লীনা দিলরুবা
নিজের জীবদ্দশায় জীবনানন্দ তাঁর লেখা গল্প বা উপন্যাস কোনোটাই প্রকাশ করেন নি। তাঁকে পৃথিবী চিনতো একজন ব্যতিক্রমধর্মী কবি হিসেবেই। আমরা জেনেছি তিনি গল্প-উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিগুলো ট্রাঙ্কে বন্দি করে রেখেছিলেন। "আমরা চারজন" উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি গত হন ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে। জীবনানন্দের কবিতার মত তাঁর গল্প-উপন্যাসে ওজনদার একটি আবহ বিরাজমান। তিনি মূলত মানুষের সম্পর্ক নিয়েই তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনী সাজিয়েছেন। "আমার কথা" প্রবন্ধে জীবনানন্দ একবার লিখেছিলেন, "ঔপন্যাসিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল, এখনও তা ঘোচে নি।" অর্থাৎ তিনি ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি ঠিক হয়ে উঠছে না।
পরে দেখা গেল, মনের কোণে লালিত স্বপ্ন তিনি ঠিকই কাজে রূপান্তরিত করেছিলেন কিন্তু প্রকাশের সাহস কেন পেলেন না? তাঁর প্রায় সব গল্প-উপন্যাসই তাঁর নিজের জীবনের দর্পন। বোধ করি একারণেই এগুলো প্রকাশিত হোক তা তিনি চান নি। তাঁর টেলিগ্রাফিক ভাষায় লেখা কোডেড নোটস যেটি 'লিটারারি নোটস' নামে পরিচিত ছিল সেখানে তিনি ব্যক্তিগত কথাবার্তা এমনভাবে লিখেছিলেন যেন কেউ এগুলো বুঝতে না পারে। নিজেকে আড়াল করে ডায়েরি লেখার বিষয়টি মাথায় রাখলে গল্প বা উপন্যাসে নানান চরিত্রের আর কাহিনীর আড়ালে নিজের কথাগুলো গড়গড় করে বলে দিয়েও সেগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক থাকা তাঁর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মনে হয়।
"আমরা চারজন" উপন্যাসটি চার জন বন্ধুর জীবন নিয়ে লেখা। গল্পটি অনাথ, শ্যামল, সুধামাধব এবং উষা'র গল্প। তিন যুবকের সব ক'জনই প্রায় বেকার। মেয়েটির পেশা আবছা রেখেছেন জীবনানন্দ। এদের মধ্যে শ্যামল এবং সুধামাধব কবিতা লেখেন। অনাথ আর উষা করেন গদ্যচর্চা। এই চার চরিত্রের বেঁচে থাকা, স্বপ্ন-ভবিষ্যত নিয়ে নিজস্ব দর্শন এবং প্রায় নিম্নবিত্তের মত জীবন কাটাতে বাধ্য হবার বিষয়গুলো জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণে অতি সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে। এই চারবন্ধুর সবাই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চান, তাদের সবার রয়েছে নারী বন্ধুটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার জটিল রসায়ন। জীবনানন্দ জীবনের অনেকটা সময় বেকার ছিলেন। এই উপন্যাসের তিন প্রায় বেকার যুবকের মধ্যেই আমরা জীবনানন্দকে দেখতে পাই। এই তিন যুবক পরষ্পরের লেখার খোঁজ রাখেন, এর মধ্যে অনাথ, যিনি গল্প উপন্যাস লেখেন কিন্তু তার কিছুই ছাপান না। সুধামাধব জীবনে সাকুল্যে কবিতা লিখেছেন বারোটি। সেসবও ধুসর হয়ে পাণ্ডুলিপিতে পড়ে রয়েছে। আর উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসের নায়ক শ্যামল কবিতা লেখেন কিন্তু সেসব কবিতা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। শ্যামলের সাহিত্যচর্চার বিষয়টি অনুল্লেখ্য থাকলেও অনাথ, শ্যামল এবং সুধামাধবের সৃষ্টি আর কল্পনার মধ্যে আমরা বার-বার জীবনানন্দকে খুঁজে পেয়েছি। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এই তিন চরিত্রের আড়ালে লেখক স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন।
অনাথের কথাই ধরা যাক। অনাথ একটি উপন্যাস লিখতে চান। সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন। অনাথ স্বপ্ন দেখেন উপন্যাসটি বিক্রি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আসবে এবং সে টাকা দিয়ে তিনি একটি মনের মত বাড়ি তৈরি করবেন। চালচুলোহীন মেসবাড়িতে বসবাসকারী প্রায় বেকার একজন যুবকের জন্য এটি কষ্ট কল্পনা বটে। অনাথের এই কল্পনার মধ্যে কীভাবে জীবনানন্দকে ধরা পড়েন সেটি দেখা যাক।
অশোক মিত্র তাঁর জীবনীগ্রন্থ আপিলা চাপিলায় লিখেছেন, "জীবনানন্দের সঙ্গেও কলকাতায় এলে নিয়মিত দেখা হতো, তিনি ক্রমশ আত্মবিশ্বাসরহিত। তাঁর ঘনিষ্টবন্ধুরা, যেমন প্রেমেন্দ্রে মিত্র, যেমন অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন, তাঁর ধারণা বুদ্ধদেব বসু-বিষ্ণু দে প্রভৃতিও দেখেছেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রসঙ্গ না হয় উহ্যই রইলো, অথচ তিনি নিজে একটি ভদ্রগোছের অধ্যাপনার কাজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারছেন না। পরিচিত এঁকে-তাঁকে ধরেও কোনও ফল হচ্ছে না, আমরা যাঁরা তাঁর অনুরক্ত শুভানুধ্যায়ী তাঁরাও কিছু করে উঠতে পারছি না। একদিন, বর্ষার ম্লান সন্ধ্যা, রাসবিহারী এভিনিউর প্রায় মোড়ে ল্যান্সডাউন রোডের গিলতে তাঁর একতলার ফ্ল্যাটের বর্হিদুয়ারে দিয়ে সদ্য ঢুকেছি, হঠাৎ আমাকে টেনে এক কোণে, নিচু নিমগাছের ডালের আড়ালে, নিয়ে গেলেন, কানে-কানে তাঁর অস্ফুট প্রশ্ন : "আচ্ছা, আপনি কি জানেন বুদ্ধদেব বাবুর নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিক্সড ডিপোজিট আছে?" বুদ্ধদেবের আর্থিক অবস্থা তখন কিন্তু আদৌ ভালো নয়, কিন্তু জীবনানন্দ এতটাই তিমিরে অবগাহিত, যে অলিক লোকপ্রবাদও তাঁর কাছে ধ্রুব সত্য বলে প্রতিভাত। যেখানে তিনি নিজে কোনওদিন পৌঁছাতে পারবেন না, সেখানে তাঁর বন্ধু ও পরিচিতরা কীরকম অমোঘ নিয়মে পৌঁছে গেছেন; তখনকার নিরিখে কোনও সাহিত্যেকের পক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকার সঞ্চয় অবশ্যই বিস্ময়ে অবাক করার মতো। (আপিলা চাপিলা, অশোক মিত্র, পৃষ্ঠা: ১০৪)
জীবনানন্দ এরকম ভাবতেন। ভাবতেন বুদ্ধদেব বসু'র সঞ্চয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। লিখে টাকা কামাই করার এরকম চিন্তা বা কল্পনা তিনি অনাথের মাধ্যমে এখানে নিবিড়ভাবে তুলে ধরেছেন। অনাথ সম্পর্কে উত্তম পুরুষে তিনি লেখেন-
"বইয়ের বিক্রির থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা যা হাতে আসবে তার, তা-ই দিয়ে বালিগঞ্জের দিকে ছোট-খাটো একটা নিরিবিলি বাড়ি তৈরি করবে-সারাটা জীবন নিজেও বিড়ি ফুঁকে কাটাবে (চুরুট-সিগারেটের চেয়ে সে বেশি ভালোবাসে বিড়ি)।"
আবার উত্তম পুরুষে লেখেন-
"কিন্তু গল্প লিখতে ব'সে অনাথ এ-সব উদ্দেশ্যের কথা ভুলে যেত-আমি লক্ষ ক'রে দেখেছিলাম, সত্যিই লেখা-ই ছিল তার কাম্য-টাকাও নয়, সম্মান প্রতিপত্তিও নয়।"
জীবনানন্দ ব্যক্তি জীবনে এরকমই ছিলেন।
তার পর উত্তম পুরুষে আবার বলেন-
"এ-জন্য অনাথকে শ্রদ্ধা করতাম; মনে হত, লেখকের প্রতিভা তার ভেতর না থাক, এক জন ভালো লেখকের অবহিতি-সমাহিতি ভাব তার আছে। একটা গল্পকে মনের মতো ক'রে দাঁড় করাবার জন্য সে অনেক কিছু সুখের ও আরামের জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে।"
লেখক বলছেন- "বন্ধু সুধামাধব অনাথকে বলত: তা হলে তোমার জীবনটা যাতনা-বিশেষ অনাথ।"
আবার উত্তম পুরুষে বলেন-
"কিন্তু বোঝা যেত, জীবনে আমাদের সকলের চেয়ে কম যাতনা তার, লিখে কিংবা লিখবার প্রয়াসে থেকে সে অনেক রকম ব্যথা ভুলে যায়। অনেক আশ্চর্য উজ্জ্বল জিনিস আশা করে; না যদি মেটে, তা হলে আজকের দিনটা আশায়-আশায় কাটল, কালকে মিটবে, কিংবা তার পরের দিন, তার পরের দিন...অনাথের মনে হত।"
জীবনানন্দের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কল্পনা করলে যেন ধরা পড়ে, এই অনাথ আর কেউ নন, জীবনাননন্দ নিজেই।
এর একটু পরেই শ্যামলের জবানীতে জীবনানন্দ লেখেন-
"কিন্তু আমাদের জীবনের বিলাস এই ধরনের যে, তা আমরা সকলেই জানি। কাজেই, এই শীতের দিনেও না পারি একটা কমলা-লেবু কিংবা একটা কাগজি-লেবু কিনতে। অথচ এই দু’টো জিনিসকেই তো খুব ভালোবাসতাম"।
জীবনানন্দ কমলালেবু ভালোবাসতেন। মৃত্যুর পর রোগীর পথ্য একটি কমলালেবু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাওয়ার আকুতিভরা একটি কবিতা রয়েছে তাঁর। ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাম দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন।
অনাথের খুব অসুখ করলো। বন্ধুরা তাকে সেবা দিয়ে যত্ন দিয়ে সুস্থ করে তুলতে চেষ্টা করছে। এর মধ্যেও সে নিজের লেখা নিয়ে কথা বলে। অনাথ বলে-
"না লেখা ছেড়ে দেব না। আস্তে আস্তে লিখতে-লিখতেই শেষে এক দিন সফলতা পাওয়া যাবে।"
0 মন্তব্যসমূহ