''এমন খ্যাস খ্যাস করে পিঠ চুলকাবেন না তো সবার সামনে! দেখতে পঁচা লাগে|'' তুবড়ানো 'কপাল-কপোল-থুতনি'তে একগাল হাসি নিয়ে উত্তর দিতেন, ''কী করি বুনডি, বড্ড ঘামাচি হইছে যে!''
চার কি পাঁচ বছর বয়সী আমি তড়িত উত্তর দিতাম, "ফ্যান এর নীচে ঘুমাবেন, ঘামাচি হবে না|" এরপর 'চমত্কার বুড়ি' তাঁর উপর-নিচের পাতলা দু'ঠোঁটে, দিগন্ত বিস্তৃত হাসি হাসতে হাসতে বলতেন, "ওরে বুনডি, আমরা গরিব যে! ফ্যান পাতাম কুথায়?" এ কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যেতাম| তারপর বেশ খানিক ভেবে, আমাদের বাড়িতে রোজ মাছ বিক্রি করতে আসা এই 'চমত্কার বুড়ি'কে বলতাম, 'আচ্ছা আমি বড় হওয়া পর্যন্ত কী আপনি বেঁচে থাকবেন?' তিনি হেসে
আমাকে জড়িয়ে ধরতেন| তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার মনের কথাটাই বলে দিতেন! বলতেন, "হু...পারি, বেঁচি থাকতি| তা তুমি কী বড় হয়ি, চাকরি করি আমারে ফ্যান কিনি দিবানি?"
এই কথোপকথনের চাইতেও বেশি হতো যে কথাবার্তা, তা হতো তাঁর নাম নিয়ে| উনার নাম 'চমত্কার'| এই টা আমাকে খুবই অবাক করত| মিথ্যা বলব না; একারণে উনাকে একটু হিংসাও হতো! ভাবতাম, আহা আমার কেন এমন চমত্কার নাম টা রাখা হয়নি? .... চমত্কার বুড়ি তুবড়ানো গালে পান খেয়ে, ঠোঁট লাল করে, সাথে একগাল হাসি নিয়ে প্রায় রোজ আমাদের বাসায় আসতেন| মফস্বল শহরের সব থেকে নিরিবিলি, শান্ত সময়টায়| সকাল ১০টা/১১টার দিকে| এসেই সোজা রান্নাঘরে, আমার নানীর কাছে| মাথা থেকে ছোট/কুঁচো মাছ আর চিংড়ি'র ডালাটা নামিয়েই লেগে যেতেন সুখ-দুঃখের গল্পে| স
গল্প শুরু করতেন তাঁর স্বামী শিবরাম (যতদুর মনে পড়ে- এ নামই ছিল তাঁর হাসব্যান্ডের) দাসকে নিয়ে| "বুইছো দিদি, বুড়োটা মানুষ খারাপ নয়| বলা যায়, ভালো| আমারে কিন্তু ভালওবাসে! সমস্যা একটাই| সমস্যা হতিছে- কোনো কাজ টাজ সে করবে না নে ......" তারপর নানী আর তিনি একটু মন খারাপ করতেন| কথায় কথায় বহুদিন আগে, যুদ্ধে হারানো তাঁর দু'ছেলের কথা বলতেন| একটু চোখ মুছতেন| তারপর কিভাবে কিভাবে যেন প্রায়ই সে গল্প বর্ধমানে গিয়ে ঠেকতো| চমত্কার বুড়ির কিছু আত্মীয় স্বজন ইন্ডিয়ায় থাকতো| সাতক্ষীরা-সীমান্তের ঠিক ওপারে| মাঝে মাঝেই তাঁরা তাই বর্ডার ফাঁকি দিয়ে ওপারে ঘুরে আসতেন| ঘুরে আসার পরের দিন গুলোতেই মূলত নানীর সাথে তাঁর আড্ডাটা জমে উঠতো| নানী যেন কেমন বিভোর হয়ে তাঁর ওপারের আত্মীয়-স্বজনের গল্প শুনতেন! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতেন| তারপর টুক করে নিজের ফেলে আসা বর্ধমানের গল্পে চলে যেতেন|
এমনিতে চোরাই পথে বর্ডার ক্রস বা অন্য যে কোনো অসৎ কাজে ছিল নানির চরম আপত্তি| কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ~ চমত্কার বুড়ির এভাবে ইন্ডিয়ায় ঘুরে আসাকে খুব একটা খারাপ তিনি মনে করতেন না! অবাক হয়ে বলতাম, নানী এভাবে যাওয়া তো ঠিক না| নানী বলতেন, "গরিব মানুষ যে! আপন আত্মীয়কে দেখতে মন পুড়লে, কী করবে সে?" ... তাঁদের আলাপ আলোচনার শেষ বা মাঝ পথে, বাসায় সকালের থেকে যাওয়া রুটি বা অন্য কিছু খেতেন তাঁরা ভাগ করে| দুজন মিলে| ও সময়টায়, আবার কোনো কোনো দিন আমাদের বাসায় ছাতু মাখানো হতো| একটু বেশি করে মাখিয়ে নানী বলতেন, "বুড়ো'র জন্যও একটু নিয়ে যেওক্ষন|"
হ্যা, যা বলছিলাম~ অবাক হতাম তাঁর এমন অদ্ভুত সুন্দর নাম নিয়ে| গল্প, মাছ কেনা-বেঁচা সব শেষে চমত্কার বুড়ি যখন গেট এর কাছে চলে যেতেন, তখন প্রায়ই তার কাছে দৌঁড়ে যেতাম| পথ আগলিয়ে ফিসফিস করে বলতাম, আচ্ছা আপনার নাম চমত্কার কেন? উনি বলতেন, "তা তো জানি নে!" উত্তর না পেয়েও হতাশ হতাম না; সুযোগ পেলেই আবার আরেকদিন একই সে কথা জিজ্ঞেস করে বসতাম| পরে অবশ্য নিজে নিজে একটা কারণও ভেবে নিয়ে ছিলাম| উনার হাসিটা ছিল অদ্ভুত মিষ্টি| আর সে চমত্কার হাসির কারণেই সম্ভবত তাঁর বাবা-মা এই নাম রেখেছিলেন| একদিন আমার মুখে এই কারণ শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে ছিলেন| কিশোরী বালিকাদের মতো| হেসেছিলেন অনেকক্ষণ! ক
......খুবই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে আজ! ভোর রাতে স্বপ্ন দেখলাম চমত্কার বুড়ি মাছের সেই ডালাটি নিয়ে আমার বাসার দরজায়| স্বপ্নের মাঝেও ভীষণ চমকে গেলাম (কিন্ত ভুলেই গেলাম তিনি মারা গেছেন| অনেক অনেক বছর আগেই! আমার সেই ছোটবেলাতেই)! বললাম, "চমতকার বুড়ি, আপনি?! আমার মেলবোর্নের ঠিকানা জানলেন কিভাবে?" হি হি হি... করে হাসলেন| ঠিক আগের মতো, হাসতেই থাকলেন! তারপর বললেন, "মাছ নিবা, চিংড়ি? ..জানো বুনডি, আমার আর এখন ঘামাচি হয় না, ইটা বলতেই আসলে আইছি|"
4 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনবাহ!
উত্তরমুছুনখুব আচ্ছন্ন করলো নৌ । চমৎকার ।
উত্তরমুছুনচমৎকার বুড়ি, নিশ্চয়ই অনেক কাছের একজন চমৎকার মানুষ ছিল। তাঁকে নিয়ে আগ্রহ এবং ভাবনাগুলোও তাই বিনিসুতোর মালার মতই গাঁথা ছিল মনের গহীনে কোথাও। চমৎকার বুড়িও সেটা নিশ্চয়ই বুঝতো। তাই ফিরে এসেছে স্বপ্নে এবং চমৎকার এই লেখায়। অনেক ভাল লেগেছে, নৌ।
উত্তরমুছুন