উপন্যাস লেখা নিয়ে কথা

আগামীকাল এরকম ভেবেছিলাম - 
অরিন্দম বসু

আমার কিশোর বয়সে সাইকেল নিয়ে মাঝে মাঝেই একটা জায়গায় চলে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এ গলি সে গলি দিয়ে কবরডাঙার মোড়। সেখান থেকে বাঁদিকে সোজা নেপালগঞ্জ। আরও ছাড়িয়ে গেলে জুলপিয়া। সাইকেলে যেতে যেতে খ্রিস্টানদের গোর দেওয়ার পাঁচিল ঘেরা জায়গা, মাছের পাইকারি বাজারের আঁশটে গন্ধ,—মিশনারি স্কুল, ছোটো ছোটো বাড়িঘর, পুকুর, ধানের গোলা, খালের উপর বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো—এসব দেখতে পেতাম। দেখতে দেখতে হঠাৎ গাছপালার আড়াল পেরিয়ে আস্ত একটা মাঠ ভেসে উঠল চোখের সামনে।

তার আগে হয়তো একটা ছোট্ট ডোবা । সেখানে কাদায় পোঁতা বাঁশের মাথায় নিবিষ্ট মনে বসে আছে মাছরাঙা। ওই সবুজ মাঠটা দেখে মনের ভেতরে আকুলিবিকুলি। একধারে গোছা গোছা শরগাছ হাওয়ায় দুলছে। মাঠ পেরোলেই ধানখেত। তার সবুজ নানারকমে। আরও ওপারে গুমোট কিছু গাছের ছায়ায় গোটা কয়েক মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। তার চেয়েও দূরে কয়েকটা তালগাছ ফেলে ইচ্ছে করেই একটু সরে দাঁড়িয়ে। 

গোড়ায় যখন এসব দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছে আমাদের বাড়ির কাছেই এরকম একটা জায়গা, অথচ আমি জানতামই না। কী আশ্চর্য! ভাগ্যিস এতটা এসেছিলাম। ওই গাছপালার আড়াল অব্দি এসে যদি দম ফুরিয়ে ফিরে যেতাম? এই আবিষ্কার করতাম কী করে! পরে যতবারই গিয়েছি, মনে হয়েছে, ওঃ এ কী আনন্দ! যেন আমি দেখব বলেই এই মাঠ, খেত, বিকেলের আলো, নীল সন্ধেবেলা অপেক্ষা করেছিল। 

লিখতে এসে মনে হল—উপন্যাস এইরকম। 

দু'হাজার সালে কুম্ভমেলায় গিয়েছিলাম। এলাহাবাদে। একদিন ভোরবেলা তাবু থেকে বেরিয়ে দেখি কুয়াশা সবকিছু মুছে দিয়েছে। বালির ওপর দিয়ে আন্দাজে আন্দাজে হাঁটছি। আচমকা এক হাতের মধ্যে কুয়াশার ভেতরে ফুটে উঠল একটি ট্রাকের হেডলাইটের হলুদ আলো। সঙ্গে ওজনদার হর্নের আওয়াজ। গান আমার কাছে এইরকম। লেখার কুয়াশায় ভেসে ওঠা কোনও অতিকায় চোখ। ভালো বাংলায় বললে দৃষ্টি, যা লেখকের মনে শিরশিরানি জাগিয়ে তোলে। পরে পাঠকেরও। 

উপন্যাসে গিয়ে বুঝলাম এ এক আদিগন্ত ব্যাপার। পায়ের নিচে ঘাস, মাথার ওপরে আকাশ, গায়ে খোলা বাতাসের ছোঁয়া আর চারপাশে যা সব ছড়িয়ে রয়েছে তা যেন খুঁজে পাওয়ার শেষ নেই।

সাতানব্বই সালে আমার প্রথম উপন্যাস “খেলাঘর” ছাপা হয় শারদীয় আনন্দলোক পত্রিকায়। বিমল করের আগ্রহে ও উদ্যোগে তা প্রকাশ পেয়েছিল। যদিও সেই উপন্যাস লিখেছিলাম তার এক বছর আগে। লিখতে বলেছিলেন রমাপদ চৌধুরী। সেই সময় বিমল করও আর একটি উপন্যাস লিখতে বলেন। দুটি উপন্যাসের একটিও ছিয়ানব্বইয়ে প্রকাশিত হয়নি। কেন হয়নি তা আপাতত বলার দরকার নেই।

উননব্বই থেকে আমি নাড়া বেঁধেছিলাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। উপন্যাস লিখতে হবে শুনেই তার কাছে ছুটলাম। কী নিয়ে লিখব? তিনি বললেন, নিজেকে নিয়ে। প্রথম উপন্যাস নিজকে নিয়েই লিখতে হয়। তোমাদের পুরনো বাড়ি, পরিবার, সম্পর্ক, তোমাদের বাড়ির দরজাটার খিল, তোমার পাড়ার চায়ের দোকান—এসব তো জানো। তার ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে, রহস্য আছে, ম্যাজিক আছে। এসব নিয়ে লেখো। পৃথিবীর প্রথম উপন্যাসগুলো খেয়াল করে দ্যাখো, এভাবেই লেখা হয়েছে।

তারপর থেকে এ যাবৎ কাল অব্দি আমার উপন্যাসের সংখ্যা কম। সাতটি। বেশি লিখতে ভাল লাগে না। তাছাড়া বছর বিয়োনিদের যা কষ্ট। দেখছি তো! তবে উপন্যাস লিখতে লিখতে মনে হয়েছে উপন্যাসের বিস্তৃতি সেই লেখার ভেতরের ব্যাপার। দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। মানে, বলতে চাইছি, কোনও ছোটো উপন্যাসও তার ভেতরে ভেতরে এত ছড়িয়ে থাকতে পারে যা পাঠককে অবাক করে দেবে। অনেকটা যেন উলের গোলা। দেখতে ছোট, প্যাঁচ খুলতে শুরু করলে মনে হবে ভেতরে এত ছিল! তার মানে অবশ্য এই নয় যে ছোট উপন্যাস মহৎ আর বৃহৎ উপন্যাস গাজোয়ারি গোছের ব্যাপার। আসলে উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে চিন্তার ওই ভেতরে ভেতরে বেড়ে ওঠাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আরও একটি ভাবনার কথা বলা দরকার। লক্ষ করে দেখেছি এক ধরনের উপন্যাস লেখা হয় যা নিছকই ব্যক্তি মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প। অর্থাৎ সেই উপন্যাসের পত্র-পাত্রীরা ভাবছে--এ-হচ্ছে আমার সমস্যা, এই হল আমার জীবন। নাগরদোলায় চড়েছি। সুইচ টিপে থামালেই টুক করে নেমে যাব। লেখক ভাবছেন এই হল গিয়ে আমার লেখা। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, এমন অনেক লেখা বহুকাল ধরে গোটা পৃথিবীতে লেখা হয়ে চলেছে। অন্য এক ধরনের লেখার কথা বলতে পারি যার গোত্র আলাদা। সেখানে ওই নাগরদোলাটি যে বাতাসে ঝাঁপ দিয়ে আবার ভেসে উঠছে সেই বাতাসও একটি চরিত্র। যে শূন্যের ভেতরে তার ওঠানামা সেই শূন্যতা আর তার ফাঁকটুকু ভরে উধাও উপন্যাসের উন্মোচনের বিষয়। আমার দেশ-মাটি-জল-হাওয়ায় আমি বেড়ে উঠেছি, তার সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক যেমন সত্য তেমনই এই বিরাট পৃথিবীর ঘটনা-দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনও এক অদৃশ্য সুতোয় আমিও বন্ধ রয়েছি-- এও সত্যি। এমনই যে সময়কে চোখে দেখতে পাচ্ছি তা পর মুহূর্তেই অতীত। আর ভবিষ্যৎ কেবলই তৈরি হয়ে চলেছে। কাল অথবা মহাকাল--যা-ই বলি না কেন, সেখানে লেখার চরিত্রকে দাঁড় করিয়ে দেখানোই উপন্যাস। চিন্তার তরঙ্গ দেশ-কালের সীমানা জানে না। সে ছুটে বেড়ায় অন্য এক তরঙ্গের খোঁজে যার সঙ্গে তার মিল আছে। এভাবেই এক সময়ে এক দেশের রূপকথার সঙ্গে অন্য দেশের রূপকথা মিলে গিয়েছে। আর এই সময়ের পৃথিবীতে এ হল বড়ো সত্য। দ্বিতীয় গোত্রের উপন্যাস একে অস্বীকার করতে পারে না। মনোহর কঁহানিয়া পারতে পারে। উপন্যাসের লেখক হিসেবে আমি ওই দ্বিতীয় গোত্রে থাকতে চাই। 

প্রথম উপন্যাস লেখার সময় থেকেই এই ভাবনা আমার মনে কাজ করতে শুরু করেছিল। সেখানে ‘খেলাঘর’ নামের বাড়িটিই প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। চার-পুরুষের সম্পর্ক, অজস্র মানুষ, বিচিত্র চরিত্র যাওয়া আসা করতে থাকে খেলাঘরের ইতিহাস ও ভূগোলের মধ্যে। কাহিনি শুরু হয় উনিশশো চুয়াত্তর সাল থেকে। তারপর তা চলে যায় উনিশশো পাঁচ সালে। পরে বিয়াল্লিশ। আবার পঁয়ষট্টি। তারপর তা গড়াতে থাকে। ফলে কাল ও সময় উলটেপালটে যায়। থাকে শুধু বহমান জীবন ও তার সঙ্গী ওই আশ্চর্য বাড়ি। 

দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মহাজাতক’-এ আমার ওই ভাবনা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে সেখানে দুটি স্পষ্ট পটভূমিতে ভাগ হয়ে যায় উপন্যাস। একটি নয়ের দশকের শেষ দিকের কলকাতা, অন্যটি তেরো শতকের ওড়িশার বৌদ্ধবিহার রত্নগিরি। উপন্যাসের মূল পাঁচটি চরিত্র, পাঁচ যুবক এক সময় থেকে পৌছে যায় অন্য সময়ে। দর্শন যখন হেরে যায়, ধর্মচার জয়ী হতে থাকে, মারণাস্ত্র যখন পৃথিবীর ভবিষ্যতের ওপর ছায়া ফেলে তখন মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে গিয়ে লিখে ফেলেছিলাম ওই উপন্যাস। রত্নগিরি সংঘের শিল্পী ভবিষ্যৎ বুদ্ধের মৈত্রেয় মূর্তি গড়েছেন কিন্তু পাথরের সেই মূর্তির মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি। আমাদের এই সময়ে, আমাদের এই দেশে ‘বুদ্ধের হাসি’ বলে যা চালানো হয় তাকে রেখেছিলাম কল্পনার পাশাপাশি । ইমাজিনেশন মানে নিশ্চয়ই শুধু একটি কাহিনি বানিয়ে তোলা নয়। কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে তৃতীয় আর একটি কিছু গড়ে ওঠাই শিল্প। তাছাড়া লেখা হল কচুরিপানায় ভরন্ত পুকুর। ওপরে বেগুনি ফুল, পুরুষ্ট সবুজ পাতা। তলায় ডুব দিলে শিকড়। মাটির সঙ্গে সম্পর্ক নেই অথচ জীবন্ত ভাসমান বাগান। রহস্যময়। এখন কে ওপরটা দেখবেন, কে ডুব দেবেন—তা পাঠকের ব্যাপার।

বেহালার বড়িশা একটি প্রাচীন জনপদ। সাবর্ণ চৌধুরীরা তো বিখ্যাতই। সেখানে এক বন্ধুর বাড়ি যেতাম আড্ডা দিতে আর তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। ওখানেই একজনের সঙ্গে আলাপ হল যিনি নিজেকে তান্ত্রিক বলে দাবি করেন। পাড়ার পুরনো কাগজপত্রের বিক্রির দোকানে খবরের কাগজ বেচতে গিয়ে একতাড়া ইংল্যান্ড লেটার পেলাম। লেখক জয়গুরু। এসবই নিশ্চয়ই মনের ভেতরে রয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় উপন্যাস ‘সূর্যোদয়ের আগে’ লিখতে গিয়ে দেখলাম এসবই সেখানে চলে আসছে। বই হয়ে বেরোনোর সময় অবশ্য তার নাম পাল্টে হয়ে যায় “একটি প্রজাপতির জন্ম।” 

যাইহোক, এই লেখাটিতে আসার ভাবনা আমাকে নিয়ে লোফালুফি খেলল বলা চলে। এত কিছু ঢুকে পড়তে লাগল যে মনে হল সুতো তো ছাড়ছি, গোটাতে পারব তো ? নিখিলেশ ও সুদত্তা নামের এক দম্পতির সাধাসিধে জীবন দিয়ে কাহিনির শুরু। সুদত্তার সস্তান আসছে। এই একদিন মায়ের ভেতর থেকে শিশুটি একটি প্রশ্ন পাঠায়--কেন আমি জন্ম নেব এই পৃথিবীতে। ভাবতে গিয়ে দেখলাম মেদিনীপুর টাউন, বড়িশা, তান্ত্রিক, ও তার বাঙালি জাগরণের স্বপ্ন, মস্তান, প্রোমোটার, প্রতিভাবান এক পাগল, উত্তর কলকাতা, নিখিলেশের চাকরির বিপন্নতা, সংবাদপত্রের অফিস, স্বাধীনতা সংগ্রামী, প্রেম, খুন, জিন, ক্লোনিং, ভেঙে যাওয়া যৌথ পরিবার, কারগিলের যুদ্ধ, এমব্রায়োলজিস্ট, মহাভারতের অভিমন্যু, নিউ ইয়র্কের ফার্টিলিটি সোসাইটির সেমিনার এমনকী মায়া সভ্যতা অব্দি ঝাঁপিয়ে পড়ে তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। তারপর মনে হল এসবই এই উপন্যাসের দাবি। আমি তো সেই বিস্তারই চেয়েছি যেভাবে কোনও গান বা ছবি মাথার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে, বাসা বাঁধে। আমি তো পাঠককে ডিসটর্ব করতে চাই। একথা জেনেও যাই যে-কোনও লেখার পাঠ যদি কোনও পাঠককে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় তাহলে তিনি সেই লেখা ও লেখকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারেন। কাজেই এই উপন্যাসে আমি আমার সমস্ত ভাবনাকে সাজিয়ে নিয়েছি।

এখানে আর একটি কথা বলতে চাই। অনেকে বলেন আমার গদ্য তাদের পড়তে ভালো লাগে। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট হয়ে ওঠার দাবি করব না। সে যোগ্যতাও আমার নেই। তবে এটুকু মনে হয় যে, গদ্য পাঠকের হাত ধরে তাকে লেখার ভেতরে নিয়ে যায়। তা না হলে তো অভিযান শুরুতেই খতম। গল্পে তো নিশ্চয়ই, উপন্যাসে এ কথা আরও বেশি করে খাটে। গল্পে খুব ভাল কিন্তু সেই একই লেখক উপন্যাসের গদ্যে হোঁচচট খাচ্ছেন—এও দেখেছি।

উপন্যাসের ভাবনা নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন তার ফর্মের দিকটাই বা এড়িয়ে যাই কী করে। বাংলা গল্পে ফর্ম নিয়ে পাকা বা আনাড়ি হাতের কাজ অনেক হয়েছে। উপন্যাসে তা কম। বিশেষ করে গত সাত-দশ বছরে তা খুবই কম। একেবারেই হয়নি তা কিন্তু বলছি না। এই অব্দি পড়ে কেউ ভাবতে পারেন—ওঃ, লিখেছে তো সাকুল্যে সাতটা উপন্যাস, তার আবার এতরকম কথা। ভাবলে তাঁর দোষ নেই। আমারও নয়। অন্তত গড়ে তেইশখানা উপন্যাস না লিখে ফেললে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না তা আমি মনে করি না। কেননা আমি বলতে চাইছি, কখনও কখনও উপন্যাসের বিষয় বা ভাবনাকে ধারণ করতে গিয়ে ন্যারেশনের বা বলার চালু ছাঁচ ভেঙে ফেলতে হয় লেখককেই। যদিও এই ব্যাপারটার অনেক বস্তাপচা অনুসরণ আছে তবে আমি সে কথা তুলব না।

উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে মনে হত আধুনিক সময়ের কোনও বিষয়কে একেবারে প্রাচীন সাধু গদ্যে লিখলে কেমন হয়। “তিন্তিড়ীনগরের উপাখ্যান’ লেখার সময় আমি তা ব্যবহার করলাম। বিশেষ করে বলা দরকার—ওই গদ্যের পিঠে উপন্যাসটির ভাবনা সওয়ার হয়েছিল। দশ-পনেরো বছর আগেও কলকাতার পাড়াগুলোর যে চেহারা ও চরিত্র ছিল তা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে প্রোমোটিং ও বাংলা সিরিয়ালের মতো শিল্পবিপ্লবের এসে পড়ার পর। অনুসারী শিল্প হিসেবে থিমপুজো, মদ্যপান ও মস্তানি তো রয়েইছে। ফলে বাঙালির কালচার জেগে উঠল, সংস্কৃতি তলিয়ে গেল। এই উপন্যাসে একটি ছেলে তিন্তিড়ীনগরে এসে উপস্থিত হচ্ছে বছর দশেকের অনুপস্থিতির পর। ওই এলাকার ছেলেদের নিয়ে সে একটি নাটকের দল তৈরি করেছিল। সেই ছেলেরা এখন কেমন আছে তা খোঁজ নিতেই তার আসা। সেই খোঁজই এই উপন্যাস। লেখাটি অসংখ্য প্রবাদ, প্রবচন, ছড়া,লোকশ্রুতি, উপকথা, জনশ্রুতিতে ভরপুর—যার সবই শুধুমাত্র এই উপন্যাসের জন্য তৈরি। অন্য কোথাও মিলবে না। এমনকী এই উপন্যাস যে আমার লেখা সেকথাও বলা নেই। যা বলা আছে তা হল—পার্থপ্রতিম নামের একটি ছেলে ‘’তিন্তিড়ীনগরের উপাখ্যান” নামে একটি বই লিখেছিল। তার প্রকাশক বঙ্গীয় সাধুগদ্য ও সাধুসঙ্গ পুনরুজজীবন সমাজ। সেই বইটি আমি হাতে পেয়েছি। এবং তা নতুন করে ছেপেছি। যদি কেউ পড়ে এই আশায়। 

আসল কথা হল কখনও এমন ঘটনা ঘটতে পারে, লেখক উপন্যাসের বিষয় হিসেবে যা ভেবেছেন তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করতে গিয়ে সহজপাচ্য করে ফেললেন অথবা তা গুরুপাক হয়ে গেল। চিন্তা ও ভাবনার পাগলামি যে লেখকের লেখায় রয়েছে তিনি নিজে সবচেয়ে ভালো জানেন যে কতখানি সিস্টেমের মধ্যে থেকে তিনি ওইভাবে লেখাটিকে বেঁধেছেন। যে উপন্যাসটির কথা বললাম তা লিখে আমি বিষয় ভাবনাকে এলেমেলো করে দিতে চেয়েছিলাম। সেইসঙ্গে প্রচলিত ন্যারেশনের বাঁধনকেও৷

আগেই বলেছিলাম যে রমাপদ চৌধুরী ও বিমল কর দুজনেই একসঙ্গে আমায় দুটি উপন্যাস লিখতে বলেছিলেন। তার মধ্যে ‘খেলাঘর’-এর কথাও আগে বলেছি। ওই একই বছরে লেখা আর একটি উপন্যাস ‘অমল গুপ্তর গুপ্ত জীবন’। লেখাটি তারপর থেকে পড়েই ছিল। দু'হাজার এক সালের পর থেকে সেই উপন্যাস বদলে যেতে থাকে। আমি দেখতে পাই যে সে লেখার বিষয় ও ভাবনা অন্য চেহারা নিচ্ছে। নিজে নিজে। এবং তা আমার হাতের বাইরে। 

এক লেখককে নিয়ে এই উপন্যাস যিনি তাঁর রোজকার জীবনযাপনের ভেতরে বোধ, মেধা, দর্শন ও অনুভূতি দিয়ে বুনে চলেন তাঁর লেখার আশ্চর্যজগৎ। বারবার নিজেকে বদলে নিয়ে একই জীবনের মধ্যে স্বাদ পেতে চান বহু জীবনের। এমনকী জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি চলে যেতে চান অন্য কোনও কোষে, অন্য কোনও শরীরে। আকাঙক্ষা, নতুন করে যদি সব শুরু করা যায়, এজন্য তিনি বেছে নেন তার চেয়ে অনেক ছোটো এক নবীন লেখক ও তার স্ত্রীকে। যেদিন তাঁর মৃত্যু হবে সেই মুহূর্ত থেকে তিনি অন্যপ্রাণ হয়ে ফিরে আসতে চান। প্রথম যখন লিখি তখন এই উপন্যাসের বিষয় ছিল ভিন্ন। পরে লেখার সেই অংশটুকু রইল বটে কিন্তু বিষয় পুরোপুরি বদলে গেল। একটি উপন্যাসের ভেতর থেকে আর একটি উপন্যাসের জন্ম হল। অবাক হয়ে দেখলাম আমার লেখা হয়ে উঠল সেই লেখকের মতো যিনি বারবার নিজেকে বদলেছেন।

জীবন যত অনিশ্চিত, লেখাও ততটাই। লেখক তাকে নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ের মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করেন। বেশিরভাগই পেরেও থাকেন। আগে থেকে তুলে নেওয়া, শেষ অব্দি ভেবে নেওয়া লেখায় এরকমই হয়। কিন্তু মস্তিষ্কের সূক্ষ্মতম কোনও কোষের খেলায় কোনও লেখা যদি এমন কোনও দিকে বাঁক নেয় যা লেখক খানিক আগেও ভাবতে পারেননি— তাহলে ? পাঠক তার সামনে পড়ে দিশেহারা হয়ে যেতে পারেন কেননা লেখক নিজেও তো তা-ই হয়েছেন। তবে লেখার কষ্ট, আনন্দ, পেরে ওঠা বা আছড়ে পড়ার সবটুকুই লেখক সেখান থেকেই পাবেন।

একটি মেয়ের জবানিতে দীর্ঘ একটি লেখা এখন লিখছি যেখানে তার জীবনই উপন্যাসের বিষয়। আমাদের শহরতলিতে কয়েক বছর একরকমের বদল হয়ে চলেছে যাতে ক্রমশ জমির মালিকানা পাল্টে যাচ্ছে। মাঠের পর মাঠ, জলাভূমি, ভেড়ি, ধানখেত, আলুখেত, কপিখেত নিঃশব্দে দখল হয়ে যাচ্ছে। যারা জমি বেঁচে দিচ্ছে বা দিতে বাধ্য হচ্ছে তারা শহুরে সমাজে হারিয়ে যেতে চাইছে। শহরও তাদের গ্রাস করে নেবেই। এও আমার অন্য এক উপন্যাসের বিষয় হয়ে উঠতে চলেছে। এমন অনেক কথা আছে যা অন্যের মুখের ওপর বলতে পারলে ভালো হত কিন্তু আলজিভ সুলসুল করলেও আমরা তা পেরে উঠি না। একটি ছেলে সেসব কথাই বলে চলেছে। তাকে নিয়ে লিখেই ফেলেছি নতুন একটি উপন্যাস।

উপন্যাসের বিষয় ভাবনা নিয়ে এই যে এত কিছু বললাম তাতে আমার অনেক কথা বলা হল তা ঠিক। তবে সেসব লেখা হয়ে উঠেছে কিনা বা উঠবে কিনা তা পাঠকই বলতে পারবেন। আমি শুধু বুক বাজিয়ে এটুকু বলতে পারি—আমার ভাবনাগুলো তো কোথাও রয়ে গেল। কে বলতে পারে এসব আগের না পরের | হয়তো আমি আগামীকাল এরকম ভেবেছিলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ