তারাপদ রায়'এর গল্প : চাঁদ ধরার মন্ত্র

চারুপিসিমা আমাদের চাঁদ ধরার মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। সুন্দর মন্ত্রটা ছিল, এখনো আবছা আবছা মনে আছে, পুরোটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। শুধু প্রথম লাইনটা মনে আসছে, দুবার বলতে হত প্রথম লাইনটা।

চাঁদ-চন্দ্র-চন্দ্রমা,
চাঁদ-চন্দ্র-চন্দ্রমা।

বেশিক্ষণের জন্যে নয়। এই মন্ত্র পড়ে ঠিক দুদণ্ডের জন্যে আকাশের যে কোনো জায়গায় চাঁদকে স্থির ধরে রাখা যেত। এক দণ্ড মানে চব্বিশ মিনিট, দুদণ্ড হল এক ঘণ্টার কিছু কম, পৌনে এক ঘণ্টার মতো।

সন্ধ্যাবেলা পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করে পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে একটা কালো পাথরের থালায় জল নিয়ে আমরা আমাদের দালানের পুবদিকের খোলা বারান্দায় এসে বসতাম। সামনে ছিল পরপর তিনটি কঁঠাল গাছ আর সজনে গাছ। তিথি ও সময়মতো নানারকমের চাঁদ উঠে আসত ডালপালা, পাতার আড়ালে। আমরা পাথরের থালাটা বারান্দার এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসাতাম, যেখানে ওই কালোপাথরের জলে একটা ঝকমকে ছায়া পড়ত চাঁদের। তখন ওই জলের ছায়ার মধ্যে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে তিনবার চাঁদ-চন্দ্র-চন্দ্রমার মন্ত্রটা খুব নিষ্ঠা নিয়ে বলতে হত। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদটা আটকিয়ে যেত গাছের ডালপালার মধ্যে। একবারে নট-নড়ন-চড়ন নট-ফট্‌, পাকা দুদণ্ডের জন্যে চাঁদ বেচারা বন্দি হয়ে যেত আমাদের কাছে। তারপর দু-দণ্ড শেষ হয়ে যেতে সন্ধ্যারাত পেরিয়ে যাওয়ার পর চাঁদ উঠে আসত গাছপালার ওপরে। আমারা তখন রান্নাঘরের মেঝেতে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িতে বসে কাঁসার বাটিতে দুধকলা দিয়ে ভাত খেতে খেতে দেখতাম, চাঁদ ডিঙিয়ে যাচ্ছে আমাদের পুরোনো বাড়ির ছাদের কার্নিশ, বুড়ো নারকেল গাছের লম্বা মাথা।

চাঁদ ধরা ব্যাপারটা খুবই শৌখিন ছিল, তখনকার আমাদের ভাষায় যাকে বলে হাউস করে মানে শখ করে আমরা চাঁদ ধরতাম।

চাঁদ-ধরার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ছিল তারা বাঁধা। আমাদের সেই মধ্য বাংলার নদী আর জলার দেশে কী যে বৃষ্টি হত। বর্ষা শেষ হয়ে যেত তাও বৃষ্টি থামত না, কার্তিক মাসে কিংবা পৌষ মাসে বৃষ্টি এলে সে আর সহজে বিরাম হত না।

তখন আমরা তারা বাঁধতাম। সেটাও আমাদের চারু পিসিমাই শিখিয়েছিলেন।

এতকাল বাদে চারু পিসিমার নামটাই শুধু মনে আছে। চেহারাটা ভালো করে মনে পড়ছেনা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় কদমছাঁট চুল, আর সাদা থান একটু একটু করে মনে আসছে, কিন্তু মুখটা মনে পড়ছে না।

চারুপিসিমা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। সে বাড়ির আর কারো কথা খেয়াল হচ্ছে না। একটা হুলো বেড়াল, একটি ভোলাকুকুর, কয়েকটা পায়রা আর কাজের লোক, এ সব ছাড়া সে বাড়িতে কাউকে বিশেষ দেখিনি।

সন্ধ্যাবেলা চারুপিসিমা এসে আমাদের বাড়িতে পুবের বারান্দায় বসতেন। মা-কাকিমার সঙ্গে গল্প করতেন। আমাদের চাঁদ ধরা, তারা বাঁধা শেখাতেন। আরও অনেক কিছু শিখেছিলাম তাঁর কাছে। আমি যে পুরুষমানুষ হয়েও আলপনা দিতে শিখেছিলাম, আম কাসুন্দি বা পুতুলের জামা বানাতে পারতাম, সেও চারুপিসিমার জন্যেই।

আপাতত তারা বাঁধার কথাটা বলি। আমাদের সেই বৃষ্টির দেশে একটা কথা ছিল ‘হেসে যায়, কেঁদে আসে’। বর্ষার সারাদিন সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েছে, শেষ বেলায় পশ্চিমের দিকে মেঘলা একটু কেটে গেল, একটু হাসিমুখ দেখিয়ে সূর্য ডুবে গেল। দু-একটা তারাও উঠল আকাশে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা নয়। আজ হাসতে হাসতে সূর্য ডুবল, কাল কাঁদতে কাঁদতে সকালবেলা ফিরবে অঝোর বৃষ্টিতে।

এই ‘হেসে যায় কেঁদে আসা’র একমাত্র প্রতিকার ছিল তারা বাঁধা। পিঁড়িতে ঘট বসিয়ে সেই ঘটে জল আর নারকেলপাতার কাঠি দিয়ে মন্ত্র পড়ে তারা বাঁধতে হত। কোনো অনাচার না হলে অব্যর্থ সেই মন্ত্র, পরদিন সকালে আর বৃষ্টি হত না। সূর্য হাসতে হাসতে ফিরে আসত ভোরের আকাশে।

চাঁদ ধরা, তারা বাঁধা এ সব কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এ বয়েসে এ সব আর কার মনে থাকে?

আমাদের বাড়ির পাশের জমিতে একটা অনেক উঁচু বাড়ি উঠছে। চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। আরো উঠছে। গতকাল অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দেখি ঘর জ্যোৎস্নায় ছেয়ে গেছে। জানলায় গিয়ে দাঁড়াতে দেখলাম চারতলার মাথায় চাঁদ, আর একটু পরেই নিচে নেমে যাবে। জ্যোৎস্না আর এ ঘরে আসবে না। কয়েকদিন পরে যখন বাড়িটা আরো উচু হবে, আমাদের ঘরে আর জ্যোৎস্নার আলো একেবারেই আসবে না।

আমি আর কী করতে পারি। এ শহরে আমাকে কে আর জ্যোৎস্নার ইজারা দেবো? মন খারাপ করে বিছানায় শুতে আসছিলাম, হঠাৎ ছোটোবেলার সেই চাঁদ ধরার কথা মনে পড়ল। আজ বিনা চেষ্টাতেই চারুপিসিমার মন্ত্রটা মনে পড়ল।

চাঁদ-চন্দ্র-চন্দ্রমা
আজ কিন্তু নাই ক্ষমা।
বন্দি থাকো দুই দণ্ড
আজ তোমার এই দণ্ড ।।

চাঁদটার দিকে তাকিয়ে পরপর তিনবার মন্ত্রটা পড়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। আজ শেষবারের মতো চাঁদটাকে দুদণ্ডের জন্যে জানলায় ধরে রাখলাম। এই শেষ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. চারতলা বাড়িটা উঠে গেছে। মন্ত্র আর কাজ করে না।।

    উত্তরমুছুন
  2. চারতলা বাড়িটা উঠে গেছে। মন্ত্র আর কাজ করে না।।

    উত্তরমুছুন