নিতান্ত একটা সুখী সমাপ্তি ঘটতে পারতো আমার জীবনে।
যেমনটা ঘটে রূপকথার গল্পে : ‘অবশেষে রাজা-রানি
সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’। কিন্তু বিধি বাম। সেই কপাল নিয়েই জন্মাইনি যে! আমি বড়ো কপালে বিশ্বাসী মেয়ে।
কিংবা বলা যায়, ওই সুখী পরিণতি কি আমি আদৌ চেয়েছি কখনো? আর সবার মতোই আমার বেড়ে ওঠা। টানাপোড়েন
সংসারের মধ্যবিত্ত ঘরের সাদামাটা জীবন আমার। লেখাপড়ায় বলতে গেলে অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর
মতো; সহজাতভাবেই মেধাবী। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গেছি অনায়াসে
বন্ধুদের ঈর্ষার কারণ হয়ে। কলেজেও তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠেও সেই একই দশা।
হঠাৎ এসময় এসে আর অনেকের মতো আমার জীবনের বাঁক-বদল হয়। শুরুতে এমনটা অনুভব করিনি। মনে
করার মতো তেমন কারণও ছিল না। খুব ছোট্টবেলা থেকেই নিজের রূপের বর্ণনা শুনতে শুনতে ভেতরে
ভেতরে অহংকারী হয়ে উঠেছি কবে, টেরই পাইনি। অথচ স্বভাবে আমি নিরহংকারী। আমাকে জেনেছে যে খুব
কাছ থেকে, অনুভব করেছে নিবিড়ভাবে,
সে-ই জানে, আমি মানুষটা নারকেলের মতো। বাইরে মরুভূমি, ভেতরে অথৈ
সাগর।
যাই হোক, অরুণাভ এলো। পাল্টে গেল আমার প্রতিদিনের
ছকবাঁধা জীবন। নিয়ত তাকে প্রত্যাখ্যান একদিন আমাকে শেখালো ভালোবাসা কাকে বলে। বর্ণমালার
মতো অরুণাভ শেখালো কী করে ভালোবাসতে হয়। জীবনে সেই প্রথমবার জানলাম-- ভালোবাসাও
শেখার বিষয়; যেমনটা একদিন হারমোনিয়ামের রিড চেপে শিখেছিলাম গান। তবে এর আগেও সেই নরম অনুভূতি
বুদবুদ করেছিল আমার মনের কুয়োয়। সেটা একান্ত একপেশে, নিজস্ব গোপনে। সেসব অতীত। ডায়েরির
পাতার ভাজে যেমন শুকনো পাতা থাকে কিংবা গোলাপের পাপড়ি, অতীতের সেই
দিনগুলো আজও রাখা আছে আমার ডায়েরি ভাজে ভাজে। কারণ, আমার অতীত কখনো ধূসর হয় না। এক এক
করে স্মৃতি হয়ে ধরে দেয় এক একটা দিনে, নয়তো নির্ঘুম রাতে। তবে আজ যে সংকটের
ভেতর দিয়ে আমি যাচ্ছি,
তা কাউকেই বলতে পারছি না। না আমার কোনো বন্ধুকে, না কোনো স্বজনকে।
অরুণাভকে আমি আর ভালোবাসতে পারছি না। তাকে দেখলে
আজ আমার বড়ো করুণা হয়। ছেলেটা পাগলের মতো আজও ভালোবাসে আমাকে। অথচ কখন কবে আমাদের ভেতরকার
সেই তানপুরার তারটি ছিড়ে গেছে-- দুজনার কেউ তা জানি না। এই পুরুষবাদী সমাজে হয়তো এতে করে সবাই
আমাকেই মন্দ বলবে। পুরো দোষটা চাপিয়ে দেবো আমার ওপরই। আমার পরিবার, আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন
সবাই আমাকে ছিঃ ছিঃ করবে। ঘেন্নায় মুখ ঘুরিয়ে নেবে। হয়তো সবাই বলবে, তবে কেন এই
মিছে স্বপ্ন-স্বপ্ন খেলা?
গ্রিক একটা মিথের কাহিনি আজকাল বড়ো মনে পড়ে। ভালোবাসার চোখে
কোনো নারী-পুরুষ যদি একে অপরের দিকে তাকায় তবে স্বর্গে একটি শিশুর নামকরণ করা হয়। আমাদের
সেই শিশুর জন্ম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। আজ তার স্কুলে পড়ার বয়স। অথচ জানি, তার জন্ম
কখনোই হবে না এই পৃথিবীতে। এ হওয়ার নয়। কেননা, আমি আর অরুণাভকে ভালোবাসি না। অনেক
চেষ্টা করেও পারছি না। আমি যাকে আজ ভালোবাসি, তাকে কোনোদিনই পাওয়ার নয়। তবুও
তাকে ভালোবাসি। সমাজ-সংসার-ধর্ম বলে কথা! আমার ও অরুণাভ’র প্রেম পর্বে যে মানুষটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই শুভ্র
মামাকে আমি ভালোবাসি। মায়ের মেসতুতো ভাইটিই আজ আমার কাক্সিক্ষত প্রেমিক পুরুষ। দিনশেষে
আমি যে একজন নিতান্ত মানুষ। ভালোবাসার কাঙাল!
শুভ্র মামা আমাকে ভালোবাসে নিজের জীবনের চেয়েও
বেশি। কিন্তু আমি তো সেই ভালোবাসা চাই না। আমি চাই তার কাছ থেকে অরুণাভ’র মতো কিছু। অথচ তা পাওয়ার নয়। সমাজ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে শিখিয়েছে মামা-সম্পর্কের
কাউকে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধতে নেই। আমি বাঁধছিও না। ছেড়ে দিয়েছি নিজেকে। সমুদ্রে ভাসিয়েছি
একা ডিঙি নৌকো। কেবল মনে মনে ভেসে যাচ্ছি, ভালোবেসে যাচ্ছি। এইটুকু অধিকার তো
আমার আছে, নাকি?
আজ মামা আমাদের বাড়িতে এসেছিল তার বিয়ের নিমন্ত্রণ
করতে। আমি মামার দিকে তাকিয়েছিলাম। মামাও আমায় দেখে স্নেহের হাসি হেসে বললো-- “তোর পড়াশুনা কেমন চলছে রে মৃদু?” আমি আমার
নামের মতো মৃদু হেসে ছোট্ট করে বললাম-- ভালোই। কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে কেন
জানি হঠাৎ আমার খুব কান্না পেল। দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো মামাকে। মামা’র বুকে মুখ রেখে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করলো। কেন এমনটা অনুভূত হলো, ঠিক জানি
না। দু’তলার বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে আমি
শুভ্র মামার চলে যাওয়া দেখলাম। শুভ্র মামা হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তায়।
পেছন থেকে মামাকে খুব ডাকতে ইচ্ছে করছিল। এমনিতেই। আরেকটিবার মুখখানা খুব দেখতে ইচ্ছে
করছিল তার। কিন্তু ডাকিনি। কিংবা সাহস হয়নি। শুনেছি, পেছন থেকে ডাকা নাকি অমঙ্গল। আমি তো
আর শুভ্র মামার কোনো অমঙ্গল চাইতে পারি না।
অঞ্জন আচার্য
জন্ম : ময়মনসিংহ জেলার প্রাণকেন্দ্রে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষে নিয়োজিত আছেন সাংবাদিকতা পেশায়। বর্তমানে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিবর্তন-এ জ্যেষ্ঠ সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। পেশাগত জীবন শুরু হয় দৈনিক ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করার মধ্য দিয়ে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গবেষণা সহকারী হিসেবে ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন’ বিষয়ে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ওপর গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমিতে। লিখেন- কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার, সাহিত্য- সমালোচনা। প্রকাশিত বই- জলের উপর জলছাপ (কবিতা, শুদ্ধস্বর), আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল (কবিতা, বিজয় প্রকাশ), রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া (গবেষণা-প্রবন্ধ, মূর্ধন্য), জীবনানন্দ দাশের নির্বাচিত গল্প (সম্পাদনা, বিজয় প্রকাশ), পাবলো নেরুদার কবিতা সংগ্রহ (সম্পাদনা, বিজয় প্রকাশ), ধর্ম-নিধর্ম-সংশয় (যৌথ-সম্পাদনা, রোদেলা প্রকাশনী)।
1 মন্তব্যসমূহ
প্রকাশিত মনের অপ্রকাশিত প্রেম...
উত্তরমুছুন