মোস্তাক আহমাদ দীন
বিচিত্ররকম কবিতা আস্বাদনের ক্ষেত্রে উদারতা দেখালেও অন্যান্য মাধ্যমের নানাবিধ শিল্পপ্রয়াস গ্রহণের ক্ষেত্রে বাঙালিরা এখন পর্যন্ত কৃপণ। হয়ত এ কৃপণতা নয়, পঠন/দীক্ষণ-এর দীনতার কারণে একধরনের নিরুপায় অপারগতা।
অন্তর্জাত আবহ-সংরাগী ওয়ালীউল্লাহ্র প্রতি লালসালুতাড়িত পাঠকদের নানা অভিযোগ জারি ছিল দীর্ঘদিন, পরবর্তীকালে প্রযুক্তির তোড়ে দেশহারা হলে এই আপাতনির্দেশ পাঠকেরাও শেষপর্যন্ত তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফসল চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদোকে মেনে নেয়। কিন্তু শওকত ওসমানের জননী ও অন্যান্য বই সেভাবে মান্যতা পায়নি। জননী দরিয়া বিবি শুধু মহত্বের গৌরবে চিত্রিত নয়, তার জীবনে অগৌরব ও ব্যর্থতা আছে, আছে রূঢ় বাস্তবতার চাপে নিরুপায় নেতিযাত্রাও; তার ওপর ছিল এমনতর নির্ভেদ উপলব্ধিও : ‘সব জেতে (জাতিতে) ঐ এক ব্যাপার’--একই মনের এতটা দ্বন্দ্ব-জট গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিল না বাঙালি পাঠক। অথচ তারও আগে চিরায়ত মাতৃপ্রতিমার প্রতি ধাক্কা-প্রদানকারী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননী উপন্যাসটি বেরুনোর ফলে নতুন উপন্যাস গ্রহণের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকবার কথা ছিল। জনপ্রীতিকে বড় করে দেখে এ-মন্তব্য নয়, কারণ ব্যক্তিরুচি তা গ্রহণে যে-দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণ করুক না কেন, সাহিত্য-ঐতিহাসিকেরা তা অস্বীকার না-করে বরং অঙ্গীকারে বাধ্য, তবু সাহিত্যে ব্যাপকতা গৃহীত না-হলে তা রুদ্ধস্রোত তো হয়ই, বিপথগামীও কম হয় না, যার ফল একালের মা-এর সঙ্গে সেকালের জননী ও Mother-এর তুল্যমূল্য বিচারে লক্ষ করা গেছে!
তবু শওকত ওসমানের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে যে তাঁকে একালের রুচি ও প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়নি, তাই জননী লেখার আগে বা পরে পাঠক-প্রতিক্রিয়া যাই হোক, সে-মাধ্যমে নিরন্তর সক্রিয় ছিলেন তিনি। এ-ক্ষেত্রে তাঁকে উচ্চাভিলাষীই বলা যায়। ওয়ালীউল্লাহ্ ও শওকত ওসমানের ক্ষেত্রে ‘উচ্চাভিলাষী’ বিশেষণটিই ব্যবহার করেছিলেন শওকত আলী; আমরা ওয়ালীউল্লাহ্কে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জনের বিবেচনায় তাঁকে উচ্চাকাঙ্ক্ষীই বলার পক্ষপাতী, আর শওকত ওসমানকে অবশ্যই উচ্চাভিলাষী : ক্রীতদাসের হাসি, পিতৃপুরুষের পাপ, পতঙ্গ পিঞ্জর এবং আরও অনেক কিছুই তাঁর উচ্চাভিলাষের তুঙ্গ প্রতিফলন। তাঁর জন্মশতবর্ষের দোরগোড়ায় এসে আজ একথা একারণেই জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে যে- তিনি এখনো বাঙালিমনের অকুণ্ঠ সমর্থন পাননি; না-পাওয়ার পেছনে এই উচ্চাভিলাষটাই প্রধান, তবু একে কোনোভাবেই নঞর্থে দেখার কারণ নেই, এর জন্য আমাদের মননদৈন্য, কুপমণ্ডুকত্বই দায়ী। কথাগুলো অনেকের কাছে শুধু গালভরা মন্তব্য মনে হবে বলেই শুধু নয়, এখনো সতর্ক হওয়ার কারণেও তা ব্যাখ্যাযোগ্য।
তুলনায় অজনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর কথা না-হয় বাদই থাকল, জনপ্রিয় উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি সম্পর্কে সম্প্রতিলিখিত [২০১৫] একটি আলোচনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি :
এ উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে যে-পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান তা বাংলাভাষার সাংগঠনিক শৈলীকে অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ করেছে। ঔপন্যাসিক সম্ভবত ভেবেছিলেন অষ্টম শতকের আরব্যোন্যাসের কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রেখে ভাষায় আরবি-ফারসির ব্যবহার যথার্থ হবে, অন্তত আবহ তৈরির ক্ষেত্রে তা সঙ্গতিপূর্ণ হবে। কিন্তু পরিবেশকে তুলে আনতে গিয়ে শওকত ওসমান উপন্যাসে যে পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন, তা বাংলার ভাষার জন্য অগৌরবের এবং অমর্যাদার। একই সাথে আরবি-ফারসির ভারে উপন্যাসের ভাষা এতোটাই ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে যে, সেখানে মূল ভাষার [বাংলার] অস্তিত্ব সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে।
মন্তব্যগুলো নির্দ্বিধ নয় কেবল, দুঃসাহসিকতাপূর্ণও; সে-আলোচনায় পূর্ববর্তী আলোচকদেরও সমালোচনা আছে এবং সেখানে আলোচক সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন। যেমন : ‘যদিও শওকত ওসমান অষ্টম শতকের বাগদাদের আবহকে ফুটিয়ে তুলতে এ জাতীয় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন বলে কোনো সমালোচক মন্তব্য করেছেন; কিন্তু আমরা তাঁদের সাথে একমত নই। কেননা পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার জন্য বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।’ চরিত্রের সংলাপ প্রত্যাশিত গতি লাভে ব্যর্থ হয়েছে বলে এই আলোচক উপন্যাসের ত্রুটি নিরূপণ করে এও বলেছেন যে, ঔপন্যাসিকের উচিত ছিল ‘সংলাপে প্রচলিত আরবি-ফারসি, অথবা অপেক্ষাকৃত পরিচিত শব্দ ব্যবহার করা’, তাতে নাকি উপন্যাসের প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো। অন্যান্য আলোচকের আলোচনায় এ-কথার বিপক্ষে যে-মন্তব্যগুলো ইতোমধ্যে লিখিত হয়েছে সেগুলো সুলভ বলেই এখানে তার উল্লেখ করা যায়, কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি ও ভাব ভাষা ভাবনা বইয়ের লেখক সম্পর্কে ওকালতির আশ্রয় নেওয়া নিষ্প্রয়োজন। যিনি মনে করতেন উপদানের সঙ্গে বনিয়াদ ও গোটা নির্মাণের সম্পর্ক ওতপ্রোত, যিনি আধুনিক কাব্য ও উপন্যাসের উপর সিনেমার ছায়া পড়ছে বলে এই ভাবে সচেতন করেছিলেন যে, ‘সমাজের একটা আবয়বিক ঐক্য বা organic unity আছে। যারা এই দৃষ্টিমুখর চোখের অধিকারী তাদের কাছে অধিক ইশারা নিষ্প্রয়োজন।’ তিনি একটি বইয়ের বনিয়াদের জন্য চারটি অভ্যন্তরীণ উপাদানকে জরুরি মনে করে লিখেছিলেন :
১। সংগঠিত মনুষ্য-সমাজ,
২। যেখানে : ভাবের আদান-প্রদান,
৩। ভাব,
৪। উপযোগী ভাষা।
এমন ধারণা পোষণকারী একজন লেখক তাঁর উপন্যাসের ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটা সচেতন হতে পারেন এবং তাকে মুনীর চৌধুরীর মতো সমালোচক কেন ‘আরবী-ফারসী শব্দ প্রয়োগের এক রূপ-দক্ষ কারিগর’ বলে চিহ্নিত করেন তা সহজেই আন্দাজযোগ্য। এরপরও তাঁর অভিব্যক্তিগুলো কেন বিপুলভাবে জনাদৃত হলো না, বা, পাঠ্যতালিকাভুক্তির কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, আঙুলগণ্য যে-পাঠকদেরকে তিনি আকৃষ্ট করেছেন, তাদের মাধ্যমেও কেন বিমূল্যায়নের শিকার হন তার কারণও খোঁজা দরকার।
এ-ক্ষেত্রে আমাদের ধারণা তাঁর উচ্চাভিলাষের সঙ্গে অন্তর্লীন ব্যঙ্গদৃষ্টি এবং কোথাও-কোথাও দৃশ্যমান কৌতুকী ভাবটাই এর প্রধান কারণ, যে-প্রবণতা বাংলাসাহিত্যে কখনো জনাদৃত তো হয়ইনি, এমনকি বিস্তার লাভ পর্যন্ত করতে পারেনি। কেন বিস্তার লাভ করতে পারেনি, সে-প্রসঙ্গে যেতে গেলে প্রথমেই শওকত ওসমান কী ভাবে এই প্রবণতাটি ধারণ করেছিলেন সেকথাটিও বলা দরকার।
এমনিতে এতদিনে এ-মন্তব্যে আর কারও দ্বিমত থাকবার কথা নয় যে ক্রীতহাসের হাসি রূপকের আড়ালে অন্তরঙ্গ-বহিরঙ্গ উভয় ক্ষেত্রেই উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সার্থক রূপায়ণ। প্রথমে বিষয়টি চেপে রেখে নিজেকে আড়াল করার জন্য একটি গল্প ফেঁদেছিলেন শওকত ওসমান, সেই গল্প সত্য হলে হতেও পারে, সত্য না হলেও তাকে সত্যে পরিণত করার সাময়িক, বলা উচিত রাজনৈতিক, বাস্তবতা ছিল তখন এবং পরে বিষয়টি স্বীকারও করেছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের ধারণা, এই বাস্তবতার আড়ালে একে মর্মান্তিক করে তোলার জন্য কৌতুকী ভাবটাও কাজ করেছিল। এতে যে তিনি সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ উপন্যাসে যাদের বিরুদ্ধে তিনি [রূপকার্থ-]সমালোচনা করেছিলেন, তাদের হাত থেকেই এর জন্য আদমজী পুরস্কার গ্রহণ। এতে তাঁর অবস্থান দ্বান্দ্বিক হয়ে পড়লেও এই আড়াল গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল ওই ভাব ও ভাষা গ্রহণের কারণে। এই মনোভাব ক্রীতদাসের হাসিতে এসেছে সার্থকরূপে :
ইসহাক : মেহেরজান কোথায়, আলম্পনা?
হারুন : সে আর কারো ‘জানে’ মেহের (করুণা) ঢালতে গেছে।
ইসহাক : তা উচিত নয়। মেহেরজান বিবাহিত স্ত্রী। আর কারো জন্য সে হারাম।
হারুন : তোমার মতে সে হারাম। কিন্তু কারো কারো মতে হারাম নয়।
এমন ফতোয়া কেউ দিতে পারে।
হারুন : আলেম পারে। এই আলেম আবদুল কুদ্দুসের ফতোয়া। তিনি লিখেছেন মেহেরজান কেনা বাঁদী। মালিকের হুকুম ছাড়া তার কোনো শাদী হতে পারে না। যদি হয় তা না-জায়েজ (শাস্ত্র-সিদ্ধ নয়)। মজকুর বাঁদী মেহেরজান ও গোলাম হাবসী তাতারীর শাদী না-জায়েজ। সই দেখেছ।
বোঝাই যায় শরিয়ত-মতে এই ফতোয়ায় পূর্ব-বিচারে আপাতসত্যতা আছে, তবে তা ব্যক্তির প্রয়োজনে লিখিত ও ব্যবহৃত; এখানে যারা কবি আবু ইসহাকের মতো বিবেকের প্রশ্ন তুলবেন তাদের কাছে এটি যুগপৎ বেদনাদায়ক ও কৌতুককর, তবে তা রূপকে বা অন্য বাস্তবে রূপায়িত বলে স্বৈরাচারীকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁর এই প্রবণতা যে শুধু ক্রীতদাসের হাসিতেই ছিল তা নয়, ছিল জননী উপন্যাসেও :
মৌলানা দোজখের বর্ণনা দিতে দিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। কণ্ঠ শুকাইয়া গিয়াছিল, বোধ হয় আগুনের উত্তাপে। তিনি এক গ্লাস পানি গলাধঃকরণ করিলেন। একটি ঢেকুর তুলিয়া তিনি পুনরায় দোজখের আগুন দেখাইতে লাগিলেন। গরমের দিন। সভা আরো গরম হইয়া উঠিল।
মনে রাখতে হবে জননী উপন্যাসটির কিছু অংশ বেরিয়েছিল ১৯৪৪-৪৫ সালে, সওগাত-এ, কিন্তু আমরা তার গ্রন্থরূপ পাই ১৯৫৮ সালে, তার কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রƒপ গ্রহণের মতো মনোভাব তখনো আমাদের তৈরি হয়নি। তৈরি হলে এবং জনাদৃত হলে অন্তত এই ধারায় তাঁর কাছ থেকে আরও কিছু উপন্যাস পেতাম হয়ত; তা তো হলোই না, বরং সেই উপন্যাসটিই আমরা পেলাম ১৯৫৮ সালে। এর বাস্তবতা বোঝা যায় ১৯৯৮ সালে লিখিত আবদুল মান্নান সৈয়দের মন্তব্য থেকেও :
শওকত ওসমানের শ্রেষ্ঠ কাজ তাঁর লঘু রচনায় নেই; হাস্যচ্ছুরিত বা পরিহাসবিজল্পিত চুটকি রচনায় নেই; নেই সিরিয়াস প্রবন্ধসমূহে।...শওকত ওসমানের শ্রেষ্ঠ কাজ তাঁর বুদ্ধির দীপিতায় নেই, নেই তার সরসোজ্জ্বল (কখনো বা স্থূল) কথকতায়- আছে সেইখানে, যেখানে তিনি মমত্বময় ও সহৃদয়। 'দুই সৈনিক’-এর উপসংহারের বিদ্রুপে তাই হেসে উঠেছি বটে, ‘সমাগম’ একটু-বা মজা পেয়েছি বা একধরনের কৌতূহল উদ্রিক্ত বা শান্ত হয়েছে-- কিন্তু ‘আব্বাস’ গল্প পড়ে অপরাহ্ণিক বিষাদে প্লুত হয়েছি, ‘ভ্রুণাঙ্গ’ পড়ে অবৈধ অজাত সন্তানের জন্যে বোধ করেছি বেদনা, ‘ক্রীতদাসের হাসি’ পড়ে চোখ ভিজে গেছে।
শওকত ওসমানের হৃদয়বৃত্তিজাত লেখার প্রতি পক্ষপাত দেখাতে গিয়ে যে-কথাগুলি লিখেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, তাতে পরস্পরবিমুখতা স্পষ্ট। ‘আব্বাস’, ‘ভ্রণাঙ্গ’ ও ক্রীতদাসের হাসি' কি মনন-বুদ্ধিহীন রচনা? হয়ত তা বলা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, বিদ্রুপ ও ব্যঙ্গধর্মিতার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য, ফলে তাঁর লেখায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, চুটকি ও সরসোজ্জ্বল রচনা, সিরিয়াস প্রবন্ধ সবকিছুই একই কাতারে উল্লিখিত। আসলে এই ইঙ্গিতধর্মী কৌতুকী প্রবণতাটি কখনোই আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়নি এবং সাহিতের ইতিহাসে প্রায়শই কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারিচাদ মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ত্রৈলোক্যনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুকুমার রায়, পরশুরাম, শিবরাম চক্রবতী ও সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ [অতি] রিক্ত বিশেষণ সহযোগে বিবেচিত। আমরা, বাঙালিরা, এঁদেরকে এখনো আমাদের ব্যক্তিগত সাহিত্যরুচির বাইরে গিয়ে মূল্যায়ন করতে পারিনি বলে আজও বুঝে উঠতে পারিনি ইউরোপীয় উপন্যাসের ইতিহাসে সারভান্তেস কেন এত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত, বুঝে উঠতে পারি না মিলান কুন্দেরার মুখে কেন দন কিহোতের স্রষ্টা সারভান্তেসের এত জয়গান এবং স্টার্ন ও দিদ্রোকে কেন তাঁর এত পছন্দ। ফিলিপ রথের এক প্রশ্নের জবাবে কুন্দেরা লিখেছিলেন, উপন্যাসের গঠনভঙ্গির ক্ষেত্রে এরা ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নিরীক্ষাবাদী, তাদের নিরীক্ষাসমূহ, ‘মজাদার! প্রসন্ন আমোদে পূর্ণ, যা এখনকার ফরাসি সাহিত্যে নেই, অথচ এ ছাড়া ‘শিল্পের সবকিছুই তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।’ এই দু-জন, কুন্দেরার মতে, উপন্যাসকে বুঝেছিলেন মহান ক্রীড়া হিসেবে, ‘তাঁরা উপন্যাসের আঙ্গিকে কৌতুককে আবিষ্কার করেছিলেন।’ আমরা যে-বাস্তবতায় বাস করি সেখানে দাঁড়িয়ে আরব্য রজনীর গল্প-বাস্তবতাকে যুগপৎ বিয়োগান্তক ও কৌতুকী উপাদান ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তার প্রতি এত আগ্রহী কেন বোর্হেসের মতো লেখক? আবদুল মান্নান সৈয়দের বক্তব্যের সূত্র ধরে এই সকল দৃষ্টান্ত তুলে ধরার কারণ প্রবন্ধটি ১৯৯৮ সালের রচনা এবং সেটি হৃদয়বৃত্তির সমর্থনে লিখিত কিছু নির্বিচার মন্তব্যের প্রকাশমাত্র। পাঠ-অভিজ্ঞতায় লক্ষ করেছি যেসব আলোচনা পূর্ববর্তী মূল্যায়ন অস্বীকার বা অঙ্গীকার না-করে মন্তব্যপ্রধান হয়ে ওঠে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলোই প্রচারিত হয় বেশি, তাই এর পুনর্মুল্যায়ন দরকার। মান্নান সৈয়দ ভুঁইফোঁড় আলোচক নন, তাঁর আলোচনায় বিবেচিত হতে পারত হুমাযুন আজাদ-গৃহীত বহুলপ্রচারিত সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত এ-বিষয়ে শওকত ওসমানের স্পষ্ট প্রতিবাদী বক্তব্যটিও। হুমায়ুন আজাদ যখন বলেছিলেন, ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে কৃত বঙ্কিমের ‘এতোটা প্রতিভা ইয়ারকিতে ফুরাইল’ মন্তব্যটি শওকত ওসমানকে পড়বার সময় তাঁর নিজেরও মনে পড়ে, তখন এর জবাবে তিনি লিখেছিলেন :
বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছেন তা নিতান্ত মূর্খতাপ্রসূত। প্রজন্মে ফারাকের কথা উত্থাপন করা যায়। রোমান্টিসিজমের হাওয়ায় মাতাল বঙ্কিমচন্দ্র এবং এই হাওয়া য়ুরোপ-আগত। ...বৃটিশের ডেপুটি তো। ঈশ্বরগুপ্ত খাঁটি বাঙালি এবং বুদ্ধির ওপর দাঁড়িয়ে কবিতা লেখেন। আর বঙ্কিমচন্দ্র গদ্য লিখলেও বুকে হাঁটেন। ...তাই প্রতিভাধর বঙ্কিম মুর্খের মতো ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছেন। আমি আজও ঈশ্বরগুপ্ত উপভোগ করি। বুদ্ধিনির্ভর না হয়ে বক্ষনির্ভর হওয়ার ফলে গত দুশো বছর সামাজিক কী দুর্ভোগ আমরা বহন করছি। তা কারও এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। স্যাটায়ার একটা শিল্পমাধ্যম। তার ওপর তুমি এত খড়গহস্ত কেনো? সার্ভান্টিজের মতো মহৎ শিল্পী তো সহজে নাকচ হয়ে যাবে।
এটা ঠিক যে, ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিমের এই সমালোচনা বহুলশংসিত, আর উক্ত মন্তব্যটি তো আরও বেশি প্রচারিত, বিষয়টি শওকত ওসমানের মতো কৃতবিদ্য ব্যক্তির অজানা থাকবার কথা নয়- বিশেষ করে তিনি যে-প্রকৃতির লেখক তাঁর পক্ষে কমলাকান্তের দপ্তর-এর লেখকের খুঁটিনাটি-বিষয়ে ভালোভাবেই অভিহিত থাকবার কথা- তবু তাঁর এই মন্তব্যটির যে-সীমাবদ্ধতার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, সে-বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে কারও কারও, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে শওকত ওসমানের সাহিত্যদর্শনের অভিমুখটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, সেখানে তাঁর সাহিত্যচিন্তার অনেক কথাই বলেছিলেন শওকত ওসমান, আর হুমায়ুন আজাদও ফাঁকে ফাঁকে লেখক সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছিলেন : ‘জ্ঞানের বিভিন্ন এলাকার প্রতি তাঁর আকর্ষণ অতি তীব্র, তাঁর অধীত বিদ্যাও বিপুল।’ তাঁর এই জ্ঞান তিনি প্রবন্ধ রচনায় তো কাজে লাগিয়েছেনই, তা মর্মে ক্রিয়াশীল ছিল ছোটোগল্প ও উপন্যাস রচনায়ও, এমনকি শ্লোক রচনায়ও- অর্থাৎ যেখানে হৃদয়বৃত্তির তাড়না, সেখানেও জ্ঞান ও মননচেতনা সমানভাবে কাজ করেছে। তাঁর উচ্চাভিলাষী উপন্যাস সমাগম-এর কথা মনে করা যেতে পারে, যেখানে মননচেতনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর শুভবোধও। এই শুভবোধ একটু প্রকটিত হয়েছে বলে কেউ কেউ সমাগম-এর শিল্পমান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করতে পারেন, কিন্তু এ-কথা স্বীকার করতে হবে যে, কল্পনার সাহায্যে তিনি যে-গল্পটি তৈরি করেছিলেন, তা ছিল অভাবিতপূর্ব। সমস্যা হলো, যারা এই উপন্যাসটিকে মূল্যায়ন করেছেন তাদের প্রায় সকলেই ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটিকে মাথায় রেখেই করেছেন। স্বীকার করছি, এই দুই উপন্যাসই রূপক, তাই বলে দুটির প্রকৃতি কোনোভাবেই এক নয়- একটিতে রয়েছে চিরকালিক অভিব্যক্তির রূপায়ণ, অন্যটিতে যুগসংকটের বর্ণনা, কিন্তু আমরা একই সঙ্গে দুটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় গ্রহণ করতে পারিনি, একটিকে ‘সফল নিরীক্ষা’ বলে অভিহিত করলেও অন্যটিকে ‘ব্যর্থ নিরীক্ষা’ বলে অভিহিত করতে আমাদের জিহ্বা এতটুকু কাঁপেনি। অথচ দুটি উপন্যাসেই জড়িয়ে আছে তাঁর সেই উচ্চাভিলাষী কৌতুকী দৃষ্টিভঙ্গি, যাকে যথা অর্থেই সহৃদয়মননসংবাদী বলে আখ্যায়িত করা যায়। আমরা, বাঙালিরা, তা সময়মতো গ্রহণ করে উঠতে পারিনি বলে শওকত ওসমান সেই ধারায় আর এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। এখানে এ-কথার সপক্ষে একটি প্রসঙ্গ তুলেই লেখাটি শেষ করতে চাই; তা হলো, ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর লালসালুর মতো সফল উপন্যাস লেখার পরও আবু শারিয়া ছদদ্মনামে আগলি এশিয়ানস ও হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিনস নামে ইংরেজি ভাষায় দুটি উপন্যাস কেন লিখেছিলেন এবং তার বিষয়টাই বা কী? কুন্দেরা ফরাসি উপন্যাসের যে-কৌতুকী ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে বলে আফসোস করেন, এই দুটি উপন্যাসে তার ছিটেফোঁটা আছে কি না, এবং এই কারণেই, অর্থাৎ কৌতুকী প্রবণতার জন্যই কি শুধু বাংলাভাষী পাঠকের ওপর ভরসা করতে পারেননি ওয়ালীউল্লাহ্? বিষয়টি আমাদের জানা দরকার এবং তা যদি সত্য হয়, তাহলে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, শওকত ওসমানের যথার্থ বিবেচনার জন্য তো অবশ্যই, নানা মাধ্যমের শিল্পপ্রয়াস ও তার বিচিত্র প্রকৃতি উপলব্ধির জন্য আমাদের গ্রহণসামর্থ্য বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
...........................
মোস্তাক আহমাদ দীনের জন্ম ১৯৭৪ সালের ১১ ডিসেম্বর, সুনামগঞ্জ জেলার ইসহাকপুর গ্রামে। বাংলাভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। পিএইচডি করেছেন ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, অধ্যাপক তপধীর ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি। ২০০১ সালে বের হয়েছে প্রথম কাব্য 'কথা ও হাড়ের বেদনা'। ২০০৫-এ কাব্য- 'জল ও ত্রিকালদর্শী', ২০০৯-এ 'জল ও শ্রীমতি', ২০১২-এ 'ভিখিরিও রাজস্থানে যায়'। এই কাব্যের জন্যে পেয়েছেন ২০১২ সালের 'এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার'। 'কবিতাযাপন' নামে তাঁর একটি বিশিষ্ট গদ্যের বইও প্রকাশিত হয়েছে, ২০১১-য়। লোকজীবন ও লোকসাহিত্যের প্রতি তাঁর টান বিশিষ্ট মাত্রা পেয়েছে। তাঁর সম্পাদনায় বেশ কয়েকজন লোক-কবির পাণ্ডুলিপি বই হয়ে বেরিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মকদ্দস আলম উদাসী'র 'পরার জমিন', 'আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : তাঁর স্মৃতি তাঁর গান, ১৯৯৯। পেশায় শিক্ষক। সিলেট কমার্স কলেজের উপধ্যক্ষ। এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার পেয়েছেন ২০১২ সালে।
0 মন্তব্যসমূহ