(৪)
সেই রাতে, মায়ের অবর্তমানে, স্কারলেট সাপারের টেবিলে
পরিবেশনের দায়িত্ব নিল। কিন্তু অ্যাশলে আর
মেলানির বাগদানের অপ্রীতিকর খবরটা মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছিল না। স্ল্যাটেরিদের
বাড়ি থেকে মা যে কখন ফিরবেন? মাকে ছাড়া
নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ আর অসহায় মনে হচ্ছিল। কোন আক্কেলে চিররুগ্ন স্ল্যাটেরিরা তার
মাকে নিয়ে গেল যখন মাকে ওর নিজের এত প্রয়োজন?
একে তো মনে এত অস্বস্তি, তার ওপরে আবার জেরাল্ডের হেঁড়ে
গলায় অবিশ্রাম বকবক, - স্কারলেট যেন আর সহ্য করতে পারছিল না। বিকেলে ওর সাথে যে এত কথা হল, মনে হয় উনি সেটা
বেমালুম ভুলেই গেছেন। নিজের মনে ফোর্ট সামটার থেকে আসা নতুন খবরগুলো বলে যেতে
লাগলেন। মাঝে মাঝে হাওয়ায় হাত নেড়ে আর টেবিলের ওপর ঘুসি মেরে বক্তব্যকে জোরদার
করবার চেষ্টা। সাধারণত, খাবার সময়ে বেশির
ভাগ কথা জেরাল্ডই বলে থাকেন। স্কারলেট
নিজের ভাবনায় মশগুল থাকে; সেসব কথা কানেও যায় না। কিন্তু আজ রাতে কথাগুলো ওর কান
ঝালাপালা করে দিচ্ছিল। ও কান পেতে এলেনের ফিরে আসার ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ শোনার
চেষ্টা করছিল।
ঠিক কি কারণে তার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে আছে, সেটা অবশ্য
মাকে খুলে বলতে পারবে না। তাহলে মা কঠিন আঘাত পাবেন। তাঁর মেয়ে এমন কাউকে বিয়ে করতে চায় যে কিনা অন্য মেয়ের বাকদত্ত! তবু জীবনের এই প্রথম বিপর্যয়ে, মনের অতল থেকে
অনুভব করল, মায়ের সান্নিধ্য তাকে খানিক শান্তি দিতে পারে। মা কাছে থাকলে ভরসা
পাওয়া যায়। যে কোন সমস্যার ভারই শুধু মা
পাশে থাকলে অনেক হালকা হয়ে যায়।
গাড়ীবারান্দায় চাকার ঘর্ঘর শব্দ
শুনে স্কারলেট তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
তারপরই আবার হতাশায় বসে পড়ল। না মা নয়। শব্দটা বাড়ির পেছন দিকে চলে যাচ্ছে।
এলেন এলে, সামনের দরজায় নেমে পড়তেন। বাইরের অন্ধকারে নিগ্রোদের গলার কলকলানি ভেসে
এল। সঙ্গে জোরে হেসে ওঠার আওয়াজ। জানালার বাইরে তাকিয়ে স্কারলেট পোর্ককে দেখতে
পেল। একটা মশাল নিয়ে ওর ঘর থেকে বেরোল। ওয়াগন থেকে দুজন ছায়ামূর্তি নামল। রাতের
অন্ধকার ভেদ করে ওদের কথাবার্তা আর হাসির আওয়াজ আসছে। বেশ ঘরোয়া নিশ্চিন্ত হাসি
খুশির মেজাজ। বাইরের উঠোন দিয়ে সিঁড়ী বেয়ে ওদের পায়ের শব্দ ওপরে এসে খাবার ঘরের পাশের
হলে এসে থেমে গেল। তারপর কিছুক্ষণ ফিসফিস শব্দ। পোর্ক ঢুকল। স্বভাবোচিত গাম্ভীর্য বিসর্জন দিয়ে, বড় বড় চোখে, মুখভরা হাসি
নিয়ে।
“মিস্টার
জেরাল্ড,” ওর
চকচকে মুখে বিবাহের পাত্রসুলভ গর্ব; শ্বাসপ্রঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। “আপনার নতুন দাসী চলে এসেছে।”
“নতুন
দাসী? আমি কোন নতুন দাসীটাসি কিনতে পারব না,” জেরাল্ড রাগ করার ভান করলেন।
“না
হুজুর, আপনি কিনে নিয়েছেন, মিস্টার জেরাল্ড। হ্যা হুজুর! ও আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে,” আনন্দে গদ গদ হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে
পোর্ক বলল।
“ঠিক
আছে। ডাকো পাত্রীকে,” জেরাল্ড
বললেন। পোর্ক পেছনে ঘুরে হলে বউএর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। উইল্কসদের পরিবারকে ছেড়ে
ও সদ্য এসেছে টারার পরিবারে থাকার জন্য। ডাক পেয়ে
ভেতরে এল। ওর বারো বছরের মেয়েও মায়ের ঘাগরার আড়ালে লুকিয়ে পায়ে পায়ে ঢুকল।
ডিলসি বেশ লম্বা, একটা ঋজুভাব আছে। তিরিশ থেকে
ষাটের মধ্যে যে কোন বয়সের হতে পারে।
তামাটে মুখে বলিরেখার চিহ্নমাত্র নেই। নীগ্রো বৈশিষ্ট ভেদ করে ইন্ডিয়ান
রক্তের সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। ঈষৎ লাল ত্বক, চওড়া সরু কপাল, বাজপাখির মত নাক দুই পাশে
এসে সমতল হয়ে গেছে আর পুরু নিগ্রো ঠোঁট – সব মিলিয়ে দুটো ভিন্ন সম্প্রদায়ের মিশ্রণ। আত্মসচেতন আর হাঁটাচলায় ম্যামির
থেকেও বেশী সম্ভ্রান্ত। আসলে ম্যামির সম্ভ্রম দেখে শেখা; ডিলসির সহজাত।
অন্যান্য নিগ্রোদের মত কথাবার্তা জড়ানো নয়। শব্দপ্রয়োগেও চিন্তাভাবনার
ছাপ।
“শুভ
সন্ধ্যা মিসেরা। মিস্টার জেরাল্ড, এই সময় আপনাকে
বিরক্ত করতে আমার খারাপ লাগছে। তবু আমি আপনাকে আবার ধন্যবাদ দিতে এসেছি। অনেক
ভদ্রলোকই আমাকে কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রিসিকে কেউই নিতে রাজি হচ্ছিলেন
না। সেটা আমার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল হত।
আপনি দয়া করে আমাদের দুজনকেই কিনে নিয়েছেন। আমি একথা সব সময় মনে রাখব। আপনাদের
আমি জীবন দিয়ে সেবা করব।”
“ঠিক
আছে, ঠিক আছে।” তাঁর
উদারতা ধরা পড়ে যাওয়ায় জেরাল্ড খুব বিব্রত বোধ করছিলেন।
স্কারলেটের দিকে ফিরল ডিলসি। চোখ
কুঁচকে একটু হাসল। “মিস
স্কারলেট, পোক আমাকে বলেছে। আমাকে কিনে নেবার জন্য আপনি মিস্টার জেরাল্ডকে কত বলেছেন।
প্রিসিকে আপনার ব্যক্তিগত পরিচারিকা হিসেবে আপনাকে দিয়ে দিলাম।”
তারপর মেয়েকে পেছন থেকে টেনে সামনে নিয়ে এল। গায়ের রঙ বাদামী। পাখিদের পায়ের
মত লিকলিকে দুটো পা। মাথার চুল দিয়ে যত্ন করে অজস্র বিনুনী বাধা। ভাব ভঙ্গী হাঁদার
মত হলেও চোখদুটো ভারি সজাগ। যেন কোন কিছুই ওর দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারবে না।
“ধন্যবাদ
ডিলসি,” স্কারলেট
জবাব দিল। “তবে
এ ব্যাপারে শেষ কথা বোধহয় একমাত্র ম্যামিই বলতে পারবে। আমার জন্মের সময় থেকেই ও আমার পরিচারিকা।”
“ম্যামির
তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, তাই না?” কথাগুলো
এমন শান্তভাবে বলল ডিলসি যে ম্যামি শুনতে পেলে আর রক্ষে ছিল না। “ও খুবই ভালো ম্যামি। কিন্তু তোমার
তো বয়স কম। তোমার একজন ভাল পরিচারিকা দরকার। গত এক বছর ধরে আমার প্রিসি মিস
ইন্ডিয়ার পরিচারিকা ছিল। ও ভাল সেলাই করতে পারে। চুলও ভাল বেঁধে দিতে পারে।”
মায়ের ইশারায় প্রিসি স্কারলেটকে
একবার নতজানু হয়ে বাও করল। তারপর হেসে ফেলল। স্কারলেটও না হেসে পারল না।
“একরত্তি
শয়তান,” মনে
মনে ভাবল স্কারলেট। মুখে বলল, “ধন্যবাদ
ডিলসি। যাই হোক, মা বাড়ি এলে তখন ভাবা যাবে।”
“ধন্যবাদ
ম্যা’ম। আপনাকে শুভরাত্রি জানাচ্ছি,” ডিলসি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে
বলল। খাবার টেবিল সাফ হয়ে যেতেই জেরাল্ড আবার তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন। ‘যুদ্ধ লাগতে আর বেশি দেরী নেই’, কিংবা ‘দক্ষিণের মানুষ আর কতদিন ইয়াঙ্কিদের অপমান সহ্য করবে’ এই সব। কিন্তু তেমন জমল না। তাঁর শ্রোতারা একঘেয়ে ভাবে কখনও ‘হ্যা বাপী’ আবার কখনও ‘না বাপী’ বলে
তাল দিতে থাকল। ক্যারীন একটা বড় ল্যাম্পের তলায় নীচু হয়ে বসে একটা রোমান্টিক গল্প
গভীর মনযোগের সঙ্গে পড়ছে। প্রেমিকের মৃত্যুতে শোকার্ত নায়িকা নিজেকে অবগুন্ঠিত করে
রেখেছে। পড়তে পড়তে ওর চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
স্যুয়েলেন ব্যস্ত একটা এম্বয়ডারি নিয়ে। মনে মনে ও এটার নাম দিয়েছে “আশার প্রদীপ।” নীরবে মতলব ভাঁজছে কি ভাবে স্টুয়ার্ট
টার্লটনকে স্কারলেটের কাছ থেকে ভাঙ্গিয়ে নিজের দিকে টেনে আনা যায়। ওর মধ্যে যে নরম
মেয়েলি গুণপনা আছে স্কারলেটের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নেই। স্কারলেটের মন অ্যাশলেকে
নিয়ে অশান্ত হয়ে আছে।
কি করে যে বাপী ফোর্ট সামটার আর
ইয়াঙ্কিদের নিয়ে এত বকবক করছেন যখন জানেন ওর মনের মধ্যে কি হচ্ছে? তার বুক ফেটে
গেলেও সবাই কেমন স্বার্থপরের মত ব্যবহার করে চলে যেন কিছুই হয় নি।
ওর মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথচ
কি আশ্চর্য খাবার ঘরের পরিবেশ অন্য সব দিনের মত একই রকম রয়েছে, কোন পরিবর্তন
নেই। এই মেহগিনির টেবিল, দেওয়ালের গায়ের
তাকগুলো, রুপোর বাসনপত্র, মেঝের ওপর কার্পেট সবই নিজের নিজের জায়গায় রয়েছে, যেন
কিছুই হয় নি। এই শান্ত, আরামদায়ক কামরায় অন্য দিন স্কারলেটও সাপারের পরে সবার সাথে
বসে নিরিবিলি পরিবেশ উপভোগ করতে ভালবাসে। আজ সে সহ্য করতে পারছে না। বাপীর গলা
চড়িয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ে এখান থেকে উঠে যেতেও পারছে না। নাহলে এলেনের অফিসে গিয়ে
পুরোনো সোফাটায় বসে একটু কেঁদে মনটাকে শান্ত করতে পারত।
ওই রুমটাকে স্কারলেট এই বাড়ির
মধ্যে সব চাইতে বেশী ভালবাসত। এখানে রোজ সকালে এলেন তাঁর লম্বা সেক্রেটারির সামনে
বসে প্ল্যান্টেশনের হিসেব বুঝে নেন। ওভারসীয়ার
জোনাস উইল্কারসনের কাছ থেকে রিপোর্ট নেন। এলেন যখন লেজার লিখতে ব্যস্ত থাকেন তখন
ওঁরা সবাই মিলে এই ঘরে বসে বিশ্রাম নেন। জেরাল্ড তাঁর পুরোনো দোলনা চেয়ারে বসেন।
বোনেরা সবাই মিলে বসে ঝুলে যাওয়া সোফাতে, যেটা এত জীর্ণ হয়ে গেছে যে বাড়ির সামনের
দিকে আর বের করা যায় না। স্কারলেট এখন
ওখানেই যেতে চাইছে। ইশ, যদি একলা মায়ের কোলে একটু মাথা রেখে শুতে পারত! আর কত দেরি
হবে মায়ের ফিরতে?
ঠিক তখনই চাকার ঘর্ঘর আওয়াজ পাওয়া
গেল। এলেন মৃদুস্বরে কোচওয়ানকে বিদায় জনালেন। তারপর দ্রুত ভেতরে এলেন। সবাই কৌতুহলে মুখ তুলে তাকাল। তাঁর চেহারায় ক্লান্তির ছাপ; দৃষ্টিতে বিষন্নতা। লেমন
ভারবেনার সুগন্ধে ঘর ভরে গেল। এই গন্ধ স্কারলেটকে সবসময়েই তার মায়ের উপস্থিতির
জানান দেয়। তাঁর পেছনে পেছনে ম্যামি চামড়ার ব্যাগ হাতে ঢুকল। মৃদুস্বরে কি বলল
বোঝা না গেলেও সবাই বুঝতে পারল যে সে বেশ অসন্তুষ্ট।
“খুব
দুঃখিত। এত দেরি হয়ে গেল,” ঝুঁকেপড়া
কাঁধ থেকে শালটা খুলে স্কারলেটের হাতে দিতে দিতে বললেন। দেবার সময় ওর গালে হালকা করে
হাতটা বুলিয়ে দিলেন।
এলেনের প্রত্যাগমনে খুশীতে
জেরাল্ডের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“ছোঁড়াটাকে
ব্যাপটাইজ় করতে পারলে?” জিজ্ঞেস
করলেন।
“হ্যা,
কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না। বেচারা,” এলেন
বললেন। “ভয়
হয়েছিল, এমিও বোধহয় গেল। তবে মনে হয় এযাত্রা বেঁচে গেল।”
“ছোঁড়াটা
মরে বেঁচেছে। যাই বল, পিতৃপরিচয়হীন _____”
“অনেক
দেরি হয়ে গেছে। চল তাড়াতাড়ি প্রার্থনাটা করে নিই,” বাধা দিয়ে বললেন এলেন। এত সহজভাবে বললেন যে এলেনের সম্পর্কে
ওয়াকিবহাল না থাকলে কেউ খেয়ালই করবে না যে তিনি বাধা দিলেন।
এমি স্ল্যাটেরির বাচ্চার বাপ কে
সেটা জানার কৌতুহল হচ্ছিল স্কারলেটের। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে সত্যিটা জানা কোনমতেই
সম্ভব নয়। স্কারলেটের সন্দেহ জোনাস উইল্কারসন। সন্ধ্যের পরে প্রায়ই জোনাসকে এমির
সাথে ঘুরতে দেখা গেছে। জোনাস একজন ইয়াঙ্কি। অবিবাহিত। আর যেহেতু সে একজন
ওভারসীয়ার, তাই কাউন্টির সমাজ জীবনে তার যোগদান পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এখানকার কোন পরিবার
তাকে মেয়ে দেবে না। আর স্ল্যাটারিদের মত অপাঙতেয় লোকদের সাথে ছাড়া আর কারও সাথে
মেলামেশার সুযোগও নেই। শিক্ষায় দীক্ষায়
জোনাস স্ল্যাটারিদের থেকে অনেক ওপরের স্তরের। তাই স্বাভাবিকভাবেই এমিকে বিয়ে করবে
না, যদিও ওর সাথে মেলামেশাতে তার কোন আপত্তি নেই।
একটু হতাশ হল স্কারলেট। তার প্রবল
কৌতুহল হচ্ছিল। কত ঘটনাই তো মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। অথচ মা এমন ভাব
করবেন যেন কিছুই ঘটেনি। যে
সব ঘটনা তাঁর বিচারধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এলেন সে সব ঘটনাগুলোকে অগ্রাহ্য
করতেন। চাইতেন স্কারলেটও তাই করুক। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি খুব একটা সফল হন নি।
তাকের ওপর রাখা ছোট কৌটো থেকে এলেন
জপ করবার মালা নিতে যেতেই ম্যামি দৃঢ়স্বরে বলল, “প্রার্থনায় বসবার আগে, মিস এলেন, সাপার করে নাও।”
“ধন্যবাদ
ম্যামি। কিন্তু আমার তো খিদে নেই।”
“আমি
নিয়ে আসছি। আর তোমাকে খেতে হবে,” ম্যামি
ভুরু কুঁচকে বেশ ঊষ্মার সঙ্গে বলল। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, “পোক, কুকিকে মাছটা গরম করতে বল। মিস
এলেন ফিরে এসেছেন।”
ম্যামির চলাফেরায় কাঠের তক্তার
মেঝেতে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ হতে লাগল। বিড়বিড় করে বকর বকর করতে লাগল। গলার স্বর একটু
চড়তেই সবাই ওর স্বগতোক্তি ভাল করেই বুঝতে পারল।
“কবে
থেকে বলে আসছি এই সব সাদা বেজন্মাদের জন্য তুমি কিছু করতে যেও না। ওঁরা এত স্বার্থপর
আর এত অকৃতজ্ঞ। কি দরকার মিস এলেনের ওদের সেবার জন্য সময় নষ্ট করার? এমন ভাব দেখায়
যেন কোন নীগ্রো দাসী ওদের সেবা করছে! আমি বলে দিয়েছি ______”
আর শোনা গেল না। ম্যামি লম্বা
প্যাসেজ পেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। নিজের
অবস্থান মালিকদের জানানোর জন্য এটাই হল ম্যামির কৌশল।
সাদা মানুষরা কালো মানুষর নিজের মনে কাউকে গালি দিলেও সেটা
না শোনার ভান করে নিজেদের বনেদিয়ানা জাহির করত।
এমন কি কালো মানুষরা যদি পাশের ঘর থেকে চেঁচিয়েও নিজের মনে কিছু বলে যায়
তাহলেও। তাই এ নিয়ে কেউ কালোমানুষদের
দোষারোপও করত না। ম্যামি তাই জেনেশুনেই এই সুযোগ নিয়ে নিজের অপছন্দের মতামতগুলো
জানিয়ে দিত।
পোর্ক ঢুকল। ওর হাতে একটা প্লেট,
রুপোর ছুরি, কাঁটা আর চামচ আর একটা ন্যাপকিন। পেছনে পেছনে ঢুকল জ্যাক, দশ বছরের
ছোট নিগ্রো শিশু। একহাতে সাদা রঙের জ্যাকেটে তাড়াতাড়ি বোতাম লাগাচ্ছে। অন্য হাতে
ওর থেকে লম্বা একটা খাগড়ার কাঠির ওপরে খবরের কাগজ লাগানো – মাছি তাড়ানোর জন্য। এলেনের ময়ূরের পালকের তৈরি খুব সুন্দর
একটা ‘ফ্লাই
ব্রাশার’ আছে।
বিশেষ কোন অনুষ্ঠান ছাড়া সেটা ব্যবহার করাই হয় না। আর সেটাও অনেক পারিবারক অশান্তি
এড়িয়ে। ম্যামি, পোর্ক আর কুকির দৃঢ়
কুসংস্কার যে ময়ূরের পালক অশুভ।
জেরাল্ডের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারে এলেন
বসলেন। অমনি চারদিক থেকে চারজন তাঁকে
আক্রমণ শুরু করল।
“মা
আমার নতুন বল-ড্রেসের লেসটা ঢিলে হয়ে গেছে। কাল ওটা পরে সন্ধ্যেবেলা টুয়েলভ ওকসে
যাব। ঠিক করে দিও না গো।”
“মা
স্কারলেটের নতুন ড্রেসটা আমারটার থেকে বেশি সুন্দর। আমাকে গোলাপী রঙে খুব বাজে লাগে।
ওকে বল না আমার গোলাপী ড্রেসটা ও পরুক যাতে ওর সবুজ ড্রেসটা আমি পরতে পারি।”
“মা,
কাল রাত্রে আমি বল নাচের জন্য জেগে থাকতে পারি তো? আমি কিন্তু এখন তেরোয় পা দিয়েছি
____”
“মিসেজ়
ও’হারা, তুমি কি বিশ্বাস করবে – এই মেয়েরা আর একটাও কথা নয় – আমি রেগে যাচ্ছি! কেড ক্যাল্ভার্ট
সকালে অ্যাটলান্টা গিয়েছিল। বলছিল
– এই তোমরা একটু চুপ করবে – আমাকে কথাটা ঠিকমত বলতে দে্বে? হ্যা
ও বলছে সবাই খুবই মর্মাহত – কারও
মুখেই যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন কথাই নেই – সামরিক অনুশীলন, সৈন্যবাহিনী গঠন এই সব আর কি।
আরও বলেছে – চার্লসটন
থেকে খবর – আর
কোন ইয়াঙ্কি অপমান কোনমতেই সহ্য করা হবে না।”
এলেন ক্লান্তভাবে হেসে প্রথমে
স্বামীর কথার জবাব দিলেন। বউদের যেটা করা উচিত।
“চার্লসটনের
বিজ্ঞ লোকেরা যদি সেরকম মনে করে, তাহলে মনে হয় কিছুদিনের মধ্যে আমাদেরও একই ভাবে ভাবতে
হবে।” এলেনের
দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, স্যাভান্না ছাড়া এই মহাদেশে আর কোথাও বনেদী মানুষ থাকে, তবে সেটা
হল এই ছোট বন্দর শহর চার্লসটনেই। এমন কি চার্লসটনের লোকেরাও এই কথা বিশ্বাস করতেন।
“না
ক্যারীন, এ বছর নয়। সামনের বছর থেকে তুমি বল ড্যান্সের জন্য জেগে থাকতে পারবে। আর বড়দের
মত ড্রেস পরতে পারবে। তখন
তোমার এই গোলাপী গালদুটো কি মিষ্টিই না দেখাবে! না মুখ গোমড়া করে না সোনা।
বারবেকিউতে নিশ্চয়ই যাবে। সাপার পর্যন্ত থাকবে। তারপর কিন্তু বাড়ি চলে আসবে। চোদ্দ
বছর না হওয়া অবধি বল নয়।”
“হ্যা
স্কারলেট তোমার গাউনটা দিও। প্রার্থনার পর ওটা ঠিক করে রাখব।”
“আর
স্যুয়েলেন, তোমার বলার ভঙ্গী আমার ভাল লাগেনি, সোনা। তোমার গোলাপী গাউনটা খুবই সুন্দর।
তোমার চেহারার সঙ্গে মানানসই, যেমন স্কারলেটেরটা ওর। তবে কাল সন্ধ্যেবেলা তুমি
আমার গারনেটের নেকলেসটা পরতে পার।”
মায়ের পেছন থেকে স্যুয়েলেন
স্কারলেটকে ভেংচে দিল। মুখে জয়ের হাসি। নেকলেসটা স্কারলেটের কালকে পরার ইচ্ছে ছিল।
ও উলটে স্যুয়েলেনকে ভেংচে দিল। স্যুয়েলেন খুবই স্বার্থপর আর প্যানপ্যানে। এলেনের
ভয় না থাকলে, ও মাঝে মাঝেই বোনের কানদুটো মুলে দিত।
“হ্যা,
মিস্টার ও’হারা
এবার বলুন মিস্টার ক্যাল্ভার্ট চার্লসটন সম্বন্ধে আর কি বলেছেন,” এলেন বললেন।
স্কারলেট ভাল করেই জানত যে মা যুদ্ধ, রাজনীতি এসব নিয়ে একদম পরোয়া করেন না। তাঁর মতে ওগুলো পুরুষদের ব্যাপার। কিন্তু জেরাল্ড এসব
ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করতে ভালবাসেন। এলেন সবসময়েই তাঁর স্বামীর আনন্দবিধানের
জন্য তৎপর।
জেরাল্ড আবার তাঁর বক্তৃতা শুরু
করতে না করতেই, ম্যামি এলেনের সামনে প্লেট সাজিয়ে রাখল। সোনালী বিস্কুট, ফ্রায়েড চিকেন ব্রেস্ট, রাঙা আলু সেদ্ধ – ওপরে মাখন গলিয়ে দেওয়া। জ্যাক আস্তে আস্তে ফ্লাই ব্রাশার
নাড়তে থাকল। ম্যামি টেবিলের কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
যেন এলেন নিজে না খেলে ও জোর করে মুখের মধ্যে খাবার পুরে
দেবে। এলেন খুব শান্তভাবে খেতে লাগলেন। স্কারলেট বুঝতে পারছিল যে শুধু ম্যামি্র মন
রাখতেই মা খাচ্ছেন। এতই ক্লান্ত আছেন যে
খাবারের কোন স্বাদই পাচ্ছেন না।
খাওয়া শেষ হল। জেরাল্ড ইয়াঙ্কিদের
গালাগালি দিয়ে চলেছেন। ওরা
দাসদের মুক্ত করে দিতে চায় কিন্তু মুক্তি কেনবার জন্য যে টাকাটা লাগবে সেটা দেবে
না! এলেন উঠলেন।
“এখন
কি আবার আমাদের প্রার্থনায় বসতে হবে?” জেরাল্ড খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“নিশ্চয়ই।
দেখুন না কত দেরি হয়ে গেছে – দশটা
বেজে গেছে!” ঘড়িতে
দশটার ঘন্টা বাজতে লাগল। “ক্যারী্নের
ঘুমিয়ে পড়া উচিত ছিল। পোর্ক,
ল্যাম্পটা দাও। আর আমার প্রেয়ার বুকটা, ম্যামি।”
ম্যামির ইশারায়, জ্যাক ফ্লাই
ব্রাশার নামিয়ে রেখে টেবিল থেকে ডিশ সরিয়ে নিল। ম্যামি দেয়ালের তাকে এলেনের জীর্ণ
প্রেয়ার বুক খুঁজতে লাগল। পোর্ক পা টিপে টিপে এসে সিলিং থেকে ল্যাম্পটা টেবিলের
কাছে নামিয়ে আনল। এলেন হাঁটু মুড়ে মেঝেয় বসলেন। সামনে টেবিলের ওপর প্রেয়ার বই।
খোলা। দু’হাত
জড়ো করে বইয়ের ওপর রাখা। ওঁর পাশে জেরাল্ডও হাঁটু মুড়ে বসলেন। স্কারলেট আর স্যুয়েলেনও
নিজের নিজের জায়গায় বসে পড়ল। ক্যারীন বয়সের তুলনায় বেঁটে।
তাই টেবিলের সামনে না বসে, চেয়ারের দিকে হাঁটু মুড়ে বসল।
প্রার্থনার সময় ও প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ত। তাই এদিকে মুখ করে থাকলে মা সেটা ধরতে পারেন
না।
দাস দাসীরা দরজার পাশে হাঁটু মুড়ে
বসল। ম্যামির নীচু হতে কষ্ট হত। ওঁর মুখ
থেকে গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে পড়ল। পোর্ক
বসল সোজা হয়ে। রোজ়া আর টীনাকে তাদের উজ্জ্বল
রঙের পোশাকে খুব মানানসই লাগছিল। কৃশকায়
কুকি ওর মাথায় দেবার সাদা কাপড়টা পেতে বসল। আর জ্যাক ঘুমে ঢুলু ঢুলু। চিমটি খাবার
ভয়ে ম্যামির থেকে প্রায় সাত হাত দূরে গিয়ে বসল।
প্রত্যেকদিন ঘুমোনোর আগে সবাই মিলে
একসাথে প্রার্থনা করতে বসা, নিগ্রো দাস দাসীরা এটাকে একটা মর্যাদা বলে মনে করত।
প্রার্থনাসঙ্গীতের ভাষা ছিল সেকেলে আর বেশীমাত্রায় অলঙ্কারসমৃদ্ধ। তাই কেউ জানে না
কতটুকু ওদের বোধগম্য হত। তবে “হে
প্রভু আমাদের করুণা কর” আর
“হে যীশু, আমাদের করুণা কর” বলার সময় তালে তালে ওদের শরীর
দুলতে থাকত।
এলেন চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা শুরু
করলেন। কন্ঠস্বর কখনো ওপরে ঊঠছে, কখনো নামছে। সুরেলা আর স্নিগ্ধ। স্বাস্থ্য আর
সুখের জন্য যখন এলেন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতেন তখন হলুদ আলোর বৃত্তের চারপাশে
সবাই ভক্তিভরে মাথা নোয়াত।
প্রথমে তিনি টারার ছাদের তলায় যারা
যারা থাকে, তাঁর বাবা, মা, বোনেরা, তাঁর তিন মৃত সন্তান এবং নরকে যন্ত্রণাপ্রাপ্ত
ভাগ্যহীনদের জন্য প্রার্থনা করে শেষ্ করতেন।
তারপর, জপমালা তাঁর সরু সরু লম্বা আঙ্গুলে জড়িয়ে নিয়ে জপ করা শুরু করতেন। বাতাসের মৃদু শব্দের মত শ্বেতকায় এবং কৃষ্ণকায়
মানুষদের কন্ঠ থেকে নিসৃত হতঃ
“হে
পবিত্র মাতা মেরী, হে ঈশ্বরের জননী, পাপীতাপী আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, আজকের জন্য
আর যেদিন আমাদের পরলোক প্রাপ্তি হবে।”
বেদনাতাড়িত অন্তর আর কেঁদে হৃদয়ভার
লাঘব করার কষ্ট সত্ত্বেও অন্য দিনের মত স্কারলেট মনে মনে এক প্রগাঢ় প্রশান্তি
অনুভব করল। সারা দিনের হতাশা আর আগামীকালের আশঙ্কা যেন কাটিয়ে উঠতে পারল। মনের মধ্যে একটা
আশার আলো জেগে উঠল। এই নয় যে ঈশ্বরের পাদপদ্মে সে তার মনপ্রাণ সমর্পণ করে দিল, কারণ
ওর কাছে ধর্ম ব্যাপারটা খুবই বাহ্যিক।
কিন্তু তাঁর প্রিয়জনদের মঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের কাছে মায়ের আন্তরিক নিবেদন
তাঁর কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে।
এলেন প্রার্থনা শেষ করলেন। জেরাল্ড
কোনদিনই প্রার্থনার সময় তাঁর জপমালা খুঁজে পান না। তিনি আঙ্গুলের কর গুনে গুনে জপ
করতে লাগলেন। স্কারলেটের চিন্তাগুলো একটু
ওলট পালট হয়ে যেতে থাকল। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না। এলেন ওকে শিখিয়েছিলেন,
দিনের শেষে একবার অন্তত মনের ভেতর উঁকি মেরে দেখতে হয় যে তার সারাদিনের কাজগুলো
সঠিক হয়েছে কি না। যদি কিছু অন্যায় করে থাকে তাহলে স্বীকার করে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করতে হয়।
ও মাথা নামিয়ে মুখটাকে দু’হাতের মধ্যে ঢেকে ফেলল, যাতে মা না
দেখতে পান। দুঃখের সাথে লক্ষ্য করল ওর মন ঘুরে ফিরে অ্যাশলের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
কি করে অ্যাশলে মেলানিকে বিয়ে করতে চলেছে যখন ও স্কারলেটকে ভালবাসে? যখন ও জানে স্কারলেট
ওকে কতখানি ভালবাসে! ও কেমন করে ইচ্ছে করে স্কারলেটকে দুঃখ দিতে পারে?
অকস্মাৎ ওর মনে একটা নতুন
সম্ভাবনার কথা মনে এল।
“অ্যাশলের
হয়ত জানাই নেই যে আমি ওকে ভালবাসি!”
এই আকস্মিকতার ধাক্কায় ও প্রায়
চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। ওর ভাবনা চিন্তাগুলো কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল,
সারা শরীর অবশ হয়ে গেল, তারপর আবার ছুটতে শুরু করল।
“কি
করেই বা জানবে? আমি তো সব সময়ই শালীন আর লেডির মত আচরণ করেছি। সব সময়ই ভান করেছি যে
আমরা শুধুই ভাল বন্ধু, তার বেশি নয়। আর এইজন্যই ও মুখ ফুটে কিছু বলে নি। ভেবেই
নিয়েছে ওর কোন আশা নেই। আর তাই ওকে অত বিধ্বস্ত _____”
ওর মন পেছন দিকে ফিরে চলল। মনে পড়ল
সেই সময় ওর ধূসর চোখে অদ্ভুত ভাবে স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেই দৃষ্টি যেটা
ওর চিন্তাকে আড়াল করে রাখত। অথচ
তখন ওর চোখে মনের ভাব সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল। মনে হয়েছিল কি একটা যন্ত্রণা, কি
একটা হতাশা ওর মধ্যে কাজ করছে।
“ও
হয়ত ভেবেছিল আমি ব্রেন্ট কিংবা স্টুয়ার্টকে ভালবাসি। কিংবা কেডকে। এটা ভেবেই হয়ত ওর
মন ভেঙে গেছে। আর তাই হয়ত ভাবছে যদি আমাকে না পায় তাহলে বাড়ির লোকের ইচ্ছে মেনে নিয়ে
মেলানিকে বিয়ে করাই ভাল। ইশ, যদি জানত যে আমি ওকেই ভালোবাসি _______”
স্কারলেটের দোদুল্যমান হৃদয় হঠাৎ
হতাশার অতল গহ্বর থেকে উচ্ছ্বাসের চরম শিখরে পৌঁছে গেল। এটাই অ্যাশলের চুপচাপ হয়ে
যাবার কারণ। অদ্ভুত আচরণের কারণ। বেচারা জানেই না!
স্কারলেটের অহমিকা তাকে এটাকেই সত্যি বলে মেনে নিতে সাহায্য করল। অনিবার্য
সত্য। “যদি ও একবার জানতে পারে আমি ওকে ভালবাসি, তাহলে ওর
দ্বিধা কেটে যাবে। আমাকে শুধু _____”
“হায়
কপাল,” গালে
হাত দিয়ে ভাবল স্কারলেট। “কি
বোকা আমি! এই সামান্য কথাটা বুঝতে আমার এত দিন লাগল? নাঃ ওকে জানানোর কোন না কোন উপায়
আমাকে বের করতেই হবে। আমি যে ওকে ভালবাসি না
জানলে কিছুতেই আমাকে বিয়ে করবে না। কেনই বা করবে?”
হঠাৎ খেয়াল হল যে জেরাল্ডের জপ শেষ
হয়ে গেছে। এলেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ও তাড়াতাড়ি জপ করা শুরু করল। এতটা আবেগের সঙ্গে যে ম্যামি চোখ খুলে অনুসন্ধানী
দৃষ্টিতে ওকে দেখতে লাগল। ওর শেষ হলে, প্রথমে স্যুয়েলেন আর তারপরে ক্যারীন শুরু
করল। ওর মন কিন্তু তখনও সেই মনমুগ্ধকর নতুন ভাবনার পেছনে ধাওয়া করে চলেছে।
এখনও দেরি হয়ে যায় নি। গোপনে
পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই কাউন্টিতে বিরল নয়। দেখা গেছে যুগলের কোন একজন এক তৃতীয়
ব্যাক্তির সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছে। অ্যাশলের বাগদান তো এখনও হয়ই নি। হ্যা মোটেও
দেরি হয় নি।
অ্যাশলে আর মেলানির মধ্যে যদি
প্রেম নাই থাকে – হয়ত
বহুদিন আগের কোন প্রতিশ্রুতি রয়েছে – তাহলে
সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙার বাধা কোথায়? যদি ও জানে যে স্কারলেট ওকে ভালবাসে, তাহলে ও নিশ্চয়ই
সেটাই করবে। তবে ওকে জানাতে হবে। কোন একটা উপায় বের করতেই হবে। আর তারপর ______
আহ্লাদের সপ্রম স্বর্গ থেকে
স্কারলেটকে আচমকাই নেমে আসতে হল। মা কিছু বলছিলেন যেটা ও শুনতে পায় নি, তাই মা ওর
দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আবার আচার শুরু করে একবার চোখ মেলে চারদিকের
পরিস্থিতির ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। হাঁটু মুড়ে বসা মানুষেরা, ল্যাম্পের হালকা আভা,
যেদিকে নিগ্রোরা বসে আছে সেদিকের আলোআঁধারি, ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র, যেগুলো একটু
আগেও অসহ্য মনে হচ্ছিল, এখন নিজের আবেগের রঙে আবার ভাল লাগতে শুরু করল। এই মুহুর্তটাকে সে কখনও ভুলতে পারবে না।
“পরম
বিশ্বাসী কুমারী মাতা,” মা
সুর করে বললেন। এখন কুমারী স্তোত্র শুরু হচ্ছে।
স্কারলেট গলা মেলাল। “আমাদের
জন্য প্রার্থনা কর,” এলেনের
সুরেলা গলায় মৃদুস্বরে মাতৃপ্রশস্তি পাঠ হতে থাকল।
সেই শৈশব থেকেই স্কারলেট এই সময়ে
কুমারী মা মেরীর চেয়ে মা’কেই
বেশি ভক্তি করতে চাইত। হয়ত গহৃত, তবুও এই সময় চোখ বন্ধ করলে ওর মনে মা’র স্নিগ্ধ মুখটাই ভেসে ওঠে; মা মেরীর
নয়। স্তোত্রের প্রাচীন শব্দবন্ধ, যেমন, “পীড়িতদের নিরাময়কারী”,
“জ্ঞানের সাগর”, “পাতকীর
আশ্রয়”,
“নিগুঢ় গোলাপ” এগুলো ভাল লাগে যেহেতু এর প্রত্যেকটা কথাই এলেনের সম্বন্ধেও
প্রযোজ্য। এই কথাগুলোই, আজ সন্ধ্যাবেলা, ওর অনুরক্ত হৃদয়ে নতুন এক অর্থ বহন করে
এল। নতুন রাস্তা দেখানোর জন্য, খুব ভক্তিভরে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল। মিনতি
করল দুর্বিপাকের অবসান ঘটিয়ে ঈশ্বর যেন ওকে সরাসরি অ্যাশলের বাহুবন্ধনে পৌঁছে দেন।
শেষবারের মত ‘আমেন’ বলে
সবাই যখন উঠে দাঁড়াল, তখন সকলেরই শরীরই বেশ আড়ষ্ট।
ম্যামিকে তো টীনা আর রোজ়া ধরাধরি করে তুলল। তাক থেকে একটা লম্বা সলতে নিয়ে পোর্ক ল্যাম্পের আগুন
থেকে সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে হলের দিকে এগোল। ঘোরানো সিঁড়ির উল্টোদিকে ওয়ালনাট কাঠের
তৈরি বিশাল আলমারিতে অনেক ল্যাম্প আর মোমবাতি রাখা আছে। আলমারিটা খাবার ঘরের পক্ষে
বেশ বড়। পোর্ক একটা ল্যাম্প আর তিনটে মোমবাতি
জ্বালাল। তারপর জাঁকজমকপূর্ণ গাম্ভীর্যের সাথে ল্যাম্পটাকে দু’হাতে মাথার ওপরে ধরে রাজকীয় গৃহাধ্যক্ষের
মত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলল। জেরাল্ড, তাঁর হাত ধরে এলেনও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। ওঁদের তিন কন্যা, নিজের নিজের মোমবাতি হাতে নিয়ে,
ওঁদের পেছন পেছন চলল।
স্কারলেট নিজের ঘরে ঢুকে মোমবাতিটা
একটা উঁচু জায়গায় রাখল। তারপর আবছা অন্ধকারে ড্রয়ার খুলে নাচের পোশাকটা খুঁজে বের
করল। মা সেলাই করে দেবেন। সেটা কাঁধের ওপর ফেলে বাবা-মার ঘরের দিকে এগোল। দরজাটা
একটু ফাঁক হয় রয়েছে। স্কারলেট শুনতে পেল মা বলছেন –
“মিস্টার
ও’হারা জোনাস উইল্কারসনকে বরখাস্ত
করতে হবে।”
জেরাল্ডের ক্রুদ্ধ গলা পাওয়া গেল। “এখন আমি কোথা থেকে আর একটা ওভারসীয়ার
জোগাড় করব, যে আমাকে ঠকাবে না?”
“ওকে
বরখাস্ত করতেই হবে। কাল সকালেই। বড় স্যাম ভাল ফোরম্যান। যতক্ষণ নতুন কাউকে না পাচ্ছেন,
ও-ই কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।”
“আচ্ছা,” জেরাল্ডের গলা আবার শোনা গেল। তার
মানে সুযোগ্য জোনাসই হল _____”
“ওকে
বিদায় করতেই হবে।”
“তার
মানে ওই হল এমি স্ল্যাটারির বাচ্চার বাপ,” স্কারলেট ভাবল। “ঠিকই
আছে। একজন ইয়াঙ্কির কাছ থেকে এর থেকে ভাল কিছু আশাই করা যায় না। একটা ইয়াঙ্কি আর একটা
আস্তাকুঁড়ের জঞ্জাল সাদাচামড়ার মেয়ে!
জেরাল্ড চুপচাপ হয়ে যাওয়ার পর
আস্তে করে দরজায় টো্কা দিল। মায়ের হাতে ড্রেসটা দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল।
মোমবাতি নিভিয়ে, পোশাক পালটে যখন
স্কারলেট শুয়ে পড়ল, ততক্ষণে ওর পুরো পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেছে। সমস্ত খুঁটিনাটি সহ।
খুব সহজ পরিকল্পনা। ও
জেরাল্ডের মেয়ে। একমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে এগোতে পছন্দ করে। লক্ষ্য স্থির হয়ে গেছে। আর
সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সিধে রাস্তাটাই বেছে নেওয়া ভাল।
যেমন জেরাল্ড বলছিলেন, প্রথমত ওকে
অহঙ্কার নিয়ে এগোতে হবে। টুয়েলভ ওকসে পৌঁছানোর পর থেকে ওকে খুব হাসিখুশি দেখাতে
হবে। যাতে অ্যাশলে আর মেলানিকে কেন্দ্র
করে ওর আজকের মনঃকষ্টের আভাস কেউ না পায়। বিবাহযোগ্য বয়সের সব ছেলের সাথে ও
ফ্লার্ট করবে। এমন কি স্যুয়েলেনের প্রেমিক কাঁচা পাকা জুলপি ফ্র্যাঙ্ক কেনেডির
সাথেও। মেলানি লাজুক ভাই চার্লস হ্যামিলটনের সাথেও। মৌমাছির মত ওকে সবাই ঘিরে থাকবে। অ্যাশলেও
মেলানিকে ছেড়ে ওর উপাসকমণ্ডলিতে এসে যোগ দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারবে না। তারপর
কায়দা করে ওকে ভীড় থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একলা পেতে হবে। মনে হয় সব ঠিকঠাক চলবে।
অবশ্য যদি অ্যাশলে প্রথম পদক্ষেপটা না নেয়, তাহলে ওকেই সেটা নিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত ওরা যখন একলা হতে
পারবে, আর ওর চোখে ভাসবে যে ছেলেরা স্কারলেটকে কি ভাবে ঘিরে রেখেছিল। হয়ত ওর মনে
কষ্ট হবে যে সবাই স্কারলেটকে চায়। কিন্তু ও অ্যাশলেকে বুঝিয়ে দেবে, সবাই চাইলেও,
স্কারলেট শুধু অ্যাশলেকেই ভালবাসে, অন্য কাউকে নয়। আর যখন ও এই কথাটা খুব মিষ্টি করে আর নম্রভাবে
বলবে তখন অ্যাশলের কত খুশি হবে! অবশ্য যা কিছু বলার লেডির মতই বলবে। এই নয় যে ও বেহায়ার মত ভালবাসার কথা বলে দেবে।
তবে ঠিক কিভাবে বলবে সেটা নিয়ে এখুনি মাথা না ঘামালেও চলবে। এরকম পরিস্থিতি আগেও
সামলাতে হয়েছে। এবারও সামলাবে।
জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্কারলেট মনের চোখ দিয়ে পুরো ঘটনাটা দেখে নিল। কল্পনার চোখে
দেখল –
ওর ভালবাসার কথা জানতে পেরে অ্যাশলের চোখে যুগপৎ বিস্ময় আর আনন্দ। তারপর অ্যাশলে স্কারলেটকে ওর স্ত্রী হবার
প্রস্তাব কিভাবে দেবে সেটাও দেখতে পেল।
খুব স্বাভাবিকভাবেই স্কারলেট বলবে
যে অন্য মেয়ের বাকদত্তকে সে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু অ্যাশলে যখন জোরাজুরি করবে
তখন শেষমেশ স্কারলেট ওকে রাজী করানোর সুযোগ দেবে। তারপর ওঁরা জোন্সবোরোতে সেদিন
বিকেলেই পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে
_______
কাল রাত্রে এই সময় সে হয়ত মিসেজ়
অ্যাশলে উইল্কস হয়ে গেছে!
উত্তেজনায় ও বিছানায় উঠে বসল।
অনেকক্ষণ হাঁটুতে মাথা রেখে নিজেকে মিসেজ় অ্যাশলে উইল্কস – অ্যাশলের বউ – কল্পনা করে খুশিয়াল হয়ে উঠল। তারপর হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই সারা শরীরে একটা
ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল। ধর যদি প্ল্যানটা কাজ না করে? ধর যদি অ্যাশলে ওর সঙ্গে
পালিয়ে যেতে রাজী না হয়? চিন্তাটাকে জোর করে মাথা থেকে বের করে দিল।
“এটা
আমি ভাবতে চাই না,” দৃঢ়ভাবে
বলল। “এটা
ভাবলে আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ব। আমি যেরকম চাইছি সেরকম না হওয়ার কোন কারণ নেই – যদি ও আমাকে ভালবাসে! ও আমাকে
ভালবাসে। আমি ভাল মতই জানি।”
ও মাথা তুলল। চাঁদের আলো ওর চোখের কালো পরিলেখে ঝিলিক মারল। এলেন ওকে কখনও বলেন নি যে জীবনে চাওয়া আর পাওয়া
দুটো একেবারেই আলাদা ব্যাপার। ও এখনও বুঝতে পারেনি যে জীবনের অগ্রগতিতে গতির চেয়ে
স্থৈর্যের প্রয়োজন বেশি। রুপোলী
ছায়ায় বিছানায় শুয়ে ধীরে ধীরে ওর মনে সাহস সঞ্চয় হতে থাকল। সুখী জীবনযাপনে অভ্যস্ত
এক ষোল বছরের মেয়ের মন নিয়ে –
যার কাছে হেরে যাওয়া এক অসম্ভব পরিণতি – যে বিশ্বাস করে শুধু চটকদার পোশাক আর শুভ্র ত্বকের জোরে সব কিছু জয় করা যায় – মনে মনে নানা রকম কল্পনার জাল
বুনতে লাগল।
(ক্রমশ)
0 মন্তব্যসমূহ