বুধন তার লোক পাঠিয়ে শাসিয়ে গেছে এই একটু আগে। আজ দুপুর থেকে মেঘ মেঘ ভাব। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে সময়ের আগেই। বাপি বিকেল থেকেই ব্যালকনিতে। অনেকদিন বাদে শহরতলীকে দেখছিল দোতলার ব্যালকনিতে বসে। চারদিক কেমন দমচাপা, থমথমে, বাতাস নেই একটুও।
ভোটের ফল বেরিয়েছে গত পরশু। ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। সে বসে বসে অন্ধকার ঘনিয়ে আসা দেখল। তার বিশ্রাম পর্ব চলছে। আরো বিশ্রাম নিতে জুনের প্রথমে দার্জিলিং যাবে ঠিক আছে। এখন মনে হচ্ছে দেরি করে যাচ্ছে। তাহলে কি বুধনের লোকজন তার বন্ধ বাড়িই ভাঙচুর করত তাকে না পেয়ে? নাকি হতাশ হয়ে চলে যেত, ভাবত পালিয়েছে বাপি গায়েন।
না, বুধন নিজে ছিল না, তার সাগরেদদের পাঠিয়েছিল। কেলে মনা, ফসসা হাবু, সাধু গণেশ আর ফকির রিয়াজ। আর কেউ? আরো ছিল কেউ কেউ। সকলকে চিনতে পারেনি বাপি গায়েন। মনা হাবুরা এককালে ছিল বাপির দক্ষিণ হস্ত, এখন বুধনের সঙ্গে ঘোরে। বাকি লোকদের দেখবে কী করে বাপি, তার বাড়ির সামনের ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলছে না কদিন ধরে। বাপির মনে হচ্ছে এইটাও বুধনের কাজ। ঝামেলা করবে বলে আলো নিভিয়ে রেখেছে তিনদিন ধরে। বাপির বয়স বছর পঞ্চান্ন। ১১ বছর বয়সে, দূর উত্তর শহরতলী থেকে তার বাবা সপরিবারে এখেনে পিসির বাড়িতে শরণার্থী হয়ে এসেছিল। পালিয়ে আসা। না এলে তার বাবা খুন হয়ে যেত। সেও বাঁচত কি না সন্দেহ। বুধন তার চেয়ে বছর দশের ছোট। বুধন সেই আমল জানে না। জেনেই বা বুধনের কী হবে? বুধন বিশ্বাসই করবে না। বরং উল্টে বলে, তোমরাই নাকি নকশালদের বাড়ি দাগিয়ে দিয়েছিলে বাপিদা?
বাপি প্রাইমারি টিচার। বুধন উষা কোম্পানিতে কাজ করত, উঠে গেছে বহুদিন। বাপি ভাগ্যি হিন্দ মোটর, বেঙ্গল ল্যাম্প, উষায় ঢোকেনি তখন। এ পাড়ায় খবরের কাগজে কাজ করত অনিল কুন্ডু। উঠে যাওয়ায় গলায় দড়ি দিয়েছিল, কতদিন আগের কথা তা। বুধন কিন্তু সামলে নিয়েছে। বাপি তার পাশে ছিল বলেই পেরেছে। তার এখন রেডিমেডের ব্যবসা। আগে দোকানটা টিমটিম করে চলত। এখন সেখানে হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা ঝলমল করে। পাশের দোকানটি কিনে নিয়ে বড় একটা গারমেন্টস সেন্টার করেছে বুধন। তিনটি সুন্দরী মেয়ে আর ছজন পুরুষ কর্মচারী খাটে। হাওড়া হাট, মেটিয়াবুরুজের এ,বি,এন হাট আর হরিশা হাট থেকে রেডিমেড পোশাক কিনে এনে ডবল দামে বেচে। বুধনের সঙ্গে ঝামেলায় বাপির কপাল পুড়েছে। তার একটা ঝলমলে বিউটি পারলার ছিল। কচি মেয়েদের দিয়ে পুরুষেরও ম্যাসাজ করাত। বেশ দাম হয়েছিল পারলারটার। আর চুক্তিও হতো। তা এই জমানাতেও নিরুপদ্রবে চলছিল থানায় টাকা দিয়ে, বুধনকে খুশি করে। তবু বুধন তা সাতমাস আগে ভাঙচুর করে, তিন বিউটিসিয়ান মেয়েকে শাসিয়ে বন্ধই করে দিয়েছে পারলার । বাপির মেয়ে লাবনী চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে, এস,এস,সি, টেট। হয়নি বলে কেস করেছে যারা তাদের সঙ্গে আছে। বাপি বারণ করেছিল। কিন্তু শোনেনি। টিভিতে তাকে দেখা গিয়েছিল, সরকারের বিরুদ্ধে বলছে। বুধনের নজর এড়ায়নি। বুধন ফোনে বলেছিল, মেয়েকে সামলাও বাপিদা, টিভিতে যেন না কথা বলে, শুধু আমাদের রিলেটিব বলে ছাড়, নইলে আজেবাজে হয়ে যেত, সব্বাইকে তো কন্টোল করা যায় না।
হুঁ বুধন তার সম্পর্কিত ভাইই হয়। তার আপন পিসির খুড়তুতো ননদের ছেলে। পিসির ফ্যামিলির সঙ্গে তার ননদের ফ্যামিলির সম্পর্ক এখন ভালো নয়, তাই বুধনের সঙ্গেও বাপির এমন চোখ রাঙানি আকচা আকচি। না হলে আগেরবার তো এমন হয়নি। অনেক বছরের পুরোনো জমানা বদল হয়ে গেল, বুধন এসে তাকে বলেছিল, তোমার কোনো চিন্তা নেই বাপিদা, শুধু আর পার্টির ঝামেলায় থেকো না, বাকি সব আমার ভার, কেউ কাউকে কিছু বলবে না , তুমি আমাদের রিলেটিব, রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজাও শুধু, রবীন্দ্র সঙ্গীত, আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে...। আচ্ছা। বাপি নিশ্চিন্তই ছিল। কিন্তু এবার যে বুধনই লোক পাঠিয়ে তাকে শাসিয়ে যাবে, তা ভাবতেই পারেনি। বাবার কাছে গল্প শুনেছে সেই ৭২ সালের ভোটের পর আর কোনো উপায় ছিল না। হুমকি দিয়ে গিয়েছিল গণেশ হালদার। লাশও খুঁজে পাবে না কেউ। আসলে পুরো একটি বাড়ি পুরোনো ভাড়ায় থাকত তারা। শোনা যায় সেই বাড়ি দখল করতে গণেশ হালদার তাদের লাশ ফেলতেও পিছ পা হতো না। গঙ্গায় নকশালের লাশ ভাসানো হয়ে গেছে তখন। হালদার সেই সময় বলেছিল, কোনো চিন্তা নেই, শুধু নামগুলো দে, অ্যাড করে থানায় দিয়ে দি, রাতে দুজনে মিলে বাড়ি দাগিয়ে দেব, পুলিশকে শুধু বলে দিতে হবে কারা কারা, রক্তবীজের ঝাড়!
বাপির বাবা অজিত গায়েন বলত, দিতে হয়েছিল, না দিয়ে উপায় ছিল না।
কেন দিলে? বাপি জিজ্ঞেস করেছিল।
না দিলে আমাকেই মেরে দিত ওরা, তখন তো এই হচ্ছিল।
ওরা মানে? বাপি জিজ্ঞেস করেছিল।
বাবা বলেছিল, হিরু, অরু দুই ভাই, আমরা ছিলাম শ্রেণী শত্রু।
তারা তো এইচ,এস-এ স্ট্যান্ড করা ছেলে শুনেছিলাম।
স্ট্যান্ড করে কী হলো, হাওয়া হয়ে গেল,বিপ্লব করবে বলে বেরিয়েছিল, আরে মানুষ খুন করে হয় বিপ্লব?
১১ বছরের বাপি অনেকটা নিজে জানত। হিরু অরুর একজনের লাশ বেলেঘাটায় পাওয়া গিয়েছিল। আর একজনের খোঁজই মেলেনি। কেউ বলে আমেরিকা চলে গেছে। আর আসে না এদেশে। এখন ভালো ছেলেরা সবাই আমেরিকা যায়। না গেলে প্রমাণই হয় না তারা ভালো ছেলে। বুধন চলে যাওয়ার পর বাপি কী করবে বুঝতে পারছিল না। মেয়েকে ফোন করল, কোথায়রে তুই?
লাবনী বলল, এক ঘন্টার ভিতরে ঢুকছি বাবা।
বাপি বলল, আছিস কোথায়?
গড়িয়াহাট, একটা কোচিঙে কথা বলছি, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ব্যাংকিং সার্ভিস সিওর, ওদের সাজেশন নাইন্টি পারসেন্ট মিলে যায়,ফিফটি থাউজান্ড আরম্ভে, এক্সামের আগে ফিফটি।
হুঁ। বাপি চুপ করে থাকল। কিছু কিছু কথা মনে পড়ে গেল।
বাবা নেক্সট উইকে অ্যাডমিশন নিতে হবে, এদের হাই কানেকশন।
হবে, তুই চলে আয়, বৃষ্টিও আসতে পারে।
লাবনী বলল, যাচ্ছি বাবা, ভেব না।
চাদ্দিকে গোলমাল হচ্ছে। বাপি উদ্বিগ্ন গলায় বলল।
এখানে কিছু নেই। লাবনী বলল, ডোনট ওরি বাবা।
বাপির পিসি নেই। পিসে একেবারে অচল। বেডসোর হয়ে গেছে অনেকদিন। পিসেই তাদের নিয়ে এসেছিল, বাবা বলত। বাড়ি অ্যাটাক হবে শুনেছিল বাপির বাবা অজিত গায়েন। তাকে হালদারের লোকই এসে খবর দিয়েছিল। নকশাল হয়ে গেছে, এবার তোমাদের কাটা হবে, রতনবাবু ঘাট যাওয়ার রাস্তা কিলিয়ার করে দেওয়া হয়েছে, কেটে পড় অজুদা।
রাতারাতি চলে এসেছিল অজিত বড়দির কাছে। জামাইবাবু সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বাপির পিসেরা ছিল খদ্দর আর চরকা কাটার ফ্যামিলি। সুতরাং নিশ্চিন্ত। ক’বছর খুব কষ্ট গেছে। টিউশনি করে সংসার চালিয়েছিল বাবা। তারপরই তো বদল হয়ে গেল সব। ইতিহাস ইতিহাস! ধীরে ধীরে পিসেদের দাপট চলে গেল। পিসেও শেষ অবধি তার বাবা অজিত গায়েনের শরণাপন্ন হয়েছিল ঝামেলায় পড়ে। তাদের পতাকাতলে এসে মাথা মুড়িয়েছিল। শুনেছে বাপি। সব ব্যবস্থা ছিল তার বাবা অজিত গায়েনের। সেই পিসে এখন একশোর কাছাকাছি হয়ে জীবন্মৃত। আর পিসের ফ্যামিলি মানে পিসির ছেলেদের সঙ্গে বুধনদের ফ্যামিলির জমি ভাগাভাগি নিয়ে কেস আরম্ভ হয়েছে বছর দেড়েক। খুড়তুতো ননদ তো। একসময় সকলেই এক পরিবার ছিল। বহুযুগের ওপারে তো ছিলই। তারপর ভাগ হতে হতে......। সেই তখন থেকেই মানে দেড় বছর আগে থেকেই বুধন তার বিরোধী হয়ে গেছে। ফলস ক্রিমিনাল কেস দিয়েছে পিসির ছোটছেলে বছর ষাটের নোটনদার বিরুদ্ধে। তাকে সাক্ষী হতে বলেছিল বুধন। সে রাজি হতে পারেনি। সেই থেকে বুধনের রাগ। তোমাকে সেফ রেখেছি, তুমি কিছু করবে না আমার জন্য? পারলার বন্ধ করে দিল কেলে মনা আর ফসসা হাবুদের দিয়ে। এখন দেখা হলে কথা না বলে চলে যায়। বললেও খুব চিবিয়ে। হিমশীতল কন্ঠ বলে ওকে। ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছে বাপি। বাপি ডিটেকটিভ বই ভালবাসে। বুধনও। দুজনের ভিতরে এইটুকু মিল। আর যা সব অমিল। পিসে, নোটনদা সকলেই তার বাবার আশ্রয়ে ছিল কতকাল। তারপর তার। কোনো অসুবিধে হয়নি। বুধনরাও তাই। কিন্তু ওরা ভোটটা দিত কোনদিকে তা ঠিক ধরতে পারত না তারা, বাবা এই নিয়ে কত অনুযোগ করত। শেষে বুদ্ধি করে ভোটের আরম্ভেই ওই ফ্যামিলির সকলেরটা ফলস মেরে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ওরা ভোট দিতে এসে দেখত হয়ে গেছে। উফফ, কী সোনার দিন না গেছে বাপির। শেষে বুধন বিপক্ষ দল করলেও তার পরামর্শ নিত। না নিয়ে টিকবে কী করে? বুধন বলত, দ্যাখো বাপিদা, যাই বলো, আমি তোমাদের পক্ষে যেতে পারব না, আমাদের ফ্যামিলির রক্তে লাল নেই, সুতরাং আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
বাপির বউ, বছর পঁয়তাল্লিশের টুকুনি বলল, আমি ফোন করব দাদাকে?
না, দেখি না কী করে?
ভাঙচুর করবে, দোতলায় উঠে এলে নতুন টিভি, কম্পিউটার, ফ্রিজ...সে কি ভালো হবে?
বাপির বড় শালা হিমাদ্রি কুন্ডু কাকদ্বীপ থানার ওসি। তার চেয়ে ছোট বছর চারেকের। সে সব সময়ই শাসকদলের খুব ঘনিষ্ঠ। বেছে বেছে বিপক্ষ দলের লোককে ধরে হাজত খাটায়। বারুইপুরে প্রায় তিন মহলা বাড়ি হাঁকিয়েছে আগের আমলেই। কুন্ডু ম্যানসন এ আমলে সেন্ট্রালি এসি। হিমাদ্রি কুন্ডু তার প্রাক্তন কমরেড কাম শ্যালক। কিন্তু এখন সে কী বলবে? বলবে মিটিয়ে নিতে। কী মেটাবে বাপী? কী করেছে সে? ফলস কেসে সাক্ষী হয়নি। সে তার মোবাইলে একটা নম্বর সার্চ করতে থাকে। না, হিমাদ্রি নয়, বুধনের খুড়তুতো ভাই তোতা। তোতা হাটগাছা কলেজের ক্লার্ক। কিন্তু লোকে জানে সে “পফেসর”। ছাত্র ভর্তি সবটাই তার হাতে। নতুন টিচার এসে তার কাছে নিজের বায়োডাটা জমা দেয়। তোতা তার লোক। পাঁচ বছর আগে পালটি খেয়েছিল সরকার বদল হতেই। তোতার চাকরি তারই করে দেওয়া। বিনিময়ে কিছু নিয়েছিল সে। এখন মনে হচ্ছে, না নিলে আজ বড় মুখ করে বলতে পারত। কিন্তু চাকরিটা তো পেয়েছিল তোতা। এ আমলে তো টাকা দিয়েও নাকি হচ্ছে না। মেয়ে যে একলাখের কোচিঙে ঢুকছে , চাকরি হবে সে গ্যারান্টি কে দেবে? মেয়ে বলে এক রকম। আর শোনা যায় অন্য রকম। খবরের কাগজে ওঠে। ফোন লেগে গেল, বাজল কিন্তু ধরল না তোতা। দমে গেল বাপি গায়েন। এক লাখের ভিতর সে নিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার। বাকি পঞ্চাশ তো ওখানকার এমেলে। সেই টাকা কি তোতা তুলে নেয়নি ? অ্যাডমিশনের সময় তো টাকার স্রোত! সে একজনকে পাঠিয়েছিল, ভেবেছিল ফ্রিতে হয়ে যাবে অনার্স। হয়নি। তোতা ছাড়েনি। যা দেওয়ার দিতে হবে। ক্যাশ।
একটু বাদেই তোতা মানে দেবকুমার ফোন করল, ফোন করেছিলে বাপিদা?
হ্যাঁ রে, কেমন আছিস?
আছি, খুব চাপ, মার্জিন বাড়েনি তো, তুহিনদা রেগে গেছে জিতেও। বলল দেবকুমার, তোমরা ভাল আছ তো ?
আছি, বুঝতে তো পারিস। বলল বাপি।
তুমি এবারেও নাকি পথে নেমেছিলে জিতবে বলে ?
বাপি বলল, হুঁ, দ্যাখ তোতা, আজ এই কিছুক্ষণ আগে বুধনের দলবল এসে বলে গেছে কাল পরশু যে কোনো সময়ে ঝামেলা হবে, তুই একটু দ্যাখ।
বুধন ছিল? তোতা জিজ্ঞেস করে।
না, কিন্তু যারা এসেছিল তারা বুধনের চেলা সব, পার্টির লোক।
তোতা জিজ্ঞেস করে, নেশা খেয়ে ছিল?
কী করে জানব, আমি তো দোতলা থেকে নামিনি। বলল বাপি।
তোতা বলল, তুমি মিটিয়ে নাও বাপিদা, দেখলে তো, তোমাদের ওই জমানা আর ফিরবে না, শুধু শুধু ঝামেলা জীইয়ে রেখেছ।
আমার তো কোনো ঝামেলা নেই, বুধনই তো আমার পারলার তুলে দিল।
ওখেনে নাকি মেয়েছেলে কন্ট্যাক্ট হতো, এসব বিজনেস তো ঠিক না বাপিদা।
বাপি বলল, মিথ্যে বলেছে, ও মেয়েগুলোকে ভয় দেখাল, তারা আসা বন্ধ করল, আমি বুঝলাম আর রাখা যাবে না, ঘরটা বুধন নিয়ে নিল, লিকার শপ করবে শুনছি।
তোতা বলল, এমনি হয় বাপিদা, তুমি কি জগৎ হাজরার কথা ভুলে গেছ?
বাপি চুপ করে থাকে। মনে হচ্ছে তোতার পাশেই রয়েছে বুধন। জগৎ হাজরার দোকান দখল করেছিল বাপি বছর কুড়ি আগে। তখন ফুল ফর্মে ছিল তার পার্টি। জগৎ হাজরার রেস্টুরেন্ট ছিল ওইটি। বহু পুরোন হাজরা কাফে। টোস্ট, ওমলেট, ফিসফ্রাই, কাটলেট, মোগলাই...। ফিস ফ্রাইয়ের গন্ধ বাতাসে ভাসত। জগতের দোকানে তার শালাকে দিয়ে রেড করিয়ে, থানায় নিয়ে গিয়ে ফলস জেরা করিয়ে, নকশাল-মাওবাদি কিনা বার বার তা জিজ্ঞেস করিয়ে কাফে তুলে দিয়েছিল বাপি। তখন অভিজিৎ সিনহা নামের এক সায়েন্টিস্টকে জেরা করে করে ভয় দেখিয়ে রেল লাইনে গলা দেওয়াতে বাধ্য করেছিল পুলিস। ডায়েরিতে নাকি কার ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছিল। তখন পোটা নামের আইন এসেছে দিল্লিতে। এদিকে পোটা না থাকলেও, ধরে ধরে জেলে ভরছিল পুলিস। জগতের কাফেতে মাওবাদিদের মিটিং হয় কিনা পুলিসি জেরায় এই একটি প্রশ্নই ছিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। প্রশ্নে প্রশ্নে তাকে জেরবার করে কাফে বন্ধ করা হলো আর তা দখল করল বাপি। হিমাদ্রি খুব হেল্প করেছিল।
তোতা আমরা তো রিলেটিভ, বুধনের কি এসব করা ঠিক হচ্ছে?
বুধনকে ফোন করো না। তোতা উদাসীন গলায় বলল।
বাপ মা, চোদ্দ পুরুষ তুলে কী খিস্তি, তুই ভাবতে পারবি না।
ছেড়ে দাও, তুমি মিটিয়ে নাও।
কী মেটাব? বিরক্তি কোনো রকমে চাপল বাপি।
তোতা বলল, সে তুমি জান, দ্যাখো বাপিদা, তোমরা যা ভেবেছিলে তা হলো না, ফালতু বাজার গরম করলে, আমরা বহুত টেনশনে ছিলাম, এখন এসব একটু হবে, তুমি মিটিয়ে নাও। বলতে বলতে তোতা নিজেই কেটে দিল ফোন। চুপ করে বসে থাকল বাপি। কদিন টেলিভিশনই সব গরম করে রেখেছিল। এখন সব ঠান্ডা মেরে গেছে। টিভিতে যে খবর আসছে তা শুধু মারামারি, ভাঙচুরের। দুপক্ষেরই লোক মরছে, ঘর পুড়ছে, কিন্তু তা অনেক দূরে। জেলায়। গ্রামে গ্রামে। খড়ের চাল মাটির বাড়ি। আগুন লাগানো এই জষ্টি মাসের আগুনের দিনে খুব সহজ। বোমা ধোঁয়া, কান্না আর্তনাদ! বুধনের দল যদি সত্যিই ভাঙচুর করে কাল, কী করবে সে ? সে হিমাদ্রিকে ফোন করল। ফোন লাগল না। তখন হিমাদ্রির বাড়িতে ল্যান্ড লাইন বাজালো। একটি অচেনা কন্ঠস্বরের যুবক ধরল, ওঁরা তো পুরী গেছেন স্যার, ফিরতে সোমবার, আপনি কে বলছেন স্যার?
নিজের পরিচয় দিয়ে বাপি জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
আঁজ্ঞে আমি পবন মন্ডল, সিভিক পুলিশ, এখন বসে গেছি, স্যার আমাকে তাঁর বাড়িতে রেখে গেছেন, মোবাইলে ফোন করুন স্যার।
নট রিচেবেল হয়ে আছে।
পেয়ে যাবেন স্যার, তবে ওঁর তো পাঁচটা নম্বর, কোনটা চালু আছে বলা যাবে না। বলল সেই পবন মন্ডল।
ফোন কেটে দিল বাপি। পুরী গেল হিমাদ্রি, বলে গেল না তো? বাপি কথাটা টুকুনিকে বলতে সে বলল, অফিসের কাজে হতে পারে।
পুরীতে আবার অফিসের কাজ কী?
আসামী ধরতে যায়, এই তো সেদিন রাঁচি থেকে খুনের আসামী ধরে আনল দাদা, কাগজে দ্যাখোনি, ভুলে গেছ?
বাপি হাসল মনে মনে, বলল, আসামী ধরতে ফ্যামিলি নিয়ে যায় নাকি?
টুকুনি চুপ করে থাকল। বাপি ভাবছিল যদি সত্যি বুধন কাল সমস্ত দিন আর রাতের ভিতর কোনো এক সময় ঝামেলা করতে লোক পাঠায়, কী করবে সে ? তখন বাড়ি ফিরল লাবনী, বলল, চাকরি হলে একমাসের মাইনেও দিতে হবে বাবা।
বাপি বলল, ও দিতে হয়।
টুকুনি গম্ভীর মুখে বলল, দেরি করে বাড়ি ফিরবি না, দিনকাল ভালো না।
কী হয়েছে বাবা ? লাবনী অবাক হয়ে বাবার দিকে ফিরল।
ঝামেলা হতে পারে। বাপি বলল।
কিসের ঝামেলা ? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে লাবনী।
বাপি সব গুছিয়ে বলল। কী হয়েছে সন্ধের মুখে। লাবনী মন দিয়ে শুনতে শুনতে বলল, বুধনকাকুর সঙ্গে মিটিয়ে নিলেই তো হয় বাবা।
কী মেটাব? ক্ষুব্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে বাপি।
সে তুমিই জানো। বলল লাবনী।
মেটানোর তো কিছু নেই। বলল বাপি, এখন তো আর পার্টি বদল করা যায় না, আর আমাদের পার্টির কোনো শক্তিই আর নেই।
তাহলে খামোকা ঝামেলা করবে কেন?
বাপি বলল, তোকে কি কেউ কিছু বলে আর?
আমি বলেছিলাম তুমি ভুল শুনেছ বুধনকাকু, আমার মতো আর একজন, আমি ওসবে নেই, আমি ওদের বিপক্ষে। বলতে বলতে লাবনী হাসতে লাগল, এমন ভাবে বললাম যে বিশ্বাস করে নিল, বলেছে কোনো ঝামেলায় পড়লে তাকে যেন ফোন করি।
বিশ্বাস করবি না, বুধনের সাগরেদ ফসসা হাবু একটা রেপ কেসে জড়িয়ে গিয়েছিল, জানিস তা? বলল বাপি, নজরে রাখছে ওরা মনে রাখবি।
জানি বাবা, খালপাড়ে একটা চোদ্দ বছরের মেয়েকে, কাগজে উঠেছিল, আমার বয়স তখন বারো, বুঝতাম, তুমিই ওকে বের করে এনেছিলে রেপ কেস থেকে।
বাপি চুপ করে থাকে সামান্যক্ষণ, তারপর বলে, এমন অকৃতজ্ঞ যে সে-ই বেশি মুখ খারাপ করেছে আজ। বাপি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, ওর তো আজ জেলে থাকার কথা, কিছুই মনে রাখেনি।
জানি আমি, ওকে দেখলে একটু অস্বস্তি হয়। বলল লাবনী। টিভি খুলে দিয়ে এভারেস্ট অভিযাত্রীদের মৃত্যু সংবাদ দেখতে লাগল। হারিয়ে গেছে বরফের রাজ্যে। হিমশীতলতার ভিতর। তুষারাবৃত হিমালয়ে এখন বৃষ্টি আর ঝড় চলছে। উদ্ধারকাজ থমকে আছে। লাবনী নিশ্চুপ চেয়ে আছে টিভির পর্দায়। কেমন নিরুত্তাপ, যেন কিছুই ঘটেনি। বাবার উদ্বেগের কোনো মানে নেই। সে এই সব ভোট নিয়ে নিরুত্তাপ।
কোনো কিছুই ভাল লাগছিল না বাপির। সে ব্যালকনিতে গিয়ে বসল। তখন একটা ফোন এল। অচেনা নম্বর। কার ফোন? হ্যালো, হ্যালো...।
লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে। এর মানে কি তাকে ফোন করতে বলা? ইস,অচেনা নম্বরে সে ফোন করবে কেন? যদি বুধনের ফোন হয়? আবার তাকে সাক্ষী হতে বলে। অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেস। পিসের ছেলে নোটনদা হকি স্টিক দিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেলেছিল নাকি শ্যামল সাহাকে। কোনো রকমে বেঁচে গিয়েছে সে। শ্যামল হলো বুধনের ভালো নাম। বাবা বলত, পিসে না আশ্রয় দিলে নাকি তারা কেউ বেঁচে থাকত না। কতদিন পিসেকে দেখতে যায়নি সে? বাসে তিনটে স্টপেজ, রিকশায় কুড়ি টাকা, অটোয় দশ । বাপির মনে হলো এখনই যায়। পিসের ছেলে নোটনদারা এখনো পুরোন চরকা খদ্দর। আসলে কিছুই না। ভোটের সময় বাপি তাকে রাস্তায় নামাতে পারেনি জোটের হয়ে। আসবে বলেও আসেনি। সে যেতেই পারে। কিন্তু তা জানতে পারলে কি বুধন আরো ক্ষেপে যাবে, নোটনের বিরুদ্ধেই তো তার মামলা। বুঝতে পারছে না বাপি। সে ফোন করল নোটনদাকে।
কে? খুব ম্রিয়মান কন্ঠস্বর।
আমি বাপি বলছি নোটনদা। বাপি শান্ত গলায় বলল।
আমার জ্বর, ভাইরাল, খুব হচ্ছে, সাবধান।
কথা বলা যাবে?
বল, কেমন আছিস, ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হয়নি তো ?
হয়েছে। বলল বাপি।
ক’দিন সাবধানে থাক। বলল নোটনদা, আস্তে আস্তে পুকুরের জল থির হয়ে যাবে, তরঙ্গ উঠেছে শুধু।
বাপি বলল, এত করেও হলো না নোটনদা।
দুর লোকে কি বুদ্ধু, অন্য কথা বল।
বাপি তখন সন্ধের কথা বলতে লাগল। ওপারে হুঁ হাঁ করতে লাগল প্রায় বৃদ্ধ নোটনবাবু। তারপর বলল, বুধনের সঙ্গে মিটিয়ে নে বাপি।
কী মেটাব? বাপি ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে।
সে তুই জানিস। বলল নোটনদা।
তুমিও তো জান নোটনদা।
বলছি মিটিয়ে নে। বলে নোটনদা ফোন কেটে দিল।
চুপ করে বসে থাকল বাপি গায়েন। রাত হলো। এই আধা মফস্বল আধা কলকাতা শহর অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। মেট্রো রেল, খালপাড়, নয়াবসত সব গমগম করে। ভিতরে এসে টিভি খুলে দিল বাপি। মেয়ে তার ঘরে ল্যাপটপে বসে গেছে। টিভি খুলে বিজ্ঞাপনে বুলেট, জাপানি তেল দেখতে দেখতে তার মনে পড়ল পিসে এখন কেমন আছে জিজ্ঞেস করা হলো না। ফুরিয়ে গিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে বুড়ো। আবার ফোন করবে নাকি? তা হয় না। বরং কাল গিয়ে দেখে এলে হয়। কতদিন, তা প্রায় বছর কেটে গেছে, বেঁচে আছে তো? গা ছ্যাঁত করে উঠল। এই সেদিন সে টুকুনির মাসির খোঁজ করছিল। বিলাসপুর থাকেন। গেলে হয় আর একবার।
মাসি তো নেই, ভুলে গেছ তুমি? মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছিল টুকুনি। সত্যি সে ভুলেই গিয়েছিল। সব কথা তো মনে রাখা যায় না। যা মনে রাখতে চায় না লোকে, তা আপনা-আপনি ভুলেই যায় সে। টুকুনির মাসির বেঁচে থাকা না বেঁচে থাকায় তার কী আসে যায়? সেদিন খবরের কাগজে দেখল সিউড়ির অম্বিকা দত্তর মৃত্যু সংবাদ। দাপুটে মন্ত্রী ছিলেন। আন্দোলনকারী ডাক্তারদের খুব পিটিয়ে ছিলেন পুলিস দিয়ে। তাদের ইউনিয়ন ভেঙে দিয়ে নতুন ইউনিয়ন গড়ে পার্টিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। একটাই ইউনিয়ন থাকবে, আর কোনো না। এই তত্ব তাঁর ছিল। অফিসে অফিসে তাই হতে লাগল। সেই অম্বিকা যে বেঁচে ছিল তা জেনেই অবাক হয়েছিল সে। কত মানুষ বেঁচে থেকেই হারিয়ে যায়। সে টুকুনিকে জিজ্ঞেস করল, পিসে বেঁচে আছে তো?
কেন বলো দেখি, খবর পেলে?
না, মানে আমরা তো অনেকদিন যাই না। বাপি বলল।
বেঁচে তো থাকার কথা।
বলা যায় না, নাইন্টি ফাইভ হয়ে গেছে, বিছানায় শুয়ে আছে বহুদিন।
যেতে তো পারো, যাও না কেন? তোমাদের তো একসময় করেছেন অনেক। বলল টুকুনি, খোঁজ তো নেবে।
আমার মনে হচ্ছে শুনেছিলাম যেন! বিড়বিড় করল বাপি গায়েন।
কী শুনেছিলে? টুকুনি জিজ্ঞেস করে।
তখন একটা ফোন এল অচেনা নম্বর থেকে। ফোনটা হিমাদ্রির হতে পারে। হয়তো ওর ফাইফরমাস খাটা বেকার সিভিক পুলিস খবর দিয়েছে স্যারকে। নোটনদার হতে পারে, পিসে হয়তো এখনই...। অন্য কারোর হতে পারে। ফোনটা বুধনেরও হতে পারে। কিংবা কেলে মনা, ফসসা হাবু...। হিরন্ময়, অরুময় দুই ভাই কিংবা জগৎ হাজরা, তোতা, খালপাড়ের সেই কচি মেয়েটার হতে পারে যাকে ফসসা হাবু রেপ করে ধরা পড়ে বেঁচে গিয়েছিল তার হাত-যশে। সবাই যেন আচমকা শ্মশান কবর থেকে উঠে এসেছে। তার সমুখে ফোন বাজতেই থাকে...... দূরে কোথায় দূরে দূরে......। আরো অনেকদূরে লাউড স্পিকারে বাজছে, আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে......। গত ছমাস ধরে তার মেয়ের ফোনের রিং টোনে প্রতিমাসেই নতুন গান। মাঝখানে কিছুদিন একটা মিউজিক বাজত। মেয়ে বলেছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানাল। সে তার এত বছরের জীবনে আগে ওসব শুনেছে কি না মনে পড়ে না। মেয়ে বলেছিল বুধন আঙ্কেলের কাছ থেকেই সে নিয়েছিল হোয়াটস আপে। মোবাইল ফোন বেজে যেতেই থাকে। কে, কে ফোন করল তাকে? তখন তার সেই চব্বিশ বছরের মেয়ে লাবনী মায়ের কাছে এসেছে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে। মোবাইল বাড়িয়ে মাকে বলল, কটা ছবি তুলে দাও দেখি এই বারমুডা আর টিশার্টে।
কী হবে? টুকুনির ম্রিয়মান কন্ঠস্বর।
ও তুমি বুঝবে না মা, বাবাকে ভয় পেতে মানা করো। লাবনী তার উন্মুক্ত উরু প্রসারিত করে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। বাপি চোখ ঘুরিয়ে নিল।
2 মন্তব্যসমূহ
দারুণ
উত্তরমুছুনখুব ভাল।
উত্তরমুছুন