
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
যে কটি উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে এ জীবন স্বার্থক, “দ্য কায়রো ট্রিলজি” তার মধ্যে অবশ্যই অগ্রগণ্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আরব সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে কায়রো শহরকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস রচনা করেছেন প্রখ্যাত মিশরীয় ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজ।
কায়রো তখন ব্রিটিশ অধিকৃত। সমাজের সেই পরিবর্তনকালীন সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজের নৈতিকতা ও ভণ্ডামি, ধর্মীয় রক্ষনশীলতা ও বিভ্রান্তি, দিশাহীনতা ও শেষে বিভিন্ন পৃথক, জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিপথের ইশারার দর্পণ এই মহাকাব্যসম উপন্যাস।
তিন খন্ডে বিভক্ত এই উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে উচ্চ-মধ্যবিত্ত আব্দেল আল জাওয়াদ পরিবারের তিনটি প্রজন্ম - পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের জীবন ও মনন, বৃহত্তর সমাজের সাথে তাদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম, প্রেমহীনতা, ভগ্ন প্রেম ও তার নিদারুন যন্ত্রণা পাঠককে অবশ্যম্ভাবীভাবে তলস্তয়ের classic-র সাথে তুলনায় মগ্ন করবে।
বাড়ির কর্তা আল সাইয়েদ (Mr.) আহমেদ আব্দেল আল জাওয়াদ এক মধ্যযুগীয়, স্বৈরতন্ত্রী গোষ্ঠীপতি। তিনি একদিকে কঠোরভাবে, দাপটের সাথে সংসার শাসন করেন ও অন্যদিকে সংগোপনে, অতি দক্ষতায় চূড়ান্ত ভন্ড জীবন অতিবাহিত করেন। তার দুটি সমান্তরাল জীবন সম্পূর্ণ compartmentalized। গোপন আড্ডায় নিত্যদিন সন্ধ্যাকালীন অবসর বিনোদনে সঙ্গী বন্ধু ও প্রণয়ীরা। বাড়িতে কিন্তু কঠোর পর্দা-প্রথা। তিনি বসে থাকেন আরাম কেদারায়, ভীরু স্ত্রী আমিনা পদতলে হাঁটু মুড়ে। তাঁর অনুমোদনের অপেক্ষা না করে ছেলের সাথে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অপরাধে সামন্ততান্ত্রিক অধিকারবোধে নিরীহ স্ত্রীকে সাময়িক ভাবে পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা করেন না। স্বামী, সংসার, সমাজ ও ধর্মে আমিনার দ্বিধাহীন পূর্ণ আনুগত্য আমাকে হয়তো কিছুটা অধৈর্য করে তুলেছিল। এমনকি কখনও কখনও মনে হয়েছে, সম্পর্কটা স্বামী- স্ত্রীর নয়, মনিব ও বাঁদীর। কিন্তু এও তো সত্য - সেই সময়ে মেয়েদের না ছিল শিক্ষা, না ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অধিকাংশ সময়ে মেয়েরা ভাগ্য-বিড়ম্বিত, উদ্ধারপ্রাপ্তির আশা শুধু এক লাগসই বিয়েতে। বিবাহিত জীবনেও স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কোন ভারসাম্য ছিল না, বিশেষ করে স্বামী যদি হয় স্বৈরতন্ত্রী ।
তিন পুত্র ও দুই কন্যার সাথে বাবা আল সাইয়েদ আহমেদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কঠোর ও শীতল। এ অবশ্য আমাদের দেশেও পঞ্চাশ বছর আগে খুবই পরিচিত ও স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল। সন্তান ও বাবার মধ্যে যোগসূত্র মূলতঃ মা। দুই কন্যা আয়েশা ও খাদিজা সামান্যই শিক্ষার অধিকার পেয়েছে। আয়েশা সুন্দরী ও খাদিজা বাস্তববাদী। প্রথম পুত্র ইয়াসিন অগভীর ও চরিত্রহীন, দ্বিতীয় পুত্র ফাহমি আদর্শবাদী, তৃতীয় পুত্র কামাল আত্মানুসন্ধানী ও দিশাহীন।
পাশের বাড়ির কিশোরীর প্রতি যুবক ফাহমির অংকুরিত প্রেম ও তার দমন, বাবা আল সাইদের প্রেম বিষয়ে কপট উন্নাসিকতা, মা আমিনার প্রতি ফাহমির গভীর মমতা; অপরিসীম দরদ ও মননের সাথে মাহফূজ বর্ণনা করেছেন। ফাহমির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং অবশেষে তার ট্রাজিক পরিণতি উপন্যাসের উপর যেন এক ঘন কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দেয়। মা আমিনা ও মাতৃসমা বাড়ির ভৃত্যা উম্ম হানাফির শোক এত ঘন, এত পবিত্র যে পাঠক তার থেকে পরিত্রাণ পাবে না ।।
বিধবা আয়েশা দুঃখী, মানসিক অবসাদগ্রস্ত, হয়তো বা দুঃখবিলাসীও বটে। বৈধ্যবের পর কন্যা সহ সে স্থান নেয় মা আমিনার আশ্রয়ে। তার খোলামেলা নেশাগ্রস্ততা আমাকে কিছুটা অবাক করেছে। এ দৃশ্য ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজে প্রচলিত ছিল না ।
খাদিজার কাজল কালো চোখ, স্থূল সুন্দর দেহের গর্ব, দৃঢ় অবরোধের আড়ালেও পাণিপ্রার্থীর প্রত্যাশা যেন মধ্যযুগের ইউরোপের ক্লাসিক চিত্র শিল্পের আভাস দেয়। এক ঝলক দেখে খাদিজাকে পছন্দ করে ফেলা যোগ্য পাণিপ্রার্থীকে বিয়ের অনুমতি দিতে বাবা আল সাইয়েদ আহমেদের দ্বিধান্বিত বিরক্তি তাকে প্রায় হাস্যকর ভাবে আজব করে তোলে। একই সঙ্গে সন্তানের মঙ্গলকামনায় মা আমিনার সরল আকুলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সমস্ত জীবন তিনি শুধু আদেশ পালন করেছেন। স্বীয় বুদ্ধিমত সময়পযোগী পরামর্শ কিন্তু তিনি স্বামীকে বার বার দিয়েছেন। যদিও কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার ছিল না। তার মনোলোগ গুলি আন্তরিক, করুণ। তিনি বাধ্য, ধর্ষিত মূক, সরল, ধর্মভীরু আবার তিনিই উদ্যমী, মমতাময়ী। ছেলেদের সাথে মসজিদে যাবার বিবরণ, কায়রোর অলি গলি, তার সরল আনন্দ আমাকে একেবারে গ্রামীণ পটভূমিকায় রচিত অপুর রেল দেখার দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বাস্তবতা এখানে মিশে গেছে আলো আঁধারি পরাবাস্তবতায়।
ইয়াসিন ও তার স্ত্রীর চরিত্রহীনতা,সর্বনাশা সম্পর্ক, কদাচারের ইঙ্গিত, বাবা আল সাইয়েদ আহমেদের নিজের পাপাচার লুকানোর শিশুসুলভ প্রচেষ্টা একই সাথে বোধহয় ঘৃণা ও এক বিন্দু সহানুভূতিরও জন্ম দেয়। আমারতো মনে হয়েছে এটা এক লেখকী কৌশল, যা ব্যক্তিবিশেষকে একই সাথে হাস্যকর ও করুণ করে তোলে ।
ছোট ছেলে কামালের ভূগোল ও বিজ্ঞানের চর্চা, ধৰ্মবিশ্বাসে তার সংশয়, পরবর্তীতে ব্রিটিশদের সাথে সংযোগ – এ সমস্ত কিছুর অভিঘাত বৃদ্ধ পিতাকে তার আকাশচুম্বী গজদন্ত মিনার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরবর্তী সময়ে কামালের ভগ্ন প্রেম তাকে করে তোলে নিঃসঙ্গ; অবশেষে নিরীশ্বরবাদী। প্রেম সম্পর্কে তার হতাশা জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই উপন্যাসে ব্যক্তি বিশেষের প্রেম ও পরিবারের ওপর তার অভিঘাত, ভগ্ন-প্রেমের মলিন করুণ পরিণতি যেন জীবনানন্দের কবিতা - "পাবো নাকো কোনোদিন,পাবো নাকো কোনোদিন,পাবো নাকো কোনোদিন আর "।
বৃদ্ধ বয়সে অসহায়ভাবে বাবা আল সাইয়েদ আহমেদ প্রত্যক্ষ করেন তৃতীয় প্রজন্মের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মতাদর্শের সংঘাত - এক পৌত্র ইসলামী ধর্মোন্মাদ ও অন্যজন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।
আল সাইয়েদ আহমেদের মৃত্যু এক যুগের অবসান। বিভিন্ন চরিত্রের সাথে যুক্ত এই বিশাল সময়ে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন ধারার ক্রমবিবর্তন, বিশ্বাস ও বিশ্বাসহীনতা, ক্ষমতা ও তার ক্ষয় এক মহাকাব্যিক ঢঙে বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাস পড়তে গিয়ে কখনও পেয়েছি তেজপাতা গাছের মৃদু সুগন্ধ, কখনও বা অনুভব করেছি এক তীব্র গর্ভযন্ত্রণা।
উপন্যাসের নায়ক নায়িকা কে? বাবা আল সাইয়েদ আহমেদ ও মা আমিনা? নাকি ছোট ছেলে কামাল ও তার প্রেমিকা? জানিনা, প্রয়োজন নেই । মহাভারতের নায়ক কে? কৃষ্ণ, অর্জুন না কর্ণ? নায়িকা কে? কুন্তী, দ্রৌপদী না গান্ধারী? আসলে এক বিরাট পটভূমিকায় লেখা উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রর বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, কোন একজনকে কেন্দ্র করে সব ঘটনা ঘটতে পারে না। কোনও একজন মহান ও বিরাট না। অনেকে মিলেই একটা সময় পূর্ণ হয়ে ওঠে। উপন্যাসের শেষে বাড়ির ভৃত্যা উম্ম হানাফিকে দেখে মনে হয় তার ভূমিকা কিছু কম নয় এই পরিবারের ইতিহাসে। অথবা হয়তো একটু বেশিই অন্য অনেক সদস্যের থেকে।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কখনও মনে হবে চরিত্রগুলি কি আজকের পৃথিবীতে বাস্তব? আবার কখনও মনে হবে, এরা সবাই আছে আমাদের চারিপাশে। আমি আপনি তাদের দেখি - ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সময়ে। আমাদের আশা,আকাংক্ষা, বেদনা একই।
আমাকে আরো মুগ্ধ করেছে ইমপ্রেশনস্টিদের মত বিভিন্ন চিত্রকল্পের আশ্রয়; বইটির তিনটি খণ্ডের নাম কায়রোর তিন বিখ্যাত রাস্তার নামে- Palace Walk, Palace of Desire, Sugar Street। কায়রো শহরের রহস্য, জাদু, সংঘাত ও বেদনা দূর থেকে ভেসে আসা আতরের গন্ধের মত এই নামগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে।
1 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভালো
উত্তরমুছুন