মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহিত্য জীবন আরম্ভ করার একটা গল্প আমি এখানে ওখানে বলেছি। ছাত্রজীবনে বিজ্ঞান শিখতে শিখতে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ''অতসীমামী" গল্পটি লিখে বিচিত্রায় ছাপানো এবং হঠাৎ এভাবে সাহিত্য জীবন শুরু করে দেবার গল্প। কিন্তু একটা প্রশ্ন দাঁড়ায় এই : কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই কি একজন লেখকের সাহিত্যজীবন শুরু হয়ে যেতে পারে?
আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোন লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে তামি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব ।
প্রস্তুতির কাজটা অবশ্য লেখক সচেতনভাবে নাও করতে পারেন । কিভাবে য়ে প্রক্রিয়াটা ঘটছে এ সম্পর্কে তার কোনও ধারণা পর্যন্ত না থাকতে পারে। জীবনযাপনের সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকায় লেখক হবার আগে এই প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার বিশেষ তাৎপর্য ধরতে না পারাই স্বাভাবিক |
সাহিত্যজীবন আরম্ভ হওয়ার পর সংস্কার ও স্বপক্ষপাতিত্ব বর্জন করে বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে নিজের অতীত জীবন বিশ্লেষণ করলে প্রস্তুতিটা কিভাবে ঘটেছিল তা কম-বেশি জানা প্রত্যেক লেখকের পক্ষে সম্ভব |
সাহিত্য করার আগে কয়েকটা বিষয়ে সকল হবু লেখকের মিল থাকে। যেমন, সাহিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা ও জবাব খোঁজার তাগিদ, সাহিত্যে প্রতিফলিত জীবনকে বাস্তব জীবনে খুঁজে নেবার চেষ্টা, ইত্যাদি— এসবই সাহিত্য জীবনের জন্য প্রস্তুতির প্রক্রিয়াটা ঘটাবার কারণ স্বরূপ হয়। দশজনের চেয়ে সাহিত্যকে ঘনিষ্ঠতর গভীরতরভাবে নেওয়ার ফলে চিন্তা ও ভাব জগতে সাহিত্যের প্রভাব সঞ্চিত হয়ে চলে, তার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে নিজের বাস্তব জীবনের সংঘাত ও পরিবেশের প্রভাব, আয়ত্ত করা জ্ঞানের প্রভাব আর সংস্কারের প্রভাব। মোটামুটি এভাবেই গড়ে ওঠে সাহিত্যিকের চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি।
সাহিত্যের জোরালো প্রভাব ছাড়া সাহিত্যের জন্ম হয় না।
হাতে-কলমে না লিখেও চিন্তা জগতে এলোমেলো ছাড়া ছাড়া ভাবে যেন লেখা মক্শ করার কাজটাই চলে, চিন্তাকে খানিকটা সাহিত্যের টেকনিকে সাজাবার অভ্যাস জন্মে যায় |
একটা কঠিন ও জটিল বিষয়কে আমি শুধু ছুঁয়ে ছুঁইয়ে গেলাম। লেখক তৈরি হবার প্রক্রিয়াটা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এবার আমি যে আসল কথায় আসছি সেটা স্পষ্ট করার জন্য এটুকু বলা দরকার ছিল।
সাহিত্যিক হতে হলে বাস্তব জীবনের মতো সাহিত্যকেও অবলম্বন করতে হয় । সাহিত্য না ঘেঁটে, নিজের জানা জীবন সাহিত্যে কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে নিজে যাচাই করে না জেনে এবং প্রতিফলনের কায়দা-- কানুন: আয়ত্ত না করে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সাহিত্য-সমালোচক হওয়া যায় কিনা তাতেও আমার ঘোর সন্দেহ আছে।
জীবনকে তো জানতেই হবে, এ বিষয়ে কোন প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জীবনকে জানাই যথেষ্ট নয় | সাহিত্য কি এবং কেন সে তত্ত্ব শেখাও যথেষ্ট নয়। যে জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি বুঝেছি সেই জীবনটাই সাহিত্যে কিভাবে কতখানি রূপায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে সেটাও সাহিত্যিককে স্পষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে হবে, নইলে নতুন সৃষ্টির প্রেরণাও জাগবে না, পথ ও মুক্ত হবে না।
সমাজ জীবনে কি আছে কি নেই, কি এসেছে আর কি আসছে এটা উপলব্ধি করে দীনতা ও অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত করে জীবনকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রামের প্রেরণা জাগবে -- সাহিত্যের মাধ্যমে এ সংগ্রাম চালাতে হলে ওই সমাজ জীবনটির সাহিত্যে কি আছে আর কি নেই, কি এসেছে আর কি আসছে সেটাও উপলব্ধি করতেই হবে সাহিত্যিককে |
লিখতে আরম্ভ করার পর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আগেও ঘটেছে, মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হবার পর আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে সে পরিবর্তন ঘটাবার প্রয়োজন উপলব্ধি করি। আমার লেখায় যে অনেক ভুল, ভ্রান্তি, মিথ্যা আর অসম্পূর্ণতার ফাঁকি আছে আগেও আমি তা জানতাম। কিন্তু মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হবার আগে এতটা স্পষ্ট ও আন্তরিকভাবে জানবার সাধ্য হয়নি। মার্কসবাদ যেটুকু বুঝেছি তাতেই আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে যে, আমার সৃষ্টিতে কত মিথ্যা, বিভ্রান্তি আর আবর্জনা আমি আমদানি করেছি-- জীবন ও সাহিত্যকে একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ভালোবেসেও, জীবন ও সাহিত্যকে এগিয়ে নেবার উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও।
সে তো বটেই ; মার্কসবাদই যখন মানবতাকে প্রকৃত অগ্রগতির সঠিক পথ বাতলাতে পারে, অতীত কি ছিল, বর্তমান কি হয়েছে এবং কিভাবে কোন ভবিষ্যৎ আসবে জানিয়ে দিতে পারে তখন মার্কসবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে সাহিত্য করতে গেলে এলোমেলো উল্টাপাল্টা অনেক কিছু তো ঘটবেই।
মার্কসবাদই আবার আমাদের এটাও শিখিয়েছে যে, এজন্য আপসেস করলেও নিজেকে ধিক্কার দেবার প্রয়োজন নেই। মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হবার আগে কেন সাহিত্য করতে নেমেছিলাম ভেবে আত্মগ্লানি বোধ করলে সেটা মার্কসবাদের শিক্ষার বিরুদ্ধেই যাবে, যান্ত্রিক একপেশে বিচারে সৃষ্টি হবে আরেকটা বিভ্রান্তির ফাঁদ।
সদিচ্ছা ছিল, নিষ্ঠা ছিল, জীবন ও সাহিত্য থেকেই নতুন সৃষ্টির প্রেরণা পেয়েছিলাম, কিন্তু মার্কসবাদ না জানায় কিছুই করতে পারি নি-- এই গোড়ামিকে প্রশ্রয় দেওয়া মার্কসবাদকে অস্বীকার করারই সমান অপরাধ। নিজের সাহিত্য সম্পর্কেও এ কথা ঘোষণা করার অধিকার আমি পাইনি। জগতে আমি একা মার্কসবাদ না জেনে সাহিত্য চর্চা করিনি আমার সামান্য লেখার সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যে এঁদের বিপুল সৃষ্টিকে ব্যর্থ আবর্জনা বলে উড়িয়ে দেবার স্পর্ধা আমি কোথায় পাব?
প্রকৃতপক্ষে, মার্কসবাদ ঘাঁটতে ঘাঁটতে যখন আমার এতদিনের লেখার ত্রুটি আর দুর্বলতাগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, আমার সাহিত্য সৃষ্টি মানুষকে এগিয়ে যেতে এতটুকু সাহায্য করার বদলে আরও বিভ্রান্ত করেছে কিনা সন্দেহ জেগেছিল এবং সোজাসুজি নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়েছিল যে, আমার অর্ধেক জীবনের সাধনা কি বাতিল গণ্য করতে হবে? তখন ওপরের ওই সূত্র ধরেই আমি অকারণ আত্মগ্লানির হাত থেকে রেহাই পাই, অনেক ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমার লেখার মূল্য কতটুকু এবং কিসে তা যাচাই করা সম্ভব হয় ।
কথাটা বুঝে দেখুন। সূত্রটা কি? বাংলা সাহিত্যে আমি যেটুকু দিয়েছি সেটুকু বাতিল করার প্রশ্নে আমি ভাবছি বাংলা সাহিত্যকে উড়িয়ে দিতে চাওয়ার স্পর্ধার কথা। এ যেন বিনয়ের ছলে আমার আরেকটা স্পর্ধা প্রকাশ যে, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও পরবর্তী বাংলা সাহিত্য বলতে আমার দানকেও বোঝায়!
কথাটা আমারও মনে হয়েছে বৈকি। কারণ, এটাই তো আসল কথা। বিচার করতে গিয়ে প্রথম প্রশ্নই তাই দাঁড়িয়েছে : আমি নিজের প্রয়োজনে অথবা বাংলা সাহিত্যের প্রয়োজনে সাহিত্য করতে নেমেছিলাম? সাহিত্য করার তাগিদ আমার কিভাবে আর কেন এসেছিল? সাহিত্যের আদর্শ জানা ছিল না, সমাজ জীবন ও সাহিত্যের সম্পর্ক বুঝতাম না- তবু, জীবন সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমার নিশ্চয়ই ছিল। সেই দৃষ্টিভঙ্গি কি আমায় সন্ধান দিয়েছিল কিছু নতুন বক্তব্যের-- বাংলা সাহিত্যে যা বলা হয়নি?
নেহাত শখের খাতিরে, নামকরা লেখক হবার লোভে সাহিত্য করতে নামিনি, সেটা বলাই বাহুল্য। এটুকু সম্বল করে নামলে সাহিত্যিকের বেশি দিন হালে পানি পাবার সাধ্য থাকে না ।
ছাত্র বয়সে আমি যখন লেখা শুরু করি তার কয়েক বছর আগে কল্লোল যুগ আরম্ভ হয়েছে ।
আমার সাহিত্য করার আগের দিনগুলি দু-ভাগে ভাগ করা যায়। স্কুল থেকে শুরু করে কলেজে প্রথম এক বছর দু-বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র প্রভাবিত সাহিত্যই ঘেঁটেছি এবং তারপর কতদিন খুব শোরগোলের সঙ্গে বাংলায় যে '“আধুনিক'” সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছিল তার সঙ্গে এবং সেই সাথে হ্যামসুনের "হাঙ্গার''’ থেকে শুরু করে শ'-র নাটক পর্যন্ত বিদেশী সাহিত্যএবং ফ্রয়েড প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি।
স্কুলজীবনেই অনেক নভেল পড়েছি। বোধ হয় ফোর্থ ক্লাস কিংবা থার্ড ক্লাস থেকে "মানসী ও মর্মবাণী'', ভারতবর্ষ এবং “প্রবাসী প্রায় নিয়মিত পড়তাম । "ভারতবর্ষ' এবং '‘প্রবাসীই' তখন প্রধানত ছিল বাংলা সাহিত্যের মুখপত্র।
ছেলেবেলা থেকেই গিয়েছিলাম পেকে। অল্প বয়সে 'কেন' রোগের আক্রমণ খুব জোরালো হলে এটা ঘটবেই । ভদ্র জীবনের সীমা পেরিয়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মাচ্ছিল নিচের স্তরের দরিদ্র-জীবনের সঙ্গে । উভয় স্তরের জীবনের অসামঞ্জস্য, উভয় স্তরের জীবন সম্পর্কে নানা জিজ্ঞাসাকে স্পষ্ট ও জোরালো করে তুলত। ভদ্র জীবনে অনেক বাস্তবতা কৃত্রিমতার আড়ালে ঢাকা থাকে, গরিব অশিক্ষিত খাটুয়ে মানুষের সংস্পর্শে এসে ওই বাস্তবতা উলঙ্গ রূপে দেখতে পেতাম, কৃত্রিমতার আবরণটা আমার কাছে ধরা পড়ে যেত। মধ্যবিত্ত সুখী পরিবারের শত শত আশা-আকাঙ্ক্ষা অতৃপ্ত থাকার, শত শত প্রয়োজন না মেটার চরম রূপ দেখতে পেতাম নিচের তলার মানুষের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে ।
গরিবের রিক্ত বঞ্চিত জীবনের কঠোর উলঙ্গ বাস্তবতা আমার মধ্যবিত্ত ধারণা, বিশ্বাস ও সংস্কারে আঘাত করত-- জিজ্ঞাসা জাগত, তাহলে ব্যাপারটা কি?
ছাড়া ছাড়া জিজ্ঞাসা-বাস্তবতাকে সমগ্রভাবে দেখবার বা একটা জীবনদর্শন খোঁজার মতো সমগ্র জিজ্ঞাসা খাড়া করবার সাধ্য অবশ্যই তখন ছিল না ।
সাহিত্যে কিছু কিছু ইঙ্গিত পেতাম জবাবের । বড়দের জীবন আর সমস্যা নিয়ে লেখা গল্প উপন্যাসে । সেই সঙ্গে সাহিত্য আবার জাগাত নতুন নতুন জিজ্ঞাসা। জীবনকে বুঝবার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম, গল্প-উপন্যাস। গল্প-উপন্যাস পড়ে নাড়া খেতাম গভীরভাবে, গল্প উপন্যাসের জীবনকে বুঝবার জন্য ব্যাকুল হয়ে তল্লাশ করতাম বাস্তব জীবন |
স্কুলজীবনেই কয়েকবার শ্রীকান্ত পড়েছিলাম। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে বালক শ্রীকান্তের অ্যাডভেঞ্চার আমায় বিশেষভাবে নাড়া দেয়নি। আমিও ভয়ানক দুরন্ত আর দুঃসাহসী ছিলাম, অনেক অ্যাডভেঞ্চারের চিহ্ন সর্বাঙ্গে আছে। বইখানার নরনারীর চরিত্র আর সম্পর্ক আমাকে অভিভূত করে দিয়েছিল। অভিভূত করেছিল কিন্তু আমি ছেড়ে কথা কইনি-- আমার একটা বড় জিজ্ঞাসার জবাব আদায় করে ছেড়েছিলাম। পরে শরৎবাবুর চরিত্রহীনেও যার সমর্থন পেয়েছিলাম। আমার জিজ্ঞাসা ছিল প্রেম আর দেহ সম্পর্কিত সমস্যাটা নিয়ে, সাহিত্যের প্রেম আর বাস্তব জীবনের প্রেম নিয়ে সাহিত্যের ছাঁকা প্রেম খুঁজে পেতাম না মধ্যবিত্তের জীবনে অথবা নিচের তলায়। মধ্যবিত্তের বাস্তব জীবনের প্রেমে যেটুকু ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্য দেখতাম তার সন্ধান পেতাম না নিচের তলার জীবনে। আবার নিচের তলার প্রেমে ভাবৈশ্বর্যের রিক্ততা সত্ত্বেও যে সহজ বলিষ্ঠ উন্মাদনা দেখতাম, মধ্যবিত্তের জীবনে তার অভাবটা ধরা পড়ত।
রাজলক্ষ্মীকে দেখলাম, মধ্যবিত্ত সংসারের সেবাময়ী স্নেহময়ী নারীত্বের প্রতিমূর্তি, শুধু সংসারের নিয়ম-নীতি বাধা নিষেধ পরাধীনতার কবল থেকে সে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। নায়িকাকে গৃহের সংকীর্ণতা আর বন্ধন থেকে মুক্ত করে নতুন পরিবেশে আনার জন্যই যে তাদের প্রেমের নতুনত্ব, আসলে এও সাহিত্যেরই ওই ছাঁকা অবাস্তব প্রেম-- দেহ নিয়ে ওরা বিব্রত হয়ে না পড়লে, দেহকে এত সমারোহের সঙ্গে বাতিল করা না হলে, ওই বয়সে কথাটা খানিক আঁচ করাও হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হত না। মনটা খুঁত খুঁত করেছিল। বাংলা সাহিত্যে নারীত্ব অভিনব মর্যাদা পেল, কিন্তু বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে কেন? ঘরের দেওয়াল খসে পড়লে আর সতর্ক পাহারা সরে গেলেও নারী অমানুষ হয়ে যায় না, এই সত্যের সঙ্গে কি বিরোধ আছে বাস্তবের? অথবা এটাই সাহিত্যের রীতি ?
চরিত্রহীন আমাকে অভিভূত, বিচলিত করেছিল। বোধহয় আট-দশবার বইখানা পড়েছিলাম তন্ন তন্ন করে। বাংলা সাহিত্যের কত দৃঢ়মূল সংস্কার আর গোঁড়ামি যে চুরমার হয়ে গিয়েছিল এই উপন্যাসে! গল্প-উপন্যাসের নৈতিক আড়ষ্টতা বর্জনের চেষ্টা আরও কয়েকজন নামকরা লেখকও করছিলেন। সাহিত্যে নীতি ও দুর্নীতির প্রশ্ন বিচার করার সাধ্য তখনও ছিল না, কিন্তু মানসিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সেটা খুব স্পষ্টভাবেই সম্পন্ন হত এবং সেদিনকার সেই ছেলেমানুষি বিচার আজও আমার কাছে অভ্রান্ত হয়ে আছে। শরৎচন্দ্রের বই পড়ে মনে হতো তিনি অন্যায় আর গোঁড়ামিকে আঘাত করেছেন কিন্তু অন্য কোন লেখক সম্পর্কেই এরকম ভাবা সম্ভব হতো না । মনে হতো, তারা যেন অনুচিত জেনেও গায়ের জোরে সেটা উচিত বলে সমর্থনা করছেন ।
শরৎচন্দ্রের বেলায় কোন প্রশ্ন জাগতো না, কিন্তু অন্য লেখকদের পতিতা, অসতী বা অনুচিত প্রেমকে কেন গ্রহণ করতে পারতাম না, পরে এটা স্পষ্ট হয়েছে। শরৎচন্দ্রের কাহিনীতে পতিতা ও অসতীরা চরিত্র হয়েছে, বড় হয়ে উঠেছে তাদের মনুষ্যত্ব, অনুচিত প্রেমও হয়েছে প্রেম । তখনকার অন্য কোন লেখক এটা পারেননি ।
যাই হোক, ছোট-বড় লেখকের বই ও মাসিকের লেখা পড়তে পড়তে এই প্রশ্নটা ক্রমে ক্রমে আরও স্পষ্ট জোরালো হয়ে উঠতে লাগল যে, সাহিত্যে বাস্তবতা আসে না কেন, সাধারণ মানুষ ঠাঁই পায় না কেন? মানুষ হয় ভালো, নয় মন্দ হয়, ভালো-মন্দ মেশানো হয় না কেন? শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলিও হৃদয়সর্বস্ব কেন, হৃদয়াবেগ কেন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যবিত্তের হৃদয়|
ভদ্রজীবনের বিরোধ, ভণ্ডামি, হীনতা, স্বার্থপরতা, অবিচার, অনাচার, বিকারগ্রস্ততা, সংস্কারপ্রিয়তা, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি তুচ্ছ হয়ে এ মিথ্যা কেন প্রশ্রয় পায় যে ভদ্র জীবন শুধু সুন্দর ও মহৎ? ভদ্রসমাজের বিকার ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত চাষী-মজুর-মাঝি-মাল্লা-হাড়ি-বাগদীদের রুক্ষ কঠোর সংস্কারাছন্ন বিচিত্র জীবন কেন অবহেলিত হয়ে থাকে, কেন এই বিরাট মানবতা-- যে একটা অকথ্য অনিয়মের প্রতীক হয়ে আছে মানুষের জগতে- সাহিত্যে স্থান পায় না?
ক্রমে ক্রমে সাহিত্যের এই অসম্পূর্ণতা, বাস্তব জীবন ও সাধারণ বাস্তব মানুষের অভাব বড়ই পীড়ন করতো। সংঘাতের পীড়ন ।
আমার নিজের জীবনে যে সংঘাত ক্রমে ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছিল, সাহিত্য নিয়েও ক্রমে ক্রমে অবিকল সেই সংঘাতের পাল্লায় পড়েছিলাম ।
ভদ্র পরিবারে জন্মে পেয়েছি তদনুরূপ হৃদয় আর মন, অথচ ভদ্র জীবনের কৃত্রিমতা, যান্ত্রিক, ভাবপ্রবণতা ইত্যাদি অনেক কিছুর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ মাথা তুলেছে আমারই মধ্যে! আমি নিজে ভাবপ্রবণ অথচ ভাবপ্রবণতার নানা অভিব্যক্তিকে ন্যাকামি বলে চিনে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছি। ভদ্রজীবনকে ভালোবাসি, ভদ্র আপনজনদেরই আপনি হতে চাই, বন্ধুত্ব করি ভদ্রঘরের ছেলেদের সঙ্গেই, এই জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে নিজস্ব করে রাখি, অথচ এই জীবনের সংকীর্ণতা, কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা, প্রকাশ্য ও মুখোশ পরা হীনতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে।
এই জীবন আমার আপন অথচ এই জীবন থেকেই মাঝে মাঝে পালিয়ে ছোটলোক চাষা-ভুষোদের মধ্যে গিয়ে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি। আবার ওই ছোটলোকদের অমার্জিত রিক্ত জীবনের রুক্ষ কঠোর নগ্ন বাস্তবতার চাপে অস্থির হয়ে নিজের জীবনে ফিরে এসে হাঁফ ছাড়ি |
বাড়তে বাড়তে এই সংঘাত প্রথম যৌবনে অবর্ণনীয় প্রচণ্ডতা লাভ করে লিখতে আরম্ভ করার পর বাস্তবকে স্বীকৃতিদানের ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে এই সংঘাতের তীব্রতা কমে আসে ।
মার্কসবাদ আজ আমার এ সংঘাতের স্বরূপ চিনিয়ে দিয়েছে। এ সংঘাত হলো ভাববাদ ও বস্তুবাদেরই সংঘাত, সমাজজীবনে আজ যা প্রকট হয়েছে ও সাহিত্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।
সাহিত্য নিয়েও এই রকম সংঘাতের যাঁতাকলে পড়েছিলাম। বাংলা সাহিত্যকে ভালোবাসি, বাস্তবতার উর্ধ্বে তোলা মধ্যবিত্তের হৃদয় মনও ভাবপ্রবণতার প্রতিফলন বলেই এ সাহিত্যকে ভালোবাসি। আমার ভাবকে সরস করে ফেনিয়ে তুলে, কল্পনা স্বপ্নকে আরও রঙদার করে আমাকে মুগ্ধ ও মশগুল করে রাখে বাংলা সাহিত্য। আবার বাস্তবকে না পেয়ে, মধ্যবিত্ত জীবনে কৃত্রিমতা, বিকৃতি ইত্যাদির মুখোশ খুলে দনা দেওয়ার উদাসীনতা পরোক্ষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ানোয় এবং বাস্তব-ঘেষা সতেজ ও বলিষ্ঠ জীবনের অধিকারী মানবতার বিরাট অংশকে ঠাঁই না দেওয়ায়, বড়ই আপসোস আর রাগ হতো ।
সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ যেমন দিন দিন বাড়তে থাকে এই আপসোসও তেমনি তীব্র হতে থাকে। একদিকে যে সাহিত্য আমাকে অভিভূত করে ফেলে, আমার চেতনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে, অন্যদিকে সেই সাহিত্যই প্রবল নালিশ জাগায়, তীব্র জ্বালার সঙ্গে ভাবি এর কি প্রতিকার নেই।
এই সংঘাত থেকে সাধ জাগতো যে, আমি একদিন লেখক হবো। নিজেই প্রতিকার করবো |
সাধ ক্রমে ক্রমে পণ্য হয়ে দাঁড়ায়। লেখক আমি হবোই। কিন্তু যতই হোক,মধ্যবিত্ত মন তো। স্কুলজীবনের লেখক হবার কল্পনা কলেজজীবনে ক্রমে ক্রমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় পরিণত হলেও - সেটা কাজে পরিণত করার কোন চেষ্টাই করতাম না। ভাবতাম এখন নয়, সাহিত্য চর্চা ছেলেমানুষের কাজ নয়। বয়স বাড়ুক, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা বাড়ুক, পাস-টাস করে চাকরি-বাকরি নিয়ে জীবনটাকে গুছিয়ে নিই, তারপর সিরিয়াসলি শুরু করা যাবে সহিত্যের ক্ষেত্রে অভিযান!
রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ করিনি । রবীন্দ্র সাহিত্যও পড়তাম, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস পড়েও আমার মনে কোনো প্রশ্ন বা নালিশ জাগতো না | কবি বলে রবীন্দ্রনাথকে সত্যই আমি রেহাই দিয়েছিলাম। যেমন তাঁর 'কাবুলীওয়ালা' গল্প পড়ে সত্যই এ কথা আমার মনে হয়নি যে কাবুলীওয়ালাকে তিনি শুধু স্নেহশীল পিতা হিসাবেই দেখলেন, অমন কত স্নেহশীল গরিব পিতার নিরুপায় পিতাকে সে যে কেমন জোঁকের মতো শোষণ করে সেটা তার চোখে ধরা পড়লো না!
বাংলা সাহিত্যে বস্তুবাদের আবির্ভাবকে সাহায্য করার দায়িত্ব থেকে আজ আমি তাঁকে রেহাই দিই! কেন দিই, সেটা এ প্রবন্ধে বলা সম্ভব নয়।
সাহিত্য করার আগের দিনের দ্বিতীয় ভাগটা প্রধানত প্রথম ভাগটারই জের ও পরিণতি |
বাংলা সাহিত্যে কল্লোল, কালি-কলমীয় ধারা অর্থাৎ যাকে বলা হতো ‘আধুনিক সাহিত্য এবং যাকে আধুনিক সাহিত্যিকেরা "বস্তুপন্থী'’ বলে দাবি করতেন--- এই ধারাকে আমি কিভাবে গ্রহণ করেছিলাম এটাই প্রধান কথা।
প্রসঙ্গক্রমে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, আমি ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র এবং যেমন আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞান পড়তাম তেমনি আগ্রহ নিয়েই আরম্ভ করেছিলাম যৌনবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব আর বিশ্বসাহিত্য পড়া।
সাহিত্যে ওই 'আধুনিক' মার্কা ধারাটা এসেছিল প্রচণ্ড শোরগোল তুলে, প্রায় একটা বিপ্লব মার্কা বিদ্রোহের রূপ নিয়ে । রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে সাহিত্যের অন্য দিকপালরা সচকিত হয়ে উঠেছিলেন তারুণ্যের এই বলগাহীন সাহিত্যিক অভিযানে, বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল ।
অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক আত্মসমর্পণ করেছিলেন এই দুরন্ত বন্যার কাছে, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আশীর্বাদ করেছিলেন এবং সাহিত্যে 'আধুনিকতা'’র কচি কচি নেতাকে নিমন্ত্রণ করে আলাপ ও ভাব করেছিলেন- পাছে এরা বাংলা সাহিত্যের অনেক কিছু ঐতিহ্যের সংগে তাঁকেও ছিন্ন ভিন্ন করে উড়িয়ে দেয়। দু-একজন তাল ঠুকেছিল। একজন কবি রবীন্দ্রনাথকে 'ডোন্ট কেয়ার' করার কবিতা পর্যন্ত লিখেছিল।
কোনো দেশে কোনো কালে খ্যাতনামা কবি বা সাহিত্যিককে গুণ্ডার মতো সোজাসুজি আক্রমণে ঘায়েল করে যেন কেউ কবি বা সাহিত্যিক হতে পেরেছে ।
বন্ধু-বান্ধবেরা খ্যাতি দিয়ে কি কোনো কবি বা সাহিত্যিককে খ্যাতনামা করতে পারে! খ্যাতনামা কবি বা সাহিত্যিক মানেই জনসাধারণ সমগ্র বা আংশিকভাবে, স্থায়ীভাবে অথবা সাময়িকভাবে যাকে তারিফ করছে । এদের ভূমিসাৎ করে কাব্যসাহিত্যের মোড় ঘুরানো যায় না। কাব্য সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়েই এদের ভূমিসাৎ করতে হয় ।
বাংলা সাহিত্যে এই আধুনিকতা একটা বিপ্লবের তোড়জোড় বেঁধেই এসেছিল কিন্তু বিপ্লব হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না-- সাহিত্যের চলতি সংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত তারুণ্যের বিক্ষোভ বিপ্লব এনে দিতে পারে না।
জোরের সঙ্গে দাবী করা হয়েছিল যে, আমরা বস্তুপন্থী সাহিত্য সৃষ্টি করেছি, কিন্তু প্রকৃত বস্তুবাদী আদর্শ কল্লোল , কালি-কলমীয় সাহিত্যিকের পিছনে ছিল না।
সচেতনভাবে বস্তুবাদের আদর্শ অবলম্বন করে নয়, বাস্তবতাই মধ্যবিত্তের জীবনে ও চেতনায় ভাববাদ ও বস্তুবাদের যে সংঘাত সৃষ্টি করেছিল, যে সংঘাত আমার জীবনে ও চেতনায় প্রকট হয়েছিল, সাহিত্যে তারই স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল এই বিদ্রোহ ।
১৩৩৩ সালের 'কালি-কলমে' সাহিত্যের নতুন অভিযানের স্বপক্ষে প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি চিঠি ছাপা হয় । তিনি লিখছেন ''জীবনকে দেখবার পাঠ নিতে যদি হ্যামসুন গোর্কির পাঠশালায় গিয়ে থাকি তাতে দোষ কি ... গোর্কি-হ্যামসুনের জগতে এলে ইউক্লিডেরা ফাঁপড়ে পড়ে। এ যে একেবারে মগের মুলুক ! এ যে জীবনের জটিল দুর্বোধ্য জগৎ!''
চিঠিখানায় আরও কয়েকবার 'হ্যামসুন-গোর্কি'র নামোল্লেখ আছে। প্রেমেনবাবুর ছোট একখানা চিঠিতে সাহিত্যে নতুন বিদ্রোহের স্বরূপ যেন ধরা দিয়েছে, বেশি দূর হাতড়াতে হয় না । বাংলা সাহিত্যে জীবন নেই, সব কিছুই গণিতের নিয়মে ছকে বাঁধা প্রাণহীন ব্যাপার। হ্যামসুন-গোর্কির মগের মুলুকে পরিণত করতে হবে বাংলা সাহিত্যকে!
হ্যামসুনের দু-একখানা বই পড়েছিলাম। প্রেমেনবাবুর এই চিঠি পড়ে গোর্কির সঙ্গে প্রথম পরিচয় করতে যাই। মনে আছে, মাদার পড়তে পড়তে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম-- হ্যামসুন আর গোর্কিকে প্রেমেনবাবু মেলাবেন কি করে?
আমার তখন হ্যামসুনেও আপত্তি ছিল না, গোর্কিতেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু ভাবের আকাশের ঝড় আর মাটির পৃথিবীতে জীবনের বন্যার পার্থক্য কি ধরা না পড়ে পারে?
অসীম আগ্রহ নিয়ে আধুনিকদের লেখা পড়ি। ভাষার তীক্ষ্ণতা, ভঙ্গির নতুনত্ব, নতুন মানুষ ও পরিবেশের আমদানি, নরনারীর রোমান্টিক সম্পর্ককে বাস্তব করে তোলার দুঃসাহসী চেষ্টা আশা ও উল্লাস জাগায়-- তারই পাশাপাশি হালকা নোংরা রোমান্টিক ন্যাকামি তীব্র বিতৃষ্ণা জাগায়।
বিতৃষ্ণা জাগাতো কিন্তু খুব বেশি বিচলিত হতাম না। জীবনের কতগুলি বাস্তব নিয়মে আমার বিশ্বাস ছিল । তখনই আমি জানতাম যে, সমাজে যেমন সাহিত্যেও তেমনি বড় একটা আলোড়ন দেখা দিলে সেই সুযোগে কতকগুলি চ্যাংড়া কিছু ফজিলামি জুড়বেই— আসল আন্দোলনটা যদি ঠিক থাকে এই সব হালকা ছ্যাবলামির জন্য বিশেষ কিছু আসবে যাবে না।
শনিবারের চিঠির 'হায় হায়, সব গেল' আর্তনাদ অকারণএবং হাস্যকর মনে হতো। সুযোগ পেয়ে কয়েকজন বাজে মানুষ খানিকটা নোংরামি এবং ন্যাকমি করেই যদি একটা দেশের সাহিত্যকে গোল্লায় পাঠাতে পারে, তবে সে সাহিত্যের গোল্লায় যাওয়া উচিত।
“আধুনিকতা’র আন্দোলন, যদি শৈলজানন্দের খাঁটি গ্রামের মানুষ আর কয়লাখনির কুলিদের সাহিত্যে আনা সম্ভব করে থাকে, বস্তির জীবনকে অন্তত সাহিত্যে প্রবেশের পথ করে দিয়ে থাকে, — শুধু এইজন্যই রাশিকৃত জঞ্জালের আবির্ভাবটা ক্ষমা করা চলে |
আশা করেছিলাম অনেক কিন্তু ক্রমে ক্রমে টের পেলাম সাহিত্যে যে অভাব, যে অসম্পূর্ণতা, আমাকে তীব্রভাবে পীড়ন করছে তার পূরণ হচ্ছে না। শৈলজানন্দের গ্রাম্য জীবন ও কয়লা খনির জীবনের ছবি হয়েছে অপরূপ-- কিন্তু শুধু ছবিই হয়েছে। বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে এই বাস্তব সংঘাত আসেনি। বস্তিজীবন এসেছে কিন্তু বস্তিজীবনের বাস্তবতা আসেনি— বাস্তির মানুষ ও পরিবেশকে আশ্রয় করে রূপ নিয়েছে মধ্যবিত্তেরই রোমান্টিক ভাবাবেগ । মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা আসেনি, দেহ বড় হয়ে উঠলেও মধ্যবিত্তের অবাস্তব রোমান্টিক প্রেম বাতিল হয়নি, ওই একই রোমান্স শুধু দেহকে আশ্রয় করে খানিকটা অন্যভাবে রূপায়িত হয়েছে।
শৈশব থেকে সারা বাংলার গ্রামে শহরে ঘুরে যে জীবন দেখেছি, নিজের জীবনের বিরোধ ও সংঘাতের কঠোর চাপে ভাবালুতার আবরণ ছিঁড়ে ছিঁড়ে জীবনের যে কঠোর নগ্ন বাস্তব রূপ দেখেছি— সাহিত্যে কি তা আসবে না? এই বাস্তব জীবন যাদের--সেই সাধারণ বাস্তব মানুষ?
অথচ প্রথম গল্পই আমি লিখি 'অতসীমামী’— রোমান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনী । কিন্তু এ গল্প সাহিত্য করার জন্য লিখিনি-- লিখেছিলাম বিখ্যাত মাসিকে গল্প ছাপানো নিয়ে তর্কে জিতবার জন্য। এ গল্পে তাই নিজের আসল নাম দিইনি, ডাক নাম 'মানিক' দিয়েছিলাম ।
কিন্তু পরেও কি রোমান্টিক কাহিনী আমি লিখিনি— কোমর বেঁধে যখন লিখতে আরম্ভ করেছি ? লিখেছি বৈকি, দিবারাত্রির কাব্য তার চরম নিদর্শন।
যে সংঘাতের কথা বলছি — এ ও তারই প্রমাণ । ভাববাদ যদি একেবারে বর্জন করতেই পারতাম— তবে আর সংঘাত থাকতো কিসের !
সচেতনভাবে বস্তুবাদের আদর্শ গ্রহণ করে সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাহিত্য করিনি বটে— কিন্তু ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল। কোন সুনির্দিষ্ট জীবনাদর্শ দিতে পারি নি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার অভাব খানিকটা মিটিয়েছি নিশ্চয় |
তারও প্রয়োজন ছিল বৈকি ! অন্তত খাঁটি বস্তুবাদী জীবনাদর্শ গ্রহণ করার স্তরে উঠবার একটা ধাপ হিসাবে।আরম্ভ করেছি?
--লেখকের কথা, ১৯৫৭
0 মন্তব্যসমূহ