি।
পরের দিন গাইবান্ধায় করিয়েছিলাম তাঁর ডায়াবেটিসের পরীক্ষা। রিপোর্ট যখন পেলাম তখন দেখলাম তা প্রায় স্বাভাবিক। বিলম্ব না করে পরের দিনই নিয়ে গিয়েছিলাম রংপুরে। দীপ আই কেয়ার ফাইন্ডশনে বাবার চোখের অপারেশন হলো দুপুর ১২ টার দিকে। ঘন্টা দুই বিশ্রাম নিয়ে বাবাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম গাইবান্ধায়। পরের দিন চোখের ব্যান্ডেজ খোলার কথা বলে সব ঔষধ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সিস্টার।
সারা রাত অস্থিরতায় ঘুমুতে পারি নি। বাবা ফিরে পাবেন তো তার দৃষ্টিশক্তি? যদি না ফিরে পান তাহলে বাকী জীবনে কী আর আমাদের দেখতে পাবেন না। দুতিন বছর পরপর দেশে ফিরলে বাবা যে বলতেন, " তুমি আরও সুন্দর হয়েছো, চেহারার মাঝে একটা আভিজাত্য এসেছে" না দেখতে পাওয়ার কারনে এমন করে আর বলতে পারবেন না। আমার ছেলেদের দেখে বলতেন " তোরা ঠিক তোদের বাপের মতো হয়েছিল" চোখে না দেখলে তাঁর পক্ষে আর এ তুলনা করা কি সম্ভব। বাবা খাওয়ার চেয়ে খাওয়ার আয়োজন দেখেই বেশি তৃপ্তি পেতেন। চোখে না দেখলে তাঁর এই তৃপ্তিবোধ হারিয়ে যাবে চিরতরে। এমন অসংলগ্ন চিন্তা করতে করতেই কেটে গেল সারাটা রাত।
সকাল আটটায় উঠে চোখের ব্যান্ডেজ খোলার আয়োজন করা হলো। ঘরে মা, আমি আর ছোটবোন মুক্তি। ছোটবোন একটা একটা করে ব্যান্ডেজ খুলছে আর আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। শেষ ব্যান্ডেজ খোলার পর চোখে ড্রপ দেয়ার পর দেখার চেষ্টা করতে বলেছিলেন ডাক্তার। চোখে ড্রপ দেয়া হলো, বাবা ধীরে ধীরে চোখ খুলেই বললেন " বাবা সবুজ , আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, এই বলে কাছে ডেকে মাথা মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে কেঁদে দিলেন। মা, ছোটবোনকে দেখেও তিনি একই কাজ করলেন। আমি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার বোনের গায়ের জামার রং কী জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি তা ঠিকঠাক বলতে পেরেছিলেন। দেখতে না পারলেও তিনি সবসময় হাতে ঘড়ি পড়ে থাকতেন? দীর্ঘদিন পর তিনি ঘড়ি দেখে সকাল সাড়ে আটটার কথা বলে আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করলেন তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার বিষয়টি।
3 মন্তব্যসমূহ
পড়া যাচ্ছিল না লেখাটা। লেখার প্রথমেই প্রয়াণের পাথর ভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তাই। পার্শি বিসি শেলির ভাষায় যা, দুঃখ ব্যাথাতুর সংগীতই সেরা সংগীতের মতো পড়েছি। কিন্তু এ-ও তো ঠিক, দুঃখের গীতি গাওয়ার চেয়ে কঠিন আর কিছুই নেই। যিনি গান তিনিই কেবল বুঝেন। বিশেষ করে প্রয়াত প্রবীণ যখন তারই পিতা, হোন তিনি পঁচাশি উর্ধ্ব।
উত্তরমুছুনকী ভংয়কর হিসেবে তাঁর, ‘আমি এখন এমনিতেই অন্ধ, সার্জারি করে ভালো হলে ভালো, না হলেও তো আর ক্ষতি নেই।’ আমরা যারা তার উত্তরসূরি, তারা এখনো সমাজে এতটাই লিপ্ত যে, এমন হিসেবটাও মেলাতে পারি না : ফলদায়ি বৃক্ষের মতো আকণ্ঠ বিলাতে বিলাতে এতটাই শুভবোধ তার যে, রিক্ত দিনের ভারটুকু দিতে চান না।
কিন্তু কে তাদের বোঝাবে, আমরা তো ফল-ছায়া পাওয়ার বৃক্ষে দিতে তাকিয়ে থাকি না যে, তা ফুরালে কুঠার হাতে তেড়ে যাবো। বরং পাতাশূন্য, ফলহীন বয়োবৃদ্ধ গাছটাকে দূর থেকে দেখে আমরা আমাদের বাড়িটা চিনতে পারি।
যেমন প্রিয় মোমিনুল ভাই আপনি, সুদূর কানাডা থেকে ওই পিতা বৃক্ষটাকে ঠিক চিনে নিতেন, গাইবান্ধায় কোনটা আপনার বাড়ি। প্রায় শতবর্ষী বৃক্ষ পতনে মর্মর ধ্বনি আপনাকে অনেক দিন নির্ঘুম রাখবে, যেমন রেখেছিল তিনি আপনাকে দেখতে পারবেন কি না। আমরা সৌভাগ্য, আমি এমনই এক জোড়া বৃক্ষ (পিতা-মাতা) আগলে রাখছি। শরীর ঠেকাতে পারছি।
আপনার জন্য সমবেদনা আর আপনিও বৃক্ষ হয়ে উঠবেন-এ কামনা।
ও হ্যাঁ, ফেসবুকে না বসার নিদারুন করুন উদাসিনতা জন্য আপনার পিতা প্রয়াণের খবরটুকু জানতে পারি নি। আর এই মাঝে ফেসবুক আইডিটা disabled করে রাখায় এতটুকু বেদনা জানাতেও দেরি হয়ে গেল। আইডিটা উদ্ধারের আগপর্য়ন্ত সব সময়ের ই-মেইল এড্রেস দুটো : alatehasan@yahoo.com এবং alatehasan.m@gmail.com
স্নেহধন্য
~ এহ্সান, অলাত
ঢাকা, বাংলাদেশ
বাবা'র জন্য শ্রদ্ধা। লেখাটা সরলভাবে গভীর দাগ কেটে গেল। আপনার বাবার মুখে শিশুর মতো হাসি।
উত্তরমুছুনবাবা ভালো থাকুন অনন্তলোকে। যোগ্য সন্তানের জন্য শুভকামনা।
উত্তরমুছুন