অসুখের কথা শুনলে শুরুতেই অনেকে ভাবে, আমার বুঝি স্বল্প মাত্রার জ্বর, হাঁচি, কাশি,সর্দি, পেটব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি। কিন্তু অসুখী শুনলেই তাদের ভুল ভাঙত, অসুখটা আমার অন্তরে। আর এতে আমার কোনো হাত নাই।
মুচকি হাসতে হাসতে গোধূলিটা পিছলে পরতে যাচ্ছে সন্ধ্যায়। অসংখ্য কাক দেহকে সংকুচিত করে, এমনকি ফুরুৎ করতেও রাজি হওয়ার ভান করে সমচেষ্টায় ঢুকতে চাচ্ছে বাবুই পাখিদের বাসায়। বাসা খালি রেখে বাবুইরা সমচেষ্টায় একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকিকে ঠোঁকরাচ্ছিল। তাদের তাড়াবার
কেউ নাই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি তাদের ঠোঁকরানো দেখছি অথচ আমি কেন তাদের তাড়াচ্ছি না। এ দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
ভাল সিনেমা বানাতে পারা এক সময় আমার কাছে স্বপ্নের মত ছিল। অবশ্য এখন ব্যাপারটি এরকম, মানুষ যা কিছুকে নিজ জীবনের পূরণ হওয়া স্বপ্ন হিসেবে ধরে সেসব আসলে তার জীবন বিষয়ক তুুচ্ছ ভাবনাই ছিল। সে স্বপ্ন ভেবে ভুল করেছিল।
স্বপ্ন নয়, ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা স্বপ্নগুলোই আমার অসুখের কারণ।আমি চাইনা এ অসুখ সার”ক। তাই ডাক্তার-ওষুধপাতি নিষ্প্রয়োজন।
পাঁচ সদস্যের একটি পরবারকে নয় নম্বর বিপদসংকেতের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে কলার ভেলায় ভাসতে দেখে সেই রাতে জলোচ্ছ্বাস সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বসেছিলাম।
স্বপ্নর পাশাপাশি আমি সিনেমার তাত্ত্বিক বিষয়াদি নিয়ে ভাবছিলাম। সে অবশ্য আদ্যিকালের ভাবনা। দুই যুগ হতে চলল।বহুবার ঘোষণা দিয়েছিলাম, গল্প রেডি ছিল, নাগালেই ছিল লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন। কিন্তু হল না। আমার টিমে অ্যাসিস্ট করতে আসা অধিকাংশ যুবক এই সার্টফিকেট দিয়ে চলে গেছে, আপনাকে দিয়ে ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু সম্ভব কিন্তু আপাতত ছোট কিছু করে নিজের খোরাকির ব্যবস্থা করতেই আমারা এসেছিলাম এবং যাচ্ছি। বাই।
বিপুলাসার থেকে হরিনারায়ণ অব্দি রেল লাইনের পাশে যেখানে যেখানে কাঠবাদাম গাছের আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত ছায়া পড়ে সেখানে সেখানে আমি রোদে, বৃষ্টিতে, শীতে কিংবা কুয়াশায় নিঃসঙ্গ। বাড়াবাড়ি বৃষ্টির মধ্যে একটা ভালো ছাতা বগলদাবা করে যে পাগল নিজ এলাকা ছাড়ছিল সে আমাকে বলে গেল,'ট্রেন আইতোনো। জাহাজ ভাসব জাহাজ।' অথচ সামনে বন্দর নয় প্লাটফর্ম।
আমি হতাশ নই, আশাহত নই, ব্যর্থ নই, কিন্তু আমি অসুখী। অনেকেই বুঝে গেছে, আমাকে দিয়ে আর সিনেমা সম্ভব নয়। তবুও তারা বিভিন্ন সময়ে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে দাওয়াত দেয় আমাকে। ব্যাপারটা আমার কাছে ছাতা বগলদাবা করে বৃষ্টিতে দৌড়ানোর মতই ব্যাপার। স্ক্রিপ্ট দেখে দিই কারো, লোকেশন রেকিতে হেল্প করি, সাজেশন দিই শুটের। ফলত সিনেমামুক্তির আগে ফেসবুকে তারা আমার নিকট কৃতজ্ঞতা জানায়।
এমনকি বহু আগে আমার সিনেমার জন্য যে নায়িকা ঠিক করেছিলাম, সে আমার সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে দুটি ব্যবসাসফল সিনেমা করলেও আমি না শুর” করায় সে আর কোনো সিনেমাই করল না। এ বিষয়ে তার সাথে কথা না হলেও আমি বুঝতে পারি, আমার ওপর অনেক অভিমান তার। অপেশাদার আচরণ তো বটেই। তবে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের আবেগকে সম্মান জানাই। যদিও রটেছে, ক্যারিয়ারটাই তার শেষ করে দিছি!
আমার প্রযোজকরা বিরক্ত। অনেকেরই অভিযোগ, স্ক্রিপ্ট আর লোকেশন খুঁজতেই খরচ করে ফেলেছি তিনভাগের দুইভাগ টাকা! শুটিং বহুদূর!
মাঝেমধ্যেই নতুন ছবি বানাতে আগ্রহী যুবক-যুবতীরা আসে স্ক্রিপ্ট চাইতে। আবদার করে,'ভাইয়া আপনি তো আর বানালেন নাহ। দেন বানাই। জোশ স্টোরি ছিল ওগুলো। একটা হলেই হয়।'
এমন প্রস্তাবে কে কি করত বা কার কেমন অনুভূতি হতো জানি না। মুখ ও মর্জি পছন্দ হলে আমি খালি হাতে ফিরাই না।
আমার প্রতিটি দিনের আলাদা আলাদা ঘটনা বলতে কিছু নাই। গত দুই যুগ ধরে এমনই ঢালাও। দুটি প্রবণতার উপর ভর করেই আমার জীবনের ব্যাখ্যাদান সম্ভব। খালি সিনেমা বানাব বানাবই করে গেলাম আর একে কেন্দ্র করে একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দুইটি প্রবণতা হচ্ছে, ঘুমস্বপ্ন ও একে কেন্দ্র করে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
ফারিয়ার কথা তুলতাম না, যদি না প্রসঙ্গ আসত। ও অনেক রাতের সাক্ষী। শেষরাতের দিকে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দেখতাম ও বারান্দায়। ও বুঝত আমাকে। বলত, 'আমার ইচ্ছে করে। কিন্তু ওতে প্রবেশের বা একে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তো আমার নাই।'
আমি বুঝতাম ওর কষ্ট। ও ইচ্ছার শেষ বিন্দু দিয়ে চাইত, আমি যেন সংরক্ষণ করি এগুলো। কিন্তু আমি ভুলে যেতাম অনেক রং এবং সূক্ষ্ম পর্যায়ের ধারাবাহিতা।
ফারিয়া একসময় হাল ছাড়ল। আমার প্রবণতার কিংবা আমার। প্রবণতাদ্বয় থেকে সৃষ্ট জীবনবিষয়ক নির”পায় যন্ত্রণা থেকে বিশ্রামের জন্যে আমার আশপাশ অসহ্য হয়ে উঠলে তার তিক্ততা থেকে সে নিজেকে সরিয়ে নিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ফারিয়া ধীরে ধীরে ডিফোকাস!
ফারিয়া জুদা হয়ে যাওয়ার পর দেখলাম, সুবিশাল সামিয়ানা আকাশে টানানো। বৃষ্টি ভিজিয়ে চলেছে এটাকে। চুঁয়ে চুঁয়ে পানি পড়ছে নিচে, তা মাটিকে সিক্ত করে গড়িয়ে যাচ্ছে ছায়ার ওপর দিয়ে, বৃষ্টির সাথে রোদও হচ্ছে যে! সামিয়ানার নিচে কুকুরের শত্রুতায় ভীত দেখাচ্ছিল এমন একটি খেক শিয়াল বরবেশে বসে আছে একা। আরো কী সবব আলিজালি দেখছিলাম। যাই হোক। আমি সবিস্তারে আর যতটা পারা যায় হুবহু স্বপ্নটা ফারিয়াকে ফোনে শোনাতে থাকার সময় কলড্রপ হয়। এতে পুরোটা শোনানোর ইচ্ছে মরে যায়। আর কল করিনি, সেও না।
আমার ব্যাপারে আমি ক্লিয়ার। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনে শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে যতই স্বাগত জানাক আর বলুক আমি হাত দিলেই হবে তাঁদের বলি, কালারগুলো পাচ্ছি নাহ, ভাঁওতাবাজি হবে, আসলে সেট আপই গড়মিল। আমি বুঝি, আমার অসুখ। আই মিন আমি অসুখী। টানা-হেঁচড়া করো না তোমরা। আমি পজিটিভ। তোমাদের কাছে নয়, আমার দায় এবং বদ্ধতা বরং ইন্ড্রাস্টির নিকট। সে আমি ম্যানেজ করে নিছি। যে অর্থে তোমরা সিনেমা বানাচ্ছ আমি তোমাদের সমকক্ষ নই! আমি শব্দের রং দেখতে পাই আর রঙের আওয়াজ শুনি, ঠিক তোমাদের উল্টা। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।
আমি একটা সিনেমা বানাব বানাব করে গত দুই যুগ ধরে সবাইকে আশাই দিচ্ছি। এটা ইদানীং আরো বেশি অসাধ্য আমার জন্য। আমি সরি। আমার অসুখ। আই মিন আমি অসুখী।
আমি তোমাদের সিনেমা দিতে পারলাম না। যথেষ্ট সামর্থ থাকা সত্ত্বেও সারাজীবনে একটিও সিনেমা বানান নি এমন এক ব্যক্তির সুইসাইড নোটই আপাতত এনাফ: 'আমি ঘুমের মধ্যে যে জাতীয় স্বপ্ন দেখি, লোকেরা যদি সেগুলো দেখতে পেত তবে বলত, তুমি ঘুমিয়েই থাকো, ঘুমিয়ে থাকো।'
0 মন্তব্যসমূহ