
প্রতিটি লেখককে প্রায়ই যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তা হল- আপনি কী লিখতে চান? এই প্রশ্নটি যত না পাঠকের কাছ থেকে উঠে আসে, তার থেকে বেশি, লেখক নিজেকেই এই প্রশ্নটি করেন। তবে কি একজন লেখক সর্বদা সজাগ থাকেন না তাঁর নিজের লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে?
নাকি তাঁর উদ্দেশ্য প্রতি নিয়ত এতটাই পরিবর্তিত হতে থাকে যে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে তিনি নিজেই তাঁর লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চান না?
কলেজে পড়াকালীন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, আমি একজন লেখক হতে চাই। লেখক ছাড়া আমি আর অন্য কিছু হতে চাই না।
আমার এই সিদ্ধান্তের পেছনে ঠিক কোন কোন বিষয় কাজ করেছিল তা বলা বেশ মুশকিল। কেননা সেই সময়ে আমি একটি মাত্র ছোটগল্প লেখা শেষ করতে পেরেছিলাম। এবং গল্পটি নিয়ে আমি মোটেও উচ্চাশা পোষণ করতাম না। তবে একটি বিষয়ে আমার মধ্যে কোন দ্বিধাবোধ ছিল না। তা হল, আমি জানতাম, আমি আমার চারপাশকে শুধু ছাপানো-অক্ষর দিয়েই বানিয়েছি, ফলে আমার চারপাশে যা আছে, যাঁরা আছেন, তা সকলই - কালো। কালো কালো ছাপা অক্ষরমাত্র।
২০০৫ সালে বাবা মারা গেলেন। ততদিনে আমি কলেজ ছেড়ে দিয়েছি। বাবার পেনশানের টাকায় এতদিন সংসার চলত। এবার সংসার চলবে বই-এর পৃষ্ঠায়, সেমিকোলনে, বাংলা হরফে। মা চলে গেল দিদির বাড়ি। আমি চলে গেলাম কলকাতা থেকে অনেক দূরে। একটা পেট্রোল পাম্পে ম্যানেজারি করতে।
তবে কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েই গেল। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ নিয়েছিলাম। প্রতি পনেরো দিন অন্তর সেখান থেকে কলকাতায় এসে বই পালটিয়ে নিয়ে যেতাম।
কলকাতার ফুটপাতে বকুলফুল পড়ে থাকত। ফেরার পথে আমি দেখতাম, শুকনো ফুলগুলোর সঙ্গে কচি কচি ফুলগুলো শহরবাসীর পায়ের তলায় থেৎলে গেলেও কী-এক মায়ায় হলুদ ল্যাম্পপেস্টের দিকে আপলক তাকিয়ে থাকতে পারে।
পেট্রোলপাম্পটি কোন ন্যাশানাল হাইওয়ে সংলগ্ন ছিল না। হেটোড় হাট, কুলতলি, সানকি বিবির ঘাট, কত সব গ্রাম আর গঞ্জের সংযোগ স্থলে এটির অবস্থান।
সামনেই নদী। নদীটি শান্ত নয়; কোলাহলমুখর। এখানে বানিজ্য চলে। ট্রলারের পর ট্রলার দাঁড়িয়ে থাকে। কোন এক শুভক্ষণে তারা মাছ ধরতে পাড়ি দেবে বঙ্গপোসাগরে।
সেই উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্যাদি সংগ্রহ। সেই উদ্দেশ্যে সারারাতব্যাপী জ্বালানী ক্রয়।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল ব্যারেলের শব্দে। অদূরেই মাঝিদের গ্রাম থেকে কাঁসরের ঘণ্টা ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তখনও ঘুম চোখ আমার। দেখি জনা তিন লোক দু' লিটারের পেপসির খালি বোতল নিয়ে হাজির। তারা আমার কাছ থেকে তেল কিনে নিয়ে যাবে।
- এত ভোর বেলা?
যে উত্তর পাওয়া গেল তা বেশ সন্দেহজনক। তবু আমি আর বেশিকিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বোতলটা ভর্তি করে দিয়ে দিলাম।
দুপুরে বাতাসে গুঞ্জন ভাসে। আমার ইংরেজি নভেলের পাতা উড়ে যায় হাওয়ায়। শুনতে পাই পাশের গ্রামের এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
কী লিখব। আমি? কী লিখতে চাই?
এখানে নির্জন দুপুরবেলা ঢোঁড়া সাপ গুটিয়ে শুয়ে থাকে খাটের পায়ায়। যথেচ্ছ কার্বলিক অ্যাসিডেও তাঁর কোন নড়নচড়ন নেই। যেন এই তার বাড়ি, এই তার কুঁড়েমির সংসার। আমি কেন তাকে অযথা অপ্রস্তুতে ফেলছি!!
দুইজন তুলনামূলক অবস্থাপন্ন চাষির মধ্যে জমি নিয়ে বিবাদ চলছিলই। কিছু কিছু জায়গায় রেশনিং ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে জোরদার আন্দোলন গড়ে উঠছিল। কাছেই একটি রেশনের দোকান লুঠ হল। পরের দিন পুলিস এলাকায় ঢুকলে মানবপ্রাচীর গড়ে তুলল আন্দোলনকারীরা। পুলিস কাউকে গ্রেফতার করতে পারলেনা।
পেট্রলপাম্পের পাশেই লোকাল পার্টি অফিস। সেখানে গোপনে মিটিং চলত।
একদিন তুমুল হট্টগোল। সেই বিতর্কিত জমির উপর কেউ এক সরা ভাত ও কিছু ধূপকাটি রেখে এসেছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লাশ পড়ল। হাটের দিন। মেঘ থমকে গেল। গাছগুলো স্থির। রাতের বেলা লোডশেডিং হলে শুধু আলো জ্বলে এই পেট্রলপাম্পেই। আমি সেই আলোর মধ্যে বসে থাকি। একা। কখনো অপরিচিত বাইক এসে তেল নিয়ে ফিরে যায়। তারপর আবার নিঝুম। ব্যকারণের মত আওয়াজ তুলে ব্যাঙ ডাকে খালে ও বিলে।
কাজ বলতে তেমন কিছু নেই। প্রতিদিন সকালবেলা উঠে পেট্রল ও ডিজেলের ঘনত্ব মাপা। সেই অনুযায়ী চার্ট বানানো। একটা দুটো করে গাড়ি আসে। বেশির ভাগই হেভি ভেহিকেল। তাছাড়া আসে ভ্যান রিক্সা। ট্রলারের জন্য ব্যারেল ভর্তি করে তেল নিয়ে যায় তারা।
আমি ছাড়া আরও দুজন এখানে কাজ করে। তারা মাঝিদের গ্রাম থেকে আসে। মাছের গন্ধ পাওয়া যায় তাদের গা থেকে। একজন সকাল থেকে সন্ধে অব্ধি, অন্যজন সন্ধে থেকে মধ্যরাত অব্ধি থাকে।
ফলে যেসব বই নিয়ে আসি তা নয়-দশ দিনে শেষ হয়ে যায়। বাকি পাঁচদিন সেগুলোকেই আবার পড়া। পড়তে পড়তে প্রিয় বাক্যগুলো আমার শরীরেরই অঙ্গ হয়ে ওঠে। আমি অন্যমনস্কতায় চুলে হাত দিলেও চমকে উঠি। বুঝতে পারি। আমার ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলে চিকমিক করছে- There was a pleasure in abandoning himself to sickness, এই অমোঘ বাক্যটি।
একটি পাঞ্জাব লড়ির ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়েছে। সেটি টানা দুদিন মাঠের একপাশে কাত মেরে পড়ে আছে। খালাসি গিয়েছে নিকটবর্তী শহরে। গিয়েছে তো গিয়েছে, ফেরবার নাম নেই তার। ড্রাইভারের মুখ কালো। মালিককে ফোন করেও তেমন সুবিধে করতে পারছে না। সে মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে। রাস্তাঘাটের গল্প শোনায়। খাবে আর কোথায়? তাকে আমার সঙ্গেই বসে যেতে বলি।
ফেরবার দিন সে আমাকে একটা কাঠের বাক্স দিয়ে গেল। বাক্সের ভেতর কী আছে জানি না। সেটিকে নাড়ালে খচখচ শব্দ আসে। যেন কোন অপরিচিত আদিম, যেন কোন ফেরিওলার অপূর্ব বস্তুসামগ্রী। বাক্সটিকে কানের কাছে তুলে আবার নাড়াই। এবার বুঝতে পারি - He hoped that his mother, who was in some sense in the box and in some sense not, being released, a spirit released into the air, was more at peace now that she was nearer her natal earth. (Life & Time of Micheal K. J.M. Coetzee)
কী লিখব। আমি? কী লিখতে চাই?
আমি আমার চারপাশের সময়কালকে কতটুকু বুঝতে পারি? আমার চারপাশের মানুষজনকে কতটুকু জানি? কোন কোন অক্ষর, শব্দ, প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে আমি তাদের ব্যক্ত করতে পারব?
কিংবা আমি কি সত্যিই আমার চারপাশের মানুষজনকে ব্যক্ত করতে চাই? নাকি এতদিনে আমি গল্প উপন্যাস পড়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, যতটুকু এই মাধ্যমটির শিল্পকলা সম্পর্কে জেনেছি, সেই অনুযায়ী আমি আমার লেখা লিখতে চাই?
তবে কি আমি 'আমার লেখা' বলতে বোঝাতে চাইছি এই মুহুর্তে সাহিত্যের শিল্পকলা সম্পর্কে আমি কীরকম ধারণা পোষণ করছি এবং কোন কোন চরিত্রের মাধ্যমে কিভাবে তাকে ব্যক্ত করতে পারছি- তার একটি মিথোস্ক্রিয়া?
মায়ের সঙ্গে দেখা হয়না কতদিন। মায়ের হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। আমার কাছে চিকিৎসা করানোর টাকা নেই। দিদি চেষ্টা করছে। দিদি পারবে। আমি চেষ্টাও করছি না।
একপাশে কাঠের বাক্সটি রাখা থাকে। আমি সেটিকে খুলেও দেখিনি।
ঠিক করেছি ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী থেকে বেশ কিছুদিন বই তুলব না। ইংরাজি বই পড়লে ইংরাজি বাক্যগুলো সারাক্ষণ মাথার ভেতর গিজগিজ করে। আমি ইংরাজিতে লিখতে পারিনা। আমি বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় লিখতে পারি না।
বেশ কিছু না-পড়া বই আছে বাড়িতে। আর যাওয়া যায় কলেজস্ট্রীটে। কলেজস্ট্রিট যাব না। তিনমাস পর ঘরে ফিরব আজ।
দুপুরে রওনা দিয়েছিলাম। পৌছুতে পৌছুতে সেই রাত ন’টা। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি রাস্তায়।
বাড়ি ছাড়ার আগে মেইন সুইচ অফ করে গিয়েছিলাম। সেটিকে অন্য করতেই ধ্বংসস্তুপকে দেখতে পেলাম।
দু'-তিনটে কালবৈশাখী খেয়ে আমাদের ঘরদোর উলটাপালট হয়ে হয়ে গিয়েছে। মা টবে গাছ পুষেছিল। যাবার আগে তাতে জল দিয়ে গেছিল। কবে ফিরবে তা তো কেউ জানে না! সেই গাছগুলোর এখন শতছিন্ন অবস্থা। ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাথরুমের দিকের জানলাটা ভেঙে গিয়েছে। বেসিনে আরশোলা। মরা টিকটিকির কঙ্কাল চেয়ারের তলায়। সাবানদানি উল্টে পড়ে রয়েছে। সাবানটি আধখাওয়া। সাবানের গায়ে নখরের চিহ্ন স্পষ্ট।
এই ঘর আমার নয়। এই মেঝে, এই দেয়াল, বাবার ফটোগ্রাফ, বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ি কোন কিছুই আমার নয়।
মিয়াও, মিয়াও।
কোন এক ঘূপচি থেকে বেড়াল ডাকছে। আমি বেড়ালটিকে দেখা পাচ্ছি না। ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ পাচ্ছি। আমি কোন মানুষজনকে দেখতে পাচ্ছি না। ঐ দূরে কার বসতবাটির উপর ক্রেন উঠে এল। আমি কোন কান্না শুনতে পাচ্ছি না। জঙ্গলে গাছ পড়ছে। আমার অন্নদাতা গলায় কলসি বেঁধে পুকুরে ডুব দিচ্ছে। চা বাগান থেকে ফলিডলের শিশি গড়িয়ে নাবিছে সমতলে...
কী লিখব। আমি? আমি কী লিখতে চাই?
হে আমার শব্দ, হে আমার ব্যাকারণ, হে আমার আ-কার, ই-কার, উ-কার তোমরা আমার পাশে এসে দাঁড়াও । আমাকে গাছের ভেঙে পড়ার শব্দ শোনাও। আমাকে দেখাও লক-আউট কারখানার সঙ্গীত। আমাকে দেখাও আদিবাসী মুদ্রা।
আমি এই অচেনা ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি এই বিদেশে, এই অস্থানে, এই অসময়ে তোমাদের অপেক্ষায় কান পেতে রয়েছি।
তোমরা বজ্রপাতের মত নেমে এসো, অতর্কিতে আঘাত করো, মশাল জ্বালিয়ে, লণ্ঠন দুলিয়ে সোচ্চার হয়ে নেমে এসো আমার সাদা পৃষ্ঠায়।
4 মন্তব্যসমূহ
আঘাত করার মুহূর্তে কোন আততায়ী কি তার শ্বাস চেপে রাখে? ঠিক যেমন ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগে মাটির অনেক নিচের স্তরে ধীরে কিন্তু অব্যর্থ লক্ষে ঢেউ ওঠে! সাদিক এর লেখা আমাকে সেই অন্তর্ঘাতের আগাম ধারাবিবরণী দেয়। সব রকম সরল রেখা কে ভাঙো। তাদের হারিয়ে যেতে দাও মানুষের বেদনা আর ষড়যন্ত্রকারীদের ফিসফাস এর মধ্যে। এই নাশকতার মানচিত্রে কোন জনপদ ফের মাথা তুলে দাঁড়াবে তা তো আমরা কেউই জানিনা।
উত্তরমুছুনআমি আমার চারপাশের সময়কালকে কতটুকু বুঝতে পারি? আমার চারপাশের মানুষজনকে কতটুকু জানি? কোন কোন অক্ষর, শব্দ, প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে আমি তাদের ব্যক্ত করতে পারব?
উত্তরমুছুনকুলদা রায়কে আমি আবিষ্কার করেছিলাম একদিন। তারপর তিনি সন্ধান দিয়েছে রত্নখনির। পেয়েছিলাম শামিম আহমেদকে। আজ পেলাম আরেক রসখনির সন্ধান।
উত্তরমুছুনকুলদা রায়কে আমি আবিষ্কার করেছিলাম একদিন। তারপর তিনি সন্ধান দিয়েছে রত্নখনির। পেয়েছিলাম শামিম আহমেদকে। আজ পেলাম আরেক রসখনির সন্ধান।
উত্তরমুছুন