আফসানা বেগম'এর গল্প : অনন্ত সান্নিধ্য

দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ ছিল না আমার। প্রথম বিয়ের স্মৃতি দগদগে ঘা কিংবা শিরশিরে উত্তেজনার মতো আমার মনে বসে ছিল। কোনোভাবে অন্য কিছু তার উপরে ছাপ ফেলবে বলে ভাবতেই পারছিলাম না। অথচ পরে দেখা গেল অদ্ভুতরকমের সুখী হলাম আমি।
যারা ধরেবেঁধে আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছিল তারা আমার সুখ দেখে যেমন হিংসে করল তেমনি শার্টের কলার নেড়ে বলতেও ছাড়ল না, ‘দেখলে তো, বলেছিলাম না?’ তারপর আবার তারাই খানিক হেসে নিয়ে মনের কথাটাও বলল; বলল, ‘তোমার ভালোর জন্যই বলেছিলাম-- কিন্তু তাই বলে এতটা ভালো অবশ্য আশা করিনি!’ তবে সে যাই হোক, সেই সুখও উদ্যাপন করার মতো স্মৃতি হয়ে গেল একসময়।

থেমে থেমে বাতাস বয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় দু’জন অফিস কলিগ এসেছে আজ। তাদের কথার মাঝখানে অন্যমনস্ক হয়ে আমার বিয়ে সংক্রান্ত এইসমস্ত কথা ভেবে নিলাম। তারা এসেছে আমাকে অনুরোধ করতে। এমনটা তারা প্রায়ই করে। অফিসে কাজের ফাঁকে কফি হাতে কিংবা লাঞ্চে। আমার একাকিত্ব তাদের ভাবায়। দু’চারদিন বাদে বাদে আড্ডার নামে সন্ধ্যায় আমার বাড়ির বর্গক্ষেত্র আকারের বিশাল বারান্দায় এসে বসে। দু-এক পেগ ড্রিংক খেতে খেতে আজও তারা সেই একই প্রসঙ্গে ফিরে গেল, ‘তোমার বিয়েটা যে টিকছে না, অনিকেত! আরেকবার ভাববে এ নিয়ে? এভাবে তো জীবন চলে না। যা হয়েছে হয়েছে, আরেকবার করেই ফেলো বরং...’ প্রায় অন্ধকারে আমি তখন হাতের আকৃতির তামার মোমদানির পাঁচ আঙুলে বসানো পাঁচটা জলন্ত মোমবাতির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মোমবাতির নিবুনিবু আলোয় ওই বারান্দায় বসে তখন আমার কেবলই মেখলার কথা মনে হতে থাকল। কলিগরাও যেন কেমন করে আমার মনের ভিতরে ঝুঁকে ভাবনাটা জেনে গেল; বলল, ‘মেখলা ভাবির স্মৃতি নিয়ে তুমি আর কতদিন পার করবে? এভাবে তো চলে না।’ 

মেখলা ছিল আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার মতো কাটা কাটা সুন্দরী কমই দেখা যায়। যেখানে যতটুকু দরকার সেখানে যেন ঠিক ততটুকু কেটে বসানো। আমি বলতাম, ‘মেখলা, বিধাতা তোমাকে কোরবানি ঈদের লম্বা ছুটিতে সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বানিয়েছে।’ মেখলা হাসত, বলত, ‘আর তোমাকে?’ ‘আমাকে বানিয়েছে ওভারটাইমে, বুঝলে? বাড়ি ফেরার তাড়ার মধ্যে’, আমি উত্তর দিলে আমরা দুজনে একসঙ্গে হেসে উঠতাম। তবে মেখলা কেবল বাইরের দিক দিয়ে সুন্দরী ছিল, তা নয়। তাকে বলা যেত সত্যিকারের সুন্দর, কারণ, তার ভিতরে ছিল অসামান্য সুন্দর এক মন। মুহূর্তে সে যে কাউকে আপন করে নিতে পারত, যে কারো মন জয় করে ফেলত। আমার মনও বলতে গেলে প্রথম দেখাতেই সে জয় করেছিল। এ বাড়ির তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের ওঠার মাসখানেক পরের কথা। অফিসে যাবার জন্য দরজা খুলে আমি বেরোতেই লিফটের দরজা দু’ধারে সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। উঁচু করে বাঁধা চুলের ঝুঁটি নাচিয়ে আমার হাতে একটা খাম চালান করে দিয়েছিল। বেগুনি ট্র্যাক স্যুটের রঙের ছটায় তার কপাল আর নাকের উপরের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলোকেও বেগুনি মনে হচ্ছিল। লিফটের দিকে আবারো এগিয়ে যেতে গিয়ে বলেছিল, ‘অফিসে যাচ্ছেন বুঝি? আপনার মেইল, আমাদেরও কিছু ছিল তো, এক সঙ্গে হাতে করে নিয়ে এসেছি। ভাবলাম পৌঁছে দিতে এসে পরিচয়টা হয়ে যাক-- আমি মেখলা, পাঁচতলায় থাকি।’ আমি বলেছিলাম, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। আমি অনিকেত। আপনি বাড়িতে আসুন না, আমার ওয়াইফের সঙ্গে কথা বলতে পারেন...’ সে হেসে লিফটের দিকে এগিয়েছিল। দু’পাশের দরজা বন্ধ হতে হতে খানিকটা গলা চড়িয়ে বলেছিল, ‘ইয়োগা ক্লাস থেকে ফিরলাম, পরে আসব কখনো... বাই।’ তার সরু হাত বিদায়ের জন্য উঠতে না উঠতেই দরজাদুটো সরল রেখায় মিলে গিয়েছিল। পাঁচতলায় যে বাড়িওলা থাকেন তা আমার জানা ছিল। ইচ্ছে করলে মেখলা বলতে পারত যে সে বাড়িওলার মেয়ে। বলেনি। প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম সে কত নিরহঙ্কার। তবে নিজ থেকে আমাদের বাসায় আসা দেখে আমি ধরে নিয়েছিলাম সে হয়ত প্রায়ই আসবে; এমনটা ভেবে আমার খানিক ভালোই লেগেছিল। তখনকার দিনগুলোতে বাড়িতে থাকার বেশিরভাগ সময়ে আমি যা করতাম তা হলো মন খারাপ করে বসে থাকা। তাই মনে হয়েছিল আমার আর জেনির স্থবির হয়ে আসা সংসারে প্রজাপতির মতো চঞ্চল মেয়েটি মাঝেমধ্যে এসে পড়লে মন্দ হয় না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। পরের বছরখানেকের মধ্যে জেনির ভয়ানক অসুস্থতার খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত মেখলা আর কখনই আসেনি।

আমরা যখন ওই বাড়িতে এসে উঠেছিলাম, জেনি তখনো হাঁটতে পারত। কয়েক পা নিজে নিজে আর বেশিরভাগ একজন নার্সের সাহায্য নিয়ে বাড়িময় হেঁটে বেড়াত সে। তার ধারণা ছিল সে যত বেশি হাঁটবে তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো অচল না হয়ে তত সচলতার দিকে ফেরত আসবে। সে যা বুঝত সেটাই করত। নিস্তব্ধতা কেটে কেটে বাড়িময় ধীর লয়ে ভেলভেটের স্যান্ডেলের থপ থপ শব্দ বাজতে থাকত। নার্স তাকে মনে করিয়ে দিত যে অনেক হয়েছে, এবারে তার বিশ্রামের দরকার। জেনি প্রায়ই নার্সকে এ কারণে জোরে ধমকে দিত। তবে মাস দুয়েকের মধ্যে এমন হয়েছিল যে ধমকানোর মতো গলার স্বরও জেনির আর অবশিষ্ট ছিল না। শার্টের বোতাম ঘর বরাবর খামচে ধরে সে আমাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় জানতে চাইত, ‘আমি ঠিকমতো কথা বলতে পারছি না কেন? কেন, হুম? ডাক্তারকে ফোন করো দেখি এক্ষুণই।’ আমি ফোন করতাম। তার ইচ্ছেমতো সামনে বসেই ফোনের স্পিকার চালু করে ডাক্তারের কথা শুনিয়ে দিতাম। ডাক্তারও রাখঢাক না করে সোজাসুজি বলতেন, ‘যেমনটা বলেছি, ধীরে ধীরে অর্গ্যানগুলো অকেজো হয়ে আসবে। তবে কোনটার পরে কোনটা বা কোনটা কখন-- সেটা বলা যাচ্ছে না। অর্গ্যান তো আর নিজের ক্ষমতায় চলে না, চলে মাথার ভিতরের নিউরনের মাধ্যমে। কিন্তু সেই নিউরনেই যদি সমস্যা হয় তবে আর কী করার থাকতে পারে। নিউরন একে একে একেকটা অর্গ্যানকে আদেশ নির্দেশ দেয়া থামিয়ে দিচ্ছে, ব্যাস। তবে ওষুধগুলো চলুক। সপ্তাহখানেক পরে দেখব একবার। ’ ডাক্তারের কাছে একটা কেস স্টাডি হিসেবে বিষয়টা সবচেয়ে কম কথায়, সবচেয়ে বোধগম্য করে বলে ফেলা খুব সহজ। কারণ ডাক্তার একজন রোগিকে দেখেন কেবল একটি অসুস্থ শরীর হিসেবে। শরীরটার সুবিধা-অসুবিধা বোঝেন আর ভালোমন্দ বাতলে দেন। ডাক্তার ভাবেন না বা ভাবতে চান না যে সেই অসুস্থ শরীরে একটা মন আছে, শরীরটার আবার কিছু প্রিয়জনও আছে। তাই তিনি জানেননি যে ওদিকের কথা এদিকে ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনের চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ত। ডাক্তারের তা জেনেও কোনো লাভ হতো না। আবহাওয়ার খবর পাঠকের মতো শরীরের ওঠানামার বিবৃতি দিয়ে ডাক্তার জানতে চাইতেন, ‘আর কিছু বলবেন?’ কান্নাভেজা গলায় তখন কথা আটকাত আমার। উত্তর দেয়া সহজ হতো না। ঢোক গেলার অবসরে ডাক্তার অধৈর্য হয়ে আরেকবার জানতে চাইতেন, ‘হ্যালো... শোনা যাচ্ছে? আর কিছু বলবেন কি?’ আমি কোনোরকমে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ফোন রাখতেই জেনির পাশ থেকে নার্স মিনমিন করে বলত, ‘স্যারের সামনে নিশ্চয় অনেক রোগী। এই সময় ফোন ধরছেন, এইটাই বেশি।’ কথা শুনে তার দিকে তাকাতাম আমি। প্রায় সব কথাতেই জেনির ধমক খাওয়া তরুণী মেয়েটির চোখে মুখে দেখতাম জোর করে আনা সামান্য হাসির মতো কিছু যেন অথচ চোখে টলটলে জল।

আমাদের আগের বাসাটা ছেড়ে আসার আগেই আমি জেনির অবস্থাটা বুঝতাম। ডাক্তার বুঝিয়ে বলেছিলেন। আমাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায় জেনি প্রথম বলা নেই কওয়া নেই হুট করে মেঝেতে পড়ে যায়। তারপর বেশ কয়েকবার একই ঘটনা ঘটে। সে কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে চাচ্ছিল না। কখনো বলছিল হয়ত মাথা ঘুরেছে, কখনো পা পিছলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোর করে ডাক্তারের কাছে নিতে জানা গেল নিউরনের সমস্যা। তখন থেকেই থেরাপি চলছিল, ওষুধ চলছিল। জেনির শরীরটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অচল হয়ে আসবে, এটা মেনে নেয়া আমার জন্য কঠিন ছিল। তবে আমি আশা ছাড়িনি। ডাক্তারের কথামতো সব করে গেছি। আগের বাসাটা যেদিন আমরা ছেড়ে আসি, কেন যেন মনে হচ্ছিল আমাদের সমস্ত দুর্ভাগ্য আমরা ওখানেই ফেলে চলে এলাম; নতুন বাড়িতে আমাদের জীবন নতুন করে শুরু হবে। কিন্তু কদিনেই বুঝতে পারলাম, তা হয় না। মানুষ যেখানে যায় ভাগ্য তার পিছনে ধাওয়া করে। তবে নতুন বাড়িতে এসে জেনির মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখেছিলাম। আগের বাসায় রাস্তার ধারে এমন লম্বা-চওড়া বারান্দা ছিল না। ছাদবিহীন বারান্দার উপরে ছাতার মতো ছেয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছ। জেনি সেই বারান্দাটা মুছিয়ে নিয়ে সাদা মোজাইকের মেঝেতে বসে থাকত। কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে বলত, ‘দেখ, পাতার ফাঁকে ফাঁকে নানান আকৃতির আকাশ দেখা যায়, সবুজ আর নীলে দারুণ কন্ট্রাস্ট হয় কিন্তু!’ জেনিকে তখন খুব খুশি দেখাত। আমি বলতাম, ‘কদিন পরে ফুল এলে সবুজ-লালে-নীলে কন্ট্রাস্ট আরো সুন্দর দেখাবে।’ অসুখের প্রথম থেকেই তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। আকাশ দেখতে দেখতে সময় কাটানো ছাড়া জেনির তখন আর উপায়ইবা কী ছিল। অফিস থেকে ফিরে আমিও তার সঙ্গে বারান্দায় বসতাম। তার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, মিরাক্যাল কিছু একটা কি হয়ে যেতে পারে না? হতে পারে না এমন কিছু যে একদিন আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম আর ডাক্তার জেনিকে দেখে বলে দিলেন, সে কী! এ তো দেখি উলটোদিকে যাচ্ছে, হাত-পাগুলো একদম ঠিক হয়ে আসছে! তেমন একটা দিনের আশায় আমি দিন গুনতাম। একেক সময় মনে হতো, উলটোদিকে যাওয়ার দরকার নেই, আমার জেনির যতটুকু ক্ষতি হয়েছে ততটুকুতেই থামুক, যা আছে তাই নিয়েই বেঁচে থাক সে, নতুন আর কোনো অঙ্গ নষ্ট না হোক। কিন্তু আমার ভাবনার মতো তেমন কিছু হয়নি। জেনি একসময় লাঠি ধরে হাঁটতে গিয়েও পড়ে গেছে। ডাক্তার তখন হুইল চেয়ার কিনে আনতে বলেছিলেন। আমি কিনতে চাইনি। অন্তত দুটো হুইল চেয়ার কেনার মতো টাকা যে কোনা সময় আমার পকেটে থাকে। তবু দিনের পর দিন নানান ছুঁতোয় হুইল চেয়ার না কিনে আমি অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছি। একদিন বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে জেনির হাঁটু ছিলে গেলে ভাবতে বসলাম যে আমি কতটা সার্থপর। চলাচল বন্ধ হয়ে একটা মানুষ বিছানায় আটক হয়ে পড়ছে আর আমি কেবল তাকে হুইল চেয়ারে বসা দেখতে চাই না বলে কিনে আনছি না। সেই রাতেই আগারগাঁওয়ে গিয়ে পঙ্গু হাসপাতালের সামনে থেকে হুইল চেয়ার কিনে আনলাম। জেনি যেন খুশিই হলো। এক হাত দিয়ে কোনোরকমে চাকা ঘুরিয়ে সে মনের খুশিতে এ ঘর ও ঘর ঘুরতে লাগল। তবে সে খুব অল্প দিন। তারপরই হুইল চেয়ার ঠেলতে তার নার্স লাগল, কারণ, দুটো হাতই পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেল। 

জেনির সামনে তারই জন্য বসে বসে কাঁদব, এত নরম মনের বোকা মানুষ আমি নই। আমি কাঁদতাম আড়ালে। জেনির সামনে ভাব দেখাতাম হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া সাধারণ সর্দি-জ্বরের চেয়ে জটিল কিছু নয়-- এই ভালো হয়ে এল বলে। তারপর বারান্দায় বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়া গাছের সরু সরু পাতা নড়াচড়ার ঝিরিঝিরি আওয়াজের মধ্যে আমার কান্নার শব্দ লুকিয়ে ফেলতাম। কখনোবা রেলগাড়ির শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে বলার মতো করে বাতাসের আসা-যাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে কথা বলতাম-- যেন কোনো অসীম শক্তির কাছে মিনতি জানাতাম, বলতাম, একটা মানুষ টুপ করে মরে যাওয়াটা দুর্ঘটনা, কাছের লোকদের বড়ো আঘাত লাগার কথা। কিন্তু একটা মানুষকে দিনের পর দিন চোখের সামনে একটু একটু করে মরতে দেখা কি তার চেয়ে আনন্দের? সেই অসীম শক্তি কোনো জবাব দিত না। আমি মরিয়া হয়ে আবারো প্রশ্ন করতাম, আমি এখন কী করে জেনির চোখের সামনে তারই মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হব?

জন্মের আগে বাবা আর খুব ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ার কারণে আমাকে মানুষ হতে হয়েছিল দুঃসম্পর্কের এক চাচার কাছে। কালেভদ্রে তার সঙ্গে যোগাযোগ হতো। কথা হলেই তিনি জানতে চাইতেন, বউমা কেমন আছে? একদিন জেনির অসুস্থতার বর্ণনা শুনে সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে ছুটে এলেন। শেষবয়সে তিনি গ্রামে গিয়ে থাকা শুরু করেছেন। যেখানেই থাকুন, খবর শুনে অবশ্য আসারই কথা, আমাদের জন্য তার খুব টান। তিনি আজীবন অবিবাহিত আর সেই হিসেবে আমি আর চাচা বরাবর আমাদের নিজেদের একাকিত্ব ভাগাভাগি করেছি। এই করতে করতেই তিনি আমাকে নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। বাড়িতে ঢোকার মুখে আমি বলছিলাম,‘এই বয়সে এতদূর থেকে কষ্ট করে কেনইবা এলেন! সম্ভব হলে জেনিকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতাম। কিন্তু...’ আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তুই সর তো, বউমাকে আগে দেখতে দে।’ জেনির পাশে তিনি চুপচাপ বসে থাকলেন। কেন তাড়াহুড়ো করে এসেছেন আর কী দেখলেন, বোঝা গেল না। অনেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আমার পাশে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অদ্ভুত একটা কথা বললেন তিনি তখন। কণ্ঠস্বর যতটুকু সম্ভব নামিয়ে বললেন, ‘অনিকেত, বাবা, মনে হয় তোর মাকে দেখছি।’

‘মানে?’

‘তুই জানিস না, তোকে কখনো সেভাবে বলা হয়নি।’

‘কী বলা হয়নি?’

’তোকে শুধু বলেছি তোর মা অসুখ হয়ে মারা গেছে। তোর বয়স তখন তিন যখন তিনি মারা গেলেন। তার আগের বছর দুয়েক তিনি একেবারে এরকম হয়ে পড়ে ছিলেন।’

‘বলেন কী!’ 

‘হুম, তোর জন্মের কিছু পর থেকেই তার শরীরটা ধীরে ধীরে অবশ হওয়া শুরু হয়েছিল। তিনি মারা গেলে আমি তোকে নিয়ে চলে এলাম। আর কেউ ছিল না দেখে তোকে আমার কাছেই রাখলাম।’

‘মায়ের ঠিক এরকমই হয়েছিল?’

‘ঠিক এরকম। একটা একটা করে সব অঙ্গ অবশ হয়ে গেছিল। দেখলাম বউমার মুখটাও কেন যেন ভাবির মতোই লাগছে, সামান্য বাঁকা হয়ে গেছে, মনে হয় কষ্টে। শেষের দিকে ভাবিরও ঠিক এরকম হয়েছিল।’’

চাচা জেনির পাশে বসে দুদিন ধরে দোয়াদরুদ পড়লেন। তারপর বললেন আর থাকবেন না। তার নাকি বোঝা হয়ে গেছে। বললেন কোনো লাভ নেই চিকিৎসায়, বড়োজোর আর কয়েকমাস জেনি আছে। এই অসুখের প্রতিটা দিন, প্রতিটা ধাপই নাকি তার মুখস্ত, আগেই দেখা। চাচাকে আটকানো গেল না। তবে তিনি যাবার সময়ে তার বউমাকে খানিক আত্মবিশ্বাসের টোটকা দিয়ে গেলেন। নিরুপায় হয়ে গেলে কে না ঠকায়! আর তিনি যেতেই জেনি এক সুযোগে নিজে নিজে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেল। কপাল কেটে রক্ত বেরোনোতে নার্স চেঁচামেচি শুরু করল। আমি ছিলাম না বলে দারোয়ান পাঁচ তলা থেকে বাড়িওলার মেয়ে মেখলাকে ডেকে আনল। অফিস থেকে ফিরে দেখলাম ব্যান্ডেজ করা কপাল নিয়ে মেখলার কোলে মাথা রেখে জেনি শুয়ে আছে। দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে মেখলার সঙ্গে জেনির পরিচয়, তাই সম্পর্ক খুব সহজ হলো। আমাকে দেখেই মেখলার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল, ‘ওনাকে এভাবে এক মুহূর্তও একা রাখা যাবে না! আপনি বরং আরেকজন নার্স রেখে দিন, মানে, একজন কোনো কারণে সরে গেলে আরেকজন... না-হলে কিন্তু আমিই এখানে বসে থাকব।’

মেখলার কথামতো আরেকজন নার্স রাখা হলো। তারপরেও মেখলা দিনে কয়েকবার ঢু মারতে ভুলত না। জেনির মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিত। জেনির কথা বলা প্রায় বন্ধই হয়ে যাচ্ছিল। আগের দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে ছাড়াছাড়াভাবে বলতে পারত। দেখতাম আলঝেইমারের রোগীর মতো খানিক মনে আছে খানিক নেই। মাঝে মাঝে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, দেখলে মনে হতো চিনতে পারছে না কিংবা চিনতে সময় লাগছে। তবে এতকিছুর মধ্যেও একদিন ঠিকই খেয়াল করেছিল যে আমি মেখলার সঙ্গে বেরিয়ে গেছি। ফেরার পরে জানতে চেয়েছিল, ‘কোথায় গেছিলে?’

‘বাগানে। ছাদের উপরে ওদের বাগান। মেখলা দেখতে ডেকেছিল।’

‘কী দেখলে?’

‘সুন্দর। ঘাসবিছানো মাঠের মতো। কিছু ফুলগাছ আর লতা-পাতা আর কী। বাড়িওলা আর তার মেয়ে মেখলা। ওনাদের সঙ্গে গল্প করে এলাম।’

‘ভালো লাগল?’

‘তা লাগল’, বলতেই জেনিকে দেখেছিলাম একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলতে; হতাশা নাকি প্রশান্তি বুঝতে পারিনি। তবে তারপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় জেনি আমাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকত। কানটা তার মুখের কাছে নিলে বলত, ‘উপরে যাও না, খানিক আড্ডা দিয়ে এলে ভালো লাগবে।’ 

ধীরে ধীরে এমন হলো যে সন্ধ্যার পর বাড়িতে আমাকে দেখলে জেনি যেন সহ্যই করতে পারত না। আর সে সময়ে মেখলা এলে তো কথাই নেই, তাকে কাছে টেনে বলত আমাকে নিয়ে ছাদে চলে যেতে। আমরা চলে যেতাম। বাড়িওলার সঙ্গে কয়েক দান দাবা খেলতাম আমি। তারপর আবছা অন্ধকারে মেখলার সঙ্গে চা খেতে খেতে বাগানে দাঁড়িয়ে গল্প করতাম। আমার একঘেয়ে থমকে থাকা জীবনে সন্ধ্যা নামলেই যেন একটা জোয়ার লেগে যেত। মেখলা ছাদে মোমবাতি জ্বালাত। বাতাসের ঝাপটায় রেলিঙের উপরের চওড়া সাদা মোম কখনো প্রায় নিবে যেতে যেতে ধপ করে জ্বলে উঠত। আলো-আঁধারির যাওয়া-আসায় মেখলার মুখ মনে হতো এই আছে এই নেই-- যেন অপার্থিব! 

এইসব আনন্দ আর বেদনায় দিন কাটাতে কাটাতে আমরা জেনির মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছিলাম। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে জেনি আমাকে চিনতে পারছিল না। আমি তার কাছে নিজের পরিচয় দিতে দিতে শেষে হতাশ হয়ে একদিন কেঁদেই ফেলেছিলাম। আমার কান্নাও তার মুখে কোনো পরিবর্তন আনেনি। শেষের দিকে জেনি কেন যেন আলো দেখলেই বিরক্ত হতো। ঘরের বাতি নিবিয়ে রাখতে বলত। জেনি মারা যাওয়ার কিছু আগে অন্ধকারে মেখলা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বসার ঘর থেকে সামান্য কিছু আলো এসে পিঠের দিকে পড়ায় মেখলাকে ছায়ামূর্তির মতো মনে হচ্ছিল। জেনি মুখ না ঘুরিয়েই বলেছিল, ‘কে, কে ওখানে?’ পরপরই জেনির মুখ নরম হয়ে গিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল সে যেন অন্ধকারে দেখতে পায় আর যা তখনো হয়নি তা-ও দেখতে পায়। মেখলা বিছানার পাশে এলে আমাকে কাছে টেনে ফিসফিস করে জেনি বলেছিল, ‘ভালো হবে।’ জেনি মারা যাবার পর থেকে তার ওই শেষ কথা দুটো আমার কানে প্রতিধ্বনির মতো থেকে থেকে বাজত। যখন তখন মনে হতো শুনতে পাচ্ছি, কে ওখানে? কে ওখানে?... ভালো হবে ভালো হবে ভালো হবে। 

শেষে যা হলো, বহুদিনের প্রস্তুতিও আমাকে শান্ত রাখতে পারল না। জেনির মৃত্যুর দিন থেকে অনেকটা এলোমেলো হয়ে গেলাম। মেখলা তখন বলতে গেলে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নিল। বাজার আর রান্নার ফর্দ থেকে শুরু করে আমাকে পাশে বসে প্লেটে খাবার তুলে দেয়া পর্যন্ত সবই করে গেল। মেখলার উপস্থিতিতে জীবন অনেক সহজ হয়ে এল। আমাকে সান্ত¦না দেয়ার কিংবা আমার মনটা ভালো রাখার এতটুকু সুযোগ সে হেলায় হারাত না। আর তখন কেবল ছাদে নয়, পাঁচতলায় মেখলার দিকটার ছিমছাম রাজস্থানী আসবাবে সাজানো প্রাচীন গন্ধওলা ঘরগুলোতে সন্ধ্যার পরে অনেকটা সময় কাটত আমাদের। কারুকাজ করা তামার মোমদানিতে জ্বলত গোটাদশেক মোম, আরেকদিকে কাঠের রঙের আগরবাতি উর্ধ্বমুখী ধোঁয়ার বক্ররেখায় চন্দনের গন্ধ ছড়াত। গল্পে গল্পে আমরা কখন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছিলাম, মনে নেই। হাসির তোড়ে একদিন মেখলা বলল, ‘অ্যাই, অনিকেত, তুমি তোমার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে এখানে উঠে আস, বুঝলে?’

কথা শুনে আমার হাসি থেমে গিয়েছিল। মেখলার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে ভেবেছিল বউ হিসেবে তাকে আমার পছন্দ নয়। জানতে পেরে অফিসের কলিগরা তখন নাক গলিয়েছিল বেশ। তারা ভেবে পাচ্ছিল না এর চেয়ে ভালো আমার আর কীসে হতে পারে! আগবাড়িয়ে বলেছিল নিতান্ত গাধা না হলে মেখলার মতো সুন্দরী, বাড়িওলা আর একাধারে ভালোমানুষ একটি মেয়েকে কেউ অবজ্ঞা করে না। তবে তখন কাউকে বলিনি, আমি ভাবছিলাম চাচার বলে যাওয়া কথাটা-- প্রথমে মা, তারপর জেনি... মেখলাকে আমি ওই একই অবস্থায় দেখতে চাই না। অথচ কিছুতেই আমার গোপন মন মেখলাকে সেই কথাটা বলতে দিল না। তাই আমি অতীতটা যতœ করে লুকিয়ে রাখলাম। বন্ধুদের কথায় হোক বা মেখলার লোভেই হোক, সায় থাকা উচিত না বুঝেও বিয়ের ব্যাপারে আমার আগ্রহ বাড়ল। সত্যি কথা বলতে কী, মেখলাকে হারানোর সামান্যতম চেষ্টা করাও তখন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

বিয়ের পরে ভাড়ার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিয়ে আমি পাঁচতলায় মেখলার দিকটাতে এসে উঠলাম-- মেখলা এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবেইনি। আমাদের বিয়েতে তার বাবারও কোনো আপত্তি ছিল না। সবকিছু ভালোই চলছিল বছরদুয়েক। মেখলার জীবনে আমি পুরোপুরি মিশে গিয়েছিলাম। জেনি আর জেনির অসুস্থতার স্মৃতি মনে পড়ত না বললেই চলে। কিন্তু আমাদের বিয়ের তৃতীয় বছরে মেখলা একদিন মেঝেতে পড়ে গেছে শুনে আমি তাকে ডাক্তারের কাছে নিলাম। তারপর আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে অতীতের পুনারাবৃত্তি চলতে লাগল। তখন আমার সব জানা-- প্রতিটি দিন, প্রতিটি ধাপ। ডাক্তারকে তখন বেশি প্রশ্ন করার দরকার পড়ত না; মেখলাও কেন যেন করত না। কথা বলতে পারত, তবু এত চুপচাপ থাকত যে মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হতো মেখলার কথা কি আগেভাগেই বন্ধ হয়ে গেল? জেনি বিছানায় পড়ে যাওয়ার পরে আমার প্রথম বিয়ের আবেগ আর উত্তেজনাপূর্ণ জীবনের সমাপ্তি হয়েছিল। মেখলাকে বিছানায় অসার হয়ে পড়ে থাকতে দেখে মনে হলো মনভোলানো কোনো সঙ্গীত বাজতে বাজতে হুট করে থেমে গেছে, যখন কিনা তার বাজাটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে ফিরে সেই একইভাবে বিছানার পাশে মেখলার মাথায় হাত রেখে বসে থাকতাম, যেমনটা থাকতাম জেনির পাশে। তবে আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল আমাদের জীবনে। সেখানে শব্দের বা আবেগের তরঙ্গ তোলার জন্য আগের সেই প্রজাপতি মেখলার মতো কেউ এসে ঢুকে পড়েনি। 

মেখলার বাবা মাঝেমধ্যে এসে বোকাবোকা চোখমুখ করে বিছানার পাশে বসে থাকতেন। কিছুই বলতেন না-- না আমাকে না মেখলাকে। তারপর একদিন হঠাৎ আমাকে ছাদে ডাকলেন। বললেন, ‘আমার তো আর তেমন কেউ নেই, ওই এক মেখলা। তার ইচ্ছা তোমার সঙ্গে যত জায়গায় ভালো সময় কাটিয়েছে, সব যেন তোমাকে দিয়ে দিই। তো, সেই হিসেবে এই বাড়ি তোমারই হলো।’ আমার ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি, আমার নাম অনিকেত-- গৃহহীন থাকার কথা আমার। মেখলা, তুমি নিজে না থেকে কেন আমাকে গৃহ দিতে চাও? তবে কিছু বললাম না। পায়ের নীচে সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেখলা আমাকে আজীবনের সুখ নাকি আজীবনের কারাগার দিয়ে যাচ্ছে-- ভাবতে ভাবতে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগল। মেখলা ছাড়া এই ছাদবাগান, ওই রাজস্থানী আসবাবের ঘর-বারান্দা, সমস্তকিছু আমাকে যে কেবল বিদ্রুপ করতে থাকবে, তা আমি নিশ্চিত জানি। ভাবলাম সব থাকবে কিন্তু মেখলা থাকবে না, এই হাহাকারের মধ্যে জীবন কাটাব এটাই হয়ত আমার শাস্তি। 

বড়ো বড়ো ডাক্তারদের বোর্ড বসানো হলো, বারকয়েক বিদেশেও বড়ো নিউরোলজিস্ট দেখিয়ে আনা হলো, কিন্তু মেখলার শেষ ঠিকানা হলো হুইল চেয়ার; জেনির সেই চেয়ারটাই। জেনির স্মৃতি হিসেবে ওটা তখন ফেলতে ইচ্ছে করেনি। তারপর একসময় চেয়ারটার অস্তিত্ব ভুলেও গিয়েছিলাম। তাই অবহেলায় স্টোররুমে ধুলোর স্তরের নীচে নিঃশব্দে পড়ে ছিল। একদিন ঝেড়ে মুছে বের করে আনলাম। মেখলাকে ওটাতে বসানোর পর মনে হলো চোখ বন্ধ করে থাকি। বিধাতাকে মনে মনে বললাম, আমাকে অন্ধ করে দাও। তবে তেমন কিছুই ঘটল না। সব দেখতে হলো আমাকে-- ধীরে ধীরে মেখলার স্থবির হয়ে যাওয়া, জেনির মতো করেই একদিন মেখলার শেষ শ্বাস নেয়া, সব। আমার কোলের উপরে মেখলার শরীরের শেষ স্পন্দনটি অনুভব করার পরে মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে সবাই চলে যাবে, কেবল আমিই থাকব, কেবল আমি। সবার সমস্ত স্মৃতির ভার কেবল আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে, শুধু আমাকেই।



‘অ্যাই, অনিকেত, কিছু বলছ না যে? কী, এরকম স্মৃতির মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে জীবন কাটালে চলবে?’

কলিগদের নিয়ে মেখলার সাজানো বারান্দাতেই বসে আছি। একজনের প্রশ্নের ধাক্কায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। বারান্দার এককোণে জয়পুর থেকে আনা মেখলার তামার মোমদানিতে মোম জ্বলছে। এই বাড়িতে আমি থাকি ঠিক মেখলার মতো করে। সে যেন সবখানে আছে সেটা টের পেতে আমি ঠিক তার পছন্দমতো পরিবেশ সাজিয়ে রাখি। সেই পরিচিত মোমের আলোয়, সেই চেনা চন্দনের গন্ধে অচেনা কারো আগমনের কল্পনাও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। তাই কলিগের কথার উত্তর দিলাম না। থেমে থেমে ওয়াইনের গ্লাস মুখে ঠেকাতে থাকলাম। হঠাৎ দেখি মেখলার বাবা এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন। ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি বন্ধুদের বসতে বলে ভিতরে গেলাম।

‘কদিন আগে তোমাকে বলেছিলাম মেখলার চাচাত বোন আসবে, মনে আছে?’

‘জি,’ বললাম বটে তবে আসলে আমার খেয়াল ছিল না। মেখলার চাচাত বোন আসবে, মেখলাকে নিয়ে কষ্টে ডুবে থাকা তখনকার সময়ে এটা আমার কাছে বিশেষ কোনো ব্যাপার মনে হয়নি।

‘ছাদে চল একটু। ও এসেছে। আর হ্যাঁ, আমি চাই তুমি ওকে বিয়ে কর। আমার সম্পত্তিটা আমার পরিবারেই থাকুক। এটা আমার ইচ্ছা।’

‘কিন্তু, বাবা, আপনি তো জানেন, প্রথমে জেনি তারপর মেখলা...’, চমকে উঠলাম আমি। 

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি সামান্য হাসলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আশ্চর্য, তুমি কুসংস্কারে বিশ্বাস কর নাকি! আমি কিন্তু করি না’, বলে আবারো খামোখা হাসতে লাগলেন। আমার দিকে তিনি আর তাকালেন না। আমার কেন যেন মনে হলো না যা বলছেন তা উনি সত্যিই বিশ্বাস করে বলছেন। ঠিক বুঝলাম না এমনটা উনি কেন চাচ্ছেন। পুরো বিষয়টাই একটা ধাঁধার মতো মনে হলো। প্রায় অন্ধকার ছাদে চুপচাপ পৌঁছে গেলাম ওনার পিছনে পিছনে। রেলিঙের উপরে বসানো মোমের আলোর কাছে মেয়েটি বসে ছিল। নিজের কোলের দিকে তার দৃষ্টি স্থির। মোমের কাঁপা কাঁপা আলোয় এক ঝলকেই মেখলার মুখের আদল পরিষ্কার ধরা গেল তার মুখে। আমার পা থমকে গেল সিঁড়িঘরের দরজায়। নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, এ মেখলা নয়। আত্মীয়দের মধ্যে চেহারার মিল থাকা অস্বাভাবিক কী! মেখলার বাবা পিছনে ফিরে তাগাদা দিলেন, ‘কই, এসো!’

মেয়েটির পাশের চেয়ারে বসতেই মেখলার বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘এই যে, এ হলো মিঠি। আমার চাচাত ভাইয়ের মেয়ে, বহুদিন পরে এ বাড়িতে এল।’

মেয়েটির নাম তার শাব্দিক অর্থের চেয়েও কেন যেন মিষ্টি শোনাল। তবু মেখলার স্মৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ আমাকে তার দিকে তাকাতে দিচ্ছিল না। পরে ধীরে ধীরে তাকালাম। মনে হলো সেই একই প্রজাপতি। তার দিকে তাকিয়ে তাকে মেখলা মনে হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মুহূর্তেই আমি মেখলাকে দেখা প্রতিটি ধাপে তাকে দেখে নিলাম। আমার কিছু খারাপ লাগল না। মনে একটা চিন্তা ক্ষীণ উঁকি দিল-- আমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটা কি মেখলার বাবাকে বলব? এই নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধার মধ্যে কাটল। আমাদের আলাপের মাঝখানে হুট করে ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। রেলিং থেকে একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে বন্ধুদের কাছে ফেরার অজুহাতে উঠলাম সেখান থেকে। ধীর পায়ে মোমের শিখা বাঁচিয়ে সিঁড়ি ধরে নামলাম। পাঁচতলার লবিতে এসে দাঁড়াতেই দেয়ালে টাঙানো মেখলার প্রিয় রাজস্থানী আয়নায় কোমর পর্যন্ত দেখা গেল আমাকে। আগুনের শিখার প্রতিফলন তেলরঙে মিনা করা ফ্রেমের রঙচঙে নকশায় ঠিকরে পড়েছে। হাজার শিখা। আয়নার চারদিকে যেন আগুন লেগে গেছে-- সবুজ-নীল-লাল-হলুদ আগুন। বুকের কাছে ধরে রাখা মোমবাতির আলো আমার গলা, থুঁতনি আর নাকের ডগায় সরাসরি লাগছে। চোখ আর কপালে আবছা ছায়া। সেই অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় নিজেকে দুর্বোধ্য মনে হলো। নিজের সামনে নিজেকে অচেনা লাগল। আমার ভিতরে আরেক আমিকে দেখতে পেলাম-- লোভী আর স্বার্থপর। দেখলাম, অদ্ভুত এক মিটিমিটি হাসি আমার ঠোঁটকে বিস্তৃত করে দিচ্ছে যা চাইলেও থামাতে পারছি না। আরো ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আমার চোখ আমারই সামনে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়ে উঠছে-- হয়ে উঠছে ক্রূর থেকে ক্রূরতর... আয়না থেকে চোখ সরিয়ে ফেলতেই বাতাসের ঝাপটা এসে মোমের শিখা দিল নিবিয়ে। 

বারান্দায় ফিরে দেখি মেখলার তামার মোমদানির মোমবাতিগুলো নিবে গেছে। চারদিক পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে চাঁদের আলো ছড়িয়ে বারান্দাটা রহস্যময় করে তুলেছে। কলিগরা একইভাবে গল্প করে চলেছে। আমি তাদের মাঝখানে এসে বসলাম। আবছা আলোয় প্রয়োজন ছিল না, তবুও মিটিমিটি হাসিটা গোপন করে বললাম, ‘নাহ্, এবারে ভাবছি বিয়েটা করেই ফেলব।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ