১
দূর্যোধনদাদুর কবিরাজ ঘর আমাদের নিরাময় ফার্মেসির পাশেই । পাশে মানে দোকানসমেত নিরাময় ফার্মেসির এই জায়গাজমি আসলে দূর্যোধনদাদুরই ছিল। ঘটনা হলো, বাপির সাথে মার বিয়ে দিয়ে আমার নানাজান দেখলেন, আরে সব্বোনাশ করিছি কী ! জামাই দেখি ভাদামের মহাসেনাপতি ! আজ নাটক তো কাল সিনেমা । পরশু কবিতা তো তারপর দিন ফুটবল ! এ তিনি কী করলেন ! তার সোনার প্রতিমা যে ভেসে গেলো মধুমতির জলে !
দূর্যোধনদাদুর কবিরাজ ঘর আমাদের নিরাময় ফার্মেসির পাশেই । পাশে মানে দোকানসমেত নিরাময় ফার্মেসির এই জায়গাজমি আসলে দূর্যোধনদাদুরই ছিল। ঘটনা হলো, বাপির সাথে মার বিয়ে দিয়ে আমার নানাজান দেখলেন, আরে সব্বোনাশ করিছি কী ! জামাই দেখি ভাদামের মহাসেনাপতি ! আজ নাটক তো কাল সিনেমা । পরশু কবিতা তো তারপর দিন ফুটবল ! এ তিনি কী করলেন ! তার সোনার প্রতিমা যে ভেসে গেলো মধুমতির জলে !
তার মেয়েও আবার বড় স্বাধীনচেতা । নিজের হাতে টাকাপয়সা নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে । কিন্তু জামাই তো ফকিরস্য ফকির। বাবার সম্পত্তি ছাড়া একেবারে ফুটো মান্দাস। বয়েস কম। যখন তখন কলকাতা ছুটছে। কলেজের খাতায় নামকাওয়াস্তে নাম আছে বটে তবে জামাই ঘুরে বেড়ায়
নাটক মহলে, কবিদের আড্ডায়। চিকন মোটা দেশি বিদেশি বইয়ে তার ঘর ভরা । সংসারের সং সাজতে তার ভীষণ আপত্তি।
আর মেয়েও কম যায় না। মহা ফাদামেশ্বরী। সেও বই কেনে, পত্রিকা আনায়, হিরোইনদের মত শাড়ি চুড়ি কিনে ফারপো হোটেলে লাঞ্চ করে। ইচ্ছে হলে লাফ দিয়ে ট্রেনে ওঠে চলে যায় হাওড়ার ভাড়া বাড়িতে । দুটোই উড়নচন্ডী। দিনরাত চইমক্কর চই চই। ঘুরছে তো ঘুরছেই । সংসার ঠনঠনে বেলতলা। তো এখন কি করা !
নায়েবি বুদ্ধিতে তিনি দূর্যোধনদাদুর সাথে পরামর্শ করে মা বাপিকে ঘরবন্দি করার
লাগসই বুদ্ধি আঁটলেন।
দূর্যোধনদাদু তিনটে দোকান সমেত জায়গাটা বিক্রি করে দিলেন আমার নানার কাছে। উদ্দেশ্য বাপিকে ওষুধের দোকান করে স্থিতি স্থাপন করা ।
তখন ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে মহামারীর মত ছড়িয়ে
পড়েছে এক অসুখ। তার নাম দেশভাগ।
এই অসুখে সমানভাবে পুড়ে যাচ্ছিল অনাদিকালের সম্পর্ক, ঘরবাড়ি, গরুছাগল, জনমানুষ, জোত জমি, হিন্দু মুসলমান, আমার মা বাবাও ।
পোড়া হৃদয় নিয়ে ওরা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে প্রিয় কলকাতা ছেড়ে নিজ শহরে। আর দাদুর পরিবারের সবাই বাপ পিতামোর ভিটে, ঘরবাড়ি, পুকুরজমি
বন্ধুদের ছেড়ে পুড়তে পুড়তে চলে যায় ইন্ডিয়া নামের অচিন অন্যদেশে ।
দূর্যোধনদাদু থেকে গেলেন। একা । কিছুতেই তিনি দেশছাড়া হবেন না। তেমনি কিছুতেই তাকে দেশ ছাড়া করা সম্ভব হলো না।
চালতা পেকে হলুদ হয়ে থাকে। পাছ পুকুরে মাছেরা বুড়বুড়ি তুলে ফেনা করে ফেলে
পানি। আদুর বাদুররা পেয়ারা খেয়ে ঝুলে থাকে গাছে। তিনি ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে রংপুরের
পাকা তামাকের হুক্কা টানেন আর সবাইকে
সচকিত করে কড়া পাহারা দেন। কাউকে ঢুকতে দেবেন না তার পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি আগান
বাগানের ত্রিসীমানায়।
সেই সময় কেউ একজন নাকি দাদুর কবিরাজ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ঠারেঠুরে বলেছিল, ও কাকা দেশের যা অবস্থা
দেখতিছি ! পারলি চলি যান না কেন? এই বয়সে
ছেলেমেয়ে আপনজনের কাছে থাকাই ত ভালো ! শুধুমুদু
পরের দেশে পড়ি আছেন কি সুখে শুনি !
রামদা তুলে দাবড়ে গেছিল দাদু, ওরে শুয়োরের
বাচ্চা শুয়োর, চুতমারানির ছাওয়াল কয় কি! ধরতি পাল্লি তোর ফল্লা কাটি দুভাগ করি দিবানি। শালার শালা চুতিয়া শালা তুই আইছিস আমারে কিবলা
দেখাতি ! কোহানে গেলি অই কুত্তার বাচ্চা, গুখোরের দল!! আয় সামনে আসি ক দেহি আবার এই কথাগুলান!
নারকেল গাছের গুঁড়ির মত কালো, ঢ্যাঙ্গা, আবার পেটমোটা দাদু
মাথার উপর রামদা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আধা মাইল পথ ধেয়ে গেছিল লোকটাকে ধরতে।
বাপিসহ আরো অনেকেই ছুটে এসে থামিয়েছিলো দাদুকে ।
ততক্ষণে সেই লোক খাটরার খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে ওঠে গেছিল ওপারে। মাথার টুপী ভেসে গেছিল
খালের পানিতে। নাগরা জুতাও পানির অতলে।
তিন তালগাছের ঘাটে নীল পাঞ্জাবীর কোচড় চিপড়ে ঝাড়তে ঝাড়তে লোকটা নাকি খালি হাত বাগিয়ে বলেছিল, মিলেঙ্গে মিলেঙ্গে ফের মিলেঙ্গে কাকা।
তারপর বাপির দিকে ঘুষি বাগিয়ে ভয় দেখিয়েছিল, ওরে কাইজার দেখবানি কতবার তুই অই বুড়োকে বাঁচাতে পারিস । তোর একদিন কি আমার একদিন !
বাপি ভিলেজ পলিটিক্সে একেবারে রামভোদাই। মানুষকে
পালটি ভয় দেখাতে ডাহা বোকচোদ।
নীল পাঞ্জাবীর খালি হাতের ঘুষির ধমক দেখে থতমত খেয়ে কিছু না বলে দাদুকে ধরে কিছুক্ষণ
থমকে দাঁড়িয়ছিল । রক্তলাল চোখে দাদু তখন মরিয়া । অন্যেরা দাদুর হাত থেকে রামদা ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে এসেছিল আমাদের এক চিলতে শহরে।
আর বাপি সে রাতে কবিতা লিখেছিল,
মানুষের মানবতার স্খলন নিয়ে। তাতে শিশিরের মত চুইয়ে পড়েছিল অপ্রমিত বেদনার চুরচুর চূর্ণতা।
মানুষ কেনো এত নীচ হয়!
একমাত্র বাপির কাছেই দাদু পোষ মেনে যেত। মাঝে মাঝে আফিং খেয়ে হু হু করে কাঁদত, কাসু আমার মুখাগ্নি কিন্তু তুই করিস বাপ
।
বাপি হ্যা হু করে শান্ত করত দাদুকে ।
ভালো করেই জানত এটা করলে জবর দাঙ্গা হাঙ্গামা হতে পারে । হতে পারে কী ! হবেই । বাপি তাই দূর্যোধনদাদুর এক গরীব দূরের
আত্মীয়কে খুঁজে পেতে নিয়ে এসেছিল । তাকে নিরাময় ফার্মেসিতে চাকরি দিয়ে রেখে দিয়েছিল ধারে কাছে ।
আমার মার আবার চড়ুই বুদ্ধি। বাপির উদ্দেশ্য
বুঝতে পেরে একটু খুঁচে দিয়েছিলো, হ্যাঁগো, বুড়ো মানুষটার
সাথে সত্যনাশ করবে ? তুমি কী তবে ভেড়া হয়ে গেলে আজন্মের ব্যর্থ কবি ?
বাপি অখন্ড ভেড়াতত্ব মেনে নিয়ে মাকে হেসে
বলেছিল, শান্তি শান্তি। ওম শান্তি। সবকিছু এত সোজা নয় রে পাগলি !
২
খুব ছোটবেলায় কাঁঠালপাতায় দেওয়া একচামচ আচারের মত কবিরাজি ওষুধ চেটে খেতে খেতে
দাদুর কাছে আমরা গল্প শুনতাম, ক্লিওপেট্রা, নেপোলিয়ন, ট্রয়যুদ্ধ, হিটলার, কলম্বাস, নবাব সিরাজউদ্দোলা, মীর জাফর, গান্ধী, নেহেরু জিন্না, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, একাত্তর আর সোভিয়েত
রাশিয়ার ।
কালো কুচকুচে রঙে লাল টুকটুক ঠোঁট, পানসুপারি
আর খয়ের জর্দার অদ্ভুত মাদক গন্ধ । একটার পর
একটা চলত পান খাওয়া আর তার সাথে গল্পকথা । মাঝে মাঝে গল্প থামিয়ে একটা ছোট্ট সবুজ গামছায়
মুখ মুছে নিতেন দাদু । এই সামান্য ক্ষণের বিরতিও আমাদের ভালো লাগত না। বিচ্ছু শয়তানের মত হামলে
পড়ে কেবলই জানতে চাইতাম, তারপর ? ও দাদু তারপর ?
বাপি এসে মাঝে মাঝে বকে যেত, আবার জর্দা
খাচ্ছেন ? আপনি তো দেখি কোনো কথাই শোনেন না। সোমেনকে এবার বলে দেবো আর যেনো জর্দা না
পাঠায়।
দাদু আগুনমুখো হয়ে ঠা ঠা করে হেসে উঠত, ইসসি রে! আমার কলকাতার হাফ সাহেব আসি
পড়িছেন। ও কাসু মিলিটারিগে গুলি খায়িও আমি
মরি নাই। পান জর্দা খর আমার কিস্যু করতি
পারবি না নে বাপ ।
বাপি অবশ্য তখনো জানে না, মাও চুপি চুপি দাদুর কাছে পান জর্দা খাওয়া শিখে
নিচ্ছে।
প্রায়ই সন্ধ্যার সময় মা, মাহমুদা ফুপি, হাসিনা ফুপি, মম আন্টি, আরতি মাসি, লক্ষ্মীদি দাদুর কাছে এসে
জর্দা দিয়ে পান খায় আর পুরোনো আমলের গল্প শোনে।
বুঝলে বউমা, ১৯০৯ সালি গোপালগঞ্জ মহকুমা হইছে। তার কিছু আগে আমি জম্মিছি । জল, জংলা, খাল, নদী বিল, হাঙ্গর কুমিরে ভরা ছেলো এই জায়গা। কি নদী ছেলো এই মধুমতি, ভাবতি পারবা নাকো তোমরা । এই এত বড় বড় ঢেউ। বজরা বলো, গয়না নাও, পিনিস যাই বলো মধুমতি ক্ষেপি উঠলি
সবাইরে গিলি গিলি খায়ে ফেলাতো। দিনে দুপুরে কুমির পায়ি হাঁটি গিরস্তের বাড়ি
ঢুকে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির সাথি আতকা হামলা করি বউ বাচ্চাও টানি নিয়ি যাতো।
চারদিকি খালি জল জল জল। নৌকো করি এবাড়ি ওবাড়ি যাতাম আমরা। একবার হইছে কি, এক জমিদারের মাইয়ের বিয়ে। বর আসি গেছে। এদিকে ঘোর কাদাপানিতে রাস্তা গেছে ডুবি। বর তো আর নামতি
পারে না। লগ্ন প্রায় যায় যায়। শেসি
জমিদার করলি কি, গোলা খুলি রাশি রাশি ধান বিছায়ে দেলো অই কাদাপানির রাস্তায়।
আমরা পড়াশুনা ছেড়ে ওদের অন্যমনস্কতার সুযোগে দু একটা পানের বোঁটা লুকিয়ে কুড়িয়ে খেয়ে নিতাম আর দেয়ালের
গায়ে হাতের ছায়া ফেলে ফেলে নানা রকমের ছবি বানিয়ে খেলা করতাম।
ওদের গল্প শুনতে শুনতেই দেখতাম মা চাচি, মাসিদের মুখ হাসিতে চকচক করে ওঠেছে। আর দাদুকে মনে হত বাসি ফুলের সিংহাসনে বসে আছে আদ্যিকালের
গল্পেরাজা। সবুজ গামছাটা হচ্ছে পান্নার মালা। মাথায় মুকুট নেই তাতে কি ! দাদু আমাদের রাজার রাজা।
মাঝে মাঝে মায়েরা এমন ছোটমানুষের মত হই হই করে উঠত যে আমরাও জমে যেতাম ওদের
সাথে। দাদু মিটিমিটি করে হাসত আর জোড়া সন্দেশের থালা দেখিয়ে আমাদের চোখের ইশারা
করত, নে নে তাড়াতাড়ি আরেকটা নিয়ে নে।
দাদুর কবিরাজঘর আমাদের দখলে থাকত সব সময়। বিনা পয়সায় দাদু আমাদের পড়াতেন। কুচোরা পড়ত একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র। আমরা পড়তাম, কোথায় চলেছ, এদিকে এসোনা , দুটো কথা বলি শোন কিম্বা বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে , জাগিয়া উঠেছে চর----।
আমরা কখনো পড়ি, কখনো অংক, ইংরেজিতে
গোল্লা পাওয়া পরীক্ষার খাতা ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিই কালিবাড়ির পুকুরে।
হেটো ধুতি, খালি গা, পা ঢাকা স্যান্ডেল সু পরে দাদু লম্বা কঞ্চি দিয়ে নৌকাগুলোকে মাঝ পুকুরের দিকে ঠেলে
ঠেলে ভাসিয়ে দিয়ে বলতেন, চেঁচা, চেঁচা ।
আমরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতাম। কোনো কোনো নৌকা ডুবে যেতো তাড়াতাড়ি, আমরা চেঁচিয়ে ওঠতাম , গেলো গেলো ভুট্টো গেলো কিম্বা ডুবিছে রে ডুবিছে, ইয়াহিয়া ডুবিছে। দাদু হাসত, চেঁচা , চেঁচা , যত চেঁচাবি তত লাংস ভালো থাকপি। অই অই ডুবে গেলো
একটা ! চেঁচা, চেঁচায়ে ক’ হেইয়ো হেইয়ো
ডুবিছে রে ডুবিছে আম্রিকা ডুবিছে ……
দাদু আমাদের বুদ্ধিদাতাও । তেত্রিশকে তেপ্পান্ন কিম্বা চল্লিশকে উনপঞ্চাশ করা দাদুর বাঁ হাত কা খেল ছিল ।
কিন্তু আজকাল কেমন খিন্ন হয়ে যাচ্ছে দাদু । কুঁজোও। যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ে । ধুতি উঠে যায় এদিক সেদিক, আর ঘরমোছা শেষে চিপড়ে রাখা ন্যাকড়ার মত দাদুর পুরুষাঙ্গ দেখা
যায় । নেতানো, কালো আর বিশ্রী সাদা চুলভরা।
আমাদের বিব্রত মুখ দেখে বাপি বলেছে বুড়ো বয়সে ওরকম হয় । লজ্জা কি ! তোমাদেরই
দাদু তো । না হয় একটু টেনে দিও ধুতিটা । ভালোবাসায় মায়া রাখতে হয় জানো ত
। কত ভালোবাসে তোমাদের ! মানুষের জন্যে মায়া করতে শেখো মা।
তা ঠিক। আমরাও দাদুকে খুব ভালোবাসি। তাই যে যখন থাকি, আমরা ঠিকঠাক দাদুকে
ঢেকে দিই। কিন্তু মাঝে মাঝে বড় লজ্জা দেয় ওপাড়ার
বন্ধুরা। আকরাম, নান্টু, রেন্টু, মুরাদ, আলতাফ জানালার লম্বা শিকের মাঝে মাথা গলিয়ে হ্যা হ্যা করে
হাসে আর আমাদের ক্ষ্যাপায়, অই তোদের
দাদুর চিন্টু দেখা যায় রে !
আমরা মারতে যাই, আচ্ছা আচ্ছা তোদের চিন্টুও
দেখা আছে। বুড়ো হ তোদের চিন্টুও এমন হয়ে যাবেনে !
ভয়ে ওরা তাড়াতাড়ি যে যার প্যান্টের চেন খুলে দেখে নিশ্চিত হয়, না বাবা এখনো ঠিক আছে।
শয়তানের শয়তান আকরাম শূয়োরের মত মুখে একটু মায়া এনে বলে, দাদুর বুকটা নড়তিছে না কেনো রে ? শিগগীর দেখ তো নিঃশ্বাস চলতিছে নাকি!
তাই শুনে পাড়ার মাস্তান
মিল্টন ভাইয়া সাইকেল
ফেলে একলাফে ঘরে ঢুকে পড়ে, এই তোরা সর, সরে দাঁড়া শাকচুন্নির দল।
তারপর দাদুর বুকের উপর কান রেখে চোখ বন্ধ করে শ্বাস শোনে। একটু পরেই হেসে উঠে ভালো ছেলেদের মত, হুম বুকটা নড়তিছে। শ্বাস নিতিছে দাদু । বাঁচি আছে বুঝিছিস পিচ্চিপাচ্চার দল। তারপর দুই হাতে চোখ মুছে চেনা চেহারায় চেনা
গুন্ডাদের মত খিস্তি করে, শালার বুড়ো মরলি কিন্তুক তোর মাথা ফাটায়ে আবার জেলে যাবানি
কথাটা য্যান মনে থাকে !
মিল্টন ভাইয়া চলে যেতে গোলাম মোস্তফার বাগান থেকে চুরি করে আনা একটা পাকা মালদা
পেয়ারা বের করে দেয় আজাদ, দাদুকে দিস।
রেন্টু দাদুর ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু হলি
ফোন দিবি। আমরা সাথি সাথি চলি আসবানি। ফোন নাম্বার জানিস তো ?
জানি আমরা। এই শহরে কজনের বাসায় আর ফোন আছে! দরকারে সবাই দাদুর কাছে না হয় ওদের বাসায়ই ফোন করতে ছোটে।
৩
ওরা চার পাঁচজন প্রতিদিন আসে। প্রতিদিন
এরকম কথা হয়। কিছুক্ষণ থেকে ওরা চলে যায়। ওদের থেকে খবর পায় আমাদের ছোট শহরের অনেকেই। কেউ কেউ সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানায়। কেউ কেউ ঠোঁট
চেপে রাগ দেখায়, বুড়ো শালিকটা এহনো বাঁচি আছে। কতবার কলাম জায়গাটা বিক্রি করি দিতি। আমার মেয়েজামাই কুয়েত থে্কি আসি
শহরেই বাড়ি বানাতে চাতিছে। তা বুড়ো কিছুতেই রাজি হতিছে না।
এরপর গভির কূট আলোচনায় মাথা নিচু করে ফিসফাস করতে শুরু করে। জায়গাটা কি শেষে ওরেই দিয়ে যাবি নাকি । এটা কিছুতেই হতি দিতি যাবে না, ও পেশকার, একটা বুদ্ধি বার কর দেখি। কাক শকুনে নেওয়ার আগি বুড়োর ছেলেদের এখনি একটা খবর দেও দিকিন, আমরা নগদা নগদি ডাবল দাম দিয়ি কিনি নেবানি !
চায়ের দোকানে অনেকগুলো ময়লা টাকা বের করে দিয়ে চা খায় আর কূট আলোচনায় মগ্ন হয়ে যায় ময়লা মনের মানুষগুলো
। চাওয়ালা সুবল প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের সময় এসে দাদুকে দেখে যায় আর বলে দেয়, ওরা কে কি ভাবছে। তাই শুনে দাদু দুলে দুলে হাসে।
সামান্য একটু পেয়ারা খেয়ে হুম হুম করে দাদু, শালারা তালি আসিছিলো। অইডাও ? ও শালার দাদু কিন্তুক
রাজাকার ছিলো জানিস ত তোরা । সাবধান। সাপের বাচ্চা কিন্তুক সাপই হয়।
তা হয়। খোন্দকার মুশতাক তো বঙ্গবন্ধুর বন্ধু
ছিল। আমার মা ত বঙ্গবন্ধুর সাথে তোলা গ্রুপ ছবিতে খোন্দকার মুশতাককে দেখিয়ে বাপিকে বলেছিল, এমা, দেখো দেখো সত্যি কেমন নাথুরাম গডসের মত লাগছে চেহারাটা !
আমরা নাথুরাম গডসেকেও চিনতাম। দুপুরে দাদুর ঘরে সিলিং ফ্যানটা কোরাঞ্চো কোরাঞ্চ, কোরাঞ্চো কোরাঞ্চ শব্দ করে চলত আর তার নিচে শুয়ে বসে আমরাও নাথুরাম গডসে আর খোন্দকার মুশতাকের চেহারায় আশ্চর্য মিল খুঁজে পেতাম ! কেবল হিস্ট্রি বইয়ে দেওয়া লর্ড ক্লাইভ আর মীরজাফরের স্কেচটা কিছুতেই মিলত না এদের সাথে।
দাদু বলত দূর পাগলের দল ! কতরকমের খুনী আছে এই পৃথিবীতে তা জানিস! ও আকরাম সালাউদ্দীন ফকিরকে একবার দেখা করতে বলিস ত দাদুভাই।
সালাউদ্দীন ফকির হচ্ছে চার খুনের আসামী। প্রমাণ হয়নি বলে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল। এই চুল ঝাঁকিয়ে যখন গান ধরে তখন মানুষ ভুলে যায় সালাউদ্দীন খুনিকে। একই লোক খুনি আবার গাতকও ! বুঝলি মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী
হে। হরেক রঙের কারবারি সে জন ।
আকরামকে কিছু বলা মানে সাথে সাথে সে কাজ হয়ে যাওয়া।
সাইকেল করে আকরাম আর তুহিন সেদিনই চলে গেল ফকিরহাট। আখড়ায় সালাউদ্দীন ফকির নাই। চিতলমারির কোন গ্রামে গেছে গানের বায়না নিয়ে। আখড়ার মা, মানে সালাউদ্দীন
ফকিরের মা জননী সর্ষে তেলে
ভাজা ঝাল কইএর সাথে নিজের হাতে লাগানো লাউয়ের ছেঁচকি দিয়ে ভাত খাইয়ে তবে ছেড়েছে ওদের। দাদুর গেস্ট বলে কথা।
তাছাড়া আকরাম ইদানীং মিল্টন মাস্তানের কমরেড হয়ে যাচ্ছে। কাউকে দেখা করতে খবর দিতে বললে, গলায় গামছা দিয়ে তখুনি ধরে প্রায় বেঁধে নিয়ে আসে তাকে !
দু ফলার একটা চাইনিজ চাকু কিনেছে আকরাম। আজকাল জামার কলার ভাঁজ না করে পরে । পড়াশুনার সময়ও ঘুরে বেড়ায়। কোচিং ফাঁকি দেয় প্রায় সব দিন। পড়াশুনাও ভাল করে করে না। দু পেপারে ফেল করেছে। এসএম মডাল হাই ইশকুলের পান্নু স্যার আকরামের বাবাকে বলে গেছে, ফাইন্যালে ফেল করলে ইশকুল টিসি দিয়ে দেবে। অইটুকু ছেলে। এখুনি চেপে ধরেন উকিল সাহেব। সময় এখনো চলে যায় নি।
উকিলচাচার হাতে ডাবল বেতের মার খেয়েও ওর কিচ্ছু হয়না।
ওর হাতে পিঠে বুকে বেতের দাগ দেখে শিউরে ওঠে আমরা জোরে শোরে পড়তে বসি। কিন্তু যে আকরাম সেই আকরামই থাকে। ভালো আকরামকে আর দেখা যায় না। আমরা বুঝি ওর আর ক্যাডেট ইশকুলে পড়া হচ্ছে না। ও গোল্লায় গেছে নজু দারোগার বড় ছেলে মিল্টনভাইয়ার মত!
৪
মিনতি মাসি একটি কালো ধাতব গামলায় পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, কাঁচা মরিচ সর্ষে তেলে ডলে সামান্য চিনি ছিটিয়ে মুড়ি মাখা দিয়ে যেত। তীব্র ঝালে আমরা শোষাতে শোষাতে চেঁচাতাম, এত ঝাল কেনো দিয়েছ গো
মাসি। মরে যাচ্ছি প্রায় !
মাসি গামছায় ভেজা হাত মুছতে মুছতে রাগী গলায় খিঁচিয়ে ওঠত, মেয়েমানুষ ঝাল খাবা না ত খাবা কি! জীবনটা কি কেবল মিঠাই মন্ডায় ভরা থাকে
নাকি !
তা বটে। আজই তো ইশকুলে দু দুটো বেতের বাড়ি
খেয়েছি কৃষ্ণাদির কাছে ।
থার্ড পিরিয়ডে সমাজ স্যার আসেননি বলে সেকেন্ড ক্যাপ্টেন সাই সাই করে ক্লাশের সামনের
পেয়ারা গাছে উঠে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে ফেলে দিয়েছিল নীচে। আমি ফার্স্ট ক্যাপ্টেন শেয়ালের মত সাবধানে তা কুড়িয়ে এনেছিলাম। কেউ দেখেনি আমরা ডাবল সিওর। সবে ক্লাশ শুদ্ধ সবাই ভাগ করে খেয়ে আনন্দ করছি, ওমা কৃষ্ণাদি এসে চটাস চটাস মেরে দিলো । আমরা নাকি ক্যাপ্টেনের কোনো জাতই না। নেক্সট উইকে নতুন ক্যাপ্টেন বানাবে। বানাক। তারাও আমাদের মতই জাত ছাড়া ক্যাপ্টেন
হবে। কৃষ্ণাদিরা তো জানেনা, আমরা ক্লাশে ডেস্কের ভেতর কাপ আইস্ক্রিম রেখে ভাগ করে করে খাই। আমাদের ইউনিটি সুপার এক্সওকিউ। ওসব একটু আধটু মারধরে আমাদের কিস্যু হয়না।
দাদু এক চোখ ছোট করে হেসে বলতেন, ঝাল খাবি
বুঝলি। ঝাল হচ্ছে মানুষের আদি ও অকৃত্রিম ভরসা। যত ঝাল খাবি তত শুদ্ধ হয়ে উঠবি।
আমরা মিনতি মাসির কষ্টটা জানতাম। রেখাদির মা মিনতি মাসিমা এখন দাদুর কাছে থাকে। দাদুর সব
কাজ করে দেয়। তাকে ভরসা দেবে, আশ্রয় দেবে, রেখাদিকে
পড়াশুনা করাবে বলে দাদুর এক ধনী আত্মীয় তার সংসারে সম্মানের সাথে এনে
রেখেছিল বহু বছর ধরে । সেই বিশাল বাড়িতে মিনতি মাসিমার একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল। এমনকি বাড়ির কুকুরটাও মিনতি মাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাইত ঘেউ ঘেউ ডাকার জন্যে।
অনেক যত্ন করে সেই লোকের ছেলেমেয়েদের মানুষ
করে দিয়েছে মাসিমা। বংগবন্ধুকে মেরে ফেলার পর তারা ইন্ডিয়া
চলে গেছে। যাওয়ার সময় কিছুতেই সাথে করে নিয়ে গেলো
না রেখাদি আর তার মাকে । দাদু অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিল। তারা দাদুকে বলে গেছিল, কি বলবো ওখানকার মানুষকে ? বলবো যে
আমার বাবা রাঁড় রেখেছিলো, ছিঃ ।
অকথ্য গালাগালি করে দাদু ওদের তাড়িয়ে দিয়ে রেখাদি আর রেখাদির মাকে নিজের বাসায় এনে রেখেছিল।
রেখাদি অবশ্য খুব ভাল আছে। বাপি মা
বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নিরাময় ফার্মেসীর কমপাউন্ডার
দাদুর সেই আত্মীয়ের সাথে। মাঝে মাঝে রেখাদি আসে ছেলেকে সাথে করে। রোগী বসার বেঞ্চে বসে ছেলেকে দুধ খাওয়ায়। ছেলেটা এক বুকের দুধ খেতে খেতে অন্যবুকের কাপড় উলটে দেয়। আর অবাক করা এক দুধের ভান্ডার আমাদের
চোখের সামনে মুখ উঁচু করে হেসে ওঠে ।
কী যে সুন্দর লাগে। আমরা বিমুগ্ধ হয়ে দেখি। ছেলেটাকে ছুঁয়ে দিই। গলার ভাজে তেল পাউডারের সর। কপালজুড়ে কাজলের টিপ। কোমরের ঘুনসিতে রূপা বাঁধানো ঘুন্টি। ওর নরম কোমল চামড়ায় সর্ষে তেল আর পাউডারের ম ম গন্ধ।
রেখাদি যা বলে আমরা তাই করে দিই। মাঝে মাঝে রেখাদির নতুন লাল স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঘুরি। ইস কত বড় ! আধখানা স্যান্ডেল
বেরিয়ে থাকে । পেছন ফিরে বেরিয়ে থাকা স্যান্ডেল দেখি আর ভাবি, আমাদেরও একদিন
বিয়ে হবে। আমরাও একদিন এমন লাল হিল তোলা স্যান্ডেল
পরে বুক উজাড় করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবো !
দাদু বলেছে, হবেই। তোরাও ত মেয়ে। মেয়েরা হচ্ছে পৃথিবী। সন্তান না থাকলে কিসের পৃথিবী ! আকরাম রেন্টুরা তাই শুনে ঠোঁট ওল্টায়, সে কোন জম্মে হবিনি কিডা জানে!
গোপনে গোপনে রেখাদির স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে পায়ের মাপ যাচাই করি। স্যান্ডেলের ফাঁকা অংশটা যেনো একটু কমে গেছে ! জামার গলা ফাঁকা করে নিজেদের বুক দেখি। একটু কি উঁচু লাগে ? ঘুম দুপুরে বড় আয়নার সামনে মার ছেড়ে রাখা ব্রা গায়ে চড়াই। ধুস কাপগুলো চুপসে ন্যাতাকানি হয়ে ঝুলে থাকে।
আর তখন অপেক্ষা নামে একটা শব্দের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সব কিছু যে তারাপদ কাকুর দোকানের মিষ্টি নয় যে পয়সা দিলেই পাওয়া যাবে, এটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারি।
৫
আকরামরা বাচ্চাটাকে দেখে আর ফিসফিস করে, দেখতে কি সুন্দর লাগছে তাই না রে । গির্জায় আঁকা মাতা মেরির
কোলে পিচ্চি যিশুর মতন।
আলতাফ পাশ থেকে বলে উঠে, এই আমাদের ধর্মের মত কথা বল। ঈসা নবীর মাতা বিবি মরিয়ম। মেরি
বলিস না খৃষ্টানদের মত।
আকরাম রেন্টু একটু ভড়কে যায়।
আলতাফের বাবা আজকাল শহরের বেশ নামকরা উকিল হয়েছে । আগে গ্রামে ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক
হিন্দু পরিবার বাংলাদেশে ফিরে আসেনি। তাদের কারো কাছ থেকে বাড়ি কিনে নিয়েছে । যে পাড়ায় বাড়ি কিনেছে সে পাড়ার হিন্দুরা আস্তে ধীরে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে আর বাড়িগুলো আলতাফের বাবা নিজের গ্রামের লোকদের নিয়ে কিনিয়ে নিচ্ছে।
আলতাফের বড়ভাই সোভিয়েত রাশিয়ায় স্কলারশীপ নিয়ে জলবিদ্যুতের উপর পড়াশুনা করছে। আলতাফের আব্বার প্রাইভেট অফিসের দেওয়ালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরাট বড় ছবি। দরকার বেদরকারে
শহরের অনেকেই আজকাল ভিড় করে সেখানে। এখন আর কেউ বলে না, এই উকিলের আব্বা একাত্তরে রাজাকার ছিল।
আমাদের ফার্মেসিতেও আজকাল মাঝে মাঝে এসে বসে। মোয়ানো মুড়ির মত মিইয়ে যায়
বাপি। ভালো
করেই জানে লোকটা তাকে উপরে উপরে সন্মান করে কিন্তু ভেতরে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
দাদুর জায়গাটা নিয়ে খুব ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। দাদু এখন বয়সের ভারে নির্বাক, স্মৃতিশক্তিহীন। শোনা যাচ্ছে জায়গাটা বিক্রি
হয়ে গেছে। কার কাছে কেউ জানে না। একদিনের জন্যে দাদুর ছেলেরা এসেছিলো। তারাই বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে। বাপির সাথে কোনো কথা হয়নি। চুক্তি হয়েছে দাদু মারা গেলেই যারা কিনেছে তারা দখল নিয়ে নেবে।
উকিলসাহেব হেসে হেসে বাপিকে চাপ দিচ্ছে। তিনি আরো বেশি টাকা দিয়ে দাদুর জায়গাটা কিনতে চান। পজেশন ভালো। বাপি যেনো দাদুর ছেলেদের কাছে প্রস্তাব
দেয় আগের বিক্রিটা বাতিল করে তার কাছে জায়গাটা
বিক্রি করে দিতে। দরকারে বাপিকেও কিছুমিছু উপহার দেওয়া
হবে। মিছরির ছুরির মত গভীর শ্লেষ ছড়িয়ে
বাপিকে আঘাত করে আলতাফের আব্বা, কি পেলেন
এ জীবনে? বঙ্গবন্ধু তো আপনার বন্ধু ছিল। কতকিছুই ত করলেন তার জন্যে। আল্লাহও ত আপনাকে মেরে দিয়েছে। কেবল কন্যা সন্তান আপনার।
বাপি থম মেরে থাকে। যা করেছে তা দেশের জন্যে । কিন্তু এইসব লোক কি তা বুঝবে!
৬
এক আলো ছড়ানো পূর্ণিমার রাতে দাদু দেহ রাখলেন। হঠাত বৃষ্টি নেমেছিল সে রাতে। শ্রাবণ জ্যোৎস্নাকে ঘিরে বৃষ্টিমেঘ তার বুকের পরত খুলে দিয়েছিল বাতাসে । বুকের খাঁজে খাঁজে সেকি মোহন মৃত্যু
নাচ। ভয়হারা । দুঃখ বিচ্ছেদ কুণ্ঠাহীন। সদাশয় । মৃত্যু
আলয়ে নেচে যাচ্ছে মানুষের প্রাণ, এসো এসো, এসো মরণ।
মোমের মত নরম মায়াবতী বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছিল দাদুর উঠোন। চমকে চমকে ওঠেছিল হাস্নুহেনা আর গন্ধরাজের পাতা। ঝমঝম আবেশে জেগে ওঠেছিল প্রকৃতি। আলো আঁধার, বৃষ্টি জল, বৃক্ষ নদী মাটি ও বাতাস রচিত করেছিল এক মহাপ্রস্থানের পথ। অবিনাশী জ্যোৎস্না আলো ছড়িয়ে মাঠ, ঘাট, গাছ, নদীর মত স্পষ্ট
করে তুলেছিল সেই অলৌকিক বীথিকা।
ভিজে গাছ আর বৃষ্টির সেকি রোমাঞ্চ । নদী ফুলে উঠেছিল কলকল আনন্দে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাজছিল মৃত্যু মেয়ের তন্নিষ্ঠ পা। আমলকি,
শিরীষ, নিম অশোকে ছাওয়া মধু বাউলের আখড়ায় কে
যেনো খোল বাজাচ্ছিল হৃতমান লয়ে, এসো এসো, এসো মৃত্যু। এসো এসো, এসো মরণ।
মিলটন ভাইয়া আরবদেশে উটের আস্তাবলে কাজ করে । ভাইয়ার চোখ এখন উটরঙা । মাঝে মাঝে কড়া রোদ্দুরে নাক দিয়ে
রক্ত পড়ে। মরুভূমির বালু তা শুষে নেয়। শাওয়ালের চাঁদ দেখে ভাবে, এই যে বিদেশ যাপন, তা জেল থেকে আর কত ভালো হল ! খেজুরের
চামর ঝুলে পড়া দেখে গোপনে ফুঁপিয়ে কাঁদে,
দেশ, আমার স্বদেশ। আমারে নিয়ে যা মা। আমার ভাল লাগে না এই মুক্তি।
সোমেন কাকুরা দাদুর জায়গা বিক্রি করার সময় দাদুর কাছ থেকে
বাপির জন্যে কেনা জায়গাটাও কিভাবে যেনো বিক্রি করে দিয়েছে। আলতাফের আব্বার হাতে সব কাগজ । একেবারে অরিজিন্যাল। বাপি অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সোমেন কাকুরা সাড়া দেয়নি।
মামলা লড়লে লড়া যায় কিন্তু বাপির সেই জোর নেই।
আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আকরাম, রেন্টুর সাথে আলতাফ এসেছিলো দেখা করতে ।ও এখন আর্মি ট্রেনিং এ চলে যাবে বহুদূর । অনেক লম্বা হয়েছে। গোঁফ উঠেছে কালো হয়ে। যাওয়ার সময় একটু পেছনে পড়ে, থেমে বলেছিলো, ভুলে যাবে? আমরা কি এতই খারাপ !
পড়ার টেবিলে উপুড় হয়ে আছে মানিক বন্দোপাধ্যয়ের “পুতুল নাচের ইতিকথা”। কুসুমকে কেমন যেনো ভাল লেগে যাচ্ছে
আমার। তার আগে শেষ করেছি গোর্কির মা। নাতাশার চাইতে সাশাকেই বেশি মনে ধরেছে আমার। দাদু আমার হাট্টাগোট্টা চেহারাছবি দেখে মাকে
বলত , বড়বউমা তোমার ঘরে দেখি রবি ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা জন্মেছে !
পুতুল নাচের ইতিকথার ভেতর মাথা মুখ লুকিয়ে আমি আমার আবেগকে খুন করি। আমার প্রথম প্রেম হিজলফলের মত পড়ে থাকে মাটিতে। আমার ছেড়ে আসা শহর। চিতলমাছের মত রূপা রঙ নদী আমি আর কোনোদিন দেখতে পাবো না !
আলতাফের আব্বা এখন মুজিব কোট পরে । অফিসঘরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চ উনিশ শ একাত্তরের ছবি। স্থানীয় এক ক্ষমতাসম্পন্ন পুরনো নেতার মেয়েকে বিয়ে করেছে আলতাফের বড় ভাই। কেন্দ্রীয় নেতারা যখন তখন আসে। মিটিং করে। আলতাফের আব্বা জীবনজয়ের দিকে আরো এগিয়ে যায়।
আলতাফ আছে কোথাও কোনো ক্যান্টনমেন্টে। জলপাইরঙের আড়ালে। বিয়ে করেছে। দুটি মেয়ে । কেনো যেনো ওই শহরে আলতাফ কখনো যায় না।
আকরাম রেন্টু সুইজারল্যান্ডের দুই শহরে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারী , বিজয় দিবসে দুজন দুজনকে
ফোনের ভেতর গান শোনায়। ওদের বউ বিদেশি।
দুজনেই মাঝে মাঝে ফোন করে, জানিস আমাদের বাচ্চাগুলো না বিদেশি। ফরফর করে ইংরেজীতে কথা কয়। জয়বাংলা ছাড়া শালারা আর কোনো
বাংলাই শিখল না ! আমরা কেমন স্বদেশছাড়া মানুষ হয়ে গেলাম রে মনা। বুকের ভেতর স্বদেশ নিয়ে
প্রতিদিন বরফ ভেঙ্গে কাজে যাই। আমরা
কতজন এমন স্বদেশ ছাড়া মানুষ মাতৃভাষা ছাড়া এখানে জমে আছি। পাকিস্তানের শাহনেওয়াজ, ভারতের উমর গুল, নরেন উথাপ্পা, মিশরের
আব্দেল, প্যালেস্টাইনের আবরাব, রাশিয়ার
আন্দ্রেই , বসনিয়ার হানান। আমাদের দেশ আছে কিন্তু স্বদেশ নাই রে!
যখন ছোট্ট শহরটি ছেড়ে চলে আসি, আমার সব চেয়ে ছোট বোনটি ইশকুল ব্যাগের ভেতর ওর প্রিয় গল্পের বই, “উভচর মানুষ” রাখতে রাখতে উচ্ছ্বসিত স্বপ্নে উদ্বেল হয়ে বলে ওঠেছিল , লঞ্চটা যদি
আমাদের বাসা হত কি মজা হত তাই না আপুলি ? আমাদের
কোন ঘর থাকত না, বাগান, দোলনা, মাধুরীলতা জড়ানো গেট কিচ্ছু লাগত না। আমরা কেবল
ভেসে বেড়াতাম নদীতে নদীতে, সমুদ্রে সমুদ্রে
!
ও জানত না পৃথিবীতে কিছু মানুষ কেবল ভেসে বেড়ায় । কিছু মানুষ আজন্মের শরণার্থী হয়ে ঘুরে বেড়ায় এই পৃথিবীর অলি গলি, বাজার, অফিস, ফুটপাথ, বেশ্যালয়, সাততারা হোটেল, এমনকি নিজের দেশে নিজ ঘরে, নিজের মনের মনপুকুরেও !
5 মন্তব্যসমূহ
আহা, চোখ ভিজে এল। "কিছু মানুষ আজন্মের শরণার্থী হয়ে ঘুরে বেড়ায় এই পৃথিবীর অলি গলি, বাজার, অফিস, ফুটপাথ, বেশ্যালয়, সাততারা হোটেল, এমনকি নিজের দেশে নিজ ঘরে, নিজের মনের মনপুকুরেও !" - অদ্ভুত মায়ায় ভরা বর্ণনা। ভীষণ মুগ্ধ পড়ে।
উত্তরমুছুনExcellent
উত্তরমুছুনবেশ সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মনকেমন করে দেওয়া লেখা।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো। মন কেমন কেমন করা অনুভূতি চেপে বসলো।
উত্তরমুছুনবড় ভাল লাগলো।
উত্তরমুছুন