কখনো কখনো রক্তের সম্পর্ক ছাপিয়ে আত্মার সম্পর্ক অনেক বেশি আপন হয়ে উঠে। অন্তত টুপুরের মায়ের সাথে পরিচয়ের পরআমার এমনটিই মনে হয়েছে।আমার থাকার কোনো জায়গা ছিল না।কি অনিশ্চিত এক যাত্রা শুরু করেছিলাম আমি! তারপর হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম টুপুরের মাকে।
টুপুরদের বাসায় আসার আগেরদিনও আমি জানতাম না আমি ওদের সাথেই থাকব। আমাকে বলা হয়েছিল আমার থাকার একটা বন্দোবস্ত করা হয়েছে।এলেই দেখতে পাব।তারপর সেদিনইহঠাৎ করে আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভোর রাত থেকে বেশ ক’বার বমি করেছিলাম। ভীষণ দুর্বল লাগছিল। তাই আর অফিসে গেলাম না।নতুন চাকরি আমার।তাই অসুস্থ অবস্থাতেই সকালে ফোন করে বসকে জানাতেই বস এমন গর্জন করে উঠেছিল আমার মনে হয়েছিল টেলিফোনের ও প্রান্তে যেন একটা ক্ষিপ্র বাঘ বসে আছে।বাঘ কিছুক্ষণ গর্জন করে ফোনের লাইনটা কাটার পরও আমি অনেকক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে নিথর বসে ছিলাম এবং ভাবছিলাম সামনের দিনগুলো বোধহয় তিত করলার চাইতেও তিতকুটে ভাব নিয়ে কাটাতে হবে।আবার মনে মনে হাসছিলাম সুবীর নন্দীর গাওয়া সেই গানের মতো, “আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই”। আগে থেকেই যে জীবন এত তিতকুটে তার আর নতুন করে তিতা হওয়ার কি আছে?
টুপুরের মা আমাকে হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টুপুরের মায়ের সাথে আমার বেশ সখ্যতা হয়ে যায়। টুপুর, টাপুরের সাথেও।নামগুলো কি সুন্দর! টুপুর-টাপুর।নাম শুনলেই মনে হয় বৃষ্টি পড়ছে।
নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ আমার খারাপ লাগত না।অফিসের সময়টা বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যেত। আর মাত্র ক’দিনেই বেশ বুঝতে পেরেছিলাম বাঘের মতো হঠাৎ হঠাৎ গর্জন করে উঠলেও বস মানুষটা ভীষণ মানবিক। তবে মুখে সব সময় ছিল আদার ঝাঁঝ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার পারিবারিক গল্প শুনতে চাইতেন ভদ্রলোক। পারিবারিক প্রসংগটা আসলেই আমি খুব বিব্রত বোধ করতাম।
অফিসে আমার টেবিলের পাশেই ছিল একটা বড় জানালা। সেই জানালাটা আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। একটা অর্ধনির্মিত ইট কংক্রিটের ছাদ দেখা যেত। সেই ছাদে অনেকগুলো পাখি এসে ভীড় করত। একটু দূরেই একটা পুকুর ছিল। ছেলে, বুড়ো সাই রোদের দুপুরে ঝুপ ঝুপ করে গোসল করত।পুকুরের টলটলে পানি দেখলে আমার মনটা কেমন জানি করত। হাতে কোনো কাজ না থাকলে প্রায় সময় আমি পুকুরের টলটলে পানির দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তখন একজনের মুখ আমার চোখে ভেসে উঠত। কখনো কখনো আমার চোখ ভিজে উঠত। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করত। আমি কান্না গোপন করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাজে মন দিতাম।
ভালো লাগত আমার টুপুরের মাকে। ভদ্রমহিলার মধ্যে সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানবিকতাও ছিল। তবে বেচারির দুঃখও কিছু কম ছিল না। তার দুঃখ কিছু কম হলে হয়তো তার সাথে আমার পরিচয়ই হতো না। ভদ্রমহিলার সাথে আমার যে খুব কথা হতো, গল্প হতো তা নয়। তারপরও কেন জানি একটা ভালো লাগা ছিল।সে ভালো লাগা অবশ্য পরে গিয়ে আরো অনেক বেশি বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সারাদিন তবু কেটে যেত। সমস্যা শুরু হতো রাতে। রাতে আমি একা ঘুমাতে পারতাম না। যখন আমার চোখের পাতা ঘুমের ভারে নুয়ে আসত তখনই শুরু হতো সমস্যা। আমার শরীরজুড়ে কেমন একটা শিরশির ভাব ছুঁয়ে যেত। আমি ভয় পেতাম। ভয় পেতে পেতে কুঁকড়ে ছোট একটা কুন্ডলীর মতো পড়ে থাকতাম। একটা শব্দ আসত আমার কানে। হিসসস, হিসসস.....! আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। মনে হতো কেউ বোধ হয় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। আমি কিছুতেই চোখ খুলতাম না। মনে হতো চোখ মেললেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই ভয়ংকর চেহারা। আমি শুধু কুন্ডলী পাকিয়ে নিজের ভেতরে নিজে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হয়ে গুটিয়ে যেতাম। কাঁথার ভেতরে কুন্ডলী পাকানো অবস্থায় অপেক্ষা করে থাকতাম কখন ফজরের আযান শোনা যাবে, কখন ভোর হবে, কখন আলো ফুটবে।
তারপর কখন যেন আমার ঘুম চলে আসত, টের পেতাম না। সকালবেলা দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গত আমার। টুপুরের মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন অফিস যাওয়ার জন্য। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার দৈনন্দিন কাজ শুরু করতাম। দিনের আলোর উন্মত্ততায় হারিয়ে যেত আমার এক একটি কৃষ্ণ গহবর রাতের যন্ত্রণা।
টুপুরদের বাসায় ডিশের লাইন ছিল না। এতে অবশ্য ওদের খুব একটা সমস্যা হতো না। ওরা দু’বোন সারাক্ষণই পড়ার মধ্যে থাকত। ওদেরকে দেখে আমার মনে হয়েছিল পড়ালেখাটা একটা খেলা। পড়ালেখাটা খুব আনন্দের। ওরা হাঁটতে হাঁটতে পড়ত, বসার বসে পড়ত, বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ত। একাডেমিক পড়া তো থাকতোই, পাশাপাশি হাতের কাছে যা পেত তা পড়ত। বাসায় নেয়া পেপারটার বিজ্ঞাপনগুলাও পড়ত। প্রতিটা বিষয় ওদের মনে থাকতো।
একবার আমি ওরিয়ানা ফাল্লাচি’র “হাত বাড়িয়ে দাও” নিয়ে গিয়েছিলাম। অফিস থেকে ফিরে দেখি টাপুর বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পিছন দিকে পা দোলাতে দোলাতে খুব মজা করে পড়ছে।আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে যেতে চাইল। আমি বললাম, পুরোটা পড়েছ?
আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল, একটু বাকি আছে।
বললাম, বইটা তোমার রুমে নিয়ে যাও। ছোট্ট টাপুর আচ্ছা বলে এক রকম পালিয়েই যেন বাঁচল। টাপুর ক্লাস সেভেন এ পড়ত।
আমি বেশিরভাগ সময় আমার রুমেই থাকতাম। আমার একার একটা রুম ছিল । একটা বারান্দা ছিল। পাঁচতলা বাড়ির চারপাশটা তখনো বেশ ফাঁকাই ছিল। অনেক দূর থেকে একটা রিভল্বিং টাওয়ারে ঘুরে ঘুরে আলো জ্বলত। মনে হতো দূরের বাতিঘর। বৃষ্টির দিনে ঝিঁ ঝিঁ পোকা উড়ত। প্রায় সময় ইলেক্ট্রিসিটি থাকতো না। আশেপাশে কয়েকটা ছোট ছোট পুকুর এবং খোলা মাঠ থাকায় ইলেক্ট্রিসিটি না থাকলেও গরমের তীব্রতা কখনো টের পেতাম না। গ্রাম গ্রাম একটা আবহ ছিল।
আমি একা একা রুমের দরজা লাগিয়ে বই পড়তাম, মোবাইলে গান শুনতাম। একই গান কয়েকশত বার করে শুনতাম। আর মাঝে মাঝে রুমের আলো নিভিয়ে বারান্দার মেঝেতে বসে কাঁদতাম। এতদিন আমার ইচ্ছা মতো কান্নার একটা জায়গাও ছিল না। আমি অন্ধকারে বসে বসে স্বপ্ন দেখতাম। যে স্বপ্ন অনেক আগেই আমার চোখের সামনেই মড়মড় করে ভেঙ্গে গেছে।সে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে মনে মনে সুপারগ্লু দিয়ে জোড়া লাগাতাম। ভাঙ্গা স্বপ্নগুলো জোড়া লাগতে গিয়েও একটা সময় কেমন যেন কর্পুরের মতো উড়ে যেত।আর তখন আমার খুব জেদ হতো। কিন্তু জেদ প্রকাশের জায়গা আমার কখনোই ছিল না।
কখনো কখনো আমি টুপুরদের সাথে ওদের বসার ঘরে টিভি দেখতে বসতাম। বিটিভির নাটক, খবরগুলো দেখতে দেখতে মনে হতো টাইম মেশিনে করে ফেলে আসা ছোট্টবেলায় চলে গেছি। যখন অপেক্ষা করে থাকতাম কখন পাঁচটা বাজবে।কখন টিভির অনুষ্ঠান শুরু হবে। পবিত্র কোরআন পাঠ, গীতা পাঠ, ত্রিপিটক পাঠ, বাইবেল পাঠ থেকে শুরু করে রাত বারটার দিকে যখন সাভার স্মৃতি সৌধের সামনে জাতীয় পতাকা দোলা শেষ হলে ঝিঁ ঝিঁ শব্দে টিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যেত, তার আগ পর্যন্ত সব কিছুই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে ইচ্ছে করত।আমার অবশ্য বেশি প্রিয় ছিল শুক্রবারে সকালে দেখানো নতুন কুঁড়ি।আমার ভাইয়ের প্রিয় ছিল কার্টুন।তা নিয়ে কখনো কারো মুখ ভার করতে হয় নি। কারণ সবই দেখার সুযোগ আছে, একটার পর একটা। রিমোর্ট কন্ট্রোল তো ছিল না যে ইচ্ছা করলেই টিভি বন্ধ করে দিব।আর ডিশও তো ছিল না যে চোখের পলকে চলে যাবপৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। টিভি থাকত শোকেসের উপরে।আর শোকেসের উচ্চতা ছিল আমাদের মাথার উপরে।
টুপুরের মা একদিন বললেন, তুমি কি রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাও?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম টুপুরদের গত মাসের বিদ্যুৎ বিল কি বেশি এলো কিনা?
টুপুরের মা আবার বলল, না, আমি মাঝে মাঝে রাতে ঘুম থেকে উঠি তো। পরপর কয়েকদিন দেখলাম তোমার রুমের দরজার নিচ দিয়ে আলো জ্বলছে। ভাবলাম বই পড়তে পড়তে বোধহয় ঘুমিয়ে গেছ। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
টুপুরের মাকে বলতে ইচ্ছে করল না রাতে যখন আমি একা থাকি তখন আমি লাইট জ্বালিয়েই ঘুমাই। আমি আসলে ঘুমাই না। ঘুমের ভারে যখন আমার চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে তখন দুঃস্বপ্নগুলো কেমন সাপের মতো ফণা তুলে আসে। আমার কোনো দুর্ঘটনাই রাতে ঘটেনি। তারপরও রাতের আঁধারকেই আমার ভয়।
ভয়ের শুরুটা তখন,যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন হঠাৎ করে থোক থোক রক্ত দেখে ভয় পেয়েছিলাম। তারপর ছোট চাচী অভয় দিয়ে বললেন, আজ থেকে নতুন যুদ্ধ শুরু হলো। নিজেকে বাঁচিয়ে চলার যুদ্ধ। এরপর একদিন মা দুম করে বলল, এখন থেকে ওড়না পরবি।এরকম উদোম গায়ে থাকিস কেন,লজ্জা করে না? মার সব কথা ঝাঁঝালো। মা সহজ করে কথা বলতেই পারে না। অথচ মা টা আমার শিশুর মতোই সরল। মার মুখে ওড়না পড়ার নির্দেশ পেয়ে সেদিন আমার খুব কান্না পেয়েছিল। নিজেকে কেমন অচ্ছ্যুত মনে হচ্ছিল। বুকের দু’পাশের ফুলে উঠা মাংসপিণ্ড নিয়ে অবশ্য আমারও বেশ অস্বস্তি লাগত। সবাই কেমন কেমন করে তাকাতো। অন্যের তাকানোর উদ্দেশ্য এবং অর্থ বোঝারও বোধহয় একটা বয়স থাকে।
বাসায় বিকাল হলেই আসত গৃহশিক্ষক। একটু বয়স্ক গৃহ শিক্ষকই রাখা হয়েছিল। কারণ অল্প বয়সী চ্যাংড়া টাইপের ছেলেগুলার বিশ্বাস নেই। প্রেম-ট্রেমের ঘটনা ঘটে মান–ইজ্জত চলে যাতে পারে।সেই বয়স্ক গৃহ শিক্ষক প্রতিদিন একটু একটু করে কি সহজে আতংকের এক অতল গহবরে ছূঁড়ে ফেলেছে আমাকে আমি তা কাউকে বলতে পারিনি।আমি মনে করতে চাই না কিছু।তবু মনে পড়ে যায়।মনে হয় এই বুঝি কোনো লোমশ হাত এগিয়ে এসে খামচে ধরেছে আমার বুকের দুপাশে ফুলে উঠা মাংসপিন্ডকে।ভয়ে, লজ্জায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
প্রথম যেদিন ওড়না পরে পড়তে বসলাম,তার কি অট্ট হাসি!তুমি ওড়না পড়েছ কেন? তুমি বড় হয়ে গেছ? হা হা হা, এই ভাবী মেয়ে তো আপনার বড় হয়ে গেছে।
সারাদিন আমি কুঁকড়ে থাকতাম। দুপুরের পর থেকেই আমার পেট ব্যথা শুরু হতো। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করতো মাকে। কিন্তু মা তো ক্ষ্যাপা শিশুর মতো। এই সমাজ যে কত কঠিন আমি ঐ অতটুকুন বয়সে বুঝে গেছি যা আমার মা এই মধ্য বয়স পেরিয়েও বুঝেছে বলে আমার মনে হয় না। কার্তিকের বিকালেই আমি সোয়েটার গায়ে দিয়ে পড়তে বসতাম। আমাকে কেউ কোনো দিন জিজ্ঞেস করেনি এই গরমে কেন আমি ভারী সোয়েটার গায়ে দিয়ে বসে আছি।
কতদিন মনে মনে দোয়া করেছি ঐ লোকটা যেন রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মরে যায়। তার হাতগুলো যেন কুষ্ঠ রোগে অচল হয়ে যায়। সে যেন নিজের হাতে পানিও খেতে না পারে।
সেই হারামজাদাটা মরে নি। হঠাৎ একদিন হার্ট এটাক করে দুম করে মরে গেল বাবা। নিজ বাড়িতেই আমরা হয়ে গেলাম আশ্রিত।আমার বোকা মা টা বুঝতেও পারল না জীবন আমাদের কতটা অসহায় করে দিল। বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে আমার একটা লাভ হয়েছে। গৃহ শিক্ষক বিদায়। আমি হয়ে গেলাম মুক্ত। আহ! সে কি প্রশান্তি আমার!
তারপর অনেকদিন আমার খুব আনন্দ নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করতো। মনে হতো একটু কষ্ট করে পড়ালেখাটাটা শেষ করতে পারলেই একটা চাকরি হবে আমার। নিজেদের ঘরে আর নিজেদের আশ্রিত হিসাবে থাকতে হবে না। আমাদের একটা ঘর হবে।ছোট্ট একটা ঘর, সুন্দর একটা ঘর...।
আমাদের ছিল যৌথ পরিবার।বাবা,চাচারা তিন ভাই। বড় চাচার তিন মেয়ে ,এক ছেলে, বাবার এক ছেলে,এক মেয়ে, ছোট চাচার দুই ছেলে। বড় চাচার মেজো মেয়ে, মানে আমাদের সীমা আপা ছিলেন যেরকম সুন্দরী, সেরকম বুদ্ধিমতী এবং সে রকম রাগী। অথচ সেই মেজো আপার বরটা ছিল চরম বদ। তার চোখের দিকে তাকালেই মনে হতো লালা ঝরছে। কি বিশ্রী রকম দেখতে! বেশ টাকাওয়ালা। নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে টাকার মূল্যায়নই আলাদা। পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা না দেখতে দেখতে টাকার প্রতি এদের একটা মোহ তৈরি হয়। টাকার ঘ্রাণ পেলে এদের আর হুঁশ থাকে না।
অনেক বড় ঘরে টাকাওয়ালার ছেলের সাথে সীমা আপার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের মাস তিনেক যেতে না যেতে আমি দেখেছিলাম সীমা আপা আমাদের বাড়িতে আসলে দরজা বন্ধ করে কাঁদত।সীমা আপা আমাদের সবার খুব প্রিয় ছিল। কান্নার পরে চোখ মুখ ফুলে থাকা সীমা আপার দিকে তাকালে আমার কষ্ট হতো। আমি বেশ বুঝতে পারতাম সীমা আপা ভালো নেই।কিন্তু আমাদের বাড়ির কারোর সেদিকে নজর দেয়ার সময় নেই। টাকাওয়ালাদের এক আধটু সমস্যা থাকতেই পারে।টাকাওয়ালারাও খুব সহজেএরকম নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের ঘরের বউ করেবিনে পয়সার দাসী বানিয়ে ঘরকেই অবাধে ব্রোথেল বানিয়েরাখতে পারে। গরীব ঘরের মেয়ের সাধ্য কি প্রশ্ন করে এরা কারা?কেন আসে? কেন আসবে? আর তাই মিথ্যা সুখের অভিনয়েধীরে ধীরে সীমা আপাও কেমন যেন বদলে যেতে লাগল।
একদিন বিকালবেলার দিকে বাড়ির সবাই গেছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে।মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। আমাদের দৌড় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত।বাড়িতে শুধু মা আর আমি।হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দ।দরজা খুলে দেখি মেজো দুলাভাই।এই অসময়ে! মা ঘুমাচ্ছিল।ডাকতে গেলাম। মেজো দুলাভাই হাত টেনে ধরে বলল, থাক না, চাচী ঘুমাক। তোমার সাথে গল্প করি।
আমি হাত সরাতে গিয়েও পারলাম না । বললাম, হাত ছাড়ুন। তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। দুলাভাই বলল, এমন তাজা ফুল এত অযত্নে থাকলে চলে! রাগে, দুঃখে চোখে পানি চলে আসছিলআমার। কিন্তু না, আমি কিছুই বলতে পারিনি। দুলাভাই বললেন, দেখো চিৎকার চেঁচামেচি করবে না, তাহলে তোমাদেরকে বাড়ি ছাড়া করতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হবে না। বাড়ি ছাড়ার কথা শুনতেই আমি একদম হজম হয়ে গেলাম।
তারপর, হু, তারপর থেকে দুলাভাই আমাদের বাড়িতে আসলেই আমার পেট ব্যথা শুরু হয়ে যেত। বুকের ভেতরটাতে চিন চিন একটা কষ্ট হতো। সারাক্ষণ মনে হতো এই বুঝি, এই বুঝি...।
আমার স্বাভাবিক জীবনটা হারিয়ে গেল। রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। ঘুমাতে গেলে মনে এখনই বুঝি কেউ আমার জামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
টুপুরের মাকে আমি কিছু বলিনি। তবে এরপর থেকে রাতে আমি লাইট বন্ধ করে দিতাম। ততদিনে শীতকাল চলে এসেছিল। বাসার পাশের খোলা মাঠে ছেলেরা কোর্ট বানিয়ে অনেক রাত অবধি ব্যাডমিন্টন খেলত। সেখানে আলো জ্বলত। তাই আমার রূম পুরোপুরি অন্ধকার হতো না। ব্যাডমিন্টনের সপাৎ সপাৎ শব্দ আমার অনেক ভালো লাগত। কারণ আমার মনে হতো আমার সাথে কেউ আছে।
অফিসে একদিন আমার বয়স্ক বস বললেন, আপনি বিয়ে করছেন না কেন?
প্রশ্নটা শুনেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।আমি বিয়ে করব কি করব না তা আমার ব্যাপার,অন্য মানুষের এত অহেতুক কৌতুহল কেন?
গলাটা একটু চড়িয়েই বললাম, আমার ইচ্ছা, কেন আপনার সমস্যা আছে?
বস খানিকটা বিব্রত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে।
বিয়ের প্রতি আমার ভীষণ ঘৃণা চলে এসেছিল মুফরাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের পর থেকে।একদিন মুফরাদের হাত ধরেই আমি নতুন করে জীবনকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। ফুটপাত ধরে মুফরাদের গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কতবার নিজেকে আমার মনে হয়েছিল আকাশ থেকে নেমে এলো ছোট্ট একটা পরী।কিছুদিনের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম আমার একার কিছু গল্প আছ।যে গল্প আমি কাউকে বলতে পারিনি সে গল্প কত অবলীলায় মুফরাদকে বলেছিলাম।একবারও মনে হয়নি মুফরাদও একটা ছেলে।এমন কত প্রয়োজন তো ওরও হতে পারে।মুফরাদের কাছে নিজেকেসমর্পন করতেও দ্বিধা হয়নি আমার একবারের জন্যও। মুফরাদ আমার এত আপন ছিল প্রায়ই আমার মনে হতো মুফরাদ বিহীন আমি একটা মৃত মা্নুষ। সেই মুফরাদ একদিন নিজের স্বার্থে আঘাত লাগায় খুব সহজে বলেছিল,তুই একটা বেশ্যা।
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ওর সম্বোধন এবং ওর মুখে বেশ্যা শব্দটা। আমি শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম ওর এমন নোংরা, অসভ্য আচরণের জন্য ওর চেহারায় কোনো গ্লানি আছে কি না দেখার জন্য।
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, না, এটা আমার একার জীবন।এ জীবনের যন্ত্রণাগুলো সবই আমার একার।তারপরও যখনআমার একার জীবনে মুফরাদের ছায়াটা পুরোপুরি ম্লান হতে গিয়েও ম্লান হয় না, তখন আমার কষ্ট হয়। কখনো কখনো জেদও হয়।
টুপুরের মা আমার জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন নাস্তা বানাতেন।আমি বাসায় ঢোকার সাথে সাথে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে সাদরসম্ভাষণ জানাতেন।যেন এতক্ষণ তিনি আমার জন্যই অপেক্ষায়ছিলেন।এই মানুষগুলো আমাকে এত ভালোবাসতেন আমি খুবঅবাক হতাম আসলে কি কোনো মানুষের পক্ষে অপরিচিত কিংবাস্বল্প পরিচিত অতি সামান্য একজন মানুষকে এতখানি অকৃত্তিমভালোবাসা আদৌ সম্ভব।
আশ্চর্য হলেও সত্যি আমিও টুপুরের মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেশুরু করেছিলাম। কখনো কখনো মনে হতো আমি হয়তো টুপুরেরমাকে আমার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। এই অনুভবহয়েছিল সে রাতে, যে রাতে ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড ভয় পেয়ে আমিচিৎকার করে উঠেছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল কেউ একজনআমার গায়ের উপর চেপে বসেছে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছেতখন টুপুরের মা তীব্র শব্দে দরজা নক করে আমাকে ডেকেছিল।আমি অনেক কষ্টে ,বুক ধড়ফড় করা ভাব নিয়ে দরজা খোলারসাথে সাথে টুপুরের মা আমাকে শক্ত করে বুকের সাথে লেপ্টেজড়িয়ে ধরেছিলেন। আমার এই ত্রিশোর্ধ্ব জীবনে এমন অভয়দিয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণার সময় কেউ কখনো আমায় জড়িয়ে ধরেনি।সারারাত টুপুরের মা আমার সাথে ছিল।ছোট্ট শিশু যেমন ভয়পেলে কুন্ডলী পাকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখেআমিও ঠিক সেভাবে টুপুরের মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।এরপরকখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারব না।
সকাল বেলা স্বাভাবিক নিয়মেই অফিসে গেলাম।আমিভেবেছিলাম টুপুরের মা হয়তো আমাকে কোনো প্রশ্ন করবে।কিন্তুভদ্রমহিলা সেরকম কিছুই করলেন না।সন্ধ্যায় অফিস থেকেফেরার পরও কোনো কৌতুহল ছিল না তার চোখে-মুখে।কিন্তুআমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল গত রাতে আমি ওনাকেডিস্টার্ব করেছি।উনি না জানি আমাকে নিয়ে কি ভাবছেন।
টুপুরের মা ড্রইং রুমে বসে জলপাই’র আচার বানানোর জন্যটুকরো টুকরো করে জলপাই কাটছিলেন। টুপুর-টাপুর দু’বোনওদের রুমে পড়ছিল।আমি খুব আস্তে আস্তে বললাম, সরি,গতকাল রাতে আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।
টুপুরের মা একটা চাপা হাসি দিয়ে বলল, সন্তান যদি মাকে ডিস্টার্বনা করে তাহলে কাকে করবে?তুমি একা ঘুমাতে ভয় পাও আমিএতদিন বুঝতে পারিনি। তাহলে রোজ রাতেই আমি তোমার সাথেঘুমাতাম।এভাবে নির্ঘুম থেকে এত কষ্ট করে চাকরি করেছএতদিন, অথচ আমি একটু বুঝতেও পারিনি।সরি তো তোমাকেআমার বলা উচিত। আহারে!আমার লক্ষী মেয়েটা!আজ থেকেতোমার আপত্তি না থাকলে প্রতি রাতেই আমি তোমার সাথেঘুমাব।
আমার চোখে পানি চলে আসছিল।আহা! আমার মা কি এমনকরে কোনো দিন বলতে পেরেছিল!
এরপর টুপুরদের বাসায় যতদিন ছিলাম আমি প্রতিরাতে নিশ্চিন্তেঘুমিয়ে ছিলাম।এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সেই নিশ্চিন্ত ঘুমেররাতগুলোতে একবারের জন্যও দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভাঙ্গেনি।
সেদিনের পর থেকে মনে মনে টুপুরের মাকে আমি মা বলেইডাকতাম।অথচ আমি ছিলাম টুপুরদের বাসার পেয়িং গেস্ট।
যেদিন বদলি হয়ে টুপুরদের বাসা থেকে চলে আসছিলাম, সেদিনআমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল খুব আপন, খুব প্রিয় কিছুহারিয়ে ফেলছি। টুপুরের মাকে সেদিন প্রথম এবং শেষবারের মতোপায়ে ধরে সালাম করেছিলাম। ভদ্র মহিলা আমাকে বুকে জড়িয়েধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি কাঁদব না। আমি কাঁদলেআমার মেয়ের অমংগল হবে না? যেখানেই থাকো জেনে রাখবেআমি সব সময় তোমার সাথেই আছি ।ভদ্রমহিলা কাঁদেন নি। শুধুআমাকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করার সময় তার চোখের পানিআমার চিবুক ছুঁয়েছে।
আমাদের খুব যোগাযোগ হতো। টুপুর, টাপুরের সাথেও অনেকগল্প হতো। টুপুরদের বাসা থেকে আসার পরও ঘুমের আর তেমনসমস্যা হচ্ছিল না। বরং কাজের ব্যস্ততা এত বেড়েছিল যেবিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসত।মাকে নিয়ে একারসংসার আমার।ভাইটা মধ্যপ্রাচ্যে আছে।বলা যায় বেশ ভালোইআছি।মাঝখানে কিছুদিন আমার অফিসের একটা প্রোজেক্ট নিয়েদেশের বাইরে ছিলাম।তখন টুপুরের মায়ের সাথে যোগাযোগেসাময়িক বিরতি ছিল।এরপর দেশে এসে একবার যোগাযোগহয়েছে।টুপুরের মা বলেছে কিছুদিনের মধ্যেই বেড়াতে আসবেআমার কাছে।
আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। কিছু অপেক্ষা এতআনন্দের হয়! আমি টুপুরের মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনেরেখেছি। একটু দাম দিয়েই কিনেছি। হালকা বেগুণী রঙের জমিনেগাঢ় নীল ফুল। যেন জারুল আর নীল অপরাজিতার মিশেল।
সেদিন বিকালে টুপুরের মায়ের মোবাইল থেকে ফোন দেখে আমিভেবেছি টুপুরের মা কখন আসবে তা জানানোর জন্যই ফোনকরেছে। কিন্তু কথা বলে দেখি অপরিচিত একটা কন্ঠস্বর।পরিচয়দিয়ে বললেন তিনি টুপুরের মামা।
তারপর যা বললেন তাতে আমাকে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় কিছুক্ষণেরজন্য। আমার হঠাৎ মনে হচ্ছিল আজ থেকে নিশ্চয়ই ইনসমনিয়াআবার আমাকে চেপে ধরবে। আবার আমার নিঃসংগ রাত গুলোতলিয়ে যাবে কৃষ্ণ গহবর অন্ধকারে। আবার সর্পিল একটা স্রোতনেমে যাবে আমার ভেতরে। আমার খুব ভয় লাগছে। খুব ভয়।
হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় চলন্ত গাড়ি যেমন করে দুমড়ে মুচড়ে যায়টুপুরের মায়ের মৃত্যু সংবাদটা আমাকে ঠিক সেভাবেই যেন দুমড়েমুচড়ে দিল। মানুষ কত সহজে মরে যায়! কত সহজে নাই হয়েযায়! টুপুরের মা আমাকে বলেছিল, আমি যেন মনে রাখি তিনিসব সময় আমার সাথে আছেন।এখনো কি তিনি আমার সাথেআছেন? তিনি কি আমার সাথে থাকবেন আগামী কাল, পরশু…?
একটা তুমুল বৃষ্টি হলে ভালো হতো। বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেআমি ভিজে যেতাম। ভিজতে ভিজতে আমি মা মা বলে কাঁদতাম।এই অসময়ে কি বৃষ্টি হবে? অফিসের জানালা দিয়ে আকাশেরদিকে তাকাই। কি খটখটে শুকনো একটা আকাশ! আহা! মা’রজন্য আমি একটু প্রাণ খুলে কাঁদতেও পারছি না!
লেখক পরিচিতিঃ
মোহছেনা ঝর্ণা
জন্মস্থানঃ লক্ষীপুর
পেশাঃ চাকরি
বর্তমান আবাসস্থলঃ চট্টগ্রাম
0 মন্তব্যসমূহ