অলোক গোস্বামীর গল্প : নিরুপম যাত্রা

--আর পারি না গো, এট্টু জিরাই।

--ফির জিরাবা? এইটুকু তো মোটে হাটসো, তাতেই এই দশা তুমার! এমুন করলি ঘাটায় পোছবা কেমনে!

--আর কদ্দূর ঘাটা?

--এই আইলো বইল্যা। 

--ধুর, থোও ফ্যালাইয়া তুমার ঘাটা। সেই কখুন থিক্যা একই প্যাচাল পাড়তাসো! হাটতে হাটতে মাজায় তো কালশিরা তো পড়সেই এহন তুমার প্যাচাল শুইন্যা শুইন্যা কানেও ঠসা হইতেসি। আমার আর ঘাটায় যায়া কাম নাই।

--শ্যাষ ম্যাষ কি আঘাটায় আইসা মরবা নাকি!

-- মরতে হয় মরুম তবু না জিরাইয়া পারুম না।

--আরে, তুমারে মিছা কথা কইয়া আমার লাভডা কিয়ের! আরেট্টু হাটো।

--না। কইলমা না, মইরা গেলেও আর হাটুম না?

--তাইলে আর কী, মরো। তুমার লগে লগে আমিও মরি।

--ক্যান, তুমি মরবা ক্যান? তুমি আমার কে লাগো!সবাই পলায় বাচছে, তুমিও বাচো। আমি কিচ্ছু মনে করুম না।

--তুমি আবার কী মনে করবা! আমাগো মন বইলা কিছু আছে নাকি?

পঞ্চাশজনের ছোট্ট দলটার থেকে সামান্য পিছিয়ে পড়া এই দুইজন, যাদের বিষয়ে শুধু মাত্র এটুকু পরিচয় দেয়া যায়,এক জোড়া মানুষ,ব্যস,এটুকুই। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এটুকুই?দুজনের কি কোন নাম নেই?কিংবা পরিচয়ের অন্য কোন অভিজ্ঞান যা দিয়ে তাদের শণাক্ত করা যায়?

সেক্ষেত্রে বলতে হয়, দুজনের অবশ্যই কোন নাম ছিল। ছিল কেন, হয়তো এখনও আছে! হয়তো কেন, অবশ্যই আছে! শুধু নাম কেন, শণাক্তকরণের আরেকটি প্রাচীন পদ্ধতি অর্থাৎ লিঙ্গ পরিচয়,সেটা তো আজও বহমান। তবু এই মুহুর্ত্বে নাম দিয়ে কিছুই যায় আসেনা। এমন কী তারা যে নর এবং নারী, এই লিঙ্গ পরিচয়টাও কোন বিশেষ অর্থ বহন করেনা। এতটা কাছাকাছি আসার পরও নয়। এমন কী একজন আরেক জনের জন্য জীবন দিতে রাজী থাকার পরও নয়।

কেন?

কারণ এই দুজন নির্দিষ্ট কোন দুজন নয়। যতই পিছিয়ে পড়ুক তবু দলের বাকি মানুষগুলোর সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং এই দুজন বাকি আটচল্লিশ জনের যে কেউ হতে পারে। নাম দিয়ে তাদের পৃথক করাটা এখন অর্থহীন। তাছাড়া এই পঞ্চাশ জনেরও তো বাদবাকি কোটি কোটি জনের মতোই জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পৌঁছনর চির পুরাতন রাস্তা ধরেই হেঁটে যাবার কথা ছিল। হয়ত সবার জন্য মোরাম বাঁধানো সড়ক থাকে না,থাকেনা ছায়াবীথি, বিশ্রামাবাস,তবু একটা পরিচিত পথ তো থাকেই যার প্রতিটি বাঁকই আবিষ্কৃত। চমক,রহস্য, শোক,দুঃখ,ব্যথা যতই আচমকা আঘাত করুক তবু চলতে চলতে কখন যেন সেসব একান্ত আপন হয়ে পড়ে!সহ্য করে নিতে নিতে সবকিছুই হয়ে পড়ে মানবিক।সুখের মতই দুঃখও গান হয়ে বেজে ওঠে।

কিন্তু রাস্তাটা যখন অপরিচিত হয়ে ওঠে?যদি হয়ে পড়ে টালমাটাল?আঁকাবাঁকা? দুর্জ্ঞেয়? গন্তব্যশূণ্য? যদি রাত্রি আর দিনের মধ্যে জেগে ওঠে যোজন যোজন শূণ্যস্থান,তাহলে? তখনও কি শণাক্তকরণের প্রাচীন পদ্ধতিগুলো বজায় থাকতে পারে? তখনও কি রক্ত সম্পর্ক, বিবাহ সম্পর্ক, যৌন সম্পর্ক, এসব আলাদা আলাদা তকমা জরুরি হয়? 

বোধ হয় হয় না। তাই ওই দুজন যদি মকবুল-হামিদা, অখিল-বাসবী, বিমল-ময়না, বরকত-আসমানী হয়, তাতে কী এসে যায়!

সুতরাং সাধারণ সূত্র মোতাবেক ওই দুজনের নাম,গোত্র,লিঙ্গ,জাতি,সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়াটা ভুল কাজ হবে। আপাততঃ পথের নিয়ম—পথেরই নিয়ম। তবে এটুকু জানানো যেতেই পারে, এরা সবাই কিছুদিন আগেও পরস্পরের অপরিচিত ছিল।হাঁটতে হাঁটতে একে অপরের সংগে পরিচয়। ক্রমশঃ সেই পরিচয়ে ঘনিষ্ঠতা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতা যেন মানবিক নয়। ঠিক যেভাবে ভাসতে ভাসতে কচুরিপানা পরস্পরের সংগে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে আবার ঢেউয়ের আঘাতে সরেও যায়,যেন তেমনটাই। যেভাবে আকাশ থেকে ঝরে পড়া শিলা বাতাসের চাপে পরস্পরের সংগে জুড়ে যায় আবার তাপে গলে হয়ে যায় জল, যেন তেমনটাই। সুতরাং যেভাবে জুড়েছে এরা সেভাবেই খুলেও যাবে জোড়। আপাতত একসংগে ভেসে চলেছে বটে তবে যে যেখানে আটকে যাবে সেটাই হবে তার গন্তব্য। তাকে ছেড়ে বাদবাকিরা ভেসে চলবে। কেননা প্রত্যেকের গন্তব্য ভিন্ন। পরস্পরের সংগে ফের মিলিত হবে না কোনদিন। এমন কী মিলিত হওয়ার স্বপ্নটুকুও দেখবে না।আপাতত এমনটাই ভেবে রেখেছে ওরা।

থাক সেসব কথা। এখন বলার এটুকুই যে পঞ্চাশ জনের এই দলটি সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের তুলনায় এতটাই ক্ষুদ্র যে কোন হিসেবেই ঢুকবে না। ভাজক-ভাজ্যের তুমুল গাঢ় সমাচারে ব্যস্ত নেটওয়ার্ক সিস্টেমের কোন মাথাব্যথা নেই এদের নিয়ে। অতএব বাকি পৃথিবীও এদের চলাচল নিয়ে আদেৌ চিন্তিত নয়। অবধারিত নিয়ম মেনেই এদের নিয়ে কোন ঠান্ডা ঘরে সেমিনার তথা মল্লযুদ্ধ বাঁধেনি। ভগ্নাংশেরও ভগ্নাংশ এই দলটির চলাচল তাই সবার অগোচরে রয়ে গিয়েছে। এই যে হাঁটা, হেঁটে চলা, মাইল মাইল, গ্রাম থেকে শহর ফের শহর থেকে গ্রাম ডিঙিয়ে চলা নদী নালা আলপথ বনপথ, পথের তাবৎ বিপদ সেসব একান্তই এদের নিজস্ব সমস্যা। 

বলাবাহুল্য এদের যাত্রা শুরুর কালে কোন নিয়ম ছিল না। যে যাত্রা নিয়ম মেনে শুরু হয় তা তো পর্যটন। দিন-রাত্রির প্রতিটি পর্বকে নিয়মে বেঁধে সেই নিয়ম ব্রোশিওরে ছাপা হয়ে বিজ্ঞাপিত করা হয়। জানিয়ে দেয়া হয়, ঘর থেকে দূরে যাওয়া সত্বেও কিভাবে পাওয়া যেতে পারে ঘরোয়া সুখশান্তি। এরপর বাকি থাকে শুধু সামর্থ অনুসারে সঠিক স্থানে টিক চিহ্ন দিয়ে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু সেই যাওয়া তো আসারই অপর নাম। কেননা বেরিয়ে পড়ার ক্ষণেও মনের ভেতর থেকে উঁকি মারে ফিরে আসার আকাঙ্খা।

--গয়নাপত্র, দলিলটলিল সব লকারে রেখে এশ্চি। ব্যস, নিশ্চিন্তি।

--ভাগ্যিস মেন ডোরে ডবল লক সত্বেও কোলাপ্সেবল গেটটা বসিয়ে ছিলাম। ডবল সুরক্ষা। বহু কষ্টে গড়ে তোলা সব, কোন ছাড়াছাড়ি নেই।

--বসার ঘরটা শুধু খোলা থাকবে। অফিস পিওনকে বলা আছে, রাতে এসে শোবে। পেচ্ছাপ, পায়খানা করবে সিকুরিটি গার্ডদের টয়লেটে। ফিরে এসে খুশী করে দেব ওকে।

--অনেক বেছেবুছে দশ তারিখ, মঙ্গলবারটাকেই যাত্রার দিন স্থির করেছি। খনার বচনে আছে, মঙ্গলে ঊষা বুধে পা/যথা ইচ্ছা তথা যা। তার ওপর পাঁজিতে দেখেছি ওই দিন অমৃতযোগ। দক্ষিণে যাত্রা শুভ।

--ধেনু বৎস প্রযুক্তা/বৃষ গজ তুরকা/নৃপ দ্বিজ গণিকা....দুগ্গা দুগ্গা।

--যাই বলতে নেই, বলতে হয়, আসি।

--ফিরে এসে আবার বেরুতে হবে। সেটা অবশ্য শর্ট ট্রিপ।

যাত্রা কালে এসব সংলাপ যেখানে আবহ সংগীত হয়ে বাজে সেখানে যাওয়া ব্যাপারটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়, মূখ্য কথাটা হয়-আসা,ফিরে আসা।

এই পঞ্চাশ জনের যাত্রা শুরুর কালে ওরকম কোন বাক্য ছিল না। সত্যি কথা বলতে,কোনও মঙ্গলসূচক শব্দই ছিলনা। কেউ শেষ রাতে,কেউ সন্ধ্যায়,কেউ বা ভর দুপুরে বেরিয়ে পড়েছিল। এই বেরিয়ে পড়ায় যেহেতু অচেনাকে চেনার আনন্দ ছিল না বরং চেনাকে আরও বেশী আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টা ছিল এবং বেরিয়ে পড়ার মূল কারণ যেহেতু ছিল অতি মোলায়েম চেনার আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে পাঁজর বিদ্ধ করা তাই সে মুহুর্ত্বে বুকের ভেতর থেকে যা বেরিয়ে এসেছিল তা ছিল নেহাতই দীর্ঘশ্বাস। কোন আকাঙ্ক্ষা নয়। কেননা তখন তো একজন শিশুরও বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে ফিরে আসার কোন জায়গাই রইল না। রইল শুধু কোথাও পৌঁছন, যে কোনখানে হোক।

যেহেতু এই পঞ্চাশজন একই তল্লাটের নয় তাই যাত্রা শুরুর কালে এবং তার অনেক পর অবধিও এরা পরস্পরের নামটুকুও জানত না। প্রাথমিক ভাবে জানবার কিংবা জানানোর প্রয়োজনটুকুও বোধ করেনি। কারণ অতি পরিচয় রাতারাতি কিভাবে সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে চোদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি গিলে নেয়, কিভাবে পাঠিয়ে দেয় অগস্ত্যের পথে সদ্য তেমন ঘটনার সাক্ষী হওয়া মানুষগুলো সঙ্গত কারণেই একে অপরকে সন্দেহের চোখেই দেখেছে। যতই আকুতি জেগে উঠুক তবু একে অপরকে হৃদয় খুলে দেখাতে ভয়ই পেয়েছে। তাছাড়া, একটা না একটা ঠিকানা জুটে যাবেই—এমন আত্মবিশ্বাসের তল্পি যেহেতু এদের প্রত্যেকের বুকেই ছিল তাই ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোটা তাদের কাছে বোঝা বাড়ানোর সমতূল মনে হয়েছিল। এবং এটাও সত্য যে, ওই আত্মবিশ্বাস কোন পলকা অহঙ্কার ছিল না।

যেমন, মকবুলের কথা ধরা যাক। তার মতো লোহার কাজ ক’জন জানে! মকবুল মিঞার তৈরি দাঁ, বটি, কাস্তের কদর তো ছিল ঘরে ঘরে। এমন কী, সড়কি, বল্লম তৈরির ধারাল দক্ষতা তাকে বহুবার বিপদে ফেলেছে। ধড়মুন্ডু আলাদা দেখলেই আশপাশের দু দশটা গ্রামের মানুষ বলতই, নির্ঘাৎ মকবুল কামারের জিনিষ চালিয়েছে। এহেন মকবুল কখনও রাস্তায় রাস্তায় ভিখিরির মতো ঘুরতে পারে? গুণের কদর হবে না! যেতে যেতে এমন কারুর সঙ্গে দেখা হবে না যে মকবুলকে দেখেই চিনে ফেলবে? শুধু চেনা নয়, জোর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বন্দোবস্ত করে দেবে না একটা কামারশালা খুলে বসার? ইন্সাল্লা,আলবৎ দেবে। তারপর মকবুল ফের বেরুবে। জেন্নত থেকে দোজখ, ফালা ফালা করে খুঁজবে হারিয়ে ফেলা স্বজনদের। পাবেও। তারপর রমরমিয়ে শুরু হবে পারিবারিক কামারশালা। ফের নতুন একটা কামারপাড়া গড়ে তুলতে কতটুকু সময়ই বা লাগবে!

যেমন অখিলের কথাই ধরা যাক। মানুষ মরে যাবে কিন্তু অখিল মিস্ত্রির হাতের কাজ যেহেতু অক্ষয় অব্যয় হয়ে রয়ে যাবে তাই তার বানানো খাট পালঙ দরজা জানালা দেরাজ চৌকাঠ তো বটেই পিঁড়িটুকুও কেনা নিয়ে কম কাড়াকাড়ি হয়েছে তালবন্দীর হাটে!সেসবের ক্রেতা তো আর আশপাশের দু-দশটা গাঁয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কখনও সখনও শহুরে বাবুরাও সস্তা এবং মজবুত মালের খবর পেয়ে ট্রাক নিয়ে হাজির হয়েছে অখিল মিস্ত্রির বাড়িতে। চা-জলখাবার খেয়ে, দর কষাকষি করে হাসি মুখে কিনে নিয়ে গিয়েছে তালবন্দীর সম্পদ। হয়ত যে কোনদিন তাদের কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে অখিলের। সব ঘটনা জানার পর বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে নির্ঘাৎ অখিলের বানানো পিঁড়ি পেতে অভ্যর্থনা জানাবে অখিলকে। তারপর?

যমুনাবতীর অবশ্য আলাদা কোন গুণ ছিল না। অমন বিয়ের গান, ধান ভাঙা, বড়ি আচার বানানোর কুশলতা গ্রামগঞ্জের প্রতিটি মহিলার ভেতরই অল্পবিস্তর থাকে। তা থাকুক কিন্তু যমুনাবতীর শ্বশুরকূলের মতো অত বড় বংশ ক’জনের থাকে? ওরা সবাই খুব মানী মানুষ। সবাই কেউকেটা। নেহাৎ যমুনার শ্বশুর ছিল গোঁয়ার ধরণের তাই রাগে দুঃখে তারা কেউ কোন যোগাযোগ রাখত না। তাই বিয়ে থেকে বিধবা হওয়া ইস্তক তাদের কাউকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি যমুনার কিন্তু তাতে কি এসে যায়! কোথাও না কোথাও ওদের কারুর সঙ্গে নির্ঘাৎ দেখা হয়ে যাবে। যমুনা যদি বা না চিনতে পারে, মানী মানুষগুলো চিনবেই তাদের বংশের বড় বউকে। তারপর কি অত বড় বংশের বউকে কেউ পথে পথে ভিখিরির মতো ঘুরে বেরাতে দেবে?

এরকমটাই ভেবেছিল যতীন,সজেন,হানিফ,ইয়াকুব। ভেবেছিল কমলা,টগর,লায়লা,বিন্তি,ফৈজেন্নুসা। তাই, অদেখা স্বজনের ঘাড়ে অহেতুক বোঝা না চাপাতে চেয়ে,পরস্পরকে না দেখার ভানে হেঁটেছে ওরা। তাবলে দলছুট হওয়ার মতো দুঃসাহস দেখায়নি কেউ। বরং ভাসতে ভাসতে ক্রমশঃ চলে এসেছে পরস্পরের কাছাকাছি। অভ্যেস বশত উজার করে দিয়েছে নিজস্ব গৌরবগাঁথা। আরও বহুদূর এভাবেই ভেসে চলার আকর্ষণ বজায় রাখতে পরস্পরকে রসদ জুগিয়েছে এভাবে—

--তুমার আর কী মিঞা! তুমার ভাত মারে কেডা? আইজ কাইলের ভিতারেই তুমার দিন ফিরা যাবে। তয় আমারে কিন্তু ভুইল্য না। তুমার হাপড় টানার কামে নিও কইয়া রাখলাম। তহন য্যান মুখ ফিরাইয়া নিয়ো না। তুমার খুদার কসম কিন্তু।

--কী যে কও! তুমার ওই আংগুল গুলান কি খোদা হাপড় টানার লাইগ্যা বানাইছে নাকি! বরন্চ তুমি আমারে র‌্যান্দা চালানো শিখাই দিও। তুমার কালীর দিব্যি দিয়া রাখলাম।

--দিদি, তুমার বড়লোক সাগাইদের কইও আমারেও য্যান এট্টু মাথা গুজার জাগা দ্যায়। গুয়াল ঘরে দিলেও হইবো। খাইট্যা খাবো, কুনো চিন্তা নাই।

__ধুর, যত রাইজ্যের হাবিজাবি কথা! তুর মতন বিষহরির গান কয়জন গাইতে পারে? তুই ব্যাটাছেলেরও নাক কাটি দিতি পারিস। তুর আবার মাথা গুজার চিন্তা! 

এভাবে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়েছে এরা,ঘনিষ্ঠ হবে না এমন প্রতিজ্ঞা করা সত্বেও। সেই ঘনিষ্ঠতা এত দূর অবধি পৌঁছে গিয়েছে যে ওইসব বলা কওয়াগুলো পরস্পরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। যে যে অঞ্চল অতিক্রম করেছে এরা সেখানকার বাসিন্দাদের কাছে নিজের কথা বলার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই বলেছে অন্যর কথা। কায়মনে প্রার্থনা করেছে, একজন অন্ততঃ আশ্রয় পেয়ে যাক। অন্ততঃ একজনের শরীর থেকে মুছে যাক উৎখাতের গন্ধ। সেই একজনের মাধ্যমে অন্য কারুর যদি ঠাঁই না জোটে, না জুটুক, তবু তো প্রমাণ হবে এরা নিছকই পথের এলেবেলে মানুষ নয়। এবং বিস্তর ভ্রমণের পরও তারা সমাজভূক্ত হওয়ার যোগ্যতা হারায়নি। প্রমাণিত হবে, মানব সম্প্রদায় থেকে আলাদা এরা কোন ভিন গ্রহের জীব নয়। বাকি মানবদেরই অংশ। একজনের ঠাঁই জুটে গেলেই বাদবাকিদের হাঁটার তেজই হবে আলাদা কেননা তাতে তখন যুক্ত হবে বিশ্বাস। আত্মমর্যাদা। সম্ভ্রম। তখন না দেখা স্বজনেরা বাধ্য হবে ডেকে নিয়ে ঘরে তুলতে। 

আপততঃ এই প্রাপ্তিটুকুর ভরসাতেই দলটা হেঁটে চলেছে মাইল মাইল।কিন্তু বাস্তব এই যে, এতটা পথ পেরুনোর পরও কোন প্রাপ্তিযোগই ঘটেনি এদের কপালে। সর্বত্রই জুটেছে অবহেলায় ছুঁড়ে দেয়া কানাকড়ি,পোকা কাটা চাল,বাসী রুটি কিংবা পুরনো শাড়ি জামা। সবখান থেকেই মিলেছে একই রকম আদেশ—আগে বাড়ো। রাস্তা দ্যাখো। এখানে সুবিধে হবে না। না গেলে পুলিশ ডাকা হবে।

--হায় রে পুড়া কপাল আমাগো! আমরা কি মানুষ না? কুত্তা বিলাই? মাইনষের বিপদে যুদি মাইনষেই না দ্যাখে তাইলে আমাগো দ্যাখপে কেডা!

বুচকুনের এই হাহুতাশ যে সর্বাংশে সত্যি সেটা বলা যাবে না। মানুষ অবশ্যই দেখেছে যেখানে দেখার মতো কিছু আছে। বুচকুনের আছেটা কি যে মানুষ তারিয়ে তারিয়ে দেখবে? বরং দেখেছে ময়নাকে, বিন্তিকে,ময়নাকে,লায়লাকে। ছেঁড়া শাড়ি,ব্লাউজ,ফ্রকের ফাঁক ফোকড় দিয়ে কতটুকুই বা চোখে পড়ে! তবে যেটুকু দেখা যায় সেটুকুকে অবহেলা করেনি। যেটুকু দেখা যায়নি মনে মনে সেটুকুকে কল্পনা করে নিতে অসুবিধে হয়নি। সেই দেখাদেখির ফলাফল অবধারিত ভাবেই সন্তোষ জনক। নাহলে যমুনাবতী কিংবা হামিদা কিংবা কমলার কানে কেন ভেসে আসবে ফিসফিসোনি,‌সুযোগ করে দাও না মাসী। মাত্র একবার। চিন্তা নেই, তোমায় খুশী করে দেব। 

খুশী হোতে পারেনি কেউ বরং অবাক হয়েছে, গ্রাম থেকে গ্রাম, শহর থেকে শহর, একটাই অসুখ! সবার দুই ঊরুর মাঝখানে একই রকম যন্ত্রণা! এতো অসুখ নয়, মহামারি!

যেকোন মহামারিই যেহেতু ছোঁয়াচে তাই এরপর দলটা আর কোন জনপদে ঢোকার সাহস দেখায়নি। ভেতরে ঢুকেছে শুধু পুরুষ এবং বয়স্কারা। বাকিরা অপেক্ষা করেছে দূরে, আড়ালে।

কিন্তু এভাবে কি আর উপকারিকে উপকার থেকে, পিপাসার্তকে পানীয় থেকে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়? চেয়ে চিন্তে কিংবা টোপ ফেলেও যদি প্রাপ্য জিনিস হাতছাড়া হয় তাহলে পরিকল্পনার বদল তো ঘটবেই। তাই মানুষ রূপ বদল করে শ্বাপদ হয়েছে। জনপদের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে শিকারি শ্বাপদের পাল। এসেছে অন্ধকারে অন্ধকারের ছদ্মবেশে। ঘাসের ভেতর ঘাস হয়ে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করেছে প্রকৃত সুযোগের। পিছু পিছু এসেছে রক্তের নেশায়,মাতাল হওয়ার আকাংখায়। 

সেই সব নেশা কিংবা আকাংখা যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। প্রথম প্রমাণটা পাওয়া গেল এক ভোরে, বিন্তির শরীরটা নদীর সোঁতায় আবিষ্কৃত হওয়ার পর। সেটাকে আবিষ্কারই বলতে হবে। কেননা শরীরটা যে বিন্তির সেটা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। যেন হাঙরে খাওয়া কোন শরীর। এমন কী শরীরটা যে কোন মেয়ে মানুষের, সেটুকুও সহজে বোঝা যায়নি। কেননা ক্ষুধার্ত হাঙর নারীত্বের চিহ্নগুলোও খুবলে খুবলে খেয়েছিল।

দীর্ঘ এই চলাচল পর্বে দলটা মৃত্যু দেখেছে অনেক। সেসব মৃত্যুর বৈচিত্রও কিছু কম ছিল না। 

যেমন, বেদানা মাসী। চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

--কি হইলো মাসী, খাড়াইলা ক্যান? কোমর বিষায়?

উত্তর না আসায় কেউ একজন গিয়ে কাঁধে হাত রেখেছিল। সহানুভূতির সেই কোমল স্পর্শটুকুতেই ধুলোয় মুখ থুবড়ে পড়েছিল বেদানা দাসী। আর উঠে দাঁড়ায়নি। 

যেমন, ইরফান। এক সকালে গাছের নীচে বেঁকেচুরে শক্ত হয়ে থাকা শরীরটা দেখে সবাই ভেবেছিল ইরফান আলী কি মরার আগে ধনুক হোতে চেয়েছিল! কেন? চেয়েছিল কি, তাকে ব্যবহার করে কেউ একজন অন্ততঃ লক্ষভেদ করুক?

যেমন, মোংলা। আচমকা মোংলার অনুপস্থিতিটা খেয়াল করেছিল কেউ একজন। সবাই থমকে দাঁড়িয়েছিল। পিছু ফিরেছিল পুরুষ এবং বয়স্কারা। খুঁজতে খুঁজতে পিছিয়ে এসেছিল অনেকটা পথ। এক তরমুজ খেতের ভেতর পাওয়া গিয়েছিল মোংলাকে। শরীরময় অজস্র ছিদ্র। সেই সব ছিদ্র পথে তখনও গরম রক্তের ফোয়ারা। ফলের লালসা নাকি কারুর প্রতিশোধ স্পৃহা মেটাতে গিয়ে এই পরিণতি? যেহেতু উত্তর মেলেনি তাই খেতের ভেতর মোংলাকে ফেলে রেখেই দলটা রওনা হয়েছিল ফের। 

কিন্তু সেইসব মৃত্যুর তুলনায় বিন্তির ঘটনাটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। বিন্তির এলো চুলের ভেতর চুনোপুঁটিগুলো এতটাই স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটছিল যে কেউ চমকে ওঠার সুযোগ পায়নি। বরং সবার কাছেই মনে হয়েছিল, এই পরিণতিটাই স্বাভাবিক। এরকমই কিছু পাওনা ছিল বিন্তির। নাহলে ঠোঁটের কোণে অমন হাসির বিভঙ্গতা লেগে থাকবে কেন? যা বোঝা যায়নি তা হলো, নদীর কাছে কিভাবে পৌঁছেছিল বিন্তি! কে ডেকে এনেছিল? কাল রাতে কে শুয়েছিল বিন্তির পাশে? সে কিছুই টের পায়নি!

যেহেতু সেই সব কৌতুহলের মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই বিন্তির শরীরটাকে চুনোপুঁটির হেফাজতে রেখেই বাকিরা রওনা দিয়েছেল। অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর খেয়ালে পড়েছিল আরেক জনের অনুপস্থিতি—কাজলদি। ফের পিছিয়ে আসতে হয়েছিল। তবে এবার জীবিতই পাওয়া গিয়েছিল কাজলদিকে। বিন্তির শরীরের পাশে বসে জলে পা ডুবিয়ে মাছগুলোকে ডাকছিল কাছে। কী আশ্চর্য, মাছগুলোও বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে জ্যান্ত কাজলদির পায়ের আঙুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দিব্যি খেলা করছিল! 

ডাকা হয়েছিল, উত্তর আসা তো দূরের কথা, ঘাড় ফিরিয়েও তাকায়নি কাজলদি। সবাই অবাক হয়েছিল, তবে কি আর হাঁটবে না কাজলদি! এখানেই রয়ে যাবে পাকাপাকি? কিন্তু কেন! বিন্তি কি পূর্ব পরিচিত ছিল কাজলদির? নাকি আত্মীয়? অথবা কোন অপরাধ বোধ!

শোকের সৌখিনতা যেহেতু এই দলের পক্ষে বেমানান তাই কেউ একজন জোর করে তুলে এনেছিল কাজলদিকে। খানিকটা পথ পুতুলের মতো এগিয়ে এক সময় থেমে পড়েছিল কাজলদি, তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করেছিল। সেই চিৎকারে শোকের পরিবর্তে ক্রোধের পরিমাণই ছিল অধিক। সেই ক্রোধের উত্তাপে বাতাস ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করেছিল। বাতাসের ভয়কে ধামাচাপা দিতে অজস্র ধুলো আর ঝরা পাতায় ভরে উঠেছিল চারপাশ।

মাত্র কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল এই ভারসাম্যহীন পরিবেশ। যেমন আচমকা চিৎকার করেছিল কাজলদি, তেমন আচমকাই চুপ করে গিয়েছিল। বাতাসও তৎক্ষণাৎ ফিরে পেয়েছিল ভারসাম্য। ধুলো এবং ঝরা পাতা সঙ্গী হারানোর অপ্রতিভতায় নিঃশব্দে সরে পড়তে বাধ্য হয়েছিল।

ব্যস, তারপর থেকে গোটা দলটার মুখে আর কখনও শোনা যায়নি বিন্তির প্রসঙ্গ। শুধু শুরু হয়েছিল রাত জাগার পালা। জ্বালানো হয়েছিল মশাল। সবাই নিজের নিজের দক্ষতা থেকে কিছু কিছু অংশ বাঁটোয়ারা করে দিয়েছিল। যেমন, মকবুল দিয়েছিল দা, অখিল দিয়েছিল হাতল, ইয়াকুব দিয়েছিল ক্ষিপ্রতা, বাদল দিয়েছিল সাহস, নিমাই দিয়েছিল গোয়ার্তুমি। 

এতদ সত্বেও ফের গণ্ডী পেরুনেরা ঘটনা ঘটলই। ফারাক শুধু এটুকুই,এবার সকলের অজান্তে নয়। সবাই দেখেছিল ঘুমন্ত এবং ঘুমনোর ভান করে থাকা শরীরগুলো ডিঙিয়ে ফরজানার চলে যাওয়া, মশালের আওতার বাইরে। যারা ঘুমোনর ভানে পড়েছিল তারা এরপর, ফরজানার এই অন্ধকার যাত্রাকে নিছকই প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, ভেবে নিয়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়তে দ্বিধা করেনি। 

অন্য ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনাটার আরও একটা ফারাক এই যে, অনেকটা দেরীতে হলেও চিৎকার করেছিল ফরজানা। যদিও ততক্ষণে দুজন তার শরীর সাঁতরে নেমে গিয়েছে, বাকি তিনজন প্রস্তুতি নিচ্ছিল সাঁতারের। তখন সাহায্য চেয়েছিল ফরজানা,কোন বিশেষ একজনের নাম ধরে জানিয়ে ছিল বাঁচার আর্তি।

কী আশ্চর্য, মোংলা তো তখন অনেক দূরে! ফেলে আসা পথের পাশে থাকা তরমুজ ক্ষেতের ভেতর অজস্র ছিদ্রসহ বাতিল কাকতারুয়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে! চিৎকার যতই তীক্ষ্ণ হোক, তা কি কখনই মোংলার কানে পৌঁছনর কথা! যদি বা পৌঁছয় তবুও কি মোংলার পক্ষে সম্ভব হোত অনায়াসে মাইল মাইল পথ পেরিয়ে এসে ফরজানাকে বাঁচানো!

এসব বিস্ময়ের উত্তর খোদ ফরজানার কাছেও ছিল কি না কে জানে! তবু মূল সত্য এটাই যে,এরপর কিভাবে যেন পাঁচটা শরীর দশ টুকরো হয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল ফসল হীন ক্ষেতের ঢাল বেয়ে! শরীর থেকে রক্ত মুছতে মুছতে এরপর হাসি মুখে ফিরেছিল ফরজানা। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল ফের যাত্রা শুরু করার লক্ষে। 

কিন্তু এরপর দলটার আর বেশী দূর হাঁটা হয়নি। কয়েক পা এগোনর পরই আচমকা অন্ধকার আকাশ থেকে নেমে এসেছিল জাল, সবার মাথার ওপর। ফুলে ওঠা ঘাঘরার মতো ছড়িয়ে গিয়ে নিমিষে সবাইকে তুলে নিয়েছিল ওপরে। হাজার কষ্টেও মাটি থেকে শূণ্যে ওঠার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় গোটা দলটাই বিস্মিত হয়েছিল এতটাই যে, কেউ ভীত হওয়ার সময়টুকুও পায়নি। 

পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করার পর সবার মনে পড়েছিল সেই প্রাচীন ব্যাধ আর বন্দী পায়রার ঝাঁকের গল্প। তাই জালের ফাঁস থেকে মুক্তি পাবার বদলে সবাই চেয়েছিল জালবন্দী অবস্থাতেই উড়ে যেতে, ততক্ষণ, যতক্ষণ না জালের দড়ি নিজ থেকেই খসে যায়, যতক্ষণ না বিরক্ত ব্যাধ ধৈর্য হারিয়ে ফিরে যায়, যতক্ষণ না জালের দড়ি কেটে দেয়ার মতো কোন শুভানুধ্যায়ী পাওয়া যায়। 

কিন্তু এরপরই কে যেন দড়ি টেনে জালটাকে ছোট করে ফেলেছিল। তারপর এক সময় ক্ষুদ্র পুঁটুলিটাকে ঢুকিয়ে নিয়েছিল অন্ধকারের গর্ভে। 

তারপর শুধু অন্ধকার-অন্ধকার-অন্ধকার। কালো পিন্ড। 

তারপর শুধু সবক’টা শরীর একাকার-একটা শরীর।

তারপর?

যদি রাত কখনও দিনের কাছে নিজেকে সমর্পন না করে, যদি সেই অন্ধকারের কোন গ্রহ, উপগ্রহ,নক্ষত্রের সাজানো সংসার না থাকে, তবে প্রহর যাচাই হবে কিভাবে? কিভাবেই বা নিরূপিত হবে সময়? সুতরাং এরপর বহু থেকে এক হওয়া সেই অক্ষম ছায়াপিন্ড নির্বাক, নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করেছে। যেহেতু এহেন মুহুর্ত্বে ‘ঘুমন্ত’,‘জাগ্রত,’,‘চিন্তিত’,‘শঙ্কিত,’ ‘হতাশাগ্রস্ত’, ইত্যাদি শব্দগুলোর বিশেষ কোন দ্যোতনা থাকে না তাই সেই জমাট সত্বা শুধু অন্ধকারের গায়ে ফুটে ওঠা কোন জানালার অপেক্ষায় থেকেছে, যে জানালা পথে ভেসে আসবে কোন রুপোলী রশ্মি। 

কী আশ্চর্য, সত্যি সত্যিই ফুটেছিল জানালা! সেই জানালা পথে উঁকি দিয়েছিল রুপোলী রশ্মিও! সেই রশ্মি ছিল এতটাই ক্ষীণ যে হয়ত স্থবির সত্বার পক্ষে রুপোলী রঙটা শণাক্ত করা অসম্ভবই হোত যদি না ভেসে আসত কোন অনিবর্চনীয় স্বর—

--মুক্তি চাও।

--চাই। চাই। চাই।

--যাও। তোমরা মুক্ত। 

--আমরা যে অক্ষম ছায়াপিন্ড!

--আবার ভিন্ন হও।

--তারপর?

--হাঁটতে শুরু করো।

--কত দূর?

--যতক্ষণ না কোন পাহাড়,নদী,অরণ্য সমৃদ্ধ কোন নির্জন অঞ্চল খুঁজে পাও। 

--তারপর?

--সেখানে আশ্রয় নিও গাছের কোটরে, গুহায়। শিকার করে ক্ষুধা নিবৃত্ত কোর।

--তারপর?

--আগুন জ্বালাতে শেখ।

--তারপর?

--চাষবাস শেখ।

--তারপর?

--নৌকো বানাতে শেখ। গৃহ নির্মাণ শেখ। গ্রাম গড়ো। বাণিজ্য শেখ। নগর তৈরি করো। বাজার বসাও। শেখ আমদানী ও রপ্তানী।

--তারপর?

--আঃ, পরের কথা পরে হবে। আপাততঃ হাঁটো। চরৈবেতি।

--কিন্তু আমাদের তো জানতেই হবে, ফের এভাবেই আমাদের বানানো গ্রাম,শহর,জীবিকা ছেড়ে উৎখাত হতে হবে কিনা? ফের শরীরে জড়িয়ে যাবে কিনা উদ্বাস্তু গন্ধ? আমাদের শ্রমে গড়ে ওঠা সমাজ শেষ অবধি আমাদেরই অস্বীকার করবে কিনা? শুধু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের ফের দোরে দোরে মাথা কুটে বেরাতে হবে কিনা? যতক্ষণ না এসব প্রশ্নের জবাব পাচ্ছি ততক্ষণ আমরা মুক্তি চাই না। অন্ধকারের ভেতরই রয়ে যেতে চাই। এখানেই পেতে চাই ফের না জন্মানোর সাধ।

কোন উত্তর আসেনি। হয়ত পাল্টা প্রশ্নগুলোর জন্য প্রস্তুত ছিল না অনিবর্চনীয় কন্ঠস্বরের মালিক! কিংবা হয়ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল!

সে যা হয় হোক, মোদ্দা কথা হলো এরপর রুপোলী রশ্মি তীব্রতর হয়েছিল।ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল ছায়াপিন্ড। এক থেকে ফের বহু হয়ে পড়া দলের সবাই নিজেদের আবিষ্কার করেছিল পথের মাঝখানে। ধাতস্ত হতে খানিকটা সময় নিয়েছিল। তারপর শণাক্ত করেছিল বাদবাকি ঊনপঞ্চাশ জনকে। ফের হাঁটতে শুরু করেছিল। নতুন উদ্যমে। কোথা থেকে এলো সেই উদ্যম, যদিও সেটা কেউই বুঝতে পারেনি।

হাঁটতে হাঁটতে প্রাচীন অভ্যাসে কিংবা হয়ত গত জন্মের স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় অখিল বলেছিল মকবুলকে,‌‘তুমার আর কী মিঞা......।’

মকবুল বলেছিল অখিলকে,‘আমারে র‌্যান্দা চালানো..।’ 

কমলা বলেছিল যমুনাবতীকে,‘দিদি তুমার বড়লোক সাগাইদের....।’ 

কাজল বলেছিল বিন্তিকে,‘ তুই আর খাড়াইস না বেটি। তুর যা গতর...।’

ফরজানা বলেছিল মোংলাকে,‘ আর পারি নাগো, এট্টু জিরাই....।’ 

বলেছিল নাকি মকবুল,অখিল,কমলা,কাজল,ফরজানা এসব কথা? একই কথা ফের বলতে লজ্জাবোধ করেনি! কিংবা উচ্চারণ করার মতো সঠিক কোন ভাষা কি আদৌ খুঁজে পেয়েছিল ওরা! নাকি উজান আর ভাটির দিক থেকে ছুটে আসা তীব্র বাতাস নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করে ওইসব ফিসফিস ধ্বনি তুলেছিল!

হতেও পারে তেমন কিছু। হয়ত ওরা শুধু ফিসফিসানিটুকুই শুনতে পেয়েছিল! হয়ত অর্থ বুঝতে খানিক থমকে দাঁড়িয়ে ছিল এবং ব্যর্থ হয়ে ফের হাঁটতে শুরু করেছিল। সবার সঙ্গে। একা একা।

সেক্ষেত্রে অবশ্য একটা প্রশ্ন জাগে, যখন মোংলার স্বর নকল করে বাতাস ফরজানার কানে কানে বলেছিল,‘ আমরা কিন্তু একসংগে থাকুম,’ তখন খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল কেন ফরজানা? কেন বিন্তি উলু দিয়ে উঠেছিল? কেনই বা তখন গোটা দলটা প্রথমে গম্ভীর, তারপর হৃদয় খোলা হাসি হেসে উঠেছিল? 

থাক সেসব কূট প্রশ্ন। বলার শুধু এটুকুই, আকাশ তখন ছিল প্রকৃতই ঝকঝকে। বাতাসে তখন ছিল সত্যিকারের প্রাণ। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ