বিপ্লব বিশ্বাসের দুটি গল্প

গল্প--১
শিল্প অথবা...

এখানে ঠাকুরের আসল- নকল একাকার করতে হয়। গাঁপথ মাড়িয়ে দুপুরখরানিতে চাঁদি ফাটিয়ে পাড়ি দিতে হয় শহুরে বাঁকপথে। সঙ্গে নিয়ে দেহঢাল। রূপবৈচিত্র‍্যে সে দেহও গিরগিটি। কখনও সে বাঘছালের শিব,কখনও দশমাথার রাবণ আবার তীরবাগানো রামও,কখনও দশভুজা তো কখনও দশমহাবিদ্যাধারী করালবদনা। আবার এসব ছাড়িয়ে পথছোঁড়াদের চমকাতে কখনও খ্যাঁকখেকানির হনু।
রামভক্ত না হলেও পেছলাগা ছোকরাদের সঙ্গে সঙ্গে পথকুকুরসবের ভক্ত তো বটেই। ঠিক যেমন এখন। হনুরঙের পাটপোশাকে দেহ মুড়ে, চারবেলায় দুমুঠো চাল ফুটোনর মেটে হাঁড়ির পাছাকালিতে মুখশ্রী গুছিয়ে ও তারই খানিক হাত ও পা তালুতে ঘষে নিয়ে চতুষ্পদ হয়ে বড়মুরির চড়াই বেয়ে ঐ যে ছোকরা চলেছে,ও শিয়ালমারা গাঁয়ের মাসাদুল। পাঁচক্লাসে তিনবার গোঁত্তা খেয়ে স্কুল ছেড়েছে। দুপুরআহারের লাপসাও বেঁধে রাখতে পারেনি ওকে। আ- বুক চোলাই গিলে গিলে ওর ভ্যানচালক বাপ যেদিন টাস করে ইন্তেকাল নিল তখন ওকেই চালকের জায়গা নিতে হল। না,ভ্যানের নয়,সংসারের।তাই নানারঙের সং সেজে সেজে এখন সে লোকশিল্পী। পি. এইচ. ডি বাগাতে উদ্যত গবেষকরা এদের নিয়েই ' গেল গেল ' কাঁদুনি গেয়ে দিব্যি ভারিছাপের কাগজসব আড়পে চলেছে। সে অবশ্য অন্যকথা। এখন মাসাদুল যাচ্ছে। থপথপিয়ে। পেছলাগা ছোঁড়াছুঁড়িরা ওর বাগানো লেজে চোরটান মারছে আর ও অনবরত খেঁকিয়ে যাচ্ছে। তাতেও না ছাড়লে বীরদর্পে হুপহুঙ্কার ছড়াচ্ছে। খিদেপেটে জবরদস্ত হচ্ছে না ধ্বনিতেজ। ওরা জ্বালাচ্ছে কিন্তু পয়সা ফেলছে না কেউ। এমনি সময়ে ডানগলিতে বাঁক নিয়েই মসজিদতলার মুখে পড়ে বেবাক চিত্তির। তা টেংরুভেংরু গবদা মিলিয়ে গোটাছয়েক তো হবেই। তার মধ্যে দুটি উপোসী এন্ট্রি পেতে একটির পেছনে খানিক গুঁতোগুতি করে ধোঁকাচ্ছিল। হনু পেয়ে ওদের সমবেত জাতরাগ চেগে উঠল। শুরু হল নানাস্বরের সমস্বর তর্জনগর্জন। মাসাদুল দু- চারবার হুপখেঁকানি মারলে ওরা টুকুন পেছটান দিলেও পরক্ষণেই ঘেউডাকে তেড়েফুঁড়ে নেয়। এভাবে মিনিটকয় চলার পর ও লক্ষ করে ছোঁড়াছুঁড়ির দল একটু পেছিয়ে থমভাবে খাড়িয়ে গেছে আর এপাশ ওপাশে বড়রাও অপেক্ষমান সব। উৎসুক খিদে ওদের মুখচোখে। এই সুযোগ ছাড়তে চায় না হনু মাসাদুল। পাশটিতে বাঁশচ্যালা একটা পড়ে থাকতে দেখেও মা- হাঁড়ির কথা ভেবে সেটি বাগিয়ে দ্বিপদী হতে চায় না সে। তাই শুরু করে নকল লড়াই। ওরা কেউ কেউ ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত বসায় খিদেশরীরে। সেও ঘুরেঘুরে খেলতে থাকে খ্যাঁকখ্যাক করে। পড়তে থাকে হাততালি এপাশ ওপাশ। সঙ্গে ঝনঝনে খুচরোও। হঠাৎই হনুশরীর থেকে চেনারক্ত টপটপিয়ে পথ রাঙাতে থাকলে শান হয় সব। হেইহুই করে তাড়ায় ওদের। মাসাদুল পয়সাকড়ি কুড়িয়ে পড়ে থাকে রক্তাক্ত। তবুও মুখজুড়ে হাসি তার। সেখানে একাকার ভাতবাসের সঙ্গে শিল্পসুষমা।



গল্প- ২ 
।। ভোজফেরৎ।।
-----------------------
প্লাস্টিক খোঁচকাঠি গুঁতিয়ে বাঁ দিকের ওপরমাড়ির দাঁতফুটো থেকে গড়দা বস্তুর খানিক ছিবড়ে বাইরে এনে সুভদ্র বলল,ধাড়ি না পাঠি কী ছিল কে জানে! আসেদ্দ মালকে কি সহজে জুত করা যায়? একে তো দাঁতের এই হাল,যা খাই আগেই ফাঁক দেখে ঢুকে পড়ে... যত্তসব! এ বয়সে অত হাউড়ের মতো না গিললেই হয়,রেলগেট ছাড়াতেই কড়কে ওঠে স্বাগতা। সঙ্গে জুড়ে দেয়,তবে যাই বল বাপু, ফ্রায়েডটা খারাপ করেনি।
তুমিও তো হাউড়ে কম নও,ওই হাইব্রিড মালই সেঁটে দিলে চারহাতা! ওটা ফ্রায়েড না দালদা- ভাত না পোলাও, কিছুই তো মালুম হল না। ওরচে আমার সাদা ভাতই ভালো, মেনু কার্ডের ভাষায় ' হোয়াইট রাইচ '। আর এঁচোড় প্রনটা দেখলে? স্বাগতা রসিকতা করে বলে,দেখলাম ভোতাশুদ্দ এঁচোড় আর চিংড়ির ' চ ' খুঁজতেও আতসকাচ লাগবে। আবার কী চাও? এ কি তোমার ঘরকত্তা পেয়েছ যে আঙুলে তেল ঘষে নখবিষ করে ভোতা ছাড়াবে? এর নাম ক্যাটারিংবাবা। কী যেন নাম? রিক্সোর বামচাকা গর্তে পড়তেই স্বাগতার উত্তর ভেঙে ভেঙে যায়, নাইট... ইন... গেল ক্যাটারার। অর্থাৎ কিনা রাতভোজের শালথালে যা পড়বে তাই কপাকপ ইন কর অথথাৎ গেলো। বুঝলে? এভাবেই সরল বাখানে সব বুঝিয়ে তেতোগেলা ঢঙে সুভদ্র বলে,আর ভাল্লাগে না শ্লা এইসব ক্যাটারিংকেচ্ছা; ফুলকো সব ভাষা মারিয়ে ঢপমাল গেলাচ্ছে সব। তাও যদি এট্টু সময় দেয়, ছোঁড়াগুলোর সব আমাশার ধাত। ঝটপট পাতে ঢেলেই ছোট ঘরে যাবে যেন। আবার ওদিকে চাটনি পড়তে না পড়তেই ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলছে পরের জন। ধুশশালা,আর কোথাও যাব না ভাবছি। বারতিনেক শ্ল্যাং ইউজ করায় সমঝাতে চায় স্বাগতা,এই কী হচ্ছে কী? ও আছে না? এরপর বলে,যেতে যে চাইছ না, উশুল হবে কীভাবে? উশুল? যে জাগাটায় সামান্য হওয়ার সে তো কবির ভাষায়,' দেখা দিয়ে যে চলে গেল.'..। রসবর্ষার কালাকাদটা কিন্তু দারুণ ছিল। গোটাদশেক মেরে দিতে পারলে তবেই তো কিছু উঠে আসত! আমার বাপু,গোলাপজামুনটা বেড়ে লাগছিল; একদম নরমেগরমে। আঁকড়া চামচেতে বাদিয়ে এট্টা টপাস করে পাতে ফেলে সেই যে হাওয়া হল,ছোঁড়াটাকে আর দেখাই গেল না গো! এদ্দূর বলে খানিক দম নেয় স্বাগতা। সুভদ্র কনুইগুঁতো মারতেই বলে, বুড়োটা এটাও লিখে গেছে গো! আচ্ছা,রবিঠাকুরের আমলে কি ক্যাটারিং ছিল? ধুর। তা থাকবে কেন! আসলে কবিরা তো ভবিষ্যৎ দেখতে পায়,তাই।
এভাবেই ইন্দিরাস্ট্যাচু পেরিয়ে ও থামে। নেমে ভাড়া চুকিয়ে দুজনে এগোতে গিয়েই হোঁচট খায়। মাঝবয়েসী রিক্সোওয়ালা একটা নকল হেউ তুলে বলে, আপ্নেদের সাথে সাথে আমারো চিপ্সে পেট্টা ভইরে গেল বাবু।

লেখক ও প্রেরক : বিপ্লব বিশ্বাস, কৃষ্টি রেসিডেন্সি,ব্লক-২,ফ্ল্যাট -৩এ,আর. ডি.-২৫,রঘুনাথপুর,কলকাতা-৭০০০৫৯।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ